#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৩
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
তপ্ত মধ্যাহ্নের সময়। ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল নগর জীবন। স্বস্তি নেই একটুও। ফ্যানের বাতাসে শরীর জুড়ে না; গরম অনুভব হয়। ভালোলাগে না এই অসহ্যনীয় গরম। খেয়ে, বসে, ঘুমিয়ে, কাজ করে, খেলে কিছুতেই শান্তি নেই। শুধু মনে হয় ফ্রিজের ভিতর ঢুকে বসে থাকি। নয়তো গরমের এই ছয়মাস শীতকালীন কোনো দেশে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে টোপলা টাপলি নিয়ে বেড়িয়ে পরি। শীত পড়লে ফিরবো আপন নীড়ে। কিন্তু হায় সেটা তো সবার পক্ষে সম্ভবপর নয়। বিদেশ ভ্রমন চাট্টিখানি কথা নয়। উচ্চাভিলাসী বিত্তশালীদের পক্ষে সম্ভবপর হলেও মধ্যবিত্তের জন্য সেটা সোনার ডিম পারা হাঁস। অরুণ সরকার অফিসে ব্যস্ত সময় পার করছে। এসি সংযুক্ত অফিস হওয়ার দরূণ গরমের অবকাশ নেই। আরামেই কাজ করছে। লম্বা ছুটি কাটানোর পর অফিসে সকলেই ব্যস্ত। অরুণ ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং রুমে বসে। শহরের বড় বড় স্বর্ণের জুয়েলারির শো রুম গুলোয় তাদের কালেকশন অহরহ। আমাদের বাংলাদেশে দুই ঈদের পর পর বিয়ের সিজন শুরু হয়। এই সময়গুলোতে ব্যস্ততায় ভরপুর থাকে তাদের অফিসের প্রত্যেকটা কর্মচারী। অরুণ মিটিং শেষ করে তড়িঘড়ি করে বের হয়। আরেক নতুন ক্লায়েন্টের সব কালেকশন ডেলিভারী দিয়েছে। সঠিক ভাবে ডেলিভারী দিতে পারলো কি না সেটা জানা অতি আবশ্যকীয়। একেতো নতুন ক্লায়েন্ট সাথে অনেক গুলো কালেকশন অর্ডার করেছে। চিন্তা হওয়া উচিত। অরুণ ভাবলো ম্যানেজার সুজনকে সাথে পাঠালে ভালো হতো। ইনসিওর হতে পারতো। এটা নিয়ে টুকটাক কথা বলতে বলতে বলতে চিন্তিত ও গম্ভীর মুখে ম্যানেজার সুজনের সাথে নিজ কেবিনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। অফিসের এক সেকশনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পায় ডেস্কটপে একটা মানব মানবীও নেই। সবাই একজায়গায় জড়ো হয়ে গভীর আলাপ চারিতায় ব্যস্ত। সুজন গলা উঁচিয়ে ধমকে কিছু বলবে অরুণ হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। শব্দহীন পায়ে হেঁটে যায় কেন্দ্রবিন্দুতে। চেনা পরিচিত কর্মচারীদের ভিড়ে এক আপন মুখশ্রীর দেখা মেলে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়লো। পাতাবাহার অফিসে? সে আরো দেখে লাবিবের কোলে ভোর হাসিমুখে এটা ওটা বলছে। অরুণ পাতার দিকে চায়। মুখে লাজুক হাসি। পিট পিট করে আঁখি যুগল দ্বারা সবাইকে দেখছে। বাকি সবাই টুকটাক জিজ্ঞাসা করছে তাকে আর মহারানী ধীরে ভদ্রভাবে জবাব দিচ্ছে। বাড়তি একটা কথাও বলছে না। এমন কিউট ও শান্ত ভঙ্গিতে সকলের সাথে কথা বলছে, মনে হচ্ছে এর চেয়ে শান্ত শিষ্ঠ মেয়ে দুটো নেই। অথচ পুরাই সাইক্লোন এই মেয়ে। অরুণের অধর প্রসারিত হয়। এদিকে ওদিকে চেয়ে হাসি লুকিয়ে গম্ভীর ভাব বজায় রাখলো। পাতাবাহার লাবিবের সাথে একটু বেশিই কথা বলছে না? হেসে হেসে বারবার তাকাচ্ছেও। সকালের হুমকির কথা মনে নেই নাকি?
-” হোয়াটস গোয়িং ওন?”
আলাপ চারিতার মাঝে হঠাৎ বসের গম্ভীর গলা শুনে সকলে সচকিত হয়ে বসের দিকে ফেরে। স্বয়ং বসকে দন্ডায়মান দেখে নিজের ডেস্কে যেতে সময় নেয় না। বাকি লাবিব ও মিসেস রুনা। মিসেস রুণা নিজ ডেস্কটপেতেই। লাবিবের ডেস্ক তার পাশে কোলে ভোর থাকার দরুন সে দাঁড়িয়ে থাকে। পাতা অরুণকে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায়। আমতা আমতা করে, কি বলবে বুঝতে পারে না। তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। ভোর মিষ্টি হেসে বাবার দিকে চায়। অরুণ গম্ভীর মুখে লাবিবকে বলল,
-” কাজ লাটে উঠিয়ে কি চলছিলো এখানে?”
লাবিব হেসে পাতার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” বসের বস এসেছে তাকে ওয়েল কাম জানালাম বস! উনিই তো আমাদের মেইন বস! তার আগমনে আজ সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে পারেন স্যার, সাথে ছুটি বোনাস!”
-” মি. লাবিব প্রমোশনের কথা ভেবেছিলাম! কিন্তু আপনার কপালে ডিমোশন নাচছে বোধকরি!”
লাবিবের মুখ খানি চুপসে যায়। গেলো তার প্রমোশন। ভোর তার গাল টেনে কোল থেকে নেমে আসে। অরুণের সামনে দাঁড়াতেই অরুণ হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। মিসেস রুনাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” মিসেস রুণা আপনার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম ফাঁকিবাজদের। কথা না শুনলে কান টেনে সুধরে নেবেন!”
বলে পাতার দিকে চায়। পাতাও তার দিকেই চেয়ে আড়চোখে। নজর মেলায় চোখ ফিরিয়ে গালে জিভ ঠেকায়।
-” আসো!”
বলে অরুণ ধীর গতিতে পা চালায় । পাতা আশেপাশে চেয়ে তার পিছনে হাঁটতে থাকে। স্বল্প দূরত্বের ব্যবধানে অরুণের কেবিনে প্রবেশ করে পাতা। পুরো কেবিনে চোখ বুলিয়ে নেয়। সিনেমায় একজন বিজনেসম্যানের কেবিন যেমন থাকে তেমনি শুধু এই কেবিনে অনেক গুলো গাছের টব। তার মধ্যে দুই তিনটা পাতা চেনে। যেগুলো বাড়িতে আছে। এরিকা পাম, ফিলোডেনড্রন, জিজি প্লান্ট, স্নেক প্লান্ট, ফিগ প্ল্যান্ট ইত্যাদি। পাতা শুনেছে তার মরহুম শশুর মশাই প্রকৃতি প্রেমী মানুষ। অফিসটা তারই হাতে গড়া সেটা অফিসের পরিবেশ দেখলেই বোঝা যায়। অরুণ দরজা লাগিয়ে পাতাকে বসতে বলে। ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজেও বসে সোফায়। ছেলেকে আদর করে শু,মুজো, টাই খুলে দিয়ে বলল,
-” আব্বু তোমার আম্মু প্রথমবার এলো অফিসে কিভাবে ওয়েলকাম করি বলো তো?”
ভোর মিষ্টি হেসে বাবার গলা জড়িয়ে বলল,
-” তুমি সকালে আম্মুকে বকেছিলে তাই এখন বেশি করে আদর করে দাও। অনেক গুলো আইসক্রিম দাও! আর লাবিব আঙ্কেলদের মিষ্টি খাওয়াও!”
অরুণ পাতার দিকে চায়। পাতা চোখ বড় বড় করে চেয়ে। কি বলে এই ছেলে? সে মাথা নাড়িয়ে না না ইশারা করে অরুণকে। অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে ভোরকে সোফায় বসিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে ম্যানেজারকে কল করে উঠে একটু দূরত্বে যায়। ভোর পাতার কোলে মাথা রেখে সোফায় পা তুলে শুয়ে পড়ে বলল,
-” আম্মু তোমার মন খারাপ?”
পাতা ভোরের কপালে চুমু দিয়ে মাথা নেড়ে না বোঝায়। ছেলেটা বুঝলো কিভাবে তার মন খারাপ? তার মন খারাপ স্কুলে যাওয়ার পরপরই। অরুণ সরকার যাওয়ার পর সে খুশি মনে টিচার্স রুমে যায়। সকলে তার সাথে হাসিখুশি কুশলাদি বিনিময় করে। কিন্তু তারপর খোঁচা মেরে কিছু ফিমেল কলিগ অনেক কথা বলে। তার নতুন ভ্যানিটি,শু’জ, ঘড়ি দেখে টিটকারী করে। কটুক্তি করে বলে,
-” এটা তো নতুন! হাসবেন্ড দিলো বুঝি? সব ব্র্যান্ডের কিন্তু! আগে তো পুরনো কম দামি জিনিস বছর ভরা ব্যবহার করতে। অথচ এখন শুধু ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র এ বেলা ও বেলা ইউস করবে! হাসবেন্ডের এতো এতো টাকা, খরচ করবে না?”
বলেই মিষ্টি করে হাসলো। আরেকজন বলল,
-” বাহ্। এই কয়েকদিনে বেশ সুন্দর হয়েছো। আবহাওয়া চেঞ্জ হয়েছে বলে কথা! তবে চোখের নিচ দিয়ে ডার্ক সার্কেল দেখা যাচ্ছে! এই রাতে ঘুম হয় না?”
আরেকজন ম্যাডাম হেসে ধীমে সুরে বলল,
-” আরে নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে ঘুম হবে কিভাবে? এমন একটা সুন্দরী কম বয়সী মেয়ে পেয়েছে রাতভর মজে থাকে হয়তো! তাই না পাতা? শুনেছি বয়স্ক লোকেরা কমবয়সী বউকে একটু বেশিই ভালোবাসে। মাথায় তুলে রাখে!”
-” তোমার তো লটারি লেগেছে। বরের সাথে বাচ্চা ফ্রি! আমাদের কথা মনে নিও না কিন্তু ফান করে বলছি!”
মজার ছলে আরো অনেক কথাই বলেছে তার কলিগরা। পাতা মুক হয়ে তাদের কথা শুনে গেছে। ওনারা এমনভাবে কথাগুলো বলল পাতা জবাব দেয়ার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলো না। আড়ালে আবডালেও অনেক কথা হয়েছে তাকে নিয়ে পাতা বুঝতে পারে। লজ্জা অপমানে পাতার চোখ ভরে উঠেছিল। সে ক্লাসের বাহানায় নিস্তার পায় কথার বাণ থেকে। তবে কথাগুলো তার মন মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ। মনটা বিক্ষিপ্ত বিষন্ন হয়ে ওঠে। মানুষ এভাবে কারো মনে আঘাত হেনে কথা বলতে পারে!! তারা কি জানে না, মানুষের মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতে নেই! সমালোচনা,পরগ্লানি করা যা ব্যাক্তির মনকে আঘাত হানে সেইসব নিয়ে মজা উড়ানো আর আপন ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সমতুল্য। এখনও পাতার চোক্ষুদ্বয় আবেগে টইটুম্বুর হতে চায় পাতা পলক ঝাপটে নিজেকে সামলে নেয়। মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। অরুণ ফোন আলাপ শেষ করে পাতার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” কি হয়েছে দুজনের মন খারাপ কেন শুনি?”
পাতা সচকিত দৃষ্টিতে চায় লোকটার দিকে! কি করে বুঝলো তার মনটা খারাপ?
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে পাতার দিকে চেয়ে কন্ঠে আদর ঢেলে বলল,
-” কি হয়েছে পাতাবাহার?”
আদর মিশ্রিত মনমোহন গম্ভীর কণ্ঠে কি ছিল? পাতার মন খারাপের রেশ কর্পূরের মতো উবে যায়। মন প্রসূণে অসংখ্য রঙ বেরঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে। সকালের মিষ্টি মন ভোলানো মূহূর্তেটুকু মানসপটে ভেসে ওঠে যেন। কপোল জোড় রক্তিমতায় আচ্ছাদিত হয়। নেত্রজোড় পলক ফেলে ঘন ঘন। ভোর তার আম্মুর দিকে একবার তাকিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল,
-” আম্মুর মন খারাপ তাই ভোরেরও মুড ওফ!”
পাতা মুচকি হেসে তার গাল টেনে দেয়।
-” তেমন কিছু না। বাচ্চাদের এক্সামের খাতাগুলো কালকেই সাবমিট করতে হবে। কতগুলো খাতা একবেলায় দেখবো কিভাবে!! তাই!’
