পাতা বাহার পর্ব-৪৩+৪৪

0
593

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৩ (প্রথমাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

ভালোবেসে বাড়িতে কুকুর পোষেন অনেকেই। আবার নিত্যদিনের চলার পথেও কুকুরের দেখা মেলে হরহামেশাই। প্রভুভক্ত হিসেবে খ্যাত বেশিরভাগই কুকুরের শরীরেই রয়েছে র‌্যাবিস ভাইরাস। র‌্যাবিস আক্রান্ত কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে হতে পারে জলাতঙ্ক।
কুকুর হচ্ছে রেবিড অ্যানিমেল। বিড়াল, শিয়াল, অন্যান্য হিংস্র বণ্যপ্রাণী এবং বাদুড় এগুলো সবই রেবিড অ্যানিমেল। রেবিড অ্যানিমেল কামড় বা আঁচড় দিলে জলাতঙ্ক রোগ হওয়ার আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে র‌্যাবিস আক্রান্ত কুকুর কামড় দিলে ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে।
তবে কুকুর কামড় দিলেই যে জলাতঙ্ক রোগ হবে তা কিন্তু ঠিক নয়, কুকুরের মধ্যে জলাতঙ্কের জীবাণু থাকতে হবে। র‌্যাবিস ভাইরাসে আক্রান্ত কুকুরের লালা থেকে ভাইরাসটি ছড়ায়।
কুকুরের লালা যদি কামড়, আঁচড় বা শরীরের ক্ষতস্থানের সংস্পর্শে আসে আর লালার মধ্যে যদি র‌্যাবিস ভাইরাস থাকে তাহলেই জলাতঙ্ক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেহেতু কুকুর রেবিড প্রাণী, সেহেতু তার মধ্যে র‌্যাবিস ভাইরাস থাকতেই পারে। তাই কুকুর কামড় দিলে ঝুঁকি না নিয়ে অবশ্যই দেরি না করে জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে।
জলাতঙ্কের ইনকিউবেশন পিরিয়ড থাকে অর্থাৎ কুকুরের কামড়ের কারণে র‌্যাবিস ভাইরাস শরীরে প্রবেশের পর লক্ষণ বা উপসর্গের বিকাশে যে সময় লাগে সেটি এক বছর পর্যন্তও হতে পারে। তবে সাধারণভাবে এই সময়কাল ৩ মাস ধরা হয়। অনেক সময় ইনকিউবেশন পিরিয়ড ক্ষতস্থান কোথায় তার ওপর নির্ভর করে। কুকুরের কামড় বা আঁচড় যদি ঘাড় বা মাথায় হয় তাহলে ইনকিউবেশন পিরিয়ড কমে আসবে। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের যত কাছাকাছি কামড় বা আঁচড় দিবে তত তার ইনকিউবেশন পিরিয়ড হ্রাস-বৃদ্ধি হবে।
জলাতঙ্ক রোগ হলে প্রথম যে লক্ষণ দেখা দেয় সেটি হলো হাইড্রোফোবিয়া মানে পানি ভীতি দেখা দেয়। রোগী পানি খেতে পারেনা। পরবর্তীতে অন্যান্য লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে শুরু করে। এরোফোবিয়া দেখা দেয় যার কারণে রোগী বাতাস সহ্য করতে পারেনা। আলোও সহ্য করতে পারেনা, অস্বাভাবিক আচরণ করে, মস্তিষ্কের প্রদাহ দেখা দেয়, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।

কুকুর কামড়ালে বা আঁচড় কাটলে করণীয়:
কুকুর কামড় দিলে বা আঁচড় কাটলে যদি কোন ধরনের ক্ষত তৈরি হয় তাহলে ক্ষতস্থান তাৎক্ষণিকভাবে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় নিয়ে কাপড় ধোয়ার ক্ষারযুক্ত সাবান দিয়ে ফেনা উঠিয়ে ধুতে হবে। আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, কুকুরের কামড় বা আঁচড় দেয়ার ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে অবশ্যই টিকা নিতে হবে।

ক্ষতস্থানের ক্যাটাগরি:
কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের ফলে সৃষ্ট ক্ষতস্থানকে ৩টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। যেমন-
ক্যাটাগরি ১: শরীরে যেখানে কোনো ক্ষতস্থান থাকে না। কুকুরের সংস্পর্শে আসা, কুকুরকে খাওয়ানোর সময়, আদরের সময় লালা লেগে গেছে কিন্তু কোনো কামড় বা আঁচড় হয়নি বা কোনো ক্ষতস্থানে লালা লাগেনি সেক্ষেত্রে এটি ক্যাটাগরি ১। এর জন্য টিকা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। জায়গাগুলো সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেই হবে।

ক্যাটাগরি ২: এক্ষেত্রে কুকুরের কামড় বা আঁচড়ের ফলে শরীরে ক্ষত থাকে, কিন্তু রক্তপাত হয় না। এর জন্য অ্যান্টি র‌্যাবিস ভ্যাকসিন (এআরভি) নিতে হবে।

ক্যাটাগরি ৩: এক্ষেত্রে শরীরে ক্ষত থাকে এবং রক্তপাত হয়। এ ছাড়া মাথায়, বুকে বা ঘাড়ে কুকুরের কামড় বা আঁচড়ে রক্তপাত হোক বা না হোক, সেটিকে ক্যাটাগরি ৩ ধরা হয়। কারণ এই জায়গাগুলো মস্তিষ্কের একদম কাছাকাছি। র‌্যাবিস ভাইরাসটি মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে প্রদাহ সৃষ্টি করে ফলে মৃত্যু হয়। এক্ষেত্রে রোগীকে জলাতঙ্কের টিকা নিতে হবে। বিশেষ করে ক্যাটাগরি ৩ বাইটের জন্য অ্যান্টি র‌্যাবিস ইমিউনোগ্লোবিউলিন (আরআইজি) ইনজেকশনও নিতে হবে।

জলাতঙ্ক শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য, আবার শতভাগ প্রাণঘাতী। র‌্যাবিস আক্রান্ত কুকুর কামড় বা আঁচড় দিলে সঙ্গে সঙ্গে টিকা নিলে জলাতঙ্ক শতভাগ প্রতিরোধ করা যাবে। আর তা না হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই শুধু টিকার মাধ্যমেই সুরক্ষা সম্ভব।
___

হাসপাতালের এক কেবিনের বেডে বসে আছে অরুণ সরকার। কোলে তার কলিজা। পাতা কেবিনের অপর বেডে বসে আছে। চোখ মুখ তার ফুলে লাল হয়ে আছে। অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে আছে পাতার মুখশ্রী। শান্ত নজর বাবা ছেলের উপর নিবদ্ধ। ঘুমন্ত জখমি ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আছে লোকটা। সেই যে পাতার কাছ থেকে কোলে নিয়েছে এপর্যন্ত কোল ছাড়া করে নি। হাসপাতালে এসেই যেন সব মাথায় তুলে নিয়েছিল। চিল্লাফাল্লাতে পুরো হাসপাতালের মানুষজনের বিরক্তের কারণ হয়েছে সে। ডাক্তারদের তো মাথায় উঠে যেন নেচেছে। ছাড় পায় নি ফিমেল ডাক্তারও। এক ফিমেল ডাক্তার তো সেইরকম রেগে যায়। অরুণের সাথে তর্কে বিতর্কে বেশ কথা আগায়। পাতা ও শুভ ব্যাপারটাকে সমঝোতার মাধ্যমে শৃঙ্খলায় নিয়ে আসে। অরুণ একদন্ডের জন্যও ছেলেকে ছাড়বে না। এমনকি ডাক্তাররা অরুণের কোলেই ভোরকে রেখে তার চিকিৎসা করেছে। ভোর এখন মোটামুটি সুস্থ। হাতে আর পায়ে চার জায়গায় কুকুর দাঁত বসিয়েছে তবে মাংস তুলে নেয় নি। জিন্সের প্যান্ট হওয়ায় কুকুরের দল খুব একটা সুবিধা পায় নি। কোমড়ে এক জায়গায় নখ বসিয়েছে হিংস্র ভাবে। সেখান থেকেই বেশি রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। আর পা থেকে বুক অবধি বেশ জায়গায় আঁচড়ের চিহ্ন। ডাক্তাররা পাতাকে আলাদা কেবিনে নিয়ে তারও চিকিৎসা করে। পাতার পায়ে ও পেটে দাঁত বসিয়ে আঁচড় কেটেছে গভীর ভাবে। হাতেও আঁচড় লেগেছে। ডাক্তার পাতার কাছে ইন ডিটেইলস কুকুরের বর্ননা নিয়েছে। পাতা শান্তভাবে সব খুলে বলেছে। এতে ডাক্তার ধারনা করে কুকুরটি সুস্থ হবে। কোনো জলাতঙ্ক বা ভাইরাসে আক্রান্ত নয়। আর এটাও বুঝতে পারে কুকুর দুটো আর কুকুরের দলের মতো স্বাভাবিক মোটেই না। কুকুর গুলো লম্বা, পরিষ্কার, মাংসল সাথে বেশ হিংস্র। তাঁরা ধারনা করে এগুলো ট্রেইনিং প্রাপ্ত কুকুর। বিভিন্ন সুরক্ষা কর্মীরা কুকুর ট্রেইনার দিয়ে ট্রেইনিং করিয়ে আর্ম বা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। পাতার বর্ননা শুনে তাঁরা শুভ কাছে সব খুলে বলে। শুভ সব শুনে বেশ চিন্তায় পড়ে তবে অরুণের কাছে ব্যাপারটা চেপে যায়। শালা এমনি ক্ষেপে আছে! এসব শুনলে কি করবে তা সবার ভাবনার বাইরে।

অরুণ ছেলের ব্যাথায় কাতর ঘুমন্ত মুখটার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। ছেলেটাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। তবেই না তার কলিজাটা ঘুমুচ্ছে। ডাক্তার ভোরের পুরো শরীর বেশ সময় নিয়ে স্যাভলন পানি দিয়ে পরিষ্কার করেছে। ছেলেটা গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করে কেঁদেছে।

~আব্বু ব্যাথা! কষ্ট হচ্ছে! আমি মরে যাবো আব্বু!

