ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
266

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–29

বাস ঢাকায় যখন ঢুকলো, তখন দুইটার বেশি বাজে। তারা কয়েক দফা বাস থামিয়ে হোটেলে নেমেছিল এজন্য সময় বেশি লাগে। সমুদ্র আগে থেকেই পিউকে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে। মেয়েটা রাত জেগে ফেসবুক চালায়, জেগেই থাকে অনেক রাত অব্দি। অযথা আব্বু-আম্মুকে পেরেশানি দেওয়ার দরকার নেই। বাস যেখানে থামিয়েছে তার ড্রাইভারও সেখানেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো৷

ঢুলতে থাকা আয়নাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে সে। গাড়িতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায় আয়না। বাসে নীলার কাছে চেয়ে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দিয়েছে। গাড়ি বাসায় থামতেই ও আয়নাকে কোলে তুলে নেয়৷ শুধু শুধু ঘুম থেকে তুলার দরকার নেই। বাসার সদর দরজা খুলে পিউ দাঁড়িয়েই ছিলো। নিজের বড় ভাইকে এভাবে ভাবীকে কোলে তুলে নিয়ে আসতে দেখে তার মুখ হা হয়ে যায়। সে চোখ বড় করে তাকায়। একবার ভাবলো ভুল দেখছে। রাতের বেলা ভাইয়ার রুপ ধারণ করে কোনো ভূত চলে এলো নাতো?

সমুদ্র ছোট বোনের সামনে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে একটু নাজুক হয় তবে দ্রুত সামলে উঠে বলে, ” এমন তাকায় আছোস কেন? প্রথম দেখছিস আমাকে?”

পিউ বলে উঠে, ” তোমায় প্রথম দেখছি না কিন্তু এমন ভাবীকে কোলে নিয়ে নায়কের মতো আসতে প্রথম দেখলাম।”

-” মুখ বন্ধ কর, নাহলে মশা ঢুকে যাবে মুখে।”

পিউ মুখ বন্ধ করলেও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে জিজ্ঞেস করলো, ” তোমাদের ট্যুর কেমন কাটলো?”

সমুদ্র লাজুক হেসে বলে, ” ওটা আসলে এক প্রকার হানিমুনই ছিলো, বুঝলি? মাত্র একরাতের জন্য যাওয়া বোকামি হলো। আগামী হানিমুনে পাক্কা একমাসের লং প্যাকেজে যাবো।”

পিউয়ের মুখ ফের হয়ে যায়। এটা আসলেই তার ভাই?নাকি শ্রীমঙ্গলে ভাই এক্সচেঞ্জ হয়ে গেছে।

সমুদ্র ওর বোনের মাথায় চাটি মেরে বলে, ” ওর জ্বর। ঘুমাচ্ছে জন্য আর ঘুম থেকে তুলিনি।”

সমুদ্র আয়নাকে নিজের রুমে নিয়ে আসে। এই প্রথম আয়না তার বাসায়, তার রুমে! সে পুলকিত হলো। বড় সাইজের বেডটায় ঘুমন্ত আয়নাকে শু’ইয়ে কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে দেয়। এরপর দু’দণ্ড সে নিজেই বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার বিছানা এই প্রথম কোনো নারীর ছোঁ’য়া পেলো। বিয়ের আগে আগে মা আর ইভানা আন্টি মিলে এ’রুমের ফার্নিচার চেঞ্জ করেছে
আগের বেড এতো বড় ছিলো না। বিয়ের আগে ইভানা আন্টির বুদ্ধিতে বড় বেড কেনা হয়েছে যেন বউ-বাচ্চা সহ এক বিছানায় শু’তে পারে সে! এর আগে তার রুমটায় এতো শোভা বর্ধিত হয়নি। আজকে যেন তার রুমে কোনো সদ্য ফো’টা পদ্ম ফুল এনে সাজানো হয়েছে, আয়নার উপস্থিতি ঠিক তেমনি করে রুমটার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে দিলো যেন।

সেও নিজেও আয়নার পাশ ঘেঁষে শু’য়ে ঘুমিয়ে পরে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়না নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একরুমে আবিষ্কার করে। সামনের দেয়ালে চোখ যেতেই দেখে তার স্বামীর তিনটা বাঁধাই করে ফটোফ্রেম ঝুলানো। একটা সমুদ্রের পাড়ে নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়ায় মেডিকেলে পড়া অবস্থায় তো’লা ছবি। পাশে আরেকটা নটোরড্রামের ইউনিফর্ম পরা অবস্থার ছবি। ওনাকে ইউনিফর্মে দেখে আয়নার মনের মধ্যে ভালোলাগার বাতাস বইতে লাগে। অন্য ছবিটা ওর ছোটবেলার মনে হয় স্কুলের প্রথম দিনের।পাঁচ-ছয় বছর বয়সী ছবি। পানির লাল বোতলটা গলায় নিয়ে ওর হাসি-হাসি চেহারা। এত্তো কিউট ছিলো উনি? দ্রুত ফোন বের করে নিয়ে ক্যামেরাবন্দী করে ফেলে ও। ইশ এত্তো কিউট যে এখনি গাল টিপে দিতে মন চাচ্ছে।

ও ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়। ডাইনিং রুমে মিসেস রোদেলা আর পিউয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। পিউ বসে নাস্তা খাচ্ছিলো। মিসেস রোদেলা আয়নাকে দেখামাত্র এগিয়ে বসে জড়িয়ে ধরে বলে, ” গুড মর্নিং, আম্মুজান!”

আয়না হেসে বলে, ” কেমন আছো, মামনি?”

–” এইতো ভালো। তোমার জন্য নাস্তা রেডি করে অপেক্ষায় আছি। আসো, খেতে আসো।”

আয়না একবার সমুদ্রের রুমের দিকে তাকায়, উনি বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে৷

মিসেস রোদেলা বলে, ” সমুদ্র ঘুমাক। তুমি খেয়ে নাও। জার্নি করে এসেছো ”

আয়না পিউয়ের সঙ্গে খেতে বসে। মিসেস রোদেলা রান্নাঘরে গেলে পিউ বলে উঠে, ” ভাবীমনি, হানিমুন কেমন কাটলো তোমার ? ভাইয়া বলেছে খুব নাকি জোশ ছিলো তোমাদের হানিমুন।”

আয়না চোখ গোল গোল করে বলে, ” তোমার ভাই এসব বলেছে?”

–” ইয়েস, ভাই আবার নাকি যাবে, নেক্সটে গেলে নাকি টানা একমাসের জন্য যাবে।”

আয়নার লজ্জায় মাথা কাটা যাওয়ার মতো অবস্থা। এ কেমন আজব লোক। নিজের ছোট বোনকে কেউ এসবও বলে?

মিসেস রোদেলা এসে ওদের সঙ্গে বসে বলে, ” আজ সকাল থেকে দু’টো ভালো ঘটনা ঘটলো।”

আয়না প্রশ্ন করে, ” কি মামনি?”

–” প্রথম তো তোমার শ্বশুড় আব্বু আজকে অনেকদিন পর অফিস গেলো। আর দ্বিতীয় হলো আমার বউমা আজ আমার বাসায় এসেছে।”

আয়নার কথাগুলো বেশ ভালো লাগলো। শ্বাশুড়িমা বেশ ভালো বটে।

মিসেস রোদেলা বলে, ” তুমি আসবে কবে মা?তোমার জন্য আমরা দিন গুনছি। আমি আর পিউ কতো এক্সাইটেড জানো?”