অরুণ ঝুঁকে আসে। পাতার দুই পাশে সোফার পিছনে হাত রেখে বন্দি করে নিলো। পাতা খানিকটা ঘাবড়ে গেল। চোখের আকার বড় বড় করে সোফার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে অরুণের দিকে তাকায়। ভোরও বড় বড় করে চেয়ে থাকে, ওষ্ঠোদ্বয় হা করে। অরুণ ছেলের দিকে চায় মুচকি হেসে পাতার ললাটে অধর ছুঁয়ে পরপর দুটো ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে নাকে আলতো কামড় বসিয়ে সরে পাতার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো। ভোর খুশি হয়। আব্বু আম্মুকে আদর করলো। তাহলে তো আম্মু আর মন খারাপ করে থাকবে না।সে পোকার মতো পাতার কোল ডিঙিয়ে অরুণের কোলে মাথা রাখলো। পাতার কোলে তার পিঠ ঠেকিয়ে, পা জোড়া সোফায়। অরুণ ঝুঁকে ছেলের মাথা হালকা উঁচিয়ে গালে মুখে ঠোঁটে আদরের বন্যা বইয়ে দিলো।
পাতা নির্বাক বসে। মিষ্টি ভালোবাসার পরশে পাতার তনুমন জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে বেড়ায়। লোকটা এমন কেন? এই ছোট ছোট আদর, যত্ন করে কি বোঝায়? পাতাকে দূর্বল করার স্বৈরতন্ত্র। পাতা বোঝে ষোলো আনা। তবুও দূর্বল হয়ে ওঠে প্রতিক্ষণ। এইরকম আদর যত্ন ছোট ছোট ভালোবাসার বিন্দু কণা পাতাকে লোকটার দিকে আরো আকর্ষিত করে তোরে। দূর্বল করে তোলে। সেই দূর্বলতা আকর্ষণ খুবই ভয়ংকর যা পাতা কিছুটা হলেও ঠাহর করতে পারলো। আবেগী পাতার আঁখি যুগলে আবেগে ভরে ওঠে। আশ্চর্য পাতা আবেগী ছিলো, কিন্তু এতটা? লোকটার সাথে জুড়ে যাওয়ার পর থেকে আবেগটাকি চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়ে চলেছে নাকি? পঁচিশ বছরের জীবনে কত লোকের টিটকারী, কটুক্তি, তাচ্ছিল্যের এমনকি প্রহারেরও স্বীকার হয়েছে মন খারাপ হলেও অন্তঃস্থলে তালা মেরে গচ্ছিত রাখতো!অথচ এখন একটু যত্নেই সব দুঃখ কষ্ট বেরিয়ে আসতে চায়। এতটা আবেগ কখনো আঁখি প্রকাশ করেছে কি? প্রত্যেকবারের মতো কথা এবারো আবেগ লুকিয়ে নেয় পাতা।
-” আব্বু কলিজা ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ!”
-” মি ঠু কলিজা!”
ভোর মিষ্টি করে হাসলো। অরুণ ছেলের চুলে হাত গলিয়ে দেয়। একটু আগেই শত ব্যস্ততা , চিন্তার ভিড়ে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিল। কিন্তু এখন মন মস্তিষ্ক সব যেন ভুলে বসেছে। সে পাতার পিঠে হাত গলিয়ে বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বলল,
-” পাতাবাহার হয়ে যাবে সব কাজ! টেনশন নিও না। আই উইল হেল্প ইয়ু!”
পাতা অধর জুড়ে খেলা করে মিষ্টি হাসি। বাচ্চারা বিনা বাক্যব্যয়ে আইসক্রিম পেলে যেমনটি করে হাসে তেমন।
-” সত্যিই হেল্প করবেন?”
-” না মিছেমিছি হেল্প করবো চলবে না?”
-” একদম না আব্বু।”
ভোরের কথায় দুজন তার দিকে চায়। পাতা হেসে দিল। অরুণ চোখ ছোট ছোট করে গম্ভীর মুখে বলল,
-” পরশু রেজাল্ট তোমার! পাশ করতে পারবে তো?”
ভোরের মুখ খানি কালো হয়ে যায়।
-” পাশ করবো কি না সেটা পরের বিষয় এক্সাম দিয়েছি এটাই মুখ্য বিষয়।”
একদম বড়দের মতো করে বলল ভোর। পাতা হাসে এটা সে ক্লাসে বলেছিল এক্সাম শুরু হওয়ার আগে। বাচ্চাটা মুখস্থ করে রেখেছে। অরুণ সিরিয়াস গলায় বলল,
-” পাশ না করলে বিয়ে করিয়ে দিবো!”
ভোর লজ্জা পায় বেশ। কুটুর কুটুর করে চায় বাবার দিকে। কোল থেকে উঠে পা ভাঁজ করে সোফায় বসে চিল্লিয়ে বলল,
-” ছোট না আমি? ছোটরা কখনো বিয়ে করে? করবো না আমি বিয়ে! কখনো না!! তোমার আব্বুকে বিয়ে করিও যাও!”
তার কথা শুনে অরুণ মুচকি হেসে বলল,
-” আমার আব্বুকেই তো বিয়ে করাবো! তুমিই তো আমার আব্বু!”
ভোর যেন কেঁদে দেবে।
-” তোমার বুড়ো আব্বুকে বিয়ে করাও গিয়ে!”
-” সে তো নেই! তাই তোমাকেই বিয়ে করিয়ে বাড়িতে একটা ছোট্ট লাল টুকটুকে বউমা আনবো।”
ভোর এবার কেঁদেই দিলো। পাতা বাবা ছেলের কথাবার্তায় হেসে কুল কিনারা পায় না। ভোরকে কাঁদতে দেখে অরুণকে বলল,
-” কি শুরু করলেন? বাচ্চাটা কাঁদছে! আর কে বলেছে ভোর পাশ করতে পারবে না? ভোর অনেক ব্রেইনি! ও টেন্থ পজিশনের মধ্যে থাকবে দেখে নিবেন!”
এরমধ্যে কেউ দরজা নক করে। অরুণ উঠে আসে। দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
-” বউমা আনার ব্যাপারে কিন্তু আমি সিরিয়াস পাতাবাহার!”
ভোরের কান্না আরো বেড়ে যায়। এই কান্নায় শুধু আওয়াজ শোনা যাচ্ছে কিন্তু ভোরের চোখে পানির দেখা নেই। ভোর দু হাতে চোখ ডলে তবুও বেড়োয় না এক ফোঁটা নোনাজল। পাতা টেনে তাকে কোলে বসিয়ে এটা ওটা বলে শান্ত করে। ভোর শান্ত হয়। আব্বু আরেকবার বিয়ে করানোর কথা বললে সে কথা বলবে না। এতটুকু ছেলে কখনও বিয়ে করে? তার বুঝি লজ্জা করে না এসব শুনলে!
অরুণ বিরিয়ানীর প্যাকেট ও প্লেট রাখে টি টেবিলে। অফিসের সকল স্টাফদের মিষ্টিমুখ করানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর নিজেদের লাঞ্চের জন্য বিরিয়ানী ও ডেজার্ট অর্ডার করতে বলেছিল ম্যানেজারকে। ছেলেটা চিকেন বিরিয়ানী পছন্দ করে। অরুণ পাতাকে সব আনপ্যাক করতে বলে ছেলেকে কোলে নিয়ে কেবিন সংলগ্ন রুমে ঢুকে ওয়াশ রুমে চলে গেল। ছেলেকে ফ্রেশ করিয়ে এসে সোফায় বসিয়ে দিলো। পাতা ততক্ষণে প্লেটে বিরিয়ানী সাজিয়ে পরিবেশন করেছে। জাপানিজ কটন চিজ কেকটাও একটা প্লেটে রেখেছে। অরুণ তাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে। পাতা ইতস্তত বোধ করে। সে কিছুই চেনে না এখানে। ছোট ভোর কি বুঝলো কে জানে পাতার হাত ধরে নিয়ে যায় ভিতরে। অরুণ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ছেলেটা তার মোটেও অবুঝ নয়। অনেক কিছুই বুঝতে পারে। আর পাতাবাহার? মেয়েটা শান্ত শিষ্ঠ দস্যি মেয়ে। এই মনে হবে তার চেয়ে শান্ত মেয়ে হয়ই না আবার এই মনে হবে চঞ্চলতায় ঘেরা। তর্ক করবে পায়ে পা লাগিয়ে। এক কথায় বলা যায় কিউট! ভোর স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই বলতো তার মিস পাতার কথা! সবাইকে আদর করে! বকে না, মিষ্টি করে কথা বলে! কেউ ঝগড়া করলে বুঝিয়ে বলে! ক্লাসে পড়া না পারলে একটুও বকে না কিন্তু দুষ্টুমি করলে দাঁড় করিয়ে রাখে। আরো কতো কথা! মেয়েটাকে অরুণের ভালোলাগে বেশ। সেই ভালোলাগা কবে ভালোবাসায় রূপ নেবে?
একটু পরেই পাতা ও ভোর এসে সোফায় বসে। অরুণ বিরিয়ানী প্লেট নিজের কাছে টেনে নিয়ে ছোট লোকমা বানিয়ে ছেলের মুখে দেয়। ভোর অন্যদিকে চেয়ে গাল ফুলিয়ে মুখে নেয়। পরের লোকমা অরুণ পাতার মুখের সামনে ধরলো। পাতা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে বাড়িয়ে দেয়া লোকমার দিকে। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে যায় অল্প পরিসরে। অরুণ মুখে বিরিয়ানী পুরে দিলো। ফলাফল স্বরূপ গালে মুখে লেগে যায়। অরুণ মুছেও দিলো। পাতা তার স্মৃতির পাতা ওলট পালট করে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে, বুঝ হওয়ার পর কেউ তাকে এতটা যত্ন সহকারে খাইয়ে দিয়েছিল কি না! কিন্তু কোনো স্মৃতি ক্যাচ করতে পারে না। পাতার চোখ জোড়া আবেগে আপ্লুত হয় না এবার বরং খুশির ঝলকানি দেয়। অন্তঃস্থলের রঙ বেরঙের উড়তে থাকা অসংখ্য প্রজাপতি একই ছন্দপতনের সুরে ডানা ঝাপটিয়ে এক রোমাঞ্চকর তানে নেচে উঠল। অরুণ নিজেও এক লোকমা মুখে পুরে ছেলের মুখে দিয়ে পর্যায়ক্রমে পাতার মুখে দেয়।
-” পর মানুষ নই যে এভাবে আশ্চর্য হবে!”
পাতা বিরিয়ানী চিবোতে চিবোতে জবাব দিলো,
-” তো কি আপন মানুষ?”
অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে চায়।
-” তুমি যেমনটা মনে করো!”
-” আমি মনে করলেই হয়ে যাবে?”
পাতার কথায় অরুণ কিছু বলে কিন্তু পাতা বুঝতে পারে না। লোকটা মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে বলেছে। পাতা পূনরায় সুধায়,
-” কি বললেন বুঝলাম না?”
-” কিছু না!”
পাতার চোখ মুখ কুঁচকে যায়।
-” কিছু তো বলেছেন?”
অরুণ জবাব দেয় না। অগোচরে এলাচসহ বিরিয়ানী পাতার মুখে পুরে দেয়। পাতা অরুণের দিকে সন্দেহ নজরে চেয়ে চিবোতে থাকে। দাঁতের নিচে এলাচ পড়ায় মুখের আকৃতি চেঞ্জ হয়ে আসে। মুখ বিকৃত করে ওয়াশ রুমে চলে যায়। একটু পরে ফিরে এসে অরুণের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
-” মজায় খাচ্ছিলাম সহ্য হচ্ছিল না, না? দিলেন তো মুখটা নষ্ট করে! নাক উঁচু ম্যানারলেস বদ লোক!”
অরুণ স্বভাব সুলভ গম্ভীর গলায় বলল,
-” আমি কি করলাম?”
-” কি করেছেন? সাধু সাজছেন? আমি জানি আপনি ইচ্ছে করেই এলাচ দিয়েছেন!”
-” আমি তো দিই নি! বিরিয়ানী যে রেঁধেছে সেই শেফ দিয়েছে এলাচ! আর এলাচ ছাড়া বিরিয়ানী হয়?”
-” আশ্চর্য আমি বলছি আপনি আমার লোকমায় এলাচ দিয়ে আমার মুখটা নষ্ট করে দিয়েছেন!”
-” ঠিকও করিয়ে দিতে পারি!”
পাতার কপালে ভাঁজ পড়লো। আগ্রহী গলায় সুধায়,
-” কিভাবে?”
-” মিষ্টি মুখ করিয়ে! করাবো?
অরুণের তাৎক্ষণিক প্রশ্ন। পাতা থতমত খেয়ে যায়। তার বেহায়া অশ্লীল মন! হাতজোড় নিয়ে ঠোঁটের উপর রাখলো। যেন এখানেই আক্রমণ হবে। অরুণ বাঁকা হেসে বলল,
-” আশ্চর্য কেকের কথা বলছিলাম আমি!হেইটস ইউর মাইন্ড পাতাবাহার!”
পাতার জবান বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। ইচ্ছে করে ভোরের মতো চিল্লিয়ে কাঁদতে। ওদিকে ভোর কেক খেতে খেতে পিট পিট করে চেয়ে হাসিমুখে আব্বু আম্মুর ঝগড়া দেখছে।
____
গোধূলি লগ্ন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে ধরনীতে। সূর্য মামা অস্তমিত হওয়ার প্রচেষ্টায়। নীল আকাশ হালকা লালীমায় ছেয়ে আছে। সাদা সাদা কালো কালো মেঘের ফালিও সূর্যের লাল আলোয় রঙ্গিন সাজে সেজেছে। গোধূলির আকাশ বিহঙ্গের দখলে। নানা ধরনের বিহঙ্গ দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ আপন নীড়ে ফিরতে ব্যস্ত। আতিকুর ইসলাম কাচারি থেকে বাড়ি ফিরেছে একটু আগেই। গোসল সেরে ড্রয়িং রুমে আসতে লাবনী আক্তারের আকুল কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তাকে উদ্দেশ্য করেই বলল,
-” পাতাকে আনবেন কবে? অনেক দিন তো হয়ে গেল। ওর শশুর বাড়ির লোকেরা কি ভাববে?”
