#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩২ (প্রথমাংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
অন্ধকারে ছেয়ে আছে পৃথিবী। কৃত্রিম আলোয় আলোকিত ঘরবাড়ি রাস্তা। কয়েক যুগ আগেও মানবমানবী অন্ধকার ভয় পেতো। সন্ধ্যা নামলেই আপন নীড়ে ফিরে আসতে কতো তাদের যাতনা। ঘোর অমানিশায় ঘরে অন্ধকারে ছোট্ট কুপি জ্বালিয়ে ঘরেই থাকতো। জোৎস্না রাতে চাঁদের ম্লান আলোয় রাতের আহার কার্য সম্পন্ন করে পাটিতেই বউ বাচ্চা সমেত রূপকথার রাজ্যে ঘুরে বেড়াতো। মশা, মাছি ও গরম তাড়ানোর জন্য হাতে হাত পাখা থাকতো। ধীরে ধীরে মানুষ অন্ধকারকে জয় করে। রাতের অন্ধকার দূরীকরণের জন্য তাদের চাঁদের জোছনার আলো প্রয়োজন পড়ে না। তারা কৃত্রিম আলোয় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। জোৎস্নার ম্লান আলোয় স্নান করতে তারা জানেই না হয়তো।
অরুণ সরকার সন্ধ্যার বেশ পরপরই তার আপন নীড়ে ফিরে আসে। বাড়ি মেইন ফটক খোলা থাকায় অনায়াসেই প্রবেশ করে অন্দরমহলে। ড্রয়িং রুমের কাছে যেতেই নজরে আসে ছেলে,ছেলের আম্মু ও আনিকাকে। মিনু ও আভারি টেবিলে খাবার লাগাচ্ছে। অরুণ এগিয়ে যায়। ভোর ও আনিকা পড়তে বসেছে পাতার কাছে। চুপচাপ পড়ছে কোনো দুষ্টুমি না। যেন অতি ভদ্র বাচ্চা। অথচ অরুণ যখন ভোরকে হোমওয়ার্কের জন্য বসায় কত বাহানা কত দুষ্টুমি যেন মাছের বাজার! অরুণ পকেটে হাত গুটিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ এখনো তাকে দেখেনি।
পাতা গম্ভীর মুখে ভোরকে টুইংকেল টুইংকেল ছড়াটা বলতে বলে। ভোর উঠে দাঁড়িয়ে ভদ্র বাচ্চার মতো ঠোঁট নাড়িয়ে বলতে শুরু করে,
-” টুইংকেল টুইংকেল লিটেল স্টার
হাউ আই এভোব দা ওল সো ..”
-” হচ্ছে না ভোর! আবার বলো?”
ভোর আবার চেষ্টা করে পারে না। তার মনে পড়ছে না। এমনি হয় তার সাথে। সে একা একা বলতে পারে। টিচার জিজ্ঞেস করলেই এলোমেলো হয়ে যায়। লজ্জায় ভোরের মুখশ্রীতে আঁধার নামলো। মাথা নিচু করে নেয়। পাতা আনিকাকে বলতে বললে আনিকা সুন্দর করে আবৃত্তি করে। এতে যেন ভোর আরো লজ্জায় পড়ে। আঁখি যুগল টলমল করে। ভোর বই নিয়ে আবার পড়তে শুরু করে। সেও আম্মুকে শোনাবে! অরুণ আর দূরে না থেকে এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দিল। পাতা মাথা উঁচিয়ে চায়। অরুণকে দেখে কতক্ষণ আহাম্মকের মতো তাকিয়েই থাকে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। পাতা তবুও নজর হটায় না। আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। দাঁড়ি গোঁফে ঘেরা অধর জোড়ায় নজর আসতেই সকালের কথা মনে পড়ে, সাথে মস্তিষ্কও যেন সচল হয়। গালে জিভ ঠেকিয়ে নিজেকে ধমকায়। জামাই বলে এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাবি? পাতা মনকে কি বোঝাবে? সদ্য কেউ যখন কারো প্রেমে পড়ে মনে হয়
“দিনকাল জাত ক্ষণ পরিস্থিতি গোল্লায় যাক আঁখি যুগল শুধু তার দিকেই নিবদ্ধ থাক।“
আনিকা অরুণকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলে,
-” বড় চাচ্চু? কখন এসেছ তুমি?”
গম্ভীর অরুণের মুখশ্রীতে হাসি না ফুটলেও স্বাভাবিক হয়। কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা কোন আইসক্রিম বের করে আনিকার দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” মাত্রই এলাম মামুনি! কত সুন্দর করে রাইম বললে তার জন্য এই লিটেল গিফট!”
আনিকা খুশি মনে নিল। বই বন্ধ করে আইসক্রিম খুলে মুখে পুরে পাতাকে বলল,
-” চাচিমনি আমি আর পড়বো না। আমার সব কমপ্লিট!”
ভোর আনিকার আইসক্রিমের দিকে তাকিয়ে থাকে। আইসক্রিম তার প্রিয়। আব্বু তার জন্যও নিশ্চয়ই এনেছে। সে বাবা দিকে চায় আদুরে ভঙ্গিতে। অরুণ ছেলের চাহনি দেখে গম্ভীর মুখে বলল,
-” পড়া পারবেন না আর আপনাকে আইসক্রিম খাওয়াবো? ইন ইওর ড্রিমস!”
ভোরের গাল ফুলিয়ে পড়তে শুরু করে জোরে জোরে ‘টুইংকেল টুইংকেল’। পাতা মুখে হাত চেপে হাসে। অরুণ আর কিছু না বলে গম্ভীর মুখে পা চালায় নিজের রুমের উদ্দেশ্য। পাতা আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ দেখা যায়। ভোর বাবার প্রস্থান দেখে ফুলো গাল আরেকটু ফুলিয়ে পড়তে থাকে। আজ সে পড়ে পড়ে আর্থের সব পড়া কমপ্লিট করে ফেলবে,হুহ!
অরুণের যাওয়ার পর পাতা উশখুশ করে। মনটা কেমন যেন আঁকুপাঁকু করছে। আশ্চর্য তার সাথে এসব কি হচ্ছে? সে কি প্রেমে পড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি। সে ভোরকে ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দিয়ে ‘তুমি পড় আমি আসছি’ বলে উঠলো। উঠে কোথায় যাবে? ‘হে হে’ করে পাতার মনটা হেসে সিঁড়ি বেয়ে নিজের কামরায় যায়। সেখানে গিয়ে দেখলো শু’স ,কোর্ট, কটি, টাই, মুজো জোড়া ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পাতা অরুণের দিকে কটমট করে চায়।
-” এগুলো নিচে ফেলেছেন কেন? আশ্চর্য এটা কোন ধরনের ম্যানারস? এসেই সব ছুড়াছুড়ি!”
অরুণ পিছন ফিরে পাতার দিকে চায়। হাত চালিয়ে শার্টের সব বোতাম খুলে শার্টটাও ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তবে সেটা পাতা ক্যাচ করে নেয়। অরুণ আলমারির দিকে অগ্রসর হয়ে চিরচেনা গম্ভীর জবাব দেয়,
-” আদর করে ম্যানারলেস ডেকে ম্যানারস আশা করো কিভাবে মিসেস পাতাবাহার?”
পাতা চোখ পিটপিট করে আড়চোখে অরুণের বলিষ্ঠ পিঠের দিকে নজর দেয় বারংবার।
-” আপনি সত্যিই ম্যানারলেস লোক! এগুলো কে তুলবে? এখন আমি তুলছি। পরবর্তীতে ফেললে আর তুলবো না। আপনাকেই তুলতে হবে। তাই আর ফেলবেন না!”
-” আমি তো ফেলবোই!”
বলেই গটগট করে ওয়াশ রুমে ঢুকে যায় অরুণ। পাতা স্থীর হয়ে দাড়িয়েই। লোকটা তার পাশ ঘেঁষেই গেলো। সাথে সাথে তার শরীরের পারফিউম ও পুরুষালী গন্ধটা ডিফিউশনের মতো তার নাসা গহ্বরের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়লো।
একটু পরেই অরুণ বেরিয়ে আসে। পরনে অ্যাশ কালারের টি শার্ট, কালো ট্রাউজার। চুলগুলো পরিপাটি না, এলোমেলো হয়ে কপালে পড়ে আছে। এতে যেন লোকটার সৌন্দর্য বেড়ে গেল। পাতা নজর সরিয়ে নেয়।
-” কেমন কাটলো সারাদিন?”
-” ভালোই!”
বলে পাতা অরুণের দিকে তাকায়। তাকিয়েই হতাশ। গোমড়া মুখে লোকটা ব্যাগ হাতাচ্ছে।
-” স্যরি আমি ভোরের পুরোপুরি খেয়াল রাখতে পারিনি!”
কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে অরুণের,
-” কি হয়েছে কলিজার?”
-” ওই দৌড়ে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলে গেছে। বেশি না এই একটু!”
মিনমিনে বলে পাতা। এখন না লোকটা ঝাড়ি দেয়! সকালে কতবার করে বললো খেয়াল রাখতে। অথচ!! অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
-” একটুও শান্ত থাকবে না। সবসময় দৌড় ঝাঁপ! একটার পর একটা লেগেই থাকে ছেলেটার! কেঁদেছে?”
পাতা না বোধক মাথা নাড়ল। লোকটা বকলো না!! অরুণ ব্যাগ থেকে অনেক গুলো কোন আইসক্রিম বের করে বিছানায় রাখলো।
-” শুধু একটা কলিজার। বাকি গুলো তোমার! একটার বেশি ওকে দিবে না। ওর ঠান্ডা সবসময় লেগেই থাকে। ফ্রিজে রাখো! গলে গেল বলে!”
এই ঘরটা একটা মিনি বেকারি স্টোর! একটা মিনি ফ্রিজ ও একটা মিনি আলমারি আছে। আলমারিতে বিভিন্ন কেক, বিস্কুট, ক্যাডবেরি সহ বিভিন্ন সদাই সামগ্রী। এবং আলমারিটা লক বিহীন।ফ্রিজে বিভিন্ন ফ্লেভারের আইসক্রিম, বিভিন্ন সফট ড্রিংকস, জুস ইত্যাদি। তবে ফ্রিজটা লক করা। আর তার চাবি পাতার কাছে গচ্ছিত বর্তমানে। পাতা সব আইসক্রিম নিয়ে ফ্লিজে রাখে।
-” ভোরের জন্য এনেছেন ঠিক আছে! আমার জন্যে আইসক্রিম? আমি কি বাচ্চা নাকি?”
