পাতা বাহার পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
663

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৫
(প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

বৃষ্টি ভেজা সকাল।গত ভোর রাতের মতো আজ ভোর রাতেও বৃষ্টি হয়েছে ঝমঝমিয়ে। গত ভোর রাতের চেয়েও বেশি হারে বৃষ্টি হয়েছে।গতদিন অরুণ হাঁটতে বের হতে না পারলেও আজকে বৃষ্টি থামার সাথে সাথেই বেরিয়েছে ছাতা সমেত। যানজট বিহীন বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা রাস্তায় হাঁটার মজাই অন্যরকম । তবে আজ অরুণ একা না। সাথে ভোর;! আজ ডাকতে হয় নি ছেলে, ছেলের আম্মুকে। পাতাবাহারকে ফজরের ওয়াক্তে দুই বার ডেকেই তোলা গেছে। তবে নামাজ শেষ করেই বিছানায় চিৎপটাং! অরুণ ছেলের হাত ধরে হাঁটছে ধীরে ধীরে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ভোরের বুলি ফুটেছে বেশ। দু’দিন বাবার সাথে ভালো করে কথাই হয়নি তা বোধহয় এই অল্প সময়েই উসুল করে নিচ্ছে। একটার পর একটা কাহিনী বলে যাচ্ছে। কাল কি করেছে, গতদিন কি করেছে! পাতাবাহার নামক বিড়াল শাবকটির সাথে আম্মুর কতবার ঝগড়া বেঁধেছে! কি নিয়ে বেঁধেছে! আনিকার সাথে তার ঝগড়া লাগে নি গত দু’দিন! আভারি কাক্কু পুকুরে থেকে ছোট ছোট অনেক গুলো মাছ ধরেছে! মিনু খালা সেগুলো ভেজে দিয়েছে।খেতে অনেক মজা! আব্বু যেন তাকেও মাছ ধরা শেখায়! সাথে সাইকেল চালানোও! আরো অনেক অনেক কথা! অরুণ শুনছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। হা হু কিছু বলছে না। এতে ভোর থেমে নেই। সে তার মতো বলে যাচ্ছে। আরেকটু পথ হেঁটে যাওয়ার পর দেখা হয় সেই বৃদ্ধা লোকটির সাথে যার নাম কাবেল! অরুণকে দেখেই হ্যান্ডশেক করে হালকা জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিলো। ভোরকে দেখে বলল,

-” আব্বাজান নাকি?”

ভোর বাবার হাত শক্ত করে ধরে পিটপিট করে চায়। অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ‘হুম’ বলে। বৃদ্ধা ভোরের গাল হালকা চেপে ধরে মুখ উঁচু করে। ভোরের লাল ঠোঁটজোড়া,গাল ফুলে ওঠে। ভোর আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। বৃদ্ধা হেসে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

-” এতো তোর কার্বন কপি রে অরুণ! অনিকের মতো হয় নি একটুও! তুইও ছোট বেলায় এমনি ছিলি! কুটুর মুটুর করে চেয়ে থাকতি!”

ভোর ছাড়া পেয়ে গালে হাত বুলায়; বাবার সাথে সেঁটে গিয়ে মুখ লুকায়। পঁচা বুড়ো! তার সুন্দর কিউট গালটাকে কিভাবে ধরলো! অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বৃদ্ধার উদ্দেশ্যে বলল,

-” দোয়া করবেন আমার ছেলেটার জন্য!”

বৃদ্ধা হেসে ভোরকে টেনে অরুণের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ভোর খানিকটা ভয় পেয়ে অরুণের দিকে কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকিয়ে রইল। অরুণ মুচকি হেসে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে। বৃদ্ধা লোকটি ভোরের মাথায় সময় নিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে গালে হাত রেখে দোয়া করে। তারপর হেসে বলল,

-” অনেক বড় হন আব্বাজান! দীর্ঘজীবী হন! আর বড় হয়ে আপনার বুড়ো আব্বুরে ভুলে যাইয়েন না!”

ভোরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। বুড়ো দাদুটা পঁচা না; ভালোই। আদর করলো তাকে।

-” নতুন মা আদর করে? ভালোবাসে?”

ভোর মিষ্টি হেসে হাত প্রসারিত করে জবাব দিল,

-” অনেক ভালোবাসে আদর করে আম্মু!”

বৃদ্ধা ভোরের গাল টিপে দিয়ে বলল,

-” তাহলে তো অনেক ভালো!”

-” তাহলে আম্মুকেও দোয়া করে দাও দাদু?আর আব্বুকেও”

ভোরের কথায় হাসে বৃদ্ধা!

-” যাহ দিলাম! শিঘ্রই তোদের বাড়ি নতুন সদস্যের আগমন হবে! কিরে অরুণ হবে না?”

অরুণ খুক খুক করে কেশে ওঠে। গাছ রোপনই করলো না বুড়ো ফলের দোয়া করছে! তবুও সে হেসে মাথা দোলায়। ভোর কিছু বুঝতে পারলো না। নতুন সদস্য কোথা থেকে আসবে? এটা কেমন দোয়া করলো! অরুণ বৃদ্ধা কাবেলের থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করে। ভোর চিন্তিত মুখে বাবাকে প্রশ্ন করে,

-” আব্বু নতুন সদস্য কে? কোথা থেকে আসবে? কখন আসবে?”

অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

-” কি জানি কলিজা! যখন আসবে জিজ্ঞেস করে নিও!”
____

পাতা সকাল সকাল ব্যস্ত সময় পার করছে। কিচেনে কাজ করতে সে মহাব্যস্ত!ভাবসাব এমন যে কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। আজ সে কাজের গুষ্টির তুষ্টি করে দেবে। আর তার কাজের নমুনা যেমন: চা বানিয়েছে; মিনুকে পেঁয়াজ ছিলে দিয়েছে;ডিম সিদ্ধ করছে; ভাজির লবণ ঝাল পরখ করিয়েছে মিনু; সবশেষে এখন তা’য়ে রুটি সেকছে! যদিও রুটি মোটেও ফুলছে না; পুরে যাচ্ছে খানিকটা। মিনু হতাশ হয়। এই মেয়ে তো কিছুই পারে না। এ ঘরে না পড়ে অন্য কোনো দজ্জাল শাশুড়ির তালে পড়লে উঠতে বসতে ঝাড়ি খেতো! কিছুই পারে না এমন না!! মিষ্টি করে অল্প সল্প কথা বলে। আর সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে, বিরক্ত হয় না‌! এই যে সে রান্নাঘরে পুরোটা সময় এটা ওটা বলছে মেয়েটা চুপচাপ শুনছে আবার ছোটখাটো প্রশ্নও করছে।

-” ম্যাডাম হইছে আপনি যান! আমি কইরে দিতেছি! আপনের কষ্ট হইতেছে! যান!”

বলতে পারে না যে আপনার এ রুটি বাড়ির লোকজনের সামনে দিলে ফিক্কে ফাইলে দিবে!

পাতা হেসে বলল,

-” না! আমার কষ্ট হচ্ছে না। বরং ভালো লাগছে!”

মিনু মুখ গোমড়া করে। কতগুলো আটা রুটি নষ্ট সাথে সময়ও; খাটুনির তো কথাই নেই। পাছে আবার তাকে নতুন করে রুটি করতে হবে। তাই সে আমতা আমতা করে বলল,

-” রুটি তো ফুলতেছে না। এই রুটি কেউ খাইতো না!”

পাতা রুটির দিকে চায় অসহায় চোখে। মুখ খানি তার দেখার মতো। শেষ রুটি টা নামিয়ে পাতা চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। মিনু পাতার অমন মুখ দেখে বলল,

-” ম্যাডাম রাগ করছেন আমার কথায়? কিছু মনে করবেন না!”

-” আরে না রাগ করবো কেন? আমি সত্যিই পারি না! তুমি শিখিয়ে দিও মিনু আপা! দিবে না?”

হেসে বলল পাতা। মিনু তার কথায় আশ্বস্ত হয়। সায় জানিয়ে ‘আইচ্ছা’ বলে। তখনই দৌড়ে কিচেনে আসে ভোর। মিনুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ও মিনু খালা আজ আমার জন্য সেমাই রান্না করবে। মিষ্টি করে! তারপর ফ্রিজে রেখে দিবে। ঠান্ডা হলে খাবো!”

মিনু তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

-” আচ্ছা ভোর বাবা! কই গেছিলা তুমি? পায়ে ময়লা লেগে আছে!”

ভোর নিজের পায়ের দিকে চায়। কাঁদা রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে লেগেছে। এরইমধ্যে অরুণ সরকারের আগমন ঘটে রান্নাঘরের দরজায়। পাতা তাকে দেখে খানিক আড়ষ্ট ভঙ্গিতে পুরে যাওয়া রুটি আড়াল করে দাঁড়ায়। অরুণের অবশ্য সেদিকে ধ্যান নেই! সে ভোরকে কোলে নিয়ে বলল,

-” চলো ময়লা পরিষ্কার করে দিই! স্কুলে যেতে হবে তো!”

বলেই পা বাড়ায়। পাতা তাদের যেতে দেখে নিজেও গুটিগুটি পায়ে অরুণের পিছু পিছু হাঁটে। মিনু‌ সেটা দেখে মুচকি হাসলো।

পাতা অরুনের পরে রুমে ঢুকে। অরুণ ভোরকে নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়। পাতা বসে থাকে। একটু পরে অরুণ তোয়ালে পেঁচিয়ে ছেলেকে নিয়ে আসে। ভোর পাতাকে দেখে লজ্জা পায়। পাতা তার লজ্জা দেখে হাসে। ভোর তোয়ালে ধরে বাবার পিছনে লুকায়। অরুণ আলমারি থেকে প্যান্ট এনে পরিয়ে দেয়।

-” স্কুলে যাওয়ার কোনো তাড়া দেখছি না!”

-” আমি আজ স্কুলে যাব না আব্বু!”

ভোরের কথায় অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।

-” কেন?”

-” যেতে ইচ্ছে করছে না!”

-” তবুও যেতে হবে! আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি!”

বলে পাতার দিকে আড়চোখে চেয়ে আলমারির কাছে যায়। পাতা মিনমিনে গলায় বলে,

-” আজ থাক! আমিও যাবো না। প্রিন্সিপাল ম্যামের থেকে ছুটি নিয়েছি!”

-” কে যাবে, না যাবে তার ব্যাপার! ভোর তুমি যাচ্ছো!”

গম্ভীর মুখে বলে অরুণ! পাতার মুখটা চুপসে যায়। ভোর কাঁদো কাঁদো জেদি গলায় বলে,

-” আমিও যাবো না! আম্মু যাবে না ভোরও যাবে না।”

অরুণ চোখ রাঙায়। ভোর গাল ফুলিয়ে নেয়। আব্বু আজকে যতই চোখ রাঙাক না কেন সে যাবে না মানে যাবে না। অরুণ শান্ত গলায় বলে,

-” বলেছিলে না নেক্সট এক্সামে ভালো করবে? তারজন্য ভালোভাবে পড়তে হবে না? স্কুলে যেতে হবে না?”

-” আমার না পড়লেও চলবে!”

-” কিভাবে চলবে?”

ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,

-” ওভাবেই!”

-” ভোর!”

ধমকে বলে অরুণ! ভোর ভয় পায় না। জেদ ধরে বলে,

-” আব্বু!”

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পাতা নরম গলায় অনুরোধের সুরে বলে,

-” আজ থাক না? এমনিতেই আজ খুব একটা ক্লাস হবে না। বৃহস্পতিবার তার উপর কাল রেজাল্ট হলো! সেগুলো নিয়েই আলাপ সালাপ হবে!”

অরুণ কিছু বলে না। চুপচাপ প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়‌। পাতা বিষন্ন মনে তাকিয়ে দেখে। রেগে তার থাকার কথা ছিল না? অথচ লোকটা তার সাথে কথা বলছে না। অরুণ মিনিট কয়েক পরেই বেরিয়ে আসে। চুপচাপ ড্রেসিন টেবিলের সামনে গিয়ে শার্ট ইন করে বেল্ট পড়ে! চুল পরিপাটি করে পারফিউম স্প্রে করে। জেন্টস পারফিউমে পুরো রুম জুড়ে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। হাত ঘড়ি বেঁধে বিছানায় বসে মুজো পড়ে, শু পড়ে নেয়‌। পাতা পলকহীন তার দিকেই চেয়ে! আজ ব্লু শার্ট! কালো প্যান্ট। নিত্যদিনের মতো আজও মারাত্মক লাগছে তার জামাইটাকে। শুধু মুখটা নিরস! একটু হাসিমুখে থাকলে লোকটার থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যেতো! অরুণ শু পড়ে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকা ছেলের কপালে চুমু দেয়। মোবাইল ও ল্যাপটপের ব্যাগটা হাতে তুলে কিছু না বলেই হনহন করে চলে যায়! পাতার চোখ জোড়ায় বিষন্নতার মেঘ নামে। ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। হঠাৎ খেয়াল হয়, লোকটা না খেয়ে চলে যাবে নাকি?”

-” আমি নিচে যাই তোমার আব্বু না খেয়ে চলে গেল নাকি? তুমিও এসো আস্তে ধীরে।”

বলেই শাড়ির কুঁচি ধরে একপ্রকার দৌড় লাগায়। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখে লোকটা ড্রয়িং রুমে দাঁড়িয়ে আরিয়ান ভাইয়ের সাথে কথা বলছে। পাতা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেঁড়ে চটজলদি নেমে কিচেনে যায়। মিনু রান্না করা শেষ হয় নি। রুটি সেকছে। পাতা মিনুকে বলে একটা প্লেট নিয়ে তিনটে গরম রুটি ও ভাজি নেয়। মিনু ততক্ষণে ডিম ভেজে দিয়েছে। পাতা প্লেটে ভাজা ডিম নিয়ে ড্রয়িং রুমে যায়। দেখে লোকটা ভাইয়ের থেকে বিদায় নিচ্ছে যাওয়ার জন্য। সে গিয়ে মিনমিনে গলায় বলে,

-” খাবারটা খেয়ে যান!”

অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে পাতার দিকে ও একবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে পা বাড়ায়। আরিয়ানেরও কপালে ভাঁজ পড়ে। তবে পাতার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে হাসে। পাতার নাকের পাটা ফুলে ওঠে।

-” প্লিজ খেয়ে যান? আমি খাবার এনেছি!”

অরুণ ঘুরে ডায়নিং এ বসে। পাতার মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়। আরিয়ানকে ভেংচি কেটে প্লেট নিয়ে অরুণের সামনে রাখে। গ্লাসে পানি ঢেলে দেয়। অরুণ হাত ধুয়ে নেয়। রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে। এরইমধ্যে ভোর চলে আসে। ড্রয়িং রুমে চাচ্চুর পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলো। অরুণ যত দ্রুত সম্ভব রুটি তিনটে সাবার করে পানি খেয়ে হাত ধোয়ার জন্য উদ্যত হলে পাতা বলল,

-” আর দুটো আনি?”

অরুণ গম্ভীর মুখে পাতার দিকে চায়। একটা গ্লাস ভাঙ্গার পর মেয়েটা এতটা যত্নশীল হয়ে উঠলো? গ্লাস ভাঙ্গার এতো পাওয়ার!

-” নো নীড!”

অরুণ হাত ধুয়ে মুখ পুছে। অরুণ পকেট থেকে রুমাল বের করবে পাতা আশেপাশে নজর বুলিয়ে নেয়। হাত বাড়িয়ে আঁচল দিয়ে যত্ন সহকারে মুখ মুছে দিয়ে বলে,

-” অফিসে ঝামেলা হচ্ছে সেটা আমায় বললে আমি কি ঝামেলা বাড়িয়ে দিবো? নাকি আমাকে বলা যায় না?”

অভিমানের গলা! অরুণ প্রতিত্তরে কিছু বলে না। ঠোঁটের কোনায় হাসি ছড়িয়ে পড়তে চাইলেও বাঁধা দেয়। গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারে রাখা ব্যাগটা ফেলেই হাঁটা দেয়। আরিয়ানের কোলে বসা ছেলেটার গালে পুনরায় চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায়। পাতা কি বুঝলো?
পাতা তার যাওয়া দেখে। তারপর চেয়ারে রাখা ব্যাগটা নিয়ে নিজেও পা বাড়ায়। মেইন ফটক পেরিয়ে বাইরে আসতেই দেখে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে গম্ভীর মুখে। তাহলে পাতার ধারনাই ঠিক। লোকটা ইচ্ছে করেই ব্যাগ ফেলে গেছে। পাতা মুচকি হেসে অরুণ পাশে দাঁড়ায়! অরুণ খপ করে ব্যাগটা কাঁধ গলিয়ে নেয়। দু গালে হাত রেখে পরপর ঝুঁকে বধুয়ার ললাটে চুম্বন করে সময় নিয়ে। আজকের ওইটুকু যত্ন অরুণের জন্য আকাশ সমান। অরুণের আবছা আবছা স্মৃতিতে ভাসে; আদর করে খাইয়ে দেয়ার পর আঁচল দিয়ে মা’য়ের মুখ মুছিয়ে দিয়ে কপালে চুমু খাওয়ার দৃশ্য খানি। মা যাওয়ার পর প্রথমবার কেউ খাওয়ার পর মুখটা যত্ন সহকারে আঁচল দিয়ে মুছে দিলো!

অরুণ ললাট থেকে অধর সরিয়ে গালে ছোট ছোট দুটো চুমু দিয়ে আলতো কামড় বসিয়ে ছেঁড়ে চলে যায় বিনা বাক্যব্যয়ে! স্বর্গে ভাসতে থাকা পাতার হুঁশ ফিরে। খানিকটা গলা উঁচিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,

-” সাবধানে যাবেন! নিজের খেয়াল রাখবেন!”