আতিকুর ইসলাম বিরক্ত হয় খানিক। সব সময় একই ঘ্যানর ঘ্যানর! তিনি বিরক্তিকর সুরেই বলল,
-” আনবো বললেই তো আনা হয় না!মেয়ে মেয়ের জামাই আনতে যাবো শুধু মিষ্টি নিয়ে গেলে মানসম্মান থাকবে? এখানে এনে দু তিন দিন রাখতে হবে না? যেমন তেমন খাবার দেওয়া যাবে? মুখে রুচবে জামাইয়ের? তাছাড়া জামাইকে খালি হাতে পাঠিয়ে দেব! কিছু দিতে হবে না? ওদের পরিবারের প্রত্যেককেই দিতে হবে। বড় ঘরের ওরা যেনতেন উপহার দেয়া কেমন দেখাবে? আবার বড় জামাই, লতাকেও আনতে হবে ওদের সাথে। শোন লাবনী রাজার ভান্ডার নেই আমার। সরকারের কামলা খাটি। যা পাই তাতে নিজেদেরই টেনে টুনে চলতে হয়। আনবো বলেছি আনবো। মাস শেষের দিকে। হাতে একটা কানাকড়িও নেই। কিভাবে চলছি আমি জানি। মাস শেষে বেতন পেলে আনবো ওদের। আর ঘ্যান ঘ্যান করবে না। আমার দায়িত্ব আমি ভুলি নি!”
বলেই লুঙ্গির কোনা হাতে পুরে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। হাতে শুধু পাঁচশ টাকা আছে। এ মাস শেষ হতে দু দিন বাকি এখনো। দু’দিনে পাঁচশ টাকায় চলবে? চলবে না চলাতে হবে। সংসার জীবন যতো সহজ আমরা ভাবি আদতে সেটা নয়। পুরোটা ঝামেলায় ভরপুর! একটা ফুরতে না ফুরোতেই আরেকটা শুরু। টাকা পয়সার সমস্যা যার আছে সেই বোঝে সংসার চালানো কতটা কষ্টকর ব্যাপার। যার রাজার হাল আছে সে সুখে থাকলেও যে রাজার রাজত্বে কাজ করে খায় সে বোঝে টাকার মূল্য।
_____
মাগরিবের আজান দেওয়ার সময় হয়েছে। আসমা বেগম রুপকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। ছেলেটা কাঁদছে ‘মা মা’ বলে। মায়ের কাছে যাবে সে। কিছুতেই ভুলিয়ে রাখা যাচ্ছে না। রুবি ব্যাংকে। আরিয়ানটাও নেই বন্ধুদের সাথে ঘোরাঘুরি করছে বোধহয়, আনিকাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে। বাড়িতে সে,পাতা, ভোর ও মিনু। আভারিকে সে বাজারে পাঠিয়েছে। মিনু ও পাতাকে দেখতে পায় না। ‘বড় বউ, মিনু’ বলে কয়েকবার ডাক দিলো কোনো সাড়াশব্দ পেল না তাদের। তিনি বিরক্ত হয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। হঠাৎ কান্নার আওয়াজে পা থেমে যায়। কে কাঁদছে? একটু এগিয়ে যেতেই পরিষ্কার হয়। এতো ভোর! কাঁদছে কেন? তাও এভাবে চিল্লিয়ে হাঁউমাঁউ করে। তিনি ‘ভোর ভোর’ বলে ডেকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে অরুণের ঘরে ঢুকে দেখে ভোর বিছানায় বসে কাঁদছে। সাথে ‘আম্মু আম্মু’ বলে জোড়ে জোড়ে ডাকছে। পাতাকে কোথাও দেখতে পেল না। তিনি এগিয়ে গিয়ে রূপকে বসিয়ে দিলো খাটে। ভোরের কান্না দেখে ছোট্ট রূপের কান্না থেমে গেছে। পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছে সব। ভোর আসমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” ও দাদি আম্মু আম্মু..!!”
কান্নার দরূণ বলতেই পারে না। আসমা বেগম চিন্তিত হয়।
-” কি হয়েছে ভোর? তোমার আম্মু গার্ডেনে বোধহয়! কাঁদে না! বলো দাদিকে?”
ভোর বলতে চায়। কিন্তু ‘আম্মু’ বলার পর গলা দিয়ে আর শব্দ বের হয় না। আসমা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বলে। এরইমধ্যে পাতা দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে। আসমা বেগমকে জড়িয়ে থাকা ক্রন্দনরত ভোরকে দেখে বুকটা ধ্বক করে ওঠে। ওভাবে কাঁদছে কেন ছেলেটা? ভোর পাতাকে দেখেই আসমা বেগমকে ছেঁড়ে ‘আম্মু’ বলে দু হাত বাড়িয়ে দেয়। পাতা তড়িৎ গতিতে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় চুমু খেয়ে আদুরে গলায় বলল,
-” কি হয়েছে বাবা কাঁদছো কেন? ব্যাথা পেয়েছো? বাবা বলো? আম্মুকে বলবে না?”
ভোর কাঁদতেই থাকে। পাতা তার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” বাবা কাঁদে না! বাবা হয়েছে কত কাঁদবে! কেঁদো না!”
বলে চোখমুখ শাড়ির আঁচলে মুছে নাকটাও মুছে দিলো। কপালে গালে ছোট ছোট চুমু দিয়ে আদুরে গলায় শান্ত করলো! ভোর শান্ত হয়ে পাতার বুকে মাথা রেখে ফোপাচ্ছে। পাতা সময় নেয়। ভোর পুরোপুরি শান্ত হয়ে গেলো।
সে একটা খুবই বাজে স্বপ্ন দেখেছে। খুবই বাজে! সে মেরির পেন্সিল ভেঙে ফেলেছিলো তাই মেরি তার আম্মু ও আব্বুকে ডেকে আনে। তারা ভোরকে অনেক বকে! তার আম্মু এগিয়ে আসলে মেরি আম্মুর পেটে ভাঙ্গা পেন্সিলটা ঢুকিয়ে দেয়। তার আম্মু আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়ে। আর কথা বলে না। মেরি, তাহসান, টয়া, রবিন সহ সকলে হাসতে হাসতে বলে ‘তোর মা চলে গেছে ভোর!’ ভাবতেই ভোর আবার ফুঁপিয়ে ওঠে।
পাতা ভোরকে আগলে নিয়ে আদর করে বলল,
-” কি হয়েছে বাবা? বাজে স্বপ্ন দেখেছো?”
ভোরের চোখ জোড়া আবার ভরে ওঠে।
-” না! তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে আম্মু? আমি তোমাকে খুঁজছিলাম!”
-” এই গার্ডেনে ছিলাম! মিনু আপা আর আমি! ওই তো মিনু আপা!”
মিনু ঘরে ঢুকে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” ভোর বাবা কাঁদে কেন?”
ভোর কিছু বলে না। শক্ত করে পাতাকে জড়িয়ে রাখে। আসমা বেগম গম্ভীর গলায় পাতাকে বলল,
-” বড় বউ? ছেলেটাকে এভাবে রেখে কোন কাজ উদ্ধার করতে গিয়েছিলে শুনি? কেঁদে কেঁদে দম বন্ধ হবার যোগার! খেয়াল রাখতে জানো না?”
-” আসলে মা ও ঘুমিয়ে ছিল তাই এই বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করছিলাম! আর হবে না!”
রূপ ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ভোরের গা ধরে উঠে দাঁড়ালো। পাতার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকে ‘মা আম্মা’। সবাই তার দিকে চায়। পাতা এক হাতে তাকে ধরে, পড়ে না যায়। ভোর আড়চোখে সেটা দেখে ঝটকা মেরে সরিয়ে নেয়। রুপ বিছানায় বসে পড়লো হাসতে হাসতে। সাথে সবাই হাসে। ভোরের ঠোঁটের আগায়ও হাসি ফুটে উঠতে চায় কিন্তু রূপের আবার পাতাকে ‘মা আম্মা’ ডাকায় হাসি বন্ধ হয়ে যায়। পাতার গলা জড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
-” আমার আম্মু! তোমার না! তোমার আম্মুর কাছে যাও রূপ!”
রূপ তার কথা শুনে কেঁদে উঠলো পূণরায়। আসমা বেগম তাকে কোলে তুলে নেয়। রূপ হাত পা ছুড়তে থাকে! পাতার দিকে চেয়ে ‘মা আম্মা’ বলে কাঁদতে থাকে! হাত বাড়িয়ে দেয়, তার কাছে যাবে। ভোর চোখ রাঙায় তাকে। পাতা রূপকে নিতে চাইলে ভোর কিছু বলে না। পাতাকে ছেড়ে কম্ফোর্ট দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে পড়লো। মিনু ডাকে শোনে না। পাতা, আসমা বেগম ডাকে তবুও না। এদিকে রূপ কাঁদছে। আসমা বেগম রূপকে নিয়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল,
-” কি হিংসুটে ছেলে তুমি ভোর! রূপ তোমার ভাই হয়! এমন করলে রূপ তোমাকে ভাই ডাকবে না!”
‘না ডাকলো’! তারও ভাই হবে। সে ডাকবে ভোরকে ভাই বলে! হুহ। ভেবে ভোর কম্সোর্ট সরিয়ে উঁকি দেয়। মিনু তার কান্ড দেখে হাসে। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে ছোট ছোট করে চায়। ভোর গাল ফুলিয়ে বলল,
-” আমার আম্মুকে ও কেন মা বলবে? বললে ওর ওই একটা দাঁত ফেলে দেবো!”
পাতা হেসে দিলো। পুরো বাবার কার্বন কপি এই ছেলে! বাবার মতোই হবে হয়তো বড় হয়ে। যেন ছোট্ট অরুণ সরকার!! পাতা বিছানায় বসে ভোরের গাল টেনে দেয়। ভোর মিষ্টি করে হেসে পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো!”
-” ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ আম্মু!”
পাতা হাসে। অরুণ সরকারের মতো কপি করে গম্ভীর গলায় বলল,
-” মি ঠ্যু বাবা!”
মিনু ও ভোর খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো তার বলার ভঙ্গিমা দেখে। পাতা নিজেও হাসলো!
______
শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে রুম জুড়ে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। শুধু ঘূর্ণায়মান ঘড়ির কাঁটার টিক টিক টিক শব্দ। রাতের পোকার ডাক শোনা যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পূর্ণ চাঁদের ম্লান আলো ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্ব। বাদুড়ের পাখা ঝাপটানোর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে। পাতা নিজ ঘরে ভোরের পাশ ঘেঁষে বসে খাতা দেখছে। বিড়াল শাবকটি খাতার উপর শুয়ে পাতাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাকে ছেড়ে দিয়েছে, বকছে না! কাছে ঘেঁষতে দিয়েছে! এতেই যেন সে অবাক!! ভোর হা করে ঘুমিয়ে। ঘরে আর কেউ নেই। ভয়ে পাতার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ঘরে সে, ভোর, আর এই হতচ্ছাড়া বিড়াল! এদিকে রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে।লোকটা এখনো আসছে না কেন? তখন তো বলেছিল তাকে হেল্প করবে খাতা দেখতে। তাই পাতা ধীরে ধীরে কয়েকখানা খাতা দেখে অরুণ সরকারের প্রহর গুনছিলো! অথচ লোকটা ধোঁকা দিলো! এখনো খবর নেই। এখন এতো গুলো খাতা কিভাবে দেখবে সে? খাতার দিকে তাকিয়েই তার কান্না ও ঘুম একসাথে আসছে। কেন যে আলসেমি করে খাতা দেখলো না। গত একবছরে তার সাথে এমনি হয়েছে। খাতা সাবমিট করার আগের দিন লতা আপু,লুব ভাইকে অনুরোধ করে খাতা দেখে দিতে বলতো। তারা পাতাকে বকেঝকে খাতা দেখে দিতো। মা’ও সাহায্য করতো। এখন তো তারা নেই কে উদ্ধার করবে পাতাকে! ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক? যার কিনা খবরও নেই। ফোন দিয়েছিল সে! বলে কি না ‘বিজি আছি! পড়ে কল করছি’ রাগে দুঃখে পাতা নিজেই খাতা দেখতে বসেছে। সারে এগারোটা বাজে। অনেক গুলো খাতাই দেখেছে পাতা। ক্লাস ফোর, ফাইফ, ট্যু এদের গুলো দেখা শেষ নাম্বার তোলাও হয়ে গেছে। শুধু নার্সারি মানে ভোরদের খাতা দেখা বাদ আছে। এগুলো জলদিই হয়ে যাবে। শুধু একটা শীট তাতেই কোশ্শেন তাতেই আনসার! পাতার কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীতে খানিকটা খুশি দেখা মিলে। একটা খাতা দেখা হলেই হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়। পাতা ভয়ে কেঁপে উঠলো। হাত থেকে লাল বল পেন পড়ে যায়। অরুণ সরকারকে ঢুকতে দেখে জানে পানি ফিরে পায়। বুকে থু থু দিয়ে পূনরায় খাতা দেখায় মনোযোগ দিলো। কথা বলবে না লোকটার সাথে। অরুণ স্বভাবসুলভ ঘরে ঢুকে ব্লেজার, কটি, টাই, শু, মুজো খুলে ছুঁড়তে থাকে। শার্টটাও খুলে ছুঁড়ে বলল,
-” উফ! আজ সারাটা দিন ব্যস্ততায় কেটেছে। কলিজা ঘুমিয়েছে?”
-” হুম!”
বলে নিজের কাজে মনোনিবেশ দিলো। অরুণ ঘার ফিরিয়ে পাতার দিকে চায়। গাল ফুলিয়ে খাতা দেখছে। অরুণ ব্যস্ত মস্তিষ্কে উদয় হয় পাতাবাহারের খাতা দেখার কথা। সে হেল্প করবে বলেছিলো! মেয়েটা নিশ্চয়ই অপেক্ষায় ছিলো? অরুণ বিছানায় বসে বলল,
-” অনেক ব্যস্ত ছিলাম অফিসে। চাইলেও আসতে পারছিলাম না!”
-” বুঝতে পেরেছি!”
