পাতা বাহার পর্ব-২৫+২৬

0
894

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৫ (প্রথম অংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

গুড়ুম গুড়ুম মেঘ ডাকছে মেদিনী জুড়ে।‌বর্ষাকালে বৃষ্টির কোনো ভরসা নেই যখন তখন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো বলে। আজকে সকালেও ঝলমলিয়ে রোদ উঠেছিল। এমনকি দুপুরের দিকেও মেঘের ছিটেফোঁটা ছিল না। হুট করে কোথা থেকে মেঘমল্লার তার দলবল পসরা নিয়ে হাজির হলো জানা নেই। নীল সাদা মেঘমালা ঈশান কোণে চোখ পাকিয়ে চেয়ে আছে। যেন বলছে অতিশীঘ্রই বর্ষণে তোমাদের পরিবেশ শীতলতায় ছেয়ে যাবে। বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই যেন ঝড়ের পূর্বাভাস! তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছ থেকে এমন কোনো পূর্বাভাস পাওয়া যায় নি।বৃষ্টির পূর্বে সাধারণত ভ্যাপসা গরম থাকে আজকেও ব্যতিক্রম নয়। ভ্যাপসা গরমের ভিতর বৈদ্যুতিক সংযোগ ছিনিমিনি খেলছে জনগনের সাথে। মেঘ দেখে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আতিকুর ইসলাম আজ বাড়িতেই। অফিসে ঈদের ছুটি পড়েছে। ঈদের যে বেশি দিন‌ বাকি নেই, মাত্র চার দিন। তিনি খবরের কাগজ পড়তে ব্যস্ত। তার সামনে বসে রাতুল ভুঁইয়া মেয়েকে কোলে নিয়ে ফোনে কার্টুন দেখছে। লাবিব মুখ ফুলিয়ে বাবার পাশে বসে ঘার উঁচিয়ে ফোনে উঁকি দিয়ে দেখছে। একটু আগেই মায়ের ঝাড়ি পড়েছে। লতা এখনো পাতার উপর রেগে আছে। কথা বলে তবে খোঁচা মেরে। লাবনী আক্তার আজ ব্যস্ত মানবী। সকাল থেকেই একটা পর একটা কাজে লেগেই আছে। এখন রান্নাবান্নার তোরজোড় চালাচ্ছে। আর তাকে সাহায্য করছে লতা। হরেক রকমের পদ রান্না হচ্ছে আজকের বিকেলের মেনুতে। আর এতোসব আয়োজনের উদ্দেশ্য বাড়িতে মেহমান আসবে। আর বাঙালি মেহমান আপ্যায়নে সর্বস্বই করতে প্রস্তুত। এক্ষেত্রে কৃপণতা তাদের ঔদ্ধত্যে নেই। আর মেহমান যদি হয় মেয়ের শশুর বাড়ী থেকে তাহলে তো কথাই নেই। বাঙালি মায়েরা পারেনা পুরো রেস্টুরেন্ট খুলে দেয়। লাবনী আক্তারের আয়োজন কিছুটা সেরকমই। পাতা লুবমান বসে নেই। মায়ের আদেশে পুরো ঘরবাড়ি ধোয়া মোছা, পরিষ্কার সহ গোছানো তাদের দায়িত্ব। লুবমান ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছিল ,

-” মেহমান তো পাতাকেই দেখতে আসছে। ও কাজ করলে চেহারার গ্লো..”

আর বলতে পারে নি। লাবনী আক্তার স্পষ্ট করে বলেছেন,

-” তো কি হয়েছে? আমার মেয়েদের চেহারা এমন যে ফকিন্নি বেশে থাকলেও কেউ অপছন্দ করবে না। আর তাছাড়া বিয়ে টা যেহেতু হয়ে গেছে পছন্দ হওয়া, না হওয়া ম্যাটার করে না। ওরা ভারি বড়লোক পরিবারের! আমরা মধ্যবিত্ত। এখন সেটা তো বদলাতে পারবো না তবে তারা যেন বলতে পারে মধ্যবিত্ত না হয় পরিবেশ ভালো! তাই বকবক না করে কাজে হাত লাগা!”

লুবমান আর বলার সাহস পায় না। সবাই মিলেমিশে সব কাজ সেরে ফেলে। মেহমান আসার সময় হয়েছে সাথে বৃষ্টিও এলো বলে। পাতা গোসল সেরে এসে ফ্যান ছেড়ে চুল শুকাচ্ছে। লতা নিজের বেশ কিছু শাড়ি ওর্নামেন্টস নিয়ে এসে পাতাকে দেখায়। কোনটা পড়বে বললে পাতা জলপাই রঙের একটি বেনারসী শাড়ি পছন্দ করে। লতা তার সাথে মেচিং জুয়েলারি রেখে বাকি গুলো রেখে আসে। পাতা চুল শুকিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তার চুল গুলো ছোট। কাঁধ থেকে অল্প একটু নিচে তবে বেশ গোছের। খোঁপা করলে মনে হবে দীঘল লম্বা কেশবতী হবে হয়তো, নয়তো এতো মোটা খোঁপা! চুল গুলো শুকিয়ে যাওয়ায় চিরুনি করে মাথায়। দৃষ্টি আয়নাতে দৃশ্যমান নিজ প্রতিচ্ছবিতে বিদ্ধ! পাতা একটু নার্ভাস!একটু এক্সাইটেড! একটু সংকিত! কি লেখা আছে তার নসিবে? কেমন হবে তার ভবিষ্যতের পথচলা? যার সাথে তার পথচলা তাকে পাশে পাবে তো? মাঝরাস্তায় হাত ছেড়ে একা ফেলে চলে যাবে না তো? এমন হলে কি করবে পাতা? কোথায় যাবে? কেমনে শ্বাস নেবে? সে উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করে, ‘ ইয়া আল্লাহ তুমি রহিম রহমান! একটু রহম রেখ সর্বদা!’ তার ভাবনার মাঝেই লতা ঘরে আসে। শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে বলে,

-” ওনারা এলো বলে! আম্মু জলদি রেডি হতে বলল! তারাতাড়ি আয়!”

পাতা এগিয়ে এসে লতাকে জড়িয়ে ধরলাম গালে চুমু খায়।

-” আপু! এখন রাগ কমাও তো! এমন লতা আপু ভালো লাগে না! আর কটা দিনই তো আছি! একটু বেশি করে ভালোবাসা দিবে তা না!”

লতার কঠোর মনটা নরম হয়। বোনটাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। তাই তো বোনের ভবিষ্যত নিয়ে এতো সংশয়! কি হবে? ছোট থেকেই সয়েই আসছে বোনটা ভবিষ্যতে কি স্বস্তির দেখা মিলবে? ভালোবাসার কাঙালিনী সুখের রাজ্যের দেখা পাবে?
সে নরম কণ্ঠে পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” জামাই বাড়ি যাওয়ার জন্য‌ এতো তাড়া? নাকি এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার?”

পাতা মাথা তোলে। লতাকে ছেড়ে শান্ত চোখে বোনের দিকে চায়‌। মলিন হেসে বলে,

-” তোমাদের দায়িত্ব নামক বোঝা থেকে মুক্তি দেওয়ার বেশি তাড়া!”

বলে বিছানায় রাখা প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে। লতা মলিন চোখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। হে পরম করুণাময়, ছোট্ট বোনটাকে একটু সুখের সংসার জীবন দান করো!
_____

একটা বড় গাড়ি এসে থামলো পাতাদের বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে। গাড়ি থামার সাথে সাথে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে ছোট্ট একটি বাচ্চা। পরনে হাফ প্যান্ট ও‌ টি শার্ট। তার সাথে আরেকটা বাচ্চা মেয়ে হালকা গোলাপি রঙের ফ্রক পরে। মাথায় ছোট একটি ঝুটি সেখানে রঙ বেরঙের ক্লিপের সমাহার। ঠোঁটে টকটকে লাল লিপস্টিক। বাচ্চা ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে দৌড় লাগায়। মেয়েটিও তার সাথে পা চালিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতরে ঢোকে। গাড়ি থেকে নেমে আসা লোকজন পেছন থেকে ডাক দেয়,

-” আরে আস্তে যাও পড়ে যাবে তো! ভোর, আনি?”

নাহ! তাঁদের কথা শোনার সময় নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে ভোর আনিকাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আম্মু দেখতে অনেক সুন্দর আর কিউট। একদম পাতাবাহারের মতো। বুঝলি?”

আনিকা ভেংচি কেটে বলে,

-” আচ্ছা দেখা যাবে! তুই বললি স্কুলের সবাইকে আদর করে! আমাকেও করবে?”

ভোর দৌড়ানি থামিয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

-” করেই তো! তবে এখন আমার আম্মু তাই শুধু আমাকে আদর করবে! তুই কিন্তু ভুলেও আমার আদরে ভাগ বসাতে আসবি না। আর আম্মুর কোলেও উঠবি না!চল?”

বলে আবার দৌড় লাগায়। দরজা খোলা থাকায় প্রবেশ করতে অসুবিধা হয় না। তবে ভিতরে ঢুকেই নজরে আসে সোফায় বসা আতিকুর ইসলামের দিকে। আরো একটা লোক যাকে ভোর এর আগে দেখে নি। ভোর দৌড় থামিয়ে ভদ্র ছেলের মতো দাঁড়িয়ে সালাম দেয় আতিকুর ইসলামকে,

-” আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল কেমন আছো?”

ড্রয়িংরুমে উপস্থিত সবাই তাদের দিকে চায়। ভোর মিষ্টি হাসে। আতিকুর ইসলাম সালামের জবাব নিয়ে দাঁড়ায়। লুবমান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভোরের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-” এই ছোট প্যাকেট! তোর বাপও আমার আব্বুকে আঙ্কেল ডাকে আবার তুই ও ডাকছিস?”

ভোরের হাসিমাখা মুখ চুপসে যায়‌,

-” তো কি ডাকবো?”

আতিকুর ইসলাম এগিয়ে এসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” নানু বলে ডাকবে ঠিকাছে? এই মিষ্টি মেয়েটা কে?”

ভোর মাথা নাড়ে বাধ্য ছেলের মতো। আনিকা ভোরের হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। ভোর হেসে বলে,

-” ও আনি! আমার বোন হয়!”

আতিকুর ইসলামের কপালে ভাঁজ পরে। বোন? ভোর পাতার রুমের দিকে চায়। সেখানে দরজা দিয়ে পাতা উঁকি দিয়ে মাথা বের করে এদিকেই তাকিয়ে। ভোরকে ইশারায় ডাকে। ভোরের খুশি দেখে কে! সে আনিকার হাত টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,

-” আম্মু? আনি ওই যে আমার আম্মু!”

বলে তাকে টেনে পাতার ঘরে নিয়ে যায়। আতিকুর ইসলাম ও রাতুল বেরিয়ে যায় মেহমানদের এগিয়ে আনতে। লুবমান সোফায় বসে রুম্পাকে কোলে নিয়ে লাবিবের গালে টোকা দেয়। লাবিব মামার গলা জড়িয়ে ধরে। ওদিকে কিচেনের সব কাজ সেরে লাবনী আক্তার রুমে যায়। কাপড়টা পাল্টে নেওয়া যাক। এরকম বেশে মেহমানদের সামনে যাওয়া কেমন দেখায়!

পাতাকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছিল লতা। ভোরের মিষ্টি গলা শুনে বুঝতে বাকি নেই সবাই এসে গেছে।তাই শাড়ি পড়া বাকি রেখে উঁকি দিয়েছিল মনে একরাশ কৌতূহল নিয়ে। ভোর রুমে ঢুকেই পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে ডাকে,

-” আম্মু! আই মিসড ইউ সো মাচ! আজকে তোমাকে নিয়ে যাবো কিন্তু।”

পাতা হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। লতা পাতার শাড়ির কুঁচি করতে করতে জবাব দেয়,

-” বাহ্ আমাদের ভুলে গেলে?”

ভোর পাতাকে ছেড়ে মিষ্টি হেসে লতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভুলিনি তোমাকেও মনে আছে তো!”

আনিকা নিরব দর্শক। সে পাতার দিকে চায়। এটাই ভোরের আম্মু? ভোর ঠিক বলেছে! সুন্দর দেখতে। পাতা আনিকাকে ডাকে। আনিকা এগিয়ে যায়। লতা শাড়ির কুঁচি দিচ্ছে দেখে কোলে তুলতে পারে না। থুতনিতে হাত রেখে বলে,

-” কি কিউট বাচ্চা! একদম বারবি ডলের মতো! ইশ! তোমার নাম কি সোনা?”

প্রশংসায় আনিকার চোখ উজ্জ্বল হয়। কি সুন্দর করে কথা বলে? একদম ডিজনে কার্টুন দের মতো! আনিকা হাসিমুখে বলে,

-” আনিকা সরকার! তুমি ভোরের আম্মু?তোমার নাম কি?”

পাতা তার গাল টিপে বলে,

-” হুম! আমার নাম পাতা! গাছের পাতা না কিন্তু!”

আনিকা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। লতা পাতার কুঁচি গুঁজে দেয়। পাতা আনিকাকে কোলে তুলে নিল। কি মিষ্টি মেয়ে! দেখতে পুরাই পুতুল।

লতাও তার গাল টিপে দিয়ে বলে,

-” সত্যিই পুতুল! পাতা পরে আদর করিস! আগে শাড়ি পরিয়ে দিই।‌ আবার চুলও বাঁধতে হবে।”

দু গালে দুটো চুমু দিয়ে পাতা আনিকাকে নামিয়ে দিল। ভোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু আনিকাকে আদর করলো! তাকে না? আনিকাকে পেয়ে তাকে ভুলে গেল!তার সাথে কথাও বলল না। এই আনির বাচ্চাকে আনাই ভুল হয়েছে! সে গাল ফুলিয়ে নিল। আনিকা পাতার কোল থেকে নেমে ভোরের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-” তোর আম্মু খুব ভালো! আমায় কত আদর করলো দেখলি?”

ভোর কিছু বলে না। সে মলিন মুখে পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। লতা পাতার কুঁচি ঠিক করে আঁচল ঠিক করে দিতে দিতে বলে,

-” ভোর কে কে এসেছে? তোমার আব্বু এসেছে?”

ভোর লতার দিকে তাকিয়ে বাবার মতো গম্ভীর মুখে বলে,

-” আব্বু, দাদি, চাচ্চু, চাচিমনি, ফুপ্পিমনি,রুপ আমরা সবাই এসেছি!”

পাতা ভ্রু কুঁচকে ভোরের দিকে চায়। কণ্ঠটা চেঞ্জ হয়ে গেল না? সে আর ভাবতে পারে না‌ কেউ দরজায় কড়া নাড়ে। লতা পাতার আঁচল ঠিক করে দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বলে,

-” কে? ভিতরে আসুন!”

ভেজানো দরজা খুলে হাসি মুখে প্রবেশ করে আদুরি ও রুবি! আদুরি সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বলে,

-” আরে আরে ভোর তোমার আম্মু কোনটা ? এতো দেখছি দুটো অপ্সরা দাঁড়িয়ে আছে!”

ভোর আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয়। পাতা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। অধরকোনে লজ্জালু হাসি মেখে। লতা‌ বোনের কাঁধ জড়িয়ে বলে,

-” এই আপনাদের আমানত!”

আদুরি পাতার দিকে চায়। মিষ্টি একটা মেয়ে।

-” মাশাআল্লাহ! কি মিষ্টি দেখতে! আমি আদুরি! অরুণ ভাইয়ের ছোট ও একমাত্র বোন! আর এটা আমার আরেক ভাই আরিয়ান সরকারের একমাত্র স্ত্রী আমার ছোট ভাবি!”

