পরিযায়ী জীবন পর্ব-০১

0
21

#পরিযায়ী_জীবন (পর্ব – ১)

আজ ৩বছর পর মেহরাব দেশে ফিরছে। ৩বছর তার জন্য দীর্ঘ একটা সময়… যার প্রতিটা মুহূর্ত মেহরাব চেষ্টা করে গেছে কিছু স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু তার ছোট্ট হিয়ার অতলে কিছু মুখ এতটাই শক্ত করে শেকড় বিছিয়ে রেখেছে যে, কয়েকশত আলোকবর্ষ দূরে গিয়েও তাদের মুছে ফেলা সম্ভব নয়। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাকি জীবন পরবাসী হয়েই কাটিয়ে দেবার কিন্তু… হুট করে এমন এক সত্য অনাহূতের মতন তার দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, এই শক্ত ইচ্ছেটাও মুহূর্তেই কেমন নড়বড়ে হয়ে গেল। সে আজ ছুটে চলেছে সেই সত্যের মুখোমুখি হতে। সে শঙ্কিত… তার এই পরিযায়ী জীবনের কী সত্যিই তবে ইতি হতে চলেছে? আচ্ছা কোন সংবাদটা তাকে বেশি বিচলিত করছে- তার আম্মার অসুস্থতা নাকি তার শেকড়ের সন্ধান? দুটোই তো তার জন্য তার জীবনের চেয়েও বেশি কিছু। ওদিকে এত সব ভাবনার ভীড়েও আলতো করে তার ব্যক্তিগত অধ্যায়ের অভিমানটাও মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে। গুরুত্ব দিতে না চাইলেও সে নিজের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের জানান দিচ্ছে… মেহরাব আপ্রাণ চেষ্টা করল অভিমানটাকে তুলে রেখে দিতে। নিজের পরিবার ছাড়া তার কাছে এখন আর কোন কিছুই ম্যাটার করে না।

দুপুর প্রায় ৩টার দিকে মেহরাব এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দেখল তার বড় বোন ফাতেমা আর ওর হাজবেন্ড সাগর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। মেহরাবকে দেখতেই ফাতেমা ছুটে এসে কাছে দাঁড়িয়ে দুহাতের আজলায় তার মুখখানা ধরে ছলছল চোখে বলল-

-কেমন আছিস?

মেহরাব কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। তার গলা ভারী হয়ে এসেছে… সে মৃদু স্বরে বলল-

-ভালো… আম্মা কেমন আছে?

-ভালো না। তোর জন্য সারাক্ষণ কাঁদে। তার তো শুধু এক সজীবই আছে…

মেহরাব মুচকি হেসে বলল- আগের মতই রয়ে গেলি বুবু! ছোট আপা আসেনি?

-না। ও আম্মার কাছে আছে। তোকে দেখার আর ধৈর্য হচ্ছিল না বলে চলে এসেছি।

মেহরাব দুলাভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় করে ফাতেমার উদ্দেশ্যে বলল-

-তোর বিচ্ছু দুইটা কই?

-আনিনি। অনেকদিন পর নানুবাড়ি এসেছে তাই আম্মার কাছেই রেখে এসেছি। তার উপর এসেই নতুন বোন পেয়ে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেছে।

-আচ্ছা বাড়ি চল তাড়াতাড়ি। ওদের মত ছোট আপার মেয়েটাকে দেখার জন্য আমারও দেরি সহ্য হচ্ছে না।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে মেহরাব দেখে তার গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা সে খুব শখ করে কিনেছিল। সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি, মোটামুটি সস্তায় ভালো বডি স্ট্রাকচারের গাড়িটা পেয়ে সে লোন করে কিনে ফেলে। প্রথমদিন আম্মাকে নিয়ে ঘুরেছিল সারা শহর। আম্মা এত খুশি হয়েছিল… গাড়িটা তার এক প্রকার গার্লফ্রেন্ডের মত হয়ে গেল। এই নিয়ে ছেলেমানুষীর মত সেই মানুষটার সাথে কত খুনসুটি হয়েছে। ওফ আবার সেই মানুষটা! সেই মানুষটার সাথে তার আর কিছুই নেই তবু তার সব কথা এখনো কেন সেই মানুষটাতে গিয়ে শেষ হয়? সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়িতে উঠল।

