ইলেকট্রিক্যাল মন পর্ব-৪৮ এবং শেষ পর্ব

0
2

#ইলেকট্রিক্যাল_মন
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Last Part

আয়নার ফোনে বিকট শব্দে রিং বেজে উঠে। সে ঘুমের ঘোরেই ফোন হাতড়াতে থাকে, ধরেই নেয় সমুদ্রের কল এসেছে। চোখ মেলে স্ক্রিনের দিকে তাকায়। আননোন একটা নাম্বার থেকে এতোরাতে কল আসে। ঘুমের ঘোর ছু’টে যায়। এমনকি ক্ষণেই ঔষধের তীব্র রিয়্যাকশন ও কাজ করা থামিয়ে দেয়। সে কল রিসিভ করতেই ও’পাশ থেকে ভরাট কণ্ঠে কেউ বলে উঠে। আয়নার তখন ঠোঁট কেঁপে উঠে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুলো না৷ কেবল একটা কথাই কানে বাজে এক্সি ডেন্ট হয়েছে। আয়না এতো জটিল শব্দগুলো নিতে পারে না। ক্ষণেই সারা শরীর অসাড় হয়ে আসে। মাথার নিউরন গুলো টগবগিয়ে উঠে। হাত কাঁপতে কাঁপতে ফোন পরে যায় ফ্লোরে।

তখন ভোর চারটা বাজছিল। সে ছু’টে যায় বাবার ঘরের দিকে। আয়না সব অস্পষ্টতা লাগছে। কয়বার যে হোঁচট খেলো ইয়াত্ত নেই। কেবল স্মরণ হয় অনেক জোরে বাবা বলে ডাক দিচ্ছিলো। ফাহাদ সাহেব রুম ছেড়ে বেরিয়ে এসে নিজের মেয়ের বেহাল, পাগল-পাগল দশা দেখে ঘাবড়ে যান। আয়না অনেকদিন পর বাবা বাবা করে ডাকছে। কিন্তু আজ পরিবেশ ভিন্ন। তিনি চমকে উঠে মেয়ের কাছে ছুটে’। আয়না একদম ছোট বাচ্চাদের মতো বাবার বুকে নেতিয়ে পরে বিড়বিড় করে কিসব বলে। তখনো ওর রুম থেকে ফোনের শব্দ ভেসে আসছে। উনি রুমে গিয়ে ফোন কানে নেয়। গাজীপুরের এক হাসপাতাল থেকে কল করা হয়েছে। আজকে রাতে একটা গাড়ি দু৷ র্ঘটনার কবলে পড়েছে। গাড়ির নম্বর প্লেট ঢাকা মেট্রো গ। পেশেন্টর ফোনে লাস্ট এই নম্বর থেকে কল এসেছিলো। ভদ্রলোক রোগীর বর্ননা দিলো। অজ্ঞান অবস্থায় আছে। ফোনে পাসওয়ার্ড নেই এজন্য নাকি দ্রুত যোগাযোগ করতে পেরেছে৷রোগীর স্বজন হয়ে থাকলে ওনারা আসতে বলছে।

ফাহাদ সাহেবের বুঝতে বাকি রইলো না সমুদ্রের এক্সি ডেন্ট হয়েছে। উনি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালালেন। গাজীপুরে আয়নাকে সহ গিয়ে লাভ হবে না। সমুদ্র কে ঢাকার উন্নত মানের হাসপাতালে নিতে হবে৷ দরকার হলে জরুরি ভিত্তিতে থাইল্যান্ড নিয়ে যাবেন। আয়না ইতিমধ্যে পাগলামি শুরু করে দিয়েছে৷ কি করবেন উনি? ভোরের আলো এখনো ফুটে নি।