বলে চিৎকার করেছে। ছেলের সাথে অরুণের কান্নার করুণ শব্দে সবাই মূক বনে গেছে। এ কেমন বেদনাদায়ক দৃশ্য! ড্রেসিং করানোর আগে ডাক্তার হাল্কা ডোজের ঘুমন্ত ইনজেকশন পুশ করে। এতেও অরুণ সরকারের ঘোর আপত্তি ছিল! তার ছেলে এমনি ব্যাথায় কাহিল তার উপর ইনজেকশন? শুভ অরুণকে সামলাতে গেলে বেচারা এক থাপ্পড় খেয়ে ফিরে এসেছে। তবে ডাক্তার হাল ছাড়ে নি। এসব তাদের কাছে ডালভাতের মতোন। কৌশলে অরুণের অগোচরেই পুশ করে। বোঝায় এভাবে ড্রেসিং করলে ছেলেটা কষ্ট পাবে। ভোর ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ে সাথে অরুণ সরকার শান্ত হয়ে আসে। ড্রেসিং করানোর পর কেবিনে শিফট করেছে। সেখানেই বসে আছে তাঁরা। অরুণ একটু পর পর ছেলের মুখে চুমু খায়। গা থেকে চাদরটা সরিয়ে জখমে ফুঁ দিয়ে আবার ঢেকে নেয়। বিড়বিড় করে দোয়া দরুদ পাঠ করে ছেলেকে ফুঁ দেয়। তার ভেজা চোখ শুকায় না। অরুণ ঢোক গিলে পাশে তাকায়। পাতার চোখে চোখ পড়তেই দু’জনেই নজর লুকানোর চেষ্টা করে। আড়চোখে চাইলে আবার নয়নে নয়নে মিলন ঘটে। দুজনেই বেশ অপ্রস্তুত হয়। পাতা দরজার দিকে নজর ফেরায় আর তাকায় না এদিকে। অরুণ একটু পর পরই পাতার দিকে চায়। তবে চোখের দিকে না। হাতের আঁচড়! পিংক কালারের লেডিস জিন্স গুটিয়ে রেখেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ। পরনের লং কুর্তির পেটের দিকটার ছিঁড়ে যাওয়া অংশ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা ব্যান্ডেজ। অরুণের দম যেন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। হা করে শ্বাস টানে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে। আঁখি যুগলে ভরে ওঠে আবার। গড়িয়ে পড়বে অরুণ ছেলের গলায় মুখ গুঁজে দেয়। চাদড়ে চোখ মুখ মুছে নেয়। বুকটা অনুতাপের অনলে পোড়ে দাউদাউ করে।

এরমধ্যে শুভসহ অরুণের বন্ধুরা প্রবেশ করে। অরুণ মাথা তুলে তাদের দিকে তাকালো। ফয়সাল এসে অরুণের পাশে বসে কাঁধে হাত রাখে। কি বলে সান্ত্বনা দেবে একে? সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই তার কাছে। সে অরুণের মনের অবস্থা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফয়সাল বলে,

-” সিনক্রিয়েট মোটেও করবি না। ডাক্তার আসছে! ভোরকে..”

-” কি?”

-” ভ্যাক্সিন দিবে দুইজনকেই! পাঁচ ডোজের। আজ দিবে এরপর তিনদিন পর! তার পর ক্রমান্বয়ে সাত, চৌদ্দ, আটাশ তম দিনে! সাথে আর আই জি ইমিউনোগ্লোবিউলিন ইনজেকশন পুশ করবে।”

অরুণের মুখের রঙ উড়ে যায়। যেন টিকা তাকেই দেওয়া হবে। তাকে দিলে হয়তো মুখটা এমন হতো না। তার মানিক টাকে দিবে। এই অসুস্থ শরীরে এতো গুলো ইনজেকশন?
অরুণ ঘন ঘন শ্বাস ফেলে বলে,

-” আজ থাক। ছেলেটা আর সহ্য করতে পারবে না। কাল দিলে..”

শুভ তেড়ে আসে। আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে বলে,

-” তুই তোর মুখ বন্ধ রাখ! নইলে একটা মারও জমিনে পড়বে না। শালা সার্কাস বানিয়ে রেখেছে! দে ভোরকে?”

অরুণের কোল থেকে ভোরকে নেওয়ার চেষ্টা করে। অরুণ দেয় না। এরমধ্যে ডাক্তার নাজনীন চলে আসে। অরুণ তাকে দেখে গম্ভীর মুখে বলে,

-” দেখুন ডক্টর আমার..”

-” একদম চুপ! এই বদমেজাজি লোক এখানে কেন? এটাকে সরিয়ে নিয়ে যান! একে দেখলেই আমার রাগ লাগছে!”

ডাঃ নাজনীন এমনভাবে বললেন যেন অরুণ কোনো পাগল। পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে এসেছে। অরুণ মুখটা অসম্ভব রকমের গম্ভীর হয়ে যায়। এই মহিলা আবার?
পাতা উঠে আসে। ডঃ নাজনীনের সাথেই তখন অরুণের তর্ক লেগেছিল! শুভ অরুণের কোল থেকে ভোরকে নিতে চায় অরুণ নাছোড়বান্দা! সে দেবে না। ডাঃ নাজনীন পাতাকে ইশারা করে। পাতা শুভকে ইশারায় কিছু বলে। অরুণের কোল থেকে সাবধানে ভোরকে টেনে নেয় নিজের কাছে। অরুণ বাঁধা দেয় না। পাতার কাছে দিয়ে চুপচাপ তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ ও ফয়সাল অরুণকে জাপটে ধরে নিয়ে যায় কেবিন থেকে। ডাঃ নাজনীন হেসে দরজা বন্ধ করে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” এই পাগলকে কিভাবে সামলান মিসেস পাতা? পুরাই বদমেজাজি! একরোখা নাছোড়বান্দা!”

পাতা ঠোঁটে হাসি ফুটতে চায় না তবুও ঠোঁটের আগায় সৌজন্য মুলক হাসি ফুটে ওঠে।

-” আমি বসছি! আপনি আগে আমাকে দিন! আগে ওকে দিলে উঠে যাবে। তখন সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে!”
-” ঠিক আছে।”
ডাঃ নাজনীন পাতার মাংসপেশীতে ইনজেকশন পুশ করে। এরপর ভোরের। এবার ভোর চোখ খোলে বড় বড় করে। খুলেই আব্বু বলে হাঁউমাঁউ করে কান্না শুরু করে। ডাঃ নাজনীন অনেক কষ্টে বাকি ইনজেকশন দেয়। ভোর আরো জোরে জোরে কাঁদতে থাকে। ইনজেকশন দেয়া জায়গায় পাতা আলতোভাবে তুলো ঘঁষে আদুরে গলায় বলে,

-‘ বাবা কিছু হয় নি! ঠিক হয়ে যাবে। আম্মু আছে না! কাঁদে না কলিজা! এই যে আম্মুর দিকে তাকাও দেখি? দেখি তাকাও?”

ভোর কাঁদতে কাঁদতে পাতার দিকে তাকায়। পাতার তার কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়।

-” ভোর সোনা অনেক স্ট্রং তাই না? কাঁদে না বাবা ‌ একটু সময় নাও সব ঠিক হয়ে যাবে!”

ভোর পাতার বুকে মুখ গুঁজে ফোপাতে ফোপাতে বলে,

-” পঁচা ডাক্তার ব্যাথা দিয়েছে আম্মু!”

-” তাই? ডাক্তারকে আমরা গণধোলাই খাওয়াবো। কতবড় সাহস আমার ছেলেকে ব্যাথা দেয়! তুমি একটু শান্ত হও বাবা?”

ভোর শান্ত হয়ে আসে। তবে তার ফোপানো বন্ধ হয় না। পাতা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে গালে চুমু দেয়। ভোর পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায়। পাতার বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে শান্ত ভদ্র বাচ্চার মতো চেয়ে থাকে পাতার দিকে। আড়চোখে ডাক্তারের দিকেও চায়। পাতার বুকে পুনরায় মুখ গুঁজে বলে,

-” আম্মু এই পঁচা ডাক্তার কে যেতে বলো! কিভাবে দেখছে আমাকে!”

ছেলেটার পরনে শুধু ছোট হাফপ্যান্ট। পাতা পাশ থেকে চাদর নিয়ে ঢেকে দেয় গা। ছেলেটার এতো লজ্জা! ডাঃ নাজনীন হেসে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” ভোর লজ্জা পাচ্ছে বুঝি? আচ্ছা আমি পঁচা ডাক্তার চলে যাচ্ছি! মিসেস পাতা আপনার ছেলেটা ভারী কিউট! একদম আপনার মতোই। ভাগ্যিস বাপের মতো হয় নি।”

পাতা মুচকি হাসলো। ডাঃ নাজনীন আবার বলে,

-” আপনি খুবই ভালোভাবে বাচ্চা সামলাতে পারেন! আমার একটা মেয়ে আছে এরচেয়ে একটু ছোট। কি দুষ্টু আর কি চঞ্চল। একটুও আমার কথা শুনবে না। যা বলবো তার উল্টো টা করবে!”

-” আমার ছেলেও চঞ্চল! তবে মোটেও দুষ্টু নয়। হিরের টুকরো ছেলে আমার।”

-” আচ্ছা আমি যাচ্ছি। আপনাদের কাল সকালে রিলিজ দেওয়া হবে। রাতটা এখানেই ম্যানেজ করবেন। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবেন এনি টাইম। আসছি!”

বলে দরজা খোলে। অরুণ দরজা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল। ডক্টরকে দেখে কটমট করে চায়। তার ছেলেটা কাঁদছিল সে স্পষ্ট শুনছে। ডাক্তাররা আসলেই নির্দয় হয়। তার জখমি ছেলেকে ইনজেকশন দিয়ে ব্যাথা দিলো! ডাঃ নাজনীন অরুণের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে চলে গেলো! অরুণ হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে।

ভোর পাতার কাঁধ গলিয়ে উঁকি দেয়। অরুণ ছেলের কাছে এগিয়ে এসে মাথায় হাত রাখে।

-” আব্বু ব্যাথা পেয়েছিলে?”

বলতে বলতেই ঝরঝর করে কেঁদে দেয় যেন কোনো বাচ্চা ছেলে। পাতা ঘুরে বসে গোল গোল করে চায়। শুভ ফয়সাল সহ বাকিরা হতাশ হয়ে অপর বেডে বসে পড়লো। ভোর বাবার কান্না দেখে ঠোঁট উল্টায়! পাতা লক্ষন বুঝতে পেরে ভোরের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” ভোর তুমি না স্ট্রং বয়। একদম কাঁদবে না। স্যার? আপনার বন্ধুকে চুপ করতে বলুন!”

শুভর উদ্দেশ্য শক্ত গলায় বলে। অরুণ দু হাতে নাক মুখ মুছে ওয়াশ রুমে যায়। ভোর আর কান্না করে না। অরুণ একটু পর ফিরে আসে ভেজা মুখে। পাতার পাশে বেডে পা তুলে উঠে বসে। আস্তে আস্তে হাত বাড়ায় পাতার ওড়নার উদ্দেশ্যে; ভেজা মুখটা মুছবে। কিন্তু হাত এগোয় না। জড়তা এসে ভিড় করে। এরমধ্যে পাতা পাশে তাকায় অরুণ ঝট করে হাত গুটিয়ে নেয়।

-” আম্মু? বাড়ি যাবো না?”

-” না বাবা। আজ আমরা এখানেই থাকবো!”

ভোরের মন খারাপ হয়। আজ না তার বার্থডে? কেক কাটা হবে না? সব বন্ধুদের সাথে খেলা হবে না? মজাও হবে না। সে গোমড়া মুখে বলে,

-” আজ না আমার বার্থডে? কেক কাটবো না?”

কি জবাব দেবে পাতা? কি বলেই বা সান্ত্বনা দিবে! পাতা ঝুঁকে কোলে মাথা রাখা ভোরের কপালে চুমু দেয়। কিছু বলবে এর আগে অরুণ বলে,

-” আব্বু আমরা এখানেই কাটবো কেক! আমি অর্ডার করছি!”

বলে ফোন বের করে বিছানা থেকে নামল। ভোর তার হাত দেখে। ব্যান্ডেজ করা। আঁচড়ের দাগ লাল হয়ে ফুলে গেছে। সে নাক টেনে বলে,

-” আব্বু আমি কাটবো না কেক! আমার হাতে ব্যাথা করে!”

অরুণের বুকটা খা খা করে। কান্নায় গলা জড়িয়ে আসে। সে আর ফোন করে না। ছেলের হাত আস্তে ধরে ছোট ছোট চুমু দেয়। পাতা ভোরের হাতটা আলগোছে ছাড়িয়ে গম্ভীর মুখে বলে,

-” ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে ডাক্তার।”

অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে সরে আসে কিছু বলে না। তবে তার ইচ্ছে করছে ছেলেটাকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিতে। কিন্তু সাহস হয় না ওই কোল থেকে উঠিয়ে নিতে। আশ্চর্য সে কি ভয় করছে পাতাবাহারকে? অরুণ বন্ধুদের পাশে গিয়ে বসে। ফয়সাল জীবন মুখে হাত দিয়ে আছে। অরুণ এখানে বসায় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

-” ভাই এইজন্যই বলে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এখন বোঝো মজা!”