একতলার ছোট্ট একটা বাড়ি সাজেদা সুলতানার। স্বামী মারা গেছে ১৪বছর আগে। মেহরাবের কারণে তাদের খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। তিনি যেমন ছেলেকে ছাড়া কিছু বোঝেন না তার ছেলেও তেমন মা আর বোন ছাড়া কিছু বোঝে না। এত আদরের ছেলেটা তাদের ছেড়ে কী করে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকে আল্লাহ জানেন! নাকি তার স্নেহ মমতায় এমন কিছু কমতি ছিল যে, কী এক অভিমানের কাছে সব তুচ্ছ হয়ে গেল?

গতকাল থেকেই সাজেদা অস্থির হয়ে আছেন তার ছেলে আসবে বলে। ছেলের যা যা খেতে পছন্দ সব আনিয়ে রেখেছেন। ছেলের ঘরটা পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখার কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। বার বার ছেলের ঘরে গিয়ে দেখছেন সব ঠিক আছে কি না? আজ সকাল থেকে তার কাছে একটা মুহূর্তও একটা বছর লাগছে। ছোট মেয়ে ফারজানাকে সারাক্ষণ জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন- “সজীবের আর কতক্ষণ লাগব আসতে?” ছেলের জন্য মায়ের অপেক্ষা দেখে ফারজানা মুচকি হাসে। সজীবের কী ভাগ্য, আম্মা ওকে কত্ত ভালোবাসে!

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পর মুহূর্তে মেহরাব বাড়ির গেটে এসে নামে। সে ফাতেমাকে বলে-

-বুবু, আম্মা তো এখন নামাজে বসে গেছে?

-হ্যাঁ।

ঠিক আছে তোরা হইচই করিস না। আম্মার নামাজটা নষ্ট হবে। আমি আস্তে করে ঘড়ে ঢুকতে চাই। ততক্ষণে ফারজানা দরজা খুলে ভাইকে দেখে চিৎকার দিতে যাবে তখনই মেহরাব মুখে আঙুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। ফারজানা টুপ করে চিৎকারটা গিলে নিয়ে দৌড়ে এসে ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। মেহরাব অপ্রস্তুত হয়ে যায়… এই বোন দুটোর সাথে ছোটবেলায় কত মারামারি ঝগড়াঝাটি করেছে। মায়ের কাছে ছেলের নামে রাজ্যের যত অভিযোগ করাটা ছিল দুই বোনের প্রতিদিনের রুটিন। কালক্রমে তারা যত বড় হয়েছে বোনেদের অভিযোগের তালিকা তত সংক্ষিপ্ত হয়েছে। সময়ের দৌড়ে অভিযোগ এক সময় স্নেহের কপট অভিমানে রূপ নিয়েছে। ভালোবাসার একটা নিরব আহ্লাদী যুদ্ধ মেহরাবকে নিয়ে মায়ের সাথে তাদের লেগেই থাকত। সে ফারজানাকে আলতো করে ধরে বলল-

-কেমন আছিস ছোট আপা?

ফারজানা চোখ মুছে বলল- তোকে ছাড়া আমরা কেউ ভালো থাকতে পারতেছিনারে ভাই… আয়, ঘরে আয়।

সবাই ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই মেহরাবের মনে হল- “শান্তি…” কী আপন আর মায়াময় এই পরিবেশ… এই ঘর, এই বাড়ি, এই উঠোন, গাছের ছায়া, ছাদের চিলেকোঠায় টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ… সবকিছু কী স্নিগ্ধ ভালোবাসায় জড়ানো!! আর মানুষগুলো? এরা তার প্রাণ! এই প্রাণ এত দূরে রেখে গিয়ে সে একটা মুহূর্তও ভালো থাকতে পারেনি… তখনই ঘর থেকে ফাতেমার দুই পুত্র ফারাবি আর ফাইয়াজ ছুটে এলো “মামা মামা” বলে। এসেই ঝাপিয়ে পড়ল মামার গায়ে। এই দুটো মামা বলতে পাগল। মেহরাব দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরে। দুইজন একসাথে পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগল-