পিউ আগ্রহ নিয়ে বলে, ” জানো ভাবী কি হইছে, ভাইয়ার রুমে আগে কোনো ড্রেসিং টেবিল ছিল না। ভাইয়ার পছন্দ না ড্রেসিং টেবিল। বিয়ের আগেও সে কোনোদিন কিনতে দেয়নি ড্রেসিং টেবিল।বিয়ের পর তোমার জন্য ভাইয়া আমাকে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিল কিনে এনেছে। তুমি সাজুগুজু করবা সেজন্য।”

মিসেস রোদেলা কোথা থেকে একটা সোনার চেইন এনে ওর গলায় পড়িয়ে দিলেন। এরপর কপালে চু–মু খেয়ে বলেন, ” তুমি প্রথম এলে এ’বাসায়। আমি খুব খুশি৷ এবার পার্মানেন্টলি আসার অপেক্ষার পালা। ”

ওইসময় সমুদ্রর ফুপি ইভানা শিকদার ভাইয়ের বাসায় এলেন। শ্রাবণকে ভার্সিটি ড্রপ করে গাড়ি নিয়ে ভাইয়ের বাসায় আসলেন। ওরা সবাই গল্প-গুজব শুরু করে৷ রোদেলা কোথা থেকে সমুদ্রের পুরাতন এলবাম এনে দেখাতে লাগে। আয়নাও আগ্রহ নিয়ে ওনার ছোট কালের ছবি দেখে। জন্মের প্রথম দিনেই মা রোদেলার সঙ্গে ছোট্ট সমুদ্রের একখানা ভারী বিমুগ্ধকর ছবি রয়েছে। আয়না বেশ খানিক সময় নিয়ে ছবিটা দেখে। এরপর ওনার তিন-চার মাস বয়সী একটা ছবি। ওনার দাদীর সাথে। কিন্তু ওই ছবিতে সমুদ্র একদম বিনা কাপড়ে। আয়নার এতো হাসি পায়। ও দ্রুত ছবিটার ছবি নিজের ফোনে তুলে নেয়৷ ওর মনে একটা প্রশ্ন জাগে, সমুদ্রের চোখের মনি নীল কেন? ওদের পরিবারের কেউ কী ভিন্নদেশী ছিলো?

ইভানা আন্টি পিউয়ের প্রথম জন্মদিনের ছবি দেখাচ্ছিলো। ছোট্ট পিউ বড়ভাইয়ের কোলে বসে কান্না করছে৷ আর ওর বড় ভাই ওর হয়ে কেক কাটছে।

আয়না একবার ভাবলো জিজ্ঞেস করবে, পরবর্তীতে ভাবে উচিত হবে কি? তবুও বলেই ফেলে,” মামনি, ওনার চোখের মণি নীল কেন?”

ইভানা ভ্রু কুচকে বলে, ” এই ‘উনি’ টা আবার কে?”

আয়নার ওইসময় প্রচুর লজ্জা লাগে। কি বললে ভেবে পায় না৷ অর্ধ পরিচিত শ্বশুড়বাড়ির মানুষজনের সঙ্গে এই প্রথম সে গল্প করছে৷ নার্ভাস ও লাগছে বেশ৷

মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” সমুদ্রের আব্বুর দাদা ব্রিটিশ আমলে এক ব্রিটিশ মহিলাকে বিয়ে করেছিলো। ওই সুন্দরী মহিলার চোখ নীল ছিলো। কিন্তু মহিলার ছেলে-মেয়েদের আবার নীল চোখ হয়নি। এমনকি তোমার শ্বশুড় আব্বুর প্রজন্মেও কারো নীল মনি নাই। শুধু আমার সমুদ্রের নীল চোখের মণি হলো। তিন প্রজন্ম পর!”

ইভানা আন্টি বলে উঠে, ” এবার দেখার পালা পরের প্রজন্মে কী ঘটে? সমুদ্রের ছানা-পোনাদের চোখের মণির রঙ কী হয় এইবার সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি।”

রোদেলা আর ইভানা হাসলেন খুব৷ আয়না উঠে সমুদ্রের রুমের পা বাড়ায়। উনি এখনো ঘুমে। দু’রাত ঠিকমতো ঘুমায়নি বিধায় এখন বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে। আয়না আস্তে করে ওনার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘুমন্ত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, ” ভালোবাসি, মিষ্টার অশেন৷”

সমুদ্রের ঘুমের একচুলও ডিস্টার্ব হয় না। আয়না ওর কপালে একটা চু–মু দিয়ে বলে, ” আসি তাহলে। ”

আয়নাকে ওদের বাসায় থাকার জন্য রোদেলা ইভানা অনেক বলছিলো কিন্তু আয়না থাকেনি। ফিরে যায় ওর বাসার পথে। ওদের বাসার ড্রাইভার নামিয়ে দিতে যায়।

___________________

সমুদ্রের ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন অলমোস্ট দুপুর। দুপুর একটা বাজে। সে তড়িঘড়ি করে উঠে আয়নাকে খুঁজতে থাকে। বেড থেকে উঠতেই ড্রেসিং টেবিলের আয়নার উপর একটা স্টিকি নোট আটকে রাখা। সে উৎসুক হয়ে নোটটা খুলে নেয়। নোটে লেখা ছিলো, ” আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় খুব কিউট লাগে তো, মিস্টার অশেন।”

জীবনে প্রথম এমন কমপ্লিমেন্ট পেলো সমুদ্র। এতোকাল যাবত তাকেই প্রশংসা করতে হতো। আজ নিজে এমন সুন্দর প্রশংসা পায়। কিন্তু আয়না কোথায়? সে ফোন হাতে নেয়। আয়নার ম্যাসেঞ্জার থেকে একটা ছবি পাঠানো হয়েছে। সে ছবিটা দেখা মাত্র চোখ কপালে উঠে যায়। তার ছোট্টবেলার একটা বিনা- জামাকাপড় পরা ছবি। এই ছবি ও কোথায় পেলো? হায় খোদা,ওর সব সম্মান ধুলায় মিশে গেলো। আবার টেক্সট ও দিয়েছে, আপনাকে খুব কিউট লাগছে। কিউট বাবু!

সে দ্রুত কল লাগায়। আয়না রিসিভ করে বলে, ” আপনি ছোট্টবেলা থেকেই কিউট।”

–” তোমারি ভাগ্য! আমাকে ছোট-বড় সব অবস্থায় বিনা কাপড়ে দেখলে। ইউ ভেরি লাকি।”

–” মুখ সামলে কথা বলুন।”

–” কই তুমি?”

–” বাসায় যাচ্ছি।”

মুহুর্তের মধ্যে সমুদ্রের হাসি মুখ ফোটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। ঘর ও মনময় একটা শূন্যতা কাজ করে। এ কেমন আজব শূন্যতা? ওর যাওয়ার দরকার কী ছিলো? বিয়ের পর থেকে এটাই তো ওর বাসা৷ সমুদ্রের মনের ভেতরে কেমন কু-ডাকে৷ মা একবার এসে ওকে খাওয়ার জন্য ডাকে। তার খাওয়ার রুচি থাকে না। কিচ্ছু খায় না সে। রুমে ফিরে আসে। একটু পর রুম থেকে বের হয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে কথা বলে। তখন ডাইনিংরুমে ইভানা আন্টিও ছিলো বসে।

সমুদ্র সবার সামনেই বিনা সংকোচে বলে, ” আম্মু, আমি আমার বউকে চাই।”

মিসেস রোদেলা আর ইভানা দু’জনেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন৷ কারো মুখেই কোনো রা নেই।

সমুদ্র-ই বলে উঠে, ” বিয়ে করে আলাদা থাকবো এজন্য নিশ্চয়ই বিয়ে করিনি। এখন আমি আমার বউকে চাই। আলাদা থাকবো না।”

মিসেস রোদেলা বলে, ” তুমি ই তো বলেছো আগে আকদ হবে। বউমা নিজের বাসায়ই থাকবে। তোমার দেওয়া শর্ত মোতাবেক সব হচ্ছে।”

সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে বলে, ” আমি এতোসব জানি না। তোমরা তোমাদের স্বামীর সঙ্গে আছো না? তাহলে আমার বউ কেনো স্বামী ছাড়া থাকবে। আম্মু, সাতদিনের মধ্যে আমি আমার বউকে এ’বাসায় চাই। ব্যাস, বাকিসব কিছু জানি না। এতোদিন বিয়ে-শাদি, সংসার নিয়ে বয়ান দিলে, এখন নিজে সংসার চাচ্ছি এখন কেন ব্যবস্থা নিবে না?”

ছেলের চিৎকার-চেচামেচিতে অতিষ্ঠ হয়ে রোদেলা বলে, ” কেমন অসভ্য ছেলে! মায়ের সামনে এসব কেউ মুখে আনে?”

–“ভুল কী বললাম? বিয়ে করেছি বউয়ের সঙ্গে থাকব। তুমি সাতদিনের মধ্যে আয়োজন কর বউ ঘরে তোলার।”

–” ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলবো।”

তখন ইভানা আন্টি বলে, ” তারচেয়ে বরং শায়লার সঙ্গে কথা বলো, ভাবী। ওর সাথে কথা বললেই কাজ হবে, আমার মনে হয় ওই বাসার সব নিয়ন্ত্রণ শায়লা নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে।’

সমুদ্র না খেয়েই চলে যায়। ছেলেকে পিছু ডেকে বলে, ” খেয়ে নে এট লিস্ট।”

–” বউ আসুক, তারপর খাবো।”

–” এরমধ্যে আর খাবি না?”