অরুণের মনটা খারাপ হয়। মেয়েটা অভিমান করে বসে আছে। কিন্তু সত্যিই তার কিছু করার ছিল না। গয়না ডেলিভারী নিয়ে গন্ডগোল বেঁধেছিল। এখনো সল্যুশন হয় নি। ব্যাপারটা পুলিশ অবধি গড়িয়েছে। অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। শরীরটা চলছে না তাঁর! অনেকটা ক্লান্ত সে। খিদেয় পেট চু চু করছে। সে টি শার্ট ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়। গোসল করে বেরিয়ে আসে। মাথায় তোয়ালে চালাতে চালাতে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” খেয়েছো?”
পাতা মাথা উঁচিয়ে চায়।
-” হুম! সবার সাথেই!”
-“ওহ্ আচ্ছা!”
বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মলিন মুখে। আঁকুপাঁকু মনটা কোথাও একটু ভেবেছিল কেউ তার অপেক্ষায় আছে না খেয়ে! কিচেনে ঢুকে ফ্রিজ থেকে রুটি, ভাজি বের করে ওভেনে দিলো। চুলা জ্বালিয়ে একটাতে দুধ গরম ও অন্যটায় কড়াই বসিয়ে তেল দিলো।একটা ডিম বের করে করে অল্প দিয়ে লবণ পোচ করে নিলো। প্লেটে রুটি, ডিম, ভাজি নিয়ে কেবিনেটের উপর বসলো। রুটি ছিঁড়ে যেই না মুখে তুলবে! কেউ ডাকলো! অরুণ খানিকটা হেসে অল্প রুটি ও ডিম ছিঁড়ে কেবিনেটের উপর রেখে বলল,
-” খাও পাতাবাহার! আজ তুমি আর আমি ডিনার করবো একসাথে!”
বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে অরুণের গা ঘেঁষে বসে রুটি, ডিমের টুকরো শুঁকে চাটতে লাগলো! অরুণ মলিন হাসে। বিড়ালটির সাথে টুকটাক কথা বলে খাওয়া শেষ করলো। এঁটো প্লেট ধুয়ে রেখে দিল। একটা গ্লাসে গরম দুধ ঢেলে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো পুরোটা! গ্লাসটা আবার ভরে কিচেনের লাইট অফ করে চলে গেল নিজের ঘরে। পাতাকে আগের মতো কাজ করতে দেখে দুধের গ্লাসটা বাড়িয়ে বলল,
-” দুধটুকু খেয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো! বাকি টুকু আমি করে দিচ্ছি!”
পাতা অরুণের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
-” আমিই পারবো। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না! বলেছেন এই অনেক! আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আপনাকে ক্লান্ত লাগছে!”
অরুণের মেজাজ বিগড়ে যায়। ধমকে বলল,
-” চুপচাপ দুধটুকু খেয়ে ঘুমিয়ে নাও! আর একবার যেন বলতে না হয়। মেজাজ ঠিক নেই!”
পাতা মুখ গোমড়া করে চায়। একে তো কথা দিয়ে কথা রাখে নি। স্যরিটাও বলল না। তার উপর ঝাড়ি দিচ্ছে। পাতা দুধটুকু এক ঢোকে গিলে নিলো। খালি গ্লাস অরুণের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ওমনি শুয়ে পড়লো কম্ফোর্ট জড়িয়ে। অরুণ খাতাগুলো একে একে নিয়ে সোফায় বসলো। পাতা শুয়ে থেকেই অরুণের উদ্দেশ্যে বলল,
-” ভালোভাবে দেখবেন। ভূল যেন না হয়! আর হ্যাঁ দেখা শেষে খাতা সিরিয়াল মোতাবেক গুছিয়ে রাখবেন। পাশের শীটে নাম তুলে নাম্বার তুলতে ভুলবেন না!”
অরুণ শীটটা হাতে নেয়। শুধু রোল লেখা আছে। সে টেবিলের উপর পা তুলে বসে চোখে চশমা পড়ে লাল বল পেন হাতে নিয়ে শুরু করে দিলো খাতা দেখা। ধীরে ধীরে মনোযোগ সহকারে খাতাগুলো দেখে নাম্বার কালেক্ট করে শীটে বসিয়ে দিলো। সব খাতার ভিড়ে ছেলের খাতাটাও চলে আসলো। অরুণ ভালোকরে সবটুকু দেখলো। ভাঙা ভাঙা হাতে ভালোই লিখেছে। শুধু রাইম টা লিখে নি! অরুণ আর সব খাতাগুলোর মতো ছেলের খাতাটাও দেখলো, নাম্বার দিলো! পঞ্চাশের ভিতর ঊনচল্লিশ পেয়েছে সে। যেখানে অধিকাংশ ছেলেমেয়েই পঞ্চাশ ঊনপঞ্চাশ! পঁয়তাল্লিশের নিচে খুব একটা কেউ নেই! হাতেগোনা কয়েকজন। অরুণ সব গুলো খাতা ধৈর্য্য সহকারে দেখলো! সিরিয়াল মোতাবেক গুছিয়ে বেঁধে নিলো। শীটটা তার উপরেই রাখলো। বার বার হামি উঠছে তার। ঘুমে চোখ ছোট ছোট হয়ে এসেছে। মাথাটাও বেশ ধরেছে। অরুণ টাফনীল খেয়েনিলো। ওয়াশ রুম থেকে ফিরে ঘড়ির দিকে চাইলো! প্রায় একটার ঘরে। অরুণ টি শার্ট খুলে ঢিল ছুড়ে বিছানায় যায়। ছেলের কপালে গালে চুমু দিয়ে দুজনের মাঝখানে গা এলিয়ে দিলো। কম্ফোর্ট নেই একটারও শরীরে। অরুণ কম্ফোর্ট গায়ের দেয়ার সময় খেয়াল করলো পাতার পড়ণে শাড়ি। মেয়েটা শাড়ি পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছে!! আর শাড়ির অবস্থাও শোচনীয়! মেয়েলি কায়া উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। আঁচল আঁচলের জায়গায় নেই! অরুণ নজর সরায় না। না নিজ মনের অবাধ্য বেহায়া ইচ্ছেটাকে অপূর্ণ রাখে। এতো কষ্ট করে ক্লান্ত শরীরে এতো গুলো কাজ করে দিয়েছে এটুকু পারিশ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা। আর অরুণ সরকার তার পাওনা আদায় করে নিতে জানে। অরুণ লাইট ওফ করে দিয়ে ঘুমন্ত পাতার দিকে ঝুঁকে আসে। কপালে, গালে চুমু দিয়ে গলায় নামলো! অবাধ্য বেহায়া হাত উদর জুড়ে খেলা করে। পাতা ঘুমের ঘোরেই কেঁপে কেঁপে উঠলো। ঘুমের ঘোর কাটতে নিলে অরুণ থেমে যায়। পিঠে হাত গলিয়ে উঁচুতে তোলে। গলায় বেশ খানিকটা নিচে দন্তপাটি বসিয়ে সরে আসে। ছেলের দিকে ফিরে শয্যায় শায়িত হয়। মিনিটের মাঝেই ঘুমে তলিয়ে যায়। পাতা পিট পিট করে চোখ জোড়া অল্প খুলে কম্ফোর্টে নিজেকে জড়িয়ে সাথে সাথেই ঘুমে কাতর হয়ে পড়ে। পাতার চোখ বুজে যায়। ঘুমের অতল সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে থাকে। আর বিড়াল শাবকটি টি টেবিলের খাতার বান্ডিলের উপর দাঁড়িয়ে। একটু আগের ঘটনার প্রতক্ষ্য সাক্ষী সে।
চলবে……
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৪ ( প্রথম অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
সকাল বেলা। সূর্যিমামা উঁকি দিয়ে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করতে ব্যস্ত। ভোররাতে ধুমছে বৃষ্টি হয়েছে। একেবারে মুষলধারায় ঝমঝমিয়ে। রাস্তাঘাট, গাছপালা সব বৃষ্টির পানিতে ভিজে আছে। জায়গা জায়গায় পানি জমে আছে। সূর্যের আলোয় সেই পানি ঝলকে উঠছে। গাছের পাতার উপর বৃষ্টির ছিটেফোঁটায় সেই আলো পড়ে যেন রামধনুর দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাখির কিচিরমিচির কলতানে মুখরিত বৃষ্টি ভেজা সকাল। সাথে ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর ডাক। সরকার বাড়ির পুকুর থেকে ভেসে আসছে সেই ব্যাঙের ডাক। পাতা ঘুম টা ভেঙে যায়। আস্তে ধীরে চোখ খুলে হামি তোলে। তারপর শান্ত হয়ে শূন্যে চেয়ে থাকে। ব্যাপারটা কি! আজ নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা ডাকার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো? লোকটি কি এখনো ফেরেনি? ভাবনার মাঝেই খেয়াল হয় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে একটু একটু! কেন? পেটের উপর ভারি কিছু অনুভব হয়। ভাবনাতেই গা কেঁপে ওঠে। মন মস্তিষ্ক ঠাহর করতে পারে কিছু। বক্ষস্থল ধ্বক করে ওঠে। লোকটা তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে। আর তার একটা হাত পাতার উদরে ; বৃদ্ধাঙ্গুল নাভিকুন্ডে! বাকি আঙ্গুল? পাতার কান ও কপোল জোড়া গরম হয়ে ওঠে। এসি রূমের ঠান্ডা পরিবেশেও পাতার মরুভূমির রূপ গরম লাগে। পাতা আস্তে ধীরে হাতটা ধরে সরিয়ে দিলো। কম্ফোর্ট সরিয়ে ঝটপট উঠে দৌড়ে ওয়াশরুম চলে যায়। গিয়েই হাঁপাতে থাকে। লোকটা তো আচ্ছা বজ্জাত! পাতা ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। গায়ে এলোমেলো শাড়ি সাথে এলোমেলো চুল। সে প্রত্যেকবার চুল ঝুটি করে ঘুমায় অথচ সকালে উঠে চুল খোলা থাকে। পাতা জানে এটা ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস বজ্জাত লোকটার কাজ! পাতার অধর জুড়ে লজ্জালু হাসি। কপোল জোড়া গরম হয়ে লালিমায় ছেয়ে আছে। আশ্চর্য! পাতু তুই ব্লাশ করছিস? বলেই ঢং করে দু হাতে মুখ ঢাকে। আঙুলের ফাঁকে আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে। হাত সরিয়ে আঁচল ফেলে দিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। হঠাৎ নজরে আসে গলার বেশ খানিকটা নিচে কিছু দাগ। পাতা ব্লাউজের গলাটা টেনে আরেকটু নিচে নামায়।বেশ কিছু জায়গায় নীলচে কালসিটে দাগ।আগে তো ছিলো না? পাতা আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। হালকা ব্যাথাও করছে। মনে হচ্ছে কামড়ের দাগ! কে কামড় দিলো? পাতার আঁখি যুগলের আকার বড় হয় ধীরে ধীরে।
ভোর পিটপিট করে চোখ খুলে। দুই হাতে চোখ ডলতে থাকে, হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ায় আশে পাশে তাকায়। আব্বু কোথায়? আসে নি রাতে? ভাবতেই কান্না পায়। সে উঠে বসলে দেখতে পায় বাবা ঘুমিয়ে আছে। ভোরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে বাবাকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে পেটের উপর বসলো। গালে হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে ডাকলো! অরুণ ঘুমের ঘোরেই হুম বলে। ভোর হেসে বাবার ঠোঁটে চুমু খায়। গালে, কপালে চুমু দিয়ে নাকে শক্ত করে কামড় বসিয়ে দেয়। অরুণ মুখশ্রী বিকৃতি করে চোখ খুলে। ভোর খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সেই প্রাণখোলা মিষ্টি হাসির ফোয়ারা অরুণ শান্ত চোখে দেখে। ইশ! আজকের সকালটা এতো মিষ্টি কেন? অরুণ ভোরকে বুকে টেনে গালে মুখে আদর করে পেটে দাড়িযুক্ত মুখ ঘঁষে দেয়। ভোর কুঁকড়ে যায়, সাথে হেসে কুটিকুটি। অরুণ থামে, বালিশে মাথা এলিয়ে দিল। মাথাটা বেশ ধরেছে। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। সে ফজর ওয়াক্তে উঠেছিল কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছিল দেখে বাড়িতেই নামাজ পড়ে গা এলিয়ে দিয়েছিল! ভোর বাবার মুখের সামনে মুখ এনে জিজ্ঞেস করলো,
-” আব্বু তুমি কখন এসেছো?”
-” রাতেই কলিজা! কাজ ছিল অনেক তাই দেড়ি হয়েছে!”
-” আব্বু তোমার কি মাথা ব্যাথা করছে?”
বাবার কপালে হাত রেখে বলল ভোর। বাবা রাতে দেড়ি করে ফিরলেই তার মাথা ব্যাথা করে। চোখ মুখ ফুলে যায়। অরুণ মাথা নাড়ল। ভোর বাবার কপালে বেশ কয়েকটা চুমু দিলো। বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিন টেবিলের উপর রাখা মুভ এনে হাতের আঙ্গুলে অল্প নিল। অরুণের কপালে ভালোভাবে লাগিয়ে ম্যাসাজ করতে শুরু করলো ছোট হাতজোড়ার সাহায্যে। অরুণের চোখ ছলছল করলো কি খানিকটা?
অরুণ চোখ বুজে ছেলের আদরমাখা যত্নটা লুফে নিলো প্রতিবারের মতো। ভোর চিন্তিত মুখে কপালে ম্যাসাজ করে। আব্বুর নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হচ্ছে! ভোর হুজুরের শেখানো সূরা ফাতিহা পাঠ করে অরুণের কপালে ফুঁ দিয়ে বিড়বিড় করে বলল,
-“আল্লাহ তুমি আব্বুর মাথা ব্যাথা জলদি সারিয়ে দাও!”