অরুণ শুনতে পেলেও পিছনে ফেরে না। অধর বাঁকিয়ে হনহন করে চলে যায় গেটের ভিতরে অবস্থানরত গাড়ির দিকে।

পাতা যায় না। সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত গাড়িটা গেইট পেরিয়ে বেড়িয়ে না যায়। তার জীবনের কঠিনতম গোলক ধাঁধা থেকে নিরবচ্ছিন্ন হয়ে কেমন রামধনুর সাত রঙের মতো রঙিন হচ্ছে। স্বামী সংসার নিয়ে তার দেখা স্বপ্ন বাস্তবিক রূপ নিয়ে রঙিন ছবির ন্যায় পর্দায় ভাসছে কি!!
___

চিন্তিত মুখে সোফায় বসে আছে রাসেল। সামনে স্ত্রী সুফিয়া ছেলে মেয়ে সুজির হালুয়া খাওয়াচ্ছে। ছেলে মেয়ে দুটো জমজ! ছেলেটার নাম সাহির মেয়েটার নাম সামান্থা। ছয় বছর পেরিয়ে সাতে পা দিয়েছে সবে। এতো দুষ্টু দুটো! হাড় মাংস জ্বালিয়ে খায়। এই যেমন সকালে রুটি খাবে না! পরোটা বানিয়ে দিলো সেটাও না! অমলেট দিলো সেটাও খাবে না। ওর মা ব্রেড ভেজে দিলো সেটাও খাবে না। তাহলে কি খাবে জিজ্ঞেস করলেও বলতে পারে না। নুডুলস, পাস্তাও বানিয়ে দিলো তারা খাবে না। তখন ছেলেটা বলল সে হালুয়া খাবে। তাও সুজির হালুয়া! এদিকে বাড়িতে সুজি নেই! সুফিয়া ভালোভাবে বুঝিয়ে বলল দুপুরে বানিয়ে দিবে সেটাও চলবে না। অগত্যা তাকে বাজারে দৌড়াতে হয়‌। এখন সে সিভিল পোষাকে বসে আছে অরুণ সরকারের অপেক্ষায়। দশটায় ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছাতে হবে। তার বাড়ি থেকে প্রায় ঘন্টা খানেকের রাস্তা। এখন নয়টা বিশ বাজে এখনও শালার আশার নাম নেই! সে চলে যেতো ; কিন্তু শালা অস্ত্র চেয়েছে! সে জানে অরুণ এটা নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু করবে না। পূর্ণ বিশ্বাস আছে তার। তবে দেয়ার ইচ্ছে এইটুকুও নেই! এটা কোন খেলনা জিনিস মোটেই না। আর সরকার এটা তাকে দিয়েছে দায়িত্ব পালনের জন্য! সাধারণ মানুষকে হেফাজতে রাখার জন্য। সেখানে সে সাধারণ মানুষের হাতে কিভাবে এই অস্ত্র তুলে দিবে? এটাতো অন্যায়। তবে না দিয়েও নিস্তার নেই। অন্য কোন বন্ধু হলে মুখের উপর কড়া কথা বলে মানা করে দিতো। কিন্তু অরুণ? ওই শালারে না করলে কিছু বলবে না। কিন্তু গাল ফুলিয়ে নেবে। কথাই বলবে না যোগাযোগ তো দূরের কথা। তার ভাবনার মাঝেই কলিংবেল বাজলো। রাসেল গিয়ে দরজা খুলে গোমড়া মুখে। সামনে অরুণ দাঁড়িয়ে! অন্যসময় হলে গলা জড়িয়ে কুশল বিনিময় করতো। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। অরুণ বন্ধুকে দেখে হেসে পেটে পাঞ্চ করে বলে,

-” ঝটপট দে! সময় নেই আমার!”

রাসেল মুখ কুঁচকে বলে,

-” শালা তোর জন্য আমি কেস খেয়ে যাবো!’

-” বন্ধুর জন্য বন্ধু জান দেয় তুই না হয় কেস খাবি । এটা কোন বড় ব্যাপার না!”

রাসেল পিস্তল টা বের করে অরুণের দিকে বাড়িয়ে দিল। অরুণ রুমালে মুড়ে হাতেই রাখলো! অপর হাতে থাকা চিপস ও আইসক্রিমের পলিটা রাসেলের দিকে বাড়িয়ে বলল,

-” বাচ্চাদের জন্য! শালা ভিতরেও যেতে বললি না। কতটা ম্যানারলেস তুই রাসু!”

রাসেল পলিটা নিয়ে কটমট করে বলল,

-” হ্যা আমি বললে তুই ভেতরে এসে ব্রেকফাস্ট করতি। আমার একবেলার রেসন ফুরিয়ে যেতো! যা চেয়েছিলি পেয়েছিস! এখন যা ফুট! তবে মনে রাখিস সন্ধার আগে যেন এটা আমার হাতে থাকে!”

অরুণ রাসের গালে আলতো থাপ্পড় মেরে বললো,

-” ওকে রাসু ডার্লিং!”

-” অরু সত্যি করে বল কি করবি এটা দিয়ে?”

উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করে রাসেল। অরুণ হাঁটা দেয়,

-” একটা গন্ডারকে খুলি বরাবর গুলি করবো!”

বলে থামে না। রাসেল তার যাওয়ার পথে চেয়ে থাকে কিছু পল!

অরুণ পার্কিং এ দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির ভিতরে বসে। ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। অরুণ রুমালে মুড়ানো পিস্তলটা বের করে। ফ্রন্টসিটে বসা ম্যানেজার সুজনের চোখ চড়কগাছ। সে ভিতু স্বরে বলে,

-” বস! এটা দিয়ে কি করবেন?”

অরুণ পাশ থেকে স্যুটকেস টেনে কোলের উপর নেয়। স্যুটকেস খুলে ভিতরে পিস্তলটা রেখে বলল,

-” মি. আলমকে টপকে দিবো!”

সুজনের চোখের আকার বড় হয়। সাথে মুখশ্রীর ভয়ের রেশ বেড়ে যায়। আমতা আমতা করে বলল,

-‘ স্যার মজা করছেন?’

অরুণ প্রতিত্তর করে না। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” গাড়ি মি. আলমের ফ্ল্যাটে গিয়ে থামবে!”

ড্রাইভার ঘার কাত করে দুরু দুরু মনে গাড়ি চালায়। স্যার কি সত্যিই খুন করবে? প্রায় মিনিট বিশেক পরে একটা ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড় করায় গাড়িটি। স্যুটকেস হাতে অরুণ ও সুজন নেমে আসে। দারোয়ান কে পরিচয় জানালে সালাম জানিয়ে ফ্ল্যাট নাম্বার বলে ভিতরে যাওয়ার তাগিদ দেয়। অরুণ সানগ্লাস চোখে স্যুটকেস হাতে লিফটে প্রবেশ করে। কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে লিফটের দরজা খুলে যায়। অরুণ, সুজন মি. আলমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। সুজন কলিং বেল বাজায়। মিনিটের মাঝেই মধ্যবয়সী মহিলা দরজা খুলে দেয়। সুজন মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে। দেখে কাজের মেয়েই মনে হচ্ছে তবে কাপড় পড়ার ভঙ্গিমা জঘন্য! অশ্লীলতায় ভরপুর। এরকম কাজের মেয়ে বাড়িতে ঘুরঘুর করে মি. আলমের স্ত্রী কিছু বলে না? মেয়েটি তাদের উদ্দেশ্যে হেসে বলল,

-” স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছেন বুঝি?”

অরুণ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। কাজের মেয়েটির নজর অরুণের দিকে স্থির। ঠোঁট কামড়ে অরুণের আপাদমস্তক দেখে মুচকি মুচকি হাসে। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। হাত মুঠোয় ভরে। সুজন স্যারের শক্ত চোয়াল দেখে ঢোক গিলে।

-” মি. আলমের সাথে দেখা করতে এসেছি আমরা। ওনাকে ডেকে দিবেন প্লিজ!”

-” ওহ্। তা বাইরে বসে আছেন কেন? ভেতরে আসুন বসুন? আমি অতিথি আপ্যায়নে একটুও কনজুসি করি না! ভালোভাবে তৃপ্তি সহকারে আপ্যায়ন করি! আমার নাম তানিয়া! তানি বলে ডাকতে পারেন”

হেসে দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল। সুজন প্রবেশ করে ভিতরে, তার পিছনে অরুণ। মহিলাটি এখনো অরুণের দিকে তাকিয়ে। সাথে বিশ্রী নজর ও হাসি তো আছেই। অরুণ পারে না ফ্লাওয়ার ভাসটা মহিলার মাথায় ফাটিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতে! ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে সুজন মহিলাটির উদ্দেশ্যে বলে,

-” মি. আলমকে ডেকে দিবেন প্লিজ! আর ওনার স্ত্রী বাচ্চাদের দেখছি না?”

-” ওনারা তো কক্সবাজার বেড়াতে গেছে দুদিন হলো! বাড়িতে শুধু উনিই আছে। আর আমি তার সেবায় মানে রান্না বান্না ঘরদোর পরিষ্কার হাবিজাবি!”

বলে ভিতরে চলে যায়। অরুণ টি টেবিলের সামনে থাকা খালি জগটা লাত্থি দিয়ে ফেলে দেয়। সুজন চোখ বড় বড় করে চায়। এই রে ক্ষ্যাপা ষাঁড় ক্ষেপেছেন। সে ঢোক গিলে বলে,

-” কুল বস কুল!”

অরুণ তার দিকে চায়। সুজনের মুখ খানি চুপসে যায়। বস এখন তাকে না আছাড় মেরে ফেলে দেয়। এরইমধ্যে মি. আলম আসে হন্তদন্ত পায়ে।

-” অরুণ সরকার যে? এতো সকালে!!”

অরুণ নিজেকে শান্ত করে জবাব দিল,

-” দেখা সাক্ষাৎ করতে এলাম। কাল ফোনে ভালোভাবে কথাই হলো না।”

মি. আলম দাঁত বের করে হাসে। ফ্লোরে ভাঙ্গা জগের টুকরোগুলো দেখে বলে,

-” কিভাবে ভাঙলো?”

অরুণ সোফায় গা এলিয়ে জবাব দেয়,

-” পা ফসকে ভেঙ্গে গেল!”

মি. আলম চিন্তায় পড়ে পা ফসকে কিভাবে ভাঙ্গে! তবে মাথা ঘামায় না। তানিয়াকে ডেকে কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করে চা দিতে বলে। এরপর অরুণের বিপরীতে সিঙ্গেল সোফায় বসে বলল,

-” তা কি সিদ্ধান্ত নিলে অরুণ?”

-” কি সিদ্ধান্ত নিবো! আপনি কি আর পথ বাকি রেখেছেন! আপনার কথাই সই! তাই তো জলদি এলাম আপনার ফরমাইশ নিয়ে!”

বলেই স্যুটকেস টি টেবিলের উপর রাখে। মি. আলমের চোখ চক চক করে ওঠে লোভে। হাত বাড়িয়ে স্যুটকেস নেবে, অরুণ স্যুটকেসের উপর পা তুলে দিয়ে আয়েশ করে বসে।

-” এতো জলদি কিসের? সবুর করুণ সবুরে মেওয়া ফলে! বাকি কথা ফাইনাল করে নিই?”

অরুণের আচরণ ভালো না লাগলেও মি. আলম মাথা নাড়লো। মালকড়ি পাচ্ছে এটাই অনেক, সম্মান ধুয়ে পানি খাবে নাকি সে!

অরুণ সানগ্লাসটা খুলে হাসিমুখে বলে,

-” আপনার পঞ্চাশ আপনি পাবেন। তবে কেস তুলে নিবেন! একটা ভালো স্টেটমেন্ট দিবেন! তার পরেই!”

-” গ্যারান্টি?”

অরুণ হাসে।

-” এডভান্স!”

মি. আলমের চিন্তিত মুখশ্রীতে হাসি ফুটে উঠলো। এরমধ্যে তানিয়া এসে ফ্লোরে বসে ঝুঁকে কাঁচের টুকরো তুলছে ধীরে ধীরে। আড়চোখে অরুণের দিকে লাজহীন অশ্লীল নজরে তাকিয়ে থাকে। অরুণ সেদিকে তাকানো তো দূর তোয়াক্কাই করে না। সুজন একবার চেয়েছিল আড়চোখে। বড় গলায় ব্লাউজ। বুকে আঁচল আছে তবে সেটা না থাকার মতোই! ঝুঁকে থাকার দরুণ বুকের বেশিরভাগই দৃশ্যমান। সে তৎক্ষণাৎ নজর ফিরিয়ে তওবা কাটে। ছিঃ ছিঃ কি বেহায়া নির্লজ্জ মহিলা! মি. আলম ধীমে সুরে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আর ওই ব্যাপারটা! তোমার কচি বউ..”

অরুণ উঠে দাঁড়ালো। মি. আলমের সামনে গিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঠাস ঠাস করে গালে দুটো থাপ্পর লাগায়। বুকের উপর এক পা তুলে চুলের গোড়া টেনে ধরে শক্ত করে। মি. আলম যেন ঘোরের মাঝে চলে যায়। কানটা এখনো ঝিঁ ঝিঁ করছে। গালটা জ্বলছে তীব্র ব্যাথায়। এরকম থাপ্পড় মায়ের জনমে খায়নি সে।

-” জা*নোয়ারের বাচ্চা! তোর *** সহ পুরো তোকে পিস পিস করে কেটে শকুনকে খাওয়াবো! তোর কলিজায় কত সাহস আজ দেখবো! শালা *****! *****”

সুজন মনে মনে কান বন্ধ করে। তার বস এতো সুন্দর করে গালি দিতে পারে সে জানতোই না! কাজের মহিলাটি ভয়ে দৌড় লাগায়! অরুণ মি. আলমের বুকে লাথি মেরে সিঙ্গেল সোফা সহ ফেলে দেয়। সুজনকে ইশারা করে মহিলাটির ব্যবস্থা করতে। সুজন নাক সিঁটকায়! ওই খারাপ মহিলাকে সে ধরতে পারবে না। তবে বসের আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই। অগত্যা মহিলাটির পিছনে যায়। দেয়াল ঘেঁষে পড়ে থাকা ব্যাটটা তুলে নেয় হাতে।

মি. আলম পড়ে গিয়ে ব্যাথা পায় বেশ! মোটাসোটা স্বাস্থ্য তার। উল্টে পড়ায় নাক ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। তবুও উঠে দাঁড়ালো।

-” ভুল করলি অরুণ সরকার! এই আশরাফুল আলমকে চিনিস না। তোর থেকে আমার হাত অনেক বড়!”

অরুণ এগিয়ে আসে, বাড়ন্ত ভুরিতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। গলায় পারা দিয়ে বলে,

-” তোর মতো **** দের কে না চেনে। বরং তুই চিনিস না এই অরুণ সরকারকে! চিনলে বোন জামাই শুকলা শু*য়োরের কথায় এই অরুণ সরকারের সঙ্গে লাগতে আসতি না! এই তুই নিজে একটা জা*নোয়ার ***! আরেকটা জানোয়ারের সাথে বোন বিয়ে দিয়েছিস! ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিস! **** দল!!”

মি. আলম কাঁশতে থাকে। অরুণ পা সরায় না। আরেকটু শক্তি খাটিয়ে পিষ্ট করে রাগে ক্ষোভে বলে,

-” তোর মতো চুনোপুঁটির সাহস দেখে আমি হতবাক! শালা আমার সাথে বাটপারি করে ব্লাকমেইল করিস! টাকা চাস! আবার হুমকি দিস! তাও আবার এরকম লেইম ঘটনাকে কেন্দ্র করে! মাথা ঘিলু টিলু নেই? আমার অর্ধাঙ্গীর নামে বাজে কথা বলিস! এই সবাইকে নিজের মতো ভাবিস যে বউকে অন্যের ঘরে পাঠাবে! শালা তোকে তো আজ…”

আজ বলে পেটে আরেকটা লাথি লাগায়। মি. আলম ছাড়া পেয়ে লম্বা শ্বাস টানলেও পেটে লাথি পড়ায় গুঙ্গিয়ে চিৎকার করে উঠল।এরমধ্যে সুজন চলে আসে। অরুণ কে উদ্দেশ্য করে মিনমিনে গলায় বলে,

-” বস কেউ জানতে পারলে কেস খেয়ে যাবো! জলদি একটা ব্যবস্থা করতে হবে!”

-” ওই স্ল্যা*টের কি করলে?”

সুজন দাঁত বের করে হাসে।

-” মাথায় একটা বারি দিয়ে পা’য়ে মেরেছি! এতেই বেহুঁশ! তবে চিন্তা করবেন না। মরবে না!”

অরুণ আলমের দিকে চায়। আলমের চিৎকার থেমে গেছে। ভয়ার্ত চোখে অরুণের দিকে চায়। অনেক কষ্টে উঠে অরুণের পা ধরে বসে পড়ে,

-” আমি কেস তুলে নেব! আর কখনো তোর ধারের কাছেও ঘেঁষবো না। মারিস না আমায়! আমায় মারলে কিন্তু তুই ও কেস খেয়ে যাবি!”

