ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
6

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–41

আজকের সকালটা অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু অন্যরকম। শৈত্যপ্রবাহ চলছে জন্য কেমন শীত-শীত। ট্যাপের পানিও ঠাণ্ডা। হাত দেয়ামাত্র সরিয়ে নিতে মন চাইবে। শায়লা চৌধুরী ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন।খাবার টেবিলে দেওয়া হয়েছে কিন্তু সে কিছুই খেলো না৷

ফাহাদ সাহেব একটু পর এলেন, তাকে দেখে মুখ-চোখ শক্ত করে একপ্রকার কটাক্ষ করে বলেই দিলেন, ” তুমি যাও নি এখনো এ’বাসা ছেড়ে? কাল রাতে না তোমাকে সাফ বলেছিলাম চলে যাওয়ার জন্য? ”

শায়লা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সে ভাবতেও পারছে না কি উত্তর দিবে। ফাহাদকে কীভাবে সামলাবে সে? ফাহাদের রাগের সাথে সে পরিচিত নয়। এই প্রথম ওকে এতো রাগতে দেখলো। সকালবেলায় উঠেও ভাবছিলো ফাহাদ বুঝি রাতে রাগের বশে বলা কথাগুলো ভুলে গেছে৷ পরবর্তীতে ঠাণ্ডা মাথায় তাকে সব বুঝাবে৷ দরকার বলে ক্ষমাও চাইবে তবুও ঝামেলা আর বাড়াতে চায় না৷ কিন্তু সকাল-সকাল ফাহাদের মুখে এমন অপমানসূচক কথা শুনে সে ভীষণ হতভম্ব হয়৷ তবে চুপ থাকে৷ দুই পক্ষকেই মাথা গরম রাখলে সমস্যা বাড়ে৷

ফাহাদ সাহেব নাস্তা না করে একপ্রকার কড়া গলায় বলে, ” আমি চাই না, তুমি আর আমার জীবনে থাকো। হাসপাতাল থেকে আসার পর তোমায় যেনো আর না দেখি।”

ফাহাদ সাহেবের চিৎকারে হামিলা বুয়া বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে। শ্বাশুড়ি সালেহা বানুও রুম ছেড়ে বের হয়। শায়লার লজ্জায় মুখ লাল হয়ে আসে। অপমানে মুখ থমথমে হয়ে যায়। অপলক নয়নে চেয়ে থাকে স্বামীর দিকে৷

ফাহাদের উচিত তাকে আরেক’টা বার সুযোগ দেওয়া। সে তো অনুতপ্ত। আয়নার সঙ্গে যা হচ্ছে এটা সে কোনোদিন চায় নি।

__________________

চঞ্চল দুপুর। মৃদ্যু বাতাসে নভেম্বরের আবহাওয়ায় যেনো শীতের আগমনী আমেজ। হসপিটালের কোমল, সফেদ বেডে আয়না ছোট্ট বাচ্চার মতো গুটিসুটি মেরে শু’য়ে আছে। চুল গুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পরে আছে বালিশের উপর। ও আধো আধো করে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু ঘুমের ডোজ বডিতে বেশ কাজ করছে। চোখ খুলে রাখতে পারছে না। সমুদ্র পাশে বসেই ক্লান্ত চোখে ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘুমানোর আগ মুহুর্তেও আয়না সমুদ্রের শার্টের কলার ধরে বলে, “আমি ঘুমায় গেলেও কোথাও যাবা না। আর মরে গেলেও কোথাও যাবা না।”

সমুদ্র ক্ষণেই ওর এমন বেখাপ্পা কথা শুনে চমকে উঠে। কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” আমি কোথাও যাবো না, আয়ু। তুমি আরাম করো৷ আমি পাশেই বসে আছি।”

আয়না ঘুমের ঘোরেই বলে উঠে, ” আমি মরে গেলে ভুলেও অন্য কাউকে বিয়ে করবা না বাবার মতো।”

সমুদ্র কথা বলার সুযোগ দেয় না। জোরপূর্বক চোখের পাতা বন্ধ করিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ায়। আয়না ঘুমিয়ে যায় দ্রুত। ও এখন যতো ঘুমাবে, ততো দ্রুত সুস্থ হবে। আয়নার বাসার সবাই দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে৷ কিন্তু হসপিটাল থেকে এলাউ করছে না এতোজনকে একবারে কেবিনে যেতে৷ বেলা বারোটা বাজে। দুপুরে আয়না কচু ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে। এছাড়া নাকি আর কিছু খাবে না। স্ন্যাক্সের বনরুটি-কলাও খায় নি।

সমুদ্র ফাহাদ সাহেবকে কল লাগায়৷ ফাহাদ সাহেব হাসপাতালের লবিতে ওয়েটিং জোনে আছেন। মেয়ের জন্য অপেক্ষায় আছেন উনি।

সমুদ্র খুব নিম্নস্বরে বলে উঠে, ” বাবা, আয়ু শায়লা আন্টির হাতের কচু ভর্তা খেতে চাচ্ছে। আপনি ম্যানেজ করেন। আমি হসপিটাল অথোরিটির সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। ওনারা সমস্যা করবে না তাহলে।”

ফাহাদ সাহেব তব্দা খেয়ে বলে, ” আয়ু কচু ভর্তা খেতে চাচ্ছে? ও তো এসব অপছন্দ করে। ও এসব খায় না। ”

–” এখন এটাই লাগবে ওর। নাহলে আরোও হাইপার হবে। এরচেয়ে আপনি শায়লা আন্টিকে রান্না করে এনে দিতে বলেন।আয়ু শায়লা আন্টির সাথে দেখা করতে চাইছে। ঘুম থেকে উঠলেই হুলুস্থুল শুরু করবে। রাখছি।”

সমুদ্র ফোন কেটে বিশাল কাঁচের জানালাটার দিকে চেয়ে থাকে। জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। বিশাল বড় বট গাছটায় একটা পাখি কিচিরমিচির করছে। একটু এগিয়ে জানালার দিকে গিয়ে দাঁড়ালো।

হঠাৎ আয়নার কণ্ঠস্বর শুনে ও অবাক হলো। পেছনে তাকাতেই দেখে আয়না উঠে বসেছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, ” তোমার না আমার পাশে বসে থাকার কথা? ওখানে কেনো? ”

সমুদ্র দ্রুত বেগে একপ্রকার দৌঁড়ে আয়নার দিকে ছুটে। মেয়েটা ঘড়ি ধরে বিশ মিনিটও ঘুমালো না। ওকে দৌঁড়ে আসতে দেখে আয়না আজকে হাসলো। ভালোই শব্দ করে হাসলো যেন মজার দৃশ্য চলছে। সমুদ্র একপল থমকে ওর হাসি দেখে। আহা কী মায়াবী হাসি!

সমুদ্র বলে, ” ঘুম থেকে উঠে গেলে যে? এসো আবার একটু রেস্ট নাও।”

–” না। আমি এখন তোমার সাথে গল্প করবো।”

আয়না একেক সময় একেক আচরণ করছে। গতকাল অব্দি সে কাউকে চিনতে পারছিলো না। আর আজকে অনবরত বকবক করেই যাচ্ছে। অনেক দ্রুত অনেককিছুই বলে ফেলছে৷ তবে ওর মনে হয় মিসক্যারেজের কথা এই মুহূর্তে স্মরণ নেই।

সমুদ্র সোফায় বসলে, আয়না বেড থেকে নেমে ওর পাশে বসে। এরপর গল্প করা শুরু করে। নিজেই আপন-মনে বলতে থাকে। কথার এক পর্যায়ে বলে উঠে, ” তুমি আমার জন্মদিনের তারিখ জানো না কেনো?”