-“মামা, তুমি কেমন আছ? মা আমাদের এয়ারপোর্টে নিয়ে যায়নি। আমরা কত্ত কান্না করলাম তাও নেয়নি। মামা, প্লেনে চড়লে কেমন লাগে? জানালা দিয়ে মেঘ ধরতে পেরেছিলে? আমরা তো দেখেছিলাম প্লেনটা, হাতও নেড়েছি। তুমি কী আমাদের দেখতে পেয়েছিলে? আমরা তো ছাদেই ছিলাম। মামা মামা, তুমি কী আয়রাকে দেখেছ? ও আমাদের দেখলেই হাসে। তোমাকে দেখলেও হাসবে। ও তোমাকেও অনেক ভালোবাসে। ও হাসলেই কী দেখবা জানো? ওর কোনো দাঁত নেই! হা হা হা হা…” দুই ভাইয়ের কথা শেষই হয়না। মেহরাব খুব মজা পাচ্ছিল দুজনের কথায়। তারা উত্তরের অপেক্ষাও করছে না, সমানে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তাদের ভাবনাগুলো কী চমৎকার! জীবনের কত সুন্দর মুহূর্ত সে হারিয়ে ফেলেছে যা এদের সাথে কাটানো যেত। সেই মুহূর্তে আম্মার গলায় “সজীব…” ডাকটা শুনতে পেল। সে ফারাবি আর ফাইয়াজকে নিয়ে দ্রুত উঠে মায়ের ঘরে চলে গেল। আম্মা এখনো জায়নামাজে বসে আছে। সে সোজা মায়ের পাশে গাঘেঁষে বসে পড়ল। সাজেদা তাকে দুহাতে জাপ্টে ধরে ডুকরে কেঁদে ফেললেন… তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না শুধুই কাঁদছিলেন…

মেহরাব চুপ করে রইল… তার নিজের চোখও চকচক করছে। কতদিন পর আজ মায়ের গায়ের গন্ধ পেল সে! এই মা মা গন্ধটা, মায়ের স্পর্শ সব এমন কেন? কেমন শান্তি শান্তি লাগে… আস্ত দীঘির টলটলে শীতল পানিতে গা এলিয়ে দেবার মত শান্তি! আশ্চর্য এক ঘোরের ভেতর টেনে নিয়ে যায় তাকে! সেই ছোটবেলা থেকেই মেহরাব মায়ের কোলে, গাঘেঁষে থেকেছে শুধু মায়ের গায়ের গন্ধ নেবে বলে। সে এই মায়াময় ঘ্রাণটার অনুভবে মিশে গিয়ে কেবলই জানতে চেয়েছে তার জন্মদাত্রী মায়ের গায়ের ঘ্রাণটাও কী এমনই হত? তার স্পর্শও কী এমন শীতলকরা হত? তার মুখটাও কী দেখতে এমন প্রশান্তির হত?

রাতে ফাতেমা তার দুই পুত্রকে একসাথে দুইপাশে বসিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছিল। সাজেদা আজ অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজেই সব রেঁধেছেন। তার ছেলের জন্য রেঁধেছেন। মেহরাব খেতে বসে বলল-

-আম্মা তুমিও বসো না?

-বসব, তুই খেতে শুরু কর। কতদিন তোর খাওয়া দেখি না!