অরুণ লাথি মেরে সরিয়ে দিলো আলমকে! সোফায় বসে স্যুটকেস খুললো! স্যুটকেসের ভিতরের অস্ত্রপাতি দেখে সুজনের চোখ চড়কগাছ! গোটা তিনেক ছুড়ি, হেক্সা ব্লেড, এন্টি কাটার, স্ক্রু গজ, হ্যামার, কাঁচি, প্লাস, রেঞ্জ সহ আরো কিছু দেশি সরঞ্জাম পিস্তল তো আছেই। ওদিকে আলমের জান যায় যায় অবস্থা। সে দৌড়ে যায় দরজার দিকে। সুজনও দৌড় লাগালো। আলমের পায়ে লাথি মেরে ফেলে দেয়। আলম সিটকে পড়ে ফ্লোরে। মুখ নাক মনে হয় শেষ! চিৎকার দেয় গলা ফাটিয়ে। সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়ার দরুণ অসুবিধা হবে না। সুজন তাকে উঠিয়ে টেনে আনে! অরুণ কিছু রশি ও কাপড় দেয়, বাঁধতে বলে জানোয়ারকে! সুজন কাঁপা কাঁপা হাতে হাত, পা বাঁধে! মুখে কাপড় গুজে বেঁধে দেয়। অরুণ ছুড়ি সমেত উঠে যায় কিচেনে। চুলা জ্বালিয়ে তা’য়ে ছুড়ি ঠেকায়। ছুড়ির প্লাসিটের অংশে কাপড় পেঁচিয়ে ধরে। বেশ সময় নিয়ে ধরে রাখে।
সুজন দু বার এসে উঁকি ঝুঁকি দেয়। বস কিচেনে কি করছে? তার উত্তর সে পেয়ে যায়।

অরুণ আগুনের তায়ে লাল আভার রূপ পরিণত হওয়া ছুরি দুইটা নিয়ে আলমের সামনে বসে।‌ আলম মুখে কাপড় বাঁধা অবস্থায় ছটফট করতে থাকে। চোখের ইশারায় কতশত অনুরোধ অনুনয় বিনয় করে! অরুণ অগ্রাহ্য করে। সুজনকে আদেশ করলে সুজন আলমকে উল্টে শুইয়ে দেয়। ট্রাওজার ও আন্ডারওয়্যার নিচে নামিয়ে নিলে অরুণ আলমের নিতম্বের উপর গরম ছুরিদ্বয় চেপে ধরে। আলম ছটফট করে গলা কাটা মুরগীর মতো! মুখে কাপড় গুঁজে বেঁধে দেওয়ার দরূণ চিল্লাতে পারে না তবে উ উ শব্দে কাঁদতে থাকে। বাঁধা হাত দিয়েই অরুণের পা চেপে ধরে অনুনয় চোখে ক্ষমা চায়! প্রাণের ভিক্ষা চায়! অরুণ নির্বিকার! অসহ্য রকম যন্ত্রণা, ব্যাথায় আলম জ্ঞান হারায়!
অরুণ ছেড়ে দেয়। খানিক সময় পর কারেন্টের শখ দেয় অল্প ভোল্টেজের ।আলম ধরফরিয়ে ওঠে! কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোর ঘেঁষে এসে দন্ডায়মান অরুণের পা ধরে উ উ করে। অরুণ ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয়। সুজনকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” শালার কাপড় খোল! ছোটটা বাদে সব! দেখি শালার কত তেজ!

বলে স্মরণ করে গতকালের ফোন আলাপকালে আলমের বলা লাস্ট কথা ‘অরুণ বুড়ো হয়ে গেছো! কচি বউ হ্যান্ডেল করতে পারবে না আমার কাছে পাঠিয়ে দিও!’
শালা ওয়েট কর হ্যান্ডেল করাচ্ছি তোকে!
সুজন চোখ বড় বড় করে অরুণের দিকে চায়। যার অর্থ এখন কি করবেন বস? অরুণ চোখ রাঙায়! সুজন ঢোক গিলে কাপড় খোলার চেষ্টা করে। হাত পা বাঁধা থাকায় বিরক্ত হয়ে বলে,

-” বস হাত পা বাঁধা খুলবো কি করে?”

অরুণ একটা কাঁচি দেয়! সুজন হেসে কাঁচি দিয়ে কাপড়চোপড় কেটে ফেলে খুলে নেয়। লোকটার পরণে শুধু ছোট আন্ডারওয়্যার! অরুণ বাঁকা হেসে সুজনকে বলে,

-” তোমার ফোনের ক্যামেরা ভালো না? ভিডিও অন করো! ফাস্ট!”

সুজনের চোখ রসগোল্লা হয়ে যায়। ভিডিও করবে মানে? বস কি করবে এই পেটমোটা আলমের সাথে? তবে সে ফোন বের করে ভিডিও অন করে ক্যামেরা তাক করে আলমের দিকে।
অরুণ শার্টের হাত ফোল্ড করে স্যুটকেস থেকে হ্যামার ও প্লাসটা তুলে নেয় হাতে‌। আলমের দিকে এগোতে এগোতে বলে,

-” আগে তোর সার্জারি করে নিই তারপর তোর বোন জামাই শুকলাকে করবো! ডার্লিং নড়াচড়া বা ছটফট করলে কেল্লাফতে পাঠিয়ে দিবো! তাই সাবধান!”

আলমের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মাথা নেড়ে না না ইশারা করে! ছটফট করতে থাকে।
______

তপ্ত বিকেল বেলা। সূর্যিমামার দেখা নেই। মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। আবছা কালো মেঘমল্লারের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে দীগন্তের বুক জুড়ে। পাখির দল উড়ে বেড়াচ্ছে। শুনশান পরিবেশে ঝগড়া করছে দুই সখি! পাতাবাহার ও পাতাবাহার! আনিকা ও ভোর নীরব দর্শক। পাতা ঝুঁকে বিড়ালটার কান মলে দিলো। বিড়ালটি মিও মিও‌ বলে তেড়ে আসে। পাতা হাতে স্কেল তুলে নিয়ে বলল,

-” আর এক পা এগো তোকে সহ তোর মালিকের ঠ্যাং ভেঙে বসিয়ে রাখবো!”

বিড়ালটি কি বুঝলো কে জানে। তবে আগালো না‌। ভোরের পায়ের কাছে গিয়ে মিও মিও করে ডেকে অভিযোগ শোনালো যেন! ভোর তাকে কোলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে। বিড়ালটি চুপটি মেরে যায়।

-” আম্মু হয়েছে ওকে আর বকো না! ও আর খামচি দেবে না!”

-” আবার দিলে ওর সবকটি নখ আমি কেটে দিবো। হতচ্ছাড়া বিড়াল!সবসময় আমার পিছনে লাগা!”

পাতার কথায় বিড়ালটি ভোরের পেটে মুখ লুকায়। পাতা গাল ফুলিয়ে বসে পড়লো সোফায়। একটু আগে সে অরুণ সরকারের আলমারিতে তাক ঝাঁক করছিলো। এটা ওটা বুলিয়ে দেখছিলো! তারপর গ্রিন কালারের একটা টি শার্ট নিয়ে শাড়ির উপড়েই পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়! দেখছিলো লোকটার টি শার্টে তাকে কেমন লাগে। হঠাৎ কোত্থেকে বিড়ালটি এসে হামলা করে। পায়ে নখ বসিয়ে দেয় পাতার। পাতা ঘাবড়ে যায় সাথে আচর লেগে কেটেও যায়। রক্ত পড়ছিলো! পাতা চটজলদি স্যাভলন ভিজিয়ে তুলো দেয়। রক্ত পড়া বন্ধ হলে টি শার্ট খুলে রেখে বিড়ালটিকে খুঁজে বের করে। শালার বিড়াল! তার জামাইয়ের টি শার্ট সে পড়েছে তাতে ওই বদ বিড়ালের এতো জ্বলেছিল কেন?
ভোর বিড়ালটিকে খাঁচায় পুরে বন্দী করে রাখে। আনিকা পাতার পাশে বসে দুঃখি গলায় বলল,

-” চাচিমনি বেশি লেগেছে? ব্যাথা করছে?”

পাতা মুচকি হেসে আনিকাকে কোলে বসিয়ে গালে চুমু খায়।

-” না কিউটি! একটুও লেগেছে ব্যথা করছে না!”

ভোর এসে পাতার পায়ের কাছে বসে। আঁচড় লাগা জায়গা লাল হয়ে ফুলে আছে। একটু একটু রক্ত লেগে আছে সেখানে। ভোর সেথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” আব্বু আসলে বলবো ওই পঁচা পাতাবাহারকে রেখে আসতে।”

পাতা আনিকাকে পাশে বসিয়ে পা তুলে বসে সোফায়। ভোরকেও টেনে পাশে বসায়। ভোরের মলিন গাল টিপে বলে,

-” থাক রেখে আসতে হবে না! ওতটাও লাগে নি!”

ভোর পাতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। এরইমধ্যে আদুরি আসে। পাতাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,

-” বড় ভাবী তোমার আব্বু এসেছে। সাথে তোমার দুলাভাই। তবে তোমার ভাইটি আসে নি! ”

পাতা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” সত্যিই?”

-” হুম! বিশ্বাস হচ্ছে না?”

ভোর পাতার কোল থেকে মাথা তোলে। পাতা খুশি হয়ে উঠে দাঁড়ালো।তারপর ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে! ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো সত্যিই এসেছে। আব্বু, দুলাভাই ও লাবিব! সে গিয়ে হাসিমুখে বলল,

-” আব্বু ভালো আছো? দুলাভাই, বোনের ছেলে তোমরা ভালো আছো? এতদিন পর আমাকে মনে পড়লো?”

হাসিমুখে বললেও চোখ জোড়া চিক চিক করছে আনন্দে। কতদিন পড়ে সকলের সাথে দেখা! রিসেপশনের পর দুই তিনবার ফোনে কথা হয়েছে শুধু! তাও শুধু আম্মু ও লুব ভাইয়ের সাথে।
লাবিব দৌড়ে গিয়ে পাতাকে জড়িয়ে ধরে। রাতুল ভুঁইয়া মুচকি হেসে বলল,

-” আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো পাতা?

পাতা মাথা দোলায়। আতিকুর ইসলাম পাতাকে দেখে। মেয়েটা হাসছে অথচ চোখে পানি। লাবিবকে কোলে তুলে আদর করছে। আড়চোখে তার দিকেও চাইছে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” তুমি কেমন আছো? জামাইকে দেখছি না! অফিসে? আর ওই পিচ্চি?”

পাতা লাবিবকে নামিয়ে দিয়ে আতিকুর ইসলামের পাশে দাঁড়ায়।

-” আব্বু আমি ভালো আছি! উনি অফিসে। আর ভোর ওই তো?”

আদুরি ভোরকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে। ভোর তার কোলে উঠে পিটপিট করে চেয়ে আছে সবার দিকে। ওরা কি আম্মুকে নিয়ে যাবে? আদু ফুপ্পি তো তাই বলল! না, সে তার আম্মুকে নিয়ে যেতে দেবে না।
আতিকুর ইসলাম ভোরকে ডাকে। ভোর কোল থেকে নেমে গুটি গুটি পায়ে পাতার পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। আতিকুর ইসলাম সোফা থেকে উঠে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” কেমন আছো ভোর?”

-” ভালো আছি আঙ্কেল! আপনি কেমন আছেন?”

-” ভালো!”

এরমধ্যে আসমা বেগম আসেন ড্রয়িং রুমে। কোলে ছোট রূপ! আতিকুর ইসলাম সহ রাতুলের সাথে কুশল বিনিময় করেন। মিনুকে মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে মেহমানদের সাথে আলাপ চারিতায় বসে। কথার ফাঁকে রাতুল বলে পাতাকে নিতে এসেছে তারা। বিয়ের পর মেয়ে বাবার বাড়ি নাইওর যাবে না? আসমা বেগম হাসিমুখে সায় জানালো ! অস্বীকার করে না!
_____

পাতা নিজের রুমে বসে লাগেজ গোছাচ্ছে। বিয়ের পর প্রথম বার যাবে বাবার বাড়িতে! প্রচন্ড উত্তেজনায় খুশিতে মনটা নেচে উঠছে যেন। যতই অবহেলিত হোক, তার বাপের বাড়ি ওটা! টান আছে না?
ভোর ও লাবিব বিছানায় বসে আছে। লাবিব টুকটাক কথা বলছে কিন্তু ভোর চুপচাপ গম্ভীর মুখে। আম্মু তাকে রেখে যাবে? ওই বাড়িতে গিয়ে তাকে ভুলে যাবে? ওই লাবিবকে আদর করবে? লাবিবের বোনকেও?
পাতা ব্যাগপত্র গুছিয়ে অরুণকে ফোন লাগায়। সব প্যাকিং শেষ। তার ও ভোরের জামা কাপড় সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র! ভোরের বাবারও গোটাকয়েক টি শার্ট প্যান্ট নিয়েছে। এখন শুধু লোকটার থেকে পারমিশন নেওয়া বাকি! আচ্ছা লোকটাকি মানা করে দেবে! পাতা দুরু দুরু বুকে কল লাগায়। লোকটা কল কেটে কিছুক্ষণ পর কল করে। পাতা রিসিভ করে হ্যালো হ্যালো বলে। ওপাশ থেকে কিছু শোনা যাচ্ছে না।

-” হ্যাঁ বলো পাতাবাহার!”

সেকেন্ড বিশ‌ পরে অরুণের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পাতার মুখশ্রীতে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।

-” কোথায় আপনি?”

-” অফিসে! কেন?”

-” না! ওই আসলে আব্বু, দুলাভাই এসেছে!”

-” কখন?

-” হুম! এই ঘন্টা খানেক হবে এসেছে! আমাকে নিতে এসেছে বলল!”

-” ভালো!শুনো তাদের আপ্যায়নে যেন কোন কমতি না হয়!””

পাতা খানিক ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল,

-” আপনি আসুন না প্লিজ? আব্বু দুলাভাই আপনার কথা জিজ্ঞেস করলো অনেকবার!”

ওপাশে নীরবতা। পাতা ‘হ্যালো’ বলতেই আবার ভেসে আসে গম্ভীর কন্ঠস্বর,

-” আমি আসতে পারবো না। ব্যস্ত আছি!আশা করি বুঝতে পারবে!”

পাতা বুঝলো। লোকটা অফিসের ঝামেলা নিয়ে এখনো ব্যস্ত।

-” হুম! তাহলে আমরা কি করবো? যাবো ওখানে?”

-” পারমিশন চাইছো?”

-” আপনি বললে যাবো! নইলে যাবো না! এখন আপনি ডিসাইড করুণ!”

অরুণ হাসে। এরকম কিউট ভঙ্গিমায় বললে মানা কিভাবে করবে?

-” আচ্ছা যাও! কলিজাটার খেয়াল রেখো সাথে নিজেরও!”

পাতার খুশি ডাবল হয়।

-” হুম! আপনি কিন্তু অফিস থেকে রাতে ওখানে যাবেন! আমি অপেক্ষা করবো!”

বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে কল কেটে দিলো! তারপর ভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ভোর আমরা নানু বাড়ি যাচ্ছি! অনেক মজা হবে!”

কিন্তু ভোরের মুখে হাসি নেই। সে গোমড়া মুখে গাল ফুলিয়ে বলল,

-” তো যাও! আমায় বলছো কেন? আমাকে তো আর নিবে না তোমার নানুর বাড়িতে!”

পাতা ভোরকে টেনে কোলে তুলে নেয়। গালে ঠোঁট চেপে চুমু দিয়ে বলে,

-” আমার পাগল আব্বাজান! আমরা আপনার নানুর বাড়িতে যাচ্ছি! আর আপনাকে নেবো না তাই হয় নাকি! আমি আর তুমি যাচ্ছি!”

ভোরের গোমড়া মুখশ্রীর আবডাল জুড়ে হাসির পুষ্প ফুটে উঠল। পাতার গলা জড়িয়ে গালে মুখে আদর করে মিষ্টি মিশিয়ে ডাকে,

-” আই‌ লাভ ইউ আম্মু!”

চলবে….

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৬
(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

পুরো সরকারি জুয়েলারি ফ্যাশন হাউস বন্ধ। মানে ছুটিতে আছে বসের অর্ডারে। সকালেই নোটিশ দেয়া হয়েছে।‌সাথে শনিবার তরি পূর্বের মাফিক পুরো দমে অফিসে আসার আহ্বান। ধরনী সন্ধ্যার কবলে। মাগরিবের আজান হয়েছে একটু আগেই। অরুণসহ সুজন, আরিয়ান, রাসেল ও জীবন অফিসের ছোট মসজিদে নামাজ পড়ে নেয়। নামাজ শেষ হলেই গ্রাউন্ড ফ্লোরে গেস্টদের জন্য বরাদ্দকৃত ওয়েটিং রুমে বসে। জীবন বাদে সবাই উপস্থিত। অরুণ সোফায় গা এলিয়ে টি টেবিলে পা রেখে হামি তুলে। আরিয়ান সামনে দাঁড়িয়ে বকর বকর করে কানের পোকা বের করে দিলো বলে। আরিয়ানের সাথে রাসেলও কম যায় না। রাসেলের হাতে সুজনের ফোন। আলমের ভিডিও দেখছে আর তাকে বকছে।অরুণের সেসবে ভাবান্তর নেই। সে বকাগুলো এক কান দিয়ে শুনছে অপরকান দিয়ে বের করে দিচ্ছে। সুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কর্মকাণ্ড দেখছে। এক পর্যায়ে জীবন চলে আসে। হাত তার ভর্তি। একটা ব্যাগ অরুণের কাছে দিলো। অরুণ সেগুলো সরিয়ে রাখে। আরিয়ানের ঘোর সন্দেহ হয়। ব্যাগে কি আছে? সে গিয়ে ব্যাগটা একপ্রকার ছিনিয়েই নেয়! খুলে দেখে বেশ কয়েকটা লেইস চিপসের ফ্যামিলি প্যাক, আরো বিভিন্ন চিপস, চকলেটস, ক্যাডবেরি, সুইটস, কুকিজ, আর ড্রিম কেকের বক্স! অরুণ গম্ভীর চোখে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” পেলি কিছু?”

আরিয়ান সব গুছিয়ে ব্যাগে ভরে। সে ভেবেছিল বিয়ার টিয়ার আনিয়েছে হয়তো! মাতালদের ভরসা নেই কি না! সে আমতা আমতা করে বলল,

-” না! মানে এগুলো দিয়ে কি করবি?”

-” শশুর বাড়ী যাবো একটু পর! তাই!”

শান্ত গলা অরুণের। সুজন চিন্তিত গলায় বলল,

-” বস শশুর বাড়ি এগুলো নিয়ে যাবেন? শশুর বাড়ি যেতে পান সুপারি, নানা রকম মিষ্টি, দই, বড় বড় তিন চারটা মাছ, ফল ফলাদি….”