ফয়সাল কন্ঠ আরেকটু খাদে নামিয়ে বলে,

-” তখন আবেগের ঠেলায় মেরে দিলি থাপ্পড়! বাঘের মতো গর্জে উঠছিলা মাম্মা! এখন বিড়ালের মতো মিও মিও করো কেন? কি পাওয়ার ফুস?”

বলেই কিটকিটিয়ে হেসে ওঠে দু’জন। অরুণ চোখ রাঙায়। দু’জন পরিস্থিতি বিবেচনা করে চুপ করে। তবে এইরকম পরিস্থিতিতেও তাদের অধরে হাসি যেন থামে না। তাই বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। শুভ গলা খাঁকারি দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। পাতার কাছে গিয়ে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” ভোর বাবা এখন কেমন লাগছে? বেশি ব্যাথা করছে?”

ভোর পিটপিট করে চায়। বিড়বিড় করে উত্তর দেয়,

-” একটু একটু ব্যাথা করছে। ভালো লাগছে না।”

সহজ সরল জবাব। পাতার চোখ আবারো ভরে ওঠে। ইশ্ যদি একজনের ব্যাথা আরেকজনের ভিতর ট্রান্সফার করা যেতো! শুভ তার গালে হাত রেখে বলে,

-” সব ঠিক হয়ে যাবে।”

বলে সেও বেড়িয়ে যায়! কেবিনে ওরা তিনজন! পাতা অরুণ ও ভোর! ডাবল বেডের কেবিন এটা। ঘরের দুই প্রান্তে দুই বেডে দু জন বসে আছে। পাতা ভোরের মাথা কোলে নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে বসে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অপর বেডে অরুণ চুপচাপ বসে। দৃষ্টি পাতাতেই। সে ভাবে কথা বলে সব ঠিক করে নেবে এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। সে রাগে আবেগের বশে হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে থাপ্পড় মেরে খুব বড় অপরাধ করেছে। সে স্বীকার করে। মেয়েটা নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পেয়েছে। পাবে না? মেয়েটার যে কোনো দোষ নেই। বরং তার ছেলেকে বাঁচাতে নিজের ব্যাপারেও একবার ভাবে নি। ঝাপিয়ে পড়েছিল। শুধু একটা শুকনো স্যরি বললেই ব্যাপারটা মিমাংসা হবে না। তবে কিছুটা হলেও তার অনুতাপ বোধ কমে যাবে। সে উঠে আসে। গলা খাঁকারি দেয় কিছু বলবে এর আগে দরজায় নক করে কেউ। ভিতরে প্রবেশ করে আসমা বেগম, আদুরি, আরিয়ান, লতা , লাবনী আক্তার, লাবিব ও আতিকুর ইসলাম। অরুণের আর কিছু বলা হয় না। পুরো কেবিন লোক সমাগমে ভরে যায়। সবাই ভোরের সাথে টুকটাক কথা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় ছলছল চোখে। লতাও তার ব্যাতিক্রম নয়। সে ভোরের সাথে কথা বলে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” তুই ও তো অসুস্থ! রেস্ট করা প্রয়োজন! এককাজ কর তুই আমাদের সাথে বাড়ি চল! ভোরের খেয়াল রাখার জন্য তার বাবা আছে। নিজের ছেলের খেয়াল আশা করি সে খুব ভালো ভাবেই করতে পারবে। তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে আরেকজনের খেয়াল রাখবি যদি এদিক সেদিক হয় তাহলে তো আবার থাপ্পড় জুটবে।”

স্পষ্ট ও ভদ্র ভাষায় খোঁচা। উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারে এ খোঁচার হকদার কে! অরুণ গম্ভীর মুখে পকেটে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লাবনী আক্তার মেয়েকে চোখ রাঙিয়ে চুপ থাকতে বলে। লতা চুপ থাকার মেয়ে মোটেও না। লোকটা তার বোনকে সবার সামনে থাপ্পড় মারবে, ধাক্কা দেবে, চিল্লাচিল্লি করবে আর সে এমনি ছেঁড়ে দেবে?

-” কি হলো? উঠছিস না কেন? উঠ?”

পাতা কিছু বলে না। চুপচাপ বসে থাকে। ভোর উঠে বসে পাতার গলা জড়িয়ে বলে,

-” আম্মু তুমি গেলে আমিও যাবো!”

পাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” আমি যাবো না!”

লতা ক্ষেপে যায়।

-” কেন? লাত্থি গুঁতা খেতে ভালো লাগে? অপমানিত হয়ে সুখ পাস? উনি সবার সামনে তোকে মারার সাহস কিভাবে পায়? নাকি এসবে অভ্যস্ত তুই?”

অরুণ হনহন করে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। পাতা তাঁর যাওয়া দেখে বোনের দিকে তাকিয়ে শক্ত করে বলে,

-” আপু? এটা হসপিটাল! আর বাচ্চার সামনে কিসব বলছো? আমি যাবো না তোমরা যাও! এটা আমাদের পার্সোনাল ব্যাপার আমরা মিটিয়ে নিবো!”

-” কাকে কি বলছি আমি! তোর তো আত্মসম্মানবোধটাই নেই! বাঙালি বউ! হাসবেন্ডের শত খুন মাফ!..”

ভোরের চোখের কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। পাতা ঠাহর করতে পারে। ছেলেকে বুকের সাথে আরেকটু সেঁটে নিয়ে বলে,

-” এখন আত্মসম্মানবোধ নেই তো কি করবো? জন্ম হওয়ার আগেই যার মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে সে কিভাবে দাঁড়াবে? তিন বেলা খাওয়ার খোঁটা শোনার পরেও ক্ষুধা নামক মহামারির কাছে হেরে ভাতের থাল নিয়ে বসতে হয়েছে তার আবার কিসের আত্মসম্মানবোধ আপু?”

উপস্থিত সবাই বাকহারা। লতা মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আতিকুর ইসলাম আস্তে করে বেড়িয়ে আসে। কোন মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে? আসমা বেগম, আদুরি, আরিয়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। লাবনী আক্তার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে পাতার মাথায় হাত রেখে বেড়িয়ে যায় কেবিন থেকে। লতা বোনের হাত মুঠোয় ভরে বলে,

-” পাতু তোর এই বড়বোন সবসময় তোর সাথে আছে। আসছি ভালো থাকিস।”

সেও চলে যায় লাবিবকে নিয়ে। পরিবেশ থমথমে। ভোর ফোপাচ্ছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। পাতা তাকে বালিশে শুইয়ে দেয়। আসমা বেগম একটা ব্যাগ পাতার দিকে বাড়িয়ে বলে,

-” এতে ড্রেস আছে তোমার আর অরুণের। চেঞ্জ করে নাও! আর ওই ব্যাগে খাবার আছে।”

পাতা ব্যাগটা নেয়! সত্যিই চেঞ্জ করা প্রয়োজন। তার কুর্তিটা ছিঁড়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। ওড়নার অবস্থাও নাজুক! সে বেড থেকে নামবে ভোর তাঁর ওড়না টেনে ধরে বলে,

-” আম্মু তুমি চলে যাবে না তো?”

-” না বাবা। চেঞ্জ করে আসছি। আদুরি ওর কাছে বসো তো?”

পাতার কথায় আদুরি ভোরের শিয়রে বসে। আসমা বেগমও তাঁর কাছে বসে টুকটাক কথা বলে। পাতা ওয়াশ রুমে যাবে এরমধ্যে বাইরে থেকে কেমন গন্ডগোলের আভাস আসে। উঁচু গলায় আওয়াজ শোনা যায়। পাতার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। লতা আপু আবার ওনার সাথে কথাকাটাকাটি করছে না তো?
পাতা ব্যাগটা রেখে দরজা খুলে বেড়িয়ে যায়। তাঁর পিছনে আরিয়ানও বেড়িয়ে আসে।

-” কিসের গন্ডগোল শোনা যায়?”

আরিয়ানের কথায় পাতা বিরক্ত হয়ে বলে,

-” আপনি যেখানে আমিও সেখানে কিভাবে বলবো?”

আরিয়ান বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায়। পাতা পিছনে। তাদের কেবিনের চার কেবিন পরের কেবিনে দুটো লোক টাকা নিয়ে ঝগড়া করছে উঁচু গলায়। পাতা আরিয়ান স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে ব্যাক করে।

-” আমি ভেবেছিলাম ভাই তোমার বোনের সাথে ঝগড়া করছে!”

-” আমিও!”

বলেই পাতা আরিয়ানের দিকে তাকায়। আরিয়ানও চায়। হঠাৎ দুজন হেসে উঠলো শব্দ করে।

অরুণ গম্ভীর মুখে এগিয়ে আসছে। হাতে কিছু ফলফলাদি, আইসক্রিম, কেক, পানির বোতল সহ আরো কিছু জিনিস। তার সাথে তার বন্ধুরা। সবাই মিলে অরুণকে লেগপুল করছে। অরুণ কিছু বলছে না দেখে যারা আরো আস্কারা পেয়ে বসে। অরুণ বিরক্ত হয়। তার মন মেজাজ বিক্ষুব্ধ! এখন লেগপুল করার মতো পরিস্থিতি আছে? কিন্তু এই বন্ধু নামক আজব প্রাণী দের এটা কে বোঝাবে!!এরইমধ্যে হঠাৎ দেখে লতা লাবিবের হাত ধরে হনহন করে আসছে।অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। শুভ লতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” কোথায় যাচ্ছো এমন করে? আন্টি আঙ্কেল কই?”

লতা‌ জবাব দেয় না। থমথমে মুখে হাঁটতে হাঁটতে তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রাসেল কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

-” এর আবার কি হলো?”

অরুণও জবাব দেয় না । হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়। লেফট টার্ন নিতেই চোখে পড়ে পাতা ও আরিয়ানকে। অরুণ বড় বড় পা ফেলে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-” এখানে তোরা? কি হয়েছে?”

-” ওদিকে দুটো লোক ঝগড়া করছে কিছু নিয়ে। তোমার আম পাতা জোড়া জোড়া ভেবেছে তার বোনের সাথে লেগেছে তোমার!”

আরিয়ান হেসে বলে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।এদের কি কমন সেন্সের অভাব? তার ছেলেটা ব্যাথায় কাতরাচ্ছে আর এদিকে এরা হাসছে? তার ছেলের ব্যাথার কাতর মুখটা দেখে মায়া হয় না!! তারা রাইট টার্ন নিয়ে কেবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটা দেয়। পাতা পায়ে ও শরীর ব্যাথা হওয়ার দরুন আস্তে হাঁটতে থাকে। অরুণ লক্ষ্য করে হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়। পাতার পায়ে পায়ে ধীরে হেঁটে যায়। হঠাৎ অরুণ পাতার বাহু ধরে। পাতা সেটা দেখে ঝটকায় সরিয়ে দেয়। অরুণ হাত পকেট ঢুকিয়ে বলে,

-” সত্যিই অসুস্থ তুমি! রেস্ট প্রয়োজন। লতার সাথে যেতে পারতে!”

এ কথা মোটেই বলতে চায় নি অরুণ। মুখ ফসকেই বেড়িয়ে গেল যেন। পাতার পদযুগল থেমে যায়। অরুণ পাতার হাত ধরে বলে,

-” স্যরি। একদম বলতে চাই নি। চলো পাতাবাহার?”