-” আইসক্রিম খেতে বাচ্চা হতে হয়? আইসক্রিম সবারই পছন্দ! ইভেন আমারও!”
পাতা তড়িৎ গতিতে অরুনের দিকে তাকায়। হেসে বলল,
-” আপনিও তো বাচ্চা”
অরুণ পাতার দিকে চায় শান্ত চোখে।
-” হ্যা সাঁইত্রিশ বছরের বুড়ো বাচ্চা!”
পাতার ভালো লাগলো না কথাটা। লোকটা তো পরোক্ষভাবে পাতার জামাইকেই বুড়ো বললো। এতো সুন্দর ফিট হ্যান্ডসাম জামাই তার, মেয়েরা দেখলে হুমরি খেয়ে পড়বে। আর তাকে বুড়ো বলা! পাতা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে,
-” ভোরের ওই হোম টিউটর কি যেন নাম!!”
-” টুম্পা! কেন?”
পাতার মুখটা চুপসে যায়।
-” কি যেন বলবে শুধু আপনাকেই আমাকে বললো না!”
অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে ঘার এদিকে ওদিকে করে। ঘারটা ব্যাথা করছে অল্প অল্প।
-” কথা হয়েছে তার সাথে। ফোন করেছিল!”
পাতার গালটা এবার ভোরের মতো ফুলে যায়। কিন্তু সেটা অরুণের নজরে পড়ে না। এটা দেখে পাতা আরো হতাশ।
-” মেয়েটা খুব সুন্দর তাই না?”
-” হুম! স্পেশালি চুল গুলো! অনেক লম্বা! ভালোই!”
সাথে সাথেই সরল মনে জবাব দেয় অরুণ। অপর দিকে যে মলিন মুখে তার দিকে চেয়ে আছে সে ধ্যান নেই। পাতা অরুণের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। অরুণ ঘার নিচু করে তার দিকে চায়। পাতা তার থেকে উচ্চতায় বেশ ছোট বুক পর্যন্ত হবে টেনেটুনে। পাতা আঙ্গুল উঁচিয়ে অরুণের মতো গম্ভীর গলায় বলল,
-” বাহ্ পরনারীর চুলও দেখা হয়! অথচ আলাভোলা মুখ দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানেন না।”
অরুণ চোখ ছোট ছোট করে চায়। দূরত্ব কমিয়ে এগিয়ে আসে পাতার নিকটে। ঝুঁকে আসে খানিকটা। পাতা সরে না একটুও। সিনা টান টান করে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটা তার কাছে। একেঅপরের শরীর ছুঁই ছুঁই হলেও ছোঁয় নি। অরুণ গম্ভীর গলায় ধীমে সুরে বলে,
-” জেলাস হুম?”
দুজনের চোখই দুজনের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।লোকটা তার দিকে ঝুঁকে। নিঃশ্বাসের ক্ষীণ বাতাস তার মুখশ্রীতে দোলা দিচ্ছে। ছোট ছোট নেত্রযুগল যেন পাতাকে সম্মোহন করছে। আর পাতা সম্মোহিত হয়েও যায়। সম্মোহনের সুরেই বলল,
-” হুম!”
অরুণ অধরজোড়া চোখা করে পাতার মুখশ্রী জুড়ে ফুঁ দেয়। পাতা আবেশে চোখ বুজে নেয়। অধরে লজ্জালু হাসি ও কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে গেছে। অরুণ পকেট থেকে হাত বের করে সেথায় আলতো ছুঁয়ে দেয়। পাতার ডাগর শান্ত কাজল নেত্রযুগল খুলে যায়। অভিজ্ঞ অরুণ পড়ে নেয় সেই চোখের ভাষা। তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। সরে আসে নিরাপদ দূরত্বে।
ভোর দরজার সাথে লেপ্টে দাঁড়িয়ে। মাথাটা উঁকি দেয় ঘরের ভিতরে। ঘরে বাবার সাথে আম্মুর উপস্থিতি দেখে স্বস্তি পায়। স্বশরীরে প্রবেশ করে হাসিমুখে। অরুণ খাঁচা খুলে বিড়ালকে বের করে। পাতা তাকে বেশিরভাগ সময় বন্দি করেই রাখে। কেন? কারণ বিড়ালটা অরুণের আশেপাশে মিও মিও করবে আর গা ঘেষবে। সুযোগ পেলেই কোল দখল করবে। বিড়ালশাবকটি ছাড়া পেয়েই মিও মিও করে শতখানা অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু বিচারপতি তার অভিযোগ বুঝতে অক্ষম। তাই সে দৌড়ে গিয়ে ছোট মালিকের কোল দখল করে। ভোর তাকে কোলে নিয়ে পাতার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ‘টুইংকেল টুইংকেল’ পুরোপুরি আবৃত্তি করে সুন্দর ভাবে। পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” অনেক সুন্দর হয়েছে ভোর! দেখেছো চেষ্টা করলে সব পারা যায়!”
ভোর মিষ্টি হেসে আড়চোখে বাবার দিকে চেয়ে বলল,
-” আম্মু এখন আমার আইসক্রিম?”
অরুণ ছেলের আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। তার থেকে ক্ষত লুকাতে ফুল প্যান্ট পড়ে আছে।
-” পাবেন। আগে বলুন এই গরমে ফুল প্যান্ট কেন পড়ে আছেন?”
ভোর জিভে কামড় দিয়ে বিড়াল শাবকটিকে ছেড়ে দেয়। কোমড়ের কাছের প্যান্টের অংশ টেনে ধরে মিষ্টি সুরে বলল,
-” ওই ওই গরম না না ঠান্ডা লাগছিলো”
-” এই গরমে ঠান্ডা লাগছিলো?”
-” হুম?”
-” কতটুকু ক্ষত হয়েছে দেখি?”
ভোর গোমড়া মুখে পাতার দিকে চায়। আম্মু সব বলেদিলো? এখন আইসক্রিম তো পাবেই না সাথে এক গাদা বকা। সে গোমড়া মুখেই প্যান্ট টেনে খুলে ফেলল। পড়নে হাফ প্যান্ট আছে। অরুণ ছেলেকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। বেশি না অল্পই ক্ষত। অনেক জ্বলেছে নিশ্চয়ই। পাতাবাহার বলল কাঁদে নি!! সে ক্ষত স্থানের আশেপাশে ঠোঁট বুলিয়ে আদর করে।
-” অনেক ব্যাথা করেছে কলিজা? এখনো জ্বলছে?”
-” তুমি আদর করে দিয়েছো আর করছে না।”
-” আমার আব্বু! কলিজা! সোনা কত বলি সাবধানে চলাচল করতে! একটুও শোনো না। এখন কার ব্যাথা করছে?”
-” আব্বুর!”
হেসে অরুনের গালে চুমু দিয়ে বলে ভোর! অরুণ ছেলেকে দেখে নয়ন জুড়িয়ে। সত্যিই তার ব্যাথা করছে। পাতা গলা খাঁকারি দেয়। বাবা ছেলের আবেগমাখা সিন আবার শুরু। পাতা তো প্রথম প্রথম নিজের চোখ কানকেই বিশ্বাস করতে পারতো না যে এ অরুণ সরকার এতটা আদুরে গলায় কথা বলতে পারে ।
-” হয়েছে বাবা ছেলের? নিচে চলুন! খেয়ে নিবেন। ভোর চলো? তুমি না বললে ক্ষিধে পেয়েছে তোমার?”
-” হুম!”
অরুণ ছেলের গালে ঠোঁট চেপে চুমু দিয়ে পা বাড়ায়। পাতা তাদের পিছনে হাঁটে আর তার পিছনে পাতাবাহার। ভোর হাসিমুখে বলল,
-” আমার আইসক্রিম?”
-‘ খাওয়ার পর পাবে!”
-” আব্বু দাদি না আমাকে একটা বড় গাড়ি ও বন্দুক এনে দিয়েছে শপিং মল থেকে।”
-” তাই?”
-” হুম”
পাতা হাসে তখন গোমড়া মুখে ছিলো উপহার পেয়েই খুশি। দাদির প্রতি সব অভিমান ভুলে গেছে।
ওরা গিয়ে ডাইনিং-এ বসে। আসমা বেগম আগেই বসে আছে। তাদের দেখে মুচকি হাসলো। অরুণ ভোর টুকটাক কথা বলে। পাতা অরুণের পিছনে লুকিয়ে চুরিয়ে থাকার চেষ্টা করে। শাশুড়ির নজরে পড়লে না জানি কোন ত্রুটি বের করে। একটু পরে আদুরি, আরিয়ান ও রুবি আসে। রুবির কোলে ঘুমন্ত রূপ। তারা নিজেদের আসন গ্রহণ করে। আদুরি হাসিমুখে বলে,
-” বড় ভাবী লুকিয়ে আছো কেন? মা’য়ের ভয়ে?”
পাতা চোখ বড় করে চায়। আদুরি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।
-” বড় ভাইয়া তোমার বউ মা কে সেইরকম ভয় পায়। মায়ের আশেপাশেই ঘেঁষে না দরকার ছাড়া। দেখলেই পলাই পলাই!”
আসমা বেগম মেয়েকে চোখ রাঙায়। অরুণ পিছনে মুড়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা পাতার দিকে একবার চায়। কিছু বলে না। আরিয়ান আদুরির মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
-” তোর বড় ভাবী ভয় পায়? যে ঝগরুটে মেয়ে! একটা কথাও ছেড়ে দেবে না!”
পাতা মনে মনে ভেংচি কাটলো। শালা তুই তো সাধু! মিনু ও পাতা সকলের খাবার পরিবেশন করে। সবাই খাওয়া শুরু করে! অরুণ পাতাকে ইশারায় খেতে বসতে বলে। পাতা রুবির দিকে চায়। রুবি খানিকটা গম্ভীর মুখে ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে, খাবার খাচ্ছে না।
-” আপু রূপকে আমার কাছে দিন! আর আপনি খেয়ে নিন?”
-” ইটস ওকে বড় ভাবী! আই ক্যান ম্যানেজ!”
-” আরে দাও তো! রূপ বাবা তার ঝগরুটে চাচি মনির কাছে যাবে!”