জীবন তাকে থামিয়ে বললো,

-” খুব এক্সপেরিয়েন্স দেখছি! বিয়ে করেছো?”

সুজন খানিকটা লাজুক হেসে মাথা দোলায়।

-” বাহ্ বাহ্। খুব ভালো কাজ করেছো! ফরজ কাজ করেছো! কয়টা বিয়ে করলে?”

কথার ছলে ফেলে অন্য হাতের ব্যাগটা কৌশলে আরিয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে টি টেবিলের নিচে লুকিয়ে নিলো। সুজন হেসে বলল,

-” কি যে বলেন না ভাই! একটাই সামলাতে পারি না! কয়টা!!!”

জীবন হো হো করে হেসে উঠলো। অরুণ মুচকি হাসে। তার হাসি দেখে রাসেল কটমট করে তাকালো।

-” শালা খুব হাসি বেরোচ্ছে? কি একটা কান্ড করে এলি দুজন যদি ধরা পরতি? আর এই সব.. কি সব !! এতো শয়তানি বুদ্ধি আসে কোথা থেকে?”

মোবাইল অরুণের দিকে তাক করে বলে। অরুণ ফোনে প্লে লিস্টে আলমের ভিডিও দেখে ফোনটা কেড়ে নেয়। অফ করে সুজনের দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” এটা তোমার হেফাজতে রাখলাম!”

সুজন ফোনটা নিয়ে পকেটে পুরে। আরিয়ান অরুণের পাশে বসে বললো,

-” ভাই এসব কি? এখন যদি ওরা আবার কেস করে? কি হাল করে ছেড়েছিস শয়তানটার! একটা জখমও মানুষকে দেখানোর জো রাখিস নি!”

-” ওতটাও সাহস নেই! আর করলেও অরুণ সরকার দেখে নেবো! সেফটি গার্ড হিসেবে ভিডিও আছে তো!তোরা এখন যা তো! তোর বউ অপেক্ষা করছে!”

জীবনের কথায় অরুণ তার দিকে চায়। জীবন দাঁত কেলায়। রাসেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-” আমি তো সারাটা দিন বুকে হাত দিয়ে বসেছিলাম কখন না শালা কেস খাওয়ায়! পিস্তলটা যে আমারি!”

-” ওটা তো শো অফ করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম আর তাছাড়াও খানিকটা সেফটি গার্ড হিসেবে। ওর কাছে যদি অস্ত্র থাকতো? তাই! আর তোরা এখন এসব বাদ দে তো! ভালো লাগছে না এসব কথা কখন থেকে ঘ্যান ঘ্যান করছিস মাছির মতো!”

বিরক্ত হয়ে বলে অরুণ। আরিয়ান হাত ঘড়িতে সময় দেখে। সাতটা বেজে দশ! বাড়ি ফিরতে হবে জলদি!

-” ভাই আমি কি চলে যাবো? তুই তো শশুর বাড়ি যাবি!”

অরুণ কিছু বলবে এর আগে জীবন চটজলদি বলে,

-” হ্যাঁ হ্যাঁ তুই যা জলদি যা ভাই!”

তার তাড়া দেখে আরিয়ানের সন্দেহ হয়। কিছু তো গন্ডগোল আছে। তাকে তাড়ানোর এতো জলদি কিসের? তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে জীবন খানিকটা এলেবেলে হয়ে যায়‌। মনটা দুরু দুরু করে ব্যাগটা না দেখে নেয়! পা বাড়িয়ে টি টেবিলের নিচে ব্যাগটা আরেকটু ভিতরে রাখে। চতুর এডভোকেট আরিয়ান সরকারের চোখে ধরা পড়ে ব্যাপারটা। ঝুঁকে ব্যাগটা নিজের কাছে নেয়। ব্যাগ খুলেই সে হতাশ! না এদের কিচ্ছুটি হবে না। আরিয়ান বিয়ারের চারটা বোতল ও চিপস, চানাচুরের প্যাকেট গুলো টি টেবিলে রেখে বল,

-” তোমরা সুধরাবে না, না? কুকুরের লেজ সোজা হবে তবুও তোমাদের মতো মাতালদের মদ খাওয়া শেষ হবে না!”

জীবন তড়িৎ বেগে এসে বিয়ারের বোতল গুলো নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,

-” মাতাল কাদের বলছিস? আমরা মদ খাই না! শুধু মাঝেমধ্যে হ্যাংআউটের জন্যা দু এক সিপ এই এনার্জির ওষুধ খাই!”

অরুণ চুপচাপ গম্ভীর। শালা আবার এসব কেন নিয়ে এসেছে? সে তো এসবের থেকে দূরেই ভাগতে চায়। প্রতিবার ভাবে আর খাবে না। কিন্তু কোনো না কোনো উছিলায় সামনে আসে আর লোভী মনটা আঁকুপাঁকু করে একটু চেখে দেখতে। অরুণ নিজের মনকে কষিয়ে ধমক লাগিয়ে জীবনকে ধমকে বলে,

-” এই শালা চুপ! নামাজ শেষ ওমনি শয়তান হাজির! নামাজে দাঁড়িয়ে এটাই ভাবছিলি? শালা তোদের দেখে তো শয়তানও ভয় পাবো! যখনই ভাবি আর জীবনেও ওসবে হাত লাগাবো না তখনই হাজির হোস এসব নিয়ে!”

অরুণের ধমকে জীবনের কপালে ভাঁজ পড়ে। বাহ্। ভূত পড়ছে ভূত তাড়ানোর মন্ত্র!! আরিয়ান ভাইয়ের দিকে ত্যাছড়া নজরে তাকিয়ে বলল,

-” বাহ্ ভাই! সূর্য আজ কোন দিকে ডুবলো? চোর চোরকে চুরির জন্য ধমকাচ্ছে! সে যাই হোক জীবন ভাই? দাও তোমার এনার্জেটিক ওষুধ গুলো! সব কমোডে ঢালবো। তার নাকি পেট খারাপ! এই ওষুধে ঠিক হবে না?”

জীবন গম্ভীর মুখে কাটকাট গলায় বলল,

-” এই জীবন জীবন থাকতে জীবনেও এগুলো তোর হাতে দিবে না। আমার কতগুলো টাকা! তুই সুদ্ধ পুরুষ যা ফুট!”

-” গিলো! বেশি করে গিলো! আমি তৃপ্তি ভাবিকে ফোন করে সব বলবো!”

-” যা যা! তোর তৃপ্তি ভাবিকে আমি ভয় পাই নাকি!”

-” সে দেখা যাবে! আর ভাই তুই যদি এসব গিলেছিস তোর আম পাতা জোড়া জোড়ার কানে সব খবর যাবে!”

বলেই চলে যায়! জীবন পুনরায় বিয়ারের বোতল সব টি টেবিলে রেখে বলে,

-” দেখেছিস অরুণ? বড় ভাবিকে সম্মান দিতে যানে না।আর তুইও বলি হারি এই চুনোপুঁটির ঝাড়ি খাস!! আগে না খুব খিল্লি উড়াতি! এখন এতো ভালোবাসা?”

রাসেল খপ করে একটা বিয়ারের বোতল তুলে নিয়ে বলে,

-” কথা ঠিক! দুশমন কি করে বন্ধু হলো?”

অরুণ টি টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসে। শান্ত গলাতেই বললো,

-” আগে ওকে দেখলেই গা জ্বলে উঠতে রাগের মাত্রা তরতর করে বেড়ে যেতো! সহ্যই করতে পারতাম না। ওর ক্ষেত্রেও একি ঘটনা ছিলো। এখন বুঝতে পারি আরিয়ান ওতটাও বিরক্তিকর নয়। ভালো ছেলে। আর শাসন ঝাড়ির কথা বলছিস? ও যখন বকে বা শাসন করে!ঝাড়ি দেয় মনে হয় আব্বু বকছে আমাকে। আব্বুও এভাবেই বকতো! ভালো লাগে খানিকটা!”

কথা শেষ করে মুচকি হাসলো। জীবন ও রাসেল খানিকটা ইমোশনাল হয়ে যায়। আর সুজন তো পুরোই ইমোশনাল বনে গেলো। তবে জীবন ইমোশনকে বাদ দিয়ে অরুণের দিকে বিয়ারের বোতল বাড়িয়ে বলল,

-” হয়েছে ইমোশনাল কথাবার্তা! ওসব শুনলে হাসি পায়! ধর ওষুধ খেয়ে নি?”

অরুণ বিয়ারের বোতলের দিকে পিট পিট করে চায়। খাবে কি? বেশি না এক সিপ খাবে! আবার ভাবে এক সিপ বললেও এক সিপে কিছু হবে না তার। বেহায়া মন আরো লোভী হবে।

-” খাবো না আমি! তোরা এনজয় কর! আর সুজন অফিসে নজর বুলিয়ে লক করে বের হবে! বেশি গিলবে না। আসছি!

অরুণ ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। শু পড়ে ব্যাগটা নিয়ে একপ্রকার ছুটে চলে গেল দোয়া দরুদ পাঠ পাঠ করতে করতে!
_____

-” কি হয়েছে টাকি তোর পাতা? ভালোভাবে কথা বলছিস না কেন আমার সাথে?

-” আপু কই কথা বলছি না! ভালোভাবেই তো বলছি!”

পাতা শান্ত ভাবে উত্তর দিলো। কিন্তু লতা জ্বলে উঠলো যেন। রিসেপশনের পর থেকে প্রতিদিন পাঁচ ছয় বার কল করেছে। পাতা একবারও রিসিভ করে নি। এখন ঢং চলছে? সে রাগে গজগজ করতে বলে,

-” দেখ পাতা একদম ফুটেজ খাবিনা। কি হয়েছে? তোর বুইড়া জামাই কি বলেছে আমার নামে? বল?”

পাতা খানিকটা বিরক্ত হয়। কথায় কথায় বুইড়া জামাই বলে আপু কি বুঝাতে চায়! মজা করে বলে? কিন্তু এই মজাটা ভালো লাগে না তার। আর সে সাবধানও করেছে। পাতা বিরক্তিকর সুরেই বললো,

-” কি বলবে উনি আমায়? কিছু বলে নি।”

-” তাহলে ফোন ধরিস নি কেন আমার?”

-” খেয়াল করি নি!”

লতা হাসে।

-” বাহ্ খেয়াল করিস নি! বুইড়া জামাইয়ের খেয়ালে এতো ডুবে ছিলি যে প্রত্যেক দিনই আমি তিন চারবার করে কল করেছি আর তুই খেয়ালই করিস নি!”

পাতা বোনের দিকে চায় শান্ত দৃষ্টিতে।

-” মানছি সে তোমার ছোট বোনের জামাই বাট উনি তোমার সিনিয়র!! বুইড়া কেমন ভাষা আপু?”

রাতুল, লুবমান, কাওছার, পাবেল, প্রিয় হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। কাওছার, প্রিয়, পাবেল সকালে এসেছে। তাদের প্রিয় পাতা আপু আসবে শশুর বাড়ি থেকে আর তারা আসবে না? লতা থমথমে মুখে তাদের দিকে তাকায়। তাকিয়েই হেসে ফেললো। সবার হাসিতে একতলা বাড়ির পুরো ছাঁদ কেঁপে উঠলো যেন। একটু দূরে খেলতে থাকা লাবিব ভোর ঘার মুড়িয়ে একপল তাকিয়ে পুনরায় খেলায় গভীর মনোযোগ দিল।
পাতার মুখে হাসির লেশটুকুও নেই। ওদের নিকট ব্যাপারটা মজার হলেও পাতার ক্ষেত্রে না। জানে সবাই মজা করছে! লেগপুল করছে! তবুও প্রতিবার বুইড়া বলে কি বোঝায় যে, পাতা তোর বুড়োর সাথে বিয়ে হয়েছে! লোকটাকে কেমন অবজ্ঞার সুরে অপমান করছে মজার সুরে। আর সবচেয়ে বড় কথা লোকটার সম্মুখে এসব বললে কেমন দেখাবে ব্যাপারটা! উনি কিভাবে নেবে? পাতা কিছু বলে না। চুপচাপ চলে আসতে চাইলে কাওছার হাত ধরে আটকালো। রাতুল হাসি থামিয়ে বলল,

-” আরে পাতা রেগে যাচ্ছো কেন? আমরা সবাই মজা করছি! আর দেখছি জামাইয়ের প্রতি তোমার কত টান!”

লুবমান পাতার মাথায় টোকা দিয়ে বলল,

-” এভাবে জামাই পাগল হলে হবে? লতা আপুর মতো জামাইকে পাগল বানাতে হবে! তবেই না জমবে সংসার!”

রাতুল লুবমানের পিঠ চাপড়ে বলল,

-” শালাবাবু এভাবে বলতে পারলে দোয়া করে দিলাম এর থেকেও দজ্জাল বউ জুটবে তোমার কপালে! তোমাকে পুতুল নাচ নাচাবে!”

-” শকুনের দোয়ায় গরু মরে না দুলাভাই!”

প্রিয় হেসে বলল,

-” তোমরা ইন ডিরেক্টলি লতা আপুকে দজ্জাল বললে!”

রাতুল প্রিয়র দিকে তাকিয়ে বলল,

-” কোনো সন্দেহ আছে তোমার! আমি ডিরেক্টলি বলছি তোমাদের বোন দজ্জাল বউ! উঠতে বসতে ঝাড়ি! কথা বলাই যায় না। আগে জানলে লতা ছেড়ে পাতার জন্য প্রস্তাব পাঠাতাম। এরকম জামাই পাগল বউই তো সব ছেলে চায়! বুড়ো বলেছে বলে কেমন ক্ষেপে গেল! আর আমারটা কি না কি বলে গালি দেয় অনবরত!”

বাকি সবাই হাসে। লতা চোখ রাঙানি দেয় রাতুলকে। রাতুল তোয়াক্কা করলো না এবার। সবাই হাসলেও পাতার মুখশ্রী হাসি বিহীন।
পাবেল এগিয়ে এসে পাতার কাঁধ জড়িয়ে বলল,

-” আপু! রাগ করছিস কেন? আচ্ছা বলবো না। এখন বল কেমন চলছে তোর সংসার জীবন? ”

-” ভালো!”

পাতার ছোট্ট জবাব। কাওছার ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-” তোর জামাই কেমন? মানে ভালো টালো বাসে? আদর যত্ন করে?”

-” করে!”

রাতুল ঠোঁট চেপে হেসে বলল,

-” করবে না বুড়ো বয়সে ছোট সুন্দরী বউ! মাথায় তুলে রাখার কথা!”

পাতা কিছু বলে না। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। লতা রাতুলকে ধমকে বলে,

-” তোমার সাহস তো কম না পাতার জামাইকে বুড়ো বলছো! দেখো কেমন সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছে!”

বলেই হেসে উঠলো। প্রিয় এসে পাতাকে জড়িয়ে বলল,

-” লতাপু হয়েছে আপুকে আর লেগপুল করো না তো! বেচারি গাল ফুলিয়ে আছে!”

পাতা প্রিয়র থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে চলে যাবে। তবে এবার লুবমান আটকালো।

-” আরে পাতু! তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? আগে তো রাগ করতিস না কোনো কথায়! বিয়ের পর চেঞ্জ হয়ে গেলি? সাথে আমাদেরও ভুলে গেলি!”

-” রাগ করি নি। আর না ভুলেছি তোমাদের! রাত অনেক হয়েছে নিচে যাই!তোমরাও চলো?”

সবাই সায় জানালো। সত্যি রাত হয়েছে বেশ। নটা দশ বাজে। প্রিয় বলল,

-” নিচে গিয়ে সবাই কার্ড খেলবো! আইডিয়া কেমন?”

রাতুল হাই তুলে বলে,

-” মন্দ না। ঠিকঠাক! চলো পিচ্চি শালিকা!”

সবাই নেমে গেল। লাবিব জেদ করে যাবে না! সে খেলবে ভোরের সাথে। লতা লাবিবকে টেনে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো; লাবিব চেঁচাচ্ছে। ছাদে পাতা ও ভোর! ভোর ছাদে বিছানো পাটিতে বসে লাবিবের চিৎকারে হাসছে মিটমিট করে। পাতা গিয়ে ভোরের সামনে দাঁড়ায়।

-” চলো ভোর নিচে যাই!”

ভোর উঠে দাঁড়ালো। হাফপ্যান্ট ঝেড়ে বলল,

-” আম্মু আব্বু কখন আসবে? ফোন করেছিলে?”

পাতা ভোরের দিকে তাকায়। লোকটা কি আসবে আদৌ? সে কল করে নি! করলে যদি মানা করে দেয়; বলে যে আসবে না। তাহলে? আর লোকটাও তো ফোন করে বলে নি যে আসবে না। তার মানে আসার চান্স আছে। সে ভোরের হাত ধরে হাঁটা দেয়।

-” আসবে তো! এই এলো বলে! ”

ড্রয়িং রুমে আড্ডা জমে ক্ষীর। কার্ড খেলার সিদ্ধান্ত বদলে গেছে। ডায়নিং টেবিলের ওপাশে রান্নাঘরের পাশে অল্প ফাঁকা জায়গায় চেয়ার পেতে সকলে মিলে গানের কলি খেলছে। দুই দলে বিভক্ত হয়েছে সবাই। পাতা, কাওছার, পাবেল, রাতুল অন্য দলে লতা, লুবমান, প্রিয়! দু দলের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কেউ কারো থেকে কম না। লতার দলে সদস্য কম হলেও পয়েন্টে শীর্ষে। কিশোরী প্রিয়র গানের সাথে বেশ সম্পর্ক। গানের গলাও ঠিকঠাক। পাতাদের দলও কম যায় না। রাতুল ভুঁইয়া গান সম্পর্কে এক্সপার্ট। গানের গলাও প্রশংসাযোগ্য। সব মিলিয়ে সবাই বেশ এনজয় করছে। এমনকি পাতাও। তার মনটাও ফুরফুরে। একটু আগের সকলের কথা ভুলে আড্ডায় মেতে উঠেছে।এরইমধ্যে লাবনী আক্তার এসে জিজ্ঞেস করে অরুণ কতদূর? পাতা আমতা আমতা করে! কি‌ জবাব দেবে। তার তো কথাই হয় নি। তবুও বলে আসছে।

ভোর লাবিবের সাথে সোফায় বসে ফোনে গেম খেলছে। ভোর লাবিবের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে অল্প সময়ে। হবে না? ভোর লাব্বু ভাইয়া, লাব্বু ভাইয়া বলে এমন মিষ্টি করে ডাকে লাবিব যেন গলে আইসক্রিম বনে যায়। আতিকুর ইসলাম ঘর থেকে বেরিয়ে আসে নাতনি রুম্পাকে কোলে নিয়ে। ভোরের পাশে বসে রুম্পাকে ফ্লোরে নামিয়ে দিলো! রুম্পা ভোরের পা ধরে উঠে দাঁড়ালো। ভোরের হাতে ফোনটা টেনে ‘দা দা’ বুলি আওড়ায়। মানে ফোন দাও! ভোর ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে বলল,

-” দেব না! আমি খেলছি দেখতে পাচ্ছো না? যাও?”