ফাহাদ সাহেবের এক বন্ধু সরকারি বড় কর্মকর্তা, গাজীপুরেই পোস্টিং আছে, দ্রুত কল লাগায়৷ ওনার বন্ধুর সেই বহুদিন আগের অভ্যাস ফযরের নামাজ পড়তে উঠা। কাজেই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বেগ পেতে হয় নি। ওনার বন্ধু খবর শোনামাত্র সাহায্য করার জন্য রাজী হলো। তার বাসা থেকে সমুদ্র কে নেওয়া গাজীপুরের সেই হেলথ কমপ্লেক্স বেশি দূর না। বন্ধুর মেয়ে জামাইকে সাহায্যে করার উদ্দেশ্য ভদ্রলোক ভোরের দিকেই ছু’টে যান। ফাহাদ সাহেবের হাত-পা কাঁপছিলো। মেয়ের জন্য বেশ চিন্তিত সে। আয়না এই অল্প সময়ের ব্যবধানেই অস্থির হয়ে একাকার। এখনই নাকি বের হবে। হাঁটা ধরবে। ফাহাদ সাহেব মেয়েকে ছোট বাচ্চাদের মতো বুকে আগলে রেখে নানান বুজ দিতে থাকে। আয়না মানে না। হাউমাউ করে কাঁদে। ওর মেন্টাল কন্ডিশন ক্রমশ খারাপ হতে লাগে।

পনের মিনিট পর ওনার বন্ধুর কল আসে। রিসিভ করতেই জানালো, সমুদ্র কে হাসপাতালে এডমিট করা হয়েছে। চিকিৎসা চলছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে, খুব গুরুতর কিছু না। তবে বাম পা সম্পূর্ণ ব্যান্ডেজ। এক ব্যাগ রক্ত লাগছে। সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয়েছে। ওরা বলেছে চাইলে এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে যেতে। ফাহাদ সাহেব ঢাকার সবচেয়ে ভালো প্রাইভেট হাসপাতালেই ইমার্জেন্সি তে নিতে বলেন।

ফাহাদ সাহেব বন্ধুকে বললেন ঢাকায় যেন নিয়ে আসে। ওনার বন্ধ সব ব্যবস্থা শুরু করে ভোরের মধ্যেই রওয়ানা হলো ঢাকার উদ্দেশ্য। এই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ই আয়না উদ্ভ্রান্তের ন্যায় আচরণ করতে থাকে। সকাল সাতটায় ঢাকার হাসপাতালে সমুদ্রকে নিয়ে পৌঁছালে, ফাহাদ মেয়েকে নিয়ে বের হন। সে সাহস পাচ্ছে না, কীভাবে সমুদ্রের বাবা-মাকে সংবাদ টা দিবেন? হুট করে এমন খবর শুনলে ইশরাক ভাইয়ের কিছু হলে কী করবেন উনি? মাথা কাজ করছে না তার।

সবসময়ই এত বিপদে কেন পড়েন তার ফ্যামিলি? উনি বেশ ভার অনুভব করেন যেন কাঁধে কয়েক পর্বত সমান চাপ। আয়নার কান্নার শব্দে যেন আরোও অসহায় বোধ করলেন। বাবা-মেয়ে পথ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইল।

হাসপাতালের কলিডোর আয়নার পরিচিত। এই হাসপাতালে প্রায় আসা হয় তার। ইমার্জেন্সি বিল্ডিংয়ে ছুটে’ যায় সে। ফাহাদ সাহেব কোনোভাবেই মেয়েকে সামলাতে পারছেন না। ও ছুটে যেতেই চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে চোট পায়, তাও দিক-বেদিক ভুলে ছু’টে। চোখের জলে গাল ভিজে যাচ্ছে, দোয়ায় ভিজে যাচ্ছে মন। শুধুমাত্র সমুদ্রের সুস্থতার চাইছে সে।

হাসপাতাল রুমের সামনেই ডক্টরের সঙ্গে দেখা। উম্মাদের মতো দৌঁড়ে আসা মেয়েটাকে দেখে ওনার বেশ মায়া হলো। আহারে! মেয়েটার চোখ দিয়ে জল বইছে নায়াগ্রা ফলস এর মতো৷

আয়না এসে দাঁড়াতেই ডক্টর বলে, ” আপনি পেশেন্টের কে হন মা?”