–” কিছুটা এমনই!”

–” সাতদিনের মধ্যে কীভাবে সম্ভব? তাছাড়া আয়নার সেমিস্টার ফাইনাল, পড়াশোনা ও আছে।”

–” আমি কী বাচ্চা নাকি যে ও পড়তে বসলে কান্না করব, মু–তে দিবো, বইখাতা ছিঁড়বো? এ’বাসায় এসে পড়ে ফাইনাল’স দিবে ও।”

মিসেস রোদেলা অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে সমুদ্রকে৷ কিন্তু ছেলে তার বেকে বসেছে। সাতদিনের মধ্যেই কোনো অনুষ্ঠান-প্রোগ্রাম ছাড়াই নর্মালভাবে আয়নাকে এ বাসায় আনবে। ছেলের জেদের সঙ্গে পারেন না সে এবার। এমন জেদের কারণ কী তাও বুঝে পান না। অবশ্য ইভানা বলে উঠে, ” ভাবী, আমাদের পরিবারের ছেলেগুলো একটু স্বভাবতই বউ পাগল। তোমার ছেলে একটু বেশিই বউয়ের জন্য কাতর। একসঙ্গে থেকেছে এখন দূরে থাকবে ভেবেই বিরহে কাতর হচ্ছে৷ ”

_________________________

আয়না যখন বাড়ি পৌঁছে তখন দরজা শায়লাই খোলে৷ তা দেখে বিষ্মিত ও ক্ষুব্ধ হয় আয়না। সে আন্দাজ করে শায়লা চৌধুরী নিশ্চয়ই এ’বাসায় থাকছেন। তার আন্দাজই সঠিক হলো। শায়লা চৌধুরী নিজে থেকে বলতে লাগে, ” আমার ও’বাসায় একা একা ভালো লাগে না। মেয়ে দুটোকে নিয়ে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি নিয়ে থাকতে চাই, পরিবারের জন্য মন খারাপ হয়৷”

আয়না রাগী গলায় বলে, ” ওসব কিছু না। আপনি বাবার সঙ্গে থাকতে চান এটাই আসল। আমাদের মোটেও পছন্দ করেন না আপনি।”

ঝগড়ার সূত্রপাত এখান থেকেই। অবশ্য শায়লা চৌধুরী ঠাণ্ডা মাথায় সব সামলাতে চান। দাদী এসেও আয়নাকে চুপ থাকতে বলে। কিন্তু শেষে আয়না একদম ঝগড়ার শেষ মুহুর্তে বলে, ” আই হেইট ইউ শায়লা চৌধুরী। আপনি আমার বাবাকে আমার থেকে আলাদা করে ফেলেছেন। কোনোদিন ক্ষমা করবো না আপনাকে।”

শায়লা চৌধুরী এসব কটাক্ষের তোপে এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন। ওনি শুধু বলেন, ” আমি সারাটা জীবন একাই কাটালাম। পরিবার হীন। আমি কী সুখে থাকার আশা রাখতে পারি না?”

আলিয়া অবশ্য চুপই থাকে। আপার সঙ্গে তাল মেলায় না আজ। তবে আয়না ওনার ইমোশনাল কথায় গলে না। বাবা না থাকায় ও আরোও শক্ত অবস্থান নিয়ে বলে, ” আপনি এ’বাসায় থাকবেন না। চলে যান প্লিজ। এটা আমার বাসা।”

–” এটা তোমার আব্বুর বাসা। তুমি যেমন ওনার মেয়ে, আমিও তার স্ত্রী, আয়ু। আগে ছোট ছিলে, ছেলেমানুষী মানাতো। কিন্তু এখন এতো ম্যাচুরিটি আসার পরও এসব বিহেভিয়ার মানায় না৷”

আয়না নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। শায়লা চৌধুরী নিজের জন্য এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় বসে৷ তখনই তার ফোনে রোদেলার ফোন আসে। সে রিসিভ করতেই রোদেলা অনুরোধের সুরে আয়নাকে ওদের ঘরে তুলে নিতে চাইল। সমুদ্রের ব্যাকুলতার কথাও জানালো।

শায়লা প্রতিশ্রুতি দিলো খুব শীঘ্রই আয়না শ্বশুড়বাড়ি যাবে।

ফাহাদ সাহেব সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে শায়লা সব জানায়। এটাও জানায় আয়না চায় না সে এ’বাসায় থাকুক। দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলো সমুদ্রের ইচ্ছা অনুযায়ী আয়নাকে তুলে দিবে বড় অনুষ্ঠান করে। আয়নার কান অব্দিও এ’কথা যায়৷

সে শুধু বাবাকে একটা কথাই বলে, ” আমি এখন তোমাদের কাছে বিষের কাঁটা তাই না? ঠিক আছে চলে যাবো এ’বাসা থেকে।”

আয়না যে কথাগুলো কতোটা অভিমান নিয়ে বলে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারে না।

সেদিন রাত বারোটার পর সমুদ্র ওকে কল করে বলে, ” আয়না তুমি আসতে না চাইলে, আমি তোমাকে তুলে নিয়ে আসবো। বুঝছো?”

আয়না ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো, ” আপনি আচানক এতো ব্যস্ত হলেন কেনো?!

–” মনে কু ডাকছে।”

সমুদ্র ফোন রেখে অতীতের ভাবনায় ডুব দেয়। ইউশা যে ইহুদি এটা সে প্রথমে জানত না। ইউশা ছোট থেকে আমেরিকা থাকত মায়ের সঙ্গে। বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না ওর। ও জানত ওর বাবা ওকে একদম ভালোবাসে না। সেকেন্ড ম্যারেজ করেছে৷ ওর মা আরেকবার বিয়ে করে যেদিন, সেদিন ওকে সত্য বলা হয়, ওর বাবা আসলে মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত হন কোনো এক কারণে। অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন মারা গেলেন৷ ওর বাবার ইতিহাস শুনে সমুদ্র নিজে হতভম্ব হন।

ভদ্রলোক বাংলাদেশী। রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলো। নব্বই দশকে পিএইচডি করতে আমেরিকা যান৷ ওইসময় ইউশার মার সঙ্গে দেখা৷ ভদ্রলোক বিয়ে করেন ইউশার মাকে। ইউশা যখন হয় তখন নাকি ওর নাম ওর বাবাই ইউশা রাখে৷ কিন্তু ইউশার দু’বছর বয়সে উনি জানতে পারেন তার স্ত্রী তাকে প্রতারণা করছে। মানসিক ভাবে ভেঙে পরেন। একসময় পিএইচডি করতে আসা জ্ঞানী মানুষটা পাগল হয়ে যায়। বোনের কাছে অস্ট্রেলিয়ায় চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান৷ ইউশা এসব ওর মায়ের বিয়ের পর জানে। তারপর আঠারো বছর হলে বাবার স্মৃতি চারণ করে অস্ট্রেলিয়ায় মেডিকেলে পড়তে আসে। ওর সার্টিফিকেট নেম টুইংকেল হলেও মেডিকেলে ও ইউশা নামে নিজের পরিচয় দেয়৷

সমুদ্র যেদিন প্রথম ইউশা দেখে এক দেখায় প্রেমে পড়ে যায়। ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিলো ও। তাও বাঙ্গালী চেহারার। প্রথম দিকে ইউশা ওকে পাত্তা দিতো না৷ পরে যখন টানা কয়েকটা পরীক্ষায় সমুদ্র সবচেয়ে ভালো করে, সেদিন থেকে নিজে থেকে সমুদ্রের সঙ্গে কথা বলে পড়াশোনা বিষয়ে। এভাবে আগাতে থাকে। থার্ড ইয়ারের শুরুতে জানতে পারে ও ইহুদি। বাসায় জানাজানি হলে বাবা ঘোষণা দেয় এ মেয়ের থেকে দূরে সরে আসতে। কিন্তু সে পারেনা ইউশাকে ভুলতে। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক এক প্রকার শেষ করে ও ইউশার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আস্তে আস্তে ওর রেজাল্ট খারাপ হতো। আগের মতো ভালো রেজাল্ট আসত না৷ ইউশা-ই সবসময়ই প্রথম হত৷ এসব কখনোই আমলেই নেয়নি সমুদ্র।