সমুদ্র পিলে চমকে উঠে। ওর এটাও এই মুহূর্তে মনে আছে যে সমুদ্র ওর জন্মদিন ভুলে গিয়েছিল। আহারে, হয়তো ওইদিন ও অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিলো, যেটা মস্তিষ্কের স্মৃতির পাতায় লেখা আছে এখনো।

সমুদ্র ওকে বলে উঠে, ” তোমার জন্মদিন ১২ সেপ্টেম্বর। আমার মনে আছে।”

আয়না যেনো এতেই খুব খুশি হলো। আবার হাসলো যেন সমুদ্রের ওর জন্ম তারিখ মনে রাখা অনেক বড় কোনো বিষয়। সমুদ্রের খুব মায়া হলো। মন চাইলো, টাইম ট্রাভেল করে গত হওয়া আয়ুর জন্মদিনে চলে যেতে, তাহলে নিশ্চয়ই ওর জন্য দারুণ কিছু করত যেন মেয়েটা কষ্ট না পায়৷

আয়না নিজ থেকে ওর বুকে মাথা রেখে বললো,” তুমি অফিস থেকে এতো দেরিতে কেন ফিরো? আমি কত অপেক্ষা করি তোমার জন্য । সন্ধ্যা থেকে তোমার আসার অপেক্ষা করি। লেবুর শরবত বানায় রাখি। কিন্তু তুমি আসো না। কতো মন খারাপ হয় আমার? সেটা কী জানো মিষ্টার ওশেন?”

সমুদ্র চুপ বনে যায়। আসলেই সে জানে না। সে জানতো না, তার আয়ু তাকে এতোটা ভালোবাসে! সমুদ্র এতো ভালোবাসা বিনা খরচায় পেয়ে গিয়েছিলো বিধায় মূল্য দেয় নি। আসলে সে আয়ুর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই না। চোখের কোণে কোনো কারণ ছাড়া-ই পানি এসে জমলো। আয়নাকে তা বুঝতে দিতে চায় না সে। মুখ ফিরিয়ে নিলে সঙ্গে সঙ্গে আয়না ওর হাত দিয়ে সমুদ্রের মুখে হাত রেখে ওরদিকে মুখ ফিরিয়ে এনে বলে, ” তুমি কী কাঁদছিলে নাকি?”

–” না তো।”

–” আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি?”

–” করো। যা ইচ্ছা বলো। তোমার সব কথাই শুনবো। ইনফ্যাক্ট প্রশ্ন করার আগে জিজ্ঞাসা করতেও হবে না আয়ু।”

–” তুমি আমাকে ভালোবাসো?”

আয়না এখন যে কন্ডিশনে আছে,এ’অবস্থায় এ-ধরনের সূক্ষ্ম প্রশ্ন করায় সমুদ্র নিজেই হচকচিয়ে উঠে। পরে মনে পরে, আয়না প্রায়শই তাকে জিজ্ঞেস করত, কোনোদিন সমুদ্র মুখ ফুটে ভালোবাসি বলে নি। আজ সে আয়নার দু’গালে তার হাত দুটো আলতো করে রেখে বলে, ” হ্যাঁ, ভালোবাসি আয়ু। তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও৷ আমরা বাসায় যাবো।”

আয়না বলে, ” সমু, আমার কি হয়েছে?”

সমুদ্র চিন্তা করে কি উত্তর দিবে তাকে। কুণ্ঠিতবোধ করে সে। এর আগেই আয়না ওর বুকে মাথা রেখে সমুদ্রের বুকের ধুকপুক, হৃদপিণ্ডের ওঠা-নামা অনুভব করে বলে উঠে, ” আমার কিছু হলে তুমি অন্যকাউকে বিয়ে করে ফেলবে?”

–” না, কক্ষনো না।”

–” আমাকে ফেলেই অস্ট্রেলিয়া চলে যাবে তাই না? আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবা না আমি জানি।”

সমুদ্র থমকালো, বিগত কয়েক মাসের সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর সবটা ওর মস্তিষ্কে খুব বাজেভাবে প্রভাব হেনেছে, প্রতিটি ঘটনায় ও আহত হতো,তবে মনের মধ্যে চেপে রাখতে রাখতে মানসিক আঘাত পেয়েছে যার জের ধরে ও এখন এসব অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। নিজের মনের মধ্যে যেসব ভয় বা কষ্ট লুকিয়ে ছিলো সবটা প্রকাশ করছে৷ আয়ু হয়তো ভাবতো, সমুদ্র তাকে ছেড়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়ে ইউশার সঙ্গে জড়াবে!

সমুদ্র ওকে ঝাপ্টে ধরে বলে, ” আমি তোমার সঙ্গে ঘর বেঁধেছি। ইউ আর মাই হোম। আমি যতোদূরই যাই না কেনো তোমার কাছেই আসবো ফিরে৷ তুমি সঙ্গে থাকলেই আমি ঘর পাবো। তুমি ছাড়া তো আমি হোমলেস।”

আয়না চোখ বন্ধ করে রাখে। ওর মধ্যে এখন বোধশক্তি কম। নিজের মতো বকে গেলো কিছুক্ষণ, এরপর বলে ফেলে, ” বাবা কেনো দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য এতো উদ্বিগ্ন হলো?”

________________________

ফাহাদ সাহেব ফোন হাতে নিয়ে হসপিটালের ওয়েটিং জোনে বসে আছেন। তিনি বেশ দ্বিধায় পরে গেছেন। শায়লাকে সকালে যা বলে এসেছে, এরপরও আয়ুর জন্য কিছু করবে ও? শায়লাকে যতোদূর চেনে সে, ও খুব আত্ম-নির্ভরশীল মহিলা। কারো অপমান সহ্য করার মতো মহিলা নয় সে। বছর পাঁচেক আগে থেকে চেনে। আয়নার মা মারা যাওয়ার পরপরই তার বাড়ির সবাই দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দিত, কিন্তু কেনো যেন সে সেকেন্ড ম্যারেজে আগ্রহ পাননি। একাকী থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তবে হুট করে একদা মাথায় ভূত চাপলো, ব্যবসা করবে। এক কলিগকে নিয়ে শুরু করে রেন্ট কারের ব্যবসা, কিন্তু ব্যবসায় কয়েক মাসের মধ্যে বিপুল লস হয়, তারা দুজনেই অনাভিজ্ঞ ছিলো। তাদের থার্ড পার্টি হয়ে ডিল এনে দিতো শায়লার কোম্পানি। তখনো শায়লা এতোবেশি উন্নতি করেনি। মোটামুটি চলছে ওর ব্যবসা। বিশাল পরিমাণ লস হওয়ার পর, লোন শোধ করতে পারছিলো না৷ লোন ক্লিয়ার না করলে আরোও বিশাল বিপদ। একে তো বড় পদের সরকারি কর্মকর্তা, কিন্তু কোনোধরনের দল সমার্থক না সে। বিধায় সাহায্যও পাবে না কারো কাছ থেকে, উলটা তাকে জেল-জরিমানা করলে বিপদ। রেপুটেশন খারাপ হবে। অসম্মানিত হতে চান। ভেবেছিলো গ্রামের সব জমি বেচে দিবেন কিন্তু কাগজ-পত্রের ঘাটাঘাটি করর দেখা গেলো, তার নিজের ভাই তার অংশ অনেক বড় একটা অংশ জালিয়াতি করে জমি আত্মসাৎ করেছে৷ ওইরকম ভয়ংকর বিপদে শায়লা তাকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করে৷ কথা হয়েছিলো ফাহাদ সাহেবের বিপদ কেটে গেলে, সময় মতো কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করবে৷ মাস অন্তর কিস্তি পরিশোধ করার সঙ্গে শায়লার সাথে যোগাযোগ বেড়ে যায়। পরে শায়লা নিজে থেকে প্রস্তাব দেয়। সে কেনো জানি, হয়তো কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে হলেও প্রস্তাবে রাজী হয়ে যায়। তবে ধারকৃত টাকা শোধ করেছে সে।

শায়লাকে ফোন লাগালো। দু’বার রিং হতেই শায়লা ফোন রিসিভ করে বলে, ” আয়ু এখন কেমন আছে?”