আরিয়ানের কথায় আনিকা, ভোর হেসে কুটিকুটি।রুবি দেয়। পাতা আরিয়ানের দিকে কটমটে চেয়ে ঘুমন্ত রূপকে নিয়ে অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর বাবার কোলে বসে খাচ্ছে আর আড়চোখে পাতার কোলে রূপের দিকে তাকাচ্ছে। তার আম্মুর কোলে উঠে আদর খাওয়া হচ্ছে? আসমা বেগম খাওয়া শেষ করে। বেসিনে হাত ধুয়ে এসে আবার বসে চেয়ারে। একটু উশখুশ করে। অরুণ সেটা লক্ষ্য করে ছেলের মুখে খাবার দিয়ে বলে,
-” কিছু বলবে ছোটমা?”
আসমা বেগম কথা বলার ওয়ে পায়।
-” হুম। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই! এখন ব্যাপারটা হচ্ছে তুমি কিভাবে নেবে?”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়লেও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করে,
-” কি কথা? নির্দ্বিধায় বলো!”
-” আসলে রুবি ব্যাংকের চাকরিটা করতে চাইছে না। ছেড়ে দেবে।”
আরিয়ান রুবি দুজনেই চুপচাপ। আজকে এটা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হয়েছে। আদুরি অবাক সুরে বলে,
-” কেন ছোট ভাবী? এতো ভালো চাকরি!”
-” ছেলেটা ছোট! ওকে নিয়ে ব্যাংকে গেলে অনেকেই কানাঘুষা করে। বড় স্যারও কেমন করে কথা বলে তাই ভেবছি রিজাইন করবো!’
রুবির স্বাভাবিক জবাব। আসমা বেগম অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” এখন ও চাইছে অফিস জয়েন করতে! তুমিও তো ছেলেকে নিয়েই অফিস করেছো! আর নিজেদের অফিসে অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবে। এখন তুমি কি বলো?”
অরুণের গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কিসের হাসি?
-” আমি কি বলবো? নিজেদের অফিস! যখন খুশি জয়েন করতে পারো রুবি! ওলয়েজ ওপেন ফর ইউ!”
রুবি হেসে বলল,
-” থ্যাংক ইয়ু ভাইয়া!”
-” ধন্যবাদের কি আছে! অফিসটা তোমাদেরও! তবে হ্যাঁ আগে কিন্তু ইন্টার্নশিপ করতে হবে?”
-” অবশ্যই ভাইয়া!”
আরিয়ান বলল,
-” ভাইয়া সাবধান হ্যাঁ? মহিলা মানুষ! ওদের কাছে চকচক করলেই সোনা!”
-” ভাইয়া আপনাদের থেকে ভালো পরখ করতে পারবে! মনে রাখবেন অলংকার কিন্তু মহিলারাই পরিধান করে!”
পাতার কথায় অরুণ একবার তার দিকে চায়। তার পর খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। আরিয়ান চুপ থাকে না। আদুরি, রুবি, পাতা ভদ্রভাবে টুকটাক কথাকাটাকাটি করে আরিয়ানের বিপক্ষে। আনিকা বাবার পক্ষে কথা বলে। বেশ তর্কাতর্কি হয়। আর তর্কে পাতা এগিয়ে জিতে যাবে জিতে যাবে ভাব আসমা বেগমের চাহনিতে চুপ করে যায়। অন্যদিকে বাবা ছেলে চুপচাপ, ভিন্ন ভিন্ন কারণে ।
_____
রাত বেশি দীর্ঘ হয় নি। নয়টা কি দশটা বোধকরি। আতিকুর ইসলাম টিভিতে নিউজ দেখছিলেন। নিউজ বলতে টকশো। দুই পক্ষের সংঘর্ষের মাঝে বেচারা সংবাদ উপস্থাপক হামি তুলছে। আতিকুর ইসলাম সেই সংঘর্ষ গুলো মনোযোগ সহকারে শুনছেন। আজকের টকশোর বিষয়াবলী দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির জন্য কে দায়ী? সেটা নিয়েই দীর্ঘ আলাপ আলোচনার নামে তর্ক বিতর্ক প্রতিযোগিতা চলেছে । লুবমান বাবার পাশে বসে সেই বিরক্তিকর টকশো গিলছে। লাবনী আক্তার টেবিলে খাবার পরিবেশন করছেন। জগ সহ খাবার বেড়ে এনে রাজা ও রাজার পুত্রের কাছে পরিবেশন করে। তারা দুজন খাবার গ্রহণ করে টিভি সহ খাবার গিলতে থাকে। লাবনী আক্তার সিঙ্গেল সোফায় বসে স্বামীর উদ্দেশ্যে বলল,
-” সাত আট দিন হয়েই গেল পাতা ও বাড়ি! আপনি গিয়ে যদি কদিনের জন্য নিয়ে আসেন মেয়েটাকে?”
আতিকুর ইসলাম স্ত্রীর দিকে একপলক চেয়ে টিভিতে মনোনিবেশ করে।
-” লুবমানকে বলো! নিয়ে আসবে।”
লুবমান লোকমা মুখে পুরে বলল,
-” আমি পারবোনা আব্বু! আমি কি বাড়ির মুরুব্বি নাকি! ওখানে গিয়ে কি বলবো কি না বলবো! তুমিই যাও! মেয়ের বাবা তুমি, একটা দায়িত্ব আছে না?”
আতিকুর ইসলাম লুবমানের দিকে চায়। লুবমান খানিকটা ঘাবড়ে যায়। প্লেট নিয়ে উঠে তড়িঘড়ি করে নিজের ঘরে চলে যায়। লাবনী আক্তার ইতস্তত বোধ করে বলল,
-” আপনিই যান না? মেয়েটা খুশিও হবে। আর তাছাড়া প্রথমবার মেয়েকে শশুর বাড়ী থেকে বাবার বাড়ি আনতে যেতে হবে! লুব গেলে কেমন দেখাবে না?”
-” আচ্ছা দেখি!”
তার ছোট্ট জবাবে লাবনী আক্তার খুশি হয়। দেখি বলেছেন মানে উনি যাবেন। এতো বছরের সংসার ওনার আচার আচরণ তার নখদর্পণে। তাদের সংসারের মাথা আতিকুর ইসলাম। ভদ্রলোকের কথাই শেষ কথা। তার কথার উপর কথা বলার সাহস কারোর নেই। লতা বাদে সবাই তাকে ভয় করে চলে।
______
রুপকথা! দুই তিন যুগ আগেও রাতের বেলা বাচ্চারা মা অথবা দাদির কাছ ঘেঁষে আবদার করতো রুপকথার রাজ্যে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার। সন্ধ্যার পর পড়তে বসে মনে মনে শত শত দোয়া করতো কারেন্ট চলে যাওয়ার। কারেন্ট চলে গেলেই আনন্দে নেচে উঠে মা দাদির কাছে চলে যেতো গল্প শুনতো। ভূত, রাক্ষস, রাজকন্যা, রাজা রানী কতশত গল্প! আজকের মডার্ন যুগ হয়তো সেই রূপকথা ভুলতেই বসেছে। অরুণ ছেলেকে সেই রূপকথা শোনাচ্ছে। আসমা বেগম আনিকাকে রাতে ঘুমানোর সময় বলে। আনির থেকে সেই গল্প শুনে ভোরও আবদার করে। অরুণ তো রূপকথা জানে না। তার মা কখনো কি তাকে শুনিয়েছিলো? কি জানি! তার তো মনে নেই।ছোট বেলা অরুণকে রেখে তো নিজেই রূপকথা হয়ে গেছে। অরুণ ইউটিউব থেকে রূপকথা দেখে নিজে শিখে পড়ে ভোরকে শোনায়। ভোর হা করে শুনে! তবে এতেই ক্ষান্ত নয়! হাজারখানেক প্রশ্ন করবে। পাখি কিভাবে কথা বলে? ব্যাঙ থেকে রাজকুমার মানুষ হলো কিভাবে? মেয়েরাই কেন পরী হয়? তাদের পুকুরেও কি জলপরী আছে? একবার তো তাদের আঙিনার শেষের পুকুরে ঘড়ি ফেলে দিয়ে কেঁদেছিল মিছিমিছি। জলপরী না ওঠায় অরুণের সাথে অনেক তর্কও করেছিলো।
পাতা ঘরে প্রবেশ করে। বাবা ছেলেকে বিছানায় দেখে আস্তে দরজাটা লক করে। ভোর পাতাকে দেখে হেসে বলে,
-” আম্মু? জলদি আসো? গল্প শেষ হয়ে গেলো!”
” আসছি সোনা!”
বলে টপস ও সালোয়ার নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়।চেঞ্জ করে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। অরুণ গম্ভীর মুখে গল্প বলছে আর আড়চোখে পাতাকে দেখছে। মেয়েটার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে নাকি! ওড়না ছাড়া! ধ্যাত! অরুণ আর তাকায় না পাতার দিকে। পাতা কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে কোমড় অবধি ঢেকে নেয়।কাত হয়ে অরুণের দিকে ফেরে। মাঝখানে ভোর শুয়ে। অরুণের গল্প শেষ হয়ে যায়। ভোর আরেকটা আবদার করলে অরুণ মানা করে,
-” কলিজা ঘুমাও! অনেক রাত হয়েছে। কাল জলদি উঠতে হবে তো! স্কুল আছে না?”
ভোর মাথা নেড়ে পাতাকে জড়িয়ে চোখ বুজে নেয়। পাতা মুচকি হেসে তার মাথায় চুমু দিয়ে চুলে হাত গুঁজে দেয়। অরুণ ভালোভাবে বালিশে মাথা রেখে পাতার দিকে চায় সরাসরি। পাতা প্রশ্ন করে,
-” এত গল্প কার কাছে শিখলেন?”
-” ইউটিউবে!”
-” একটা কথা বলি?”
-” না ঘুমাও!”
-” প্লিজ একটা?”
-” না!”
-” প্লিইজ?
-” ঠিকাছে!
-” আপনাদের ডিভোর্স কেন হলো? না মানে লাভ ম্যারেজ ছিল! শুনেছি আপনারা একেঅপরকে অনেক ভালোবাসতেন! পার্ফেক্ট জুটি! তারপরও..”
থেমে যায় পাতা। গম্ভীর অরুণ সরকারের মুখশ্রী যেন আরো গম্ভীর হয়ে ওঠে। ফর্সা কপালের নীল রগ দৃশ্যমান। পাতা ঢোক গিলে এতো রেগে গেলো!