আয়না উদ্ভ্রান্তের ন্যায় জবাব দিলো, ” ওয়াইফ।”

–” ওহ আচ্ছা। পেশেন্টের গাজীপুরে এক্সি -ডেন্ট হয়েছিল। এরপর ওখান থেকে এখানে আনা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত যে মাথায় ইঞ্জু রি তেমন হয়নি। তবে বাম পা অনেক বেশি ইঞ্জু রড। ওনার জ্ঞান ফিরেছে।”

আয়না অসহায় টলটলে চোখে ডক্টরের দিকে তাকায়। এই চাউনিতে আকুল আবেদন আছে, একটা বার আপন মানুষ টাকে দেখতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা। উনি না করতে পারলেন না। হেসে জবাব দিল, ” যাও দেখা করে আসো। কিন্তু বেশি শব্দ করবে না। ইঞ্জেকশন পুশ করা হয়েছে৷ ছয় ঘণ্টা ঘুমাবে। ”

আয়না ভেতরে ঢুকে পরে। রুমে প্রবেশ করতেই নীল আর বাদামী চোখের মণির মিলন ঘটে। সমুদ্র কে হাসপাতাল বেডে দেখামাত্র কেঁদে ফেলে আয়না। পা দুটোয় ব্যান্ডেজ দেওয়া। ব্যান্ডেজের নিচ দিয়ে লাল র ক্ত সামান্য ভেসে আছে। কপালে ব্যান্ডেজ। সমুদ্রের একটু আগেই জ্ঞান ফেরে। এতোক্ষণ চোখ বন্ধই ছিলো। গেইট খোলার শব্দে কষ্ট করে হলেও চোখ মেলে তাকাতেই আয়নাকে সামনে দেখতে পায়৷ ও ব্যথা পাওয়া হাতটাই এগিয়ে দেয়। হাত দিয়ে আয়নার ওম স্পর্শ করতে চায়। অনুভব করতে চায় তার সেভেন মিনিটকে।

নিজেকে বড্ড ভাগ্যবান মনে হয়। সৃষ্টিকর্তা তবে তার প্রতি এতোটাই সদয় হয়েছেন যে এক জীবনে মৃত্যুর কাছাকাছি দ্বারপ্রান্ত হতে ফিরিয়ে দিলেন!

আয়না ওর ব্যথা পাওয়া হাত ধরে বলে, আস্তে করে বলে, ” সমুদ্র।”

নীল মনি দিয়ে খুব দুর্বল অবস্থায় সে জিজ্ঞেস করলো, ” আয়ু, তুমি আজকে সকালের ঔষধ নিয়েছো?”

আয়নার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ে। সমুদ্রর মন চায় নিজের হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দিতে কিন্তু সক্ষম হয় না। ভীষণ ঘুম পায় তার। চোখের সামনে গত কালকের ভয়ংকর স্মৃতি ভেসে আসে। অজ্ঞান হওয়ার আগ মুহূর্তে তার নাকে তীব্র আগুনের গন্ধ উড়ে আসে। আগুনের তাপে গা গরম হয়ে আসে। জ্ঞান থাকতে থাকতে সে বুঝে যায় যে করেই হোক উলটে যাওয়া গাড়ি থেকে বের হতে হবে নাহলে খুব দ্রুত ছাই হয়ে যাবে।

আয়নার কাছে যেতে হবে– শুধুমাত্র এই একটা অনুপ্রেরণা তার বুকে এক পাহাড় সম মনোবল দেয়।কেবল মনোবলের জোরে, জানালার গ্লাস ভেঙে যে ফাঁকা স্থান ছিলো সেখান হতে এক প্রকার জবরদস্তি বেরিয়ে আসে। ফলে হাত-পা, পেট ছি৷ লে ছু। লে একাকার। মাটিতে লুটিয়ে পরার পর আধভেজা চোখ দিয়ে দেখে সাদা গাড়িটা জ্বলছে। ভয়ংকর সেই আগুনের তোপ। গা শিউরে উঠে এরপর আর কিছু মনে নেই।

সমুদ্র খুব নিম্নস্বরে ঘুমের ঘোরে বলে, ” তোমার ধারণাও নেই আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি। হয়তো আমার ভালোবাসার প্রশস্ততা মাপা সম্ভব না। এক সমুদ্রে যতগুলো ঢেউ, আমার হৃদয়ে ঠিক ততো খানি ভালোবাসাময় ঢেউ আছে। শুধুমাত্র তোমার জন্য।”