ইন্টার্ণ করার সময় ওদের এক ইয়ং প্রোফেসারের সঙ্গে ইউশা সম্পর্কে জড়িয়ে চিট করে। সমুদ্র মানতে পারে না৷ সমুদ্র ভেঙে পড়ে একদম। ইউশার হাত-পাও ধরে৷ কিন্তু ততোদিনে ইউশা দূরে সরে গেছে৷ সমুদ্র একপ্রকার মেডিকেল যাওয়া ছেড়ে দেয়। ওই সময় শায়লা চৌধুরী অস্ট্রেলিয়া ভাইয়ের বাড়ি আসেন। সমুদ্রের এ অবস্থায় দেখে অবাক হন। রোদেলাকে জানান। রোদেলা সব শুনে সিদ্ধান্ত নেন অস্ট্রেলিয়া আসবে সমুদ্রের কাছে। তার আগেই সমুদ্র সু–সাইড এটেম্প করে৷ ওইদিন শায়লা আন্টি না থাকলে আজ নতুন জীবন পেতো না সমুদ্র। আন্টি ওইসময় ওর অনেক যত্ন নিয়েছে। একদম নিজের ছেলের মতো। সাইক্রিয়াটিস্টও দেখান। এরপর ওর মা আসার পর, সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে ইন্টার্ণ শেষ করে ও দেশে ফিরে। ইউশা ওকে খুব অদ্ভুত ভাবে দুর্বল করে রেখেছিলো। সমুদ্র ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না। সম্পূর্ণ আন্ডার কন্ট্রোলে ছিল সে।

নীলা তো এসব শুনে বলেছে, মা-মেয়ে জ্ঞানী মানুষদের ফাঁসিয়ে ইচ্ছা করে পাগল বানানোর পায়তারা করে।ওর বাবা-মাও একসাথে পিএইচডি করছিলো। ওর মা ঠিকই পরে ডক্টরেট ডিগ্রি পান কিন্তু ওর বাবা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পরে। ই৷ সরায়েলীরা নাকি নিজেদের চেয়ে জ্ঞানীদের সহ্য করতে পারেনা।

সমুদ্রের মনে ভীষণ কু ডাকে। আয়নার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে তো? তাদের মধ্যে কী বিচ্ছেদ আসবে কোনোদিন? মনের মধ্যে কুৎসিত এক কোকিল কু ডাকে৷ কোকিল খুব যত্ন করে কু ডাকছিলো যেন বেদনার ঋতু সন্নিকটে।

এজন্য চারদিনের মাথায় ঘরোয়া প্রোগ্রাম করে আয়নাকে নিজের বাসায় আনে। ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অফিসের মানুষ-জনও ছিলো। সমুদ্রের অফিসের পক্ষের মানুষজন আয়নাকে শায়লার সৎ মেয়ে হিসেবেই চিনে।

ওইদিন লাল বেনারসি পরে আয়না নিজের শ্বশুড়বাড়ি পা রাখে। সমুদ্র কোলে তুলে ওকে নিজের সাজানো ঘরে নিয়ে যায়।

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–30

সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষায় থাকে না। বড় নির্মম কিংবা প্রকৃতির এক আর্শীবাদ যেন এ’বিধি। সময় কীভাবে জানি অতিবাহিত হয়ে যায়। অস্থির ঘড়ির কাঁটার যেন মৃত্যুর আগ অব্দি বিশ্রাম নেওয়ার অনুমতি নেই। যতোক্ষণ শ্বাস আছে, ওটা সেকেন্ডের কাটা পেরিয়ে মিনিট পার করে ঘন্টায় গিয়ে ঠেকে। ঘন্টা থেকে দিন, দিন থেকে পার হয় মাস। চোখের পলকে কিংবা রয়ে-সয়েই তিন’টে মাস পার হয়ে গেলো। আয়নার জীবনে অবশ্য এখনো বসন্ত আসা বাকি। কেবল শরৎ চলছিলো। হিমেল ঠাণ্ডা বাতাস, কিন্তু কোথায় জানি একটা শুষ্কতার আভাস৷

সেদিন রবিবার ছিলো। আয়নার ক্লাস ক্যান্সেল হয়ে গেছে। ও আলসে ভঙ্গিতে বিছানায় শু’য়ে থাকে। উঠতে মন চাচ্ছিলো না তার৷ তবে সমুদ্রের তার মতো অলসতা নেই। ও ঠিকই সকালে উঠে বিশ মিনিট হেটে এখন ফ্লোরে ম্যাট বিছিয়ে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করছে। পুশ আপ দিচ্ছে আপাতত। হাত কাটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে ও। ওর উম্মুক পিঠ দর্শন হতেই চোখ সরিয়ে নেয় আয়না। পরবর্তীতে ফের তাকায় ওর পানে। ঘেমে গেছে একদম। নিশ্চয়ই এখন গোসলে যাবে৷ হলোও তাই শেষ পুশ-আপ দিয়ে উঠে দাড়ালো ও। সাইড টেবিল থেকে পানি পান করে আয়নার দিকে তাকায় এবং বলে, ” ওই, অলস মেয়ে, আর কতো ঘুমাবা?”

আয়না কম্বল আরোও ভালোমতোন জড়িয়ে মটকা মেরে শুয়ে থাকে এবং বলে,” শীতের দিনে সকাল দশটার আগে উঠা দণ্ডনীয় অপরাধ।”

সমুদ্র হাসলো এরপর ওর দিকে এগিয়ে আসে। আয়না ভাবে নিশ্চয়ই ঘুমাতে আসছে কিন্তু না ওনি তো আসলে বদ স্বভাবের। অন্যের আরাম সহ্য করতে পারে না। এগিয়ে এসেই আয়নার পায়ের দিক থেকে কম্বল তুলে নিয়ে একদম ডিভান বরাবর কম্বল ছু’ড়ে মারে। কম্বল গা থেকে সরতেই ঠাণ্ডায় একটু কেঁপে উঠে ও। সমুদ্র এরপর ফিচেল হেসে নিয়ে ওর ঠাণ্ডা হাতটা আয়নার গলায় রেখে উষ্ণতা অনুভব করে। তারপর খানিক বাদে বলে, ” তোমার শরীরের গরম উষ্ণতা তো আমায় পাগল করে দিচ্ছে৷ এক কাজ করি, আমিও দশটা পর্যন্ত ঘুমাই। আজ লেইটে অফিসে যাই।”

আয়না ইদানীং ওনার মতিগতি বুঝে ভালো। সে বলে উঠে, ” না, না, আপনার ঘুমাতে হবে না।আপনি বরং যান অফিসে।”

সমুদ্র বলে, ” সিউর?”

আয়না তড়িঘড়ি করে উঠে এক্সাইটেড হয়ে বলে, ” আজ বিকেলে কোথায় যাই?”

–” কোথায়?”

–” শপিংয়ে।”

–” না, জরুরি কাজ পেন্ডিং আছে।”

–” আপনার সবদিনই জরুরি কাজ থাকে?”

–” কিছুটা এমনই।”

–” শপিং যাওয়াও জরুরি।”

–” তোমার জন্য জরুরি বাট আমার জন্য নাহ।”

আয়না হতাশ হলো। একটা সিংগেল ডে’তেও সমুদ্র টাইম বের করে তাকে নিয়ে ঘুরতে যায় না৷ ওর নাকি সময় নেই। ব্যস্ত খুব। সমুদ্র গোসল সেড়ে কফি কালারের একটা শার্ট পরে ইন করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল আছড়ায় সময় নিয়ে। পারফিউম মাখে একগাদা। আয়না চোখ গোল গোল করে ঘুমু চোখে ওনার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সহজেই তা বুঝে যায় সে।

সে মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “সুন্দরী, আপনার দেখি হান্ডসাম ছেলে দেখলে একদম রসগোল্লার মতো খেতে মন চায়।”

আয়না আনমনে উত্তর দিলো, ” হুম।” এরপর ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে, ” আপনি এই শার্ট পরে অফিস যাচ্ছেন?”

সমুদ্র পরনের শার্টটা একবার পরখ করে নেয়, দেখে নেয় শার্টের কোনো অংশ ত্রুটিপূর্ণ কীনা!

সে বলে, ” এ শার্টে সমস্যা কোথায়?”

–” আমি এই শার্ট পুড়িয়ে দিবো।”

সে ভ্রু কুচকে তাকায় এবং বললো, ” রুপ দিয়ে আমাকে পুড়াচ্ছো এখন আবার আমার শার্ট কেও ছাড় দিবা না? শার্টে কি সমস্যা? চেঞ্জ করবো?”