-” স্যরি হ্যাঁ? বলতে হবে না! গুড নাইট!”
বলেই চোখ বুজে। কিছুসময় পরেও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখতে পেয়ে এক চোখ অল্প খুলে চায়।খুলেই যেন ভুল করলো। লোকটা এখনো তার দিকে চেয়ে। পাতা দুই চোখ খুলে হাসার চেষ্টা করে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” ওসব এখন অতীত! অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে কি করবে পাতাবাহার? আমাদের মাঝে সব ঠিক ছিল। খুশি ছিলাম দুজনে।ও বি সি এস দিয়ে দেশেই অতিরিক্ত সচিবালয়ে একটা জবে যোগ দিয়েছিল।ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব সবাই বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ওখানেই সেটেলড হয়। ও আমাকেও বলে ভালো কোনো কান্ট্রিতে সেটেলড হতে। আমার মন টানতো না। যদিও দেশে কোনো পিছুটান নেই। তবুও আমার দেশ! আমার জন্মভূমি! কিভাবে ছেড়ে যাই? শুরু হয় দুজনের মনোমালিন্য! এর মাঝেই ভোর আসে। ও এখনি বেবি চাইনি কিন্তু আল্লাহর রহমতে এসে গেছে। কি করার। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন বিদেশে একটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করার সুযোগ পায়। কিন্তু আমি যেতে দিই নি। ভোর হয়। কিন্তু ওর দিকে কেমন বিমুখ হয়ে থাকতো। যত্ন করতো না। কেমন যেন একটা বিহেভ করতো। শুধু ওর সাথে না আমার সাথেও। ধীরে ধীরে সব চেঞ্জ হয়। ও আবার কিরগিজিস্তানের এক ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডির সুযোগ পায়। হঠাৎ করেই ডিভোর্স চায়। আমিও অবাক হয়েছিলাম। কিছু জিজ্ঞেস করি নি। তার চোখেই সব জবাব পেয়ে গিয়েছিলাম। ভোর সারাজীবন আমার কাছে থাকবে সেই শর্তে ডিভোর্স হলো। তারপর সে তার রাস্তায় আমি আমার রাস্তায়!”
পাতা মনোযোগ দিয়ে সব শুনে। এসব কথা সে শুনেছে আদুরি, প্রিন্সিপাল ম্যাম আরো অনেকের কাছে। তবুও লোকটার মুখে শোনার ইচ্ছে ছিল।
-” এখনো ভালোবাসেন তাকে? ভুলতে পারেননি তাই না?”
অরুণ মুচকি হেসে পাতার নাক টেনে দেয়।
-” এখনো ভালোবাসবো? ওসব আবেগী কথা বলবে না। এটা রিয়েলিটি। ভালোবেসে ছিলাম। মন থেকেই। সম্পর্ক তৈরি হলো। একবুক তিক্ততা নিয়ে ভেঙেও গেলো। দুধের ছেলেকে রেখে চলে গেছে সে, তাকে আমি এখনো ভালোবাসবো? আমার ছেলের মা মা বলে ক্রন্দনরত মুখশ্রী দেখেও যে মায়ের বুক কাঁপে না। পিছনে না ফিরেই চলে যায় তাকে ভালোবাসবো? মা মা বলে কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধ হবার যোগার ছেলের! ফোন করে কানে দিলে পাঁচ মিনিট কথা বলার সময় হতো না তার। কেটে দেয়ার বাহানা খুঁজতো তাকে ভালোবাসবো? অরুণ সরকার ওতটাও আবেগী না পাতাবাহার! তার ভালোবাসাও অত সস্তা না। আমার আঙিনা থেকে যেদিন বেড়িয়েছে সেদিন থেকে সে আমার অন্তঃস্থল থেকেও বেড়িয়ে গেছে।”
থামে অরুণ। পাতা অরুণের দিকেই তাকিয়ে হা করে। মনটা তার পেখম তুলে নাচছে! আহা জীবনটা কেমন আনন্দ আনন্দ লাগছে! এমন তো কখনো লাগে নি!! সিনেমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে মনে হচ্ছে। সে অরুণ সরকারের একটা লুঙ্গি পরে লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছে! সঙ্গে ভোর সেও লুঙ্গি পড়ে লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছে, এমনকি বিড়াল শাবকটিও। পাতা নাচ থামিয়ে দেয়! ওই তো নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক? লুঙ্গি পড়ে! দাঁত বের করে হাসছে। পাতা দৌড়ে যায়। তার গলা জড়িয়ে টপাটপ চুমু খায় বেশ কয়েকটি। আহা! সব কিছু কেমন যেন বাড়াবাড়ি রকমের ভালো লাগছে।
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়েই। মেয়েটা মটকা মেরে গেল কেন? কোন স্বপ্নে বিভোর আছে?
-” মিসেস পাতাবাহার? কোথায় হারিয়ে গেলে?”
অরুণের কথায় পাতা রঙিন সিনেমাটিক দুনিয়া থেকে বেরিয়ে আসে। গোমড়ামুখো অরুণ সরকারকে দেখে নাক মুখ কুঁচকে নেয়। স্বপ্নটাই ভালো ছিলো। সে হামি তুলে বলে,
-” কোথাও না। ঘুম পাচ্ছে আমার।”
-” তো ঘুমান!”
বলে ভোরকে পাতার থেকে ছাড়িয়ে নেয়। পাতা ভেংচি কাটলো।
-” আমার কাছে থাকলে কি হতো?”
-” কিছু না আমার ছেলেটা ভর্তা হয়ে যেতো!”
-” মানে?”
-” কিছু না! আপনার ঘুমানোর স্বভাব খুবই বাজে!”
বলে অরুণ লাইট অফ করে চোখ বুজে নিল।
পাতার মুখ খানি চুপসে যায়, কথা সত্য। মন খারাপ করে খাটের একদম কিনারা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। অরুণ ভোরকে ওপাশে রেখে হাত বাড়িয়ে পাতার পেটে রাখে। পাতা চমকে ওঠে। অরুণ কাছে টেনে এনে পাতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে নেয় । পাতার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে বলল,
-” বিছানার নিচে ভুতের বাচ্চারা ডিনার করছে কাঁচা মাংস দিয়ে। সাবধান!”
পাতা হাসে। সে মোটেও ভয় পাচ্ছে না। তবে সে না হয় একটু অভিনয় করলো! কেউ জানতে পারবে কি? উল্টো দিকে ফিরে অরুণের কাঁধে মুখ গুঁজে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। নাক ঠেকিয়ে শ্বাস টেনে নেয়। অরুণ চমকায় বেশ। কেঁপে ওঠে বক্ষস্থল। শীরায় শীরায় রক্ত কনিকা যেনো টগবগিয়ে ওঠে। মেরুদণ্ড বেয়ে পাগল করা স্রোত বয়ে যায়। তার উন্মুক্ত তনু জড়িয়ে এক নারী কায়া। পুরুষালী মন সন্ন্যাসী হয়ে ধ্যান করবে? শক্ত করে সেও নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পাতার নরম শরীরটাকে। পাতার মস্তিষ্ক সচল হলো যেন। সরে আসতে চায় পারে না। অরুণ তার চুলের রেবন খুলে দেয়। চুলের ভিতর হাত গলিয়ে শক্ত করে ধরে মুখোমুখি হয়। একেঅপরের উষ্ণ গরম নিঃশ্বাস আছরে পড়ছে মুখশ্রীতে। পাতা ঢোক গিলে। এ কেমন মরণ অনুভূতি! অভিনয় করতে এসে এভাবে ট্রলের স্বীকার হবে জানলে কখনো করতো না। ভয়ে তার চোখের আকার বড় হয়। অজানা আশঙ্কায় বুকটা ধুকপুক করছে। কেঁপে উঠছে বারংবার। ছোটার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ভয়, উত্তেজনায় তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, শক্তি যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সে একবুক সাহস নিয়ে অরুণের দিকে চায়। কিন্তু লোকটার নজর অন্যদিকে। পাতা ঢোক গিলে পুনরায়। অরুণ অগ্রসর হবে পাতা চটজলদি নিজ ওষ্ঠাধরে হাত দিয়ে ঢেকে নেয়। অরুণের অধর ঠেকে পাতার করপুটে। অরুণের শ্বাস ক্রমাগত ভারী হয়। ফোঁস ফোঁস শব্দ হয়। অরুণ পাতার চোখে চোখ রাখে। পড়ে নেয় চোখের ভাষা। তাদের মধ্যে দেয়াল সৃষ্টি হওয়া হাতে শক্ত করে কামড় বসায় অরুণ! ব্যাথায় পাতার আঁখি যুগল বুজে যায়। অরুণ সরে আসে। বালিশে মাথা রেখে ছেলের দিকে ফিরে শোয়। পাতা যেন জানে প্রাণ ফিরে পায়। বালিশে মুখ লুকিয়ে দাঁত দাঁত চেপে শুয়ে থাকে। লোকটা কি রাগ করলো? করুক! সে ওত সহজে ধরা দেবে না। পাতাকে ফাঁদে ফেলা ওতো সহজ না। যেদিন ভালোবেসে কাছে টানবে সেদিনই পাতা নিজের সর্বস্ব সপে দেবে। যতটুকু ভালোবাসা দিবে তার শতগুণ ফিরিয়ে দিবে।
হঠাৎ অনুভব করে সরে যাওয়া কম্ফোর্ট টা পাতার গা পুনরায় ঢেকে দেয়। পাতা জানে কার কাজ! সে লজ্জায় মুখ তোলে না। মটকা মেরে শুয়ে থাকে।
________
চলবে……
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩২ (শেষাংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
সকাল বেলা।পাখির কিচিরমিচির ডাক শোনা যায়। অরুণ সরকার পুরো ফরমাল ড্রেসআপে। আজ অফিস জলদি যেতে পারবে। অরুণ রুমে প্রবেশ করে। ভোর বিছানায় দাঁড়িয়ে আর পাতা তার টাই বাঁধার চেষ্টা করছে। তাকে দেখে পাতা বলল,
-” ভোরের আব্বু দেখুন তো? আমি লাগাতে পারছি না। আপনিই টাই টা বেঁধে দিন!”
বলেই সরে যায়। অরুণ টাই বেঁধে কলার ঠিক করে দেয়। পাতার হাত থেকে স্কুলের আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে ছেলের কপালে চুমু খায়। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু মুড়ে বসে মুজো, শু পড়িয়ে দিলো। এখন সে পুরোপুরি রেডি! অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এভাবেই যাবে?”