পাতা মিনমিন করে সালাম দেয়। রুবি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এগিয়ে আসে। চেনা চেনা লাগছে! মস্তিষ্ক ঘেটে ঘেটে পরে চিনতে পারে এটা তো সেই পার্টির ঝগরুটে মেয়ে! এই মেয়েটাই অরুণ ভাইয়ের বউ? এ তো পিচ্চি মেয়ে। এখন শাড়ি পড়ায় একটু বড় বড় লাগছে।‌ সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” তুমি সেই মেয়েটা না? ওই দিন জন্মদিনের পার্টিতে আরিয়ানের সাথে ঝগড়া করছিলে?”

পাতা জিভে কামড় দেয়। ইশ! চিনে ফেলেছে! কি ভাবছে তার বিষয়ে! ইয়া আল্লাহ! জামাই বাড়ি যাওয়ার আগেই ইমেজ নষ্ট হয়ে গেল। লতা ,আদুরি বুঝতে পারে না ।‌আদুরি রুবির হাত ঝাঁকিয়ে বলে,

-‘ চেনো তুমি?”

রুবি মাথা ঝাঁকিয়ে কিছু বলবে পাতা মিনমিন করে বলে,

-” সেদিন আমার দোষ ছিল। আমি স্যরিও বলেছিলাম। তবুও উনি বেয়াদব স্টুপিড বলেই চলেছিল।ওনারও কিন্তু দোষ ছিল হুম!”

রুবি হেসে ওঠে। পাতা তার হাসি দেখে যেন একটু স্বস্তি পায়।‌ লতা আদুরি কিছু বুঝতে পারে না। রুবি তাদের সব খুলে বলে।

_____

ড্রয়িং রুমে সোফায় চুপচাপ বসে আছে অরুণ সরকার।‌ কোলে ছোট্ট রুম্পা। তাকে দেখে হাত বাড়িয়ে আ আ করছিল।‌অরুণ কোলে তুলে নেয়। চারপাশে আরিয়ান বসে আছে রুপ কে কোলে নিয়ে। আসমা বেগম সিঙ্গেল সোফায় বসে। আতিকুর ইসলাম চেয়ারে বসে আরিয়ানের সাথে টুকটাক কথা বলছে। আসমা বেগম গম্ভীর মুখে বসে। সে ভেবেছিল অরুণ তাদের মতোই কোনো বড় ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছে। কিন্তু এতো মধ্যবিত্ত!! অরুণ পাগল হয়ে গেছে নাকি। এতো বড় বিসন্যাসম্যান হয়ে এই ঘরে বিয়ে করেছে আত্মীয় স্বজন জানলে কি ভাববে! ক্লাসের একটা ব্যাপার আছে না। বিয়েতে আত্মীয় স্বজন এ বাড়িতে আসলে হাসাহাসি করবে না? বিরক্তিতে তার মাথা ধরেছে।
আতিকুর ইসলাম, রাতুল ও আরিয়ানের কথোপকথনের মাঝে রুপ মা মা বলে কেঁদে ওঠে। আরিয়ান এটা ওটা বলে চুপ করানোর চেষ্টা করে পারে না। অরুণ রুম্পাকে কোলে বসিয়ে বলে,

-” রুবির কাছে যাবে। দিয়ে আয়!”

রাতুল সায় জানালো।

-” ওর মা বোধহয় পাতার ঘরে! ওই যে কর্ণারে! লুব নিয়ে যাও?”

-” আমিই যাচ্ছি!”

বলে উঠে দাঁড়ায় আরিয়ান। ছেলেকে কোলে নিয়ে কর্নারের রুমে গিয়ে নক করে। আদুরি দরজা খুলে হাসিমুখে বলে,

-” ছোট ভাইয়া! রুপ কাঁদছে কেন?”

-” কি জানি! রুবির কাছে দে তো!”

রুবি এগিয়ে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,

-” তোমার ভাবিকে দেখবে না? ভেতরে আসো?”

আরিয়ান হেসে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” বড় ভাবিজান? আসলাম কিন্তু?”

বলেই ভিতরে ঢোকে। প্রথমে নজরে আসে লতা। আরিয়ান ভাবে এই ভাবি হবে হয়তোবা! সে হেসে কিছু বলবে তার আগে পাশে দাড়ানো মাথায় ঘোমটা টানা পাতার দিকে নজর যায়। তার ভ্রু যুগল কুঁচকে যায়। এই মেয়েটা ঘোমটা দিয়ে আছে এ পাতা নয়তো! রুবি আরিয়ানের দ্বিধা ভেঙ্গে দেয়। পাতাকে দেখিয়ে বলে,

-” এই হলো তোমার বড় ভাবি!”

আদুরি ঘোমটা টা একটু তুলে দেয়। এতে পাতার সম্পূর্ণ মুখশ্রী দৃশ্যমান হয়। আরিয়ানের চোখ কপালে! এতো সেই ঝগরুটে বেয়াদব মেয়েটা! কলেজের গন্ডি পারই করেনি বলে কি না শিক্ষিকা! এই মেয়েটা ভাইয়ের বউ? সম্পর্কে তার ভাবি? ভাই তাহলে বাল্যবিবাহ করলো? হাঁটুর বয়সী মেয়েকে গলায় ঝুলিয়ে বসে আছে। সে কটমট‌ চোখে পাতার দিকে চায়। পাতা আরিয়ানের দিকে চায় সরাসরি। আরিয়ানের মুখের আদল দেখে তার ‌হাসি পাচ্ছে। সে গালে জিভ ঠেকিয়ে হাসি আটকায়। নজর ঝুঁকিয়ে সালাম দেয়,

-” আসসালামুয়ালাইকুম ভাইয়া!”

আরিয়ান একবার রুবির দিকে তাকিয়ে হন হন করে বেরিয়ে যায়। সে বেরিয়ে যেতেই ঘরে হাসির রোল পরে। রুবি সেদিনের ঘটনা সবাইকে জানিয়েছে একটু আগেই। পাতাও হেসে উঠলো। লতা বোনকে চোখ পাকায়। পাতা অনেক কষ্টে হাসি থামায়। ভোর এদের হাসাহাসিতে বিরক্ত হয়ে বিছানা থেকে নেমে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আদুরি পাতা ডাকলেও শোনে না।

আরিয়ান রাগে গজগজ করতে করতে ভাইয়ের পাশে বসে। ভাইয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ধীমে বলে,

-” এটা তুই ঠিক করিস নি! দুনিয়াতে মেয়েদের অভাব ছিল নাকি! কলেজ পড়ুয়া পিচ্চি মেয়ে।তোর হাঁটুর বয়সী হবে ওই আম পাতা জোড়া জোড়া!”

অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি! সে গম্ভীর মুখে কণ্ঠ খাদে এনে বলে,

-” মাথা গেছে? পাতা ভোরের স্কুলের টিচার! গ্র্যাজুয়েটেড!”

আরিয়ান খানিকটা অবাক হয়। মেয়েটাকে দেখে তো মনে হয় না। প্রথম দেখায় যে কেউ ভাববে কমবয়সী মেয়ে। তবে‌ সে যাই হোক আসল কথা হলো মেয়েটাকে তার ভাবি হিসেবে একদম পছন্দ হয় নি। সে অরুণকে বলে,

-” বিয়ে ক্যান্সেল! মেয়ে আমার পছন্দ হয় নি!”

অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায়।

-‘ বিয়েটা ওলরেডি হয়ে গেছে। আমরা শুধু ফর্মালিটিজের জন্য এসেছি‌। আর‌ বিয়েটা তুই করছিস না!”

আরিয়ান বিরক্তিকর চাহনিতে ভাইয়ের দিকে চায়। রাতুল দুই ভাইয়ের সিরিয়াস মুখে গুসুর ফুসুর লক্ষ্য করছিল। কোনো প্রবলেম হয়েছে কি? সে ভদ্র কণ্ঠে বলে,

-” কোনো সমস্যা?”

অরুণ মাথা নাড়ে। তন্মধ্যে লাবনী আক্তার ও লুবমান ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমে আসে। ট্রেতে ফলফলাদি, মিষ্টি ,শরবত, চা বিস্কুটের সমাহার। টি টেবিলে রেখে হাসিমুখে আসমা বেগমকে বলে,

-” আসসালামুয়ালাইকুম আপা! ভালো আছেন? আমি পাতার আম্মু!”

আসমা বেগম গম্ভীর মুখে সালামের জবাব দিয়ে বলে,

-” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?”

লাবনী আক্তার খুশি হয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ভালো আছো?”

-” হুম”

ছোট্ট জবাব। প্রতিত্তরে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে না। কেমন একটা জড়তা কাজ করে।আরিয়ান কনুই দিয়ে ভাইকে গুতা দেয়। এই ভাই সুধরানোর নয়। তারপর লাবনী আক্তারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-” আমি আরিয়ান! ভালো আছেন আন্টি? আপনাকে দেখে কিন্তু আন্টি আন্টি মনে হয় না একদম! আমি সত্যিই বলছি!”

লতা খানিকটা লজ্জা পায়। প্রসঙ্গ পাল্টাতে ট্রের দিকে ইশারা করে বলে,

-” নাও!”

আসমা বেগম একটা আপেলের টুকরো হাতে নিয়ে বললেন,

-” নিচ্ছি। আপনি পাতাকে নিয়ে আসুন!”

লাবনী হেসে মাথা নাড়ায়। ভোর গুটি গুটি পায়ে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ায়। বাবার কোলে ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে দ্রুততম পায়ে এগিয়ে যায়। তার বাবার কোলে কেন বসবে? অরুণের পায়ের উপর ভর দিয়ে ডাকে,

-” আব্বু?”

অরুণ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে?”

ভোর গলা জড়িয়ে ধরে। রাতুল এসে মেয়েকে অরুণের হাত থেকে নিলো। অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে আব্বু?”

ভোর অরুণের কাঁধ মুখ লুকিয়ে বলে,

-” কিছু না!”

অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। হাসিখুশিই তো ছিল। এখন গাল ফুলিয়ে! আতিকুর ইসলাম ভোরকে ডাকে,

-” এদিকে এসো? কি হয়েছে? মন খারাপ কেন?”

ভোর মাথা তোলে। বাবার কোল থেকে নেমে আতিকুর ইসলামের কোলে বসে। আতিকুর খানিকটা অবাক হয়। সে তো কাছে ডেকেছিল, আর এ‌ ছেলে কোলে উঠে বসলো।‌

লুবমান লাবিবের পাশে দাঁড়িয়ে । ভাগ্নের কাঁধ চাপড়ে বলে,

-” তোর আদরের নানা নানির আদরে ভাগ বসানোর লোক এসে গেছে মামু!”

লাবিব তীক্ষ্ণ নজর ফেলে ভোরের দিকে। পঁচা ছেলে?

আতিকুর ইসলাম ট্রে থেকে কুকিজ তুলে ভোরের হাতে দেয়। ভোর হাসিমুখে সেটা নিয়ে মুখে পুরে মিষ্টি করে বলে,

-” থ্যাংক ইয়ু নানু!”

কঠোর আতিকুর ইসলামের অধরেও হাসি ফুটে ওঠে ভোরের মিষ্টি কথায়। বাচ্চটা এতো আদুরে!

তন্মধ্যে আনিকা দৌড়ে আরিয়ানের কোলে বসে। রুবি, আদুরি,লাবনী আক্তার ও লতা পাতাকে নিয়ে আসে ড্রয়িং রুমে। সবার নজর পাতার উপর পরে। অরুণ ও চায়। জলপাই রঙের শাড়িতে বেশ লাগছে। মুখশ্রীতে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়াটাও মন্দ নয়। কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টানায় পুরো বউ বউ লাগছে। আরিয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চায় পাতার দিকে। পাতার নজর অরুণের দিকে না পড়ে আরিয়ানের উপর পড়ে। কেমন করে তাকিয়ে আছে। যেন সে মুজলিম! পাতা ভারি মজা পায়! তবে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। রাতুল মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে ডাবল সোফা থেকে উঠে পড়ে। আদুরি, রুবি পাতাকে নিয়ে সেখানে বসে। পাতা আড়চোখে সামনে চায়। গম্ভীর মুখো অরুণ সরকারের দিকে দৃষ্টি পড়তেই ফিরিয়ে নেয়। আসমা বেগম পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে। নাহ! মেয়েটি দেখতে বেশ। তাই হয়তোবা অরুণ পিছলে পড়েছে। সে পাতাকে জিজ্ঞেস করে,

-” নাম কি তোমার?”

পাতা মিনমিনে গলায় জবাব দেয়,

-” পাতা ইসলাম!”

আরো কিছু টুকটাক প্রশ্ন করে আসমা বেগম। পাতা নম্র কণ্ঠে জবাব দেয়। আসমা বেগমের বিরক্তির রেশ খানিকটা কেটে যায়। আরিয়ান চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে বসে। ভোর এখনো আতিকুর ইসলামের কোল দখল করে বসে। লাবিব তার নানার পাশে দাঁড়িয়ে। লুবমান ভাগ্নিকে কোলে নিয়ে। লতা লাবনী আক্তার ডায়নিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে।
অরুণ গম্ভীর মুখে বসে আছে। পাতা আড়চোখে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে অরুণের দিকে কিন্তু নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা একবারও চায় নি! পাতার প্রফুল্লচন্দ্র মনটা একটু মলিন হয়ে আসে। ভাবে সে একটু বেশিই এক্সপেক্ট করে বসে থাকে। তাদের মধ্যে তো তেমন ভাব নেই যে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে হা করে তাকিয়ে থাকবে!
আসমা বেগম আতিকুর ইসলামের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এখন শুধু ফরমালিটিজ মেইনটেইন করতে হবে। আমরা পাতাকে রিং, বালা পড়িয়ে দিন ক্ষণ ঠিক করতে এসেছি! আপনারা কি বলেন?”

আতিকুর ইসলাম ভদ্রসুলভ হেসে বলে,

-” আমরা কি বলবো? আপনারা যা ভালো বোঝেন!”

বলে রাতুলকে কিছু ইশারা করে। রাতুল চলে যায় ঘরে।‌ লাবনী, লতা এসে দাঁড়ালো। আসমা বেগম আরিয়ানকে উঠতে বলে আদুরির দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ওকে এখানে বসিয়ে দাও!”

আদুরি সায় জানিয়ে হাসিমুখে পাতাকে নিয়ে অরুণের পাশে বসিয়ে দেয়। অরুণ প্রতিক্রিয়া হীন বসে থাকে। পাতা মাথা নিচু করে অরুণের পাশে বসে। ভোর আতিকুর ইসলামের কোল থেকে নেমে এসে বাবার কোলে বসে। লাবিব সুযোগ বুঝে নানার কোলে বসে। আর উঠবে না! তার নানার আদর শুধু তার।
আরিয়ান ভোরকে অরুনের কোল থেকে নিতে চাইলে অরুণ ছেলেকে জড়িয়ে বলে,

-” আমার কাছে থাক!”

আরিয়ান আর কিছু বলে না। আসমা বেগম ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে চারটা গয়নার বাক্স বের করে।একটা বক্স থেকে একজোড়া বালা বের করে অরুণের হাতে দেয়। বালা জোড়া দেখে অরুণের চিনতে অসুবিধা হয় না। এগুলো তার মায়ের বালা! ছোট বেলায় দেখেছিল মায়ের হাতে। সে বালা জোড়া হাতের মুঠোয় ধরে রাখে। মায়ের স্মৃতি, মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে। আসমা বেগম অরুণকে বলে,

-” পরিয়ে দাও!”