-হুম… অনেকদিন…

সাজেদা খেয়াল করল সজীব খাবারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে না। তার চোখ চকচক করে উঠল… বাচ্চাগুলো কেন বড় হয়ে যায়? কী হয় বললে যে, “আম্মা তোমার হাতে খাব?” নাহ, ভুলটা তো তারই হয়েছে। তারই উচিত ছিল নিজের হাতে খাবার তুলে দেয়া। সে তখন প্লেটটা টেনে নিয়ে ভাত মেখে ছেলের মুখে তুলে দিল। মেহরাব চুপচাপ খেয়ে নিল। অনেকদিন পর আজ তার খাওয়ায় তৃপ্তি হচ্ছে। ফারাবি আর ফাইয়াজ তখন চেঁচিয়ে বলতে লাগল- “মামা একা খেতে পারে না, মামা একা খেতে পারে না…।” সাজেদা হেসে বললেন- “তোরা তোর মায়ের হাতে খাইতেছিস খা, আমার ছেলের দিকে তাকাস কেন? আমার ছেলেও তার মায়ের হাতে খাবে।”

তারপরও দুই ভাই সুরে সুরে তাল মিলিয়ে একই কথা বলতে লাগল। সবাই ওদের কথায় হাসতে লাগল। এই বাচ্চাগুলোই তো বাড়ির আনন্দ, ঝলমলে রঙ।

খাওয়া শেষ হলে সবাই মিলে মায়ের ঘরে বসেছে। মেহরাবকে দেখে মায়ের শরীর নাকি অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছে! তার আর কোন কষ্টই হচ্ছে না। কিন্তু মেহরাব বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মায়ের শরীরটা মোটেও ভালো নেই। খুব বেশিই স্বাস্থ্যহানি হয়েছে তার, খেতে নাকি ভালোই লাগে না, মাঝে মাঝেই জ্বর আসে, সারা শরীর ব্যথা করে, কাশির জন্য রাতে ঘুমাতে পারে না। প্রায়ই কাশির সাথে রক্ত যায়। সে প্রাথমিক চেকাপ করে নিল। প্রেসার অনেক বেশি সাথে সুগার লেভেলও হাই! তবে এতটুকুই তার অসুস্থতার কারণ নয় আরও কিছু আছে যা টেস্ট করলেই শিওর হওয়া যাবে। তবে সে যা আশঙ্কা করছে সেটা তাকে ভেতরে ভেতরে আতংকিত করে তুলেছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে সে মায়ের মুখে লেপ্টে থাকা আনন্দটা উপভোগ করতে লাগল। বোনেরাও তার পাশে এসে বসে বিদেশের গল্প জানতে চাইছে। তবে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত তার দুই ভাগ্নে। তারা লাগেজ গাড়ি বানিয়ে ঠেলাঠেলি করে খেলছে আর অপেক্ষা করছে কখন এগুলো খোলা হবে আর তারা চকলেট পাবে? মেহরাব তার লাগেজ থেকে সবার জন্য আনা জিনিস গুলো বের করল। প্রথমে ফারাবি, ফাইয়াজকে তাদের চকলেট আর খেলনা দিল তারপর আয়রার জন্য একটা গোল্ডের চেইন দিল। আয়রাকে সে প্রথম দেখছে তাই তার জন্য অনেক ভেবে চিন্তে এটা এনেছে। তারপর দুই বোনকে দুইজোড়া কানের দুল আর কিছু কসমেটিকস দিল, সেসব পেয়ে তারা মহা খুশি। মেহরাব বলল-

-হুট করে আসতে হয়েছে বলে কিছু শপিং করতে পারিনি আর তাছাড়া শপিং এর মনমানসিকতাও আসেনি। এবার তোরা কিছু বলিস না। আম্মা সুস্থ হলে ফিরে গিয়ে তোদের যা যা লাগে লিস্ট দিয়ে দিস সব পাঠিয়ে দিব। তারপর সে মায়ের জন্য আনা জিনিসগুলো বের করল। সাজেদা দেখেছে তার ছেলে যখন থেকে রোজগার করতে শিখেছে তখন থেকেই তার জন্য যা কিছু এনেছে তার সবই দুটো করে এনেছে। তার হাতে দিয়ে বলেছে- “একটা তোমার জন্য আর অন্যটা অসহায় কাউকে দিয়ে দিও।” সজীব না বললেও সাজেদা বুঝতে পারে আরেকটা সে তার নিজের মায়ের কথা ভেবে আনে! এই যে সে সজীবকে এত স্নেহ করে নিজের গর্ভের কন্যাদের চেয়েও বেশি তারপরও সজীবের ভেতর নিজের মায়ের প্রতি আলাদা করে ভালোবাসা জমিয়ে রাখা! সাজেদা এসবই টের পায়। আর এই ব্যাপারটাই তাকে ভেতর থেকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে চলেছে এতকাল ধরে…