–” ও তোমার হাতের রান্না খেতে চাচ্ছে। তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে। আসতে পারবে?”

–” হ্যাঁ। আমি রান্না-বান্না করে নিয়ে আসছি।”

ফাহাদ সাহেব কল্পনাও করেনি শায়লাকে অপমান করে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার পরও একঘণ্টার মধ্যে ও আয়ুর জন্য রান্না করে সত্যি হসপিটাল এ আসবে৷ কেবল শায়লাকে কেবিনের ভেতরে ঢুকতে দিলো। শায়লাকে কেবিনে ঢুকতে দেখে আয়না অনেক সুন্দর করে হাসে যেন অনেক আপন কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হলো। শায়লাও হাসলো।

সমুদ্র ওকে ভাত বেড়ে খেতে দেয়৷ আয়না নিজ হাতে কচু ভর্তা দিয়ে খুব তৃপ্তি করে ভাত খায়৷ আজকে নিজেজ সুন্দর গুছিয়ে একাই ভাত খাচ্ছে৷ নোংরাও করেনি কিছু। আয়নাকে দেখে শায়লারও খারাপ লাগছে অনেক। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তার জন্য আয়ুর এই অবস্থা। সে আয়ুর লাইফ হেল করে ফেলেছিলো৷ আসলেই কী দরকার ছিলো এমন কারো সাথে ওর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার যে নিজেই মুভ অন করতে পারেনি৷ মেয়েটা নিশ্চয়ই প্রেগন্যান্সির টাইমে কচু দিয়ে ভাত খেয়েছিলো আরাম করে, সেটিই মনে রেখেছে৷

সমুদ্র শায়লাকে আস্তে করে বলে, ” থ্যাংকস আন্টি৷ আপনার জন্য আয়ু আজকে পেট ভরে ভাত খাচ্ছে৷ সকালেও ঠিকমতো খায় নি। ”

শায়লা ভারাক্রান্ত স্বরে বলে, ” সমুদ্র, আমাকে মাফ করে দিও। আমি তোমাদের অজান্তেই তোমাদের অনেক বড় ক্ষতি করে দিয়েছি। আমাকে হয়তো সারাজীবন অভিশাপ দিতে তোমরা।”

সমুদ্র তাকে অবাক করে দিয়ে বলে, ” আপনি সঠিক সময় না আসলে, মিসক্যারেজের টাইমে আয়ুর আরোও শারীরিক অবনতি হতে পারতো। ক্ষতিও করছেন আবার সাহায্যই করলেন। সাহায্যটা মনে রাখবো।”

শায়লা চৌধুরী পারলেন না বিয়ের সাতদিন অন্তর সমুদ্রকে বলা মিথ্যা ডিভোর্স দেওয়ার অভিযোগ গুলো। তার শিক্ষিত মন তাকে সমুদ্রের সামনে নিচে নামতে দিচ্ছে না। সে বলে, ” তুমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো। আয়ুকে আমরা দেখে রাখবো। তোমার একটু রেস্ট দরকার।”

সমুদ্র আয়ুর দিকে তাকিয়ে বলে, ” আয়ু, আমি একটু বাসায় যাই?”

আয়না জবাব দিলো, ” কেনো বাসায় যাবে কেনো? আমার সঙ্গে একেবারে যাবে।”

–” গোসল করবে ও।”

শায়লা আয়ুর প্রশ্নের জবাব দিলো৷ আয়না একদণ্ড ভেবে বলে, ” তুমি অন্যকোথাও যাবে নাতো?”

সমুদ্র বলে, ” না। আমি এখানেই থাকবো। যাবো না কোথাও।”

শায়লা আন্টি বলে, ” আয়ু, সমুদ্র কোথাও যেতে পারবে না তো আমি থাকলে।”

আয়না পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, ” কেনো?”

শায়লা বুদ্ধি করে জবাবে বলে, ” আমি তোমাদের বিয়ে দিয়েছি না? আমি থাকলে মানে যে বিয়ে দিয়েছে সে উপস্থিত থাকলে, যারা বিয়ে করেছে তাদেরকেও থাকতে হয়। সমুদ্র অন্যকোথাও যেতে পারবে না। ও গেলে আমি ধরে-বেঁধে এনে দিবো তোমার কাছে৷ কিন্তু ওর এখন একটু রেস্ট দরকার। ও বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হতে যেতে দাও মা।”

আয়নার বুঝি কথাগুলো ভালো লাগলো। সে সমুদ্রকে যেতে দিলো। সমুদ্র যাওয়ার পর আয়না স্বভাবত শায়লার অনেক প্রচুর কথা বললো। স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। শায়লাও উত্তর দিলো। নিজ থেকে গল্প করলো। আয়না দ্বিতীয়বার ভাত নিলো। আবার নাকি ভাত খাবে।

আয়না যখন খাচ্ছিলো ফাহাদ সাহেব সাহস জুটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। বাবাকে দেখামাত্র আয়না অবাক হলো। এরপর বলে উঠে, ” বাবা তুমি এসেছো। কেমন আছো? দুপুরে ভাত খাইছো? নাহলে বসো আমার সঙ্গে। ভাত খাও।”

ফাহাদ সাহেব আবেগ ধরে রাখতে পারলেন না। কেদে ফেলেন শব্দ করে। তারপর মেয়েকে জড়িয়ে নিয়ে বলে, ” আমার মা। আমার মেয়ে তো আমার বড় মা।”

চলবে৷

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–42

বাতাসের দমকা হাওয়ায় মনে প্রশান্তি খেলে যায়। পিচঢালা রাস্তায় আরামে কুকুর ঘুমাচ্ছে। কেমন হুহু বাতাস যেন আজ, প্রকৃতির মাঝেও বেজায় বিষন্নতা। সমুদ্র সবে বাড়ি ফিরলো। এয়ারপোর্টে থেকে সরাসরি হাসপাতালেই গেলো। অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে আজকেই প্রথম বাড়ি আসা। বাসায় তার অপেক্ষায় ছিলো মা। তাকে দেখামাত্র সমস্ত দুঃখ চেপে রেখে একটা হাসি দিলো। সমুদ্র ফিরতি হাসি উপহার দিতে পারে না। কেমন এলোমেলো ওর চালচলন।

সমুদ্র গুটিগুটি পায়ে নিজের রুমে ঢুকলেই ক্রমশ চাপা আর্তনাদ অনুভব করে। রুমের চারিদিকে চোখ বুলালো। যেভাবে রেখে গিয়েছিলো তেমন-ই আছে সবকিছুই। কেউ কোনো কিছু সরায় নি। সে রুমে এলো। বিয়ের পর যতোবারই রুমে ঢুকেছে আয়নার হাসিমুখ বা মনমরা মুখ দেখেছে। আজকে রুমটা সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ নেই রুমে। ফাঁকা রুমটায় তার কেমন দমবন্ধ লাগে। অস্থির লাগে৷ কোথায় জানি শুনেছে, পুরুষ সবকিছু এডজাস্ট করতে পারলেও, খালি ঘরে এডজাস্ট করতে পারে না।