আয়না গম্ভীরমুখে বলে, ” আপনাকে এই শার্টে একটু বেশি সুদর্শন লাগছে।”

সমুদ্র একগাল হাসি উপহার দেয়। সময় কম জন্য কথা সংক্ষিপ্ত করে বলে, ” দেখি কতোজন ললনা পটে আজ! যাচ্ছি। দশটায় উঠে নাস্তা খেয়ে নিও।”

আয়না মুখ ভার করে ওর পানে চেয়ে থাকে৷ কিন্তু ওর মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। ও ফাইল চেক করে ফোন জাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। একপ্রকার রুম ছেড়ে গেছে, দুদণ্ড বাদে ফের ভেতরে এসে পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে বলে, ” এবার একাই শপিংয়ে যাও। যা লাগে কিনে আনো। পরের বার দেখি টাইম ম্যানেজ করবো।”

আয়নার একটু হলেও ভালো লাগলো। সে বিবাহিত জীবন যেমন ভাবে কল্পনা করেছিলো, বাস্তবতা তার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ভিন্ন। সমুদ্র খুবই দায়িত্বশীল, যখন যা লাগে সব দেয়। তবে ওর মনে হয় কিসের যেন একটা কমতি আছে। তাদের সম্পর্কটা ঠিক যেন লবণ পরিমাণ মতো না হওয়া দেখতে সুস্বাদু তরকারির মতো! তবে, সমুদ্র তাকে দারুণ ক’টা সুন্দর স্মৃতি উপহার দিয়েছে৷ আজ সে শপিং যেতে চাইছিলো কারণ আগামীকাল তার জন্মদিন। বিয়ের পর প্রথম জন্মদিন তার। এজন্য টুকটাক কেনাকাটা করতে চায়৷ বিয়ের আগে জন্মদিনের আগেরদিন করে বাবা নিয়ে যেতো দোকানে নতুন জামা-জুতা, চুলের ফিতা সব কিনে দিতো। তারপর রাতে চাইনিজ খেয়ে বাড়ি আসতো। বার্থডের আগের দিন থেকেই উৎসব ভাব শুরু হতো। সকালে স্কুল থেকে ফিরে নতুন জামা পরে আনন্দ করত। বিকেলের দিকে বাবা কেক নিয়ে আসতো। আয়নার মন বিষিয়ে উঠে। আজ তিনমাস ধরে বাবার সঙ্গে সে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখছে না। বাবা ফোন করলেও ধরে না। এমনকি বাবার বাড়ি একবারও যায়নি সে। তবে আলিয়া আসে, দাদার সঙ্গে কথা হয়। তার ঘুম ছু’টে যায়।

সে বিষন্নতা গায়ে সুগন্ধির মতো মেখে বারান্দায় পা রাখে। বারান্দায় তার লাগানো নয়নতারা গাছটি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নার একটা স্মৃতি মনে পড়লো। কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। সে বারান্দার জন্য শাহবাগের একটা নার্সারি থেকে এই গাছ এনে লাগিয়েছে কিন্তু এতো যত্ন-আত্তি করার পরও গাছে ফুল ফুটে না। সে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি তো ডাক্তার মানুষ, দেখেন তো গাছটার কী রোগ হলো যে ফুল ফু’টে না।”

সমুদ্র গম্ভীরমুখে বলে, ” তুমি এক কাজ করো, গাছের ডগায় একখানা ভারী চুমু খাও, ব্যাঙ রাজপুত্র যেমন রাজকন্যার চুমু খেয়ে ব্যাঙ থেকে রাজপুত্র হয়েছে, তেমনি দেখা গেলো, তোমার চুমু পেয়ে এ’গাছে ফুল ফুটলো।”

আয়না ওইদিন খুব হেসেছিলো।

_________________________

অফিস আওয়ারে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছে সমুদ্র। সে অফিসের সব কাজ সামলালেও মনে মনে আয়নাকে নিয়ে একদম অস্ট্রেলিয়া সেটেল ডাউন হওয়ার প্লান করছে। ভবিষ্যতে কার্ডিওলজি এর উপর হায়ার স্টাডিজ করার পরিকল্পনা আছে তার। নেক্সট ইনটেকের জন্য এপ্লাই টাইম চলছে। ও ভাবছে ও এপ্লাই করলে ওর হওয়ার চান্স কম। তবুও অনলাইনে এপ্লাই করে ফেলে আজকে। কাউকেই বলেনি বিষয়টা।শুধু প্রোফেসর এডরিক স্যার জানে।

সে এপ্লাই করে ফেলে অফিসের কাজে মনোযোগ দেয়৷ তখন সজল ভাই এসে বলে ভাইভা বোর্ডে আসতে৷ ওর খেয়াল হলো, তার পিএ এর পোস্টে নতুন মানুষ নিয়োগ দেওয়া হবে। টুম্পা আপুর প্রেগ্ন্যাসি লিভ চলে। এছাড়া তার প্রোমোশনও হবে। তাই ভ্যাকেনসিতে লোক নেওয়া। সজল ভাই যাকে সিলেকশন করবে সেই সবচেয়ে যোগ্য তবুও কেন তাকে ডাকছে৷

একে একে তিনজনের ভাইভা শেষ করে চতুর্থ ক্যান্ডিডেট যখন ভেতরে আসে, সমুদ্র চমকে উঠে। দু’বার মেয়েটার দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়। এবং দু’বারই আশ্চর্য হয় সে। ইন্টারভিউয়ের একটা পর্যায়ে সে জিজ্ঞেস করে, ” আপনি কী ই– হুদি?”

কর্পোরেটে এ’টাইপ প্রশ্ন কেউ করে না। এসব সিভিতে লেখা থাকে৷ মেয়েটা ভ্যাবাচেকা খেলেও হাসি মুখে বলে, ” নো, স্যার।”

সমুদ্র ভাইবা বোর্ড থেকে বের হয় আসে। সে কেবিনে বসে সিগারেট ধরায়। চোখ বুজে চেয়ারে হেলান নিয়ে রেস্ট নেয় কিছুক্ষণ।

পিউয়ের আজকে ভার্সিটির অরিয়েন্টেশন। পিউ আর আলিয়া দু’জনেই একি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো।আলিয়া এসেছে তার বোনের বাসায় সাজতে। দু’জন সেজেগুজে আয়না সহ যাবে অরিয়েন্টেশনে।

আয়না যখন আলিয়ালে মেকাপ করে দিচ্ছিলো। আলিয়া ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছিলো।

সে বলে, ” আপা, জন্মদিনের প্লান কি?”

–” এখনো কিছু ভাবি নি।”

–” বাসায় আসো প্লিজ। বাবা অনেক করে বলে। আপসেট ও হয়৷ আমরাও মিস করি তোমাকে৷”

আয়না বলে, ” না। যাবো না৷”

এমন সময় পিউ ফোন হাতে করে এনে আয়নার কাছে ধরে বলে, ” তোমার রাগী বর কল করেছে। তোমাকে কল করে নাকি পাচ্ছে না। এজন্য আমাকে কল দিয়ে বকা দিচ্ছে৷”

কথা শেষে পিউ ঠোঁট উল্টায়। ভাইয়ের ব্যাপারে ভাবীকে অভিযোগ করলো।

আয়না কানে ফোন ধরতেই সমুদ্র বলে, ” কই তুমি? ফোন ধরো না কেন?”

–” পিউ আর আলিয়াকে সাজিয়ে দিচ্ছিলাম৷ কি হলো আপনার?”

–” আজকে আসতে দেরি হবে৷”

–” প্রতিদিন ই হয়৷”

সমুদ্র নরম গলায় বলে, ” আজ একটু বেশি দেরি হবে, বউ। সর‍্যি।”

–” ইটস ওকে।”

ওরা তিনজন বেরিয়ে যায়। নবীনবরণ শেষ করে শপিং শেষে খাওয়া-দাওয়া সেড়ে, বাড়ি ফেরে। তখন সন্ধ্যা সাতটা বাজে। আয়না অপেক্ষায় থাকে সমুদ্রর। দশটা বাজে। সবাই খেয়ে নিলেও ও খায় না। অপেক্ষায় থাকে৷ সোয়া এগারোটা অব্দি জেগে থাকে সে। একটা সময় পর বিছানায় বসা অবস্থাতে ঘুমে ঢুলে পড়ে৷

সমুদ্রের গাড়ি যখন বাসায় ঢোকে তখন বারোটা পার। বাসায় ঢুকে ডাইনিং টেবিলের দিকে চোখ যায়৷ খাবার সাজানো আছে। এমনকি লেবুর শরবত ও বানানো আছে। সে অল্প একটু তরকারি থেকে চিকেন খেয়ে রুমে আসে। রুমে আসতেই তার মন খারাপ হয়। আয়না বিছানায় বসেই কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয়ই ওর অপেক্ষায় ছিলো। মেয়েটা সে বারং করেছে ওর জন্য অপেক্ষা না করতে কিন্তু শুনে না ও৷