পাতা নিজের দিকে তাকায়। রাতে পরিহিত সেই সালোয়ার ও হাঁটুর একটু উপরে টপস। গলায় ছোট ওড়না ঝুলছে। মাথার চুল গুলোও এলোমেলো। পাতা ড্রেসিন টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে হতাশ। পুরাই কাজের বেডি।
-” এভাবে গেলে পুলিশ পাবনায় ছেড়ে আসবে!”
অরুণ গম্ভীর গলায় হুকুম দিলো,
-” তাহলে রেডি হয়ে আসো। ফাস্ট!”
পাতা মুখ গোমড়া করে বলল,
-” কি পড়ে যাবো?”
-” কাপড়ের অভাব পাতাবাহার? এক কাজ করো আমার একটা স্যুট পড়ে নাও!”
পাতা আহম্মকের মতো করে চায়। অথচ অরুণ স্বাভাবিক। ভোর হেসে বলল,
-” হ্যা আম্মু পড়ে নাও! কিন্তু আব্বুর স্যুট তোমার লাগবে?”
অরুণ ভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আমি যখন বাচ্চা ছিলাম তখনকার অনেক ড্রেস, স্যুট আছে। সেগুলো ফিট হলেও হতে পারে!”
ভোর অবাক সুরে বলল,
-” আব্বু তুমি বাচ্চা ছিলে?”
অরুণ ভোরের দিকে চায় শান্ত দৃষ্টিতে। পাতা বাবা ছেলের দিকে চায়। তার মজা উড়াচ্ছে।
-” আমি কি পাগল?”
-” না। পাগলি! পাগল তো ছেলেরা হয়!”
ভোরের কিউট জবাবে পাতার ফেস কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়।
-” তুমি আমায় পাগল বলতে পারলে ভোর সোনা?”
ভোর পিট পিট করে চেয়ে পাতার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
-” আমি বলি নি তো। তুমি তো আমার ভালো সোনা ময়না আম্মু!”
অরুণ হাত ঘড়িতে সময় দেখে ধমকের সুরে বলে,
-” দু’ জনের মেলোড্রামা শেষ হলে রেডি হয়ে আসুন!”
পাতা তবুও দাঁড়িয়ে থাকে। ভোর বাবার মতো গম্ভীর গলায় বলল,
-” আব্বু তুমি আমার আম্মুকে বকছো কেন?সবাই শুধু আম্মুকে বকে!”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” কে কে বকে?”
-” শুধু আপনিই বকেন! সকাল বিকেল দুপুর সবসময়!’
পাতা বুকে হাত গুটিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে। অরুণ তার দিকে চায়।
-” কথা ঘুরাচ্ছো কেন? আর কে বকে তোমায়?এই ভোর তুমিই বলো?”
ভোর বাবার দিকে চায়। দাদি বকে আম্মুকে, চাচ্চুও। ওই নানি আন্টি না বকলেও দাদিকে দিয়ে বকা শোনাতো! কিন্তু সে বাবাকে বলবে না। আব্বু যদি দাদির সাথে ফাইট করে! তাহলে তো তার কষ্ট হবে। সে পাতার দিকে চায় আড়চোখে। পাতা ভোরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় অরুণের উদ্দেশ্যে বলল,
-” কে বকবে? আপনি ছাড়া কেউ বকে না। মা একটু আকটু শাসন করে ,আম্মুর মতো। ভালো লাগে আমার। আর আরিয়ান ভাইয়ের সাথে ঝগড়া লাগে না ? সেটাই বলছে। ছাড়ুন তো ছেলের কথা!”
অভিজ্ঞতায় ভরপুর অরুণের বুঝতে অসুবিধা হয় না। আদুরিও বলছিলো পাতা ভয় পায় ছোটমাকে। দূরে দূরে থাকে। আর সেও লক্ষ্য করেছে। রুবি ও পাতা দুজনের প্রতি ভিন্ন আচরণ! হবে না আপন ও সৎ পার্থক্য আছে তো। তবে অরুণ কিছু বলবে না। একবার সে এসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হোক ছেড়ে কথা বলবে না। এখন কিছু বললে পাতাকেই ভূল বুঝতে পারে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-” পাতাবাহার রেডি হয়ে নাও!”
-” স্কুলে টিচারদের ড্রেস কোড এক। এখন আমার শাড়িটা তো বাড়িতে। প্যাক করতে ভুলে গিয়েছিলাম!”
-” দ্যাটস গুড! শাড়ি পড়ে আর যাবেও না স্কুলে। সালোয়ার কামিজ পেয়ে যাবে কাল। আজ নরমাল ড্রেস পড়ে নাও!”
পাতার ভ্রু কুঁচকে যায়।
-” শাড়িতে কি সমস্যা?”
অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে দরজায় যেতে যেতে জবাব দেয়,
-” যেটা বলছি সেটা করো! আমরা ড্রয়িংরুমে অপেক্ষায়!”
___
পাতা প্রায় আধাঘণ্টা সময় নিয়ে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়। এক হাতে স্টুডেন্টসদের এক্সামের খাতা অপর হাতে নতুন ভ্যানিটি ব্যাগ। বিয়ের পর একদিন সে ,নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা ও ভোর শপিং মলে গিয়েছিল। সেদিন অনেক কিছুই কেনাকাটা করা হয়েছে। আর বেশিরভাগই তার জন্য কিনেছে লোকটা। একগাদা শাড়ি সহ প্রয়োজনীয় জিনিস, হিলস, স্কার্ফ, ঘড়ি, টুকটাক অনেক কিছু সেখানে শ্যাম্পু কন্ডিশনার থেকে শুরু করে মেয়েলী প্রয়োজনীয় সব এমনকি কাজল, লিপস্টিক,মেকাপ সামগ্রীও। পাতা কোনো কিছুতেই মানা করে নি। বিয়ে করেছে আর বউকে শপিং করিয়ে দেবে না? কোনো জিনিস একটা কেনে নি লোকটা। এই যেমন ভ্যানিটি ব্যাগই বিভিন্ন ডিজাইনের সাতটা। পাতা শুধু মুচকি হেসে লোকটার পিছু পিছু ঘুরেছিল ভোরের হাত ধরে। নতুন নতুন জিনিসপত্র কিনতে,শপিং করতে কার না ভালো লাগে। এতো বড় শপিং মলে সব সুন্দর ইউনিক কালেকশনের জিনিস পত্র দেখে পাতার মনে হচ্ছিল সব ব্যাগে পুরে নিয়ে আসতে। পাতা মিটিমিটি হাসতে হাসতে যাচ্ছিল কিন্তু সামনে শাশুড়িকে দেখে হাসি গায়েব হয়ে যায়। আমতা আমতা করে কিছু বলবে এর আগে আসমা বেগম গম্ভীর গলায় বলল,
-” স্কুলে যাচ্ছো?”
-” জি মা!”
-” ভালো! কিন্তু এসব কি পড়েছো?”
পাতা মাথা নিচু করে নিজেদের দিকে চায়। দুই কানি নামানো গোল কুর্তা পড়েছে সাথে লেডিস জিন্স। মাথায় স্কার্ফ এক পাশে ওড়না ঝুলছে। আসমা বেগম নিচে ড্রয়িং রুমে অরুণ, ভোরকে একবার দেখে নিয়ে খানিকটা নিচু গলায় বলল,
-” ছোট বাচ্চা তুমি? এমনিতেই অরুণের থেকে বয়স কম! দেখতে বাচ্চা বাচ্চা লাগে। এসব পড়লে আরো ছোট লাগবে।”
পাতা ঠাহর করতে পারল না প্রশংসা করলো নাকি মজা উড়াল। পঁচিশ পড়েছে তার চার মাস হলো। ছোট বাচ্চা লাগছে? সে মিনমিন করে বলল,
-” মা রুবি আপুও তো পড়ে!”
বলেই মনে হলো বলা ঠিক হলো না। আবার কি না মনে করে। আসমা বেগম বলল,
-” রুবির বিয়ের সাত আট বছর হয়ে গেছে বাচ্চা কাচ্চাও আছে। কিন্তু তুমি তো নতুন বউ তাই না? শাড়ি টারি পড়ে একটু সেজে ধেজে নতুন বউয়ের মতো থাকবে তা না। কিশোরী মেয়েদের মতো ড্রেস পড়ছো!’
পাতা আড়চোখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে নিচে অবস্থানরত স্বামী ছেলের দিকে চায়। অপেক্ষায় আছে তার। আসমা বেগম সেটা লক্ষ্য করে আরেকটু নিচু গলায় বললেন,
-” নতুন বউ তুমি শাড়ি টাড়ি পড়ে একটু সেজে স্বামীর সামনে ঘুরঘুর করবে। নিজের আঁচলে বেঁধে নেবে ধীর ধীরে। তা না! এখন শাশুড়ি হয়ে এসব শিখিয়ে দিবো নাকি?”
“দিলে মন্দ হয়না” মনে মনে আওড়িয়ে ভাবে আইডিয়া মন্দ নয়। আরে সে শাড়ি পড়ে সেজেগুজে আয়নায় নিজেকে দেখেই শ খানেক ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে বসে সেখানে জামাই তো গড়াগড়ি খাওয়ার কথা।
আসমা বেগম পাতাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়। বিয়ের পরের সময়টা স্বামী স্ত্রীর জন্য মধুমাস। অনেক মধুর স্মৃতি বিজড়িত হবে এই সময়ে। অথচ গাধা মেয়েটা! সেও ভালোভাবে বুঝিয়ে বলতে পারছে না। বললে যদি ভাবে যে ভোরকে বাবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য কুমন্ত্রনা দিচ্ছে। সেও তো এক মেয়ে। তার ঘরেও একটা মেয়ে আছে। আর পাতার সময়টা এককালে সেও পেরিয়ে এসেছে। এখন হয়তোবা সম্পর্কটা মিষ্টি মধুর মনে হচ্ছে। ধীরে ধীরে সময় গড়াবে তিক্ততা সৃষ্টি হতে কতক্ষণ। আর অনিক সরকারের সাথে তার বিয়েটা দ্বিতীয় বিয়ে ছিল। প্রথম বিয়েটা টিকে নি। সেও প্রথম প্রথম সম্পর্কটাকে মন থেকে মেনে নিয়েছিল। অরুণ কেও নিজ ছেলের মতন ভালোবাসতো। কিন্তু হঠাৎ সব বদলাতে শুরু করে। অনিক সরকারের অরুণের প্রতি অবাধ ভালোবাসা, কেয়ার, শাসন, ধমক। বলতে গেলে ছেলেকে নিয়েই তার সব চিন্তা ভাবনা। আসমা বেগম কোথাও ছিল হয়তো অল্প অল্প। তার খুব কষ্ট লাগতো, মন বিষিয়ে উঠতো। অরুণকে কেমন যেন তৃতীয় ব্যক্তি মনে হতো। থাক অতীতের স্মৃতি চারণ। আসমা বেগম খানিকটা মায়া নিয়ে পাতার দিকে চায়। মেয়েটার প্রথম বিয়ে। স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা আছে হয়তো অগাধ। সেই স্বপ্ন পূর্ণ হবে তো আদতে?