অরুণ পাশে তাকায়। পাতার অশান্ত নিচু মুখশ্রী, হাত মোচড়ানো দেখে ভোরের হাতে বালা জোড়া দিয়ে বলে,

-” আব্বু? পড়িয়ে দাও!”

পাতা নজর তোলে। অশান্ত নজর শান্ত হয়। হাত মোচরা মুচরি থেমে যায়। মন কুঠিরে সদ্য জন্ম নেওয়া স্বপ্ন খানি কাঁচের চুড়ির মতো ভেঙ্গে পড়ে। নিজের হাতে কি পড়িয়ে দিতে পারতো না বালা জোড়া!
ভোর খুশি হয়ে বালা জোড়া পাতাকে পড়িয়ে দিতে নিলে আসমা বেগম থামিয়ে দেয়। ভোরকে বলে,

-” ভোর তুমি আমার কাছে আসো? আর অরুণ তুমি পড়িয়ে দাও!”

ভোরের মনটা খারাপ হয়। বালা জোড়া অরুণের হাতে দিয়ে উঠে যেতে নিলে অরুণ আটকায়। কিছু বলবে এর আগে পাতা ছোট করে বলে,

-” ভোর তুমিই পড়িয়ে দাও!”

ভোর দাদির দিকে চায়। আসমা বেগম কিছু বলে না। সে পাতার দিকে চায়। পাতার হাসিমুখে থাকা মলিন চেহারার কথা সে জানে। নিজেও এমন পরিস্থিতি পার করে এসেছে কি না! তাই পাতার মলিনতা তার চোখ এড়ায় নি।

অরুণ বালা জোড়া পুনরায় ভোরের হাতে দেয়। ভোর তার ছোট্ট হস্ত দ্বারা পাতার হাতে বালা জোড়া পড়িয়ে দেয়। পাতা ভোরের হাত মুঠোয় পুরে চুমু দেয়। ভোর খুশি হয়ে অরুণের কোল থেকে নেমে পাতার কোল জুড়ে বসে। পাতা হাসিমুখে তাকে জড়িয়ে নেয়। এরমধ্যে রাতুল আসে। আতিকুর ইসলামের হাতে কিছু দেয়। আতিকুর ইসলাম সেটা পাতার হাতে দিয়ে আসমা বেগম ও অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আমরা মধ্যবিত্ত। আপনাদের মতো দামি উপহার দেওয়ার সাধ্য নেই হয়তো! তবে এই ছোট্ট রিংটা! পড়লে খুব খুশি হবো?”

আসমা বেগম কিছু বলবে এর আগে অরুণ ছোট্ট করে বলে,

-” আমি রিং পড়ি না! আর তাছাড়াও..”

আর কিছু বলতে পারে না। পাতার কান্ডে অবাক হয়ে হাতের অনামিকা আঙ্গুলের দিকে চায়। উপস্থিত সবার চোখে মুখে অবাকতার রেশ। পাতা নির্বিকার। বললেই হলো রিং পড়ি না।‌ পড়তে হবে! নাক উঁচু লোক!
আসমা বেগমের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেশ। না বাঘকে সামলাতে বাঘিনীই দরকার। সে অরুণের হাতে পাতার জন্য আনা রিং টা দেয়। আদেশের সুরে বলে,

-” নিজে পড়িয়ে দিবে!”

অরুণ প্রতিত্তর করে না। পাতার নরম হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে রিং পড়িয়ে দেয়। সবাই হাসিমুখে অভিনন্দন জানায় অরুণ পাতাকে। আসমা বেগম বাকি কানের ঝুমকো ও নাকের নথ পাতার মায়ের কাছে দেয় পড়িয়ে দিতে। পাতার নাক ফুটো নেই সেটা ভেবেই অরুণ একটা নথ বানিয়ে এনেছে। অনেকটা মারাঠির মেয়েরা পড়ে না? সেরকম। লাবনী আক্তার মেয়েকে যত্নের সাথে পড়িয়ে দেয়। সবার নজর পাতার দিকে। সোনার অলংকার এমনিতেই মেয়েদের সৌন্দর্য যেন ফুটিয়ে তোলে। পাতার ক্ষেত্রেও তেমনটা হয়েছে। বিশেষ করে নাকের নথ! পাতার ফর্সা মুখশ্রীতে যেন ফুটে উঠেছে। আদুরি তো ক্যামেরা ম্যান বনে গেছে। ভাই ভাবিকে একসাথে বসিয়ে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিয়েছে। অরুণ পাতা চুপচাপ বসে আছে।

চলবে……

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৫ (শেষাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

ঝুমঝুম বারি ধারা ভিজিয়ে দিচ্ছে মেদিনী। রাস্তা, মাঠ, ঘাট সব বৃষ্টির জলে স্নানে ব্যস্ত। বৃষ্টির ঝম ঝমে শব্দ যেন কানে ঝংকার তুলছে। বৃষ্টির জল ফোঁটার মৃদু বাতাসে যেমন পরিবেশ, তনু জুড়িয়ে শীতলতায় ছেয়ে যায় তেমনি বৃষ্টির ‘ঝম ঝম’ শব্দে শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে মনটা জুড়িয়ে অন্দরমহলকে শীতলতায় ভরিয়ে তোলে।‌ আর যে ব্যাক্তির বারিধারার শ্রুতিমধুর প্রকৃত সৃষ্ট বাদ্যযন্ত্রের তানে মন না জুড়ায় সে কঠোর! বর্ষনের সময় যে মৃদু মেঘের গর্জন শোনা যায় তারও আলাদা তান আছে।‌ ঘন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি! বৃষ্টির ঝুম ঝুম তান! ভূপৃষ্ঠের স্থল ও জলভাগে বৃষ্টি পতনের রিমঝিম কলতান! মেঘের গর্জনে গান! হালকা বাতাসের শম শম সুর! সব মিলিয়ে একজন বর্ষণ প্রেমী মানুষ ঘোরে চলে যায়। রুবি পাতার ঘরে বিছানায় জানালার ধার ঘেঁষে বসে বৃষ্টি বিলাসে ব্যস্ত। পাশে ঘুমে বিভোর ছোট্ট রূপ! হা করে ঘুমুচ্ছে। পাতা বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে । তার একপাশে লাবিব ওপর পাশে আদুরি বসে ভাইয়ের দোষ, গুনগান‌ গাইছে। লতা সামনে চেয়ারে বসে মেয়েকে কোলে নিয়ে তার কথা শুনছে। মাঝে মাঝে নিজের বোনের গুন বলতে ভুলছে না‌। পাতা কখনো শুনছে, কখনো না।‌ ভোর টেবিলে বসে পাতার আঁকানো ড্রয়িং দেখছে। আনিকা তার সঙ্গী। একটা করে দেখছে আর প্রশংসার ফুলঝুরি। ড্রয়িং রুমে বড়রা বিয়ের দিন ক্ষণ অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। আর বাকিরা পাতার সাথে আড্ডায়। পাতা বিছানায় বসে তার সামনে দন্ডায়মান ড্রেসিন টেবিলের আয়নায় আড়চোখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে মাঝে মাঝে। মনে মনে ভাবে ,নাহ! মন্দ লাগছে না! বাহ পাতা তুই এতো সুন্দর আগে তো দেখিনি! আজ রূপ যেন ফুটে উঠেছে। গ্লো করছিস? হুম হুম ব্যাপারটা কি? বিয়ের রঙ লেগেছে নাকি? নিজের চেহারার উজ্জলতা দেখে নিজেই যেন ক্রাশ খাচ্ছে পাতা তাহলে জামাই তো ক্রাশ বাঁশ সবই খাওয়ার কথা! কিন্তু নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার নজর তার উপর নিবদ্ধ হলে তো! আনরোমান্টিক গোমরামুখো! পাতা নিজের ভাবনায় নিজেই লজ্জা পায়। আশ্চর্য টিনেজারদের মতো বিহেভ করছে কেন হৃদয়ের অন্তঃস্থল! তার লজ্জাঘেরা ভাবনার মাঝেই দরজা নক করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ভিতরে প্রবেশ করে রাতুল ভুঁইয়া। রুবি ঠিক হয়ে বসে। রাতুল হাসিমুখে বলে,

-” বাহ বাহ আমাদের রেখেই আড্ডা জমে ক্ষীর! এটা কিন্তু ঠিক না! কোথায় ভেবেছি নতুন সুন্দরী বেয়ানদের সাথে বৃষ্টি মুখর রোমান্টিক পরিবেশে আড্ডা দেব!”

আদুরি হেসে কপালে পরে থাকা চুল কানের পিঠে গুজে ভাব নিয়ে বলে,

-” মানা করেছে কে দুলাভাই বেয়াই! আমরা তো আপনারই অপেক্ষায় প্রহর গুনছি!”

বলেই হেসে ওঠে। রাতুল নাটকীয় ভঙ্গিতে বুকে হাত রেখে মুচকি হেসে বলে,

-” ওহে রমনী! এভাবে হাসতে নেই! তোমার ওই মিষ্টি মধুর হাসিতে চাঁদও লজ্জায় মুখ লুকাবে! বাইরে বহমান বৃষ্টির পানিও হিংসেই জ্বলে উঠলো বলে!”

আদুরি খানিকটা লজ্জায় পড়ে। রুবি বাহবা দেয়,

-” বাহ বেয়াই সাব! আপনার ফ্লার্টিং স্কিল দুর্দান্ত! এক চুটকিতে মেয়ে পটাতে পারবেন! সাহসও আছে নইলে বেয়ানের সামনে অন্য মেয়ের প্রশংসা! সবাই পারে না!”

রাতুল হাসিমুখে লতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তুমিও‌ আছো? খেয়াল করি নি! মজা করছিলাম তো!”

আদুরি চেহারায় কৃত্রিম অবাকতা ফুটিয়ে বলে,

-” এতো সুন্দর বউকে খেয়াল করেন নি!”

-” এতো সুন্দরীদের ভিড়ে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে।”

রাতুলের কথায় হাসির রোল পড়ে। লতা আড়চোখে রাতুলকে চোখ রাঙায়। ব্যস রাতুল হলুদ কার্ড পেয়ে গেল। এখন সাবধান। সে দরজা থেকে ভিতরে প্রবেশ করে। তার পিছন পিছন ঘরে প্রবেশ করে আরিয়ান ও অরুণ সরকার। পাতা তাদের দেখে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে যায়। ইশ! এখন বসবে কোথায়? ছোট্ট একটা ঘর মানুষে ভরে গেছে। লতাও‌ উঠে দাঁড়ায় চেয়ার ছেড়ে। রাতুল সেখানে আরিয়ানকে বসতে বলে। আরিয়ান বসে যায়। লতা বিছানায় উঠে রুবির কাছে বসে।‌লাবিবও উঠে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। রাতুল অরুণকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে,

-” ভাই আপনি আপনাকে কোথায় বসতে দিই বলুনতো?”

ভোর ড্রয়িং খাতা বন্ধ করে অরুণকে তার‌পাশে টেবিলে ইশারা করে বলে,

-” আব্বু তুমি এখানে বসো। আমরা আম্মুর ড্রয়িং দেখবো একসাথে!”

রাতুল অরুণের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে পাতাকেও পাশে বসায়। পাতা উঠে আসতে নিলে রাতুল চোখ পাকায়! অগত্যা পাতা মাথা নিচু করে বসে ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নিল। আশ্চর্য আজ তার এতো লজ্জা লাগছে কেন?

অরুণ গম্ভীর মুখে বসে থাকে। রাতুল এবার বিজয়ী হেসে বলে,

-” দুজনে একেবারে রাজ যোটক! আরে লজ্জা পাচ্ছো কেন তোমরা! ওলরেডি বিয়ে হয়ে গেছে তোমাদের। টেক ইট ইজি গাইস!”

অরুণ শু খুলে এক পা বিছানায় তুলে বসে। ফলে পাতার সাথে ছোঁয়া লাগে। পাতা জড়সড় হয়ে বসে। অরুণ খেয়াল করে আদুরির দিকে তাকিয়ে বলে,

-” একটু ওদিকে যা?”

আদুরি ভাইয়ের দিকে ছোট ছোট করে চায়। তারপর শয়তানি হেসে নিজেও দু পা তুলে আরো বেশি জায়গা জুড়ে বসে অরুণকে পাতার দিকে ঠেলে দিল। অরুণ সকলের মাঝে কিছু বলতেও পারে না। এর মাঝে লুবমান আসে, হাতে চায়ের ট্রে। হাসিমুখে সবার হাতে চা দেয়। আদুরির চোখে মুখে উপচে পড়া হাসি। লতা সাহায্য করে। বৃষ্টির মুখর শীতল পরিবেশে গরম গরম চা! আহা! মনটা জুড়িয়ে যায় যেন! সবাই ধোয়া উড়ানো চায়ের কাপে চুমুক বসায়। তবে পাতার হাত ফাঁকা। তাকে চা দেয় নি রাতুল। পাতা কিছুটা খুশিই হয়েছে। সকলের মাঝে চা খাবে কেমন করে? তবে রাতুল তার খুশির ঝুড়ি উল্টিয়ে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ভাই আপনি আমার সিনিয়র হলেও সম্পর্কে কিন্তু আমি আপনার বড় বুঝলেন! তো আপনাকে কিছু সিক্রেট বলি! আমাদের পাতা খুবই নরম শোভা! জামাই পাগল হবে মিলিয়ে নিবেন। আপনার নামে একটু এদিক সেদিক বললেই যেন রৌদ্র রূপ ধারণ করে! বলাই যায় না!”

-” দুলাভাই?”

পাতার ডাকে রাতুল তার দিকে তাকায়। পাতা করুণ চোখে চায়। এভাবে মান ইজ্জতের ফালুদা না করলে নয়!অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে চায়। সত্যিই কথাটা? রাতুল পাতার চুপসানো মুখশ্রী দেখে আর কিছু বলে না।

সবার জন্য চা আনলেও বাচ্চাদের জন্য মাঝারি সাইজের গ্লাসে গরম দুধ দেওয়া হয়। লাবিব দুধ দেখেই নাক ছিটকিয়ে মায়ের কোলে মুখ লুকায়। লতা মাথা তুলে চোখ পাকাতেই গটগট করে দুধ সাবাড় করে। তার কান্ডে সবাই হেসে ওঠে। ভোর আনিকার আবার দুধ খেতে বাহানা নেই। তাদের পছন্দ। আনি তো ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলে। ভোর ড্রয়িং দেখায় ব্যস্ত তাই টেবিলে রেখে দিল। আনি চুপিচুপি তার গ্লাস তুলে ছোট্ট চুমুক বসায়। ভোর দেখে ফেলে! আনিকার দিকে রেগে তাকাতেই আনি দুধের গ্লাস রেখে কান ধরে স্যরি বলে। কিন্তু ভোর তো ভোরই! দুধের গ্লাস ঠেলে ফেলে দেয় ফ্লোরে। কাচের গ্লাস হওয়ায় ভেঙে চুরমার। দুধ ছিটকে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দরজা ভিজিয়ে রাখায় বাইরে তেমন শব্দ যেতে পারে নি। রুমের সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে। পাতা চমকে উঠে! ছোট্ট রূপ চমকে ঘুম থেকে উঠে কেঁদে উঠল। আনিকাও কেঁদে দেয়। আরিয়ান উঠে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই আনিকা কেঁদে কেঁদে বলে,

-” ওর গ্লাসের দুধ থেকে এইটুকু খেয়েছি! স্যরিও বলেছি!”