___________________

সেদিন খুব সুন্দর একটা দিন ছিলো। সূর্য ডোবার পর সমুদ্র হাসপাতাল থেকে বের হলো। ভীষণ ক্লান্ত সে। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। সিডনিতে আজ বেশ শীত। সোয়েটার পরেও পার্কিং লটে পৌঁছাতেই হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। গাড়ি নিয়ে ছুটে বাসার উদ্দেশ্য। পথিমধ্যে একটা সুপার শপে থেমে, এক বক্স চকলেট কিনে। কেনো কিনলো ও নিজেও জানে না। এরপর নিজেই নিজেকে বুঝ দিলো, সে চকলেট নিজে খাওয়ার জন্য কিনেছে৷ চকলেট কিনে গাড়ি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হলো। নিজের এপার্টমেন্টের বেজমেন্টে গাড়ি রেখে উপরে উঠে বাসার দরজার সামনে এসে থামলো। দরজায় নেমপ্লেটে লেখা মিষ্টার এন্ড মিসেস রহমান।

সে বেল বাজায়। বাসার ভেতর থেকে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। দরজা খুলতেই টি-শার্ট পরা আয়নার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। আয়না মুখ ঘুরিয়ে নিলো। তাদের দুইজনের চেহারা দেখা আপাতত বন্ধ।

তবে সারা বাসায় বিরিয়ানির গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। সমুদ্রের ক্ষুধারা হরতাল শুরু করলো। গতকাল আয়নার সঙ্গে এক প্রকার ঝগড়া হয়েছে৷ কাল রাত থেকে তাদের মধ্যে কথা বন্ধ। সমুদ্র চকলেট ডাইনিং টেবিলে রেখে গলা খাকারি দিয়ে বলে, ” আজকে ক্লাসে গিয়েছিলে?”

–” না।”

–” কেনো ক্লাসে যাও নি কেন?”

–” ক্লাস ছিলো না। তাই।”

সমুদ্রের এতো মেজাজ খারাপ হয়, কেমন বিচ্ছু মেয়ে! সে চুপচাপ চকলেটের বক্স খুলতে থাকে। আয়নাও সার্ভ করে রাখা বিরিয়ানির থেকে ঢাকনা সরায়। বিরিয়ানির চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুরাই ফার্স্ট ক্লাস হয়েছে। আয়না ঝগড়াঝাটির পর তার দুর্বলতায় হাত দেয়, যেন সমুদ্র আগে সর‍্যি বলে। মেয়ে হয় লাল শাড়ি পরবে নাহলে বিরিয়ানি রাঁধবে।

সমুদ্র দ্রুত চেয়ারে বসে বলে, “দাও, খেতে দাও। খেয়ে-দেয়ে ঘুম দেই। কালকে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি ড্রাইভ করা লাগবে।”

আয়নার চোখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে আসে। ও সমুদ্রের কোলে বসে পড়ে বলে, ” সত্যি আমরা যাবো?”

সমুদ্র ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয় এবং বললো, ” হ্যাঁ। তোমার সব আবদার ই তো পূরণ করি।”

আয়না খুব খুশি হলো। নিজ হাতে ওকে সার্ভ করে বিরিয়ানি খাওয়ালো। সমুদ্র দু’লোকমা খেয়েই আয়নাকে নিজ হাতে বিরিয়ানি মুখে তুলে দেয়। আয়না একটু খেয়ে আর খেতে চায় না। ওর বমি পাচ্ছে নাকি। সমুদ্র জোর করে না।

রাতের খাওয়ার পর্ব সেড়ে আয়না টিভি অন করলো। কে-ড্রামা দেখবে সে। সমুদ্র পাশে বসে থাকে। এসব কে ড্রামা তার মাথার উপর দিয়ে যায়। কে নায়ক আর কে ভিলেন চিনতে কষ্ট হয় তার। সবাইকে এক রকম লাগে। আজকে আয়না এক অদ্ভুত ড্রামা দেখছে। এই ড্রামায় নায়িকা বিড়াল থাকে, কিন্তু পৃথিবীতে এসে মানুষ রুপে নায়কের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমুদ্র হাই তুলে। আজকে সারাদিন এতো প্রেশার গেছে। এসব বিড়াল মানবীর ড্রামা দেখে ক্লান্তি ঘুঁচবে না। সে শুয়ে পরে বেডে৷