সে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ে আয়নাকে নিজের বুকেএ সঙ্গে জড়িয়ে নেয়৷আয়না জানতেও পারে না ওর ব্যস্ত বর ওকে কতোটা ভালোবাসা নিয়ে আগলে নিলো৷ পরদিন দ্রুত অফিস যেতে হবে জন্য ঘুমিয়ে পরে সমুদ্র। কিন্তু নিদ্রার সমস্যা হলে যা হয়! ঠিকঠাক ঘুম পূরণ হয় না৷ সকাল হতেই যথারীতি কাজের জন্য বের হয় ও। কিন্তু আজকে আয়না জাগে নি। ওকে আর জাগায় না সমুদ্র। বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।

আয়না যখন উঠে তখন নয়টা বাজে। ঘুম থেকে উঠে রুম সম্পূর্ণ ফাঁকা পেলো সে। সমুদ্র এসেছিল রাতে? হ্যাঁ! ওইতো ওনার ভেজা টাওয়াল বেডেই পরে আছে৷ আজ আয়নার জন্মদিন। কিন্তু সমুদ্র তাকে উইশ না করেই চলে গেছে অফিস। এমন কি কাল রাতে এসে একবারও কথাও বলেনি ওর সাথে। এতো ব্যস্ততা কিসের ওনার? জন্মদিনটা তার ভালোই যায়৷ ফেসবুকে অনেকেই উইশ করে। পিউও উইশ করে৷ সে বড্ড আগ্রহ নিয়ে রাতের জন্য সমুদ্রের পছন্দের বিরিয়ানি রোস্ট বানায় নিজ হাতে।

বিকেল হয়ে আসলে, সুন্দর একটা শাড়ি পরে রেডি হয়। আজকে সমুদ্র একবারও কল দেয়নি ওকে। সেও দিলো না। তার বার্থডে, সে কেন ম্যাসেজ দিবে৷ সন্ধ্যায় অবাক জনক ঘটনা ঘটে৷ বাবা, দাদা-দাদি, আলিয়া আসলো। কেক নিয়ে আসলো। এতো, এতো উদাসীনতার মাঝেও একটু হলেও তার ভালো লাগলো।কিন্তু সমুদ্রর আসার নাম-গন্ধ ও নেই। ফোনও তুলে না ও। কেক কেটে ফেলা হলো। খাওয়া-আড্ডা হলো৷ আয়না সমুদ্রের অপেক্ষায় একটু পর জানালার দিকে তাকিয়ে দেখে গাড়ি আসছে কিনা৷ কিন্তু সমুদ্র আসে না৷

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–31

রাতে খাওয়ার সময় সবাই আয়নার হাতের রান্নার এতো প্রশংসা করলো। ফাহাদ সাহেব দু’বার পোলাও নিলেন। খুব তৃপ্তি করে খেয়ে বলে, ” আমার মেয়ে তো একদম শেফ হয়ে গেছে। বিশ্বাস হচ্ছে না এতোকিছু আয়ু রান্না করেছে।”

আয়না তখন রান্নাঘরে কাজ করায় ব্যস্ত। ডিম কোরমা গরম করে সার্ভ করে। পিউ এদিকেই আসছিলো। ওকে ডাক দিলো সে৷ পিউ হাসিমুখে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে বলে, ” ভাবী তোমার হাতে জাদু আছে। এত্তো মজা হয়েছে রান্না গুলো।”

আয়না ট্রেতে করে দই সার্ভ করে বলে, ” আমার আব্বুকে একটু দই টা সার্ভ করে দিতে পারবে প্লিজ?”

পিউ বলে, ” কেনো না। দিচ্ছি।”

পিউ কিছু জিজ্ঞেস না করে ডাইনিং টেবিলের সামনে দই নিয়ে যায়। আয়নার বাবার দই খুব পছন্দ এজন্য পিউকে দিয়ে দই পাঠালো৷ সবার রাতের খাওয়া শেষ হয়। রোদেলা অনেক জোর করছিলো কিন্তু আয়না খেল না। ও নিজের রুমে যায়৷

রাত দশটায় ফাহাদ সাহেব যখন ফিরে যাবে বলে উঠবে ওইসময় সমুদ্রের গাড়ি গ্যারেজে ঢুকে। ও বাসায় ফিরলো। আজ বাসায় শ্বশুড়বাড়ির লোকজন দেখে একটু অবাক হলেও আয়নার বাবাকে দেখে খুশি হলো। বাপ-মেয়ের অভিমান ভাঙ্গলেই ভালো। সে সবাইকে সালাম দিয়ে কথা বলে৷ ওকে দেখেই কেমন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে। পিউ বার কয়েক ইশারায় তাকে ডাকে। আয়না উপস্থিত ছিলো না আসরে।

সমুদ্র বোনের ডাকে সাড়া দিয়ে পিউয়ের রুমে যেতেই পিউ আর আলিয়া তাকে প্রশ্ন করে, ” ভাইয়া কই ছিলা তুমি?”

সমুদ্র বলে, ” আজকে গাজিপুর গিয়েছিলাম৷ কেন কি হয়েছে?”

পিউ বলে, ” তুমি ভাবীকে নিয়ে একটুও কনসার্ন না, ভাই৷ মানে দিজ ইজ সো ব্যাড৷”

আলিয়া অবশ্য দুলাভাইকে কিছু বলতে পারছিল না। তবে পিউ ইচ্ছামত কথায় শুনাতে লাগে ভাবীর হয়ে৷

সমুদ্র বলে, ” এতো রেগে আছিস কেন আমার উপর? ”

–” তুমি লেটে কেন এসেছো তাও প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর। ভাবী কতো আপসেট জানো তুমি? ”

–” কিসের অনুষ্ঠান, পিউ?”

–” ভাবীর বার্থডে। ডোন্ট সে তোমার মনে ছিলো না?”

সমুদ্র ভিন্ন এক প্রতিক্রিয়া দেখায়। ও মুখ কালো করে বলে, ” তোর ভাবীর আজ জন্মদিন?”

আলিয়া-পিউ দু’জনেই আকাশ থেকে পড়ে৷ ভাইয়া জানেই না কিছু! মাই গড!

পিউ রাগান্বিত গলায় বলে, ” এসব কি বলো ভাইয়া? মানে তুমি ভাবীর বার্থ ডেট জানোই না! লাইক সিরিয়াসলি?”

সমুদ্র মুখ গোমড়া করেই সাফাই গায়,” আসলে বিয়ের সময় বায়োডাটায় ডেট খেয়াল করি নি। আর ফেসবুকও এক্টিভ না আমি। ওর ও দোষ আছে৷ আমাকে বলে নি কোনোদিন।”

আলিয়া বলে, ” আপা, জন্মদিনের কথা কাউকে বলে না৷ আমরাই মনে রাখি সবসময়ই।”

পিউ বলে, ” আমার জামাই যদি এমন করত আমি শিউর ওর মাথা ফাটাতাম। তুমি লাকি যে ভাবী এখনো তোমার মাথা ফাটায় নি। কতো বড় অপদার্থ বউয়ের জন্মদিনের তারিখ জানো না।”

সমুদ্র বলে, ” তাইলে তো বিধবা হবি তুই।”

এরপর ও বিড়বিড় করে বলে, ” ওর নিশ্চয়ই অনেক মন খারাপ হয়েছে৷”

পিউ আরোও কিছু কথা শুনালো। দুই ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেলে আলিয়া শান্ত করার উদ্দেশ্য বলে, ” ভাইয়া গিল্ট তো৷ এখন ঝগড়া না করে আপার অভিমান ভাঙ্গানোর ট্রাই করি?”

সমুদ্র চিন্তা করে বলে, ” তোমরা আমাকে একটু হেল্প কর, প্লিজ।”

পিউ বলে, ” যারা বউকে প্রায়োরিটি দেয় না, জন্মদিনই মনে রাখে না তাদের আমি হেল্প করি না।”

ও বলে, ” আর কতো খোটা মারবি। চুপ কর, ছোট মরিচ।”

সমুদ্র বলে, ” কি করলে ও খুশি হবে এনি আইডিয়া?”