অরুণ এসে ঝটকা দিয়ে ভোরকে টেবিল থেকে নামায়। ধমকে বলে,

-” কি করলে এটা বেয়াদব ছেলে? এক চরে গাল লাল করে দেব! ”

ভোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছু বলে না। চোখ মুখ শক্ত। অরুণ আবার ধমক দিবে লতা এগিয়ে এসে বলে,

-” ছোট বাচ্চা! বুঝতে পারে নি! আপনি ছাড়ুন তো ভাইয়া! ভোর যাও পাতার কাছে যাও!”

অরুণ ছেলেকে চোখ রাঙায়। ভোরের চোখে অশ্রু ভিড় করে! সে অরুণের হাত ঝটকায় ছাড়িয়ে পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে নাক টানে। আরিয়ান ক্রন্দনরত মেয়েকে নিয়ে বাইরে যায়। লুবমান ট্রেতে কাচের টুকরো গুলো তুলে নিয়ে যায়। লতা ফ্লোরটা মুছে দেয় তৎক্ষণাৎ। লাবিব বিছানায় বসে ভোরকে মনে মনে বকে। দুষ্টু ছেলে! রূপ অল্প কেদেই ঘুমিয়ে যায়। রুবি ছেলেকে পুনরায় শুইয়ে দিল। পাতা ভোরকে বিছানায় বসিয়ে চোক্ষু যুগল থেকে বেরিয়ে আসা অল্প অশ্রু মুছে দেয় হাত দিয়ে। কপালে চুমু দিয়ে আদুরে গলায় বলে,

-” ভোর কি হয়েছে? ওভাবে ফেলে দিলে কেন?”

ভোর জেদি‌ গলায় বলে,

-” ও সবসময় এমন করে। আমার খাবার চুপিচুপি খেয়ে এঁটো করে দিবে! পঁচা আনি!”

-” ও তো তোমার ছোট্ট বোন! একটু দুষ্টুমি করেছে তাই এরকম করবে? কিভাবে কাদলো? স্যরিও বলেছিল!”

পাতার কথায় ভোর গাল ফুলিয়ে পিট পিট করে চায়।

-” আমিও স্যরি!”

পাতা তার গাল টিপে বলে,

-” আমাকে না! আনিকে গিয়ে বলো!”

ভোর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

-” না বললে হবে না?”

-” তুমি না গুড বয়! গুড বয় রা ভুল করলে স্যরি বলে তো!”

ভোর পাতার গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” আমি এক্ষুনি স্যরি বলে আসি আনিকে!”

বলেই নেমে দৌড়ে চলে যায়। আদুরি হামি তুলে হেসে বলে,

-” ভাই শেখো কিছু! তুমি তো পারো শুধু ধমক আর হাত তুলতে! ওরা ছোট ঝগড়া করবে আবার গলা জড়িয়ে ঘুরবে।”

অরুণ আদুরির দিকে শান্ত চোখে চায়। আদুরি আমতা আমতা করে বলে,

-” আমি আসছি হ্যাঁ! তোমরা থাকো? বৃষ্টি থেমে গেছে বাইরে গিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে আসি!”

লুবমান, লতা কাঁচের টুকরো নিয়ে বাইরে চলে যায়। রুবি বিছানা থেকে নেমে পাতাকে বলে,

-” তুমি আমার ছোটই হবে বয়সে! তবে সম্পর্কে বড়! তাই বড় ভাবি বললাম। ছেলেটাকে দেখো? আমি দেখি মেয়েটার কান্না থামলো কি না!”

বলেই চলে যায়! ঘরে রাতুল, পাতা, অরুণ, লাবিব! আর ঘুমন্ত রূপ! রাতুল অরুণ পাতাকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে বলে,

-” বাচ্চারা এমনি! বাদ দাও! এই উছিলায় দুজনে কিছু সময় পেলে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করার! ওল দা বেস্ট গাইস! সুযোগের সদ্ব্যাবহার করো!”

বলে চোখ টিপে। পাতা চোখ রাঙায়! কথার কি ছি!রি! অরুণ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। রাতুল পাতার চোখ রাঙানোতে হেসে বলে,

-” চোখ পাকিয়ে লাভ নেই! আমি জানি তোমরা দুজনেও এটাই চাইছিলে! এই ব্যেটা চল?”

লাবিব বিছানা গেড়ে বসলো যেন।

-” আমি যাবো না। মায়ের বোনকে যদি এই খালুজানটা ধমকায়!”

রাতুল এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

-” ধমকাবেনা বাপ!”

বেরোনোর পর দরজা লাগাতে ভুলে না। পাতা ঢের অস্বস্তিতে পড়ে। এই দুলাভাইটাও না! সে এখন কি করবে? অরুণ কিছু বলে না। বিছানায় রিল্যাক্সড মুডে বসে দু হাত বিছানায় রেখে দিয়ে পিছনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে পাতার দিকে চায় সরাসরি। না রাখঢাক না আড়চোখে। আর না এদিক সেদিক। সম্পূর্ণ নজর পাতার আপাদমস্তক ঘিরে। কানে তার দেয়া সোনার ঝুমকো জোড়া জ্বল জ্বল করছে। নাকে নোস পিনটা যেন মুখের আদলটাই চেঞ্জ করে দিয়েছে। চেহারায় অষ্টাদশী ছাপটা আর নেই। একদম যুবতী পরিস্ফুটিত নারীর মতোই লাগছে। ফর্সা হাতে বালা জোড়া চিকচিক করছে। হাতে বিদ্যমান কাঁচের চুড়ি খুলে ফেলেছে। শুধু তার মায়ের স্মৃতি বিজড়িত বালা জোড়া। জলপাই রঙের বেনারসীতে বেশ মানিয়েছে পাতাবাহারকে।

অরুণকে পলকহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। ঢোক গিলে লম্বা শ্বাস নেয়। লোকটি এভাবে তাকিয়েছে কেন? আচ্ছা লোকটার নজরে কি মুগ্ধতা ভিড় করেছে? কি জানি! সেটা বুঝবে কি করে! পাতার কাছে তো লোকটার দৃষ্টি মহাভারতের শকুনীর মতো লাগছে! সে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

অরুণ নজর হাঁটায় না। এক ভ্রু উচিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

-” দেখছি!”

পাতাও এক ভ্রু উঁচিয়ে অরুনের মতো করে বলে,

-” কি দেখছেন?”

-” তোমাকে”

বাব্বাহ! তুমি বলছে। আপনি থেকে তুমিতে! শুনতে মন্দ লাগছে না। ভালোই শোনাচ্ছে। আপনি ডাকলে নিজেকে কেমন বুড়ি বুড়ি ফিল আসতো! পাতা অধরকোণে আসতে চাওয়া হাসি লুকিয়ে হালকা ভাব নিয়ে বলে,

-” কেমন লাগছে?”

-” ভালো!”

পাতার মনটা প্রসন্ন হয়। লোকটা প্রশংসা করলো!

-” শুধুই ভালো? সুন্দর লাগছে না?”

-” হুম!”

পাতা ভ্রুযুগল কুঁচকে যায়। লোকটা সত্যিই বলছে নাকি তার মন রক্ষার্থে। পাতা মাথার ঘোমটা ফেলে দেয়। বেনারসীতে বেশ গরম তার! খোপা করা চুল খুলে দিল। কাঁধ সমান ঝর ঝরে সিল্কি চুল ছড়িয়ে পড়ে। পাতা চিরুনি চালিয়ে রাবার হাতে নেয় চুল বাঁধার জন্য। অরুণের দৃষ্টি এখনো পাতার দিকে। মেয়েটা কত অবলিলায় মাথার ঘোমটা ফেলে দিল! যেন তারা দু বছর সংসার করা দম্পতি! অরুণ পাতার চুলের দিকে চায়। মাথা ভর্তি চুল তবে এতো ছোট কেন? মেয়েটাকি জানে না লম্বা চুল মেয়েদের সৌন্দর্য বর্ধিত করে। পাতা চুল ঝুটি করে আঁচল কোমড়ে গুজে অরুণের সামনে বুকে হাত গুজে দাঁড়ায়। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাতা অরুণের মতো গম্ভীর সুরে বলে,

-” তখন ভোরকে বকলেন কেন?”

-” দুষ্টুমি করলে বকা খাবেই!”

স্পষ্ট জবাব অরুনের। পাতা অরুনের চোখে চোখ রেখে বলে,

-” বাচ্চারা দুষ্টুমি করবে না তো কি বাচ্চার বাপে করবে?”

-” সব ব্যাপারে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক নয় পাতাবাহার!”

-” বুঝিয়ে বললেই বুঝবে। ভোর খুবই বুঝদার ছেলে। অথচ আপনি অবুঝ! শুধু ধমকাধমকি!”

অরুণ কিছু বলে না তবে তার অধরকোণে ক্ষীণ হাসির রেশ। পাতার নজর এড়ায়নি।

-” বাড়িতে এসে আব্বুকে সালাম দিয়েছিলেন?”

অরুণ খানিক ভেবে ঠোঁট নাড়িয়ে জবাব দেয়,

-” উনিই দিয়েছিল!”

পাতা ক্ষেপে গিয়ে বলে,

-” আর আপনি ঘোড়ার ঘাস কাটছিলেন? ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করেছিলেন? না বলবেন না প্লিজ?”

অরুণ না করে না।

-” উনিই জিজ্ঞেস করেছিল আমি উত্তর দিয়েছি!”

পাতা কি বলবে ভেবে পায় না।এই লোকটা কি দিয়ে তৈরি! সে অরুণের দিকে এগিয়ে এসে খানিকটা ঝুকে কটমট করে বলে,

-” সেদিন কত করে বললাম গুরুজনদের দেখলে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করতে হয়! আপনার কানে আদৌ‌ ঢুকেছিল? এই শুনুন কথা বললে কি ট্যাক্স লাগে নাকি! সবসময় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন? ভোর তো এসেই সালাম দিয়েছিল মিষ্টি করে। ছেলের থেকেও কিছু শিখতে পারেন!”

-” ধীরে ভদ্রভাবে কথা বলুন! ঝগরুটে মেয়েদের মতো তেড়ে আসছেন কেন?”

শান্ত ভঙ্গিতে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে অরুণ। পাতা রেগে আঙ্গুল তুলে কিছু বলবে কিন্তু গতবারের কথা স্মরণে আসায় আঙ্গুল নামিয়ে নেয়। অরুণ মুচকি হাসে পাতার কান্ডে। পাতা অরুণের হাসি দেখে চোখ পাকিয়ে বলে,

-” আপনি ঝগরুটে বললেন আমায়? আবার হাসছেন?”

অরুণ হাসি লুকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে,

-” না তো! কিছু বলছিলেন?”

পাতা হতাশ! এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোককে ম্যানারস শেখানো তার সাধ্যের বাইরে। শালার জামাই! সে অসহায় মুখে অরুণের দিকে চায়। তাদের মধ্যে দূরত্ব একহাতের মতো হবে। পাতা অরুণকে এতো কাছ থেকে প্রথমবার দেখছে। নাক উঁচু লোকটার নাকটা মোটেও উচু না। বরং একটু বোচা বলা যায়। তবে বেশি না, এই সামান্য! অতি কাছে না এলে বোঝা যায় না।‌ গম্ভীর চোখ দুটো ছোট ছোট কিন্তু ভোরের ডাগর ডাগর চোখ। ভ্রু যুগল একদম ভোরের মতো। চোখের পাপড়ি গুলো বড় বড়। চোখের মনি কালো কুচকুচে। গোফ দাড়িতে কপোল, চোয়ালদ্বয় ঢাকা! গালের দিকে নজর আসতেই চোখে পড়ে কালচে দাগ! কিছু টা কামড়ের মতো লাগছে। সে অরুণের সেই দাগে তর্জনী আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়। অরুণ চমকে ওঠে। পাতার উষ্ণ আঙ্গুলের ছোঁয়ায় গরমটা যেন বেড়ে গেল। তনুমন উষ্ণতায় ছেয়ে যায়। বুকের বা পাশে অবস্থানরত বক্ষ দেশীয় কশেরুকা বরাবর আড়াইশো থেকে তিনশত নব্বই গ্রামের ত্রিকোনাকার মোচার মতো অঙ্গটি যেন ধ্বক করে উঠলো। নিঃশ্বাসের গতি একটু বাড়লো কি? পাতার এসবে খেয়াল নেই সে দাগে তর্জনী ঠেকিয়ে প্রশ্ন করে,

-” এটা কিসের দাগ? নতুন মনে হচ্ছে!”

কণ্ঠে খানিক সন্দেহের আভাস! অরুণ মনে মনে হাসে। এই না হলো মেয়ে মানুষ! সন্দেহ তাদের রগে রগে! অরুণ সন্দেহে ঘি ঢালতে বলে,

-” কামড়ের দাগ!”

ব্যস! পাতার চোখ জোড়ায় সন্দেহ টইটম্বুর। পাতা আঙ্গুলটা গালে ডাবিয়ে দেয়। অরুণ চোখ জোড়া বুজে নেয়। ব্যথায়? কি জানি!
পাতা শান্ত কঠোর গলায় বলে,

-” কার কামড়ের দাগ?”

অরুণ সময় নেয় জবাব দিতে। এতে যেন‌ পাতার সন্দেহ চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে যায়। অরুণ ভাবনার সুরে বলে,

-” উম.. কার হবে?”

পাতা হাত সরিয়ে নিল।

-” থাক বলতে হবে না!”

অরুণ অভিমানী পাতার দিকে চায়। কয়েকদিনের সম্পর্ক! অথচ মেয়েটা অভিমান করতে শিখেছে? অধিকারের সাথে প্রশ্ন করে জবাব চাইছে? অরুণ পাতার হাত ধরে আটকায়। শক্ত খসখসে হাতের মুঠোয় পাতার নরম হাত বন্দি করে। অপর হাতে পাতার নাকের ডগা টেনে বলে,

-” পার্ফেক্ট বাঙালি বধূ! সন্দেহ নাকের ডগায়। ছেলে কামড় দিয়েছিল!”

পাতা জিভে কামড় দিয়ে গালে ঠেকায়! সে কি না ভেবেছিল! মেয়ে মানুষ আসলেই বেশি বুঝে। পাতা আমতা আমতা করে বলে,

-” কই সন্দেহ করলাম! এমনি জিজ্ঞেস করলাম। আপনিই বেশি বুঝেন!”

অরুণ হাতের চাপ বৃদ্ধি করে।

-” আচ্ছা?”

পাতা হাত মোচরা মুচরি করতে থাকে। তার নরম কোমল হাতটা এই লোকের শক্ত হাতের মুঠোয় ইন্না লিল্লাহি না করে বসে। কেমন খসখসে শক্ত হাত! অরুণ হাতের বাঁধন ঢিলে করে দেয় তবে ছাড়ে না। পাতাকে আরেকটু কাছে আনে। দুজনের মধ্যে অল্প দূরত্ব বিদ্যমান। অরুণ বিছানায় বসে। আর পাতা তার দিকে ঝুঁকে খানিকটা। পাতা হাত মোচড়ানো থামিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে অরুণের চোখে চোখ রাখে। অরুণের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার মুখে আছরে পড়ছে। লোকটা এতো কাছে টানলো? কি হতে চলেছে? রোমান্টিক মুভির মতো কোনো রোমান্টিক সিন? পাতার বক্ষস্থল কেঁপে উঠলো। চোক্ষু যুগলের আকার বড় হয় ধীরে ধীরে। অরুণ হালকা হাসে, পাতার মনোভাব বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে পাতার মুখশ্রীতে ঠোঁট নাড়িয়ে মৃদু ফু দেয়। পাতা যেন ঘোরের মাঝে চলে যায়। ঢোক গিলে! আবেশে চোখ মুদে নেয়। অরুণের এবার বেশ হাসি পায়। ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার! তোমার কিউট টাম্মিতে অবস্থানরত অশ্লীল কালো তিলটা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে আমায়! তাকে সাবধান করে দিও। আমি কিন্তু মোটেও সাধু পুরুষ নই!”