সমুদ্র সিডনিতে সেটেল হয়েছে অলমোস্ট তিনবছর হলো। কার্ডিওলজির উপর পড়াশোনা করছে। আয়না যখন ফাইনাল ইয়ারে তখন অফার লেটার হাতে পায় সমুদ্র। পরের জানুয়ারি তে অস্ট্রেলিয়া ফিরে আসলো। আয়না তার কয়েকমাস পর এসেছে। মাস্টার্স করছে এখানে। শায়লা চৌধুরী কে ঘিরে কাহিনি ঘটে গেলো। তার শ্বশুর ডিভোর্স দিতে চাইছিলো। শায়লা চৌধুরি আরোও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পারিবারিক গোল মিটিং করে আয়না ওর বাবাকে কনভিন্স করেছে বিচ্ছেদের দিকে না আগাতে। পরবর্তীতে শায়লা চৌধুরী ফাহাদ সাহেবের সঙ্গে থাকা শুরু করেন।

চোখ বুজে রেখেই টের পেল আয়না ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্র চোখ খুলে না। আরাম উপভোগ করে। তার ফ্যামিলি অনেক ভালোবাসে তাকে। এক্সি ডেন্ট হওয়ার পর প্রায় তিন-চার মাস সাপোর্ট ছাড়া হাঁটতে পারত না। ওইসময় আয়না ওর এতো যত্ন নিয়েছে, যা কোনোদিন কল্পনা ও করে নি সে।

পরের দিন সকালবেলা রওয়ানা হয় তারা দু’জন। আজকে উইকেন্ড। ছুটি আজ। তারপরও এতো সকালে উঠে তারা পার্শ্ববর্তী সিটিতে যাওয়ার জন্য রওনা হলো৷ সমুদ্রের চেহারায় বিরক্তি ফুটে উঠে তবে আয়না বেশ খোশ মেজাজে আছে। তাদের এক বৃদ্ধা প্রতিবেশী অসুস্থ। এখন পাশের শহরে হাসপাতালে ভর্তি, আয়না ওনার সাথে দেখা করবে৷ এটা নিয়েই গতকাল ঝগড়া লেগেছিলো। সমুদ্র বলছিলো ভিডিওকলে কথা বলতে, এই যুগে কারো এতো সময় নেই। কিন্তু আয়না সরাসরি দেখা করতে চায়৷ অতঃপর ঝগড়া বাঁধলো।

পাক্কা পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভ করে বৃদ্ধ মহিলার কাছে পৌঁছে তারা। মহিলা বৃদ্ধ বয়সে একদম একা হয়ে গেছেন। অসুস্থ অবস্থায় আয়না-সমুদ্র কে দেখে খুশি হলেন। একদম নিজের সন্তানের মতো অস্ট্রেলিয়ান এই বৃদ্ধ আদর করলেন। সমুদ্র মনে করার চেষ্টা করে এই বৃদ্ধ কবে তার প্রতিবেশী ছিলো?

দুপুরে লাঞ্চ সেড়ে তারা প্লান করলো সি-বীজ ঘুরে যাবে। ড্রাইভিং করে সি-বীজের ধারে এসে পৌঁছে। অস্ট্রেলিয়া ঘিরে শুধু সমুদ্র। যেদিকে তাকায় মানুষ, সেদিকেই সি-বীজ। তবে আজকের আবহাওয়ার খুব ঠাণ্ডা। কেমন মায়া জড়ানো আজকের আবহাওয়া। সমুদ্রের সমস্ত বিরক্তি, ক্লান্তি দূর হয়ে আসে।

দুজনে খালি পায়ে সি-বীজের পাড় ঘেঁষে হাঁটে। মৃদ্যু বাতাসে আয়নার চুল নড়ে। একটু হাঁটার পর আয়না থামে।

আয়না বলে উঠে, ” মিষ্টার অশেন, আপনি একটু পিছন ঘুরে থাকুন। ভুলেও এদিকে ঘুরে কিছু দেখবেন না।”

এরপর সে এগিয়ে যায়, ঝুঁকে বসে কিসব করে। সমুদ্র উলটো দিকে ঘুরে থাকায় বুঝে উঠতে পারলো না কি লিখছে ও।