রুম্পা কেঁদে উঠলো শব্দ করে। আতিকুর ইসলাম কোলে তুলে নেয়। রুম্পা শান্ত হয় না। ভোরের চুলের মুঠি ধরে টেনে ধরে। লাবিব উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-‘ বুনু ছেড়ে দাও! ভাইকে ছেড়ে দাও?”

রুম্পা ছাড়ে না বরং আরো শক্ত করে ধরে। আতিকুর ইসলাম হাত ছাড়িয়ে নিতে নেয় রুম্পা ছাড়ে না। ভোর চুপ করে বসে তবে আঁখি জোড়া এই ভরে উঠলো বলে! ফোনটা সোফায় পড়ে গেছে। পাতা ওপাশ থেকে লক্ষ্য করে দৌড়ে উঠে আসে। রুম্পার হাত থেকে ভোরের চুল গুলো ছাড়িয়ে দিয়ে কোলে তুলে নেয়। আতিকুর ইসলাম ভোরকে জিজ্ঞেস করে,

-“ওকে বকে দেবো! ব্যাথা পেয়েছো ভোর?”

ভোর না বোধক মাথা নাড়ে। তবে সে ব্যাথা পেয়েছে।এমন শক্ত করে চুল টেনে ধরেছে! ব্যাথা পাবে না? পঁচা বাঁদর মেয়ে। নাকের পাটা ফুলিয়ে ভোর পাতার দিকে চায়। ব্যাথা সে পেয়েছে অথচ আম্মু ওই বাঁদর মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করছে!
পাতা রূম্পাকে আদর দিয়ে এটা ওটা বলে শান্ত করে! কোলে নিয়ে রান্নাঘরে যায়। একটা আইসক্রিম বাচ্চাটার হাতে দিয়ে তার মায়ের কোলে দেয়। ভোরের কাছে এসে দেখে ছেলে গাল ফুলিয়ে ঢোল বানিয়ে রেখেছে। সে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে কোলে তুলে নেয়।

-” ব্যাথা পেয়েছো?”

ভোর নাক টেনে জবাব দেয়,

-” অল্প অল্প!”

পাতা দু গালে চুমু দিয়ে বলল,

-” ছোট বাবু বোঝে না তাই ওমন করেছে! তবুও রুম্পাকে বকে দেবো! চলো ওখানে বসে গানের কলি খেলি?”

ভোর মাথা নাড়ল। পাতা তাকে নিয়ে কাওছারের পাশের চেয়ারে বসে পড়লো। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে রাখলো।

-” আম্মু? আব্বু কখন আসবে?”

পাতা কিছু বলবে কাওছার ভোরকে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে বলে,

-” আসবে না তোর বাবা! এসেছে থেকে শুরু করে দিয়েছিস আব্বু কখন আসবে!”

ভোরের চোখ টলমল করছে। সে পাতার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টায়। এখুনি কেঁদে দিবে। লুবমান কাওছারের কোল থেকে ভোরকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে গাল টিপে বলল,

-” তোর বাপকে তো ডাকাতরা ধরে নিয়ে চ্যাংদোলা করে পেটাচ্ছে! আর তোর বাপ ‘উরি মা’ বলে চিৎকার করে কাঁদছে!”

রাতুল পাশ থেকে বলল,

-” শুধু কি তাই? দড়ি দিয়ে বেঁধে ইয়া বড় বড় লাঠি দিয়ে ঠাস ঠাস করে মারছে…’

এ পর্যায়ে আর থামানো গেলো না ভোরকে। ঠোঁট উল্টিয়ে ‘আব্বু’ বলে কেঁদে উঠলো। চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় বর্ষণ হচ্ছে। পাতা এগিয়ে এসে কোলে নেয় ভোরকে।

-” দিলে তো ছেলেটাকে কাঁদিয়ে!! আর ভোর! বাবা কাঁদে না ! মামারা মজা করছে তোমার সাথে। তোমার আব্বু ঠিক আছে। এই তো আসলো বলে! কথা‌ বলবে? ফোন দিই?”

ভোর পাতাকে জড়িয়ে ধরে ফোপাতে থাকে। আব্বুর জন্য তার বুকটা কেমন করছে! তার আব্বুকে চাই! এখনি চাই? পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে এটা ওটা বলে শান্ত করানোর চেষ্টা করে। আতিকুর ইসলাম এসে গম্ভীর মুখে সবাইকে ধমকায় বাচ্চাটাকে কাদানোর জন্য। লতা বলে,

-” আমরা তো এমনি মজা করছিলাম! কে জানে ভোর সোনা কেঁদে বুক ভাসাবে! ভোর আমরা সবাই স্যরি হ্যাঁ? মজা করছিলাম তো! তোমার আব্বু ঠিক আছে। এক্ষুনি আসবে! কেঁদো না!”

পাতা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

-” ছেলেটা বাবা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। বাবার পাগল! ওসব শুনে!”

লুবমান ফ্রিজ থেকে আইসক্রিমের বাটিটা বের করে ভোরের কাছে দাঁড়িয়ে বলল,

-” ছেলে মানুষ এভাবে কাঁদে নাকি! হয়েছে কান্না বান্না। এখন নে আইসক্রিম খা? চকলেট ফ্লেভার!”

অন্যসময় হলে ভোর অফার লুফে নিতো। এবার কিছু বলে না। কাওছার পাতার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভোরের ফুলো গালে, মুখে চুমু দিলো।

-” ইয়া আল্লাহ কি কিউটের ডিব্বা! পাতা তোর এই ছেলেকে আমি আমার মেয়ের জামাই বানাবো! তার জন্য জলদি বিয়ে করতে হবে আমাকে। এই তোমরা কেউ নজর দিবা না আমার মেয়ের জামাইয়ের উপর!”

ভোর এবার লজ্জা পায়। হেসে ফেললো শব্দ করে। তার হাসি দেখে সবাই স্বস্তির শ্বাস নেয়। টুকটাক হাসির কথা বলে ভোরকে হাসায়। এরমধ্যে কলিং বেল বেজে উঠলো। লাবিব দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। সামনে দন্ডায়মান মানবটিকে দেখে হেসে গলা উঁচিয়ে বলল,

-” ভোর দেখ কে এসেছে? তোমার আব্বু এসেছে!”

অরুণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আতিকুর ইসলাম সহ সবাই এগিয়ে আসে। অরুণ সালাম দিল। আতিকুর ইসলাম জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

-” কেমন আছো? বাড়ির সবাই কেমন আছে?”

-” ভালো!”

প্রতিত্তরে আর কিছুই বলে না।কি বলবে ? অস্বস্তি ঘিরে ধরে যেন! পাতা কটমট করে চায়। এ লোক আসলেই ম্যানারলেস! ভোর কাওছারের কোল থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে বাবার কোলে ওঠে। বাবার গালে কপালে বেশকিছু চুমু দিয়ে গলা জড়িয়ে বলল,

-” আব্বু এতো দেড়ি করলে কেন? আই মিসড ইয়ু!”

অরুণ ছেলের কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে, কিছু বলে না। লাবনী আক্তার এটা ওটা জিজ্ঞেস করলো! অরুণ হুম হা তে জবাব দিলো। অরুণ উপস্থিত সকলের দিকে নজর বুলিয়ে নেয়। রাতুল, কাওছার, পাবেলের সাথে টুকটাক কথা বলে পাতার দিকে তাকিয়ে ইশারায় ডাকে। পাতা এগিয়ে আসলে তার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দেয়।

-” সবার জন্য!”

পাতা অরুণের চোখে চোখ রাখে। সবার জন্য এনেছে! ভালো কথা, তার হাতে দিচ্ছে কেন লোকটা! সুন্দর করে ডেকে আম্মুর হাতে দিতি ! লাবনী আক্তার অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” ঘরে যাও বাবা! ফ্রেশ হয়ে নাও! পাতা নিয়ে যাহ?”

পাতা মাথা দোলায়। ব্যাগটা মায়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে ‘আসুন’ বলে নিজের ঘরে চলে যায়। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে তার পিছু পিছু যায়। অরুণ প্রবেশ করা মাত্রই পাতা ধরাম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। অরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাতা অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রভাবে সুবোধ মহিলার মতো সুধায়,

-” আত্নীয় স্বজনের সাথে ভালোভাবে কুশল বিনিময় করতে ট্যাক্স লাগে?”

অরুণ পাতার সামনে থেকে সরে ভোরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে। বেশ গরম লাগছে তার। শার্টটা টেনে খুলে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

-” সালাম দিয়েছিলাম তো!”

পাতা ফ্যান চালায়, রেগুলেটর ঘুড়িয়ে ফুল পাওয়ারে ছাড়ে। অরুণ যেন কিছুটা স্বস্তি পায়। ঘেমে নেয় একাকার সে। পাতা এগিয়ে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

-” সালাম দেওয়ার পর ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করতে হয়! কেউ ভালো আছো বললে প্রতিত্তরে তার ভালোমন্দের খোঁজ নিতে হয়! জানেন না?”

অরুণ পাতার শাড়ির আঁচল টেনে মুখশ্রীর নোনাজল মুছে জবাব দিল,

-” জানি না!”

অরুণের কান্ডে পাতার মন পায়রা বাক বাকুম ডেকে উঠলো। মুচকি হেসে অরুণের হাত থেকে আঁচল ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই গলায় গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দিলো! শার্টের বোতামে হাত গলিয়ে একটা একটা করে যত্ন সহকারে খুলতে শুরু করলো।

-” তা জানবেন কেন! নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক কি না!! সবাই কি ভাববে? যে অহংকারী! বড়লোক তাই ভাব নেয়। অথচ তারা তো জানে না যে আপনার মুখে রসকস নেই! ছেলের থেকেও তো কিছু শিখতে পারেন!”

ব্যাক্তিগত নারীর যত্ন ও শাসনে ঘেরা বাক্যে অরুণের অধর জুড়ে খেলা করে ক্ষীণ হাসির রেশ। ভোর পিছন থেকে অরুণের গলা জড়িয়ে পিঠে ঝুলে পড়ে। কাঁধ গলিয়ে উঁকি দিয়ে পাতাকে বলে,

-” আমার আব্বুকে বকছো কেন?”

পাতা তার গাল টিপে দিয়ে বলল,

-” তোমার আব্বু কার্টেসি জানে না! বকবো না তো কি করবো?”

-” বেশি বেশি আদর করবে! একটুও বকবে না!”

কাঁধে মাথা গলিয়ে গালে বাবার গালে চুমু দিয়ে বলে ভোর! পাতার হাত থেমে যায়! পিটপিট করে ভোরের দিকে তাকালো ‌। আড়চোখে অরুণের দিকে তাকাতে ভুলে না। লোকটি মিটমিট করে হাসছে।

-” কলিজা একদম খাঁটি কথা বলেছে পাতাবাহার!”

পাতা লজ্জা পায় খানিকটা! সরে আসতে নিবে অরুণ বুঝতে পেরে আঁচল গলিয়ে উন্মুক্ত কোমড়ে হাত রাখে‌। পাতার চোখের আকার বড় হয়। অরুণ দু হাতে টেনে নিয়ে ঊরুর উপরে বসিয়ে দেয় পাতাকে। শক্ত করে কোমড় চেপে ধরে, যেন পালাতে না পারে ‌। পাতা পালানোর চেষ্টাও করে না। লজ্জা বরণ মুখশ্রী নিয়ে চুপটি করে বসে থাকে। অরুণ হাসে। এতে পাতার লজ্জা তরতর করে বেড়ে যায়। এবার ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে। অরুণ মুখশ্রী এগিয়ে নিয়ে যায়। পাতার গালে ঠোঁট ডাবিয়ে শব্দ করে চুমু খায়! লজ্জা ও ভালোলাগার সংমিশ্রিত অনুভূতিতে পাতা নুইয়ে পড়ে। কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়; অধরকোনে লজ্জালু হাসিমাখা। ভোর বাবার কাঁধ থেকে মাথা এগিয়ে এনে পাতার অপর গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসে। আবেগী পাতার নেত্রযুগল আবেগে টইটুম্বুর হয়ে ওঠে। কোমড়ের কাছটার শার্টের কোনা মুঠোয় পুরে অরুণের ঘারে মুখ লুকায়। এরা‌ বাবা ছেলে এতো মিষ্টি কেন? পুরো রসমালাই! অরুণ পিঠে হাত বুলিয়ে জড়িয়ে নেয়। বেশ সময় পেরিয়ে যায়। পাতা ওভাবেই থাকে; ছাড়ার নাম নেই। ভোর গলা ছেড়ে পিছনে দাঁড়িয়ে অরুণের চুল টেনে দিচ্ছে। অরুণ শান্তির শ্বাস ছাড়ে। জীবনটা যেন এমনি স্বস্তির হয় আজীবনভর!

-” এভাবেই থাকবে পাতাবাহার?”

পাতার হুঁশ ফিরে। চটজলদি উঠে অরুণের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। আশ্চর্য! সে ইচ্ছে করে বসেছিলো নাকি! নিজেই টেনে বসালো, আদর করলো! যাইহোক এরকম আরামদায়ক স্থান থেকে কারই বা উঠতে মন চাইবে!
অরুণও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-” জামাকাপড় কিছু এনেছো! বেশ গরম লাগছে! আই নিড টু শাওয়ার!”

পাতা টেবিলের উপর রাখা লাগেজ খুলে অরুণের টি শার্টসহ প্রয়োজনীয় কাপড় বের করে বিছানায় রাখে। অরুণ ভাঁজ কৃত কাপড় খুলে দেখে বলল,

-” পাতাবাহার তোমাকে ভদ্র মেয়ে ভেবেছিলাম তুমি দেখছি খুব ডেঞ্জারাস! আমার গোপন জিনিসপত্রের উপরও হামলা চালিয়েছো! হায় আল্লাহ!”

পাতা চোখ গোল গোল করে চায়।অরুণ আন্ডারওয়্যার ইশারায় দেখায়।পাতার কান গরম হয়ে ওঠে।বিছানার সব কাপড়গুলো তুলে নিয়ে বাইরে যেতে যেতে বলে,

-” অসভ্য নির্লজ্জ লোক!মুখে কিছুই আটকায় না।ওটা না আনলেই ভালো হতো! উপকারীর উপকার স্বীকার না করে লজ্জায় ফেলছেন!”

-” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওগুলো?”

-” আমার রুমে এটাচ বাথরুম, ওয়াশ রুম নেই! আমি লুব ভাইয়ের ঘরে রেখে আসছি আপনিও আসুন জলদি করে!”

অরুণ মুখশ্রীর আদল পরিবর্তন হয়। অন্যের বাথরুম!!! অফিস থেকে গোসল সেরে আসলেই ভালো হতো! এখন কি আর করার! আধখোলা শার্টের বোতাম আটকে নিলো।ভোরকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।
_____

পাতা লুবের ঘর থেকে বের হয় ভোরের হাত ধরে। লোকটা গোসলে! অফিস থেকে সোজা এসেছে বোধহয়! অফিসের ঝামেলা কি মিটেছে? দুপুরে কিছু খেয়েছেন কি? মুখশ্রীতে অবশ্য ক্লান্তির রেশটুকু নেই। ভাবনার মাঝেই সামনে চিপসের প্যাকেট হাতে দন্ডায়মান রাতুলকে দেখে পাতা ভদ্রতাসুলভ হাসে। রাতুল চিপসের প্যাকেট ভোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” পাতা তুমি কিন্তু বেশ ফাস্ট! জামাই পাওয়া মাত্রই ঘরে নিয়ে খিল দিলে। খোলার নাম নেই! কি কি হলো? হুম”

লজ্জায় পাতার কেঁদে দিবে ভাব!

-” আস্তাগফিরুল্লাহ্ দুলাভাই! কি সব বলেন বাচ্চার সামনে!”

রাতুল হেসে ভোরের মুখে চিপস দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” আরে আস্তাগফিল্লাহ্ কেন হবে! তোমারই জামাই যখন খুশী..”