পাতার মুদে রাখা চোখ কপালে। তার সকল ভাবনা চুরমার করে ভেঙ্গে এই লোক কি বললো? অরুণের ঢিলে হয়ে যাওয়া হাতের ফাঁক থেকে হাত টেনে কোমড়ে গোজা আঁচল খুলে ভালোভাবে ঢেকে নেয়। অরুণের দিকে না তাকিয়ে সরে যায় তার সামনে থেকে। কি সব দমবন্ধকর কথাবার্তা! কিউট টাম্মি? কারো পেটও কিউট হয়! আরে শালার জামাই! উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে ভালোকথা! দিতেই পারে, তোকে বলতে হবে? তুই ও উঁকি ঝুঁকি দে? হিসেব বরাবর। পর পুরুষ তো নয়। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র জামাই তার! ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে উকি দিতেই পারে! তুই সুযোগের সৎ ব্যবহার কর।

চলবে……

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৬

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

পাতার বুজে রাখা চোখ কপালে। তার সকল ভাবনা চুরমার করে ভেঙ্গে এই লোক কি বললো? অরুণের ঢিলে হয়ে যাওয়া হাতের ফাঁক থেকে হাত টেনে কোমড়ে গোজা আঁচল খুলে ভালোভাবে ঢেকে নেয়। অরুণের দিকে না তাকিয়ে সরে যায় তার সামনে থেকে। কি সব দমবন্ধকর কথাবার্তা! কিউট টাম্মি? কারো পেটও কিউট হয়! আরে শালার জামাই! উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে ভালোকথা! দিতেই পারে, তোকে বলতে হবে? তুই ও উঁকি ঝুঁকি দে? হিসেব বরাবর। পর পুরুষ তো নয়। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র জামাই তার! ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে উকি দিতেই পারে! তুই সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। পাতা নিজের ভাবনায় নিজেই ফিট খাবার উপক্রম। পাতা কি সব উদ্ভট ভাবনা তোর। সবাই সত্যিই বলে তুই জামাই পাগল বনে গেছিস! এখন তোর কি হবে? পাতা মনে মনে নিজের গালে কষে এক থাপ্পড় লাগায় উদ্ভট ভাবনার জন্য।

অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে।‌ পাতা তার দিকে পিঠ ফিরে আছে। মেয়েটা তার কথায় কি কিছু মনে করলো? নাহ! এভাবে বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু সেই বা কি করতো! ওই অশ্লীল তিলটা উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল তো। সব দোষ তিলটার। সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” পাতাবাহার? বিয়ের ডেট কিন্তু ঈদের দুদিন পর ফিক্সড করা হয়েছে। আবারো বলছি কোনো প্রবলেম হবে?”

পাতা যেন অস্বস্তিকর পরিস্থিতির থেকে নিস্তার পায়। নিজেকে শান্ত করে অরুণের দিকে ফিরে।

-” না সমস্যা নেই।”

-” বিয়ের শপিং কাল পরশুই সেরে ফেলতে হবে। আগে থেকেই ওয়ার্ন করছি কোনো বাহানা শুনবো না!”

পাতা মাথা নাড়ে বাধ্য মেয়ের মতো। অরুণ পরণের ব্লেজারের একটা বোতাম খুলে। একটা র্্যাপিং করা ছোট্ট প্যাকেট বের করে। পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” তোমার গিফট!”

পাতার কপালে গাড় ভাঁজ পড়ে।

-” কিসের গিফট?”

অরুণ পাতার হাতে ধরিয়ে দেয়। বিছানায় পা তুলে বসে ছোট্ট রূপের গালে হাত বুলিয়ে চুমু দিয়ে বলে,

-” ছোট মা টাকা দিলো না? কি যেন নিয়ম! আমিও দিলাম গিফট হিসেবে! ওটা তোমার জন্য!”

অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তিতে পাতার ছোট্ট মন কুঠিরে সদ্য জন্ম নেয়া অনুভূতির পুষ্প বৃন্ত পুলকিত হয়। অধরকোণে ভিড় করে মিষ্টি হাসি। উপহার পেতে কার না ভালো‌ লাগে। আর‌ পাতা পঁচিশ বছরের জীবনে হাতে গোনা উপহার পেয়েছে। পাতা গিফট আনরাপ করে। ছোট জুয়েলারি বক্স। পাতা অসীম কৌতূহলী মন নিয়ে সেটা খুলে। দৃশ্যমান হয় সুন্দর সিম্পল ডিজাইনের পেনডেন্ট। সেন্টারে ইংরেজি লেটার এ,ভি,পি একসাথে এডযাস্ট করে ডিজাইন করেছে এবং তাদের অভ্যন্তরে ছোট্ট একটা পাথর বসানো! পাতা অবাক হয়ে তাকায়। অরুণ তার অবাক নজর খেয়াল করে বলে,

-” অবাক হচ্ছেন কেন? ছোটমা দিল তখন তো অবাক হলেন না!”

পাতা কিছু বলে না। সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। লতা আপুর নেকলেস টা খুলে অরুনের দেয়া‌‌ পেনডেন্ট পড়তে চেষ্টা করে।

-” স্বর্ণের?”

-” গাঁধা! স্বর্ণ সোনালী হয়! ওটার‌ সেন্টারে যে স্টোন দেখছেন ওটা‌ ডায়মন্ড।”

পাতা যেন ঝটকা খেল। ঘার ঘুরিয়ে অরুনের দিকে চাইলো। হাত থেকে পেনডেন্ঠ টা টুস করে পড়ে গেল। চোখে মুখে অস্বাভাবিক অবাকতা! সে কি সঠিক শুনলো?

অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায় নিচে পড়া পেনডেন্টের দিকে। তারপর পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” কি হলো?”

পাতা চটপট পেনডেন্ট তুলে নেয়। এই লোক‌‌ বলে‌ কি!

-” এতো‌ দামি গিফট আমি কি‌ করবো?”

-” স্যুপ বানিয়ে খাবেন!”

বিরক্ত হয়ে বলে অরুণ। পাতা অরুণের দিকে করুণ চোখে চায়। অরুণ চোখ রাঙিয়ে বলে,

-” পড়ুন এখনি। আর এটা সবসময় পড়ে থাকবেন!”

এক প্রকার ধমকের সুরেই বলে। পাতা দোনামোনা মনে গলায় ঝুলায়। এতো দামি গহনা তার গলায় ঝুলছে! এ যেন‌ বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা! পাতা আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখে। ফর্সা গলায় বেশ ফুটে উঠেছে। সে নিজেকে পুনরায় দেখে!

-” সবসময় পড়বো? যদি হারিয়ে যায়?”

অরুণ সময় নেয় না। উঠে এসে পাতার পিছনে আয়নায় সামনে দাঁড়ায়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব দু হাত। পকেটে হাত গুজে আয়নার নারী কায়ার প্রতিচ্ছবির দু নয়নে নয়ন রেখে মোহনীয় গলায় বলে,

-” আবার গড়িয়ে দেবো!”

পাতা নজর ঝুঁকায়! আবার গড়িয়ে দেবে! কথাটা এতো মিষ্টি শোনালো কেন? তেতো মুখে মিষ্টি কথাও বের হয়? পাতা আয়নার সামনে থেকে সরে আসে। অস্বস্তি কাটাতে বাহানা‌ হিসেবে টেবিলের ড্রয়িং খাতা গোছাতে থাকে। হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বলে,

-” আচ্ছা আপনি আপনার মাকে ছোটমা কেন ডাকেন?”

অরুণের গম্ভীর মুখশ্রী খানিক মলিন হয়ে আসে। তবে সেটা পাতার নজরে পড়ে না। অরুণ শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

-” বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী সে! সেই হিসেবে ছোটমা ডাকি!”

পাতার হাত থেমে যায়। দ্বিতীয় স্ত্রী! তাহলে ওনার মা?

-” আপনার মা?”

-” ছোট থাকতেই মারা গেছেন!”

পাতা যেন চমকে ওঠে। মারা গেছেন! ছোট বেলায়ই! সে ঢোক গিলে। অরুণের দিকে চায়। শান্ত ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে।পাতার সেদিনের বলা কথাটা স্মরণে আসে। বিষাদে ঘেরা জীবন! সত্যিই তো মা হীন জীবন নিশ্চয়ই পুষ্পঘেরা নয়। সে মায়ের ভালোবাসা যতটুকুই পাক না কেন তবুও মা বিন একটা ছোট্ট দিনই কাটে না; অথচ উনি! সে অরুণের দিকে এগিয়ে আসে। ভয়, অস্বস্তি, লজ্জা পিছে ফেলে পা উঁচিয়ে অরুণের বুকের মধ্যিখানটায় মাথা রেখে দু হাতে পিঠ আঁকড়ে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। জড়িয়ে ধরতেই পাতার গা যেন শিরশিরিয়ে ওঠে। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে দোদুল্যমান অনুভূতি টগবগিয়ে বেড়ে ওঠে। অরুণের গা থেকে ভেসে আসা জেন্টস পারফিউমের ঘ্রাণের সাথে তীব্র পুরুষালী ঘ্রাণটাও যেন নাসাগহ্বরে সুরসুরি দিচ্ছে। সে হাতের বাঁধন শক্ত করে।

অরুণ সরকার স্তব্ধ, বিমূঢ়, অনুভূতিহীন দাঁড়িয়ে! পাতাকে আকরে ধরে না ,না সরিয়ে দেয়। হাতের মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে নির্জীব কাঠপুতুলের মতো।
_______

মিটমিট তারায় প্রজ্বলিত খোলা আকাশের নিচে একতালা বিশিষ্ট ছাদে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছে রমনীদের দল; ছেলেরাও আছে। ছাদের কিনারায় লাগানো বড় টবে মাঝারি শিউলি গাছের ফুল থেকে শিউলি ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ হালকা বাতাসে সবার নাসারন্ধ্রে বাড়ি খাচ্ছে। তার পাশে লাগানো গোলাপ, নয়নতারার টবেও গোটা পাঁচেক ফুল আছে তবে সেগুলি ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে না। ছাদের কিনারে ছোট্ট পেয়ারা গাছে গোটা দশেক পেয়ারা ঝুলছে। আরো ছিলো সেগুলো বাড়িতে আগত মেহমানদের উদরে পরিপাকের পথে। পাতা পেয়ারা গাছ থেকে আরো দুটো পেয়ারা পেরে একটা চাচাতো বোন ছোটো জুঁই কে দেয়। আরেকটা ওড়নায় ডলে নিজে কামড় বসায়। জুঁই পেয়ারা নিয়েই আড্ডায় যোগ দেয়। ছোট সে তবুও বড়দের কথা হা করে গিলছে।পাতা ছাদের রেলিংয়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে আঁধারের চাদরে মুড়ানো। শুনশান পরিবেশেও তার কাজিন মহলের হইহুল্লোড়ে মনে হচ্ছে মাছের বাজার।‌ আর তাদের হইহুল্লোড় ও আড্ডার মুখ্য ভূমিকায় অরুণ সরকার ও কালকের হলুদের অনুষ্ঠান। পাতা চুপচাপ তাদের সকল হাসি তামাশা শুনতে থাকে। বিরক্ত লাগছে না! বরং ইনজয় করছে। তবে তার মনটা একটু খারাপ। কাল হলুদ পরশু বিয়ে। বাড়ি মেহমানে ভরপুর। তার দুই মামা, মামী মামাতো ভাই বোন। চাচা চাচী সহ চাচাতো ভাইবোন। প্রিয়, পাবেল, কাওছার ভাই, জুবাইদা,ফরহাদ আর মা এসেছে। আর কেউ আসেনি ও বাড়ি থেকে। দাদি, ছোট মা, চাচা আসেনি সে মেনে নিয়েছে কিন্তু বাবা? সেও আসলো না! তার নাকি কাজের ব্যস্ততা। আসতে পারবে না। পাতা ভাবে প্রিয়র বিয়ের সময়ও কি ব্যস্ত থাকবে? না সে তো নিজের রক্ত। সেক্ষেত্রে হাজার ব্যস্ততাও তাকে ব্যস্ত রাখতে পারবে না। পাতার চোখ ভরে ওঠে। বাবা তাকে মেয়ে না মানুক! সে তো তাকে বাবাই মানে। ছোট্ট থেকে তাকেই বাবা ডেকে এসেছে। সে তার জন্মদাতা নয় জানার পরও মন থেকেই বাবা ডেকে এসেছে। প্রিয়, পাবেলের মতো বাবার আদর ভালোবাসা না পেলেও কখনো বাবার নামে অভিযোগ আনে নি মন কুঠিরে! কিন্তু আজ তার এই বিশেষ দিনগুলোতে বাবার অনুপস্থিতিতে মন অভিযোগ করে বসলো যেন! পাতার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে জুবাইদার ডাকে। তাকে ডাকছে আড্ডায় বসার জন্য।
পাতা চোখের পানি লুকিয়ে হাসি মুখে বলে,

-” তোরা দে আড্ডা আমি শুনছি তো!”

পাতার মামাতো বোন সালমা এসে পাতাকে টেনে বসিয়ে দেয় আড্ডায়। মামাতো ভাই স্বপন পাতাকে বলে,

-” আরে পাতা সবসময় চুপচাপ থাকো কিভাবে? আমি তো বাবা একটু চুপ থাকলেই হাঁপিয়ে যাই!”

জুবাইদা হেসে বলে,

-” ও ছোট থেকেই এমন! তবে সবসময় চুপচাপ থাকে না। যখন কথা বলে কাউকে বলার সুযোগ দিবে না। একাই ফরফর করবে!”

সবাই হেসে ওঠে তার কথায়। পাতাও মুচকি হাসে; কথা ঠিক। কাওছার হাই তুলতে তুলতে বলে,

-” এই পাতু? তোর বুইড়া জামাইয়ের সাথে কথা হয়েছে?”

পাতা চোখ রাঙায়। এই কাওছার ভাই শুধরানোর নয়।

-“হয় নি!”

পাতার আরেক মামাতো বোন ঐশী বলে,

-” হয়নি বললে আর আমরা বিশ্বাস করে নেব! আমরা বুঝি না ভেবেছো পাতা আপু। একটু ফাঁক ফোকর পেলেই আড়ালে চলে যাও প্রেমালাপ করতে!”

পাতা শান্ত চোখে চায়।

-” শুধু দুপুরেই কথা হয়েছে তাও দরকারি কথা। তোরা সেটাকে টেনে হিচরে বড় বানাবি!”

সবাই সম স্বরে বলে,

-” অবশ্যই!”

পাতা কানে হাত দেয়।

-” আস্তে কথা বল। লতাপু ঝাড়ু নিয়ে এসে সবকটাকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে।”

লতার কথা শুনে সবাই শান্ত হয়ে বসে। কাজিন দের মধ্যে লতা সবচেয়ে বড় ও রগচটা। রাগ যেন রগে রগে। লতার কথা আসতেই জুবাইদা বলে,

-” আচ্ছা দুলাভাই কবে আসবে?”