আয়না বলে, ” আসুন এবার।”

সমুদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বালুতে খোদাই করা লেখা পড়লো। ছোট্ট করে লেখা বায়োটেক লোডিং। সে বুঝতে পারে না আয়না মজা করছে নাকি! কিন্তু ওর ওই প্রাণখোলা হাসি, মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যাওয়ার তৃপ্তি ময় মুখমণ্ডল তো মিথ্যা নয়৷ আয়নার নির্মল হাসির প্রেমে পড়ে যায় সে।

সমুদ্রের চোখে পানি চলে আসে। ওমন সময় ঢেউ এসে তাদের পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। সমুদ্র গিয়ে ওকে কোলে তুলে বলে, ” আই লাভ ইউ আয়ু।”

আয়না ওর নাকে নাক ঘঁষে বলে, ” আমার কিন্তু নীল চোখের মণি ওয়ালা বাবু চাই।”

সমুদ্র হেসে ওকে আলিঙ্গন করতে চাইলে আয়না চিৎকার দিয়ে উঠে বলে, ” সমুদ্র তোমার গা থেকে কেমন খাসি-খাসি গন্ধ আসছে৷”

আয়না নাকে হাত চেপে বিরক্তি মুখে এসব কথা বলে, সমুদ্র কে দূরে ঠেলতে থাকে।

সমুদ্র হয়তো পৃথিবীর প্রথম মানুষ যে নিজের গা থেকে খাসির গন্ধ আসছে শুনে এতো খুশি হলো।

অশ্রুভেজা চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালো সে। নাকে হাত চেপে, বিরক্তিমাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা তার জীবনে পাওয়া সবচেয়ে বড় নিয়ামত। সে মিহি হাসে। এই মিষ্টি মেয়েটা তার জীবনের সবধরনের অপূর্ণতা কীভাবে পূর্ণ করে দিলো!

তার মনে হয়, সবার জীবনেই একজন আয়না থাকা দরকার।

পরিশিষ্টঃ

সমুদ্র সিডনি শহরের এক হাসপাতালে, ডেলিভারি রুমের বাইরে অপেক্ষায় আছে। চিন্তায় হাত-পা কাঁপছে তার। ডেলিভারি রুমে ঢুকানোর আগ মুহূর্তে আয়না ওর হাত ধরে বলছিলো, ” সমুদ্র আমার কিছু হয়ে গেলে, তুমি প্লিজ আমার বাবুকে ঠিকমতো দেখে রাখবে৷”

আয়নার আবোলতাবোল কথা শুনে সমুদ্র এক ধমক দিলো। আয়না ওর হাত আরোও শক্ত করে ধরে বলে, ” আমি মারা গেলে, তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করে নিও।”

ওইসময় সমুদ্রের চোখ বেয়ে আপনা-আপনি কান্না চলে আসে৷ মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। কেবল বোবা দৃষ্টি মেলে ডেলিভারির আগ মুহূর্তে ব্যথায় কাতরাতে থাকার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আয়নার কমপ্লিশন আছে জন্য আরোও দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
পেছনে থেকে তার মা মিসেস রোদেলা বলে উঠে, ” বাবু, ধৈর্য্য ধর। দুয়া কর।”

এমন সময় নার্স এসে ফটাফট ইংলিশে বলে গেলেন, ” অভিনন্দন, তোমার পুত্রসন্তান হয়েছে। মা ও শিশু সুস্থ আছে।”

সমুদ্র ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। রোদেলাও ছেলেকে পরম মমতায় আগলে নেয়।

আগামীকাল ফাহাদ সাহেব আর শায়লা চৌধুরীর অস্ট্রেলিয়া আসার কথা। তাদের বাড়ির নতুন সদস্য একদিন আগেই আব্বু-আম্মুর কাছে চলে এসেছে৷ বাংলাদেশের সবাই অধীর আগ্রহে সুখবরের আশায় চেয়ে আছে। আলিয়ার আগামী মাসে বিয়ে শ্রাবণের সঙ্গে। ও ভিডিওকলে দাদা-দাদি কে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদেলার হাতে ফোন। সবাই বাবুকে দেখার জন্য অস্থির করছে।

ওদিকে আবেগ আর পিউয়ের ফোনের জ্বালায় মিসেস রোদেলার মাথা পাগল প্রায়। বাড়ির সবাই এতো অস্থির আর এতো খূশি। খুশিতে সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে বুঝি!