অরুণের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। চোখ খুললেই কার্নিশ বেয়ে একফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। ভোর সেটা দেখে কাঁদো কাঁদো গলায় বাবার বাহু টেনে বলল,
-” আব্বু অনেক কষ্ট হচ্ছে? তুমি এখনি ডাক্তার দাদুর কাছে চলো? চলো?”
বলেই নাক টানে। এক্ষুনি কেঁদে দেবে। অরুণ উঠে বসে। ছোট হাতজোড়ায় বেশ কয়েকটা চুমু খায়! ছেলেকে কোলে বসিয়ে গালে ঠোঁট চেপে বলল,
-” আমার কলিজা! মানিক সোনা! ম্যাসাজ করে দিলো, সূরা পড়ে দোয়া করলো এখনো ব্যাথা থাকবে? একদম গায়েব হয়ে গেছে!!”
-” মিথ্যে বলছো না তো?”
-” একদম না মানিক!”
এরইমধ্যে পাতা বেরিয়ে আসে ওয়াশ রুম থেকে। অরুণকে দেখে গলাটা শুকিয়ে গেলো যেন! কান ও গাল দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে মনে হয়! অরুণের হাতের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে । তবে বাবা ছেলেকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে আমতা আমতা করে বলল,
-” কি হয়েছে?”
ভোর কিছু বলে না। বাবার গলা জড়িয়ে চুপটি করে থাকে। অরুণ গম্ভীর গলায় বলল,
-” কি হবে?”
পাতার আচ্ছা ভালো মুড টাই টুস করে ফ্লোরে পড়ে গড়াগড়ি খায়। শালার জামাই! মুখে একটুও রসকস নেই। এভাবে কেউ কথা বলে? মনে হয় ঝাড়ি দিচ্ছে! পাতা গাল ফুলিয়ে ভোরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” ভোর? আসো ব্রাশ করিয়ে দিই! স্কুলে যেতে হবে তো! সারে আটটা বাজে!”
অরুণ ভোরকে নামিয়ে দিলো। সারে আটটা বেজে গেছে!! সে তড়িঘড়ি করে টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে রুমের বাইরে পা বাড়ায়। আরিয়ানের সাথে কথা বলতে হবে! সাথে অফিসেও যেতে হবে জলদি! ভোর পাতার কাছে যায়। আর পাতার ফুলো গাল আরেকটু ফুলে যায়।
_____
ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছেন আসমা বেগম। আরিয়ান ছেলের মুখে ফিটার দিয়ে নিজেও চোখ বুলাচ্ছে খবরের কাগজে। রুবি ঘরে আনিকাকে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ডাকছে। মিনু সকালের রান্নায় ব্যস্ত। আভারি বাগানে। আজ মালি এসেছে বাগান পরিচর্যা করতে। তাকেই সাহায্য করছে। অরুণ ড্রয়িং রুমে এসেই আরিয়ানের পাশে বসে রূপকে কোলে নিলো। আরিয়ানে হাত থেকে ফিটার নিয়ে ভালোভাবে মুখে পুরে দিলো। রূপ ফোকলা দাঁতে ফেসে ফিটার টানতে লাগলো। আরিয়ান যেন মুক্ত স্বাধীন! আহা! বাচ্চা বউ লালন পালন করা এতোটা কষ্টের আগে জানলে চির কুমার থেকে যেতো! কোনো কিছুতেই শান্তি নেই। অরুণ সময় নেয় না। আরিয়ানকে বলল,
-” একটা ঝামেলায় পড়েছি! তোর ফেভার চাই!”
আরিয়ান ভ্রু উঁচিয়ে চায়।
-” ওহ্! তাই তো বলি তুই আজ হঠাৎ সকাল সকাল আমাদের আড্ডায়!”
-” এমনভাবে বলছিস যেন বসি না তোদের সাথে! সে বাদ দে সময় নেই আমার! ঝামেলায় আছি! সাহায্য করবি করবি কিনা বল? নইলে আমারো অ্যাডভোকেটের অভাব নেই!”
আরিয়ান গম্ভীর মুখে বলল,
-” তুই সৎ ভাবতে পারিস! আমি আপনই ভাবি!”
অরুণ গম্ভীর মুখে বলল,
-” সৎ? সেটা তো কথায় কথায় তুই ই মনে করিয়ে দিস! এখনও সেটাই করলি!”
-” ঝামেলা কি সেটা বল? মারামারি?”
-” নাহ্! নতুন ক্লায়েন্ট! নাম আশরাফুল আলম। উত্তরায় বড় শো রুম আছে জুয়েলারির। বেশ কিছু কালেকশন অর্ডার করেছিলো! আমি সব কিছু পরখ করেই ডেলিভারী করেছি তামিমকে দিয়ে। কাল দুপুরে ডেলিভারী দিয়েছে! সব ঠিকঠাক! বিকেলে হঠাৎ ফোন করে বলল চার জোড়া এয়ারিং নকল! এই নিয়ে অনেক কাহিনী! আমি গিয়ে দেখেছি রিং গুলোর ডিজাইন একই শুধু ওগুলো নকল! সবাই তামিমের দিকে আঙুল তুলছে। বেচারা কেঁদে অস্থির; বলছে সে এসবের কিছুই জানে না।যেমন আমি দিয়েছি তেমনি ডেলিভারী করেছে। আর আজ কি সে নতুন ডেলিভারি দিচ্ছে? দশবছর হবে কাজ করছে। বিশ্বস্তই! আমি দেখলাম যা হবার হয়েছে মি. আলমের সঙ্গে কথা বলে এক্সচেঞ্জ করে মিটমিট করে নি। লস গেলে কি করার! কিন্তু লোকটা আরেক জোচ্চর! সে মিটমাটে আসবে না। তার কোন শালা নাকি কমিশনার! কেস করবে কম্পানির নামে! হুমকিও দিয়েছে!! ওর হুমকিতে আমি অরুণ সরকার ভয় পাই না! বাট ইমেজের একটা ব্যাপার আছে। এতো বছরের ব্যবসা! সবাই চোরের তকমা না লাগায়!”
আরিয়ান সব মনোযোগ দিয়ে শোনে। আসমা বেগম খবরের কাগজ রেখে ওদের দিকেই চেয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে! ততক্ষণে রুবিও আলোচনায় হাজির! আরিয়ান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
-” আই থিংক! তামিম ইনোসেন্ট! এতো বছর ধরে কাজ করে কখনো এদিক সেদিক হয় নি!আর যেখানে এটা নরমাল ব্যাপার যে কোনো এদিক সেদিক হলেই তামিমের উপর আঙুল উঠবে! সো সে এরকম বোকামি করবে না! আর নকল গয়না বানানোর জন্য ডিজাইন জানতে হবে! মনে হচ্ছে সামথিং ইজ ফিসি ! মি. আলম ফাঁসানোর জন্য এমন করে নিতো? হতেও পারে! ওর সাথে আমাদের কম্পানির কোনো লিঙ্ক?”
অরুণ চিন্তায় পড়ে।
-” আপাদত মনে হচ্ছে না। তবে খোঁজ লাগাই! তুই আজ কোর্টে যাচ্ছিস না! আমার সাথে যাচ্ছিস! জলদি রেডি হয়ে নে!”
আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়লো!
-” কোথায় যাচ্ছি?”
-” গেলেই দেখতে পাবি! ফাস্ট রেডি হয়ে নি!”
বলে রূপকে রুবির কাছে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। ঘরে ঢুকে দেখল পাতা ভোরের হাত মুখে লোশন মাখিয়ে দিচ্ছে। অরুণ কিছু বলল না। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। পাতা আড়চোখে দেখলো সবটা! এর আবার কি হলো? রাত থেকেই কেমন অদ্ভুত বিহেব করছে! পাতা ভোরকে স্কুল ড্রেস পড়িয়ে দিলো! সম্পূর্ণই রেডি শুধু টাই বাঁধা বাকি! পাতা কয়েকবার চেষ্টা করে পারেনা। মিনিট পাঁচেক বাদে অরুণ বেড়িয়ে আসে। গোসল করেনি শুধু চেঞ্জ করেছে। এসে চুপচাপ গম্ভীর মুখে ছেলের টাই বেঁধে দিলো! নিজেও সাদা শার্টটা গায়ে জড়িয়ে, কালো শু পড়ে! আয়নার সামনে দাঁড়ালো! তারপর বেল্ট পড়ে শার্ট ইন করে চুল সেট করলো! পারফিউমও লাগিয়ে নিলো। পাতা হা করে তাকিয়ে অরুণের দিকে। এরকম হিরো বেশে কোথায় যাবে? সাদা শার্ট ও কালো জিন্সে পুরাই জোস লাগছে লোকটাকে; যদিও কানের পিঠের কিছু কিছু পাকা চুল উঁকি দিচ্ছে! তবুও লোকটাকে হেব্বি লাগছে! টপাটপ কয়েকটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে। পাতা কয়েকদফা ক্রাশ খেয়ে ফেললো! কিন্তু এভাবে রাস্তায় বেরোলে তো সবাই পাতার জামাইকে চোখ দিয়েই গিলে খাবে! পাতার আরেকটা ইচ্ছে হয়! রূপের মতো লোকটার কপালের এক পাশে কালো নজরকাড়া টিপ পড়িয়ে দিতে। যেন কোন বদ মেয়েদের নজর না লাগে!
অরুণ হাতে ঘড়ি পড়ে ছেলের সামনে যায়! কোলে তুলে আদর করে বলল,
-” কলিজা রঞ্জু তোমাদের নিয়ে যাবে স্কুলে! আমার একটা দরকারি কাজ আছে।ব্যস্ত থাকবো সারাদিন! ফিরতেও দেড়ি হতে পারে! সাবধানে থাকবে। আব্বু! মোটেও ছোটাছুটি করবে না। দুষ্টুমি তো নয়ই! আম্মুর সাথে সাথে থাকবে। তার কথার অবাধ্য হবে না। ঠিকাছে মানিক সোনা?”
ভোরের মন খারাপ হলেও মাথা নাড়ে। অরুণ আবার ছেলেকে আদরে ভরিয়ে তোলে। কপালে চুমু দিয়ে বিছানায় নামিয়ে দিলো! পাতার মনটা খারাপ হয়ে যায়। লোকটা কোথায় ব্যস্ত থাকবে? কখন আসবে? গত দিনের মতো রাত করে আসবে? অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে ড্রেসিন টেবিল থেকে মোবাইল পকেটে পুরে পাতার গাল জোড়ায় হাত রেখে কপালে চুমু খায় ঠোঁট চেপে! পাতার গোমড়া মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাথে সাথেই! অরুণ সরে আসে কালো ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে বলল,
-” সাবধানে থাকবে!আসছি পাতাবাহার! আসছি আব্বু!”
বলেই চলে যায় অরুণ! পাতা ভোর গোমড়া মুখে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
________
চলবে….
#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৪ ( শেষ অংশ)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
মেঘলা আকাশ মেঘলা দিন! পরিবেশ কেমন যেন থমথমে! ঝড়ো এলোমেলো বাতাসে গাছপালা মড়মড় করে দুলছে।পাখির দল ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই কারেন্টের পোল, তারে একে একে বসছে মিনিটের জন্য আবার ডানা ঝাপটে দৌড়ে কোনো দোকানে বসছে। আবার এলোমেলো উড়ে স্কুলের কৃষ্ণচূড়ার ডালে ডালে বসে কিচিরমিচির শব্দে হৈচৈ মাতিয়ে রেখেছে। স্কুলের পরিবেশটাও আজকে হইহুল্লোড়ে ভরপুর। স্কুলে স্টুডেন্টের উপস্থিতি ঢের সাথে গার্ডিয়ান! হবে না কেন আজ ফাস্ট টার্মিনালের রেজাল্ট দিবে! অডিটরিয়াম পুরো হাউসফুল! বাচ্চাসহ গার্ডিয়ানে ভরপুর! ইয়াং ক্লাস টিচার্সরা সবাই স্টেজে দাঁড়িয়ে! প্রিন্সিপাল ম্যাম সহ আরো সিনিয়ার টিচাররা অডিটরিয়ামের সামনের সারিতে ভি আই পি সিটে বসে আছে। মাত্রই শুরু হবে ফলাফল ঘোষণার কার্যক্রম! আজকের অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আছে সৈয়দ! মিষ্টি ভাষী মজার স্যার মজার মজার কথা বলে পুরো অডিটোরিয়াম মেতে রেখেছে! সকলেই হাসিমুখে, কেউ বোর ফিল করছে না বোধহয়! প্রতিটি সেকশনের জন্য সিট মার্ক করে রাখা হয়েছে। প্লে ও নার্সারির বাচ্চারা সামনের সারিতে! তারপর ওয়ান, ট্যু! এরপর ক্রমান্বয়ে থ্রি, ফোর, ফাইভ, সিক্স, সেভেন, এইটের ছেলে মেয়ে! প্লে, নার্সারি, ওয়ানের সকল বাচ্চার সাথেই গার্ডিয়ান উপস্থিত! ট্যু থেকে এইটের ছেলে মেয়েদের সাথে হাতেগোনা কয়েকজন গার্ডিয়ান এসেছে। বিশাল বড় অডিটোরিয়ামে ছাত্র-ছাত্রী ও গার্ডিয়ানের সমাগমে গমগম শব্দ হচ্ছে। ভোর সামনে সারিতে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। মুখশ্রী মোটেও স্বাভাবিক নয়! গম্ভীর ও ছলছলে! তার যথা উপযুক্ত কারণ আছে বটে। তার ক্লাসের সকলের বাবা অথবা মা এসেছে। অনেকের বাবা মা দুজনেই এসেছে। তার পাশে রোহানের আম্মু, রোহান। ভোরের সাথে কেউ আসে নি! গতরাতে সে ঘুমানোর পর আব্বু এসেছিল বোধহয়! সকালে উঠে সে অনেকবার বলেছিল আব্বু যেন আজ তার সাথে স্কুলে থাকে! আব্বু রাজি হয় না। তার নাকি গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে আসতে পারবে না। আর আম্মু তো যাচ্ছেই। ভোর মেনে নিয়েছিল! আম্মু তো আছেই! কিন্তু এখানে তো আম্মু নেই। আম্মু সব টিচার্সদের সাথে টিচার হিসেবে আছে। ভোরের আম্মু হয়ে না। তার সব সহপাঠীরা বাবা মায়ের সাথে কতো মজা করছে! আর সে একা একা বসে আছে। কেউ তার সাথে কথা বলছে না। এমনকি রোহানও না! সে তো তার মা’কে পেয়ে বন্ধুকে ভুলেই গেছে! আইসক্রিমটাও একা একা খেলো! তাকে সাধলোও না। সাধলে সে কি খেতো নাকি!! ভোর গম্ভীর মুখে সামনে পাতার দিকে অভিমানী চোখে চেয়ে থাকে! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফলাফল ঘোষণা শুরু হয় পর্যায়ক্রমে। প্রথমে প্লের বাচ্চাদের ক্লাসটিচার তাদের রেজাল্ট দিলো! মেধাতালিকার দশজনের নাম ডেকে এরপর শুধু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দের নাম ঘোষণা করলো! প্লের বাচ্চাদের পর নার্সারির । রোহানের আম্মু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে। তার বিশ্বাস রোহান ফার্স্ট হবে। কিন্তু তার আশায় পানি ঢেলে রোহান সেকেন্ড আসে।ফাস্ট গার্লের সাথে তার দুই মার্কের তফাৎ! রোহান ভয় ভয় চোখে মায়ের দিকে চায়। রোহানের আম্মু চোখ রাঙায় ছেলেকে। চাপা স্বরে গোটাকয়েক ধমক লাগায়! বকতে শুরু করে নিচু স্বরে। রোহান ধমক শুনে কাঁচুমাচু মুখে ভোরের দিকে চায়। ভোরও অসহায় মুখে তার দিকেই চেয়ে। বেচারা সেকেন্ড হয়েছে তাই বকা শুনছে সে তো মনে হয় পাশটাও করতে পারবে না। আব্বু বলেছে পাশ না করলে বিয়ে করিয়ে দিবে!! আর সে বিয়ে করতে চায় না। সে বাবার মতো বড় হতে চায়!