পিউ বলে, ” ভাবীকে নিয়ে লং ড্রাইভিং এ যাও।”

সমুদ্র বলে, ” আসার পথে খারাপ লাগছিল, এজন্য প্যারাসিটামল আর একটা নিউ ঘুমের মেডিসিন নিসি। একটু পরই মেডিসিনের রিয়্যাকশন শুরু হবে। ড্রাইভিং করলে সিউর এক্সি ডেন্ট হবে। ”

পিউ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, ” তোমার সব ভালোতে বাম হাত ঢুকানো লাগবে। ধ্যাত। মেডিসিন নিতে কে বলেছে?”

সমুদ্র বলে, ” আমি যাই গিয়ে ওকে উইশ করি। দেরি হয়ে যাচ্ছে৷”

যাওয়ার আগে লেফট ওভার কেক থেকে এক পিস কেক সুন্দর করে সাজিয়ে ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে ভেতরে ঢুকে সমুদ্র।

আয়না তখন আলমারির কাপড় ভাঁজ করছিলো। সমুদ্রকে আসতে দেখে ও কিঞ্চিৎ নড়ে উঠে কাজে ফোকাস করে।

সমুদ্র ওর সামনে দাঁড়িয়ে কেকের প্লেট হাতে ধরে বলে, ” সর‍্যি আই মিন হ্যাপি বার্থডে, বউজান।”

আয়না হাল্কা হাসলো। ও বলে, ” ইটস ওকে আই মিন থ্যাঙ্কিউ।”

সমুদ্র কেক টেবিলে রেখে ওকে নিজের কাছে টেনে ওর বুকে কাত হয়ে মাথা রেখে বললো, ” তুমি আমাকে আগে বলো নি যে?”

–” বার্থডে তেমন স্পেশাল কিছু না।”

সমুদ্র উঠে দাঁড়িয়ে কেক হাতে নিয়ে বলে, ” হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার।”

আয়না চামচ দিয়ে কেক তুলে সমুদ্রকে খাওয়াতে চাইলে, ও আগে আয়নাকে খাইয়ে দেয়৷ আয়না খেতে চায় না। জোর করে খাওয়ায় ওকে সমুদ্র।

সে বলে, ” আপনি কেক খান। আমি খেয়েছি আগে।

সমুদ্র দুষ্টু হেসে বলে, ” আমি তো এভাবে কেক খাই না।”

–” তাহলে কিভাবে খাবেন? অন্য চামচ আনবো?”

সমুদ্র ওকে টান মেরে এনে নিজের কোলে বসায়। আয়না এটার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না। চোখ বড় করে ফেলে ও।

এরপর কেকের ক্রিম হাতে নিয়ে আয়নার গালে, ঠোঁটে লাগায়। সে শিউরে ওঠে, ভেতর থেকে কেঁপে উঠে। লজ্জায় চোখ বুজে ফেলে।

সমুদ্র বলে, ” বিয়ের পরও, তিনমাস সংসার করেও কেউ এতো লজ্জা পায়?”

আয়না ওর কলার খামচে ধরে বলে, ” ছাড়ুন।”

সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র ওর ঠোঁট নিজের দখলে নিয়ে নেয়। কথাবার্তা বলতে দেয় না। একদম থামিয়ে দিলো অন্যভাবে। ক্রিম লেগে থাকা ডান হাত দিয়ে আয়নার টসটসে গাল দু’টোয় স্লাইড করতে লাগে সমুদ্র। দু’মিনিট পর আয়না নিজ থেকে সরে আসে। সরে আসতেই সমুদ্র দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ চালায় ওর গালে। ঠোঁটের পাতা দিয়ে গালে লেগে থাকা ক্রিম সাফ করতে থাকে৷ আয়না ওর সম্পূর্ণ ভার সমুদ্রের উপর ছেড়ে দিলেই ওকে নিয়ে বিছানায় শু’য়ে পরে। নিজের প্রশস্ত ছাতিতে জায়গা হলো আয়নার৷ ঠে–সে ধরে একদম ওকে আটকে নেয়। চোখের পাতায় ঠোঁট ছু’য়ে দেয়। হাতে হাত রেখে আয়নাকে বিছানায় শুইয়ে ফেলে, ওর উপর উঠে আবেশে কেবল গলায় মুখ ডুবিয়েছে, এমন সময় দরজায় ঠকঠক আওয়াজ পরে। সমুদ্র একপ্রকার রেগে যায়। বলে উঠে, ” বিয়ের পর কোন আক্কলে ম্যারিড কাপলের রুমে ঢুকে মানুষ? প্রাইভেসি দেয় না কোনো।”

–” আপনার এতো প্রাইভেসির দরকার কীজন্য?”

–” রুমের সামনে ডু নট ডিস্টার্ব লাগায় রাখব।”

আয়নাকে ওকে ধাক্কাধাক্কি করে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গাল পরিষ্কার করতে করতে বলে, ” আমাকে পেয়েছেন কী আপনি? ক্রিম লাগিয়ে একদম যা-তা অবস্থা! সবার সামনে কীভাবে যাই?”

সমুদ্র হাই তুলে নিয়ে বলে, ” তোমাকে কেকের নরম অংশ পাইছি এজন্য ক্রিম লাগিয়ে ডেকোরেশন করছিলাম। তুমি আমার ভ্যানিলা কেক।”

সমুদ্রর বুকে একটা কিল মেরে ও দরজা খুলে দেয়। দরজায় মিসেস রোদেলা দাঁড়িয়ে।

উনি বলে, ” তোরা কি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করতে চাচ্ছিস ?”

আয়না সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” আসুন, খেয়ে নিন।”

সমুদ্র বলে, ” আমি খেয়ে এসেছি তো। আমি খাবো না ”

আয়না একটু মন খারাপ করে বলে, ” মামনি, তুমি ময়নার মাকে সব খাবার ফ্রিজে তুলে রাখতে বলো।”

মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” তোরা দু’জন না খেলে খাবার ঢুকিয়ে রাখি কীভাবে ? আয়ু দুপুরেও ঠিকঠাক খায় নি। এতো রাত হতে চললো। ও এখনো খায়নি।”

সমুদ্র রাগী চোখে তাকিয়ে বলে, ” কি তুমি খাও নি! কেন খাও নি। এক্ষুনি আসো। আমার সামনে বসে খাবে।”

সে আয়নাকে একপ্রকার টেনে ডাইনিং রুমে নিয়ে যায়। মিসেস রোদেলা দাঁড়িয়ে থেকে ছেলের কাণ্ড দেখে মুচকি হাসে কেবল।

তখনো ফাহাদ সাহেব চলে যায় নি। ইশরাকের সঙ্গে গল্পে মজেছে। আয়নাকে বসিয়ে সমুদ্র এক প্লেট বিরিয়ানি আর রোস্ট তুলে দেয় এরপর বলে, ” খাও।”

–” খেতে মন চাচ্ছে না।”

সমুদ্র কথা বাড়ায় না, নিজেই বিরিয়ানি মাখিয়ে আয়নার মুখে তুলে দেয়। ও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলে, ‘ আশেপাশে বড়রা আছে না?এসব কি করছেন?”

–” দুপুর থেকে তুমি খাও নি সেটা ফ্যাক্ট না? ফ্যাক্ট হলো কেউ দেখে ফেলবে। চুপচাপ খাও।”

আয়না ভদ্র বাচ্চার মতো খাবার মুখে তুলে নেয়৷ সমুদ্র বলে, ” পুরা প্লেট শেষ করবে৷”

–” পাগল আপনি! আমি এমনি অল্প খাই।”

সমুদ্র রাগী গলায় বলে, ” সব শেষ করতে হবে৷”

পরের লোকমা খাওয়াতে গেলে আয়না ওর হাতের আঙুলে কামড় বসায়। সমুদ্র ব্যথা চেপে সহ্য করে বলে, ” বাহ! বাহ! সবার সামনে খাইয়ে দিচ্ছি তাতেই কতো বাঁধা আর এখন যে সবার সামনে লাভ বাইট দিলেন তার বেলায় কী?”

আয়না লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়, সমুদ্র ওর থুতনিতে হাত রেখে এদিকে ঘুরিয়ে খাইয়ে দেয়৷

ফাহাদ সাহেব বিদায় নিলেন সবার সঙ্গে। আলিয়া আয়নাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলো। যাওয়ার আগ মুহুর্তে ফাহাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে, ” অনেক সুখী হও, আমার মা।” এরপরে সমুদ্রের হাতে আয়নার হাত তুলে নিয়ে কণ্ঠে কোমলতা এনে বলে, ” তোমরা দু’জন এখন সবচেয়ে বেশি আপন একে-অপরের৷ সবসময় একসাথে থাকো।”

আয়নার বাড়ির লোকরা যাওয়ার পর সমুদ্র ঘোষণা দিলো ও আয়নার জন্য নিজ হাতে কেক বানাবে৷

রোদেলা বলে, ” তোদের যা ইচ্ছা কর। আমি গেলাম ঘুমাতে৷”

পিউও চলে যায় নিজের রুমে। ডাইনিং রুমে কেবল আয়না আর সমুদ্র রয়ে যায়৷

আয়না প্রশ্ন করে, ” জীবনে কোনোদিন রান্নাঘরে গিয়েছেন?”