পাতা আস্তে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দেয়। অরুণ এগিয়ে এসে তার বাহু ধরে আটকায়,

-” স্যরি বলছিতো! প্লিজ সিনক্রিয়েট করো না। চলো?”

পাতা ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে অরুণের পেটে হাত রেখে ধাক্কা দেয়। অরুণ পিছিয়ে যায় দুই কদম। পাতা একপ্রকার চিল্লিয়েই বলে,

-” সিনক্রিয়েট করছি আমি? একদম এগোবেন না!”

অরুণ থেমে যায়। শান্ত গলায় বলল,

-” পাতাবাহার কুল! আমি সব দোষ স্বীকার করছি! চলো? ভোর..”

-” আমি গিয়ে কি করবো? আপনার ছেলে! আপনি আছেন তো!”

পাতা শান্ত গলায় বলল। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতার হাত ধরে বলে,

-” তোমারও ছেলে! চলো?’

পাতা আবার ধাক্কা দেয়,

-” আমার ছেলে! হ্যাঁ আমার ছেলে।ভোর আম্মু ডাকে আমায়। আমি তার মা! সেটা ভোর মানে! আমি মানি! কিন্তু আপনি অরুণ সরকার মানেন না। আপনার কাছে তো আমি ভোরের আয়ার মতো। শুধু মাসে মাসে বেতন না দিয়ে একটু আকটু যত্ন নেন।”

ইতিমধ্যেই ঘটনাস্থলে মানুষের ভিড় জমে গেছে। শুভ, ফয়সাল রাসেল ও জীবন আগেই উপস্থিত হয়েছে। অরুণের চোয়াল শক্ত হয়। ধমক দিয়ে বলে,

-” বেশি হয়ে যাচ্ছে। ভিতরে চলো?”

পাতা তার চেয়েও গলা উঁচিয়ে বলে,

-” যাবো না আমি কি করবেন? এখন অপমান ফিল হচ্ছে? অপমান বোধ শুধু আপনার আছে আমার নেই? ভোরের কষ্টে শুধু আপনার বুকে ব্যাথা হয় আর কারো না? কথায় কথায় ধমক ঝাড়ি! আরে আমি শালা ভাবি যে ভালোবেসে শাসন করে। ”

হাসে পাতা। চোখের পানি বাঁধ ছেড়ে দিয়েছে। পাতা হাতের উল্টো পিঠে সেটা মুছে নিয়ে বলে,

-” আমি ভোরের আম্মু! আপনি মনে রাখবেন মা হই আমি তাঁর। ছেলের জন্য আমার বুকটাও ধুকপুক করছিলো। শ্বাস আটকে আসছিলো। কিন্তু আফসোস আপনার চোখে পড়ে নি। আপনি একজন স্বার্থপর লোক। আমাকে বলেন ভোরের মা হতে অথচ নিজেই আমাকে তার মা ভাবতে পারেন না।
আমি মানছি আমার আরো খেয়াল রাখা উচিত ছিলো। তবুও আমি আমার সর্বচ্চটা দিয়ে প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ভাগ্য বলতেও একটা কথা আছে না? এখন যদি আপনি থাকতেন বাড়িতে তারপরও এমন ঘটনা ঘটতো তখন আপনি কার উপর দোষ বর্তাতেন?”

পিনপিন নিরবতা। অরুণের মুখে কথা নেই। চোখ মুখ স্বাভাবিক। যেন আয়নার প্রতিচ্ছবিতে তার দোষ গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। শুভ পাতার কাছে আসে। তার মাথায় হাত রেখে বলে,

-” পাতা যথেষ্ট হয়েছে। অরুণ যা ভোরের কাছে। আমি আছি!”

পাতা চোখ মুখে মুছে। শুভ নির্দ্বিধায় তার হাত ধরে নিয়ে যায়। পাতাও বাধ্য মেয়ের মতো তার সাথে হাঁটতে থাকে।
অরুণ তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু পল। তারপর উল্টো ফিরে কেবিনেটের দিকে চলে যায় সুর সুর করে। ফয়সাল জীবন তার পিছু পিছু।
____

হাসপাতালের পাশে এক চা স্টলে বসে আছে পাতা ও শুভ! একটা অল্পবয়সী ছোকরা দু কাপ চা দিয়ে যায় তাদের হাতে। শুভ চায়ে চুমুক বসিয়ে পাতাকে বলে,

-” খাও? ফ্রেশ লাগবে।”

পাতা ফুঁ দিয়ে চুমুক দেয়। শুভ পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। হালকা হেসে বলে,

-” তুমি খুব ভালো মেয়ে পাতা!”

পাতা তার দিকে চায়। শুভ সামনে দৃষ্টি রেখে বলে,

-” কিন্তু আমার বন্ধুটা মোটেও ভালো না। সত্যিই ভালো না! তুমিই বলো ভালো?”

পাতা পিটপিট করে চায়। সে কি না বলবে? শুভ পাতার জবাবের আশা না করে বলে,

-” ভাবতে পারো বন্ধুর হয়ে সাফাই গাইছি! বা ইমোশনাল গল্প শুনিয়ে ওর দোষ ঢাকতে চাইছি! তবুও বলবো আমি!”

পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। শুভ বলতে থাকে,

-” ওই শালার ট্রাস্ট ইস্যু আছে! কাউকেই সহজে ভরসা করতে পারে না। ভরসা করলেও খুঁত খুঁত স্বভাবের! অরুণের সাথে আমাদের পরিচয় কিশোর বয়স থেকেই। একসাথে থেকেছি, খেলেছি ,মারামারি, বিড়ি, সিগারেট সব। তাই বলে ভাববে না উচ্ছন্নে যাওয়া লোক আমরা। উঠতি বয়সে ফ্যান্টাসিতে ভুগে ওসব টেস্ট করেছি একবার করে। অরুণ খুবই চাপা স্বভাবের। কাউকে কিছু বলবে না। আমাদেরকেও কখনো কিছু বলে নি। ওর মায়ের স্মৃতি খুব একটা মনে নেই ওর। কিন্তু ওর মা’কে খুব ভালোবাসতো! আসমা আন্টি অরুণ কে ভালোই বাসতো! তবে আঙ্কেলের সামনে বেশি বেশি কেয়ার করতো আঙ্কেলের অনুপস্থিতিতে কেয়ার কমে যেত একটু আকটু। ব্যাপারটা অরুণের মনে বেশ দাগ কাটে। তবুও কিছু বলতো না। প্রতিবেশীরা অরুণের সামনে সহানুভূতি দেখালেও আড়ালে আসমা আন্টির কানে বিষ ঢালতো! পরের ছেলে পরই হয়। সময় হলে কালসাপ হয়ে দংশন করতে দ্বিধাবোধ করবে না। অরুণের নিজ কানে শোনা। থাক সেসব কথা! আরিয়ান এলে অরুণ আসমা আন্টির কেয়ারনেসে বিরাট ফারাক খুঁজে পায়। অরুণ তবুও মেনেই চলতো। আরিয়ানের সাথে পড়তো না। আঙ্কেল বকতো মাঝে মাঝে উত্তম মধ্যম দিতোও। ওই শালা যেন মজা পেত। আঙ্কেল যা বারণ করবে সেদিকেই তার ঝোঁক বেশী। আরিয়ানের সাথে ওর কিছু নিয়ে মারামারি হয় সেদিন আসমা আন্টি অনেক কথা শোনায়। অরুণের সবচেয়ে কানে বেজেছিল তার মরহুম মায়েকে নিয়ে কটুক্তি। ব্যস! অরুণের ভোল ভাল পাল্টাতে শুরু করে। তারপর আমাদের সাথেই থাকতো। বর্ষার সাথে ওর ভালোই ভাবসাব হয়। আঙ্কেলের কাছে বললে পজিটিভ উত্তর পায়। মাঝে আঙ্কেলের চলে যাওয়া। অরুণ ভেঙে পড়ে সেবার। আসমা আন্টি তখন স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। অরুণ লুফে নেয়। বর্ষার সাথে ধুমধাম বিয়ে হয়। ভোর আসে সব ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ শুনি ডিভোর্স নেবে দু’জন। আমরা সবাই অবাক। অরুণ কখনো কিছু বলে নি যে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। ডিভোর্সের পর টুকটাক কিছু বলে। ভোরকে নিয়ে ও খুবই পসেসিভ। ওর গায়ে একটা পিঁপড়া বসলেও পিঁপড়ার চৌদ্দ গুষ্টির ব্যান্ড বাজিয়ে দিবে। কোলে কোলে রাখতো। নিজে বকবে মারবে ইটস ওকে। অন্য কেউ টোকা দিলে লন্ডভন্ড করে দেবে। ছোটবেলায় মা কে হারানো! তারপর বাবাকে হারানো। ভালোবাসার বিয়ের পর ডিভোর্স। সবমিলিয়ে ও মোটেই স্বাভাবিক নয়।”

থামে শুভ। পাতার দিকে আড়চোখে চায়।

-” আমি ইঞ্জেকশন দেওয়ার কথা বলায় দেখেছো কিভাবে মারলো? ও এমনিই! ছেলের বেলায় হুঁশ জ্ঞান হারিয়ে অবুঝ বনে যায়। আমি একটুও ওর সাফাই গাইছি না। তুমি ওকে একটু টাইট দিবে। ওর আজকের ব্যবহার খুবই দৃষ্টিকটু ছিলো। মানছি ছেলের এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিল তবুও কাজটা মোটেই ঠিক করে নি।ওকে ওর ভুল বুঝতে হবে। ও অনুতাপে পুড়ুক একটু। তবে তুমি দূরে ঠেলে দিও না। ও স্বার্থপর ঠিক কিন্তু তোমাকে ভালোবাসে। মিছে বলছি না। ট্রাস্ট মি!”

চলবে…

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৩ (শেষাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

রাত গভীর হতে এখনো ঢের বাকি। ঘড়িতে সবে সারে আটটা। কেবিন টা পুরোই অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে। ভোর ঘুমে আচ্ছন্ন। অরুণ ছেলের পাশে শুয়ে আছে। পাতা অপর বেডে একাই ঘুমিয়ে পড়েছে। অরুণ একবার ভেবেছিল ডাকবে এই বেডেই শুয়ে পড়ার জন্য। কিন্তু সিঙ্গেল বেড! জায়গা সংকুলান। তার উপর মেয়েটা তার উপর রেগে আছে। একটু আগের ঘটনায় যেন জড়তা আরো ভিড় জমায়। বলতে পারে নি অরুণ।তার চোখে ঘুম ধরা দেয় নি এখনো। আরিয়ানরা সাতটার দিকেই চলে গেছে। পাতা তারও বেশ পরে কেবিনে আসে। শুভ তার পিছনেই প্রবেশ করে। অরুণ আড়চোখে চেয়েছিল। পাতা অবশ্য ফিরেও তাকায় নি। ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করে ওয়াশ রুমে চলে যায়। অরুণের বন্ধুরা বিদায় নেয়। পাতা চেঞ্জ করে এসে দেখে ভোর ঘুমিয়ে পড়েছে। বেডে কমলার খোসায় ছড়াছড়ি।পাতা বেড ঝেড়ে নেয়। অরুণ চুপচাপ বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে তাঁর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করে। পাতা ব্যাগ থেকে অরুণের শার্ট প্যান্ট বের করে বেডের কিনারায় রাখে। মুখে বলে নি ঠিকই কিন্তু অরুণ বুঝতে পারলো চেঞ্জ করতে বলেছে তাকে। অরুণের মনটা খানিক পুলকিত হলো কি? তবে সে যায় না চেঞ্জ করতে ভাবে পাতা মুখে বলবে তাকে। কিন্তু তাঁর আশায় গুড়ে বালি মিশিয়ে পাতা কিছুই বলে না। ছোট টেবিলের উপর রাখা ব্যাগ থেকে খাবারের বক্স বের করে খাওয়া শুরু করে আপন মনে। অরুণ খানিকক্ষণ গম্ভীর মুখে সব অবলোকন করে বেড থেকে শার্ট প্যান্ট নিয়ে ওয়াশ রুমে যায় হনহন করে। বেরিয়ে এসে পাতার সামনে চেয়ারে বসে।পাতার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা যায় নি। তবে টেবিলের একটা বক্স ঠেলে দেয়। যার অর্থ হয়তোবা এটা দাঁড়ায় এটা তাঁর ভাগের খাবার। অরুণ কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বক্স হাতে নেয়। মোরগ পোলাও! অরুণ ঘুমন্ত ছেলের দিকে তাকায়। মোরগ পোলাও ছেলেটার পছন্দের। ছেলেকে রেখে সে কিভাবে খাবে? নামবে না তার গলা দিয়ে। অরুণ উঠে বেডে শুয়ে পড়ল ছেলের পাশে। পাতা বক্স আঁটকে উঠে পড়ে। পুরো কেবিনে পায়চারী করে অপর বেডে শুয়ে পড়ে।