আসমা বেগম পাতার উদ্দেশ্যে বলেন,
-” শোন বড় বউ? সময় খুবই মূল্যবান সম্পদ। যে সময় একবার চলে যায় তা কখনো ফিরে আসে না। নিজের সম্পর্কে এফোর্ড দিবে সর্বোচ্চ। নিজের ভালোলাগা, পছন্দ,আশা আকাঙ্ক্ষাকে , নিজেকে! ভূলে যাবে না। তুমি নিজের জন্য কিছু না করলে অন্যরা তা করে দেবে না। দিলেও তোমার মনমতো নাও হতে পারে। নিজেকে রেসপেক্ট না করতে জানলে অন্যের থেকে আশা করাটা বোকামি হবে। ভোরকে ভালোবেসো ,খেয়াল রেখো যত্ন করো সাথে নিজেরও! আর হ্যাঁ এসব কিশোরী সাজা বাদ দাও আইন্দা দেখলে তোমার আলমারিতে আগুন লাগিয়ে দিবো!”
বলে চলে যায়। পাতা পিট পিট করে চায় যাওয়ার দিকে। শাশুড়ির কিছু কিছু কথা সে বুঝতে পেরেছে। পাতা এই মহিলাকে বোঝে না। তাকে শাসন করে বেশ! কখনো মনে হয় এটা তার ভালোর জন্যই। আবার কখনো মনে হয় রুবি ও তাকে ভিন্ন নজরে দেখছে। এখন কার মনে কি আছে উপর ওয়ালাই ভালো জানেন। পাতা ভাবনা পেছনে ঠেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। অরুণ পাতার দিকে গম্ভীর মুখ চেয়ে। পাতা এদিকে ওদিকে নজর ঘোরায়। দেড়ির জন্য ঝাড়ি না দেয়। অরুণ ঝাড়ি দেয় না। সে দেখেছে ছোটমা আর পাতাবাহার কথা বলছিল উপড়ে। সে শান্ত গলায় বলল,
-” কি বলল ছোটমা?”
-” আপনাকে কেন বলবো? হুহ!”
পাতার ত্যাড়া তীক্ষ্ণ জবাবে অরুণের মেজাজ বিগড়ে যায়। খানিকটা বেয়াদবির আভাস পেল যেন।
-” এক থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দেব বেয়াদব! বন্ধু লাগি আমি তোমার? বড়দের সম্মান দিতে জানো না! সাধারণ প্রশ্ন করেছি বলবে না, ভদ্র ভাবে না করো। এভাবে মুখের উপর বেয়াদবি করার কি দরকার?”
ধমকে পাতা ভোর কেঁপে উঠলো। পাতার নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে। ঠোঁট জোড়া ভেঙে আসতে চায়। সে তো ওভাবে বলে নি। ঠাট্টার ছলেই বলেছে যেন এটা নিয়ে কথা উঠে, প্রসঙ্গ পাল্টে যায়। অথচ লোকটা বেয়াদব বলে দিল। সে নিজেকে সামলে বলল,
-” স্যরি আমি ওভাবে বলি নি।”
অরুণ গম্ভীর মুখে পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতে খাতার বান্ডিল দেখে বলল,
-” ওগুলো?”
পাতা মাথা নিচু করে খাতার দিকে চায়।
-” বাচ্চাদের এক্সামের খাতা। পরশু রেজাল্ট হবে অথচ দেখা হয় নি। কিছু আমি রেখেছি বাকি গুলো ফ্রেন্ডকে দেব ও দেখবে।”
অরুণ আর দেড়ি করে না। ভোরের স্কুল ব্যাগ কাঁধে তুলে পাতার হাত থেকে খাতার বান্ডিলটা নিয়ে হাঁটা দেয়। ভোর গম্ভীর মুখে পাতার হাত ধরে বাবার পিছনে হাঁটতে থাকে।
গাড়ির ভেতরে পিনপিন নীরবতা।গাড়ির ইঞ্জিন,হর্ণ ও আশেপাশের গাড়িঘোড়ার আওয়াজ ভেসে আসে। ড্রাইভার রঞ্জু গাড়ি ড্রাইভ করছে স্বাভাবিক বেগে। আজ আভারির উপস্থিতি নেই ফ্রন্টসিটে। পেছনে অরুণ, পাতা, মাঝখানে ভোর পাতার দিকে ঘেঁষে বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে আছে। মুখটা বড়দের মতো গম্ভীর। পাতা স্বাভাবিকভাবেই বসে, তবে তার মনটা বেশ খারাপ। লোকটা এভাবে ধমক দিতে পারলো ছেলেটার সামনে। লজ্জায় তার চোখে পানি চলে আসে। খোলা জানালার দিকে মুখ করে অলক্ষ্যে মুছে নেয়।অরুণ মোবাইল হাতে ফেসবুকে স্ক্রল করছে। তবে আড়চোখে পাশে মানব মানবীর গোমড়া মুখ নজর এড়ায় নি। সে ফেসবুকে সার্চ করে একটা ফানি ভিডিও বের করে। ভোরের দিকে তাক করে বলে,
-” আব্বু দেখো কতো মজার ভিডিও!”
ভোর আড়চোখে একবার চেয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অরুণ এগিয়ে এসে তার সম্মুখে ফোন রাখে। ভোর ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল।ফলাফল স্বরূপ ফোনটা পড়ে যায় হাত থেকে। পাতা চোখ বড় বড় করে ফোনের দিকে চায়। অরুণ ফোনটা তুলে ঝাড়ি দিল একটা।
-” কি হয়েছে টাকি হ্যাঁ? অনেকক্ষণ হলো সহ্য করছি!”
ভোর অরুণের দিকে ফোঁস ফোঁস করে বলল,
-” তুমি আম্মুকে অনেক জোড়ে বকেছো! আম্মু কষ্ট পেয়েছে! তোমার সাথে কথা নেই!”
আর বলতে পারে না কান্নায় গলার স্বর রোধ হয়ে আসে তার। আম্মুর মলিন মুখ দেখে তার কষ্ট হয়। পাতা অবাক হয় বেশ। ভোরকে তুলে নিজের কোলে বসায়। অরুণ মা ছেলের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চায়। বকলো কাকে আর চোখের জল ফেলছে কে? সাথে অবাকও হয়। ছেলেটা এ কয়দিনে পাতাবাহারকে বেশ ভালোবেসে ফেলেছে। পাতা ওড়না দিয়ে ভোরের গাল মুখ নাক মুছে দিলো। বুকে জড়িয়ে বলল,
-” আরে কাঁদছো কেন? আমি তোমায় বলেছি যে আমি কষ্ট পেয়েছি! আমি একটুও কষ্ট পাই নি। এরকম ধমক ঝাড়ি কতো শুনেছি। এমনকি দাদির হাতে লাঠির পেটা খেয়েও দাঁত বের করে হেসেছি আমি ও কাওছার ভাই।”
বলে হাসলো পাতা। কিন্তু ভোর হাসলো না। পাতার গলা জড়িয়ে আড়চোখে বাবার দিকে চায়। অরুণও তাকিয়ে ছিল বলে চোখাচোখি হয়। সে পাতার হাসিমুখ ও ছেলের ক্রন্দনরত মুখ দেখে বলল,
-” ভালো। ছেলে ও ছেলের আম্মু একটিমে হয়ে আমাকে ভুলে গেছে! আমিও টিম বানাবো..”
তাকে আর বলতে না দিয়ে ভোর বলে উঠলো,
-” আম্মুকে স্যরি বলো?”
অরুণ ছেলের দিকে চায় শান্ত চোখে। পাতা না না করে বলে,
-” ভোর সোনা স্যরি কেন বলবে? নিজেদের মধ্যে কেউ স্যরি বলে নাকি! আর আমার ভুল ছিল, বেয়াদবি করেছি তাই বকেছে। তুমি একটু হাসো তো? তোমার আব্বুর মতো গম্ভীর মুখ বানিয়ে রেখেছো কেন? ভোরকে হাসি খুশি থাকলেই ভালো লাগে!”
অরুণ আড়চোখে পাতার চোখের দিকে চায়। পাপড়িগুলো ভিজে। ভোর হাসে না। পাতার কোল থেকে নেমে অরুণের কোলে বসে।অরুণের বাম হাতের তালু মুখে পুরে শক্ত করে কামড় বসায়। অরুণ কিছু বলে না, না হাত সরানোর কোনো চেষ্টা করে। তবে পাতা হাত সরিয়ে ভোরকে খানিক শক্ত করে বলল,
-” ভোর এসব কি? এর আগেও তুমি উনাকে আঘাত করেছো! এটা ঠিক না। তোমার আব্বু তোমার গুরুজন। তাকে আঘাত করা ঠিক?”
ভোর মাথা নাড়ল ঠিক না। তাই সে কামড় দেয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে সরে আসতে নিলে অরুণ ছেলেকে আটকায়। শান্ত নরম গলায় বলল,
-” ভুল হয়েছে আমার। স্যরি পাতাবাহার!”