রাতে মেহরাব তার ঘরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছিল। মনের ভেতর চাপা উত্তেজনা আর জেট লেগের কারণে ঘুম আসছিল না। এমন সময় তার আম্মা আসেন। মেহরাব অবাক হয়ে বলে-

-আম্মা তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?

-ঘুম আসেনারে বাপ… ওই এক ইতিহাস চাইপা রাইখা বহু বছর না ঘুমায় পার করলাম। আর না… আমি আজকেই তোরে সব বলব। তুই কী বুঝবি জানি না কিন্তু আমি আর পারতেছি না…

মেহরাব সতর্ক দৃষ্টিতে বলল- বহু বছরের চেপে রাখা ইতিহাস?

-আমি শুরু থেকেই তোমার কাছে বিষয়টা গোপন রাখছিলাম… এখন আর পারতেছি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি তোমারে সব বইলা যাইতে চাই। শরীরটা তো আর চলতেছে না, কখন চইলা যাই?

-“শুরু থেকেই বিষয়টা গোপন রাখছিলাম” কথাটা মেহরাবের মনে অস্থিরতা তৈরি করল কিন্তু সেটা চেপে গিয়ে বলল- আম্মা এভাবে বলবা না। কিচ্ছু হয়নি তোমার, তুমি ঠিক আছ। আর… আমি আছি তো, কী বলতে চাও সময় করে বলো সমস্যা নেই।

-না বাজান, আমারে বলতে দেও। আইজ আমি তোমারে সব বলব। শরীরটা ভালো লাগে না… কোন মুহূর্তে আল্লাহপাকের হুকুম হয়ে যাবে আর আজরাইল দরজায় হাজির হবে। পরে আর বলা হইব না।

-আম্মা, তুমি এগুলা কী সব বলতেছ? এমন করলে আমি আবার চলে যাব।

সাজেদা হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলেন। এইটা তার নিজের ছেলে, আর কারো না। আর কারো হতেই পারে না। তিনি ছেলের হাত ধরে বলতে লাগলেন-