ভাবতে ভাবতে অরুণের চোখ লেগে যায় কিন্তু ছেলের গোঙানির আওয়াজে অরুণ ধরফর করে ওঠে। ছেলেটা ঘুমের ঘোরেই কাঁদছে। অরুণ তার গায়ে গলায় কপালে হাত বুলায়। জ্বর এসেছে হালকা। অরুণ উঠে বসে। ব্যাগ হাতরে পাতার এক ওড়নার একাংশ ছিঁড়ে ওয়াশ রুম থেকে ভিজিয়ে আনে ছেলের কপালে রাখে। ভোর ঘুম হালকা হয়ে আসে। সরিয়ে দেয় জলপট্টি। বিড়বিড় করে বলে,

-” কুকুর আবার আসবে আব্বু? ভোরকে কামড়াবে। তুমি মা’কে ডাকো? আমার শীত করছে অনেক। ভয়ও করছে।”

অরুণের ছেলের কাঁধ গলিয়ে হাত রেখে উপড়ে তুলে বলে,

-” কলিজা আব্বু আছে ভয় নেই। ঘুমাও তুমি!”

ভোর এবার নিভু নিভু প্রদীপের মতো চোখ খুলে পিটপিট করে চায়‌। বাবাকে দেখে ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,

-” শীত করছে। ব্যাথা করছে। মা’ কে আনো বাবা। ভোরের কষ্ট হচ্ছে!”

অরুণ কপাল থেকে ভেজা পট্টি সরিয়ে চুমু খায়। বাহুতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

-” তোমার আম্মু ঘুমোচ্ছে। সেও অসুস্থ তাই না? আব্বু আছে না ভোরের কাছে!”

ভোর চোখ বুজে নিয়ে বলে,

-” মা’ র বুকে থাকলে ব্যাথা কমে যায়। কষ্ট হয় না বাবা!”

অরুণ ছেলের শুকনো ঠোঁটে বেশ কয়েকবার চুমু দিয়ে বালিশে শুইয়ে দেয়। উঠে এসে পাতার বেডে বসে। মেয়েটা ঘুমুচ্ছে গালে হাত রেখে। হাত পা গুটিয়ে রেখেছে; ঠান্ডা লাগছে বোধহয়। অরুণ তাঁর কপালে গলার ভাঁজে হাত রাখে; নাহ জ্বর আসে নি। পাতার গালে হাত রাখে। বৃদ্ধাঙ্গুল নাড়াচাড়া করে আস্তে করে বুলিয়ে দেয়। মেয়েটার ফর্সা গাল লালচে হয়ে আছে। থাপ্পড়টা জোড়েই পড়েছিল হয়তোবা। তাঁর অতশত খেয়াল নেই। সে তো ছেলেকে দেখেই পাগল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটাকে খেয়ালই করেনি। করলে হয়তো থাপ্পড় মারার মতো দুঃসাহস দেখাতো না‌। অরুণ ঝুঁকে এসে গালে অধর ছোঁয়ায় কয়েকবার। গভীর ভাবে চুম্বন বসিয়ে সোজা হয়। গায়ের উপর থাকা চাদরটা সরিয়ে দিয়ে হাতের ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে চুমু দেয়। পেটের ক্ষত দেখার জন্য কামিজটা উপরে তোলে। নাভিকুন্ডের একপাশে ছোট ব্যান্ডেজ। অরুণের হাত সেথায় ছুঁয়ে যায়। পাতা ঘুমের ঘোরেই কেঁপে কেঁপে ওঠে। কামিজ নামিয়ে পাতার গালে হাত রেখে ডাকে। পাতার ঘুম হালকা হয়। পিটপিট করে চোখ খোলে। অরুণ আবার ডাকে,

-” এই? পাতাবাহার?”

পাতার ঘুম ছুটে যায়। এতো আদুরে গলায় সুন্দর সম্মোধনে ডাকায় পাতা ফ্যালফ্যাল করে চায়।অধরকোনে হাসি ফুটবে ফুটবে ভাব; পাতার মস্তিষ্ক সচল হয়। হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে। অরুণ উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,

-” ছেলেটার জ্বর এসেছে। ব্যাথায় গোঙাচ্ছে! বিড়বিড় করে মা কে ডাকছে। ওর পাশে শুয়ে একটু বুকে নাও পাতাবাহার!”

পাতা চোখে মুখে চিন্তার উদ্রেক স্পষ্ট দেখা যায়। সে তড়িঘড়ি করে নেমে ভোরের কাছে যায়। কপালে গলায় হাত রেখে দেখে সত্যিই জ্বর এসেছে। অরুণ ভেজা কাপড়ের টুকরা পুনরায় ভিজিয়ে পাতার কাছে দেয়! পাতা ভোরের কপালে দিলে ভোর চোখ খোলে। পাতাকে দেখে ঠোঁট নাড়িয়ে দূর্বল গলায় বলে,

-” আম্মু? কুকুর গুলো আবার আসছে। আমার ভয় করছে! হাতে পায়ে ব্যাথা করছে। খুব কষ্ট হচ্ছে!”

পাতা ভোরের পাশে গা এলিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” সব ঠিক হয়ে যাবে বাবা! আর কোনো কুকুর নেই। তুমি বাজে স্বপ্ন দেখেছো!”

ভোর কপালের কাপড় ফেলে পাতার বুকে মুখ লুকিয়ে বলে,

-” আম্মু আমার শীত করছে। তুমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরো! তাহলে ব্যাথাও পালিয়ে যাবে!”

-” এই তো নিয়েছি! বাবা কিছু খাবে? বিস্কুট কেক?”

-“উঁহু। শুধু তুমি থাকো!”

পাতা ভোরকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যিখানে আগলে নেয়। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” টেবিলে রিপোর্ট আছে। সেখানে ডাঃ নাজনীনের নম্বর আছে। কল করুণ! আমি কথা বলবো তার সাথে!”

অরুণ সরকার ঝটপট ফোন লাগিয়ে পাতার কাছে দিয়ে চুপচাপ ব্যাথিত নয়নে দাঁড়িয়ে থাকে। ব্যাথা পেলে মানুষ সবার আগে মা কে স্মরণ করে। মুখ থেকে অজান্তেই বেড়িয়ে আসে মা ডাক! মা যে ব্যাথা উপশমের সবচেয়ে কার্যকরী ওষুধ। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে সবার আগে মায়ের সান্নিধ্য খুঁজে বেড়ায়। কেননা মায়ের হাতের ছোঁয়ায় রহমত,আদর, ভালোবাসা মিশে আছে।সেই ছোঁয়া মানুষকে সুস্থ হতে সাহায্য করে। মায়ের সান্নিধ্য পেলে কষ্ট লাঘব হয়। অরুণের চোখ ভিজে ওঠে। তাঁর লাস্ট কবে শরীর খারাপ করেছিল মনে নেই। সে খুব একটা অসুখ বিসুখে পড়ে না। হয়তোবা যত্ন নেবার কেউ নেই তাই উপর ওয়ালা অসুখ বিসুখে পড়তেই দেয় না। সে যখন মেসে প্রথম প্রথম উঠলে সেই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে তার অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। দশ দিনের জ্বরে ভুগেছিল। তখন সে জ্বরের ঘোরে মা মা করেছিল। তার বন্ধুরা বলেছিল তাকে। এরপরও বেশ কয়েকবার অসুখে ভুগেছিল। তখনও মায়ের কথা খুব মনে পড়তো। মায়ের পুরনো স্মৃতি মনে করে ভুলে থাকার চেষ্টা করতো! কিন্তু হায়! স্মৃতি গুলোই যে আবছায়া; চোখের পাতায় ভাসে না।

পাতা ডাক্তারের সাথে কথা বলে। ডাক্তার জানায় এটা স্বাভাবিক! ছোট্ট নাজুক শরীর এতো ডোজের টিকা, সাথে শরীরের ক্ষত! জ্বর আসাটা স্বাভাবিক! যে ওষুধগুলো খাওয়াতে বলেছিল তাতে জ্বরের সিরাপ ছিল। টেনশনের কিছু নেই। ঠিক হয়ে যাবে একটু পর। জ্বর নেমে যাবে! পাতা আশ্বস্ত হলেও বুকের ভিতর খচ খচ করে। সে ফোন রেখে দেয়। ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,

-” ছেলেটা নাক টানছে জলপট্টি দিতে হবে না। আরো ঠান্ডা লাগবে। একটু সরিষার তেল হলে ভালো হয়! মাথায় ঘষে দিলে ভালো লাগবে!”

অরুণ ফোনটা নিয়ে বেড়িয়ে যায়। এখন সরিষার তেল কোথায় পাবে?
অরুণ চলে গেলে পাতা ভোরকে তুলে বসায়। মুখটা ধুয়ে দিয়ে আপেল দেয়। ভোর এক কামড় দিয়ে মুখ কুঁচকে নেয়। পাতা জোড় করে না। টেবিলে রাখা বক্সটা খুলে কয়েক লোকমা পোলাও খাওয়ায়। জ্বরের মুখে ঝাল ঝাল মোরগ পোলাও ভালো লাগায় ভোর খায়! এরই মাঝে অরুণ আসে। হাতে ছোট তেল, পানি ও জুসের বোতল! পাতা হাত ধুয়ে ভোরের মাথায় তেল ঘঁষে দেয়।

-” ছেলেটা কয়েক লোকমা খেয়েছে। বাকি টুকু খেয়ে নিন। নষ্ট করে কি লাভ!

গম্ভীর মুখে বলে পাতা। তার গোমড়া মুখ দেখে অরুণও মুখটা গম্ভীর বানিয়ে বলে,

-” ক্ষিধে নেই আমার!”

পাতা আর কিছু বলে না। ভোরের মাথায় তেল মালিশ করে বুকে ও হাত পায়ের তালুতে ঘষে দেয়। ছেলেটার শীত লাগছে বলল। আর হাত পাও ঠান্ডা হয়ে ছিল। এখন একটু আরাম পাবে। সত্যিই ভোর আরামবোধ করে। মুচকি হেসে বলে,

-” আম্মু এখন একটু ভালো লাগছে আমার!”

পাতা হেসে তাঁর গালে মুখে আদর করে বুকে জড়িয়ে বলে,

-” এখন চুপটি করে ঘুমাও বাবা। সকালে উঠে দেখবে সব ব্যাথা ভ্যানিশ হয়ে গেছে।”

ভোর ‘হুম’ বলে চুপটি করে পড়ে থাকে। হঠাৎ বাবার কথা খেয়াল হয়। উঁকি দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আব্বু আই এম ফাইন! তুমি খেয়ে নাও নইলে তোমারও অসুখ করবে। তখন আমার একটুও ভালো লাগবে না!”