রোহানের আম্মু রোহানকে ধমকের সুরে ধীরে বলল,
-” মানুষের দিনে দিনে উন্নতি হয়। অথচ তোমার অবনতি হচ্ছে! আর হবে নাই বা কেন? সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে! মানুষ সবসময় নিজের চেয়ে ভালো গুড স্টুডেন্টদের সাথে বন্ধুত্ব করে আর তুমি? তোমার বন্ধু? সেতো দশের ভিতরেও নেই! আদৌ পাশ করবে কি না! ওর না পড়লেও চলবে ওর বাবা ব্যবসায়ী! বড় হয়ে বাবার ব্যবসা সামলাবে কিন্তু তুই কি করবি? এরপর থেকে ওর সাথে মেশা তো দূরে থাক কথা বললেও তোর খবর আছে! তাহসান, মোহন ওদের সাথে থাকবি!”
ধীরে আওয়াজে বলেছে। তবে ভোরের কানেও যেন যায় সেভাবেই বলেছে। ভোরও ভালোভাবেই শুনতে পেয়েছে। তার গম্ভীর মুখশ্রী যেন আরো গম্ভীর হয়ে গেলো। যেন এ অরুণ সরকারের অবিকল কার্বন কপি! ভোর আস্তে করে সিট থেকে উঠে অডিটোরিয়ামের কোনায় বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। তার জন্য রোহান যেন আর বকা না শোনে। সে মিশবে না আর রোহানের সাথে কথাও বলবে না।
পাতা স্টেজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে একা না তার সব কলিগরাই উপস্থিত আছে। পাতা ক্লাস থ্রির স্টুডেন্টসদের ফলাফল ঘোষণা করবে। তার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। নইলে সে ভোরের কাছে থাকতো! ছেলেটা গোমড়া মুখে বসে আছে। পাতা ভোরের রেজাল্ট আগেই দেখেছে। র ্যাংকিয়ে বাইশ! পাতা ভেবেছিলো দশের মধ্যে থাকবে। এখন নেই এতে তো আর কিছু করার নেই! সৈয়দ তার নাম ডাকলে পাতা রেজাল্ট শীট নিয়ে সামনে গেলো। সালাম জানিয়ে ধীরে ধীরে রেজাল্ট বলতে শুরু করলো!
ভোর গাল ফুলিয়ে পাতার দিকে তাকিয়ে। এখনো দাঁড়িয়ে। প্রিন্সিপাল সাবরিনা সাবিনা লক্ষ্য করছিল বেশ কিছু সময় ধরে। ওখানে ওভাবে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ডাকে ওকে। ভোর প্রথমে বুঝতে না পারলেও পড়ে বুঝতে পারে তাকেই ডাকছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায়। সাবরিনা ভোরকে পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-” ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলিস কেন? একদম বাপের মতো মুখ বানিয়ে!”
-” এমনি ম্যাম!”
-” রেজাল্ট ভালো হয় নি বলে মন খারাপ? অরুণ বকবে?”
-” না ম্যাম!”
সাবরিনা চৌধুরী ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকলেট বক্স বের করে ভোরের হাতে দিলো। ভোর লজ্জা পেল খানিক; না করবে তখন সাবরিনা বলল,
-” না করলে বকে দেবো! আর নানু হই তোর! নানু ডাকতে পারিস না?”
ভোর কাঁচুমাচু করে। সাবরিনা হেসে বলল,
-” অরুণ মানা করেছে?”
ভোর মানা করে, বলে নি। সাবরিনা চৌধুরী ভোরের কপালে চুমু খায়! এবার ভোর লজ্জায় শেষ! মিনমিন গলায় বলল,
-” আসি ম্যাম!”
বলেই আর অপেক্ষা করে না। একপ্রকার ছুটেই চলে যায়। অডিটরিয়াম থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে যায়। কলেজের একপাশে বটগাছের নিচে শান বাঁধানো জায়গায় বসলো। নিত্যদিনের মতো আজ স্কুল ড্রেসে নেই। হাফ প্যান্টের সাথে হাফ হাতার ব্লু কালারের শার্ট মাথায় ক্যাপ পরা। একাই বসে থাকে। স্কুলের আঙিনায় এখন খুব একটা মানুষ জন নেই। কিছু ঝালমুড়ি ওয়ালা, হাওয়াই মিঠাই, কুলফি আইসক্রিম ওয়ালা আরো কিছু লোকজন। কুলফি আইসক্রিম দেখে ভোরের লোভ হয়। পকেট ফাঁকা থাকায় খাওয়া হয় না। চকলেট বক্স খুলে একটা ক্যাডবেরি ছিঁড়ে মুখে নেয়। চিবোতে চিবোতে সামনে দেখে একটা পাগল দাঁড়িয়ে, ছেঁড়া ময়লা কাপড় গায়ে। ভোর চেনে, তাদের স্কুলেই থাকে। একটু ভয় পেলো সে! উঠে দৌড় লাগাবে। তখনি লক্ষ্য করে পাগলটা তার চকলেটের দিকে চেয়ে! ভোর আর দৌড়ায় না। পাগলটিকে জিজ্ঞেস করলো,
-” খাবে?”
পাগলটি ময়লা দাঁতে হি হি করে হেসে মাথা নাড়ল খাবে! ভোর তার হাসিতে ভয় পায় খানিক। কিছু ক্যাডবেরি পকেটে রেখে পাগলটির দিকে বাড়িয়ে দিলে পাগলটি খপ করে ধরে নেয়। ভোর ভয় পেয়ে দৌড় লাগায় মাঠ বরাবর! দৌড়ে অডিটরিয়ামের সামনে গিয়ে হাঁপাতে থাকে। কিছুসময় দাঁড়িয়ে থাকলে দেখতে পায় পাতা বেড়িয়ে আসছে। ভোর পিটপিট করে তার দিকে চায়!
পাতা এগিয়ে আসে ভোরকে দেখে। পুরো অডিটরিয়াম খুঁজে সে হয়রান! ভয় পেয়ে গিয়েছিল ছেলেটা কোথায় চলে গেলো! রোহানও বলতে পারে নি! এক স্টুডেন্ট বলল বাইরে যেতে দেখেছে তাই তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে। ভয় পেয়ে গিয়েছিল! পাতা এগিয়ে আসতেই ভোর ছোট বাচ্চার মতো দুই হাত বাড়িয়ে দেয় কোলে নেয়ার জন্য! পাতা কোলে তুলে নিলে ভোর তার গালে চুমু দিয়ে বলল,
-” আম্মু বাড়ি যাবো! আব্বুর সাথে কথা বলবো! আব্বুকে ফোন করো না!”
পাতা উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
-” কি হয়েছে ভোর? যাবো তো বাড়ি! তোমার আব্বুর সাথেও কথা বলিয়ে দিবো! আগে বলো কোথায় ছিলে তুমি? কত খুঁজছিলাম আমি তোমায়! ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”
ভোরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
-” ওখানে বসে বোর হচ্ছিলাম তাই ওই গাছতলায় বসেছিলাম! ওখানে পাগল দেখে দৌড়ে এসেছি!”
পাতা ভোরকে নিয়ে অডিটরিয়ামের ভিতরে যায়!
-” তোমার কি রেজাল্ট দেখে মন খারাপ?”
ভোর জানেই না তার কি রেজাল্ট! শোনেই নি!
-” আমি জানিই না!”
-” পাশ করেছেন আব্বাজান! বিয়ে করতে হবে না।”
ভোর খুশি হয় খানিকটা।
-” আব্বুর সাথে কথা বলবো! ফোন দাও না আম্মু?”
-” হ্যাঁ দেব সোনা। তুমি না বাড়ি যেতে চাইলে? প্রিন্সিপাল ম্যামের থেকে পারমিশন নিয়ে চলে যাবো!”
পাতা ভোরকে কোলে নিয়ে প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে যায়। বাড়ি যাওয়ার পারমিশন চাইলে বিনা বাক্যব্যয়ে পারমিশন দেয়। দিবে না কেন ভাগিনা বধু বলে কথা! তবে পাতাকে বলল,
-” বাচ্চাটার খেয়াল রেখো! পড়াশোনার দিকে ভালোভাবে নজর দিবে নেক্সট এক্সামে যেন ফাস্ট হয়! কিরে ফাস্ট হবি না?”
ভোর আগেই মুখ লুকিয়ে রেখেছে পাতার ওড়নায়। ওনার কথায় আরেকটু লুকিয়ে যায়। কথা বলে না। পাতা হেসে প্রিন্সিপাল ম্যামের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায়! টিচার্স রুম থেকে নিজের ব্যাগটা নিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটতে থাকে। রঞ্জু ড্রাইভারের নাম্বারে কল করে গাড়ি আনতে বলে। ভোর কুলফি খাওয়ার বায়না করলো। পাতা দুটো কুলফি কেনে। একটা ভোরকে দিয়ে অপরটা নিজের কাছেই রাখে। তবে খায় না। তার খাওয়ার মুড নেই! গত দিনের মতো আজকেও সবার হাসি তামাশার খোরাক হয়েছে! তাই তো বাড়ি যাওয়ার তাড়া। ভোর অল্প সময়ে কুলফি শেষ করে আবদার জুড়ে, আরেকটা খাবে! পাতা নিজের হাতেরটা বাড়িয়ে বলল,
-” এটা খাও! আমি খাই নি! তবে এটাই লাস্ট! দুটো খেয়েছো জানলে তোমার নাক উঁচু আব্বু আমার নাকটাই কেটে দিবে!”
ভোর হাতে নিয়ে পাতার মুখের সামনে ধরে। পাতা মুচকি হেসে একটু মুখে নিল। ভোর পরপর কুলফি মুখে নিয়ে বলল,
-” আব্বুর নাক মোটেও উঁচু না! তুমি সবসময় বলো! আমার আব্বুর নাক সব থেকে পার্ফেক্ট! হুম!”
-” আচ্ছা? উঁচু না! তোমার আব্বুর নাক বোচা!”
পাতা হেসে ভোরের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল! ভোর বলল,
-” বোচা আবার কি?”
-” তোমার আব্বুর নাক!”
ভোর গাল ফুলিয়ে হাঁটতে থাকে। পাতা ফোন বের করে অরুণের নাম্বারে কল দিলো! রিং বাজলো তবে রিসিভ হলো না। কেটে দিলো। একটু পরে আবার কল এলো। পাতা রিসিভ করে বলল,
-” সবসময় কল কেটে দিয়ে ব্যাক করে কি প্রমাণ করতে চান যে আমার ফোনে ব্যালেন্স থাকে না? রিসিভ করলে কি হয়?”
ওপাশে অরুণ থমথমে মুখে। মেজাজটা তার বেশ গরম! ঝগড়ার মুড না ফাইটিং মুডে সে। মি. আলম কেস করেছেন। তামিম আপাদত পুলিশের হেফাজতে। আরিয়ান অবশ্য তার জামিনের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আসল কথা হলো জলটা ঘোলা হয়েছে বলে কি সে শিং ধরতে পারবে না? ওরা অরুণ সরকারকে জানে না! অরুণ নিজেকে শান্ত করে পাতার কথার জবাবে বলে,
-” পাতাবাহার ফাও কথার মুড সময় একটাও নেই! দরকারি কথা থাকলে বলো নইলে রাখছি! আই এম বিজি নাও!”
পাতা ভেংচি কাটলো। আসছে ব্যস্ত মানব!