-তুমি কোন কথা বইল না বাবা, আজকে আমাকে বলতেই হবে। তারপর সাজেদা বলতে শুরু করে- তুমি আমাদের জীবনে আসার আগে আমাদের আর্থিক অবস্থা মোটেও ভালো ছিল না। আমরা তখন যে এলাকায় থাকতাম সেখানে এক নামকরা লোকসংগীত শিল্পী থাকত। দেশ-বিদেশ তার অনেক সুনাম। গান গাইতে প্রায়ই দেশের বাইরে যাইত। সে বিখ্যাত হলেও অশিক্ষিত ছিল। তার স্বামী ছিল না, একমাত্র মেয়ে ছিল কলি। মেয়েটাও পড়ালেখা করে নাই। তাদের গানের দলে যারা কাজ করত সবই ছিল অশিক্ষিত। তাই এত বড় বিখ্যাত গায়িকা হয়েও নিজের উন্নতি করতে পারে নাই। তাদের বাড়িতেই আমি টুকটাক কাজ করে দিতাম। তার একমাত্র মেয়ে কলির একমাত্র ছেলেটা একদিন অপঘাতে মারা যায়। নাতি মারা যাওয়ায় তার মেয়ের অবস্থা পাগল পাগল। তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় একটা ছেলে কারো কাছ থেকে পালক নিবে। কিন্তু পালক নিলেও ঝামেলা থাকে তাই সে সিদ্ধান্ত নিল হাসপাতাল থেকে বাচ্চা চুরি করবে! তারপর নিজের ছেলে বলে বড় করবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। এক হাসপাতালে তাদের পরিচিত এক নার্সকে মোটা টাকা খাওয়ায় রাজি করায় ফেলে। তারপর একদিন বোরকা পরে গিয়ে হাসপাতাল থেকে এক পুত্র সন্তান চুরি করে আনে। এত কষ্ট করে যাকে চুরি কইরা আনল দুইদিন না যাইতেই তার প্রতি অবহেলা হইতে লাগল! কলি ছোটবেলা থেকে মায়ের সাথে গানের জন্য এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায় বড় হইছে। তাই সংসার, পরিবারের প্রতি যে আলাদা একটা মায়া থাকে সেইটা কলির মধ্যে তৈরি হয় নাই। সেইজন্যই হুট করে আবেগে পড়ে ছেলে একটা চুরি করে এনে তার যত্ন সে নিতে পারতেছিল না। ছেলেটা ওর কাছে এক প্রকার যন্ত্রণা হয়ে গেল। তাই সেই বাচ্চার দেখাশোনা আমিই করতে লাগলাম। কী মায়া মায়া চেহারার ছেলে একটা… কার বুক খালি করে এনে তারে এমন অযত্নে রাখছে!!! নিজের হাতে এরে খাওয়াই, ঘুম পাড়াই, পিশাব-পায়খানা পরিষ্কার করি, গোসল করাই… কী যে এক শান্তি লাগে কলিজাটার মধ্যে। সেও আমার উপর অভ্যস্ত হয়ে গেল, সারাক্ষণ আমারেই খোঁজে। আমার মনে হইত এ আমার নিজের ছেলে! এর মায়ায় আমার বুক পুইড়া যায়… এক দিন সাহস কইরা কলিকে বললাম-

-বুবু, ছেলেটারে দিবা আমাকে? তোমরা তো গান বাজনা নিয়াই ব্যস্ত থাকো আমি নাহয় ওরে নিয়া নেই?

কলি ২য় বার ভাবার সময় নিল না। বলল- যা, নিয়া যা। নিলে একবারে নিয়া যা। আমার কাছে আর কোনদিন আনবি না। এইটারে আইনা আসলে ভুলই হইছে। ফেরত দেওয়ার উপায় থাকলে কবেই দিয়া আসতাম।