পাতার অধরকোনে হাসি ছড়িয়ে পড়ে নিমিষেই। ছেলেটার সব দিকেই খেয়াল! অরুণ এগিয়ে এসে ঝুঁকে ছেলের কপালে চুমু দেয়। পাতা কাঠ হয়ে পড়ে থাকে। লোকটা তার উপর ঝুঁকে আছে। ভোর যে তাঁরই বুক থেকে উঁকি দিয়েছে‌। অরুণ সরে এসে খাবার খেয়ে নেয়। ওয়াশ রুম হয়ে এসে ভাবে কোথায় শোবে! এখানে ছোট বেডে তিনজন আটবে না। আর অন্য বেডে তার ঘুম হবে না। সে এই বেডেই অল্প একটু জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নিবে ভেবে উঠতে নিলে পাতা শক্ত গলায় বলে,

-” ছোট একটা বেড! দু’জনেরই ঠিকঠাক জায়গা হয় না। অন্যত্র যান।”

-” আমি ম্যানেজ করে..”

-” আমি পারবো না মানিয়ে নিতে!”

এরকম কাঠের মতো শক্ত জুবানের পৃষ্ঠে অরুণ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। মেয়েটা এভাবে বলতে পারলো? তার পাতাবাহার তো এতোটা কঠোর নয়! তাহলে আজকের ব্যবহারেই কি তার এতো পরিবর্তন? অরুণ কঠোর পাতা চায়; তবে সেটা অন্য সবার ক্ষেত্রে। তার ক্ষেত্রে তার নরম চঞ্চলতায় ঘেরা পাগলাটে মেয়েটাই মানানসই। অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে লাইট নিভিয়ে বেডে গা এলিয়ে দেয়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সিলিং বরাবর। নিঃশ্বাস তার ভারি হয়ে আসে। তাঁর জীবনের পাতায় সুখের আগমন ঘটে কিন্তু সময়ের সাথে সেটা হারিয়ে যায়। এবার আর সে হারাতে দেবে না। অরুণ প্রায় আধা ঘন্টার মতো ওভাবেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে বালিশ ভিজে যায়। একসময় অরুণ উঠে বসে। আবছা আলোয় ওপাশের বেডে আসে। পাতা কাত হয়ে ভোরকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। পেছনে অল্প জায়গা আছে। সেটুকু অরুণের মতো বলিষ্ঠ দেহের মানবের জন্য যৎসামান্য তবুও সেটুকু জায়গায় নিজের শরীর এলিয়ে দেয়। পাতার পিঠের সাথে বুক ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। এক হাত ছেলের পিঠে রেখে দু’জনকেই বাহুবন্ধনে বেঁধে নেয়। পেছনে কিঞ্চিত পরিমাণ জায়গাও নেই। ওপাশ ফিরলেই আর রক্ষে নেই ধপাস করে পড়ে যাবে।পাতার উন্মুক্ত ঘারে নাক ঠেকিয়ে শ্বাস টেনে নেয় অরুণ। এখন একটু ভালো লাগছে তার। দম বন্ধ কর পরিস্থিতি থেকে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।
পাতা বুজে রাখা চোখ খোলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরকে নিয়ে ওদিকটায় আরেকটু সেটে যায়। অরুণ চমকে ওঠে। মেয়েটা ঘুমায় নি? অরুণ সৃষ্টি হওয়া স্বল্প দূরত্বটুকুও ঘুচে নেয়। আবার বলিষ্ঠ বুকের সাথে লেপ্টে যায় পাতার পিঠ। অরুণ পাতার মসৃণ উন্মুক্ত ঘারে নাক মুখ ঘষে। কানের পিঠে গভীর ভাবে চুমু দিয়ে বলে,

-” ওখানে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। ট্রাস্ট মি আর মানিয়ে নিতে হবে না; আমি সামলে নেবো প্রমিজ!

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৪

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

সকাল বেলা। সূর্য মামার আগমনের বেশ সময় পেরিয়ে গেছে। ঘড়িতে সময় দশটার এদিক ওদিক হবে। সরকার মহলের পরিবেশ থমথমে ভাব বিরাজ করছে। হবে না কেন? সরকার বাড়িতে বর্ষার আগমন ঘটেছে। কালও এসেছিল বিকেল বেলায়; ভোরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে। ভোরের আহত হওয়ার ঘটনা শুনে বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিল। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়েছিল কিন্তু কেউ ঠিকানা দেয় নি। বর্ষা বেশ রাগারাগী করেছে। অরুণের সাথে তার ডিভোর্স হলেও বরুণ তার ছেলে। এই সত্যটা কেউ মুছে দিতে পারবে না। ভোরের উপর তারও অধিকার আছে। আসমা বেগম গম্ভীর মুখে দু একটা জবাব দিয়েছিল! তবে বর্ষা দমে যায় নি। আসমা বেগম আর তর্কে জড়ায় নি তবে তার বোন আসমানী বেগম কোমড় বেঁধে নেমেছিল! বর্ষাকে তীক্ষ্ম কথার বাণে চৈত্রে পাঠিয়ে দিয়েছিল! কিন্তু বর্ষা পরদিন সকালেই হাজির হবে এটা তাদের ভাবনাতিত ছিল। এখন এসে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেছে আর ওঠার নাম নেই‌। গতকাল ‌ছেলেকে সঙ্গে আনলেও আজ সে একাই এসেছে। কারোর কোনো কথার জবাব সে এখনো দেয় নি। চুপচাপ বসে আছে। সে আজ পণ করেছে ছেলেকে দেখবে, কথা বলবে, প্রাণ ভরে আদরও করবে।
সরকার বাড়ি মেহমানে ভরপুর ছিল কাল। দুপুরের ঘটনার পর অনেকেই চলে গেছে। বার্থডে পার্টিও ক্যান্সেল হয়ে গেছে। এখন বাড়িতে মেহমান বলতে আসমানী বেগম ও তার দুই নাতি নাতনি। রুবির মা আর সাবরিনা সাবিনা চৌধুরী। সাবিনা বর্ষার সামনের সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে।বাড়ির প্রায় সকলেই ড্রয়িং রুমেই উপস্থিত আছে শুধু আনিকা ও আরিয়ান বাদে। বর্ষার ওতে ভাবান্তর নেই।

গেইট পেরিয়ে একটা গাড়ি বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে। মেইন ফটকের সামনে গাড়ি দাঁড় করালে গম্ভীর অরুণ সরকার নেমে আসে। পাজা কোলে ঘুমন্ত ছেলে। পরপর পাতা নেমে আসে তার হাতে ব্যাগ পত্র! আভারি এগিয়ে এসে পাতার হাত থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে নেয়। সাথে বাড়ির থমথমে অবস্থার প্রতিবেদন পেশ করে। অরুণের গম্ভীর মুখটায় চিন্তার ছাপ দেখা মিলে! হঠাৎ বর্ষা? আর পাতার স্বাভাবিক মুখটা নিমিষেই অন্ধকারাচ্ছন্ন নেমে আসে। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত অনুভূতির আগমন ঘটে। সেথায় হালকা ভয়, ঈর্ষা, বিরক্ত, আশংকা আরো কিছু উপাদানের সংমিশ্রণে তার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অরুণের পাশে দাঁড়িয়ে তার কোমড়ের কাছটার শার্টের কোনা চেপে টান দেয়। অরুণ আভারির কথায় মনোযোগী ছিল এহেন টান পড়ায় ঘার ফিরিয়ে চায়। পাতা মুখে কিছু বলে না; নাকের পাটা ফুলিয়ে ভোরের পা ধরে টান দেয় আস্তে। অরুণ কিছু বুঝতে পারলো না। ভ্রু উঁচিয়ে সুধায়,

-” হোয়াট?”

পাতা বিরক্তের সাথে তাকিয়ে ভোরকে নিজের কাছে টেনে নেয়। ভোর পা দুটো দিয়ে পাতার কোমড় পেঁচিয়ে ঘুমের ঘোরেই পাতার গলা জড়িয়ে ধরলো। পাতা ভোরকে নিয়ে হনহন করে ভিতরে হাঁটা দেয়।
পাতার আগমনে ড্রয়িং রুমের সকলেই তার দিকে তাকায়। বর্ষাও ব্যাতিক্রম নয়। পাতার কোলে ভোরকে দেখতে পেয়ে সে হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে আসে। পাতা থামে না; বর্ষাকে পাশ কাটিয়ে আস্তে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। পেছনে থেকে বর্ষা ভোরকে ডাকে। ভোর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকায় সাঁড়া দিতে পারে না। বর্ষা পাতাকে ডাকবে কিন্তু পাতার নামটা তার স্মরণে নেই! তবুও সে ডাকে,

-” এক্সকিউজ মি! দাঁড়াও? এই মেয়ে?”

পাতা মোটেই দাঁড়ায় না। কারো কোনো কথাকে তোয়াক্কা না করেই চলে যায় নিজ রুমের উদ্দেশ্যে!রাগে অপমানে বর্ষার মুখটা লালিমায় ছেয়ে যায়!
এরইমধ্যে অরুণের আগমন ঘটে। সাবিনা চৌধুরী অরুণের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

-” কি অবস্থা ছেলেটার? ডাক্তার কি বললো?”

অরুণ বর্ষার দিকে এক পলক তাকায়! আশেপাশে সকলের নজর তার উপর।‌সকলেই তার উত্তর শোনার অপেক্ষায়। অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো! ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে। দুই এক দিনের ভিতর শুকিয়েও যাবে। আর টিকাও চলছে!”

আসমা বেগম বলেন,

-” বড় বউয়ের কি অবস্থা?”

-” দুজনেই ঠিক আছে! চিন্তার কোন বিষয় নেই!”

অরুণের কথা শেষ হতেই বর্ষা এগিয়ে এসে অরুণের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই বলে
,
-” আমি বরুণের সাথে দেখা করবো! তোমার ওই পিচ্চি বউটা হনহন করে নিয়ে গেল আমার ছেলেকে আমি ডাকলাম তোয়াক্কাই করলো না!”

অরুণ তার থেকেও স্বাভাবিক গলায় বলে,

-” সি’জ ওলসো হিজ মাদার! ইয়ু স্যুড টেক পারমিশন ফ্রম হার! নাও সি উইল লেট হার সন মিট ইয়ু ওর নট! দ্যাটস হার থিং!”

বর্ষার মুখশ্রী থমথমে।

-” আই এম হিজ মাদার!বরুণের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে আমার ওই মেয়েটার পারমিশন লাগবে? বরুণ যদি একবার শোনে তার মা এসেছে সে ছুটে আসবে!”

অরুণ ঘারে হাত রেখে মাথা এপাশ ওপাশ করে অলস ভঙ্গিতে বলে,

-” তোমার সিলি কথাবার্তা শোনার মুড একটু নেই! ছেলে ঘুমোচ্ছে তার ঘুম অতিব জরুরী!”

বর্ষা কিছু বলবে অরুণ তাকে থামিয়ে দিয়ে আপন গতিতে চলে যায়! এমনিতেই পাতাবাহার তার সাথে কথা বলছে না তার উপর এই আপদের আগমন। তার রানি সাহেবার রাগের মাত্র নিশ্চয়ই আরো বেড়েছে। অরুণ রুমে প্রবেশ করে দেখে দুজন বিছানায় শুয়ে আছে। সেও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। কিন্তু সুবিধা করতে পারে না। উঠে ওয়াশ রুমে যেতে যেতে বলল,

-” গোসল করবো আমি! কাপড় বের করে রেখো!”