উনি আয়না পাঁচমাস প্রেগ্ন্যাসির সময়েই ওকে সঙ্গ দিতে অস্ট্রেলিয়া এসেছে। ওনার নিজেরই খুশিতে কান্না পাচ্ছে৷ কারো সাথেই ঠিকঠাক কথা বলতে পারছেন না। শুধু একাধারে বলে যাচ্ছে, ” আমার বাবুর বাবু হইসে। আমার জুনিয়র বাবু।”

সমুদ্র এগিয়ে গিয়ে আয়নার কেবিনে যায়। ও ধরেই নেয় আয়না নিশ্চয়ই ব্যথায় কাতরাচ্ছে। মেয়ে সামান্য মাথাব্যথা সহ্য করতে পারে না। না জানি এতো ব্যথা পাওয়ার পর কী অবস্থায় আছে এখন৷ কেবিনে ঢুকে সদ্য মা হওয়া আয়নাকে দেখে সে বেশ অবাক হল। মেয়েটার চেহারায় ব্যথার চেয়ে আনন্দ বেশি। এক গাল হেসে শুয়ে আছে। চোখ-মুখে ব্যথার যন্ত্রণা প্রকাশ পাচ্ছে। দুই বেনী করে থাকায় ওকে কিশোরী বাচ্চার মতো লাগছে এখন।

সমুদ্র কে দেখেই আয়না প্রশ্ন ছুঁড়লো, ” আমার পুটুনুর চোখের মণি নীল হয়েছে কীনা দেখেছো?”

সমুদ্র গিয়ে ওর কপালে চু-মু খেয়ে বলে, ” না।”

আয়না রাগী গলায়, ” ষ্টুপিড ডক্টর! এখনো দেখো নি কেনো!”

সমুদ্র ওকে ফের চুমু দেয়। এমন সময় নার্স বাবা-মায়ের কাছে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে নিয়ে এসে সমুদ্রের কোলে তুলে দেয়। তুলোর মতো নরম বাবুটা বাবার কোলে আসার সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকায়। সমুদ্রের মনে হচ্ছে সে নিজের চোখ গুলোই আয়নায় দেখছে। একদম সেইম টু সেইম, সমুদ্রের কার্বন কপি যেন। ও একবার আয়নার দিকে তাকায়, আয়না হাসিমাখা চোখে তাদের পিতা-পুত্রকে দেখছে নয়নে জুড়ে, সে আবার বাবুর দিলে তাকায়৷ ও কেঁদে দেয়। নীল চোখের বাবুটা কেঁদে দেয় বাবার কোলে।

আয়না বলে, ” আমার ছেলে আমাকে বেশি ভালোবাসে এজন্য মাকে খুঁজছে । আয় পুটুনু বাবা। মায়ের কাছে আয়।”

সমুদ্র আরেকবার স্ত্রীর দিকে তাকায়, তারপর ছেলের দিকে। বাবু চোখ বড়বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

আচ্ছা, এই জীবনে কী তার আর কিছু চাওয়ার আছে? জীবনের সমস্ত সমীকরণ কীভাবে যেন মিলে গেল। শুধুমাত্র একজন ভালো জীবন সঙ্গী তাকে এতো বড় খুশি উপহার দিলো! আর কী বা চাওয়ার আছে এক জীবনে? উহু, এই মুহূর্তটা বুকে নিয়ে এক জীবন সে অনায়াসে পাড় করে দিতে পারবে৷ কখন যে টুপ করে একফোঁটা চোখের জল গড়তে লাগে! কী অদ্ভুত জীবনের নিয়ম!

দুঃখ পেলেও কাঁদি আবার খুব খুব সুখেও কেঁদে ফেলি আমরা! জীবনটা এতো বেশি সুন্দর কেনো? কেন বাঁচতে ইচ্ছা করে বারেবারে?

Why life is so peaceful?

~The End~