-আমি একবারেই নিয়া যাব। ওরে আমার ছেলে বইলাই পালব। তোমার কথা ওরে কোনদিন জানতে দিব না। কলি আর কথা খরচের ঝামেলায় গেল না। তবে বলে দিল- “একে নিয়ে যা কিন্তু ভবিষ্যতে একে নিয়া আমি কোন রকম ঝামেলা যেন হইতে না দেখি। আমি তোরে বা এরে কাউকেই চিনি না। এর সাথে আমার কোনো রকম কোনো সম্পর্ক নাই। যদি কখনো উল্টা পাল্টা কিছু মাথায় আসে তাইলে মনে রাখিস, আমার বিরুদ্ধে কিন্তু কোন প্রমাণ নাই। আমারে ফাসাইতে চাইলে আমি সোজা বইলা দিব এরে তুই চুরি করছিস। আর টাকা দিয়া সবই সম্ভব। তাই আমাকে এর মধ্যে ভুলেও টানার চেষ্টা করিস না।”
আমি তখন তারে বললাম- বুবু তুমি এইসব নিয়া কোনো চিন্তা কইর না। আমি কাক-পক্ষিকেও জানতে দিব না এ আমার ছেলে না। পরে আমি তারে নিয়া আসলাম। তখন তার ৫মাস বয়স। সেই থেকে সে আমার নিজের ছেলে। নিজের নামের সাথে মিলায় নাম রাখলাম “সজীব”। এই যে আমি তারে আমার ছেলে বইলা পালতে লাগলাম আমার ভিতরে কিন্তু শান্তি নাই। যদি কোনদিন ছেলে সব জাইনা যায়? আমাকে অপরাধী মনে করে? আমাকে স্বার্থপর ভাবে? আমার তখন কেমন লাগব? আমি তখন ছেলের আসল মায়ের খোঁজ করলাম। কাজটা অনেক কঠিন আছিল, কেউ কী আর এই বিষয়ে মুখ খোলে? অনেক যন্ত্রণা কইরা নার্সকে পুলিশের ভয় দেখায় ছেলের মাকে খুঁজে বাইর করলাম। তাতে কয়েক মাস সময় লাগল। জানলাম ছেলে ভালো ঘরেরই সন্তান। বাবা স্কুলের হেড মাস্টার আর মাও স্কুলের মাস্টার। তাদের দুইটা ছেলে আছে। এইসব জানার পর মনেহইল, তাদের তো দুইটা ছেলে আছেই একটা ছেলে আমি রাইখা দিলে খুব পাপ হবে না। তাছাড়া আমি তো ছেলে চুরি করি নাই বরং অযত্ন অবহেলা থেকে তাকে রক্ষা করছি। তারা বাপ মা দুইজনেই খুব নরম মনের মানুষ তাই হাসপাতালের সাথে মামলা কইরাও কিছু করতে পারে নাই। আমি আর তাদের কিছু জানাইলাম না। আসলে সেইটাও না… ওই ছোট্ট মুখটার উপর এত মায়া বইসা গেছে যে, ওরে দিয়া দিলে আমি কেমনে থাকব? তাই সাহস কইরা সব চাইপা গেলাম। ছেলের মায়ের নাম মেহেরুন্নেসা আর বাবার নাম কামরুল হাসান। ছেলে যেন বাপ মায়ের ছায়া ছাড়া না হয় তাই তাদের নামের সাথে মিলায় ছেলের নাম দিলাম “মেহরাব হাসান সজীব”। আমার দুইটা মেয়ে, অভাবের সংসার… তারপরেও আমি তাকে পালতে কোন কিছুর কার্পণ্য করি নাই। তার কারণেই হয়ত আল্লাহ আমার সংসারে বরকত বাড়ায় দিল। ফাতেমার বাপের আয় বাড়তে লাগল। সে রিকশা চালান বাদ দিয়া এক সময় ছোট একটা চায়ের দোকান নিল। সেই দোকানে আল্লাহপাক বরকত ঢাইলা দিছে। তুই বড় হইলি আস্তে আস্তে, তোরে স্কুলে দিলাম। যখন থেকে বুঝতে শিখলি তখন থেকে নতুন করে জ্বালা শুরু হইল। এলাকার সবাই জানে আমার সজীব আমার নিজের না তাই সেই কথা তোর কানে যাইতে খুব সময় লাগল না। তুই বাইরে থেকে আইসা খালি জিজ্ঞেস করতি আর কান্নাকাটি করতি। আমি তোকে বুঝাইতাম সবাই মিথ্যা বলছে, মজা করছে। তোর গায়ের রঙ আমাগো থেকে বেশি পরিষ্কার দেখে সবাই এইসব মজা করে বলে বুঝ দিতাম। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তুই সবই বুইঝা গেলি। যখন থেকে বুঝলি তখন থেকে আর এইসব নিয়া কান্নাকাটি করতি না। কিন্তু একদিন জানতে চাইছিলি তোর আসল মা-বাপ কই? আমি সেদিনও সত্য বলতে পারি নাই… কারণ আমি তোরে হারাইতে চাই নাই বাপ… আমার অপরাধ হইছে, অনেক বড় অপরাধ হইছে, যার ক্ষমা নাই। আমি স্বার্থপরের মতন তোকে আমার কাছে রাইখা দিছি, তোর মায়ের কোলে ফিরায় দেই নাই… কিন্তু সেইজন্য নিজেও ভালো থাকি নাই। সারাটা জীবন চাপা যন্ত্রণা নিয়া আছি, যন্ত্রণা সহ্য করছি তাও তোকে দিয়া দিতে পারি নাই। কেমনে দিবরে বাপ… বলে সাজেদা কান্নায় ভেঙে পড়লেন আবার। মেহরাব তাকে শান্তনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। সে মাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে চোখের পানি ফেলে। সে কী আসলেই ভাগ্য বঞ্চিত? না। যে এমন একটা মা পেয়ে যায়, এমন একটা পরিবার পেয়ে যায় সে কিছুতেই ভাগ্য বঞ্চিত নয়। যে ভালোবাসা সে এখান থেকে পেয়েছে তা তার নিজের পরিবার থেকে পেত কিনা কে জানে? সে তার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। সৃষ্টিকর্তা কখনো ভুল করেন না। মায়ের যে তীব্র ভালোবাসা সে পেয়েছে তার কাছে এটাকে সে কোনো অপরাধ বলতে নারাজ। এরপরের গল্পটা তার জানা। সে যখন বুঝে গেল এই পরিবার আসলে তার নিজের নয় তখন থেকে নিজের শেকড়ের সন্ধান করতে লাগল। কিন্তু এত বছর পর ওই ছোট বয়সে সেটা কী করে পাওয়া যায়? তাই সে ভাবল তাকে প্রচুর পড়তে হবে। সে বড় হয়ে ডাক্তার হবে তারপর নিজেই নিজের শেকড়ের সন্ধান করবে। সেই জেদ থেকেই সে নিজেকে নতুন করে ভেঙে সাজায়। তার স্বপ্ন পূরণ করতে ডাক্তার হয়। যেটা এমন একটা পরিবারে থেকে মোটেও সহজ ছিল না। এর জন্য সবাইকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আজ সে একজন নামকরা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ।