আদেশ মুলক বাক্য! পাতা ভেংচি কাটলো।এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক জীবনেও শুধরানোর নয়! এখনও হুকুম করছে! তার হুকুম পালন করতে যেন পাতা মুখিয়ে আছে!হঠাৎ নক করে কেউ! পাতা ভাবে বাড়ির কেউ হবে তাই আসতে বলে। কিন্তু বর্ষাকে দেখে তাঁর মুডটাই নষ্ট হয়ে যায়! বর্ষা এসে বিছানায় বসে। পাতার চিল্লিয়ে বলতে ইচ্ছে করে এটা আমার বিছানা! আমার রুম! এখানে বসা তো দূর, এই রুমে আপনার প্রবেশ করারও কোনো অধিকার নেই। এক্ষুনি বের হয়ে যান! কিন্তু বলতে পারে না। সে ওতটাও অভদ্র নয়! সে উঠে বসে। ভোরের গা ভালো করে কম্ফোর্টে ঢেকে দিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়।
বর্ষা নাক মুখ কুঁচকে বলে,

-” তখন কতবার ডাকলাম শুনলে না কেন?”

-” এমনি!”

বর্ষার বিরক্তের মাত্রা বেড়ে যায়।

-” বরুণকে ডাকো! কথা বলবো আমি!”

-” ঘুমুচ্ছে!”

ছোট করে জবাব দেয় পাতা। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মোটেও। ইচ্ছে করছে মহিলার বড় বড় চুলের গোছা ধরে বের করে দিতে। বর্ষা এবার মেজাজ হারিয়ে বসে,

-” আশ্চর্য ডাকতে বললাম ডাকো! তোমার হাসবেন্ডের সাথে লুতুপুতু করতে আসি নি যে এমন মুখ বানিয়ে রাখবে‌। আমি আমার ছেলের কাছে এসেছি!”

পাতা গোল গোল করে চায়। সবাই শুধু তাঁর উপরেই চিল্লাচিল্লি করবে! দুনিয়ায় মানুষের অভাব? পাতা থমথমে মুখে জবাব দেয়,

-” আওয়াজ নামিয়ে ভদ্র ভাষায় কথা বলুন! আর হ্যাঁ আমার হাসবেন্ডের ব্যাপারে একটা কথাও বলবেন না। আমি পাতা সহ্য করবো না। হাসবেন্ড আমার, ছেলেও আমার! ইয়ু মাস্ট বি গেট লস্ট ফ্রম মাই রুম!”

বর্ষা শক্ত চোয়ালে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” অরুণ কোথায়?”

পাতার নাকের পাটা ফুলে ওঠে।এই মহিলা আবার তার জামাইয়ের নাম নিচ্ছে। মহিলার ওই টকটকে লিপস্টিক দেয়া ঠোঁট পাতা হামানদিস্তায় পিষবে।‌সে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকায়! লোকটার গোসল শেষের পথে বোধহয়। কাপড়চোপড় তো নেয় নি। অর্ধনগ্ন অবস্থাতেই না বেড়িয়ে আসে! সে বর্ষার কথায় তোয়াক্কা না করে আলমারি থেকে ট্রাওজার টি শার্ট নিয়ে ওয়াশ রুমের দরজায় নক করে। সাথে সাথেই দরজা অল্প খুলে যায়। একটা লোমশ হাত বেড়িয়ে আসে পাতা কাপড়চোপড় দিয়ে বর্ষার সামনে দাঁড়ায়। শান্ত গলায় বলে,

-” ছেলেটার শরীর ভালো নয়। এখন ঘুমুচ্ছে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে না। আপনি আসতে পারেন!”

বর্ষা ওঠে না। কম্ফোর্ট সরিয়ে দিয়ে ভোরকে ডাকে। ভোর চোখ খুলে নিমিত্তে! বর্ষাকে দেখে গোল গোল করে চায়। কয়েকবার পলক ঝাপটিয়ে বোঝার চেষ্টা করে সে স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যিই!যখন বুঝতে পারে এটা স্বপ্ন না, বাস্তব! তার চোখে মুখে যেন ঝিলিক দিয়ে ওঠে। বর্ষার গলা জড়িয়ে ‘মা’ ডাকে।
পাতা নিষ্পলক চেয়ে থাকে। স্তব্ধ বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকটা খালি হয়ে যায়। এতক্ষণ বর্ষা নামক মহিলার প্রতি ঈর্ষান্বিত হলেও এবার কেটে যায়। পাতার মনে হয় সে এতো দিন মোহ মায়ার জালে আটকা পড়েছিল! সদ্য ছিটকে বেড়িয়ে এলো। যে দুঃখকে সে নিজে ডেকে এনেছে সেই দুঃখ নিয়ে পাতা কি করে আফসোস করবে। ভোরের গর্ভধারিনী সে নয়! তার সাথে তার রক্তের টান নেই। তাঁর সঙ্গে কেবল মনের টান/ আত্মার টান আছে বোধকরি! বাচ্চাটা যখন তাকে আম্মু ডাকে পাতা নিজেকে মা মা অনুভব করে। কাল রাতেও যখন বাচ্চাটা তার বুকে মাথা রেখে মা মা করছিল পাতার এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয় নি সে তাঁর সৎ মা বা বাচ্চাটা তার নয়! কিন্তু এখন এই মহিলাকে মা ডাকলো তার ছেলেটা; মনে হলো সে কোন তৃতীয় ব্যক্তি। পাতার চোখ ভরে ওঠে। ভোর তাঁর মা’য়ের গলা জড়িয়ে গল্প করছে। কাল কিভাবে কুকুর আক্রমণ করেছিল! বর্ষা মনোযোগ দিয়ে শুনছে কখনো কখনো চুমু দিচ্ছে ভোরের গালে। ভোরও প্রতিত্তরে আদর করতে ভোলে না। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে পাতা যে টইটুম্বুর চোখে চেয়ে আছে নিস্পৃহ ভাবে সেটা কি ভোরের চোখে পড়ে না? পড়বে কিভাবে? রক্তের টান যে নেই! পাতা অগোচরে চোখের পানি মুছে নেয়। তার ইচ্ছে করছে ভোরকে ওই কোল থেকে ছিনিয়ে বুকের মাঝখানে লুকিয়ে রাখতে!
এর মাঝেই অরুণ সরকার বেড়িয়ে আসে ওয়াশরুম থেকে। গলায় তোয়ালে ঝুলানো। পাতা সেদিকে তাকায়। নিমিষেই সব রাগ অভিমানের সুর সুরঞ্জিত হয়ে লোকটার উপর বর্তায়। সব দোষ এই নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য বেহায়া লোকটার!
অরুণ এগিয়ে এসে গম্ভীর মুখে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এটা বেড রুম আমাদের! কোনো বৈঠক খানা নয় যে যাকে তাকে ঢোকার অনুমতি দেবে!”

ভোর ভীত চোখে বাবার দিকে তাকালো। বর্ষার গলা জড়িয়ে মিনমিন করে বলল,

-” আম্মু চল বাইরে যাই?”

বর্ষা তাকে কোলে নিয়ে উঠে চলে যায়। অরুণের কথা তাঁর বিন্দুমাত্রও গায়ে লাগে নি। কোন পুরুষই তার প্রাক্তন স্ত্রীকে নিশ্চয়ই মধুর গীত শোনাবে না!!
পাতা তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওরা বেরিয়ে গেলে অরুণের দিকে তাকালো। অরুণের নজরও পাতাতেই নিবদ্ধ। সে পাতার নাকটা টিপে দিল। পাতা প্রতিক্রিয়া হীন। অরুণ গলা থেকে তোয়ালে নামিয়ে পাতার গলায় ঝুলিয়ে কাছে টেনে আনে।

-” এমনভাবে তাকিয়ে আছো কেন? মনে হচ্ছে বর্ষাকে আমিই ডেকে এনেছি! আরে বাবা আমি কেন ওকে আনতে যাব!”

পাতা আস্তে করে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। আলমারি খুলে শাড়িস প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়। অরুণ গলা উঁচিয়ে বলে,

-” একা পারবে? আমি আসবো? হেল্পের জন্য!”

ধরাম করে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে।

-” এটা কেমন বেয়াদবি পাতাবাহার?”

কথার কোনো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আসে না। অরুণ ফ্লোরে পা ঝুলিয়ে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুজে শ্বাস টানে। তখনই মানসপটে ভেসে ওঠে এক আদুরে চেহারা। অরুণ চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো। বেলকনিতে গিয়ে একটা খাঁচা আনে। খাঁচা খুলে বের করে বিড়াল ছানাটিকে। প্রতিবারের মতো মিও মিও করে লাফিয়ে ওঠে না। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। পাতাবাহার ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে দূর্বল গলায় মিও বলে গুঙ্গিয়ে ওঠে। অরুণ খেয়াল করে বিড়ালটার ঘারের দিকটায় জখম! জখমে ওষুধ জাতীয় কিছু লাগানো। কাল কী তাহলে এই ছোট্ট বাচ্চাটাও আহত হয়েছে? ইশ্! তার ছোট পরিবারের সকলেই আহত! সে বিড়ালটিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করে গা বুলিয়ে বলে,

-” জলদি ঠিক হয়ে যাও পাতাবাহার! আই মিস ইয়ু!”

বিড়াল শাবক অরুণের হাতে গাল ঘষে।অরুণ হেসে বিড়ালটিকে খাঁচায় পুরে দেয়। একেও টিকা দিতে হবে!
অরুণ পূর্বের মতো বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মিনিট বিশেক পড়ে পাতার আগমন ঘটে। অরুণ আড়চোখে চায়। চাওয়া মাত্রই সে উঠে বসে তড়িৎ বেগে। মেয়েটা শাড়ি পড়ে নি। শুধু কোনো মতে গায়ে জড়িয়েছে। অনাবৃত মেয়েলি কায়া উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে অরুণকে।
পাতা ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়িটা পড়তে শুরু করে প্রাথমিকভাবে। ওয়াশরুম ভিজে থাকার দরুন এখানে আসা। লোকটা রুমেই আছে বুঝতে পারলে আসতো না। সে ভেবেছে ভোরের কাছে গেছে হয়তো। পাতা দক্ষ হাতে কুচি দিয়ে গুঁজে নেয়। বুকের আঁচল ফেলে সম্মুখে আয়নায় কারো প্রতিবিম্ব দেখতে পায়। অসভ্য লোক কেমন করে তাকিয়ে আছে! যেন চোখ দিয়েই গিলে নিচ্ছে। পাতা আঁচল ঠিক ঠাক করে তোয়ালে খুলে মাথার চুল মুছতে থাকে‌। অরুণ সরকার আর বসে থাকতে পারে না। উঠে এসে পাতার পিছন ঘেঁষে দাঁড়ায়। হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে যত্ন করে মুছে দেয় চুল!

-” ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছো? ইটস্ ওকে আমি করে দিবো!”