সমুদ্র আলমারি খুলতেই আরোও বেশি থমকে দাঁড়ায়। আয়ুর জামা-কাপড়ের ভীড়ে তার শার্ট-প্যান্ট কিছু ই নজরে আসছে না। সমুদ্র ওর একটা মোলায়েম সুতির ওড়না হাতে নেয়। এরপর চুপচাপ বেডে গিয়ে বসে। ওড়না হাতে নিয়ে বসে থাকে। নানান চিন্তা মাথায় আসে। কয়েক পল সেভাবেই কেটে যায়। ঝিম মেরে বসে থাকে সে। হুট করে কাঁধে কারো হাত রাখার স্পর্শে ওর ধ্যান ভাঙ্গে। পেছনে তাকাতেই নিজের মাকে দেখামাত্র কেমন একটা শান্তি লাগে তার৷ জীবনের যেই পর্যায়েই থাকি না কেনো, প্রতিটা পর্যায়ে মা-বাবাকে দরকার।

মিসেস রোদেলা করুণ গলায় বলে, ” কী হয়েছে বাবু?”

সমুদ্র তার মায়ের কোলে মাথা রেখে বললো, ” আম্মু, আমার কিছু ভালো লাগছে না। আয়না কবে সুস্থ হবে?”

রোদেলা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” তুই ওর যত্ন নে। আয়ু এম্নেই দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। ডাক্তারও লাগবে না ওর। ওর দরকার যত্ন আর ভালোবাসা। মেয়েটা ছোট থেকেই যত্নে বড় হয়েছে তো। এজন্য অযত্ন নিতে পারেনা।”

সমুদ্র আস্তে করে বলে, ” আমি ওকে অনেক যত্নে রাখবো।”

রোদেলা বলে, ” তোর ভাগ্য অনেক ভালো। দ্বিতীয়বার সুযোগ পেয়েছিস। অনেকেই আছে যারা কখনো লাইফে সেকেন্ডে চান্স পায় না। আজীবন অনুশোচনা নিয়ে ঘুরে।”

সমুদ্রের চোখ গড়িয়ে একফোঁটা অশ্রু পরে। সে দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। উঠে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। ওয়াশরুম থেকে ফিরে বারান্দায় যেতেই চোখ গেলো আয়নার লাগানো নয়নতারা গাছটার দিকে। আয়না খুব শখ করে এই গাছটা লাগিয়েছে। তবে, পানির অভাবে গাছটা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে দ্রুত গাছের টবে পানি দিয়ে দু’পল অপেক্ষা করে আপনমনে বলে উঠে, ” আয়ু এবং আয়ুর সংস্পর্শে থাকা সবকিছুর-ই যত্ন নিবো আজ থেকে।”

_________________

বিকেল হওয়ার আগে থেকেই আয়না পুনরায় সমুদ্রের জন্য অস্থির হয়। ডাক্তার রোকসানা আসলে ওনাকে বলে, ” আপনি সমুদ্রকে আসতে বলেন। ও অনেকক্ষণ ধরে নাই।”

রোকসানা মূলত ভিজিটিং এ এসেছিলো। আয়নার উন্নতি দেখে ফাহাদ সাহেবকে একটু সরিয়ে এনে বলে উঠে, ” আপনারা চাইলে আয়নাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন আগামীকাল৷ এখন ওর ফ্যামিলির সাপোর্ট দরকার। সবার ভালোবাসা দরকার। আমাদের যা সেবা দেওয়ার দিয়ে দিয়েছি। মেডিসিন চলুক। সপ্তাহে সপ্তাহে চেক করলেই ইনাফ। বাসায় যাক। ও হাসপাতালে বিরক্ত হচ্ছে।”

ফাহাদ সাহেব আয়নার রিলিজ দেওয়ার কথা শুনে অনেক বেশি খুশি হন৷ মেয়েকে বাসায় নিয়ে যেতে পারবে এরচেয়ে সুখকর খবর আর কি হতে পারে? প্রতিটা হাসপাতালের রোগীর স্বজনদের জন্য বুঝি রুগীর রিলিজ হওয়ার দিনটা সবচেয়ে আনন্দের!

আয়না বিকেলের নাস্তা খেলো না। সমুদ্র আসলে নাকি ওর সাথে খাবে একেবারে। কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো। বেডেও বসে না। অপেক্ষায় থাকে। শায়লা চৌধুরী রোদেলাকে কল দিয়েছিলো আরোও ঘন্টা খানেক আগে। তখন নাকি ঘুমে ছিলো সমুদ্র। আয়না অবশ্য আগের মতো এগ্রেজিভ হচ্ছে না। তবে সমুদ্রের জন্য একদম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ফাহাদ সাহেব অনেক করে বলছে, কিন্তু আয়না শুনে না। একবার তো রুমের বাইরে চলে যাচ্ছিলো৷ পরে ফাহাদ সাহেব গিয়ে কেবিনে ধরে এনেছে।

সন্ধ্যার দিকে আয়না ভীষণ ব্যাকুল হয়। বারবার একি প্রশ্ন করতে থাকে। নার্স সন্ধ্যায় মেডিসিন দিতে আসলে সেটাও নেয় নি। একটাই কথা সমুদ্র আসলে খাবে। ফাহাদ সাহেব দ্রুত সমুদ্রের ফোনে কল লাগায়।

অবশেষে সন্ধ্যা সাত’টা বাজলে সমুদ্র হন্তদন্ত হয়ে আসে হসপিটালের কেবিনে। আয়না ওকে কেবিনে প্রবেশ করতে দেখে অনেক খুশি হলো। ও সোফায় বসা ছিল। সমুদ্রকে দেখামাত্র ছুঁটে এসে বাবার সামনেই ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” এতোক্ষণ কই ছিলে তুমি? তোমাকে মিস করছিলাম। আর যাবা না কোথাও।”

সমুদ্র আলতো করে ওকে জড়িয়ে রেখে বললো, ” আচ্ছা, সোনা। কোথাও যাবো না।”

–” আমাকে রেখে কোথাও যাওয়া চলবে না।”

–” কোথাও গেলেও তোমাকে পকেটে করে ঢুকায় নিয়ে যাবো।”

সমুদ্র ওকে বেডে বসিয়ে দিয়ে বলে, ” ঘুমিয়েছিলে তুমি? ”

আয়না মাথা নাড়িয়ে বলে, ” এখন ঘুমাবো।”

সমুদ্র ওকে মেডিসিন খাইয়ে দেয়। ফাহাদ-শায়লা আর কেবিনে থাকতে পারবে না। কেবিনে থাকার সময় দু’জনের কেউ কোনো কথা বলে নি। শায়লা চৌধুরী কে রেখে ফাহাদ সাহেব একাই বেরিয়ে গেলেন বিনা বাক্য ব্যয়ে। শায়লা দু’দণ্ড থেমে একাই রওনা হলেন নিজের বাসার উদ্দেশ্য। ফাহাদ সাহেব এখনো তার উপর ক্ষুব্ধ। নিজের বাসায় শায়লাকে কোনোদিন সহ্য করবে না।

কেবিনে তখন আয়না-সমুদ্র একাই ছিল। আয়না সমুদ্রের সঙ্গে অনেক গল্প করছে। সমুদ্র ওর চুলে তখন তেল দিয়ে দিচ্ছিলো। এই তেল নাকি মাথা ঠাণ্ডা রাখে। আম্মু আসার সময় হাতে ধরিয়ে দিলো।

সমুদ্র বলে, ” আজকে থেকে প্রতি সপ্তাহে তোমার চুলে তেল দিয়ে দিবো। চুলের অবস্থা ভালো। স্যাম্পু করে করে কেমন রাফ হয়ে গেছে।”

আয়না একা একাই অনেক কিছু বলছিলো। হুট করে ও বায়না ধরলো, লাল শাড়ি পরবে। সমুদ্র আকাশ থেকে পড়ে।হাসপাতালে কে লাল শাড়ি পরতে চায় ভাই?