পাতা আর দাঁড়ালো না। ভোরকে নিয়ে কেটে পড়ে। কি সব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা! লজ্জায় তার মুখশ্রী লাল হয়ে এসেছে। পাতা ভোরকে নিয়ে ডায়নিং টেবিলে বসায়। লাবনী আক্তার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে। রান্না সব কমপ্লিট করে রেখেছে শুধু অরুণের আসার অপেক্ষায় ছিলো! পাতা তাকে সাহায্য করে। পাবেল ও লাবিব এসে ভোরের পাশে বসে। লতা,পাতা ও লাবনী আক্তার মিলে সব খাবার ডায়নিং টেবিলে সাজিয়ে রাখে। পাতা লুবমানের ঘরে যায়। গিয়ে দেখে অরুণ মাত্রই গোসল সেরে বেরিয়েছে। গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে মাথা মুছছে। পাতা ওয়াশ রুমে ঢুকে অরুণের ভেজা কাপড় ধুয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে। নিজের ঘরে নিয়ে দেয়ালে টানানো রশিতে মেলে দিলো।

খাবার টেবিলে বসে অরুণ। কোলে ভোর আর পাশের চেয়ারে রাতুল বসে। টেবিলে হরেক রকমের পদের সমাহার। অরুণ মোটেও অবাক হয় নি। বাঙালী বাড়িতে জামাই আদর সম্পর্কে অভিজ্ঞ সে। লাবনী আক্তার একের পর এক পদ অরুণের বড় প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছে। ভোর উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করছে ওটা কি এটা কি! লাবনী আক্তার হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছেন। পাবেল, লুবমান, রাতুল, কাওছার অরুণের সাথে রসিকতা করছে এটা ওটা বলে। মাঝেমধ্যে লতাও দু একটা কথা বলছে। অরুণ প্রতিত্তরে একবারে চুপ বসে নেই। শান্ত স্বাভাবিক গলায় তাদের জবাব দিতে ভুলছে না। তাদের গোটাদশেক রসিকতার জবাব একটাতে দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিচ্ছে। ওরাও চুপ করে নেই এটা ওটা বলে ক্ষেপাচ্ছে; অরুণের সাথে না পেরে পাতাকেও রেহাই দিচ্ছে না। পাতার হয়ে অরুণ তাদের ক্ষেপিয়ে দিচ্ছে। শেষে হার মেনে খাওয়ায় মনোযোগী হয় সব! অরুণ নিজে খাচ্ছে সাথে ভোরকেও খাইয়ে দিচ্ছে আস্তে ধীরে। এরমধ্যে ভোর বলে
,
-” আব্বু আমি আর খাবো না। পেট ভরে গেছে!”

অরুণ জোড় করে না। ছেলেকে কোলে নিয়েই খেতে থাকে। লাবনী আক্তার বাটিতে দই মিষ্টি দেয় ভোরকে। ভোর একটু মুখে পুরে রেখে দেয় আর খাবে না। তার পেট ভর্তি। পাতা খেয়াল করে অরুণ খাচ্ছে না শুধু প্লেটে নাড়াচাড়া করছে। প্লেটে অর্ধেকের বেশি খাবার এখনো বিদ্যমান। পাতা এগিয়ে এসে সুধায়,

-” খাচ্ছেন না কেন?”

অরুণ পাতার দিকে চায়। তার পেটটাও ফুল হয়ে গেছে। আর একটা খাবারও গলা দিয়ে নামবে না। অথচ প্লেট এখনো ভর্তি। এমন না সে খায় নি। যথেষ্ট খেয়েছে। তবুও প্লেট ভর্তি আর এর সব ক্রেডিট পাতার আম্মুর।
এরইমধ্যে লাবনী আক্তার পোলাও এর বোল নিয়ে এগিয়ে আসে। অরুণের পাতে পোলাও দিতে উদ্যত হয়ে বলে,

-” নাও! খাচ্ছো না কেন?”

অরুণ প্লেট সরিয়ে নিয়ে বলে,

-” আন্টি নেব না। প্লেটে যথেষ্ট আছে।আমি এটুকুই শেষ করতে পারবো না!”

লাবনী আক্তার আর দেয় না।রাতুল হেসে টিপ্পনী কেটে বলে,

-” অরুণ ভাই আপনাদের ওখানে শাশুড়িকে আন্টি বলে বুঝি? আমাদের এলাকায় কিন্তু মা , আম্মা বলে ডাকে!”

লতা সায় জানালো।

-” হ্যাঁ। আমি নিজেও শাশুড়িকে আম্মু বলে ডাকি!”

কাওছার হেসে মিনমিনে গলায় বলল,

-” আমাদের গ্রামেও সবাই আম্মা বলেই ডাকে।”

সবাই মিলে অরুণ কে জব্দ করে এবার। অরুণ পাতার দিকে তাকালো। পাতা কি করবে বুঝতে পারে না। আতিকুর ইসলাম পরিস্থিতি সামাল দিলো।

-” কি হচ্ছে টাকি! সবাই চুপচাপ খাও! আর লাবনী জামাইকে দই, মিষ্টি দাও!”

অরুণ প্লেটে নাড়াচাড়া করে এক লোকমা খাবার মুখে তোলে কিন্তু গিলতে পারে না। পেট ভর্তি পুরোপুরি। খেতে ইচ্ছে করছে না তার। আর অতিরিক্ত খাবার সে খেতে পারে না। পাতা অরুণ মুখশ্রী খেয়াল করে বলল,

-” জোড় করে খেতে হবে না। রেখে দিন! মিষ্টি মুখ করুণ! আমি দিচ্ছি!”

অরুণ যেন স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। ভোরের রেখে দেওয়া দই মিষ্টির বাটিটা তুলে নিল।

-” দিতে হবে না। এতেই হবে!”

বলে চামচে করে মুখে নেয়। দই শেষ করে পানি পান করে অরুণ। লাবনী আক্তার সেমাইয়ের বাটি এগিয়ে বলে,

-” একটু সেমাই নাও?”

-” যথেষ্ট খেয়েছি। আর খাব না কিছু!”

এবার আর আন্টি বলার ভুল করে না। সম্মোধন হীন কথা বলে বিদায় নেয় খাওয়ার পর্ব থেকে। পরপর সব ছেলেদের খাবার পর্ব শেষ হয়। সবাই উঠে গেলে লতা প্লেট নিয়ে ধুয়ে আনে। সবাই বসলে পাতাও এসে বসে। লতা পাতার সামনে অরুণের এঁটো প্লেটটা রেখে বলে,

-” এঁটো খেলে ভালোবাসা বাড়ে। খেয়ে নি! তোর আদরের জামাইয়ের এঁটো বলে কথা! আর এতো গুলো খাবার নষ্ট করবো নাকি!”

বলেই হাসে। পাতা প্লেটের দিকে তাকায়। একপাশ থেকে খেয়েছে লোকটা বাকি অংশে হাতই লাগায় নি মনে হচ্ছে। নীড এন্ড ক্লিয়ার খাবার দাবার লোকটার। পাতা প্লেটে হাত দিবে লতা তার মাথায় চাটি মেরে বলে,

-” এই গাধা সত্যিই খাবি নাকি! রেখে আয় কিচেনে আমি তোর প্লেট দিচ্ছি!”

পাতা মিষ্টি হেসে বলে,

-” উনি একপাশ থেকে খেয়েছেন। বাকি অংশে হাতই লাগায় নি। এতো গুলো খাবার নষ্ট করার কি দরকার! আমি খাচ্ছি! তোমার মতো আমার ওত বাছ কোচ নেই!”

বলেই প্লেটে হাত দেয়। লতা হেসে পাতার চুল এলোমেলো করে দেয়। জামাই পাগল বোন তার। লাবনী আক্তার মুচকি হাসে। প্রিয় টিপ্পনী কাটে। পাতা লজ্জা পায় তবে আমলে নেয় না।
____

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৩৭ (প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

তিমিরে আচ্ছন্ন রজনী এখনো গভীরে ডুব দেয় নি। আকাশ মেঘলা না হলেও চাঁদের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। দু এক গোছা তারকারাজি ক্ষণে ক্ষণে পিট পিট করছে। ধরনীর বুকে গম্ভীর গুমট ভাব! পবনের দেখা মেলা ভার! গাছের পাতার নড়চড় দেখা যাচ্ছে না। বাদুরের দল ডানা ঝাপটায়! কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করছে এক নাগাড়ে! বিরক্তিকর সেই সুর!রাতের শুনশান নীরবতায় ঝিঁঝিঁ পোকার বিরতিহীন সুর! দেয়াল ঘড়ির টিক টিক টিক শব্দ! পাতা বিছানায় শুয়ে উশখুশ করছে। ঘুম আসছে না তার! যার ফলে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ শব্দও বিরক্ত লাগছে পাতার কাছে। পাতা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। ঘুম ধরা দেয় না! চোখ মেলে রাখলেও অন্ধকারে গা ছমছম করে ওঠে। তার উপর মাথার কাছটার জানালাটা খোলা! ছোট বিছানা পাতার! একজন ভালোভাবে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোতে পারে। দুজনেও সমস্যা হয় না; মানিয়ে নেয়া যায়। সেই বিছানায় আজ তিনজন ঘুমিয়ে।অনেকটা চাপাচাপি করে শুয়েছে তিনজন। সে ভোর দুই পাশে মাঝখানে অরুণ সরকার। লুব ভাই অবশ্য বলেছিল ভোরকে তার সাথে রাখবে। সে, ভোর আর লাবিব থাকবে। লোকটা গম্ভীর মুখে তৎক্ষণাৎ মানা করে দেয়; সাথে পাতার দিকে চায় শান্ত দৃষ্টিতে। লোকটা হয়তো ভেবেছিল পাতাই অন্যত্র রাখার জন্য পাঁয়তারা করছে। কিন্তু এমনটা মোটেই না!চাপাচাপিতে পাতার ঘুমের অসুবিধে হচ্ছে না। তার উশখুশ অস্থিরতার কারণ ভ্যাপসা গরম; তার সাথে কারেন্ট মামা ভ্যাকেশনে গেছে! এই কয়েকদিন এসিতে থেকেই বড়লোকি ভাব এসে গেছে পাতু? চার্জার ফ্যান ঘুরছে এতেও গরম লাগছে? এখন লাগলে কি করার! পাতা পাশ ফিরে কাত হয়ে শোয়। লোকটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! চিৎ হয়ে এক হাত পেটের উপর রেখে। অপর হাতের উপর ভোর মাথা রেখে ঘুমিয়ে। তার কি গরম লাগছে না? লাগবে না? সে তো কয়েকদিন এসি যুক্ত কামরায় থেকে এই সামান্য গরম সহ্য করতে পারছে না। আর লোকটা তো এসি ঘরেই সারাজীবন কাটিয়েছে। ঘনঘটা অন্ধকারের মধ্যে জানালা দিয়ে আগত ক্ষীণ আবছা আলোয় পাতা হাত বাড়িয়ে অরুণের বলিষ্ঠ হাতের উপর রাখে। ভালো লাগে পাতার। মন বলে ঘুম আসবে। অরুণের হাতের উপর থেকে হাত সরিয়ে কোমড়ের একপাশে রেখে জড়িয়ে ধরে; সাথে একটা পাও তুলে দেয়। যেন এটা অরুণ সরকার নয় ; পাতার ব্যাক্তিগত কোলবালিশ। কিন্তু ব্যাক্তিগত কোলবালিশ জড়িয়েও পাতার ঘুম ধরা দিল না। লোকটা ঘেমে একাকার। পাতা অরুণের উন্মুক্ত বুকে, গলায় হাত রাখল। ঘেমে চিপচিপে হয়ে আছে লোকটা! পাতা উঠে বসে। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ভোরকে দেখে। ছেলেটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়েই ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘেমে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। মুখশ্রীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। পাতা ঘরময় হাত পাখা খোঁজ করে পায় না। দরকারের সময় কোনো জিনিস হাতের নাগালে পাওয়া যায় না। অথচ সবসময় সেইটা চোখের সামনেই থাকে। পাতা তার ড্রয়িং খাতা বের করে সেটা দিয়েই বাতাস করে বাবা-ছেলেকে। বেশি সময় করতে হয় না। মিনিট পাঁচেক পরেই কারেন্ট চলে আসে। পাতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। লাইট জ্বালিয়ে বিছানার হাঁটু ভাঁজ করে সেথায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে রইল! নজর ঘুমন্ত অরুণ! কখনো কখনো ভোর! ঘুম আসছে না; এখন সময় পার করার এর থেকে ভালো পন্থা হতেই পারে না। পাতা তার দিকে তাকিয়ে থাকে আর মুচকি মুচকি হেসে সুখে আচ্ছাদিত কল্পনার রাজ্যে ঘোড়া ফেরা করে। লোকটা ঘুমের ঘোরেও মুখের আদল গম্ভীর বানিয়ে রেখেছে। নাকটা সিঁকায় তুলে রেখেছে। পাতা দাঁত বের করে হাসে। ‘নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক’ বিড়বিড়িয়ে হাত টান করে অরুণের নাকটা টেনে দেয়। সাদাসিধে মনটা লোভী হয়। দাঁড়ি যুক্ত গালে হাত বুলিয়ে টিপে দেয়। লোকটা সবসময় তার নাক, গাল টেনে দেয় আজ সে দিলো! পাতা হামি তোলে; চোখে ঘুমের আবির্ভাব ঘটে। অরুণের দিকে ঝুঁকে প্রথমবারের মতো তার নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার ললাটে মিষ্টি ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। দিয়ে সরে আসবে অরুণ চোখ খোলে! পাতা থতমত খেয়ে যায়! তড়িঘড়ি করে সরে আসে। বুকটা ধরফর করছে অনবরত! কথা জড়িয়ে আসে তবুও আমতা আমতা করে বলে,

-” ওই ওই মশা পড়েছিলো!”

বলেই মনে মনে নিজের গালে একটা থাপ্পড় লাগায়। এটা কোনো এক্সকিউজেস হলো? এখন লোকটা যদি জিজ্ঞেস করে চুমু দিয়ে মশাকে তাড়াচ্ছিলে? কিন্তু অরুণ কোনো প্রকার প্রশ্ন করে না। পাতা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক বাবা লোকটা ঘুমের ঘোরে হয়তো; খেয়ালই করে নি! সে বিছানা থেকে নেমে লাইটের সুইচ অফ করে এসে বালিশে মাথা রাখে। অন্ধকারেই পাশে তাকায়! কিন্তু কিছু দেখার সুযোগ পায় না। তড়িৎ বেগে অরুণ সরকার একপ্রকার হামলে পড়ে। পাতার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে চুমুর বর্ষণ শুরু করে। পড়নের টপসের ভিতর হাত গলিয়ে উদরে রাখে। সদ্য নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত পাতা শিউরে ওঠার সময় পায় না। মস্তিষ্ক কেমন অচল হয়ে যায়। ভয়ে উত্তেজনায় হাত পা শিথিল হয়ে আসে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় অস্বাভাবিক গতিতে। পাতা ঢোক গিলে। এ কেমন অসহ্যনীয় ভালোলাগার রেশ! অরুণ থেমে নেই। অগাধ উত্তেজনায় ঠাসা অরুণ সরকার বেপরোয়া বেগে হিংস্র গতিতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। হাতের নরম ছোঁয়া গভীরে ডুব দেয় সাথে কঠোরতার রেশ! পাতা ছটফটিয়ে উঠে। বলিষ্ঠ দেহটাকে সরাতে চায়; ব্যর্থ হয়! বরং বলিষ্ঠ দেহটা পিষে ফেলতে চায় ছোট নরম তনু! হাতটা যেন খেই হারিয়ে ফেলে। পাতা নিজ নরম হাতে বাঁধা দিলে, তার হাত জোড় দখল হয়ে যায়। পাতার ছটফটানি বেড়ে যায়, সাথে অরুণের বিস্তার! কিন্তু কপোত যুগল খেয়ালহারা! বিছানার কিনারায় অবস্থান তাদের; সেটা বেমালুম ভুলে বসে। ফলাফল স্বরূপ ধপাস কোরে পড়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়! পাতা অতি মৃদুস্বরে চেঁচায়! কোমড়টা তার আজ গেলো! অরুণও বেশ ব্যাথা পায় কনুই জোড়ায়! তবে আমলে নেয় না। উঠে ফ্লোরে বসে নরম গলায় পাতাকে সুধায়,

-” আর ইয়ু ওকে?”

পাতা অরুণের দিকে চায়। লোকটা হাঁপাচ্ছে নিঃশ্বাসে গতি অস্বাভাবিক! শালার জামাই! অসভ্য! অরুণ আবার একই প্রশ্ন করে। পাতা ছলছল চোখে না বোধক মাথা নাড়ে। অরুণ খানিকটা উদ্বেগ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে,

-” ব্যাথা পেয়েছো? কোথায় লেগেছে?”

পাতা কটমট‌ করে চায়। শালার জামাই! লোকটার জন্যই তো সব হলো! অসভ্য লোক! অরুণ পাতাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। পাতা চুপটি করে এপাশ ফিরে কাত হয়ে শোয়! কিছুপল আগের মুহূর্ত চোখের পাতায় ভাসছে যেন! পাতা ঢোক গিলে। লজ্জায় কান গরম হয়ে আসে। তার লজ্জাকে বাড়িয়ে দিতে অরুণ তাকে কাছে টেনে নেয়। পেছন থেকে জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে ধীমে সুরে গম্ভীর গলায় বলে,

-” ইফ দিছ ওয়াজ আওয়ার বেডরুম ইনস্টেড ওফ ইয়োর ফাদার’স হাউজ, ইয়ু উড বি ফিনিশড ট্যু ডে পাতাবাহার!”
_______

-” অসুখ শরীর নিয়ে তোমার কাজ কইরতে হইবে না! ওঠো? ওখানে বইসে থাকো! আমি করছি তুমি শুধু দেখতে থাইকবে! ভূল হইলে সুধরে দিবে!”

-” আমি পারবো আপনি যান তো!”

বলে পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে মিনু। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ঝাঁঝে। তবুও থামে না। আভারি বিরক্ত হয়।

-” তুমি আমার কথা শুইনবে না, না? ওঠো বলছি? ওঠো?”

ধমকে বলে আভারি! মিনু খানিকটা ভয় পেলেও আমলে নেয় না। সকাল আটটা বাজতে চললো এখনি রান্না হয় নি। সবাই ঘুম থেকে উঠেই তো চা নাস্তার জন্য চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেবে। আভারি মিনুর বাহু ধরে টেনে সরিয়ে দেয়। মিনু চাপা স্বরে বিরক্ত হয়ে বলল,

-” কি কইরছেন টা কি! বিরক্ত করবেন না তো! সবাই উঠলো বলে! রান্না না কইরলে কি‌ খাইবে সবাই?”