পাতার মুখটা আবার মলিন হয়ে যায়। তার বিয়ে নিয়ে এতো ঝামেলা। দুলাভাই আপুর সাথে রাগ করে লাবিবকে নিয়ে চলে গেছে বাড়িতে। এটা অবশ্য আব্বু আম্মু জানে না। পাতাকে রিং পড়িয়ে যাবার পরদিন রাতুল লতাকে ভালোভাবে বলেছিল বাড়ি যেতে। ঈদের পরদিন আবার আসবে। জেদি লতা যাবে না তার এককথা! দুলাভাই ভালো ভাবে অনুরোধ করতে করতে হঠাৎ রেগে যায়। কিন্তু কিছু বলে না। আব্বুকে বলে লাবিবকে নিয়ে চলে যায়। লতা আটকায় না। এরপর কি হয়েছে পাতার জানা নেই। আতিকুর ইসলাম কল করলে বলে; বিয়ের দিন সকালে আসবে। আতিকুর ইসলাম লতাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করে; কিছু হয়েছে নাকি? জামাই এমন কথা‌ বলে কেন? লতার সাফ জবাব; সে জানে না। পাতা অবশ্য কল করেছিল রাতুলকে। দুলাভাইকে বুঝিয়ে অনুরোধ করে। রাতুল আশ্বাস দিয়েছে কাল সকালে আসবে।

-” কি রে বল না?”

জুবাইদার ধাক্কায় পাতা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। জুবাইদার দিকে তাকিয়ে আধ খাওয়া পেয়ারায় কামড় বসিয়ে বলে,

-” কাল সকালেই আসবে!”

কাওছার ভ্রু কুটি নাচিয়ে বলে,

-” এই তুই একটু পর পর কোথায় হারিয়ে যাস? নিশ্চয়ই তোর ওই বুইড়া জামাই..”

আর বলতে পারে না।‌ পাতা আধ খাওয়া পেয়ারা ছুঁড়ে মারে তাকে উদ্দেশ্য করে। কাওছার সেটা ক্যাঁচ করে নেয়। পাবেল হেসে বলে,

-‘ পাতা আপু তুমি আস্ত জামাই পাগল! তোমার জামাইয়ের নামে কিছু বলাই যায় না ছ্যাত করে ওঠো! লতা‌ আপুও এমনি। নিজে দুলাভাইকে ভাও দিবে না অথচ তার নামে কেউ কিছু বললে সর্বনাশ!”

কাওছার সায় জানায়। আধ খাওয়া পেয়ারা পাতার দিকে ছুঁড়ে বলে,

-” হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি কথা। এখন পাতু এক কাজ কর তোর জামাইরে কল লাগা! এক্ষুনি; এটা তোর বড় ভাইয়ের আদেশ।”

পাতা ভেংচি কাটে। পেয়ারা পুনরায় ওড়নার আজলে মুছতে মুছতে বলে,

-” তোমার আদেশ মানতে বয়েই গেছে।”

-” কল দিবি না?”

-” না।”

-” ভেবে বলছিস?”

-” হুম।”

কাওছার নিজের ফোন বের করে দুষ্টু হেসে বলে,

-” তুই না করলি আমি করছি। আমার কাছে ফোন নম্বর আছে। ফোন দিয়ে বলবো অরুণ বরুণ কিরণমালা তোমার পাতা‌ কাঁদছে তোমার বিরহে।”

পাতা সন্দেহ নজরে চায়। কাওছার ভাইয়ের ভরসা নেই। কাওছার ভ্রু নাচিয়ে বলে,

-” বিশ্বাস হচ্ছে না?”

-” দেখ কাওছার ভাই একদম ফালতু কাজ করবে না। এখন রাত সারে এগারোটার কাছাকাছি।”

কাওছার অরুণের নাম্বার দেখিয়ে বলে,

-” তুই কল করবি; না আমি?”

পাতা হতাশ হয়। এই নাছোড়বান্দা কথা শোনার নয়।

-” আমিই করছি। তোমার ভরসা নেই। তবে আজেবাজে কথা নয়?”

জুবাইদা পাতার পিঠ চাপড়ে বলে,

-” লাউডে দিবি। আমরা কিছু বলবো না; চুপ থাকবো। শুধু তোরা দুজনে কথা বলবি।”

পাতা কল করে। তার ওত টেনশন নেই। সে জানে নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা ফোন করলে হু হা করে ভোরের হাতে ধরিয়ে দিবে। অল্পক্ষণ পরে কল কেটে যায়। পাবেল আফসোস করে বলে,

-” যাহ্ পাতা তোর কল‌ কেটে দিল!”

পাতা মুচকি হেসে বলে,

-” কল এলো বলে!”

সাথে সাথে কল আসে। কাওছার কল কেড়ে নিয়ে রিসিভ করে লাউডে দেয়। ইশারায় কথা বলতে বলে। পাতা সালাম জানায়। ওপাশ থেকে মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে আসে।

-” আম্মু আমি ভোর!”

উপস্থিত বাকি সবাই হতাশ। পাতা খুশি হয়ে ফোনটা তুলে নিয়ে ছাদের কিনারায় যায় শিউলী গাছের পাশে।

-” কেমন আছো ভোর? কত রাত হয়েছে ঘুমাও নি?”

অরুণ ছেলেকে‌ বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। ভোর বাবার বুক থেকে মাথা তুলে বলে,

-” এইতো‌ ঘুমাবো এখন। তুমি কল করলে; তুমি ঘুমাবে না?”

-” এই তো ঘুমাবো! তুমি ঘুমাও কেমন? রাখি?”

-” ওকে আম্মু! গুড নাইট!”

-” গুড নাইট!”

কল কেটে যাবার পর ভোর বাবার গলা জড়িয়ে বলে,

-” আব্বু আম্মু কবে আসবে আমাদের বাড়িতে?”

-” খুব শিঘ্রই কলিজা!

ভোর মাথা তুলে অরুণের ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে,

-” ভোর লাভস ইউ সো মাচ আব্বু কলিজা!”

অরুণ হেসে ছেলের পুরো মুখশ্রী চুমুতে ভরিয়ে দেয়।শক্ত করে বুকে জড়িয়ে বলে,

-” মি ঠু কলিজা!”

পাতা কল কেটে পাশে তাকায়। কাওছার ভাই দাঁড়িয়ে। সে পিছন ফিরে দেখে বাকি সবাই আড্ডায় মেতে।

-” তুমি এখানে? আড়িপাত ছিলে? ছোট বোন হই তোমার।”

কাওছার হাসে। পাতার মাথায় টোকা দিয়ে সিরিয়াস গলায় বলে,

-” পাতু ইউ ডিজার্ভ বেটার।”

পাতা কাওছারের দিকে চায় একপল। তারপর খোলা আকাশে মিটমিটিয়ে হাসি মাখা তারকারাজির দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ইউ ডিজার্ভ বেটার বলে কিছু হয় না! তুমি যা ডিজার্ভ করো তাই পাবে। আর যা পাবে না তা তুমি ডিজার্ভই করো না।”

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ২৬ (বর্ধিতাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

তপ্ত রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেল। পশ্চিম দিগন্তে অরুণ হেলে পড়ছে। বিকেলে রোদের তীব্রতা কম থাকলেও তাপমাত্রা যেন আটত্রিশ ডিগ্রি সেন্ট্রিগেট।‌ ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল লোকালয়। সরকার বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত সময় পার করছে।‌ শান্ত শুনশান নীরবতায় ঘেরা বাড়িটা আজ হইহুল্লোড়ে মেতে আছে। বিয়ে বাড়ি মেহমানদের ভিড় অঢেল। মেহমান সহ বাড়ির সকলে বাড়ির বাইরে গার্ডেন এরিয়ায় অবস্থান করছে। বাচ্চারা দৌড়ঝাপ করতে করতে খেলছে। বয়স্করা বসে চায়ের কাপে সাংসারিক আলাপে ব্যস্ত। ইয়াং ছেলেমেয়েরা যান্ত্রিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত। ডেকোরেশনের লোকগুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত। বাইরে গার্ডেনে লাইটিং ও ডেকোরেটর এর কাজ চলছে। তাদের মাঝে মাঝে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে অ্যাডভোকেট সরকার সাহেব । অরুণ দূরে একটা গাছের নিচে ব্রেঞ্চে বসে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে অফিসের কিছু কাজে ব্যস্ত। দূরে বসার কারণ তার একেকটা হারামিখোর বন্ধু! সকালে এসেছে অবধি আজকের অনুষ্ঠান নিয়ে তার কানের পোকা বের করে ফেলেছে। বিকেলের হলুদ সন্ধ্যার অনুষ্ঠান না; হলুদ সন্ধ্যার পর রাতের ব্যাচেলর পার্টির অ্যারেঞ্জমেন্ট বিষায়ক আলাপ-সালাপ! অরুণ বলেছে‌; সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে তোরা শুধু খেয়াল রাখবি আরিয়ানের কানে এসব কথা না পৌঁছায়। এর পরও ওই হারামীর দল নাছোড়বান্দা টাইপ আচরণ করছে। তাদের থেকে বাঁচতেই এখানে বসে! আশেপাশে বাচ্চারা দৌড়া দৌড়ি করছে অরুণ সেদিকেও খেয়াল রাখছে। ছেলেটা গরমে ঘেমে একাকার। তবুও ছোটাছুটিতে ব্যস্ত। ক্লান্তির ছিটেফোঁটাও নেই চেহারায়; বরং উজ্জ্বল মুখে সব বাচ্চাদের সাথে মিলে মিশে একাকার! এতো এতো খেলার সাথী রোজ রোজ মেলা ভার! আর পাতাবাহার তার পাশে তাকে ঘেঁষে বসে আছে। ছোট্ট মালিকের কাছেও গিয়েছিল। তার খেলার সাথী কোলে তুলে দু তিনবার ছুড়ে ফেলে। ব্যস! মহারাণী দৌড়ে তার কাছে চলে আসে। সে বিড়াল শাবকটির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বিড়ালটি আরেকটু ঘেঁষে বসে মিউ মিউ করে ডাকে। অরুণ তার কান টেনে বলে,

-” পাতাবাহার তুমি কি এক্সাইটেড তোমার নতুন সখির আগমনে? তার নামও পাতাবাহার। তোমার মতোই কিউট!”

বিড়াল শাবকটি মিউ মিউ করে ডাকে। অরুণ তার গাল চেপে বলে,

-” বুঝতে পারছি তুমি এক্সাইটেড!”

বলে নিজের কাজে মনোযোগ দেয়। তারাতাড়ি শেষ করলেই হলো। নইলে দেখা যাবে ওরা আবার হাজির হবে। বিয়ে উপলক্ষে তার সব বন্ধুদের আগমন। আরো অনেক আত্মীয় স্বজন। আসমা বেগমের বাবার বাড়ির লোকজন, আদুরির কিছু বান্ধবী, আরিয়ানের বন্ধুরা,রুবির বাবার বাড়ির দু একজন। আর ভোরের স্কুলের প্রিন্সিপাল সাবরিন সাবিনা ওরফে তার খালামনি! তার সাথে তার দুই নাতনি। আর মামা স্বাধীন চৌধুরী কাল আসবে বলেছে। শুধু তিনিই আসবেন অরুণ জানে। কারণ তার একমাত্র মামার ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীর সাথে অরুণের সম্পর্ক খানিকটা এলেবেলে! ছোটবেলায় বাবার সাথে মনোমালিন্যে রাগ করে মামার বাসায় থেকেছিল টানা একমাস। এতেই মামী ও মামাতো ভাই বোনের চোখের বালি হয়ে গিয়েছিল। মা হীন‌ অরুণকে মামা একটু বেশিই আদর করতো। আপন ছেলে মেয়ের মতোই। তাই হয়তোবা! বাবার কথা আসতেই অরুণের তার কথা স্মরণে আসে। অনিক সরকার লোকটা গাম্ভীর্যে ভরপুর দায়িত্ববান কঠোর রগচটা জেদি লোক ছিলেন।‌ অরুণের সাথে তার বাবার সম্পর্ক খুব সুবিধার ছিল না। মা হীন অরুণ বেপরোয়া, উচ্ছৃঙ্খল, জেদে টইটম্বুর ,বদমেজাজি ও মারকুটে স্বভাবের ছিল। অরুণের এমন শৃঙ্খল বিহীন জীবন নিয়ে অনিক সরকারের ঘোর বিরোধিতা ছিল। তিনি অরুণকে মানা‌ করতেন! অরুণ মাথা কাত করে সায় জানাতো। সায় জানানো অবধিই ঠিক; বাইরে বের হলেই যেই অরুণ, সেই অরুণই। অনিক সরকারের সাথে এ নিয়ে রাগে জেদে ফেটে পড়তেন।‌ প্রহার করতে ভুলতেন না‌।‌ অরুণ বাবার সাথে কখনো তর্কে জড়াতো না। সে জানে বাবা তাকে ভালোবাসে খুব। তার ভালো ভবিষ্যত চায় তাই চিন্তা করে। কিন্তু সে এভাবেই থাকতে ভালোবাসে। আজকের অরুণ সরকার আর এক যুগ আগের অরুণ সরকারের মাঝে ঢের ফারাক।‌ আজকের অরুণ সরকার হওয়ার পেছনে বর্ষার হাত অনেক সেটা অস্বীকার করে না অরুণ। তার নিয়মহীন বিশৃঙ্খল জীবনে বর্ষা যেন রূপকথার সোনার কাঠি রুপোর কাঠি হয়ে ম্যাজিকের মতো‌ জীবনকে পরিবর্তিত করে দিয়েছিল। তাকে ভরা নদী থেকে প্রণয়ের জোয়ারে ভাসিয়ে কিনারায় নিয়ে যাওয়া মানবী বর্ষা; আবার অথৈ সমুদ্রে‌ ফেলে‌ পালিয়ে যাওয়া মানবীও বর্ষা। সে তো বেঁচে আছে তার লাইফ বোট; তার কলিজার টানে!

বর্ষার সাথে তার প্রণয়ের সম্পর্ক বর্ষার ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই। তাদের প্রণয় কথা ভার্সিটির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে। অরুণের ভার্সিটি লাইফ শেষ হওয়ার পরেই সে বাবাকে বর্ষার কথা জানায়। অনিক সরকার বিরোধীতা করে না। তিনি আগে থেকেই অবগত তার ছেলের পরিবর্তনের মুখ্য কারণ। তিনি সব মেনে নেন; তবে শর্ত দেন অরুণকে তার পারিবারিক ব্যবসায় বসতে হবে। অরুণের এতে আপত্তি ছিল না। সে কোন ক্লাস টপার ছিল না। কোনো মতে টেনে টুনে চালিয়ে লোকের মুখ বন্ধ রাখার মতো। কিন্তু বর্ষার এতে ঘোর আপত্তি। সে চাইতো অরুণ ব্যবসায় না বসে নিজ উদ্যোগে কিছু করুক। অরুণের বাবা বর্ষার বাসায় প্রস্তাব পাঠালে বর্ষা সময় চায়। অরুণ দেয় সময়; তার তাড়াহুড়ো নেই। কিন্তু এরই মাঝে অনিক সরকার পরলোকগমন করেন। এমন হৃদয় বিদারক সময় পেরিয়ে না যেতেই ব্যবসায় ধস! অরুণ নিজ হাতে ব্যবসার হাল ধরে। বছর খানিক বাদে বর্ষার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সম্পর্কে ও ব্যবসায় ধাক্কা খেতে খেতে এখন সে আ সিঙ্গের ফাদার ও সফল বিজন্যাসম্যান। তার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। অরুণ ফোন রিসিভ করে কানে ঠেকিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,

-” টাইমিং দেখো! তোমার কথাই ভাবছিলাম!”