সে আমতাআমতা করে বলে, ” আয়ু, আজ না কালকে লাল-কালো যে রঙের শাড়ি পরতে মন চায় পরে বসে থেকো। তবে আজ না। এটা হাসপাতাল।”

আয়না একদম জেদ ধরে বাচ্চাদের মতো। সমুদ্র ধৈর্য্য ধরে ওকে নানা বাহানা দিয়ে বুঝায়। এরপর বলে, আচ্ছা আসো, তোমাকে একটা গান শুনাই।”

মূলত গান শুনিয়ে ওর মাইন্ড ডাইভার্ট করার চেষ্টা চালায়।

সমুদ্র আয়নাকে নিজের কাছে বসিয়ে গান গায়,

“আমার ভিনদেশি তারা
একা রাতের আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে

ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্প বলো কাকে?”

আয়না গানটা মনোযোগ দিয়ে শুনলো চুপচাপ। এরপর প্রশ্ন করলো, ” তোমার ভীনদেশী তারা কে?”

সমুদ্র ওর সাথে নিজেকে মিশিয়ে নিয়ে বলে, ” তুমি।”

রাত নয়টায় আরেকবার ডাক্তার রোকসানা আর একজন নার্স এলেন। রোকসানা ম্যাডাম কিছুক্ষণ কথা বলে। তারপর আয়নাকে উদ্দেশ্য করে বলে,” রাতে খেয়ে নাও। তারপর ঘুমাও।”

আয়না বলে, ” আমাকে সমুদ্র খাইয়ে দিবে।”

রোকসানা ম্যাডাম বলে, ” আচ্ছা বেশ তো। ঘুমিয়ে যাও দ্রুত। কালকে বাসায় যাবে। খুশি তো?”

আয়না বলে, ” তাড়াতাড়ি ঘুমাবো না।”

–” কেনো?”

সমুদ্র আয়নার খাবার গুলো প্লেটে সার্ভ করছিলো, পাশাপাশি আয়নার কথাও শুনছে।

আয়না রোকসানা ম্যাডাম এর উত্তরে বলে, ” রাতে জলদি ঘুমাবো না৷ রাতে সমুদ্র আমাকে আ৷ দর করবে। দ্রুত ঘুমালে হবে না।”

আয়নার এহেন কথায় নার্স সহ, ডাক্তার দুইজনেই হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সমুদ্রের লজ্জায় ওই মুহূর্তে পালিয়ে যেতে মন চাচ্ছিলো। সে খুকখুক করে কেশে উঠে।কিছু বলতেও পারছে না লজ্জায়। একদম নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷

আয়না বলতেই থাকে, ” আমি লাল শাড়ি পরবো। লাল শাড়ি পরলে ও আমাকে অনেক আদর করে।”

নার্স আর ডাক্তার দুইজনেই দ্রুত প্রস্থান করে। তবে ওরনারা যাওয়ার পর আয়না বায়না ধরলো, ওর অনেকগুলো আদর লাগবে। ও ভাত খেতে চায় না। আ -দর খাবে। কেমন বাদড় মেয়ে! সমুদ্রের চেহারা তখন দেখার মতো ছিলো!

হাসপাতালে কেউ এমন আবদার কীভাবে করে? কীভাবে ওকে বুঝাবে!

আয়নার জোড়াজুড়ি তে সমুদ্র ওর কপালে একটা প্রগাঢ় অনুভূতি সম্পন্ন উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়া এঁকে দেয়।

আয়না ওকর বুকের দিকে শার্ট একপ্রকার খামচে ধরে বলে, ” এরকম চাই না। ওইদিনকারটার মতো চাই।”

–” কোনদিনের মতো আয়ু?”

–” ওইযে গাড়িতে বসে!”

সমুদ্রের খেয়াল আসে না। পরবর্তীতে মনে পরলো, ওর ফ্রেন্ডের বিয়ের প্রোগ্রাম শেষ করে আসার পথের ঘটনা। আয়না ঘুমেত ঘোর এসে যাচ্ছে তাও বাদ ড়ামি কমে না। সমুদ্রের গালে আলতো ঠোঁট ছু’য়ে দেয়। এরপর খুব অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সমুদ্রের ঠোঁটে এটাক মারে। সমুদ্র তব্দা মেরে সটান করে দাঁড়িয়ে থাকে। সে সম্পূর্ণ হতবাক। মনে মনে ভাবে, ” ডাক্তারের বউরা-ই হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি নিয়মভঙ্গ করে দেখি!”

আয়না ওইরাতে টানা ঘুমিয়েছিলো। একবারও উঠে নি ঘুম থেকে। পরদিন সকাল হলেই ওকে রিলিজ দেওয়া হলো। আয়না নিজ থেকে বলে, ” আমি আব্বুত বাসায় যাবো।”

সমুদ্রের সামান্য মন খারাপ হয়। ভেবেছিলো তার শূন্য ঘর আজ পূর্ণ হবে। তবে সে নিজেই আয়নাকে নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি যায়। আলিয়া বোনের জন্য একটা কেক আনিয়েছে। বাসায় এলেই আলিয়া ওকে ফুল দিয়ে স্বাগতম জানায়। কেক কেটে দু’বোন কেক খায়। আয়না বাসায় এসে মনে হচ্ছে অনেক খুশি৷ সেদিন রাতে সমুদ্র আয়নার বাসায় রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নিলো।

রাতের খাওয়ার পর আলিয়া নিজের রুমে এলে, দেখলো শ্রাবণের কল এসেছিল। সে কল ব্যাক করলে, শ্রাবণ সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরলো। দুজনেই কিছু ক্ষণ কথা বলে। এরপর হুট করে শ্রাবণ বলে উঠে, ” এক কাজ করি, ভাইয়া-ভাবী সহ সিলেট থেকে ঘুরে আসি। কী বলো? ভাবীরও রিফ্রেশমেন্ট হবে। ভাইয়া ভাবীর খেয়াল রাখবে। তোমাদের একটা ভ্যাকেশন দরকার। একটু প্রকৃতির কাছাকাছি যাওয়া দরকার। তাহলে মাইন্ড রিফ্রেশ হবে।”

আলিয়া বলে, ” আই ডোন্ট নো। ভাইয়া-আপা রাজী হবে কীনা। আপা মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরলো।”

–” কয়েকদিন পর যাওয়ার প্লান করতে বলি!”

সেদিন রাতেই শ্রাবণ সমুদ্রকে আয়নাকে নিয়ে সিলেট ঘুরে আসার বুদ্ধি দিলো। সমুদ্রের আইডিয়াটা মনে ধরলো। সে শ্রাবণকে সব ব্যবস্থা করতে বললো। তবে আরোও সাতদিন পরে ট্যুর প্লান করতে বললো। আয়না ততোদিনে পুরাপুরি রিকোভার করবে। ফোনে কথা বলার সময় ই আয়না শুনেছে ওরা সিলেট যাবে। ও খুশিতে আত্মহারা যেনো!