সাজেদা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে হাতের মুঠো থেকে ভাঁজ করা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ ছেলের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন- এইখানে তাদের ঠিকানা লিখা আছে। গোপন করা সব কথাই আজ বলে দিলাম… এখন তুই যদি আমাকে দোষী মনে করস, আমাকে আর আম্মা না বলস তাইলে… আর কিছু বলতে পারল না সাজেদা, কান্নায় ভেঙে পড়ল।

সজীব কাগজটা শক্ত করে মুঠোবন্দি করে নিল। হ্যাঁ, তার হাতের মুঠোতেই এখন লুকিয়ে আছে তার বহু বছরের আরাধনা। কিন্তু কী এক কারণে যা পাবার জন্য সে এত বছর মহাকালের পেছনে ছুটে চলেছে তা আজ হাতের মুঠোয় পেয়েও আনন্দের চূড়ান্ত সীমানা ছুতে পারছে না! সে কোনো কথা না বলে মায়ের কোলে শুয়ে পড়ল। ছেলের গায়ে একটা হাত রাখতেই সজীব সে হাত শক্ত করে ধরে রাখল। সাজেদা অন্য হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে। আঁচলের ফাঁক গলে বাঁধ না মানা চোখের পানি টুপটাপ গড়িয়ে পড়ে মেহরাবের গাল ভিজিয়ে দিতে লাগল।

রাতে মেহরাবের ঘুম হল না। সাজেদা তার ঘর থেকে চলে যেতেই সব কিছু তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। একা নির্জনে ভাবনারা জাল বিছাতে শুরু করে গড়িয়ে নিল বহুদূর। তার মস্তিষ্কে কিছু শব্দ যুক্ত হতে শুরু করল- “সব জেনেও আম্মা তাকে নিজের করে রেখেছে। একবারও তার জায়গা থেকে ভাবেনি, বেড়ে ওঠার পর তার এত হাহাকার একবারও আম্মাকে স্পর্শ করল না! হ্যাঁ তিনি ছেলে হিসেবে তাকে ভালোবাসা দিতে কোনো কার্পণ্য করেননি কিন্তু সেটা কী আসলেই নিখাঁদ ছিল? এতগুলো বছর ধরে আগাগোড়া তিনি তো কেবল নিজের কথাই ভেবেছেন। মেহরাবের কথা তো একবারও ভাবেনি! তিনি আসলে চূড়ান্ত স্বার্থপর একজন মহিলা!” মেহরাবের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, চোখে আগুন!

চলবে।