আভারিও তেজের সাথে বলল,

-” সেই ব্যবস্থা আমি কইরতেছি! তুমি চুপচাপ বইসে থাকো মিনু। রান্না আমি কইরতেছি! রান্না বান্না আমিও পারি!”

মিনু মিনমিন করে কিছু বলতে চায় আভারির ধমকে বলে,

-“খবরদার কথা না শুনলে!”

অগত্যা মিনু চুপ বনে যায়। কাল রাত থেকে শরীরটা বেশ খারাপ। জ্বর ঠান্ডা সাথে মাথা ব্যাথা!রাতে বেশকয়েকবার বমি করে ভাসিয়েছে। লোকটা নিজেই পরিষ্কার করেছে। মাথায় পানি ঢেলেছে। বলা চলে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আভারি ছুরি হাতে নিয়ে পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে খানিকটা অপরিপক্ক হাতে। এরইমধ্যে কিচেনে আসমা বেগমের আগমন ঘটে। মিনুকে ছলছল মুখে বসে থাকতে দেখে সাথে আভারিকে কাজ করতে দেখে গম্ভীর মুখে আভারির উদ্দেশ্যে বলে,

-” কি হয়েছে? চিল্লাচিল্লি করছিলে কেন মেয়েটার উপর? হুম?”

আভারি মাথা নিচু করে জবাব দেয়,

-” ম্যাডাম! অসুখে পইড়েছে! কাল রাত থেকে অনেক জ্বর! বারবার বমি কইরে শরীর দূর্বল! পাক পাইরতেছে‌। কহন চোখ উল্টাইয়ে পইড়ে যায়! এই অবস্থায় রান্না কইরতে আইছে। মানা করছি তাও শোনে নাই! তয় ধমক দিছি!”

আসমা বেগম এগিয়ে গিয়ে মিনুর কপালে হাত রাখে। বেশ গরম! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়! এই অবস্থায় রান্না করতে এসেছে মেয়েটা!

-” জ্বর বাঁধালে কিভাবে?”

মিনুকে কিছু বলতে না দিয়ে আভারি বলে,

-” বাইধবে না? ঠিক মতো খাইবে না। নিজের যত্ন নিইবে না! চেহারার কি হাল হইছে! শরীরের এক পত্তন মাংস নাই!”

সত্যিই মিনুর চেহারার উজ্জলতা নষ্ট হয়েছে! শুকিয়েও গেছে বেশ! আসমা বেগম মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো! মিনুর কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বাবা মা গত হয়েছে বিয়ের কয়েকবছরের মাথায়! একটা বড় ভাই আছে সে সংসার নিয়েই ব্যস্ত। বছর অন্তর একবার ফোন করে খোঁজ খবর নেয় এই যা। এতেই মিনু খুশি। আজ আসমা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়াতে কেন যেন বাবা মায়ের কথা মনে পড়লো! আসমা বেগম আভারিকে বললেন,

-” ওকে ঘরে নিয়ে যাও! রেস্ট করুক! আরেকটু পরে ডাক্তার দেখিয়ে আনবে। আমি ড্রাইভারকে বলে দেব নিয়ে যাবে‌। আর যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে যাবে অবশ্যই!”

আভারি মাথা নেড়ে সায় জানালো। চুলায় চড়ানো চায়ের কেতলি নামিয়ে অফ করে দিলো। মিনুর হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আসমা বেগম বললেন,

-” ওর কাছেই থেকো! গা টা তোয়ালে ভিজিয়ে মুছে দিয়ো! গায়ে অনেক জ্বর! আর রান্নার চিন্তা করতে হবে না। আমি করছি!”

আভারি অবাক সুরে বলে,

-” না ম্যাডাম! আমি রান্না করতে পারি..”

-” যেটা বলছি সেটা করো যাও! রান্না আমিও করতে পারি!”

ধমকের সুরে বলল আসমা বেগম। তবে ধমকে আভারি বা মিনু কারো মন খারাপ হয় না। বরং মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়‌।
আসমা বেগম কোমড়ে আঁচল বেঁধে দক্ষ হাতে সকালের নাস্তা বানায়। রান্না শেষ করে নিজেই ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করে। শুক্রবার হওয়ার দরুণ সকলেই দেড়িতে ঘুম থেকে উঠে। তিনি চায়ের কেতলি পুনরায় চুলায় দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে আদুরিকে ডাকতে যান। মেয়েটাকে এখন না ডাকলে এগারোটা বারোটার আগে উঠবেই না!

রুবি ছেলেকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। ছেলেটা মাতৃদুগ্ধপান করতে ব্যস্ত। রুবি ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। যদিও ঘড়িতে নয়টা বেজে সাতাশ! তবুও আজকের ঘুম যেন অপূর্ণই রয়ে গেলো! ওদিকে আরিয়ান কম্ফোর্ট জড়িয়ে আরামে নিদ্রা বিলাসে ব্যস্ত। মেয়েটা আদুরির সাথে ঘুমিয়েছে গতরাতে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার তার পতি মহাশয় করেছে। রুবি পাশ থেকে বালিশ নিয়ে আরিয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারে। আরিয়ান নড়েচড়ে ওঠে। ঘার ঘুরিয়ে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকালো। রুবিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,

-” জর্জ সাহেবান কিছু বলবেন?”

সদ্য ঘুম ভাঙ্গার দরুণ ভাঙা ভাঙা গলার আওয়াজ। রুবি চোখ পাকিয়ে বলল,

-” উকিল সাহেব কৃপা করে উঠুন? সূর্যিমামা আপনার প্রতিক্ষায়!”

আরিয়ান ওপাশ ঘুরে চোখ বুজে বলল,

-” আজ ফ্রাইডে! সারাদিন ঘুমোলেও প্রবলেম নেই!”

-” অরুণ ভাইয়া কবে ফিরবে শশুর বাড়ি থেকে?”

রুবির প্রশ্নে আরিয়ান পুনারায় এপাশ ফিরে।

-” প্রথম প্রথম শশুর বাড়ি গেলো! দুই এক দিন থাকবে না? তোমার এতো জলদি কিসের?”

রুবি মুচকি হেসে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে জবাব দিল,

-” আজ ছুটির দিন। কাল শনিবার অফিস তো খোলাই থাকে! আমার রিজাইন লেটারও পাশ হয়ে গেছে। ভাবছি কাল থেকেই জয়েন করবো অফিস!”

আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে।

-” দুই এক মাস সময় নাও! ছেলেটাকে আরেকটু সময় দাও! তারপর শুরু করো! এতো তাড়া কিসের?”

রুপ মায়ের কোল থেকে নেমে বাবার কাছে যায়। বাবার বুকের উপর উঠে বসে। উ উ শব্দ করে ঘোড়া চালানোর মতো ভঙ্গিমা করে। আরিয়ান ছেলেকে বুকে নিয়ে চুমু খায়।
রুবি মুচকি হেসে জবাব দেয়,

-” একচুয়ালি আই এম ঠ্যু মাচ এক্সাইটেড! আমাদের অফিস! সব কিছুতে আমাদের হুকুম! আহা! অন্যের অধিনে কাজ করে অতিষ্ট হয়ে গেছি!”

আরিয়ান ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। সিরিয়াস গলায় বলল,

-” ভালো! বাট একটা কথা মাথায় রাখবে রুবি! অফিসটা ভাইয়ের! বাবা মারা যাওয়ার পর অফিস ডুবতে বসেছিল! ব্যবসায় লস! অফিসের পুরোনো ম্যানেজারের ধোঁকাবাজি! ঋণে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল! সব মিলিয়ে নিলামে ওঠার মতো অবস্থা! ভাই সেখান থেকে একলাই টেনে এনেছে এতদূর! তুমি অফিসে যাবে ভালো! বাকি স্টাফদের মতোই সৎ মনে কাজ করবে! কোন প্রকার এক্সট্রা সুবিধা গ্রহণ করবে না! আর তুমি ভাইয়ের অধিনে কাজ করবে এটা খেয়াল রাখবে। ভাই অনেক এক্সপেরিয়েন্সড! তুমি বুদ্ধিমতী,আই থিংক আমার কথা বুঝতে পারছো।”

রুবির মুখশ্রীতে গাম্ভীর্য ভর করে।

-” তুমি কি বোঝাতে চাইছো? ক্লিয়ারলি বলো?”

আরিয়ান হাসে। ছেলেকে রুবির কাছে দিয়ে বলে,

-” তুমি যেটা বুঝেছো!”

বলে মুচকি হেসে ওয়াশ রুমে চলে যায়। রুবি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। মানছে অরুণ ভাইয়া ক্ষতিগ্রস্ত অফিসটাকে পুনরায় দাঁড় করিয়েছে। তার কৃতিত্ব অনেক। তার মানে এটা নয় যে অফিসটাই তার! সেখানে আরিয়ান, আদুরিরও অধিকার আছে।

আসমা বেগম আনিকাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসেন! তখনই কল আসে। তিনি আনিকাকে রেখে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। আনিকা এদিকে ওদিকে ঘার ফিরিয়ে ভোরকে খোঁজে! আজ ফ্রাইডে! মানে সারাদিন ছুটি খেলাধুলা। সে ডিসাইড করে ভোরের সাথে সারাদিন কি কি খেলবে। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয় যে ভোরতো নেই! তার নানুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তাহলে সে কার সাথে খেলবে? তার ভাবনার মাঝেই রুবি চলে আসে রূপকে নিয়ে। আনিকাকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখে বলল,

-” মামনি মন খারাপ করে বসে আছো কেন? কি হয়েছে?”

আনিকা গালে হাত দিয়ে গোমড়া মুখে বলে,

-” আজ ফ্রাইডে! ভোর নেই আমি কার সাথে খেলবো? আনি মিসড ভোর!”

রুবি মুচকি হাসে। দুটোর মধ্যে একটুও পড়ে না। কিন্তু একে অপরের থেকে দূরে গেলেই বলবে ‘আনি মিসড ভোর’ ‘ভোর মিসড আনি’ রুবি রূপকে বসিয়ে দিয়ে আনিকার সামনে বসে বলল,

-” ভোর নেই তো কি হয়েছে? রূপ আছে না তার বোনের সাথে খেলার জন্য!”

-” ও পঁচা আর ছোট ওর সাথে আমি কিভাবে খেলবো!”

-” তাহলে কি করা যায়? উম এক কাজ করি আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাই? আমি, তুমি, রূপ, তোমার আব্বু?”

আনিকা খুশির চোটে লাফ দিয়ে উঠলো।

-” সত্যিই! তাহলে তো অনেক মজা হবে! আচ্ছা দাদিকে নেব না কেন?”

রুবি মেয়ের হাসিমাখা মুখশ্রী আঁজলে তুলে চুমু খায়!

-” দাদিকেও নেবো!”

-” কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”

বাবার আওয়াজ শুনে আনিকা সামনে তাকায়। বাবাকে দেখেই দৌড়ে কোলে উঠে। আরিয়ান মেয়ের মুখশ্রী আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। সোফায় বসে মেয়েকে কোলে নিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,

-” ক্ষিধে লেগেছে কেউ কিছু খেতে দাও না? চা টাও দিতে পারো!”

আসমা বেগম ফোন রেখে আরিয়ানের সম্মুখের সিঙ্গেল সোফায় এসে বসে‌।

-” ডায়নিং টেবিলে সব খাবার আছে শুধু সার্ভ করে খাবি! যাহ্!”

আরিয়ান আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

-” মিনু আপা কই? আভারি ভাই কেও দেখছি না!”

-” মিনুর শরীর ভালো নেই! রাত থেকেই জ্বর! জ্বরের শরীর নিয়েই রান্না করতে এসেছিলো! আভারি তাকে বারণ করে নিজেই রাঁধতে বসেছিলো!”

-” বাহ্! আজ আভারি ভাইয়ের রান্না খাবো?”

রুবির কথায় আসমা বেগম গম্ভীর মুখে বলল,

-” আমি রান্না করেছি! আভারি মিনুর কাছে।”

আরিয়ান বলে,

-” বেশি খারাপ? ডাক্তার ডাকবো?”

-” অনেক জ্বর! আমি বলেছি একটু পর হাসপাতালে নিয়ে যেতে! ড্রাইভারকেও বলেছি ফোন করে!”

আসমা বেগমের কথায় আরিয়ান খানিকটা সন্তুষ্ট হয়। রুবি সোফায় বসে চিন্তিত সুরে বলল,

-” মা আমাকে ডাকতে পারতেন আমি রান্না করে দিতাম! লাঞ্চে আমি রেঁধে খাওয়াবো!”

আসমা বেগম খানিকটা হেসে বললো,

-” সেটার মনে হয় দরকার পড়বে না। অরুণের শশুর বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। এখনি যেতে বলেছে। আমি বলেছি রারোটার দিকে যাবো!তোমরাও সাথে যাচ্ছো!”

আনিকা খুশিতে চিল্লিয়ে ওঠে ‘ইয়ে’ বলে!
______

রান্না ঘরে ব্যস্ত সময় পার করছেন লাবনী আক্তার। সকাল ভোর থেকেই তিনি রান্নাঘরে! বাড়িতে দুটো মেয়ের জামাই তাদের সকালের নাস্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠা পুলির মেলা বসেছে। বর্ষা কাল‌ হওয়ায় তালের বরা, তালের পিঠা, ঝাল পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, কুসুলি, পাটিসাপ্টা বানিয়েছে! এছাড়াও নাস্তার জন্য আলুর পরোটার সাথে দেশি মোরগের কষা মাংস! সব রান্নাই শেষ শুধু লতার মেয়ে রুম্পার জন্য সুজি ছড়িয়েছে। এরমধ্যে লতা মেয়েকে নিয়ে আসে। লাবনী আক্তার লতাকে বলল,

-” ওরা এসেছে?”

-” রাতুল, লাবিব আর লুব এসেছে! অরুণ ভাইয়া কাওছারকে নিয়ে কোথাও গেছে।ওদের বলে যায় নি! বলেছে আসছে আধা ঘন্টার মধ্যে!”

-” কোথায় গেল!! আচ্ছা সেসব বাদ দে! শোন কাল রাতে অরুণ কতগুলো সদাই আনলো আবার পাতাও এনেছে মিষ্টি, ফলফলাদি কতসব! বাচ্চাগুলোকে সদাই দিস মনে করে! আর এক কাজ কর এক প্যাকেট মিষ্টি বের করে রাখ! প্রতিবেশিদের দিতে হবে না? প্রথমবার জামাই বাড়িতে আসলো!”

-” আচ্ছা!”

-” আর শোন পাতাকে ডেকে দে! দশটা বাজতে চলল মহারানি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! এর সোধবুদ্ধি কবে হবে! আল্লাহ জানে!”

লতা মেয়েকে রাতুলের কাছে দেয়। সকাল ভোরেই রাতুল, অরুণ, কাওছার, লুবমান, লাবিব ও ছোট্ট ভোর হাঁটতে বের হয়েছিল! উদ্যোক্তা অবশ্য অরুণ! নয়তো তার অলসের ঢেঁকি স্বামী যায় হাঁটতে! হাঁটতে বের হয়েছে ভোরেই এখন দশটা বাজে ! এসেছে তবে কয়েকজন। আর গুলোর খবর নেই! এরা সকালের নাস্তা কখন করবে! লতা ভাবতে ভাবতে পাতার ঘরে প্রবেশ করে। পাতা উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। লতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! এই মেয়েটির ঘুমানোর অভ্যাস বিয়ের পর মোটেই চেঞ্জ হয় নি। লতা পাতাকে ডাকে পিঠ ঠেলে। পাতা হুম হা বলে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়! লতা টানে পাতা বিরক্ত হয়ে চোখ পিটপিট করে হাত ছাড়িয়ে আবার শুয়ে পড়ল। লতা কটমট করে বলল,

-” পাতু উঠ বলছি? দশটা বাজে! তার উপর তোর জামাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সকালে হাঁটতে বেরিয়েছে এখনো আসেনি!”

ওষুধে‌ কাজ হয়! পাতা উঠে বসে বিছানায় অরুণ ও ভোরকে খোঁজে! না পেয়ে লতার দিকে চায় বড় বড় করে,

-” আপু! কি বলছো এসব! দেখো এরকম ফালতু মজা করবে না!”

লতা পাতার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

-” আমি জানতাম তুই জামাই পাগল হবি! তবে এতোটা আর এতো জলদি ভাবি নি!”

পাতা মুচকি হাসলো ‌। দু হাত উঁচুতে তুলে হাই তোলে। লোকটা কোথায় গেল? তাকে ডাকবে না? লতা বোনের দিকে চায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে! টপসের উপরের দুটো বোতামই খোলা! হা হয়ে আছে! গলা সহ বেশ কিছু অংশ দৃশ্যমান। সাথে গলায় লাল, নীল ছোপ ছোপ জখম! অভিজ্ঞ লতার বুঝতে অসুবিধা হয় না‌। সে পাতা টপসের গলাটা আরেকটু নামিয়ে এনে বলল,

-” আরেকটু সময় নিতে পারতি! এতো জলদি কিসের ছিলো? সারাজীবনের ব্যাপার। বোঝাপড়াটা আগে ভালো করে বুঝে নিতি!”

পাতা সরে যায়। বুঝতে বাকি থাকে না আপু কিসের কথা বলছে। লজ্জায় গাল গরম হয়ে যায়। টপসের বোতাম আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু বোতাম খুঁজে পায় না ছিঁড়ে গেছে বোধহয়। পাতা মনে মনে অরুণকে ভয়ংকর একটা গালি দিলো। শালার জামাই! পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গলায় জড়িয়ে নিলো। লতা পাতার অস্বস্তি ও লজ্জা দেখে মুচকি হাসলো। পাতার খোলা চুল এলোমেলো করে বলল,

-” হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। আমিই তো! তবে আর কিছুদিন..”