-” বাব্বাহ অরুণ সরকার এখনো আমাকে নিয়ে ভাবে!!”

বর্ষার কথায় অরুণ মৃদু হাসে। ল্যাপটপের সাটার অফ করে রিল্যাক্স হয়ে বসে।

-” অরুণ সরকার বেইমান ও স্বার্থপরদের কখনো ভুলে না!”

বর্ষা চুপ করে যায়। কিছু সময় পর শান্ত গলায় বলে,

-” শুনলাম বিয়ে করছো?”

-” না করার কথা ছিল নাকি?”

অরুণের ত্যারা কথায় বর্ষা বিরক্ত হয়ে বলে,

-” সেটা বলি নি। বিয়ে করছো ভালো কথা কনগ্রেটস! আমি বরুণের কথা ভাবছি। আমি বরুণকে নিতে..”

আরুণ তাকে থামিয়ে কড়া গলায় বলে,

-” আমার ছেলের কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার ছেলের জন্য আমি আছি। মার্ক মায় ওয়ার্ড আমি আছি আর আজীবন থাকবো!”

-” ভুলে যেওনা আমি বরুণের মা। আমারো অধিকার আছে ওর উপর। এখন তো জোড় গলায় বলছো আমি আছি; দুদিন পরে কচি নতুন বউ আসবে তাতেই মজে থাকবে। বাচ্চা কাচ্চা আসবে। তাদের ভিড়ে বরুণ..”

অরুণ হেসে তার কথা শেষ করার আগেই বলতে শুরু করে,

-” শোন জন্ম দিলেই মা হওয়া যায় না। তুমি মা কথাটার যোগ্যই না। এতটুকু কোলের বাচ্চাকে রেখে চলে গেলে একবার মায়া হলো‌না। এখন এতো দরদ কোথা থেকে আসছে শুনি? আর হ্যা জোর গলাতেই বলবো আমার ছেলের জন্য আমি আছি; থাকবো। নিজের মতো স্বার্থপর ভেবো না আমায়। আমার কাছে সবার আগে আমার ছেলে।”

বর্ষা উচ্চ স্বরে হেসে বলে,

-” তোমার অতিরিক্ত রাগ জেদই তোমাকে বরুণের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। ঠিক তোমার বাবার মতোই। আমিতো তোমার মধ্যে তোমার বাবার প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাচ্ছি আর বরুণের মধ্যে তোমার।”

অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। নিজেকে শান্ত রেখে শান্ত গলায় জবাব দেয়,

-” তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। নিজের রাস্তা মাপো! তোমার হাসবেন্ড ভালো মনের মানুষ। মাঝপথে তার হাত ছেড়ে দিও না। লোভ খুবই ভয়ংকর জিনিস। আর ভুলেও কল করার চেষ্টা করবে না। গুড বায়!”

বলেই কল কাটতে নিলে বর্ষা বলে ওঠে,

-” কাটবে না। ভোরের সাথে কথা বলবো আমি! ওর কাছে দাও?”

অরুণের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে।

-” দেব না। তোমার এসব বস্তা পঁচা কথাবার্তা আমার ছেলের কানে না যায়।”

বর্ষা অনুনয়ের সুরে বলে,

-‘ আমি ওতটাও খারাপ না অরুণ। ওর কাছে দাও একটু কথা বলবো। প্লিজ?”

অরুণ ফোন কান থেকে সরায়। বাচ্চাদের দিকে খানিক এগিয়ে ভোরকে ডাকে। ভোর শুনতে পায় না হইহুল্লোড়ের মাঝে। অরুণ উঁচু গলায় ডাকে। বাচ্চারা ভয় পেয়ে কেটে পরে এলোমেলো দৌড়ে। ভোর গোমড়া মুখে বাবার সামনে কোমড়ে হাত দিয়ে ঝগরুটে ভঙ্গিতে বলে,

-” আব্বু একটু মিষ্টি করে ডাকতে পারো না? এমনিতে ভেনোমের মতো গলা তোমার তারপর এতো জোরে ডাকছো; আমার বন্ধুরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলো।”

অরুণ হাল্কা হেসে ছেলেকে কোলে নিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দেয়। তার পাশে বসে ফোনটা বাড়িয়ে বলে,

-” কথা বলো?”

ভোর কপাল কুঞ্চিত করে গাল ফুলিয়ে চায়।

-” কার সাথে?”

বলে ফোনটা কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে বর্ষা আদুরে গলায় বলে,

-” বরুণ সোনা? আমি তোমার মা; কেমন আছো?”

ভোরের মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়। কুঞ্চিত কপাল শিথিল হয় ; ফুলো গালে হাসির রেখা বয়।

-‘ মা! আমি ভালো আছি; তুমি কেমন আছো?”

-” আমিও ভালো আছি! খেলছিলে তুমি? আমি ডিস্টার্ব করলাম?”

-” খেলছিলাম কিন্তু ডিস্টার্ব হয় নি মা। খুশি হয়েছি তুমি কল করেছো! জানো মা আব্বু আমার জন্য একটা কিউট আম্মু সারপ্রাইজ দিয়েছে। আম্মু খুউব ভালো। আমায় অনেক ভালোবাসে ও আদর করে। একটুও বকে না।”

অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে বর্ষার রিয়াকশন কল্পনা করে। মেয়ে মানুষ হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করবে না তা হয় নাকি! প্রাক্তন হোক বা বর্তমান! তার সাথে জড়িয়ে অন্য কোন মেয়ের কথা শুনলেই জ্বলবে আর লুচির মতো ফুলবে। অরুণ পকেটে থেকে রুমাল বের করে ছেলের মুখশ্রীর ঘাম মুছে দেয়।

বর্ষার হাসি মুখ খানি মলিন হয়। তার নিজের ছেলে কি সুন্দর করে অনায়াসে অন্য একজনকে আম্মু ডাকছে!

-” তাই? আম্মুকে ভালো লেগেছে তোমার?”

-” খুউব! কালকে নিয়ে আসবো আম্মুকে। কাল থেকে আমাদের সাথেই থাকবে। আমি আম্মু আর আব্বু।”

বর্ষার বুকটা কেঁপে উঠলো কি?

-” ওহ্। তোমার আম্মুর সাথে পরিচয় করাবে না আমার?”

ভোর প্রবল উৎসাহের সাথে উত্তর দেয়,

-‘ অবশ্যই মা! তুমি আসো?”

অরুণের ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়। বর্ষা মিছে অভিমানের সুরে বলে,

-” কিভাবে আসবো তুমি তো আমাকে ইনভাইট ই করো নি!”

ভোর জিভে কামড় দিয়ে বলে,

-” ইশ! একদম মনে ছিল না। এখন বলছি তো!”

-” না থাক আসবো না। তোমার আব্বুর ভালো লাগবে না আমি আসলে। তোমার নতুন আম্মু যদি রেগে যায়!”

ভোর ঘোর বিরোধিতা করে,

-” কেউ কিছু মনে করবে না। তুমি আসো না মা? আই মিস ইউ!”

বর্ষার মাতৃমনটা যেন কেমন ছটফট করে।

-” তোমার আব্বুর থেকে আগে পারমিশন তো নাও আমায় এলাও করবে কি না?”

ভোর হাসি মুখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আব্বু তুমি বলো না মাকে? তুমি বললে ঠিক আসবে। প্লিজ? প্লিজ আব্বু কলিজা?”

অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চায়। কতটা মায়াময় নিষ্পাপ মুখশ্রী। সেদিনের ঘটনার পরও ভোরের ছোট্ট মনে একটুও দাগ কাটে নি? ভোর বসা থেকে উঠে বাবার গলা জড়িয়ে গালে চুমু খেয়ে অনুনয়ের সুরে বলে,

-” আব্বু কলিজা প্লিজ?”

এভাবে বললে মানা করা যায়? তার তো সাধ্য নেই;ছেলের হাসিমুখের আবদার ফেলতে পারে না। ফোন নিজের কানে ধরে বলে,

-” আসতে পারো। পরশু রিসেপশনে; সন্ধ্যার পরপরই!”

বলেই কেটে দেয়। ভোর খুশি হয়ে বাবার গালে আরো কয়েকটা চুমু খায়। অরুণ ফোন সরিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে কোলে শুইয়ে দিল। গালে আলতো কামড় বসিয়ে বলে,

-” আদরের ব্লাকমেইল হুম? বাবাকে বশ করা শিখছো!”

ভোর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে; হাসার দরূণ তার ছোট্ট শরীর দোদুল্যমানমান। অরুণ ছেলের পেটে মুখ ঘসে,

-” আমার দুষ্টু আব্বু! কবে বড় হবে? সব বুঝতে শিখবে?”

ভোর সুরসুরি পেয়ে কৈ মাছের ছটফট করে হাসতে হাসতে বলে,

-” আমি তো বড়ই। আর কিছুদিন পরে তোমার সমানও হয়ে যাবো দেখে নিও!”

-” না কলিজা তুমি এমন ছোট্ট টিই থেকো! বড় হলে তো বাবাকে ভুলে যাবে!”

ভোরের হাসি থেমে যায়। সোজা হয়ে বাবার চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বড়দের মতো বলে,

-” ভোর কখনো তার আব্বুকে ভুলবে না দেখে নিও!”

অরুণের ঠোঁট হাসি বিস্তার হয়। ছেলের আদুরে মুখশ্রী আদরে ভরিয়ে তোলে। ভোর আবার হাসিতে মেতে ওঠে। ছোট্ট বিড়াল শাবক ল্যাপটপের উপর শুয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বাবা ছেলের ভালোবাসা দেখছে। তাকে তো ভুলেই বসেছে। সে কথা বলবে না বাবা ছেলের সাথে; মিও!

-” বাপ ছেলের হয়ে গেলে আমরা আমাদের কাজ করতে পারি?”

অরুণ ভোর সামনে তাকায়। শুভ, জীবন, ফয়সাল, মুস্তাকিম, দীপ্ত রাসেল দাঁড়িয়ে। সবার পরনে হাফ প্যান্ট ও হাতা কাটা গেঞ্জি। আর দীপ্ত ও রাসেলের হাতে বালতি ভরা পানি। মুস্তাকিম, ফয়সাল ও জীবনের হাতে কিছু আছে; তার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। আর শুভ এগিয়ে এসে তার কোল থেকে ভোরকে এক প্রকার ছিনিয়েই নিল। অরুণ সন্দেহ দৃষ্টিতে তাদের দিকে চায়। শালাদের ভরসা নেই। সে উঠে পা চালায় কেটে পরার জন্য; কিন্তু পারে না।‌ শুভ ভোরকে নামিয়ে দিয়ে অরুণকে পিছন থেকে জাপটে ধরে শক্ত করে। রাসেল মেজরের মতো করে বলে,

-” মিশন স্টার্ট!”

বলেই বালতির সকল পানি অরুণের মাথায় ঢেলে দেয়। আদুরি ক্যামেরা নিয়ে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে সাবাসী দেয়,

-” ওয়েল ডান। নেক্সট মিশন স্টার্ট করো ভাইয়ের বন্ধুগনস?”

অরুণ বাকহারা। এগুলো কোন জাতের গরু!
জীবন , মুস্তাকিম, দীপ্ত হলুদের বাটি সম্মুখে এনে হাতের মুঠোয় ভরে অরুণের গালে মুখে গলায় ভরিয়ে দেয়। গায়ের শার্ট টেনে ছিঁড়ে খুলে ফেলে। অনাবৃত সম্পূর্ণ জায়গায় হলুদ মেখে ভুত বানিয়ে দেয়। অরুণ ছটফট করতে থাকে।

-” কাজটা ঠিক করছিস না!”

ফয়সাল বলিষ্ঠ পেটে চিমটি কেটে বলে,

-” বেশি ভাব নিলে প্যান্ট খুলে ওইখানেও হলুদ লাগিয়ে দেব! চুপ থাক শা*লা!!

অরুণ চুপ করে যায়। হারামিদের ভরসা নেই। গার্ডেন ভর্তি মানুষের তোয়াক্কা করবে না। সকলে এখন এখানেই উপস্থিত। বুড়ো বুড়ো ছেলেদের বাচ্চামো কান্ড দেখছে। ভোর তো হেসে কুটিকুটি। বাবাকে ইয়োলো ভুত লাগছে।
জীবন হাসতে হাসতে বলে,

-“গায়ে হলুদ অথচ হলুদ ছুবি না তাই কখনো হয়! নে হলুদে গোসল করিয়ে দিলাম। আদু যাহ এবার কনের‌‌ বাড়ি হলুদ তত্ত্ব নিয়ে। এদিকের হলুদ সম্পন্ন।”

আদুরি ক্যামেরা থেকে মুখ সরিয়ে বলে,

-” থ্যাংকস ভাই গনস!”

মুস্তাকিম ভ্রু নাচিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলে,

-” অরুণের হলুদ বলে কি ও একা হলুদ মাখবে নাকি! সবার হক আছে!”

রাসেল খালি বালতি নিচে ফেলে ভোরের দিকে যেতে যেতে বলে,

-” ওর কলিজাকে আগে লাগানো যাক। তার‌ কিউট মাম্মি আসবে বলে কথা!”

ভোর দৌড় লাগায় হাসতে হাসতে। রাসেলও বড় বড় পায়ে তার পিছু ছুটছে। অরুণ রাসেলের পিছনে যেতে যেতে সাবধান গীত গায়।

-” এই সমন্ধির বাচ্চা হারামখোর খবরদার আমার ছেলের গায়ে হলুদ লাগালে!”

শুভ জিভে কামড় দিয়ে বলে,

-” ছিঃ ছিঃ অরু ভাষা সংযত কর! এগুলো মুখে আনাও পাপ!”

-” হ্যা তোরা একেকটা সাধুর ওঁলাদ! রাসেল ভাইপার দেখ শুধু গালে ছুঁইয়ে দিবি। ওর এমনিতেই বারোমাস ঠান্ডা!”

মুস্তাকিম দৌড়ে ভোরকে ধরে একহাতে উঁচুতে তুলে গালে মুখে পুরো শরীরে হলুদ মাখিয়ে বলে,

-” হলুদ লাগালে গ্লো করবে। তখন তোর বিয়ের পিরিতেই ওর জন্য লাল টুকটুকে বউ খুঁজে বিয়ে পরিয়ে আনবো!”

ভোর তো হলুদে মাখামাখি; হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার যোগাড়। অরুণ এগিয়ে এসে মুস্তাকিমের হাত থেকে ভোরকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার ব্যাকসাইডে লাত্থি মেরে বলে,

-” শালা সম্বন্ধির দল! তোদের সব কটাকে মেনহলের বিশুদ্ধ পানিতে চুবাব। ওয়েট কর!