ভোরের গোমড়া মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খায় গালে। অরুণ পাতার দিকে চায়। পাতাও তার দিকে। স্যরি বলল! কিন্তু বাধ্য হয়ে। তবে পাতা কিছু বলে না, ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে অল্প। অরুণ হাত বাড়িয়ে পাতার ফুলো গালে আঙ্গুল দাবিয়ে দেয়। পাতা ব্যাথা পায় না একটুও বরং একটু কেঁপে উঠল কি? তবে তার ইচ্ছে করে ভোরের মতো আঙ্গুলটায় শক্ত করে একটা কামড় বসিয়ে চুমু খেতে।
_____
ব্যস্ত রাস্তা। গাড়ি ঘোড়া রিকশা ছুটে চলছে অনবরত। গাড়ির হর্ন বাজছে । বাচ্চারা ছুটোছুটি করে রাস্তা পাড় হয়ে স্কুলে প্রবেশ করছে। ছোট ছোট বাচ্চা গলায় আইডি কার্ড ও পানির বোতল ঝুলছে। সাদা শার্ট ও কালো হাফ প্যান্ট, মেয়েটা শার্ট ও স্কার্ট পড়ে, সাদা মুজো ও শু পড়ে কাঁধে বড় ব্যাগ ঝুলিয়ে বাবা অথবা মায়ের হাত ধরে হাঁটছে সকলে। কেউ কেউ বাবার কোলে চড়ে যাচ্ছে। স্কুল সামনে হওয়ার দরূণ এই রাস্তায় জ্যাম লাগে সকাল বেলা। গেট বরাবর একটা জেব্রাক্রসিং আছে। রাস্তার দু ধারে ফুটপাত বন্দি নানা রকম দোকানির কর্মসূচিতে। কেউ ঝালমুড়ি, শরবত, আইসক্রিম, ফুচকা ইত্যাদির দোকান। তবে একটা জিনিস ভালো সেটা হচ্ছে স্কুলের ভিতরে এসব এলাও না। স্কুলের আঙিনায় বাচ্চাদের জন্যে একটা দোকান আছে। তবে সেটা ক্লাস চলাকালীন বন্ধ থাকে। টিফিন পিরিয়ডে ও স্কুল শুরু ছুটির আগ মুহূর্তে খোলে। অরুণের গাড়ি জ্যামে আটকে। পাতা ও ভোরকে নামিয়ে দিয়েছে। ওই তো যাচ্ছে। আগে তো সেই নামিয়ে দিয়ে ক্লাসে বসিয়ে তবেই ফিরতো। কিন্তু আজ সে তার আম্মুর হাত ধরে নাচতে নাচতে যাচ্ছে হাসিমুখে। ব্যাগটা পাতার কাছে। জ্যাম ছেড়ে গাড়ি যায়। ইউ টার্ন নিয়ে স্কুলের সামনের অপর রাস্তায় আসে। পাশের সিটে তাকাতেই নজরে আসে একটা ব্যাগ। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে ব্যাগে টিফিন বক্স। এটাতো সেই বানিয়ে এনে দিয়েছে পাতাবাহারকে। লাঞ্চের জন্য! মেয়েটি ফেলে গেলো? অরুণ বক্স হাতে নেয়। ড্রাইভারকে বলে গাড়ি থামায়। রাস্তা পার হয়ে গেট পেরিয়ে স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করে। সোজা টিচার্স রুমের উদ্দেশ্যে যায়। ভোরের ক্লাসরুমও ওইদিকেই। টিচার্স রুমের সামনে দিয়েও আসা যায়। অরুণ মাঠ পেরিয়ে বারান্দায় যায়। পাতাকে নজরে আসে। ওই তো দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। দুই পা এগিয়ে গেলেই অরুণের পা থেমে যায়। পাতা একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। অরুণ চেনে ছেলেটাকে। স্কুলেরই টিচার। সেই হিসেবে পাতাবাহারের কলিগ। কথা বলতেই পারে কিন্তু!ওভাবে হেসে হেসে!! পাতা ছেলেটার দিকে খাতার বান্ডিল বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা হাসিমুখে নিয়ে কিছু বলল। পাতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। অরুণের দন্ত কপাটি কটমট করে ওঠে। হাতের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে পা চালালো হনহনিয়ে। এই তার ফ্রেন্ড! যে এতো গুলো খাতা দেখবে একদিনে। ভালো খুবই ভালো।
-” তাড়াহুড়ো করে দেখো না যেন! ভালোভাবে দেখো খাতাগুলো!”
সৈয়দ হেসে পাতাকে বলল,
-” যথা আজ্ঞা ম্যাডাম পাতা অরুণ সরকার!”
পাতা মুচকি হেসে চোখ রাঙায়। সৈয়দ হেসেই মজার সুরে বলল,
-” যাই বলো আমি কিন্তু বলেছিলাম রাজি হয়ে যাও জুনিয়র পার্টনার ওতটাও ওড না! ট্রাই করতে পারো! কিন্তু তুমি তো তোয়াক্কাই করলে না। এখন বুড়ো বেডারে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে। কষ্ট কষ্ট আফসোস!!”
পাতা মুচকি হাসে। ছেলেটার সাথে স্কুলে আসার পর থেকেই পরিচয়। একসাথেই জয়েন করেছিল। খুবই ফ্রেন্ডলি হাসিখুশি একটা ছেলে। মনটাও ভালো হয়তোবা।
-” বুড়ো নয় মোটেও। তোমার থেকে যথেষ্ট হ্যান্ডসাম ও হাট্টাকাট্টা দেখতে। তোমাকে তো হালকা বাতাসেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোন না কোন গাছের সাথে লকটে থাকবে!”
সৈয়দ হেসে উঠলো সামনে দেখিয়ে বলল,
-” পিছনে দেখো আসছে তোমার হ্যান্ডসাম হাট্টাকাট্টা জামাই। তোমার জামাই মুখ খানি দেখো? মনে হচ্ছে নিমপাতা মুখে নিয়ে আছে। একটু মিষ্টি মুখ করিয়ে দাও বেশি করে আসছি টা টা!”
বলেই চলে যায় সামনে তারপর রুমে ঢুকে দরজা চেপে দেয়। পাতা পিছনে চায়। অরুণ গম্ভীর মুখে পাতার সামনে দাঁড়ালো।বেশি দূরত্বে না কাছ ঘেঁষেই। পাতা আশেপাশে দেখে। ছোট ছোট কিছু বাচ্চারা গলাগাটি করে ক্লাসে যাচ্ছে। পাতা চাপা স্বরে বলল,
-” কি হয়েছে? কিছু বলবেন?”
অরুণ ব্যাগটা বাড়িয়ে দেয়।
-‘ মন কোথায় থাকে?”
পাতা হাতে নিলো।
-” মনে ছিলো না। আর আসলে আজ টিফিন পিরিয়ডেই ছুটি নিবো তাই আর কি!”
অরুণ ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করলো,
-” ছুটি কেন?”
-” এতো গুলো খাতা দেখতে হবে না। তাই শেষ হলে হয়!”
-” কেন আপনার বন্ধু নিলো তো!”
বন্ধু কথাটা একটু টেনে বললো। পাতা বুঝতে পারলো কি?
-” সৈয়দকে অর্ধেক দিয়েছি। বাকি অর্ধেক বাড়িতেই ওগুলো আমি দেখবো!”
অরুণ কিছু বলে না চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পাতা উশখুশ করে। লোকটা যাচ্ছে না কেন? বাকি টিচার্সরা দেখলে মজা উড়াবে অনেক। সে শুধু ঘার এদিকে ওদিকে করে দেখছে কেউ আসছে কি না। অরুণ পাতার অস্থিরতা লক্ষ্য করে গম্ভীর মুখে বলল,
-” আমি দাঁড়িয়ে আছি বলে অস্থির হচ্ছো? ওই ছেলেটার সাথে তো হাসিখুশি কথা বলছিলে!!”
পাতা তড়িঘড়ি অরুণের দিকে ফিরে। কি বললো? অরুণ সরাসরি পাতার চোখের দিকে চেয়ে। পাতাও চোখ রাখে। জেলাসি!!! বাব্বাহ অরুণ সরকার তার বউকে নিয়ে জেলাস!! অরুণ কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” পাতাবাহার? তোমার দাঁত গুলো খুব সুন্দর! ছোট ছোট, একদম সাদা! অনেক স্ট্রং তাই না? এরকম অন্য লোকের সাথে হাসাহাসি করলে একটাও থাকবে না। থাঁপড়ে ফেলে দেবো! আমি মোটেও ভালো মানুষ নই! আমার হাতটা বেশিই চলে কি না!!”
পাতার মুখটা রঙহীন হয়ে যায়। কথায় কথায় ‘থাপ্পড় মেরে কানে তালা ঝুলিয়ে দেবো’! আরে শালার জামাই বউয়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? একটু মিষ্টি করে বলতে পারিস না! পাতা কিছু বলে না। অন্য সময় হলে পায়ে পা লাগিয়ে তর্ক করতো। কিন্তু লোকটা সকালে ছেলের সামনে কিভাবে বকলো! পাতার নীরবতা দেখে অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটাকি এখনো তার উপর রেগে? অরুণ ঘার ডলে হাত দিয়ে। টিচার্স রুমের দিকে চায়। দরজা বন্ধ। পেছনেও কেউ নেই দু একটা বাচ্চা আসছে। অরুণ পাতার কাঁধ ধরে ঝুঁকে তড়িৎ বেগে থুতনিটা মুখে পুরে কামড় বসালো। জোড়ে না, আবার আস্তেও না। সময় নেয় না পরপর ছোট ছোট দুটো চুমু বসিয়ে সরে আসে। আশেপাশের ছোট বাচ্চা গুলো মিটিমিটি হাসছে। অরুণ খেয়াল করে কিন্তু মাথায় নেয় না। বড় বড় পা ফেলে চলে যায় গম্ভীর মুখে।
বাচ্চারা গুসু্য ফু্সুর করে।পাতা মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে। কি হয়ে গেল? তিনটা বাচ্চা; দুটো মেয়ে ও একটা ছেলে ক্লাস ওয়ানের। পাতা চেনে তাদের। মিটমিটে হেসে পাতাকে সালাম জানিয়ে পাশ কাটিয়ে ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে গেল। পাতা এখনো দাঁড়িয়ে। ডান হাত বাড়িয়ে থুতনিতে ছোঁয়, ভেজা ভেজা। আচ্ছা তার মাথা ঘুরছে কেন? লোকটা কামড়ে চুমু খেলো নাকি রক্ত চুষে রক্তশূন্যতায় ফেলে দিয়ে গেলো কে জানে!। পাতা চোখ পিটপিট করে। বাগান বিলাসে আচ্ছাদিত বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে অরুণ সরকারকে একবার দেখে। ওইতো পকেটে হাত পুরে মাঠের রোদের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হনহন করে। পাতার অধরকোণে ফুলের কলি ফোটে মিষ্টি হাসির ডালে ডালে। মনটা নেচে ওঠে তালে তালে। থুতনিতে রাখা হাতটা ঠোঁটের ভাঁজে রেখে সময় নিয়ে চুম্বন করে। আহা! আকাশে বাতাসে চল সখি উড়ে যাই তোর ডানা মেলে রে!!