-” আপু কি সব বলো না। আমি ওয়াশ রুমে যাচ্ছি! ইটস এন ইমার্জেন্সি!”

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে অরুণের গুষ্টির তুষ্টি করে। ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোকটার জন্য আপুর সামনে কি লজ্জাটাই না পেল! ধ্যাত!
পাতার পলায়ন দেখে লতা মুচকি হাসলো। পাগলিটা বেশ লজ্জা পেয়েছে।
____

একটা অটো এসে থামে আতিকুর ইসলামের বাড়ির সামনে। অটো থেকে নেমে আসে ভোর! হাতে অনেক গুলো হিলিয়াম গ্যাসে ভরপুর খেলনা বেলুন! যেগুলো মাছ,মটু,পাতালু, ঘোড়া, বিমান সহ বিভিন্ন শেপের! ভোর হাসিমুখে সেগুলো দেখছে আর হাঁটছে, বাড়ির ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সে এই বেলুন গুলো মা ও লাবিবকে দেখাবে!
এরপর অটো গাড়ি থেকে নামে অরুণ ও কাওছার। চালকও নেমে গাড়িতে অবস্থানরত বাজারের ব্যাগ গুলো ভিতরে রেখে আসে একে একে। অরুণ তার ভারা মিটিয়ে কাওছারের সাথে ভিতরে প্রবেশ করে।
ভোর সব বেলুন গুলো অনেক কষ্টে ভিতরে নিয়ে গিয়ে গলা উঁচিয়ে ‘আম্মু, লাব্বু ভাইয়া’; ডাকলো বেশ কয়েকবার! লাবিব পাতা সহ সবাই ড্রয়িং রুমে আসে। ভোর বেলুন গুলো দেখিয়ে বলল,

-” দেখো কতোগুলো বেলুন! মটু, পাতলু, মাছ, বিমান!”

লাবিব গিয়ে ভোরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে সব! অরুণ গিয়ে সোফায় বসে! গরমে সে ঘেমে নেয়ে একাকার! জলপাই রঙের টি শার্ট গায়ে লেপ্টে আছে। পাতা গিয়ে ফ্যান ছাড়ে ফুল স্পীডে! তারপর পানি আনতে যাবে তার আগে অরুণের গলার আওয়াজ ভেসে আসে।

-” আম্মা! লেবুর শরবত আনবেন দুই গ্লাস! চিনি ছাড়া শুধু লবন দিয়ে!”

কথাটা যে লাবনী আক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলেছে অরুণ সরকার সেটা কারোরই বুঝতে বাকি নেই! রাতুল মিটমিট করে হাসে। পাতা অবাক হয়ে অরুণের দিকে চেয়ে। লাবনী আক্তারও অবাক হয় বেশ! কাল রাতে আন্টি বলল আজ আম্মা ডাকলো! তবে তিনি অবাকতাকে ঠেলে কিচেনে যায় সায় জানিয়ে। অরুণকে অস্বস্তিতে ফেলে না। এমনকি রাতুল, লুব ও কাওছারও কিছু বলে না। বলেছে এই অনেক! আতিকুর ইসলাম সবসময়য়ের মতো গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার ও বাকি সকলের নজর দরজায়! ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে বাজার দেখে সবার চোখ কপালে । বড় বড়‌ চারটা রুই ও কাতল মাছ! পাশে আরো তিনটা বাজারের ব্যাগ! লতা গিয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে আস্তে ধীরে সব বের করে!এক থলেতে পান সুপারি, মিষ্টি, সন্দেশ, পানতোয়া, জিলেপি ও দই! আরেক থলেতে গরু ও খাসির মাংসের পলি; বড় দুটো ব্রয়লার, একটা লেয়ার মুরগি ড্রেসিং করে এনেছে! তৃতীয় ব্যাগে শসা, টমেটো, লেবু, মশলাপাতি ও কিছু শাক সবজি! লতা সব দেখে আতিকুর ইসলামের উদ্দেশ্যে বলে,

-” আব্বু তোমার ছোট মেয়ের জামাই বাজার করে এনেছে! হয়তো ভেবেছে তুমি বিত্তশালী অতিথি আপ্যায়ন করতে সক্ষম হবে না!”

অরুণের মুখাবয়ব কঠিন হয়! রাতুল স্ত্রীর দিকে চোখ রাঙিয়ে চায়। মেয়েটা বেশি বলে! আতিকুর ইসলাম নরম গলায় অরুণকে বলল,

-” বাবা এসব..”

-” আমাদের ওখানে একটা রিচ্যুয়াল আছে!বিয়ের পর প্রথমবার শশুর বাড়ি এলে জামাই বাজার করে! আপনাদের এখানে হয়তো এই নিয়ম নেই; জানলে আমি করতাম না বাজার, যেচে অপমানিত হওয়ার জন্য!”

আতিকুর ইসলামকে থামিয়ে ভদ্র কন্ঠে বলল অরুণ! আতিকুর ইসলাম আর কিছু বলেন না। রাতুল লতার দিক কটমট করে চেয়ে অরুণের পাশে বসে বলল,

-” ভাই মজা করে বলেছে লতা!”

-” তাহলে ধরে নিবে আমিও মজা করেই বললাম!”

কাটকাট জবাব! রাতুল অপ্রসন্ন করুণ চোখে পাতার দিকে চায়! যার অর্থ এই যে তোমার ক্ষ্যাপা ষাঁড় তুমিই সামলাও! পাতা খানিকটা হেসে বলল,

-” কি নিয়ে পড়লে সবাই বাদ দাও তো এসব! বেলা কত হলো! সকালের খাবার খেয়ে নাও”

এরইমধ্যে লাবনী আক্তার শরবত নিয়ে আসে চার গ্লাস! অরুণ একগ্লাস নিয়ে অর্ধেকটা খেয়ে ভোরকে দিলো! ভোর‌ বাবার কোলে বসে এক চুমুক খেয়ে মুখ কুঁচকে বলল,

-” উম্ টক! খাবো না!”

লাবনী আক্তার আরেকটা গ্লাস ভোরকে দিয়ে বলল,

-” এটা খাও! এতে চিনি আছে!”

ভোর মুচকি হেসে ঢকঢক করে সবটুকু খেয়ে বলল,

-” থ্যাংক ইয়ু নানু!”

লাবনী আক্তার মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো! ভোর ক্লোজ আপ হাসি দেয় প্রতিত্তরে। ভোর আঙুলের ক্যাড় গননা করে বাবাকে জিজ্ঞেস করে,

-” আব্বু আমি যদি আরো এতগুলো বেলুন কিনি তাহলে কি ওগুলো আমাকে আকাশে নিয়ে যেতে পারবে?”

-” হুম”

অরুণ প্রতিত্তরে ছোট্ট জবাব দেয় ।
ভোর হাসিমুখে আবার সুধায়,

-” তাহলে আরো এতো এতো বেলুন কিনলে আমাদের বাড়িও উড়িয়ে নিয়ে যাবে ওগির বাড়ির মতো? তাহলে ভালো হবে তাই না? আমাদের বাড়ি আকাশে হবে! নিচের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাইকে দেখবো! বড় বড় বিমান আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে!”

অরুণের গোমড়া মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। ছেলের গালে চুমু দিয়ে বলল,

-” আমার কলিজা এতো কথা জানে!”

-” আমি সব জানি!”

বলে অরুণের কোল থেকে নেমে হাসে খিলখিলিয়ে। অরুণের অধরকোনায়ও মুচকি হাসি। পাতা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। লাবনী আক্তার মেয়ের কাছে গিয়ে ধীমে সুরে বলল,

-” এভাবে বলা মোটেও উচিত হয় নি লতা! রাতুলকে যদি এভাবে পাতা বলতো?”

লতাও বুঝতে পারে এভাবে বলা ঠিক হয় নি। সে একবার স্যরি বলে নেবে সিদ্ধান্ত নেয়। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে অরুণের সামনে যায়! রুম্পাকে অরুণের কোলে বসিয়ে দিয়ে বলল,

-” স্যরি বললাম কিন্তু! জামাই মানুষের এতো নাখরা থাকতে নেই! সম্পর্কে আপনার বড় হলেও বয়সে আপনার ছোট। একটু আকটু মজা করার হক আমাদেরও আছে! সেই হক থেকে বঞ্চিত করবেন নাকি?”

অরুণ প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও লতার কথায় হেসে উঠলো। রুম্পাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল,

-” একদম না! বউয়ের বড় বোন তুমি।”

লতাও হেসে উঠলো! পাতা আবারো স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।
_____

মধ্যাহ্নের সময়! অরুণ সরকার সবেই গোসল সেরে পাতার ঘরে বসে আছে। আজ শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করতে যাবে একটু পর! আযান হয় নি এখনো তাই অপেক্ষা। ছোট ভোর প্যান্ট শার্ট ও মাথায় টুপি পড়ে বসে আছে বাবার সাথে; বাবার সাথে সেও গোসল করেছে। আযান হলেই বাবা নানা ও সকলের সাথে নতুন মসজিদে যাবে। সে চুপচাপ মোটেও বসে নেই! এটা ওটা প্রশ্ন করে চলেছে অরুণকে।

-” আব্বু ফ্রাইডে তে মসজিদে নামাজ পড়লে জিলিপি দেয়! বাকি দিন দেয় না কেন?”

-” ফ্রাইডে জুম্মার দিন! এটি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন। তাই!”

ভোর বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ল। আবার চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,

-” আচ্ছা আব্বু এই জিলিপি কি আল্লাহ তায়ালা দেয় ইমাম সাহেবের কাছে? তাহলে তুমি একটু আল্লাহকে বলে দিও আমি জিলিপি নিব না। আমাকে যেন চারটা কোন আইসক্রিম দেয়!”

অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চায়। ভোরও বাবার দিকে তাকিয়ে; একটু পর পর কিউট ভঙ্গিতে চোখের পলক ফেলছে। অরুণের ঠোঁটে হাসি ফুটতে চায়; হাসি লুকিয়ে হাত বাড়িয়ে ছেলের মাথার টুপি টেনে ঠিক করে পড়িয়ে বলে,

-” তুমিই বলিও মোনাজাতে!”

ভোর মাথা নাড়ল। তখন খেয়াল করে বাবার হাতে কিছু হয়েছে। সে বাবার হাত ধরে উল্টিয়ে দেখে। ছিলে গেছে দুই জায়গায়। ভোরের মুখ খানি মলিন হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন ভরা মায়াময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

-” আব্বু? এখানে লাগলো কিভাবে? কিভাবে ব্যাথা পেয়েছো? কখন লাগলো? আমাকে বলো নি কেন?”

অরুণ ছেলেকে বুকে টেনে নিল! শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ঝুঁকে গালে চুমু দিয়ে। ফুলিয়ে রাখা ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,

-” একটু লেগেছে তো! ওতে কিছুই হয় না কলিজা!”

-” বেশি ব্যাথা করছে আব্বু?”

-” তুমি একটু আদর করে দাও! সব ব্যাথা হাওয়া হয়ে যাবে!”

হেসে বলে অরুণ! ভোর বাবার বুক থেকে মাথা তুলে গালে মুখে ছোট ছোট চুমু দেয়। আঘাত প্রাপ্ত হাতে কয়েকটি চুমু দিয়ে বিড়বিড় করে সুরা ফাতিহা বলে ফুঁ দিল।

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পাতা! বাবা ছেলের আবেগীয় মিষ্টি মুহূর্তের সাক্ষী সে। দুজনের মিষ্টি মধুর আলাপনে বাঁধা দিতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। আল্লাহ তায়ালা এদের বাবা ছেলেকে কোথাকার মাটি দিয়ে বানিয়েছে? সেই মাটি কি মিষ্টি ছিল নাকি? না হলে এরা বাবা ছেলে এতো মিষ্টি কেন? পুরাই রসগোল্লার হাঁড়ি! তার তো ইচ্ছে করছে টুপ করে গিয়ে গিলে ফেলতে! নিজের ভাবনায় পাতা নিজেই হাসে। সে সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে! সে শব্দহীন দরজা চাপিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে বাবা ছেলের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ালো! ভোর পাতাকে দেখে বাবার হাত দেখিয়ে বলল,

-” আম্মু দেখ না আব্বু ব্যাথা পেয়েছে! হাত ছিলে গেছে কতখানি!”

পাতা দেখে বেশি না , এই এইটুকু ছিলেছে! তার জন্যই ছেলের এতো উদ্বিগ্নতা! নিঃসন্দেহে অরুণ সরকার একজন সার্থক বাবা। পাতা হেসে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা মলম বের করে বলল,

-” এই যে ওষুধ! এটা দিলে ঠিক হয়ে যাবে! তাই টেনশন নট!”

অরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাতার দিকে চায়। তার চাহনি দেখে পাতা থতমত খেয়ে যায়। আঁচল ঠিক করে। গতরাতের ঘটনা রিপিট টেলিকাস্টের মতো চোখ সম্মুখে ভাসে! কপোল জোড়ায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে। হাত পা সর্ব শরীরে অস্বস্তি নামক পাখি বাসা বাঁধতে শুরু করে! অরুণ সেটা লক্ষ্য করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। হাত বাড়িয়ে ইশারা করে মলম লাগিয়ে দিতে! পাতা অস্বস্তি পিছনে ঠেলে অরুণের সম্মুখীন হয়ে বিছানায় পা তুলে বাবু হয়ে বসল। অরুণের হাত টেনে কোলের উপর রাখে; মলম ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে ধীরে ধীরে লাগিয়ে দিল! সাথে যত্ন সহকারে ফুঁ দিতে ভূলে নি! ভোর বাবার কাছ থেকে সরে আম্মুর পাশে বসে বলল,

-” আব্বু তুমি কিন্তু বললে না কিভাবে ব্যাথা পেলে? তুমি কি দুষ্টুমি করেছিলে?”

তার প্রশ্ন শুনে পাতা গোল গোল করে অরুণের দিকে চায়! অধর জোড়া চেপে হাসি আটকানোর বৃথা প্রচেষ্টায়! অরুণ তাকে চোখ রাঙিয়ে ভোরকে বলল,

-“সেটা তোমার জানতে হবে না!”

-” অবশ্যই জানতে হবে! বলো তুমি? যদি দুষ্টুমি করে থাকো তাও বলো! আমি বকবো না তোমাকে!”

জেদি কন্ঠস্বর! একদম বড়দের মতো করে বলল। যেন সেই অরুণ সরকারের বাবা। আর অরুণ তার ছোট ছেলেটি! পাতা ভোরের দিকে একবার তাকিয়ে অরুণের চোখে চোখ রাখলো! শালার জামাই! এখন জবাব দে? কি দুষ্টুমি করেছেন! আব আয়া না উট পাহাড় কা নিচে। তার হাসি বাঁধ ভেঙে ছড়িয়ে পড়তে চায়। অনেক কষ্টে আটকিয়ে রেখেছে। অরুণ নির্বিকার ভাবে বসে। মুখের অবায়ব ঠাহর করা যাচ্ছে না। পাতা আর নিজের হাসিকে বেঁধে রাখতে পারে না। বাঁধন ছেড়ে দেওয়া মুক্তিলোভি বিহঙ্গের মতোন ডানা ঝাপটিয়ে বেরিয়ে আসে। ডানা মেলে মুক্ত আকাশে মুক্তির আনন্দে উড়তে থাকে এলোমেলো! পাতার হাসি দেখে ভোর পিটপিট করে চায়। আম্মু ওভাবে হাসছে কেন? সে আব্বুর দিকে চায়। অরুণ মুখশ্রীতে এবার খানিকটা রাগ মিশে আছে। তবে সেটা কৃত্রিম নাকি প্রাকৃতিক ঠাহর করা মুশকিল! পাতাকে চোখে শাসায়। পাতা থামে না। হাসতে হাসতে তার চোখের কোনায় পানি জমে গেছে। বিছানায় একপ্রকার গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। ভোর জিজ্ঞেস করলো,

-” আম্মু এভাবে হাসছো কেন? আমাকেও বলো? আমিও হাসবো তোমার মতো করে!”

পাতা হাসতে হাসতেই বলল,

-” এক রাজ্যে এক ডাকাত ছিল! সে রাত্রে ডাকাতি করতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে গেল। ধপাস!”

বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো! ভোর কিছু বুঝলো না তবে সে পাতার প্রাণখোলা হাসি দেখে নিজেও হাসতে লাগলো খিলখিলিয়ে! অরুণের চোখে মুখে এবার কৃত্রিম রাগের প্রতিচ্ছবিও নেই! প্রিয়জনের হাসির মনোমুগ্ধকর কলতানে চোখ, কান ,তনু মন শীতলতায় ছেয়ে যায়! তবুও কৃত্রিম ধমকের সুরে বলল,

-” কি হচ্ছে টাকি পাগলের মতো হাসছো কেন?”

পাতা ও ভোরের হাসি থেমে যায় ধমকে! দুজনে পিটপিট করে চায়। পাতা কাঁচুমাচু মুখে চায়। এ বিষয়ে তার লজ্জা পেয়ে অন্য মেয়েদের মতো বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকার কথা থাকলেও সে আহম্মকের মতো হাসছে! পাতু তুই জীবনে ভালো হলি না। এখন তারই বা কি দোষ! তার হাসি পাচ্ছে আর সে কন্ট্রোল করতে পারছে না!
অরুণ চোখ রাঙিয়ে বলল,

-” ভূতে ভর করেছে? এভাবে কেউ হাসে? এক থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিবো!”

পাতা সটান হয়ে বসে। গাল ফুলিয়ে মন খারাপের রেশ ফুটিয়ে তুলতে চায় মুখশ্রী জুড়ে; কিন্তু ব্যার্থ হয়! হাসি যেন আবার বেড়িয়ে আসে। লোকটার ধমকেও যেন কেমন রসকস নেই! সে আবার হেসে উঠলো সাথে ভোর সঙ্গী! অরুণ হতাশ! এই মেয়ে ছোট ভোরের কোনো অংশে কম না। বিচ্ছু!

চলবে…..