সমুদ্র ফোন রেখে আয়নার ঔষধ-পত্র দেখছিলো। এমন সময় আয়না ওর হাতে গুতা দিয়ে বলে, ” আমাকে সিগারেট দাও। সিগারেট খেতে মন চাচ্ছে।”

সমুদ্র বলে, ” তোমার ক্ষুধা পেয়েছে নাকি? দেখো সি গারেট কোনো খাওয়ার জিনিস না। এটা খেলে পেট ধরবে না। তারচেয়ে বরং কুকিজ-বিস্কুট খাও।”

আয়না চিন্তিত গলায় বলে, ” তাহলে তুমি খাও কেনো?”

–” আয়া খাই না তো।”

আয়না বলে, ” আমি দেখেছি তোমাকে সি গারেট খেতে। এখন আমিও তোমার মতো সিগারেট খাবো। দাও বলছি।”

সমুদ্র ওকে নিজের কাছে টেনে এনে কোলে বসিয়ে, আয়ুর ফোলা ফোলা গালে আলতো করে ঠোঁট ছু’য়ে দিলো প্রায় আড়াই মিনিট ধরে।

তারপর সে বলে, ” এটাই সিগারেট খাওয়া। ”

চলবে।

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–43

স্নিগ্ধ-কোমল সকাল। ভোর ছয়’টা বাজছিলো তখন। নভেম্বরের শীতে আলসেমি তখন তুঙ্গে। সমুদ্র চোখ কচলে মাথা তুলে তাকায় চারপাশে। বুকের পাশটা কেমন ভারী ভারী লাগলো। বুকের দিকে চোখ মেলতেই দেখে আয়না গড়াগড়ি খেয়ে ঘুমের মধ্যে তার বুকে এসে জোড়ো হয়ে শুয়ে খুব বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। একটা পা সমুদ্রের গায়ের উপর তুলে দেওয়া। কমফোর্টার সামান্য সরে গেছে গা থেকে। সমুদ্র আস্তে করে গায়ে কম্বল টা মুড়িয়ে দিয়ে ওর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে নির্বাক হয়ে। কী নিষ্পাপ চেহারা ওর। চোখের কোনে ডার্ক সার্কেলের কালো দাগ। না জানি কতো রাত নির্ঘুম ছিলো সে! সমুদ্র ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। মেয়েটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। সমুদ্র ডিস্টার্ব না করে উঠে বসে। তার ঘুম ছু’টে গেছে। বেডে হেলান দিয়ে বসে একদৃষ্টিতে আয়ুর দিকেই তাকিয়ে থাকলো।

আয়নার ঘুম ভাঙ্গে সকাল দশটার দিকে। ওকে জাগ্রত হতে দেখে সমুদ্র নিজ থেকে ওর দিকে ঝুকে একগাল হেসে বলে, ” গুড মর্নিং।”

আয়না পিটপিট করে চেয়ে থাকে। আশেপাশে তাকালো অবাক দৃষ্টিতে। তারপর নিজের পেটের দিকটায় হাত দিয়ে বলে, ” আপনি? আপনি না অস্ট্রেলিয়া ছিলেন? এখানে কীভাবে আসলেন?”

আয়না অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রতিনিয়ত অনেক অদ্ভুত কথা-বার্তা বলছিলো। সমুদ্র ধৈর্য্য নিয়ে সবকিছুর উত্তর দেয়। মনের ভুলেও বিরক্তি প্রকাশ করে না৷ সে আয়নার কপালে চু মু দিয়ে বলে, ” আমি তো অনেক আগেই তোমার কাছে এসেছি।অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসেছি। ”

আয়না কিসব ভাবে এরপর বলে, ” আমার মাথা কেমন ঝিম ঝিম করছে।”

–” ঘুমাও। এককাজ করো, আমার কোলে মাথা রাখো৷ আমি মাথায় ম্যাসাজ করে দেই।”

আয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলে, একটু পর ও আবার ঘুমিয়ে যায়। বেলা একটায় ওর ঘুম ভাঙ্গে।

ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে এলে ওর জন্য দুপুরে অনেককিছুই আয়োজন করে রেখেছে বাসার বাকি সদস্যরা। বহুদিন পর আয়না দুপুরে বাবা আর পুরা পরিবারের সঙ্গে খেতে বসে। ওর প্রিয় রোস্ট করা হয়েছে। বিয়ের আগে বাসায় ইলিশ মাছ রান্না হলে যেমন করে বাবা মাছের কাটা সরিয়ে দিতো, আজও ঠিক সেইভাবে মেয়ের পাতে ইলিশ মাছ বেছে দেন ফাহাদ।

আয়না খেতে খেতে বলে, ” শায়লা আন্টি কোথায়?”

ফাহাদ সাহেব সামান্য ভ্রু কুচকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ আলিয়া দ্রুত আগ বাড়িয়ে বলে, ” আপা, কচু ভর্তা বানানো হয়েছে তোমার জন্য। দিবো?”

আয়না কিছু বলে না। আশেপাশে তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজে। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ঔষধ-পত্র দিয়ে হাজির হয় সমুদ্র। আয়না সবাই যেনো চোখে হারাচ্ছে। আলিয়া দু’মিনিট পরপর এসে আপাকে দেখে নিচ্ছে। ওর আপার চেহারার দিকে তাকালেই এতো মায়া লাগছে!

দুপুরের দিকে সবাই ভাতঘুমের জন্য যে যার রুমে চলে যায়। আয়নাও ঘুমিয়ে যায়। ওর ঔষধ গুলো বেশ পাওয়ারফুল। ঘুম খুব তীব্র হচ্ছে। এখনো ঔষধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পরে ও। সমুদ্র টি-শার্ট টানটান করে বাসার বাইরে বের হয়। তখন অলমোস্ট সাড়ে চার’টা বাজছিলো। একটা কাজে এলাকার বাইরে গেছে। আধাঘন্টা ও লাগবে না ফিরতে৷ এদিকে তখনো আয়না ঘুমে ছিলো জন্য কেউ ওকে ডিস্টার্ব করেনি। এমনকি বাসায় কেউ কোনো সাড়া-শব্দও করেনি। আয়নার রুমের দরজা ভীড়ানো ছিলো৷ কখন যে ও ঘুম থেকে উঠে বাসার বাইরে চলে যায় কেউ বলতে পারেনা৷

আলিয়া চা নিয়ে আপার রুমে এসে দেখে রুম ফাঁকা। মেইনগেইটের লক খোলা। ওর বুক ধক করে উঠে। আপা কই চলে গেলো? সে বিকট আওয়াজে চিৎকার দিয়ে উঠে। দ্রুত ফাহাদ সাহেব বেরিয়ে আসে মেয়ের চিৎকার। আয়নার রুম ফাকা দেখে উনার বুঝতে বাকি রইল না, আয়ু নিশ্চয়ই বাসার বাইরে চলে গেছে৷ টেনশনে ওনার কপালে ঘাম ছু’টে। ওর তো শরীর ভালো না৷ তার উপর এতো কড়া ডোজের ঔষধ নিচ্ছে, একা বের হওয়া রিস্কি। উনি দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেন। আলিয়া সমুদ্রের ফোনে কল দিতে থাকে। কি করবে সে? উপায় না পেয়ে নিজেও নিচে নেমে পরে৷

_________________

আয়না এলোমেলো পায়ে হাঁটছে। ঘুম থেকে উঠে সে বাসার বাইরে চলে এসেছে। আশেপাশে সবকিছুই অচেনা লাগছে। কই যাচ্ছে নিজেও জানে না। হাটতে হাটতে বাসার গলির চৌরাস্তায় চলে আসে ও৷ রাস্তা পার হওয়ার জন্য যানবাহন চলাচল করতে থাকা গাড়ি-রিকশার ভীড়ে পা বাড়াতে ধরলে, কেউ একজন ওকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। আয়না বিরক্ত হয়ে পিছে ফিরে দেখে সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। ওর ঐ নীল চোখের মণিতে একরাশ আতঙ্ক। আয়না সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। কেমন বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকে দু’জন। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া দু-একজন পথচারী তাদের বকাঝকা দিয়ে গেলো। ওরা কর্ণপাত করলো না। অন্যদিন হলে সমুদ্র নিশ্চিত আয়নাকে অনেক বকা দিতো কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। সে নম্র গলায় বলে, ” আয়ু, তুমি বাসা থেকে একা কেন বেরিয়েছো?”