ওদের বন্ধুদের খুনসুটি বাড়ির সকল মেহমান হাসিমুখে ইন্জয় করতে ব্যস্ত। মুস্তাকিম লাথি খেয়ে থেমে যায় নি। আদুরি, আরিয়ান, আনিকা ,আসমা বেগম, আভারি, মিনু সহ সবাইকেই হলুদে গোসল করিয়েছে।

________

হইহুল্লোড়ে পরিবেশ জমে ক্ষীর। বাড়ির ছাদে ভুল ভলিউমে হিন্দি গান বাজছে। ছোট থেকে বড় সব মেয়েরা হলুদ শাড়ি গায়ে জড়িয়ে কাঁচা ফুলে সজ্জিত হয়ে সম্পূর্ণ তৈরি। কেউ ছবি তুলছে তো কেউ আড্ডা দিচ্ছে। কেউ পাতার শশুড় বাড়ির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ডেকোরেশনের লোক থেকে শুরু করে গায়ে হলুদে সকলের শাড়ি, ফুল‌, মালা ও বাড়ি থেকে এসেছে। আরো বিভিন্ন তত্ত্ব ডালা এসেছে সেগুলোতে পাতার গায়ে হলুদের সাজসজ্জার জিনিসপত্র। সাথে বিয়ের বেনারসী,গয়না, লাগেজ ভর্তি আরো বিভিন্ন সরঞ্জাম ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই এসব তত্ত্ব দেখে বাকহারা। পাতার ভাগ্য প্রসন্নের কথা সকলের মুখে মুখে। সাথে পাতা ও পাতার শশুর বাড়ির গুনগান। পাতার পা যেন মাটিতে ফেলতে দিচ্ছে না। পাতা অরুনের এসব কাজে যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ অবাক সকলের হঠাৎ পরিবর্তনে। আগত আত্বীয় মেহমান কয়েকদিন আগেও তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। তার থেকে দূরে দূরে থাকতো তারাই যেন আম্মু ছাড়া কথা বলছে না। এই মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তো এই আদর করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। লাবনী আক্তার, লুবমান ও লতা তো হা করে সকলের কর্মকান্ড দেখছে। পাতার বুঝতে অসুবিধা হয় না সকলের তাৎক্ষণিক পরিবর্তন। টাকা, সম্পদ, ক্ষমতা খুবই আজব জিনিস মানুষকে নিজের পিছনে ঘুরানোর মুখ্য বাহক। পাতা এখন চুপচাপ নিজের ঘরে বসে। পার্লার থেকে লোক পাঠিয়েছে নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা। পাতার হাসি পায় জীবনে পার্লারের ভিতরের চোপা খানি না দেখা মেয়েটাকে সাজাতে পুরো পার্লারের লোক এখানে উপস্থিত। কি সব ঘষামাজা করছে! পাতার বেশ লাগছে। সুন্দর একটা হলুদ জামদানি শাড়ি পড়ে আছে। শাড়িটা দেখতে বেশ সাথে দামিও। পাতার শাড়ির প্রতি আলাদা দূর্বলতা কাজ করে। সে একজন বাঙালি হিসেবে শাড়ি পড়তে খুব ভালোবাসে। তার তো ইচ্ছে করছে কিশোরী কন্যার মতো আঁচল উড়িয়ে নাচতে ছবি তুলতে। লতা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে আছে। ভারি মেকাপে পুরো চেহারার আদল বদলে দিয়েছে। পাতা লতাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,

-” ওভাবে কি দেখছো?”

লতা মাথা নাড়িয়ে বলে,

-” কিছু না।তোর জামাই বাড়ি থেকে লোকজন এসেছে। জলদি কর?”

পার্লার থেকে আগত মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলে,

-” হয়ে গেছে ম্যাম। নিয়ে যেতে পারেন।”

পাতা দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। পাতা অবাক হয় এতো পুরো চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে।‌ সে লতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” কে কে এলো? ভোর এসেছে কি?”

-” দেখলাম না তো। খালা শাশুড়ি এসেছে। তোর সাথে কথা বলতে চায়!”

বলার সাথে সাথেই একটা মধ্যবয়স্ক নারীর আগমন ঘটে ঘরে। ঘিয়ে রঙের শাড়ি পড়ে। চেহারা ও সাজসজ্জায় আভিজাত্যের ছাপ। পাতা সালাম দেয় তড়িঘড়ি করে,

-” আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাম! কেমন আছেন?”

সাবরিনা সাবিনা হেসে পাতার সম্মুখে দাঁড়ায়। থুতনিতে হাত রেখে মাশাআল্লাহ আওড়ায়। পাতার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-” মিষ্টি লাগছে। শোন আমি এখন প্রিন্সিপাল নই তোমার। খালামনি বলে ডাকবে। অরুণের আপন খালা আমি! বুঝলে?”

পাতা অবাক হয়। শুনেছে প্রিন্সিপাল ম্যামের চেনাজানা লোক অরুণ সরকার। কিন্তু ডিরেক্ট খালা? সেদিন অফিস রুমে তো ম্যাম বলেই ডাকলো। পাতা ভাবনা বাদ দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। লতা চেয়ার টেনে বসতে বলে তাকে। সাবরিনা সাবিনা অসম্মতি জানিয়ে বলে,

-” বসবো না। পাতার সাথে কিছু কথা আছে আমার। তোমরা‌ একটু বাইরে যাও দয়া‌ করে। আর দরজাটা লাগাতে ভুলবে না।”

লতা‌ সম্মতি জানিয়ে চলে যায়। পার্লারের মেয়েরা নিজেদের সরঞ্জামসহ বিদায় হয়।সাবরিনা পাতার ঘরে বিছানায় বসে ‌ পাতা ঢোক গিলে। কি বলবেন উনি? বকাঝকা করবেন? সাবরিনা হেসে বলে,

-” ভয় পাচ্ছো কেন? আমি বাঘ ভাল্লুক নাকি! এদিকে এসো?”

পাতা এগিয়ে যায়। সাবরিনা পার্স থেকে একটা কিছু টাকা বের করে পাতার হাতে ধরিয়ে বলল,

-” কোনো বাহানা না; ভাগ্নে বউয়ের মুখ খালি হাতে কিভাবে দেখি! মানা করলে বকবো কিন্তু?”

পাতা আর না করার সুযোগ পায় না। টাকা গুলো হাতের মুঠোয় নেয়। অনেক গুলো টাকা! শুধু কচকচে হাজার টাকার নোট! সাবরিনা পাতার হাত মুঠোয় ভরে বলে,

-” কিছু কথা‌ বলবো! মনোযোগ দিয়ে শুনো!”

পাতার কপাল কুঞ্চিত হয়। কি বলবেন উনি? সাবরিনা বেগম মলিন হেসে বলে,

-” তুমি জানোই হয়তো যে অরুণের মা বেঁচে নেই। ভোরের থেকে আরেকটু টান ছিল তখন মারা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।আমার বোন; অরুণের আসল মা নাম স্বপ্না। অরুণ মা পাগল ছেলে ছিল।‌ বাবার সাথে ছোট থেকেই বনে না। মা মারা যাবার পর ভেঙে পরে। ওর বাবা অনিক সরকার ওর কথা ভেবে ওর থেকে অনুমতি নিয়েই আরেকটা বিয়ে করে। তোমার বর্তমান শাশুড়ি আসমা‌ বেগমকে। আসমা বেগম ভালো মেয়ে ছিল। অরুণকে ভালোবাসাতো সাধ্যমতো। আমরা সেটাই জানতাম। একদিন বিকেলে সরকার বাড়ি গিয়েছিলাম। অরুণ ছিল না।‌বাবার সাথে কোথাও গিয়েছিল। তো আমি অরুণের ঘরে যাই। টুকটাক জিনিস দেখতে দেখতে একটা ডাইরি নজরে আসে। কৌতূহল বসত খুলে দেখি। কিছু লেখা ছিল না; তবে লাস্ট পাতায় ভাঙ্গা ভাঙ্গা অক্ষরে লেখা ছিল!

~ ছোটমা ভালো! আমাকে ভালোও বাসে। তবে আব্বুর সামনে বেশি ভালোবাসে; আদর করে। আব্বু না থাকলে কম কম ভালোবাসে।•

কথাগুলো পড়ে আমি স্থির থাকতে পারি না। ডাইরিটা রেখে আসমার কাছে গিয়ে অনেক কথা শুনাই আসমা অবশ্য কিছু বলে না।আমি তার চরিত্র নিয়েও কথা শোনাই! আমি রেগে চিল্লিয়ে চলে যাই। অনিক সরকারকে কল করেও অনেক কথা বলি। ছেলেকে যেহেতু পালতে পারবেন না; আমাদের কাছে দিয়ে দিন! আর আপনি নতুন বউ নিয়ে চুটিয়ে সংসার করুণ। আমার বোনের ছেলেকে আমরা মানুষ করতে পারবো। কিন্তু সেটা হয় না। আসমা অনিক সরকারকে‌ সব জানায়।
_____
অনিক সরকার পরদিন সকালে অরুণকে জিজ্ঞেস করে,

-” তোমার ছোটমা তোমাকে ভালোবাসে না?”

অরুণ হাসিমুখে জবাব দেয়,

-” বাসে তো বাবা!”

অনিক শক্ত গলায় অরুণকে বলে,

-” তাহলে সাবিনার কাছে কি বলেছো? আসমা তোমাকে ভালোবেসে না, বকে, কখনো কখনো মারেও? বাইরের মানুষ এসে আসমাকে কটুক্তি করে অপমান করে চলে যায়! কথা‌ বলছো না কেন?”

ছোট্ট অরুণ কেঁপে ওঠে। সে তো বলে নি এসব। বাবা কি সব বলছে?

-” কথা বলছো না কেন? স্পিক আউট?”

চিল্লিয়ে বলে অনিক সরকার। অরুণ ভয়ে দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগায়। বাবা চলে গেলে টেলিফোন দিয়ে খালামুনিকে কল করে জানায়, ছোটমাকে কি‌ বলেছে! সাবরিনা অরুণকে ডাইরির কথা বলে বলে,

-” তুমি আমাকে আগে কেন বলো নি অরুণ?”

-” তুমি কোন সাহসে আমার ডায়রিতে হাত দিয়েছো? আমি কোথায় লিখেছি যে ছোটমা আমায় বকে মারে? হ্যাঁ ?কথা বলো? সবাই আমাকে মিথ্যে বাদি ভাবছে! তুমি আর আমার সাথে কথা বলবে না! তুমি আমার খালামুনি নও!”

বলে কল কেটে দেয়। পুনরায় ফোন আসলেও ধরে না। চুপিচুপি কিচেন থেকে দিয়শলাই এনে ডায়টিটা পুরিয়ে ফেলে। আসমা বেগমের গলা জড়িয়ে ক্ষমা চায়। রাতে বাবা ফিরলে তার কাছেও ক্ষমা চায়। অনিক সরকার ধমকে বলে,

-” তার মানে তুমি সব স্বীকার করছো! কি হয়েছে মিথ্যে কথা বলে? তোমার জন্য আসমা কতটা অপমানিত হয়েছে?”

অরুণ মাথা নিচু করে বলে,

-” স্যরি বাবা আর হবে না!”

অনিক সরকার থামে না।

-” স্যরি বললে তো হবে না। আজ থেকে নানা বাড়ির সকলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ তোমার। খবরদার তাদের সাথে কথা বললে হাড্ডি একটাও আস্ত রাখবো না।”

ছোট্ট অরুণ গম্ভীর গলায় বলেছিল,

-” খালামুনির সাথে কথা বলবো না। তবে মামু নানুর সাথে কথা বলবো আমি! তোমার সব কথা শুনবো না!”

অনিক রেগে থাপ্পড় লাগায়। আসমা বেগম আটকায় তাকে। অরুণ প্রথমবারের মতো বাবার উপর চেঁচিয়ে ওঠে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে,

-” একদম মারবে না। তুমি সবসময় বকো আর মারো! থাকবো না তোমার কাছে।”

বলে ঘরে চলে যায়। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে। ঘুমে অচেতন অরুণ জানে না তার বাবা তাকে কোলে নিয়ে সারাটারাত চোখের জল ফেলেছে। আসমা বেগম কাঁদতে কাঁদতে তার কাছে সাবরিনার সব কথা জানায়। আবার সাবরিনাও কল করে কত কথা শোনালো! সব মিলিয়ে রেগে ছিল। অরুণ দোষ স্বীকার করায় ক্ষেপে যায়। রাগ সামলাতে পারে না। সকাল হলে বাবা অফিস চলে গেলে অরুণ ব্যাগ পত্র গুছিয়ে ড্রাইভারের সাথে চলে যায় মামার বাড়ি। অনিক সরকার আনতে গিয়েছিল বেশ কয়েকবার। জেদি বাপের জেদি ছেলে আসে নি। নানু ,মামুর ভালোবাসায় সে বাড়িতে থাকতে চাইলেও মামী ও মামাতো ভাইবোনের কটাক্ষে একমাস পর ব্যাগ পত্র নিয়ে একাই চলে আসে বাড়ি। আসমা‌ বেগম তাকে জড়িয়ে অনেক কাঁদে, আদর করে। অনিকও আর কিছু প্রশ্ন করে না , বুকে জড়িয়ে নেয় ছেলেকে। জেদি ছেলে ফিরে এসেছেন এই অনেক! তবে এরপর থেকে যেন অন্য অরুণ সরকার জন্ম নেয়; উশৃঙ্খল, মারকুটে, ভবঘুরে! কারো কথাই শুনতো না। সাবরিনার সাথে আর কথা বলতো না। অনিক ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে সেখানে যায় না। পারার কিছু বন্ধু বান্ধবদের সাথে ঘুরতো ফিরতো। তাদের স্কুলেই ভর্তি হবে জানায়। অনিক ভর্তি করিয়ে দেয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর কিভাবে যেন ঢাবিতে চান্স পায়। শুধু ও না ওর সকল বন্ধুরাও! এখন কিভাবে আল্লাহ তায়ালাই জানে। সেখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে অরুণ সরকার।
____

সাবরিনা সাবিনা বর্ষার কথা বলে না পাতাকে। পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” ছেলেটা এখনো ভালোভাবে কথা বলে না। ম্যাম বলে ডাকে আমাকে। আমি আমার ভুল বুঝতে পারি। আসমা, অনিক সরকারের থেকেও ক্ষমা চাই। ওরা ক্ষমা করে দিলেও অরুণ এখনো সেটা মনে পুষে
রেখেছে। ও এমনিই। কারো কথায় বা আচরণে কষ্ট পেলে বুঝতে দেবে না। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিবে। ছেলেটা অনেক সহ্য করেছে; নিজেকে খোলসে আবৃত করে নিয়েছে। বর্ষার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম ছেলেটা শেষ; কিন্তু না ও শক্ত ছিল। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে হাসিখুশি জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেকে সামলিয়ে নিয়েছে। তোমাকে এসব বলছি কেন আমি নিজেও জানি না। শোন তোমার সাথে অরুণ সরকারের জীবনটা জড়িয়ে গেছে। অরুণ খুব শক্ত ধাঁচের। ওর ছেলে ওর প্রাণভোমরা। তোমাদের বিয়েটা কেমন পরিস্থিতিতে হয়েছে আমি জানি না! তবে এটা বলবো অরুণ সরকারের হৃদয়ের দোরগোড়ায় যেতে হলে ভোর নামক চাবিকাঠির প্রয়োজন। তুমি ভোরকে ভালোবাসবে আদরে রাখবে; দেখবে অরুণ সরকার তোমায় মাথায় রাখবে। কথাটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও সত্যিই। স্বার্থ ছাড়া দুনিয়া চলে না। তুমি ওকে আর ওর কলিজাটাকে আগলে রেখো কেমন?”

পাতা সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে। অরুণ সরকারকে সেভাবে না চিনলেও‌ এখন ম্য্যমের কথাগুলো শুনে তার সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারনা পেয়েছে। সে তাকে আস্থার সুরে বলে,

-” আমি মাথায় থাকতে চাই না ম্যাম! আমি ওই হৃৎকুঠিরেই নিজের বাসস্থান তৈরি করতে চাই।আর অরুণ সরকার গোটা‌ লোকটাই যেহেতু আমার! তার সাথে জুড়ে সকল কিছুও আমার। তার সুখ, দুঃখ, রাগ, জেদ এমনকি ভোর নামক কলিজা; সব। আপনি শুধু দোয়া করবেন!”

চলবে….