______
প্লে ও নার্সারির রুম পাশাপাশি। নিচের ফ্লোরে টিচার্স রুমের পাশে। এর উপরে ক্লাস ওয়ান ও টুয়ের বাচ্চারা। ভোর ক্লাসে বসে আছে কর্নারের ফাস্ট ব্রেঞ্চে। সে একাই কিছু বই পাশে রেখে রোহানের জন্য জায়গা আটকে রেখেছে। রোহান এখনো আসে নি। ক্লাসে আরো অনেক বাচ্চা। সবাই এসেছে বোধহয়। রবিন, সানা, তাহসান, মেরি, টয়া ভোরের সামনে দাঁড়ায়। তাহসান ক্লাসের ক্যাপ্টেন। অনেক দুষ্টু সবাইকে বকবে ও মারবে ধরে ধরে। তবে ভোরকে কখনো মারার সাহস পায়নি। মাঝে মাঝে ক্লাসে কথা বলার জন্য বকে। ভোর সবাইকে দেখেও কিছু বলে না। পেন্সিল পেপার বের করে অ আ লিখতে থাকে। মেরি তার পেন্সিল কেড়ে নেয়। ভোরগম্ভীর মুখে বলল,
-” মেরি আমার পেন্সিল দাও আমি লিখছি দেখতে পারছো না?”
-” সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আমলা যে এসেছি সেটা তুমি দেখতে পালছো না?”
মেরির কথায় ভোরের হাসি পায়। সেও ব্যঙ্গ করে বলে,
-” পালছি! মেলি”
বলেই হেসে দিল। মেরি রেগে পেন্সিল দিয়ে ব্রেঞ্চে মারলো পেন্সিলটা ভেঙ্গে যায়; মেরি ভাবে নি ভেঙে যাবে। ভোর নিজের ভাঙ্গা পেন্সিল দেখে রেগে বলল,
-” কি করলে তুমি এটা? আমার পেন্সিল ভাঙলে কেন বাজে মেয়ে!”
বাজে বলায় মেরিও রেগে মারতে গেলে সানা আটকায়। তাহসান ভোরকে বলে,
-” ওকে বাজে মেয়ে বললে কেন? আমি স্যারকে বলে দেবো তোমায় পানিশমেন্ট দিবে!”
-” আমিও বলে দেব যে ও আমার পেন্সিল ভেঙে ফেলছে।”
সবাই দমে যায়। রবিন ভোরের পাশে বসে হেসে বলল,
-” শুনলাম মিস পাতা নাকি তোর মা হয়ে গেছে?”
ভোর কপালে ভাঁজ ফেলে গাল ফুলায়। ওরা জানলো কিভাবে? ভালোই হয়েছে জেনেছে।
-” আম্মু হয় আমার!”
-” একই তো! আচ্ছা তোর আসল মা তোদের সাথে থাকে না কেন?”
তাহসানের কথা ভোরের ভালো লাগে না। তাই সে জবাব দেয় না। চুপ করে থাকে। টয়া বলে,
-” ভোর তোমার আসল মা তোমায় ভালোবাসে না?”
ভোরের মুখশ্রী বাবার মতো গম্ভীর হয়। রেগে বলল,
-” বাসে। অনেক ভালো বাসে। শুধু আমাদের সাথে থাকে না!”
রবিন হেসে বলল,
-” ভালোবাসলে তোর সাথে থাকে না কেন? আর তোর আব্বুই বা মিস পাতাকে আম্মু বানালো কেন?”
ভোর কিছু বলে না। মেরি হেসে ব্যঙ্গ করে বলল,
-” আম্মু! মিস তো ওল সৎ আম্মু হয়। আমি শুনেছি সৎ আম্মু অনেক খালাপ হয়। ভ্যাম্পায়ালেল মতো । অনেক মালে কাজ কলায়। খেতে দেয় না।”
ভোর মেরির দিকে রেগে চায়। রাগের দরূণ তার গাল জোড়া লাল হয়ে গেছে। চোখ জোড়া টলমল করছে নোনাজলে। ভোর কিছু বলতে পারে না রাগের দরূণ শুধু জোরে জোরে শ্বাস টানছে। স্যার চলে আসায় সবাই যার যার সিটে বসে পড়লো। দাঁড়িয়ে স্যারকে সালাম দিলো। ভোরও তার ব্যাতিক্রম নয়। ব্যাগ হাতরে রুমাল বের করে নাক মুখ মুছে নেয়। স্যারের পিছনে রোহানকে আসতে দেখে খানিকটা খুশি হলেও মুখ গোমড়া করেই রাখে। রোহান বসে পড়লো ভোরের পাশে। স্যার থাকায় কিছু বলতে পারে না। রোল কল শেষ হলে স্যার হোমওয়ার্ক দেখতে শুরু করে। রোহান তার ও ভোরের হোমওয়ার্ক দিয়ে এসে ভোরকে ফিসফিস করে বলল,
-” কি হয়েছে ভোর? রাগ করে আছিস কেন?”
-” এমনি!”
-” এই পাতা মিস সত্যিই তোর আম্মু হয়ে গেছে?”
-” তুই কি করে জানলি?”
ভোরের প্রশ্নে রোহান হেসে বলল,
-” আমি কেন সব্বাই জানে! মিস এখন তোদের সাথেই থাকে?”
ভোর মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। রোহান আরো ফিসফিস করে বলে,
-” তোকে অনেক আদর করে? ভালোবাসে? খাইয়ে দেয়? ঘুম পাড়িয়ে দেয়?’
ভোর উৎসাহ নিয়ে জবাব দেয়,
-” হ্যাঁ! অন্নেক আদর করে ভালোবাসে। খাইয়ে দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, আমার সাথে খেলে, আমাকে স্কুল ড্রেসও পড়িয়ে দিয়েছে!”
রোহান হাসে। স্যার সবাইকে শান্ত হতে বলায় দুই বন্ধু চুপ করে ক্লাসে মনোযোগ দিল। পরপর সবগুলো ক্লাস শেষ হয় একটা বাদে। আজ পাতার ক্লাস ছিলো না। লাস্ট ক্লাসে কথার মাঝে রোহান ভোরকে বলল,
-“ভোর মিস তো তোর সৎ আম্মু! আর আমি শুনেছি সৎ আম্মু বেশি ভালো হয় না। বাচ্চাকে মারে, বকে ,ভালোবাসে না, কাজ করায়। কখনো কখনো তো খেতেও দেয় না। আর বাবাকেও নিজের দিকে করে নেয়!”
ভোরের নাকের পাটা আবার ফুলে ওঠে। আঁখি যুগল ভরে ওঠার সাথে সাথে নাসা গহ্বরও ভরে ওঠে। ভোর নাক ডলে কান্না আটকে থেমে থেমে বললো,
-“আমার আম্মু আমার আম্মুই । সৎ নয় আম্মু। সে আমাকে খুব ভালোবাসে। আদর করে খাইয়ে দেয় বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। একটুও বকে না। মারা তো অন্নেক দূরে। তুই আর এমন বলবি না বলে দিলাম!”
ক্লাসের ঘন্টা বেজে যায়। টিচার ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলে ভোর বইখাতা পেন্সিল এলোমেলো করে ব্যাগে পুরে উঠে আসে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। মেরির সিটের সামনে দাঁড়ালো। মেরি মধ্যের সেকেন্ড ব্রেঞ্চে বসে নিজের বই খাতা গোছাচ্ছিল। ভোরকে দেখে বলল,
-” কি চাই?”
ভোর কিছু না বলে ওর পেন্সিলটা নিয়ে দুই হাতের সাহায্যে মট করে ভেঙ্গে ফেলে দিলো।
-” আমার আম্মু সৎ না। আমাকে মারেও না, বকেও না অনেক অনেক আদর করে। তোর মায়ের থেকেও বেশি।”
বলে দৌড়ে ক্লাসরুম থেকে বেরোলো। টিচার্স রুমে গিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিলো। এক ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলো,
-” আম্মু কোথায়?”
ম্যাডাম না বুঝলে ভোর সংশোধন করে বলল,
-” পাতা মিস কোথায় মিস?'”
-” ক্লাস ফোরে ক্লাস ছিল বোধহয়। সেখানেই হবে কেন?”
-” এমনি!”
বলে বারান্দা পেড়িয়ে মাঠে নামে। ক্লাস থ্রী, ফোর ও ফাইফের ভবন টিচার্স রুমের উলম্ব বরাবর। ভোর দৌড়ে সেথায় যায়। নিচের বাম দিকে ক্লাসে উঁকি দিলো। পাতা ক্লাসের ছাত্রদের ম্যাথ বুঝিয়ে দিচ্ছে। ঘন্টা পড়লেও শেষ হয় নি। ভোরকে উঁকি দিতে দেখে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে কি! ভোর দৌড়ে একপ্রকার জোর করেই পাতার কোলে উঠলো। পাতা খানিকটা হতভম্ব। ক্লাস চলাকালীন এভাবে ভোরের দৌড়ে আসা!!
-” কি হয়েছে ভোর সোনা?”
ভোর কিছু বলে না। শক্ত করে তার আম্মুকে জড়িয়ে বিড়বিড় করে আম্মু আম্মু জপতে থাকে। ক্লাসের সব ছাত্র কানাঘুষো করছে একে অপরের সাথে। পাতা তাদের উদ্দেশ্যে বলল,
-” স্টুডেন্টস ইউ ক্যান গো নাও! আই উইল এক্সপ্লেইন দা ইকুয়েশন ট্যু ইয়ু নেক্সট ক্লাস ইনশাআল্লাহ!”
সবাই চলে যায় একে একে। পাতা ভোরকে ক্লাসরুমের হাই ব্রেঞ্চে বসিয়ে কপালে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বলল,
-” কি হয়েছে বলবে না?”
ভোর পাতার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” কিছু হয় নি আম্মু। আই মিসড ইউ সো মাচ! তাই!”
পাতা মুচকি হেসে ভোরের গাল টেনে দেয়। ভোর মিষ্টি করে হাসলো।
চলবে….