আয়না পিটপিট করে চেয়ে থাকে এরপর আশেপাশে তাকিয়ে বলে, ” আমি রাস্তা চিনতে পারছি না। আমরা কোথায় আছি এখন?”

সমুদ্র আলতো করে ওত হাত ধরে বলে, ” সমস্যা নেই৷ আমি আছি তো৷ আমি তোমার গুগল ম্যাপ। চলো শীতের বিকেলে একটু হাঁটাহাঁটি করি।”

আয়নার প্রস্তাব খানা ভারী পছন্দ হলো। সে মাথা দুলিয়ে সমুদ্রর হাতে হাত ধরে সামনে আগালো। সমুদ্র ওকে ফুটপাতের দিকে সরিয়ে নিয়ে, নিজে রাস্তার দিকে থাকে। দু’জন সামনে আগালো। ফুটপাত ঘেঁষে কুকুরের দল খেলা করছিলো। আয়নাকে সমুদ্র বনরুটি কিনে দেয়। ও রাস্তার কুকুর গুলোকে রুটি দিচ্ছিলো। সমুদ্র তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। সে যখন রাস্তায় ছিলো, বাসায় ফিরার জন্য মোড়ের দিকে আগায়। তখন আলিয়ার কল আসে যে আয়না হুট করে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে গেছে। আলিয়ার কথা শোনামাত্র সমুদ্র দু’চোখে আঁধার দেখে। সমুদ্র দ্রুত আয়নার বাড়ির পথে ফিরে যেতে আরম্ভ করে৷ দু’টো চোখ কেবল আয়নাকে খুজছিল। সে ধারণা ছিলো আয়ু বেশিদূর হেঁটে যায় নি। বাড়ির আশেপাশেই আছে। খুঁজতে খুঁজতে চৌরাস্তার মোড়ে এসে আয়নাকে রাস্তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে আয়নার অজান্তেই ওর কিছু ছবি তুলে রাখে। আলিয়াকে ছবি গুলো পাঠিয়ে দিলো। যেন ওরা চিন্তামুক্ত থাকে৷

আয়না যখন রুটি ছিড়ে দিচ্ছিল তখন রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট কুকুর ছানা এসে দাড়ালো। ওর পা ভাঙ্গা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কুকুরটাকে দেখামাত্র আয়না হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। কাছে ডাকলে ভয়ে গুটিসুটি মেরে ঘেউঘেউ করে আর লেজ দুলায়। কুকুর ছানাটার চোখে কী উপচে পড়া মায়া। ভাঙ্গা পায়ের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। হয়তো না খাওয়া ক্ষুধার্ত। কোনো মানুষ মনে হয় ঢিল ছুড়ে মেরেছিল, ছোট্ট ছানাটা আঘাত পেয়েছে এজন্য।

আয়না জোরর আওয়াজ করে সমুদ্র কে ডাকে। বলে উঠে, “তুমি না ডাক্তার! এই বাবুটাকে সুস্থ করে দাও।”

আয়নার সরল আবদারে সমুদ্র বিপাকে পড়ে। সে তো হিউম্যান ফিজিওলজি পড়ে এসেছে৷ সে মাথা চুলকে কুকুরের ছানাটাকে কোলে নেয়। সমুদ্র আবার কুকুর ভয় পায় না।দ্রুত আয়না সহ একটা ফার্মেসী তে যায়। বিশাল বড় ফার্মেসী। ফার্মেসীর লোক একটু অবাকই হলো। আজকাল মানুষ-জনের বোবা প্রানী নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে না অথচ দুজন মিলে একটা কুকুর নিয়ে এসেছে৷

লোকটা প্রাথমিক ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়ে বলে, ” রাতের মধ্যে আমরা স্থানীয় ভেটেরিনারি ক্লিনিকে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিব।”

সমুদ্র ভদ্রলোক কে কিছু টাকা দিয়ে দেয়৷ ভদ্রলোক খুশিই হলো। যদিও কুকুরটার চিকিৎসা করাতে এতো টাকা লাগবে না। তারমানে বকশিস ও দিলো। ওনার ফোন দিয়ে, সমুদ্রের ফোন নাম্বার নিলো।

আয়নাকে নিয়ে ফেরার পথে জিজ্ঞাসা করে, ” ফুচকা খাবে? ”

আয়না বলে, ” হ্যাঁ, হ্যাঁ। খাবো।”

সমুদ্র হাসে ওর উত্তেজনা দেখে। একটা ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়ালো। আয়ু অনেক মজা করে ফুচকা খায়। এক প্লেট ই অর্ডার করেছিলো। সমুদ্র এসব খায় না৷

আয়না তা দেখে প্রশ্ন করে, ” আপনি খাবেন না?”

–” উহু। আমি এসব ধুলাবালি খাই না।”

আয়না ওর কথা কানে তুলে না, একটা ফুচকা সমুদ্রের মুখে পুড়ে দেয়। ঝাল ঝাল ফুচকা খেয়ে নাজেহাল অনেক সমুদ্রের৷ ও একদম ঝাল খেতে পারেনা। ঝালে নাকের পাটা লাল হয়ে আসে। সমুদ্রের নাজেহাল দশা দেখে আয়না খিলখিল করে হেসে বলে, ” আপনি ফুচকা খান না! পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যে ফুচকা খায় না?”

সমুদ্র ওর দিকে মোহগ্রস্ত চাউনিতে তাকিয়ে থাকে।

একদিন, দুইদিন করে মোট চারদিন কেটে গেলো। আয়নার কড়া ডোজের ঔষধ খাওয়া বন্ধ হলো। বলতে গেলে সে আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। কেবল ঘুমের ঔষধ চলছিল তখন। সে নিজের পুরাতন স্বভাবে ফিরে আসে। বাবার সঙ্গে কথা বলতে চায় না। সমুদ্র কে ইগনোর করে।কিন্তু এবারে তার জীবনের দুই পুরুষ ই সম্পূর্ণ উলটা আচরণ করে। আয়না ওদের সঙ্গে কথা না বললেও নিজেরাই এসে এসে ভাব জমায়। যত্ন-আত্তির কমতি নেই। অসুস্থ থাকা অবস্থায় করা ব্যবহার বা ওই সময়ের স্মৃতি আয়নার স্মরণ নেই। রোকসানা ম্যাডাম বলেছে এটা নাকি খুব নর্মাল। ম্যাক্সিমাম পেশেন্ট -ই ট্রমায় থাকা অবস্থার ঘটনা ভুলে যায়।

আয়না রাতে বসে ছিলো বারান্দায়। ওর মন ভীষণ খারাপ। এতোদিন পর ও নিজের মিসক্যারেজের কষ্ট টের পাচ্ছে। ওর বাবুটা আর পৃথিবীতে নেই। পৃথিবীতে আসার আগেই মায়ের সঙ্গে অভিমান করে দূরে চলে গেলো? চোখ বেয়ে টপাটপ দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নিকষ কালো আধারে সব কষ্ট যেনো কোথায় তলিয়ে যেতে লাগে। কেমন শূন্য লাগে সবকিছুই।

এমন সময়, রুমে সমুদ্র প্রবেশ করে। আয়না ওকে দেখামাত্র বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলো। সমুদ্র হাসি মুখে বারান্দায় টোকা দিয়ে বলে, ” আয়ু, বারান্দায় থাকলে মশা কা মড়াবে তোমাকে। ভেতরে আসো। অবশ্য ভেতরে আসলে বড় মশা কা৷ মড়ালেও কা মড়াতে পারে। হু নোজ?”