–” আজ যাবো।”

সমুদ্র রান্নাঘরে ঢুকে ইউটিউব এ কেক বানানো দেখল। যা যা বলছিল ইউটিউব এ ওইসব সামগ্রী জোগাড় করতেই হিমশিম খায় উনি। ওনার কাণ্ড দেখে আয়নার এতো হাসি পাচ্ছিলো। বেচারা আটা আর ময়দা চেনে না। ভুলে আটা নিতে ধরছিলো। কতো কিউট লাগছিলো ওনাকে দেখতে যখন ময়দা ভেবে আটা নাড়ছিলো!

আয়না আটকিয়ে বলে, ” আরে আটা নিচ্ছেন যে, ময়দা নেন।”

সমুদ্র আবার ময়দা চেনে না। ওকে ময়দার ডিব্বা বের করে দেয়। ময়দা বাটিতে ঢালতে গিয়ে সমুদ্রের চোখে-মুখে ময়দা ছিটকে পরে। পুরা নাজেহাল অবস্থা ওর। টি-শার্ট আর চুল সাদা হয়ে গেছে। আয়না এবারে হাসি আটকাতে পারে না। ওর সব অভিমান কোথায় জানি অজানা ঠিকানায় হারিয়ে যায়। সে ফিক করে হেসে ফেলে।

সমুদ্র নাড়াচাড়া দিয়ে গা থেকে ময়দা সরায়৷

আয়নার হাসির শব্দে থমকে দাঁড়ায় ও। এরপর বলে, ” হাসছো কেন?”

–” আপনাকে একদম সাদা বাদড়ের মতো লাগছে৷ হুয়াইট মানকি।”

সমুদ্র ময়দা চুল থেকে ঝারতে ঝারতে বলে, ” তোমাকে তাহলে একটু সাদা বান্দরনী বানাই।”

কথাটার মানে বোধগম্য হতেই আয়না রান্নাঘর ছেড়ে পালায়। সমুদ্র ওর পিছে ময়দা নিয়ে ছু’টে আর বলে, ” থামো, বলছি।”

–” পাগল আপনি! আপনি বরং থামুন। প্লিজ।”

সমুদ্র ওকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে ধরে ফেলে একদম বড় সোফায় বসে, এরপর অর্ধ শোয়া করে নিজে ওর দিকে ঝুঁকে এসে বলে, ” সুন্দরী, আপনার পালানোর সব পথ বন্ধ।”

এরপর হাতে মুঠো করে রাখা ময়দা ওর চুলে লাগিয়ে দেয়,আয়না চোখ বন্ধ করে খিটমিট করে বলে, ” আমার শ্যাম্পু করা চুলগুলো নষ্ট করলেন।”

বাকি ময়দা হাতে নিয়ে সরাসরি ওর শাড়ি ভেদ করে পে৷ টে আস্তে করে ছু’য়ে দেয়। এরপর চোখের পাতায় ঠোঁট ছু’য়ে দিয়ে বলে, ” আমার কেক খাওয়ার সব সাধ ভরে গেলো। এক জীবন আর কেক না খেলেও চলবে৷”

–” সমুদ্র, এটা আপনার বেডরুম না। সবসময় এতো খামখেয়ালি কেনো আপনার?”

সমুদ্র খুব সংক্ষেপে বলে, ” কে বা আসবে এখন?”

আয়নার গলার ঠিক বাম পাশে ছোট্ট একটা তিল আছে। সেখানটায় হাত বুলায় সমুদ্র। এরপর নিজের গালে লেগে থাকা ময়দা আয়নার গালে ঘঁষে। সময় কোনদিক দিয়ে যাচ্ছে কেউ টের পায় না।কেবল দু’জনের হার্টবিটের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঠিক গলা বরাবর ওর প্রিয় তিলটায় চুমু খেতে ধরলে ড্রয়িং-ডাইনিং রুমের মাঝ বরাবর শব্দ ভেসে আসে।

–” ভাইয়া! আমি কিছু দেখিনি।”

সমুদ্র তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে লজ্জায় বোনের দিকে তাকাতে পারে না৷

ও মিনমিনে গলায় বলে, ” কি বা দেখবি? মানে কিছু করলে তো দেখবি!”

পিউ বলে, ” সেটাই ভাইয়া। তুমি যে ভাবীকে কি৷ স দিচ্ছিলে ওটা একদম আমি দেখি নি।”

সমুদ্র রেগেমেগে বোনকে মারার জন্য তেড়ে এসে বলে, ” যা ভাগ।”

কিন্তু সরে গিয়ে পিউ বলে, ” কালকে ফ্রেন্ডদের সাথে হ্যাংআউটে যাবো। দুই হাজার টাকা দেও।”

আয়না দুই ভাই-বোন এর কাণ্ডে তাজ্জব বনে যায়। সে চোখ গরম করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। সমুদ্র টাকা বের করে পিউকে দিয়ে বলে, ” ভাগ নাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

টাকা নিয়ে পিউ চলে যায়৷

এরপর আয়না ওকে একদম কাছে ঘেষতে দিলো না। কেক বানানোর সময় কোনোরকম দুষ্টুমি করেনি সমুদ্র। ওভেন থেকে বের করে ও কেকটা আয়নার সামনে ধরে, ” হ্যাপি বার্থডে, ওয়াইফ।”

তখন এগারোটা ছাপ্পান্ন বাজছিলো ঘড়িতে। কেক কেটে আয়না মুখে নিলে, ওটা এতো পরিমাণ শক্ত যে চাবানো যাচ্ছিলো না।

সমুদ্র আশায় বুক বেঁধে জিজ্ঞেস করলো, ” জীবনে প্রথম কেক বানালাম। কেমন হয়েছে?”

–” মজা।”

আয়নার হাতে থাকা বাকি অংশে সমুদ্র কামড় দেয়, সে’সময় সে ইচ্ছা করেই আয়নার আঙুলে আস্তে কামড় বসায়। কেক মুখে নিয়েই ও ফেলে দিয়ে বলে, ” ইয়াক থু! এতো বাজে। কিভাবে এই শক্ত, পোড়া, তিতা কেক খেয়ে মজা বলো? এখুনি ডাস্টবিনে ফেলে দিবো।”

আয়না হেসে বলে, ” ইটের মতো শক্ত কিন্তু তাও আমার জন্য অনেক বেশি স্পেশাল।”

সমুদ্র হেসে ওকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে পা বাড়ায়। এরপর দু’জনে ফ্রেশ হয়ে ময়দা সরায় গা থেকে।

সমুদ্র দুঃখী মুখ করে বলে, ” কিছু ই করলাম না। তার আগেই ফ্রেশ হতে হচ্ছে। কয়লায় বাঁধা কপাল আমার।”

আয়না তখন চুল মুছছিলো। সমুদ্র ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে টাওয়াল টেনে নিয়ে ফেলে দিলো, এরপর গোসল করা ভেজা চুলে মুখ ডুবিয়ে কিছুক্ষণ ওর চুলের ঘ্রাণ নিয়ে, পেছনে থেকে জড়িয়ে নিয়ে সমুদ্র বলে, ” বলো, আয়না, কী উপহার নিবে?”

আয়না দু’দণ্ড ভেবে, নিজেকে প্রস্তুত করে, লজ্জায় নুইয়ে পড়লেও, ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ” আই ওয়ান্ট টু বিকাম দ্যা মাদার অফ ইউর কিডস।”

সমুদ্র চকিত উঠে বলে,” একবছরও হলোও না এর আগেই!”

–” কেন, আপনার বেবি পছন্দ না?”

–” না, মানে এখন আমি প্রস্তুত নই। ক্যারিয়ার গুছানো বাকি। এরমধ্যে দু’দিক ম্যানেজ করা সম্ভব না। তাছাড়া মাত্র বিয়ে হলো। এখনি এসব নিয়ে ভাবতে চাইছি না। মোরওভার, আই ডোন্ট লাইক কিন্ডস ইটস ট্রু। বাচ্চারা প্রচুর এনোয়িং হয়। ”

চলবে।