-” ভোরের রেজাল্ট বেরিয়েছে! র ্যাংকিংয়ে বাইশ! দেখুন বকবেন না আমার ছেলেকে! ওতটাও খারাপ করে নি।”
অরুণ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,
-” ওর কাছে দাও?”
-” দিচ্ছি। আপনার সাথেই কথা বলার জন্য উতলা হয়ে আছে!”
বলে ভোরের কাছে দিলো! ভোর ফোন কানে ঠেকিয়ে ডাকলো,
-” আব্বু!”
অরুণ ক্ষিপ্ত মেজাজ ঠান্ডা হলো কি!!
-” কনগ্রেটস কলিজা!”
ভোরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
-” থ্যাংক ইয়ু আব্বু! আমি নেক্সট এক্সামে অনেক ভালো করবো দেখে নিও?”
-” ইনশাল্লাহ আব্বু! মন খারাপ করবে না। কেমন? আমার কলিজাকে হাসিখুশিই ভালো লাগে!”
-” আব্বু তুমি জলদি আসো! আই মিস ইয়ু!”
-” একটু কাজ আছে মানিক সোনা! কাজ শেষ করে জলদি চলে আসবো! তুমি সাবধানে থেকো! আর তোমার আম্মুর খেয়াল রেখো! রাখছি আচ্ছা?”
-” হুম!”
বলেই কেটে দিল ভোর। অরুণ চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো! মেজাজটা একটু কন্ট্রোলে এসেছে। এখন মি. আলমের হচ্ছে! অরুণ সরকারের সাথে লাগতে আসার ফল তো ভোগ করতেই হবে। এমন হাল করে ছাড়বে যে আয়নায় নিজের চেহারাটি দেখতে লজ্জায় পড়ে যাবে!!
ভোর ফোনটা পাতার কাছে দেয় না। নিজের পকেটে পুরে হাঁটতে শুরু করল। পাতা তার পিছু পিছু। বাপকে বোচা বলেছে বলে ছেলে গাল ফুলিয়ে আছে। এতো বাপ পাগল ছেলে হয়? গেইট পেরিয়ে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়ালো দুজন। পাতা ভোরের হাত ধরে আছে শক্ত করে। ভোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে। পাতা আড়চোখে ছেলের গম্ভীর মুখশ্রী দেখে নিলো। সামনে ঝালমুড়ি ওয়ালাকে দেখে বলল,
-” ঝাড়মুড়ি খাবে ভোর?”
ভোর পাতার দিকে চায়। ঝালমুড়ি অনেক ঝাল হয়। একবার সে বাবার কাছে জেদ ধরে ঝালমুড়ি খেয়েছিলো! ঝালে তার মুখ মনে হয় জ্বলে যাচ্ছিলো!
পাতা ভোরের উত্তরের আশা করে না। বিশ টাকার ঝালমুড়ি নিলো তবে ঝাল দিতে মানা করলো! তবুও যদি ঝাল লাগে তাই দুটো হাওয়াই মিঠাই কিনলো! রঞ্জু গাড়ি নিয়ে এলে দু জন গাড়িতে উঠে বসলো! রঞ্জু বলল,
-” দেড়ির জন্য স্যরি ম্যাডাম! আপনি বলেছিলেন দেড়ি হবে দেড়টার মতো লাগবে তাই..”
-” আরে না স্যরি বলতে হবে না। দেড়ি হতো ভোর বাড়ি যাবে বলল তাই জলদি চলে এলাম!”
হাসিমুখে বলে পাতা! রঞ্জু প্রতিত্তেরে মুচকি হেসে গাড়ি স্টার্ট করে। ভোর বলে উঠলো,
-” আঙ্কেল? আব্বুর অফিসে চলো! আব্বুর কাছে যাবো!”
রঞ্জু মিররে ভোরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলল,
-” ভোর বাবা! আজ অফিসে যাওয়া যাবে না। স্যার অনেক ব্যস্ত আছে। আজ বাড়ি যাবো!”
-” প্লিজ?”
অনুরোধ করে ভোর। পাতা তার গাল টিপে বলল,
-” বিকেলে তোমার হুজুর আসবে! আরবি পড়তে হবে না? আর তোমার ওই টুম্পা মিস আসে না কেন?”
-” আব্বু বলল মিস আর আসবে না!”
মন খারাপ করে বলল ভোর! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। আসবে না কেন? আর লোকটা তাকে বলল না কেন?
-” কেন আসবে না?”
-” মিসের নাকি স্টাডি আছে অনেক! তাই!”
পাতার অধর যুগলে কিশোরীদের মতো হাসি ফুটে উঠলো। কেন আসবে না এটা বিষয় না! আসবে না এটাই মুখ্য বিষয়। অমন সুন্দরী মেয়ের আসারও দরকার নেই। তার জামাইয়ের সামনে অমন হুর পরী ঘুর ঘুর করবে আর সে জ্বলবে? কদাপি নেহি! তার মনটা কেন জানি ফুরফুরে হয়ে উঠলো! এ কেমন ছেলেমানুষী মন!!
পাতা ঝালমুড়ির ঠোঙা খুলে ভোরকে দিলো!
ভোর ঝালমুড়ির দিকে চেয়ে বলল,
-” যদি ঝাল লাগে?”
-” আরে ঝালই দেয় নি! খাও অনেক মজা! আমি কত খেয়েছি!”
বলেই অল্প ঝালমুড়ি ভোরের মুখে দিলো। ভোর মজা পেলো। এটা তো বেশি ঝাল না। একটু একটু ঝাল; আর ভালো লাগছে খেতে। সে আবার হা করে; পাতা তার মুখে দিলো! নিজেও খেলো! একটু পর পাতা খেয়াল করলো ভোরের ঠোঁট গালজোড়া লাল টকটকে হয়ে গেছে। ঝাল লাগছে কি?
সে পানি দিলো। ভোর ঢকঢক করে খেলো।
-” ঝাল লাগছিলো বলবে না?”
-” বেশি না আম্মু একটু একটু!”
পাতা হাওয়াই মিঠাইয়ের ঠোঙা ছিঁড়ে দিলে ভোর খেলো।
-” ঝাল কমেছে?”
ভোর পাতার গলা জড়িয়ে কোলে বসে গালে চুমু দিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,
-” না! একটা কোন আইসক্রিম খেলেই কমে যাবে!”
পাতা ছোট ছোট করে চায়। ভোর মিষ্টি হেসে পাতাকে আম্মু বলেই যেন বশ করে নিলো! এরকম মিষ্টি করে আবদার করলে মানা করা যায়? পাতা তো করতে পারে না। ভোর পাতার মিষ্টি মেলাবন্ধনে পরিবেশ মুখরিত। দুজনেই ভুলে যায় তাদের মন খারাপী! একে অপরের মন খারাপ হাওয়ায় মিলিয়ে দুজনে মেতে ওঠে।ভোর মিষ্টি মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে নানা গল্প বলে! তার গল্প শেষ হয় না। আর পাতা তাকে উৎসাহ জানিয়ে মনোযোগ সহকারে প্রত্যেকটা কথা গুরুত্ব সহকারে শোনে। বরবরই পাতা একজন ভালো ধৈর্যশীল শ্রোতা! আর এরকম মিষ্টি মুখ করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললে সে সর্বক্ষণ শুনতে রাজি! দুটো পরিবারের মাঝে থেকেও তার এত বছরের একাকিত্ব অনুভব ঘুচিয়ে দিতে সক্ষম এই মিষ্টি মিষ্টি গল্প। এক দুটো কথার ফুলঝুরি শুরু হয়ে বিশাল উপন্যাস হয়েও তাদের মিষ্টি গল্প ফুরোয় না। অসমাপ্তই রয়ে যায়!
_____
রাতের বেলা! গোধূলির লগ্ন শেষ হয়ে ধরনী জুড়ে তিমিরের খেলা। মেঘলা আকাশ জুড়ে ঝিরিঝিরি বর্ষণ হচ্ছে। ঠান্ডা আবহাওয়ায়! মাঝে মাঝে ক্ষীণ সুরে মেঘের গর্জন শোনা যায়। আনিকা ও ভোর সোফায় বসে ফোনে ‘বাবল স্যুটার’ গেম খেলছে আলাদা আলাদা ফোনে। দুজনে নিজেদের মধ্যকার হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত।আর বড়রা ব্যস্ত চিন্তায়! অরুণ আরিয়ান এখনো বাড়ি ফিরেনি। এদিকে অফিসে ঝামেলা! কি যে হলো? আর পাতার চিন্তার কারণ ভিন্ন। সে এখনো অফিসের ঝামেলার কথা জানেই না। সে তো অরুণের চিন্তায়। লোকটা এখনো আসছে না কেন? বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। রাতও কম হলো না। দশটা বাজতে চললো। এদিকে ভোর একটু পর পর আব্বু আব্বু করছে। খাচ্ছেও না। বলছে আব্বু আসলে খাবো! পাতা প্লেটে গরম ভাত ও বড় রুই মাছের চাকা ভাজা নিয়ে ভোরের পাশে বসলো। মাছের কাঁটা বেছে ভাতসহ ভোরের মুখের সামনে ধরলো। ভোর মুখ ফিরিয়ে বলল,
-” আব্বু আসলে খাবো!”
-” এখন অল্প খেয়ে নাও! তোমার আব্বু আসলে আবার খেও!”
-” না আব্বু আসলেই খাবো!”
ভোরের জেদি কন্ঠস্বর। পাতা হতাশ হয়। এতো জেদ ছেলের। যা বলবে তাই! আসমা বেগম সোফায় সামনের সোফায় বসে ধমক দিয়ে বললেন,
-” এখনি খাবে! খাও? দশটা বাজতে চললো! সেই দুপুরে একটু দুধভাত খেয়েছে। তারপর সব হাবিজাবি চকলেট,চিপস! ভাত খেতে হবে না? আরিয়ানও তো আসে নি! আনিকা খেলো না? তুমি খাবে না কেন?”
ধমকে কাজ হলো বোধহয়। ভোর নাকের পাটা ফুলিয়ে হা করে। পাতা হেসে তার মুখে খাবার তুলে দেয়। সবটুকু খাবার খাইয়ে দিলো। পানি খাইয়ে দিয়ে আঁচলে মুখ মুছে চুমু খেলো। ভোর হাসলো! ফোন পাতার কাছে দিয়ে বলল,
-” ঘুমাবো আমি! ঘুম পাচ্ছে!”
বলেই হাই তোলে। পাতা এঁটো প্লেট রেখে আসে। মিনুকে বলে দুই গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আসে। ভোর দুধ দেখেই পেটে হাত দিয়ে বলল,
-” আম্মু আমার টাম্মিতে একদম জায়গা নেই! সত্যিই বলছি!”
-” আইসক্রিমের জন্য জায়গা হবে?”
পাতার কথায় ভোর দাঁত বের করে হেসে দিলো। আইসক্রিমের জন্য তার পেট সবসময় খালি! পাতা আনিকাকে এক গ্লাস দিয়ে ভোরকে বলে,
-” চুপচাপ শেষ করবে! কোন বাহানা না!”
ভোর গটগট করে সবটুকু সাবার করে। ঠোঁটের উপর সর লেগে গোঁফের মতো হয়। আনিকা হেসে বলল ‘ভোরের গোঁফ’! তারপর নিজের গ্লাস খালি করে বলল ‘আনিবুড়ির গোঁফ’ বলেই হেসে উঠলো। ভোরপাতার আঁচলে মুখ মুছে নিলো! আনিকা সেটা দেখে পাতার আঁচলে মুখ মুছতে নিবে ভোর আঁচলটুকু মুঠোয় পুরে বলল,
-” একদম না!”
আনিকা মুখ ভেংচি দিয়ে আসমা বেগমের কোলে বসে। আসমা বেগম যত্ন সহকারে নাতনির মুখ মুছে বলল,
-” ভোর তুমি দিন দিন হিংসুটে হয়ে যাচ্ছো!”
ভোর কিছু বলে না। পাতার হাত ধরে নিজের রুমের দিকে রওনা হয়। পাতা তার সাথে পা মেলায়! এইটুকু ছেলের এতো জেলাসি!
____
অরুণ,আরিয়ান বাড়ি ফেরে রাত বারোটার দিকে। রুবি জেগেই ছিলো। দরজা সেই খুলে দেয়। দুজনকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে খাবার গরম করতে শুরু করে। অরুণ নিজের ঘরে যায়। ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। লাইট জ্বলছে! বিছানায় পাতা ও ভোর ঘুমিয়ে আছে। অরুণ ঘড়ি খুলে সোফায়,শার্ট খুলে উদ্দেশ্যহীন ছুঁড়ে ফেলে। শু খুলেই বিছানায় উঠলো। কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয়। ভোরের কপালে গালে মুখে আদর করে পাতার দিকে চায়। মেয়েটা আজকেও শাড়ি পড়েই শুয়ে আছে তবে আজকে শাড়ি এলোমেলো নেই, পরিপাটি। অরুণ তার দিকে ঝুঁকে আসে! ললাটে অধর বসিয়ে সরে আসবে কিন্তু বেহায়া চোখ জোড়া অধরযুগলে পড়ে; সেখানেই নিবদ্ধ হয়। হালকা গোলাপি মোটা হৃষ্টপুষ্ট শুষ্ক ওষ্ঠাধর! মৃদু কাঁপছে। অরুণের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়! পুরুষালী মন টগবগিয়ে জেগে ওঠে। ইচ্ছে হয় শুষ্ক ওষ্ঠাধর ভিজিয়ে দিতে! হৃষ্টপুষ্ট আইসক্রিমের মতো লোভনীয় ওষ্ঠাধরের ভাঁজে ভাঁজে হারিয়ে পিপাসায় কাতর মনটাকে ভিজিয়ে নিতে। ভাবনার মাঝে অরুণ ঝুঁকে যায় বেশ খানিকটা। নাকে নাকে সংঘর্ষ হয়! সংঘর্ষে পাতা আঁখি মেলে চায় বড় বড় করে।অরুণ সরে যায়! পাতা ধরফর করে উঠে পড়ে। অবাক সুরে প্রশ্ন করে,
-” কি করছিলেন?”