আয়না ওপাশ থেকে বলে, ” আমাকে আয়ু বলে কেনো ডাকছেন?”

–” আমার বউকে আমি আদর করে ডাকছি। তোমার সমস্যা কী?”

সমুদ্র বারান্দার দরজা খুলে ওর পাশে দাঁড়িয়ে একটা কিটক্যাট এগিয়ে দিয়ে বলে, ” মন খারাপ কেনো আমার বউয়ের? হু?”

আয়না খামোশ থেকে সমুদ্রের পানে তাকালো। সমুদ্র সাদা টি-শার্ট পরে আছে। চেহারায় ক্লান্তি ভাব ফুটে আছে। সে আয়নার মুখে চকলেট তুলে দিয়ে বলে, ” কাল রাতের ট্রেনে সিলেট যাচ্ছি। জামা-কাপড় গুছিয়ে নেও।”

আয়না ভ্রু কুচকে বলে, ” আমি যাবো না। আমার ইচ্ছা নাই।”

–” বারে, তোমার না এতো আগ্রহ যাওয়ার! হুট করে কী হলো?”

আয়না মনে করতে পারেনা তার কখন সিলেট যাওয়ার শখ জাগে। সমুদ্র কেন তার সঙ্গে এতো মিষ্টি ব্যবহার করছে। ওর না দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা! মানসপটে সব ঘোলাটে স্মৃতি পরিষ্কার হয়ে উঠে।

সে বলে, ” আপনি খুব খারাপ একটা লোক সমুদ্র। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হন।”

সমুদ্র ওর পেছনে গিয়ে দাড়ালো এরপর বলে, ” এবার চলবে? দেখো, তোমার চোখের সামন থেকে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি।”

আয়না খুব বিরক্ত হলো, তাকে আরোও বিরক্ত করতে সমুদ্র পেছনে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ” আই আম সর‍্যি জান। আমি আর কখনো তোমাকে কষ্ট দিবো না। আই প্রমিজ সবসময়ই তোমাকে খুব যত্নে রাখবো। আই উইল নট গিভ ইউ লিলি’স, আই উইল টেক কেয়ার অফ ইউ লাইক এ হুয়াইট লিলি।”

আয়না বলে, ” এতো দ্রুত আপনার সব অপরাধ মাফ হবে?”

–” শাস্তি দিলে দেও!”

সমুদ্র ওর সামনে এসে দাঁড়ায় এবং কানে হাত দিয়ে বলে, ” সর‍্যি, মাই হুয়াইট লিলি।”

আয়না সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত নামিয়ে দিয়ে বলে, ” আমি স্বামী হিসেবে আপনাকে অনেক বেশি সম্মান করি।”

সমুদ্র ওর পাশে এসে বলে, ” তোমাকে কোনো চাপ দিবো না। তোমার যেদিন আমার সঙ্গে আসতে মন চাইবে। ফিরে এসো৷ আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।”

আয়না অপলক নয়নে চেয়ে থাকে বলে, ” আমাদের বাবুর জন্য আপনার খারাপ লাগে না?”

সমুদ্র এবারে কিছুটা মিইয়ে গিয়ে বলে, ” লাগে কিন্তু আমি জানি ও খুব আনন্দে,সুখে আছে, আয়ু। বরং ওর জন্য আমরা দুঃখ পেলেই ও দুঃখ পায়। ওর জন্য হলেও আমাদের হাসি-খুশি থাকতে হবে। বাবা-মা হাসি-খুশি থাকলে বেবিও আনন্দে থাকবে।”

আয়না সামান্য হাসে। সমুদ্র ওর হাতে হাত রেখে বললো, ” আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। দেখো, অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।”

–” কীভাবে? আপনাকে বিশ্বাস করতে ভয় লাগে। যদি আবারোও অবহেলা করেন?”

সমুদ্র ওর কথায় থমকে যায়। কয়েক দন্ড নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে এরপর বলে, তোমার না অনেক ইচ্ছা ছিলো একটা প্রেম করার। বয়ফ্রেন্ড নিয়ে টিএসসি ঘুরার। আমাকে কয়েকদিনের জন্য বয়ফ্রেন্ড বানাও। দেখবা অটো আমার প্রতি বিশ্বাস চলে আসবে।”

আয়না বিষ্ফোরিত চোখে সমুদ্রের পানে তাকালো। সমুদ্র তার এই ইচ্ছার কথা কিভাবে জানলো? এটা তো তার এডমিশন টাইমের ফ্যান্টাসি ছিলো।

— “উইল ইউ বি মাই গার্লফ্রেন্ড? দেখো আমাদের কতো ভাগ্য ভাল, মানুষ বয়ফ্রেন্ড টু হাসবেন্ড হয় আর আমি হাসবেন্ড টু বয়ফ্রেন্ড হওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছি।”

আয়না জবাব না দিয়ে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকে৷

সেদিন রাতে সমুদ্র নিজের বাড়ি ফিরে যায়। পরদিন বিকেলে ফোন দেয় আয়নাকে। আজকে সিলেট যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের।

আয়না ফোন তুলে বলে, ” আপনি অপেক্ষা করেন৷ আমি আর আলিয়া বের হচ্ছি।”

–“শুনো, বাঙ্গালী মেয়েরা বয়ফ্রেন্ডকে কোনোদিন আপনি বলে ডাকে। সে ‘তুমি’।

কমলাপুর স্টেশনে পৌঁছে যায় সবাই। ট্রেনে করে যাবে তারা। রাত সাড়ে আটটায় ট্রেন। শ্রাবণ, সমুদ্র, পিউ এসে গেছে। আয়না-আলিয়াকে ফাহাদ সাহেব ড্রপ করলেন। গন্তব্যস্থলে, হুট করে ট্যুর অর্গানাইজার হিসেবে রঙ্গনকে দেখা গেলো। রঙ্গনকে দেখামাত্র সমুদ্র ভ্রু কুচকে তাকালেও পিউ মিটমিট করে হাসে৷

রঙ্গন আর শ্রাবণ নাকি ট্যুর ম্যানেজমেন্ট এর ভলেন্টিয়ার হিসেবে আছে। রঙ্গন সঙ্গে ওর বোনকেও এনেছে। ট্রেনের একটা বগির অর্ধেক জুড়ে ট্যুর ঢাকা টু সিলেট এর মানুষ জনে ভরে গেলো। ফেসবুক গ্রুপে দেখে অনেকে রেজিস্ট্রেশন করেছে। বাজেট একটু বেশি হওয়ায় ভদ্র পরিবারের মানুষ-জন ই আগ্রহ পোষণ করেছে।

আয়না জানালার পাশে বসে পরে ট্রেনের। ট্রেন চলা শুরু করতেই সমুদ্রের ফোন থেকে ম্যাসেন আসে৷

” ট্রেনের বাম সাইডে আসো। একটু প্রেম করি।”

চলবে।