-” মরে টরে যাও নি তো? শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে নাকি তাই চেক করছিলাম!”
স্বাভাবিক সুরে নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দিলো অরুণ! অথচ স্বাভাবিক মুখশ্রীর আড়ালের রূপটা দেখতে পেলে পাতা হয়তো লজ্জায় নুয়ে যেতো!
পাতা পিট পিট করে তাকিয়ে থাকে অরুণের দিকে। কি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে বাহানা পরিবেশন করলো! পাতা মোটেও ঘুমিয়ে ছিল না। সে তো মোবাইল দেখছিলো! কারো আসার শব্দে খানিকটা ভয়ে ফোন অফ করে চোখ বুজে ছিলো। পরে বুঝতে পারে লোকটা এসেছে তবে চোখ খুলে নি! ভাগ্যিস খোলে নি নইলে এই ভদ্রলোকের এই রূপটা আন্দাজ করতে পারতো না! লোকটা তার ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে কি করতে যাচ্ছিল?! ইয়া আল্লাহ পাতু তোর যা মরার লাহান ঘুম! এতো দিনে লোকটা লুকিয়ে চুরিয়ে অর্ধেক বাসর সেরে ফেলেছে হয়তোবা! লোকটা তো আচ্ছা ধরিবাজ! দেখে মনে হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না অথচ কাঁটা সমেত ভাজা মাছ গিলে নেয় ঢেকুর অবধি তোলে না।
পাতার ভাবনার মাঝেই অরুণ ওয়াশ রুমে চলে গেল। পাতা পা ভাঁজ করে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে চিন্তা ভাবনায় মশগুল হয়। এখন থেকে ঘুমের ঘোরেও সজাগ থাকতে হবে তবেই না চোর মহারাজকে ধরতে পারবে। এই চোর তো যে সে চোর না! অরুণ সরকার নামক নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য ধরিবাজ চোর! শালার জামাই! লুকিয়ে চুরিয়ে আদর কেন করবি? সামনাসামনি করলে কি সে খেয়ে ফেলবে নাকি! বরং খুশি হয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিবে, মাথায় তুলে রাখবে।
অল্প সময় নিয়ে গোসল করে অরুণ বেড়িয়ে আসে। পাতাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে বলল,
-” ওভাবে বসে আছো কেন? খেয়েছো?”
পাতা অরুণের দিকে চায় বিমুগ্ধ লেচনে; চোখ মুখ উজ্জ্বলতম হয়ে ওঠে; যাতে ফুটে ওঠে এক রাশ ভালোলাগা। সদ্য গোসল সেরে আধ ভেজা উন্মুক্ত শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি তার। ওই ভেজা লোমশ বুকটার মালকিন সে!ভেজা চুলে তোয়ালে ঘষছে! লোকটাকি ওই আধ কাঁচাপাকা চুল মোছার দায়িত্ব তাকে দিতে পারতো না? বোকা পাতা জানেই না ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটাও চায় তার ব্যাক্তিগত নারী একটু যত্ন করুক!
অরুণ পাতাকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তোয়ালে মুখের দিকে ছুঁড়ে মারে। পাতা হচকচিয়ে উঠে। নাকে মুখে ভেজা তোয়ালে পড়ায় সে মোটেও বিরক্ত হয় না। নাক টেনে শ্বাস নেয়! যেন কোনো নেশালো বস্তু!
-” কি হলো?”
পাতা নিজেকে সামলে নেয়। আস্তে করে বলল,
-” আমি খেয়েছি! আপনি চলুন আমি খাবার গরম করে দিচ্ছি!”
অরুণের স্বাভাবিক মুখশ্রী গম্ভীর হয়ে ওঠে। বিছানা থেকে নামতে উদ্যত হওয়া পাতাকে বাঁধা দিয়ে বলল,
-” তার দরকার নেই! রুবি জেগে ছিলো আরিয়ানের জন্য! না খেয়েই! ওই গরম করেছে। তুমি ঘুমাও পাতাবাহার!”
বলে অপেক্ষা করে না গায়ে টি শার্ট চাপিয়ে চলে যায় হনহনিয়ে। পাতা বসে পড়লো বিছানায়। লোকটা ওভাবে বলল কেন? কেমন যেন শোনালো না? “রুবি জেগে ছিল আরিয়ানের জন্য! না খেয়েই” আচ্ছা তারও কি উচিৎ ছিল, না খেয়ে লোকটার জন্য অপেক্ষা করা? ছিল তো! হান্ড্রেন্ট পার্সেন্ট উচিত ছিলো! না খেয়ে তার স্বামীর জন্য বসে থাকা তো একজন স্ত্রীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! অথচ সে কি করলো? নিজে পেট পুরে খেয়ে ঘুমে কাত! স্বামীর কথা ভুলেই বসেছে। পাতার মনটা খারাপ হয়ে গেল নিমিষেই! ইশ্ লোকটাও বুঝি তার থেকে আশা করেছিলো! লোকটা তার কত যত্ন করে আদরও করে। অথচ সে!! পাতা গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো!
খাওয়া দাওয়া শেষ করে অরুণ রুমে প্রবেশ করে। পাতাকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে সুধায়,
-” ঘুমাও নি? ঘুমিয়ে পড়ো!”
বলেই ওয়াশ রুমে চলে যায়! পাতা দু একবার চোখ পিটপিট করে। ভেবে নেয় লোকটা আসলে কি কি বলবে! একটু পর অরুণ বেরিয়ে আসলে পাতা জিজ্ঞেস করে,
-” আপনি রোজ রোজ এতো দেরি করে আসেন?”
অরুণ ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করে গ্লাসে পানি নিয়ে সোফায় বসল।
-” কখনো কখনো!”
-” এত রাতভর কিসের কাজ? শুনেছি সবার সন্ধ্যার পরপরই ছুটি হয়! আপনি এতো লেট করে আসেন কেন? ভোর আজ সারাদিন আব্বু আব্বু করেছে। অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলো! জেদ ধরে বসে ছিল আব্বু আসলেই খাবে সে। মা বললে তবেই খেলো!”
অরুণ পানির গ্লাস পাশে রেখে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে বলল,
-” ব্যস্ত ছিলাম!”
-” এতো কিসের ব্যস্ততা?
-‘ কাজ করছি আমি! ডিস্টার্ব করো না।”
শান্ত স্বরে বলে অরুণ। পাতার ভালো লাগে না। সেই সকাল ভোরে বেরিয়েছে। সারাটা দিন ছিলো। এখন রাত বারোটার পর এসে আবার কাজ করছে! এতো কিসের কাজ? ঘড়িতে একটা বেজে গেছে। ঘুমাবে কখন? পাতা বিছানা থেকে নেমে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
-” ডিস্টার্ব করছি আমি? এখন রাত একটা বাজে ঘুমোবেন কখন আপনি? সারাদিন, রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করেও আপনার কাজ ফুরোলো না! এতো কি কাজ?”
অরুণ প্রতিত্তর করে না। চুপচাপ কাজ করতে থাকে। পাতা আরো অনেক কিছুই বলে অরুণ কানে তুললো না। সে কাজে ব্যস্ত। পাতার দিকে তাকায়ই না! পাতা রেগে গেলো। শালার জামাই তার কথা শুনছে না! এতো দিনের আদর যত্নে পাতার বেশ সাহস সঞ্চয় হয়েছে। তাই তো অরুণের কোল থেকে ল্যাপটপ কেড়ে নিয়ে সাটার অফ করে কম্ফোর্টের ভিতর লুকিয়ে রাখে।
-” আপনি আমার কথা শুনছেন না! কখন থেকে বলে যাচ্ছি আমি! এখন কোনো কাজ না। না মানে না !”
অধিকার দেখিয়ে বলে বুকে হাত গুঁজে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে অরুণের দিকে চায়। গম্ভীর অরুণের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়! হাত নিশপিশ করে। পাশে রাখা পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ঠাস করে ফ্লোরে ছুঁড়ে মারে। ঝনঝন শব্দে পুরো রুম ভরে ওঠে। পানি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ফ্লোর ভিজে গেল। ভোর এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শোয়। খাঁচায় বন্দী পাতাবাহার মিও মিও করে ডাকতে শুরু করে। পাতা স্তব্ধ মুক হয়ে দাঁড়িয়ে। সে বেশ ভয় পেয়েছে! সাথে এটাও বুঝে গেছে সে অনর্ধিকার চর্চা করতে গিয়েছিল! আর এর ফলাফলও সুদ সমেত পেয়ে গেল। লোকটা গ্লাস ফেলেনি, পাতাকে ফেলে টুকরো টুকরো করে দিলো যেন! পাতার চোখ ভরে ওঠে। এবার আর বাঁধা দিলো না। আস্তে করে পা ফেলে কম্ফোর্টের ভিতর থেকে ল্যাপটপ বের করে অরুণের সামনে রাখে।
-” স্যরি!”
বলেই তন্ত পায়ে হেঁটে বিছানায় যায়। পায়ের গোড়ালিতে কাঁচ ফুটে এতেও ভাবান্তর হয় না। কম্ফোর্ট পেঁচিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে নিঃশব্দে। লোকটা তাকে আদর যত্ন করে, খেয়াল রাখে! ঝাড়ি ধমক দেয়, তবে সেটা ভালো লাগে! ভাবে অল্প খানিক ভালোবেসেই শাসন করে যেমনটা ভোরকে করে! তাই তো পাতা সাহস পায় লোকটার উপর একটু আকটু কথা বলতে! মাঝে মাঝে বলেও! লোকটা কখনো কিছু বলে নি। অথচ আজ!! ভাবতেই পাতার ফোপানো বেড়ে যায়! বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ালিতে কামড়ে কান্না, ফোঁপানো আটকানোর চেষ্টায়! ঢের শিক্ষা হয়েছে তার।
অরুণের চোয়ালদ্বয় এখনো শিথিল হয় নি। মেজাজ এখনো তিরিক্ষি! রাগে শরীরটা যেন জ্বলছে। তবুও সে নিজেকে ঠান্ডা রেখেছে। বিছানায় যে একজন অশ্রু বিসর্জন দেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে সেটাও বুঝতে বাকি নেই। অরুণ সোফায় গা এলিয়ে দেয়! মুখশ্রী কপালে হাত রাখে! যন্ত্রণায় মাথার রগ ছিঁড়ে যাবার উপক্রম! হাত পা কোমড়সহ পুরো শরীরের রগে রগে যেন সে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ছে! অরুণ টি টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নেয়। রাসেলের নাম্বারে কল করে। রিসিভ হলেই অরুণ জিজ্ঞেস করে,
-” কোথায় তুই?”
রাসেল মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টায় আছে। দুষ্টু মেয়েটা ঘুমুচ্ছেই না।মায়ের ফোনে কার্টুন দেখছে। ভেবেছিল মেয়েকে জলদি ঘুম পাড়িয়ে বউকে নিয়ে একটু বিছানাবিলাস করবে কিন্তু মেয়েটা ঘুমোনোর নামই নেই অথচ মেয়ের মা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। বন্ধুর ফোন পেয়ে একটু খুশিই হলো। দুঃখের কথা বলা যাবে।
-” এতো রাতে কই থাকবো! ঘরেই আছি! ভালো করেছিস ফোন দিয়েছিস! দুঃখ শেয়ার করার জন্য কাউকে পেলাম!”
-” তোর দুঃখের আলাপ শোনার টাইম আমার নেই! তোর সরকারি মালটা আমার লাগবে!”
বিরক্তিকর সুরে বলে অরুণ। রাসেলের বুঝতে বাকি নেই কিসের কথা বলছে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-” হোয়াট পাগল তুই? কি করবি?”
-” সেটা আমার ব্যাপার! কাল সকালে ওটা নিয়ে আসবো! বাড়িতেই থাকবি! রাখছি!”
-” আরে শোন কি করবি সেটা বল? এটা খেলনা বস্তু না যে..”
-” আমি জানি সেটা! আর আমি খেলবো না। খেলনা বস্তু আমার ছেলের ভরি ভরি আছে। আর কি করবো সেটা কালকেই বলবো!”
বলেই খপ করে কল কেটে দিলো।তারপর ফোন সোফায় ছুড়ে ল্যাপটপ ওপেন করলো। কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করে সেভ করে রাখলো! ল্যাপটপের সাটার অফ করে ফ্লোরের কাঁচের টুকরোগুলো তুলে বিনে রাখলো। ভেজা ফ্লোর মুছেও নিলো! টি শার্ট খুলে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে বিছানায় বসলো। পাতার পায়ের কাচের ছোট্ট টুকরো বের করে ড্রেসিন করে দিলো। ভোরকে সাইডে রেখে মাঝখানে শুয়ে পড়লো। ছেলের মাথায় কিছু সময় হাত বুলিয়ে লাইট অফ করে পাতার দিকে ঘেঁষে গা এলিয়ে দিলো। ঘুমিয়ে পড়েছে কি মেয়েটা! অরুণ পাতার কোমড় টেনে কাছে আনে। বুকে জড়িয়ে চুলের ভাঁজে ছোট ছোট চুমু খায়। চুলের রেবন খুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। পাতা চোখ খুলে অল্প। চোখের সামনে অন্ধকার দেখলেও চোখের তারায় অগনিত সুখতারা মিটমিট করে জ্বলতে থাকে। ঝাড়ি, বকা, গ্লাস ভাঙচুর যাইহোক না কেন! সবশেষে প্রতিবার এভাবে বুকে টেনে নিয়ে আদর করলে পাতা একশ দুইবার অনর্ধিকার চর্চা করবে!
চলবে….