বলে ভেজা তোয়ালে সোফায় ছুঁড়ে ফেলে। সেটা দেখে পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। তোয়ালে তুলতে যাবে তার আগেই কারো বাহু বন্ধনে বেঁধে রাখা হয় তাকে। পাতা চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। অরুণ শূন্যে তুলে নেয় তাকে। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে ভেজা চুলে নাক ডাবিয়ে শ্বাস টানে। কিছু বলে না; কিছু করে না। তবে তার নীরবতা, গভীর আলিঙ্গন যেন অনেক কথাই বলে ফিসফিসিয়ে! পাতার অবুঝ মন অনেক কিছুই বুঝে নেয়। সে ছটফট করে না; আবার আকরেও ধরে না। অরুণ আরেকটু চেপে ধরে নিজের সাথে। চুলের ভাঁজে চুমু দেয়।

বর্ষার হাত ধরে ভোর হাসিখুশি মুখে হাঁটতে হাঁটতে রুমে প্রবেশ করে। বর্ষা ইতস্তত বোধ করে বেশ! ভোর সেসবের তোয়াক্কা না করে হুড়মুড়িয়ে মা’কে টেনে আনে। কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পাতা উশখুশ শুরু করে। অরুণ ছেড়ে দিয়ে দরজায় তাকায়! ভোর ও বর্ষাকে দেখে খানিকটা ঝাঁঝালো গলায় বর্ষার উদ্দেশ্যে বলে,

-” বিনা পারমিশনে অন্যের রুমে প্রবেশ করতে নেই জানো না? কমন সেন্সের অভাব! গেট আউট?”

রুমে প্রবেশ করেই দু’জনকে ওমন পরিস্থিতিতে দেখে বর্ষাও বেশ অস্বস্তিতে পড়ে। সে কিছু বলবে এর আগে ভোর নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,

-” মা’ কে বকছো কেন? আমিই এনেছি মা’কে। মা’ কে একটুও বকবে না!”

পাতা এপাশ ফিরে শান্ত চোখে ভোরের দিকে চায়। ভোরের নজরে পাতা পড়ে না। অরুণ গম্ভীর গলায় বলে,

-” আচ্ছা বকলাম না। ভোর? এদিকে এসো? অসুস্থ শরীর নিয়ে এভাবে দৌড় ঝাঁপ দেয় কেউ?”

ভোর এগিয়ে যায় বর্ষার হাত ধরেই।

-” ও আব্বু! আমি একটু মা’ র সাথে নানু বাড়ি যাই? প্লিজ আব্বু? প্লিজ?”

অরুণ কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে বর্ষার দিকে চায়। বর্ষা ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে খানিক অনুনয়ের স্বরে বলে,

-” না কোরো প্লিজ!কাল ভোরে আমাদের ফ্লাইট। আগামী চার পাঁচ বছরেও আশা হবে না। এই মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য নিয়ে যাবো। বাবা মাও দেখতে চেয়েছে!প্লিজ অরুণ?আমি ওর যথেষ্ট খেয়াল রাখবো!”

পাতার মনটা দুরু দুরু করে। সে চায় না ভোর ওনার সাথে যাক! সে অরুণের দিকে চায়। লোকটা যেন মানা করে! অরুণের কপালের ভাঁজ শিথিল হয়।

-” তো এসব ইমোশনাল কথা বলে ছেলেটাকে রাজি করিয়েছো! ছেলে ভুলতে পারে আমি না। ভোর কোথাও যাচ্ছে না। না মানে না!”

পাতার মুখ উজ্জ্বল হয় খানিক। তবে ভোর দৌড়ে এসে অরুণের হাত ঝাঁকিয়ে অনুরোধ করে বলে,

-” আব্বু প্লিজ! আমার না ওই নানু বাড়ির কথা একটুও মনে নেই। আমি যাবো আর এখুনি আসবো! একটু যেতে দাও না? প্লিজ?”

অরুণ কঠোর গলায় বলে,

-” কানে শুনতে পাও না?না বলেছি! অসুস্থ শরীরে মার না খেতে চাইলে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ো! যাও?”

ভোরের চোখ ভরে ওঠে নিমিষেই। নাকের পাঠা ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে। বাবার হাত ছেড়ে পাতার হাত ধরে বলে,

-” ও আম্মু? আব্বুকে বলো না রাজি হতে! আমি এই এইটুকু যাবো? প্লিজ? আমার না খুব করে যেতে ইচ্ছে করছে! একটু বলো না আব্বুকে? ”

প্রতিবারের মতো এবার আর ভোরের ক্রন্দনরত মুখটা দেখে ইচ্ছে হয় না তার জেদের জন্য আপিল করতে! সে ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” অসুস্থ না তুমি? অন্য কোন দিন যেও!”

ভোরের চোখ এবার বাঁধন ছাড়া হয়। পাতার হাত ছেড়ে বর্ষার কাছে যায়। পাতার বুকটা কেঁপে উঠলো নিমিষেই! সে ঢোক গিলে।
বর্ষা এবার অরুণকে বলে,

-” অরুণ? আমি বরুণকে নিয়ে হারিয়ে যাবো না। সহি সালামত তোমার কাছেই ফিরিয়ে দিবো। একটু সময় আমার ছেলেটার..”

-” ভোর আমার ছেলে! শুধু আমার! ও কোথাও যাবে না। তুমি যেতে পারো এখন?”

হুঙ্কার দিয়ে বলে অরুণ। বর্ষা দমে যায় না। সেও চিল্লিয়ে বলে,

-” তুমি বোধহয় ভুলে যাও ভোরের জন্মদাত্রী মা আমি! ওর উপর আমারও অধিকার আছে! ছেলেটা আমার সাথে যেতে চায়; আমি নিয়ে যাবোই!”

-” জন্ম দিলেই মা হয়?হবে হয়তো! তবে মমতাময়ী না! এটা তো ভোরের দূর্ভাগ্য যে তুমি তার জন্মদাত্রী!দুধের বাচ্চাকে রেখে যাওয়ার সময় মাতৃত্ব কোথায় গিয়েছিল?এখন হঠাৎ এতো দরদ ভালোবাসা উতলে উতলে পড়ছে! থাক পুরনো কথা! দেখি তোমার কত বড় স্পর্ধা!নিয়ে গিয়ে দেখাও?”

এবার শান্ত সুর অরুণের!ভোর সেই কখন বর্ষার কোমড় জড়িয়ে মুখ লুকিয়ে নিয়েছে। সে মা’য়ের সাথে যেতে চায়।মা অনেক দূরে যাবে বিমানে চড়ে।অনেক বছর আসবে না। তাই সে একটু মায়ের সাথে সময় কাটাতে চায়!বর্ষা ভোরকে কোলে তুলে নেয়,

-” দেখি কিভাবে আটকাও!”

-” ভোর? একেবারে ছোট বাচ্চা তুমি নও! আম্মু চাই! আম্মু চাই! এনে দিই নি? তোমার আম্মু কম ভালোবাসে তোমায়?তারপরও এর কাছে কেন যেতে হবে তোমার?”

-” অরুণ সৎ আর আপন বলে একটা কথা আছে! আশা করি এ বিষয়ে তোমার থেকে ভালো কেউ জানে না!”

তাচ্ছিল্যভাবে বলে বর্ষা! অরুণ পাতা দুজনেই যেন নিস্প্রভ প্রদীপের আলোর মতো নিভে গেলো! অরুণ এগিয়ে যায়। বর্ষার সম্মুখীন হয়ে ভোরকে বলে,

-” ভোর? তুমি যেতে চাও?”

ভোর কনুই ভাঁজ করে চোখ ডলে বলে,

-” আব্বু? একটু গেলে কি হবে?”

-” কিছু না! আসো আমি রেডি করিয়ে দিচ্ছি!”

বর্ষা ,ভোর, পাতা তিনজনেই অবাক হয় ঢের! ভোর উজ্জ্বল লেচনে জিজ্ঞেস করে

-“সত্যিই আব্বু?”

অরুণ মাথা নাড়ল। ভোর খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে দিলে অরুণ কোলে তুলে নেয়। ছেলেকে নিয়ে ওয়াশ রুমে যেতে যেতে বলে,

-” পাতাবাহার? ঘর থেকে জঞ্জাল বের করো! ফাস্ট!”

পাতার অধরকোনে হাসির রেখা দেখা যায়। এই নাক উঁচু ম্যানারলেস কপোট লোকটার চাল বুঝতে বাকি নেই! বর্ষা আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে! পাতা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” ঝাড়ু আনবো? ওই ওই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে!”

বর্ষা কটমট করে পাতাকে চোখ রাঙিয়ে হনহন করে বের হয়ে যায়। তার বোঝা উচিত ছিলো অরুণ সরকার কখনোই বরুণকে নিয়ে যেতে দেবে না!
বর্ষা বেরিয়ে যেতেই পাতা দরজা বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার জীবন নাটক সিনেমার থেকেও কোনো অংশে কম নয়। তবে ছোট ভোরের উপর তার বেশ অভিমান হয়। সে যখন কোন বাচ্চাকে কখনো আদর করে নবাব গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে ‌আর এখন মা’ কে পেয়ে আম্মুকেই ভুলে গেলো?
_______

বিছানায় গাল ফুলিয়ে বসে আছে আনিকা! পাশে রূপ আনিকার পুতুল হাতে বসে আছি। শুধু বসেই ক্ষান্ত হয়নি; পুতুলের নাক মুখে পুরে কামড়ে দিচ্ছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। তাঁর হাসিতে আনিকা বিরক্ত হয়ে ধুম করে কিল বসিয়ে দেয়‌‌। ব্যস রূপের রেডিও বেজে উঠলো। আরিয়ান ছেলের কান্না শুনে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে এসে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে আমাল বাবাটাল? হুম! ওলে লে কাঁদে না! আনি মা কি হয়েছে? কাঁদছে কেন?”

রূপ আও আও করে অভিযোগ জানায়। আরিয়ান কিছু বোঝে না তবে হেসে ছেলের গালে মুখে চুমু দিয়ে বলে,

-” হুম বকে দেবো! বাবা হাসো তো?”

রূপ হাসে না। ঠোঁট উল্টিয়ে আনিকার দিকে তাকায়। আরিয়ানও তাকায়। মেয়েকে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে বলে,

-” আনি মা? কি হয়েছে? এভাবে গাল ফুলিয়ে রেখেছো কেন? ভোর এসেছে দেখা করো নি? ভোর যাবো ভোর যাবো বলে তো কাল থেকে পুরো বাড়ি মাথায় তুলছিলে। এখন ভোর তো এসে গেছে!”

আনিকা গাল ফুলিয়ে রেখে বলে,

-“গিয়েছিলাম আমি ওই পঁচা ভোরের কাছে! ও পঁচা চাচিমনির সাথে কথা বলছিলো! আমার কথা শুনলোই না! ওর সাথে আর কথা নেই!”

আরিয়ান ছেলেকে শূন্যে ছুঁড়ে আবার ধরে। রূপ খিলখিল করে হাসে, কান্না ভুলে। আরিয়ান মেয়ের উদ্দেশ্যে বলে,

-” ওই মহিলা চলে গেছে সেই কখন! এখন দুপুর হতে চলল!”

-” সত্যিই চলে গেছে?”

কৌতূহল মনে প্রশ্ন আনিকার। আরিয়ান মাথা নাড়তেই আনিকা দৌড়ে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। উদ্দেশ্য ভোরের সাথে কথা বলা!
সে দৌড়ে ভোরদের রুমে যায়! ধরাম করে দরজা খুলে হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

-” ভোর? বড় চাচিমনি? তোমরা ঠিক আছো?”

পাতা ঘার ফিরিয়ে আনিকার দিকে চায়! হাঁফ প্যান্ট ও ফ্রক পড়ে মাথায় রঙ বেরঙের ক্লিপ লাগানো এক আদুরে মিষ্টি মেয়ে! পাতা মুচকি হেসে বলে,

-” একদম! আসো?”

আনিকা এগিয়ে আসে। পাতা তাকে বিছানায় বসিয়ে দেয়। ভোর কম্বল থেকে মুখ বের করে একবার দেখে নিয়ে আবার লুকিয়ে পড়ে‌। সে সবার সাথে রাগ করে আছে। আব্বু তখন তাকে বোকা বানিয়েছে। তাকে রেডি করানোর কথা বলে নিয়ে যায়। রেডি হয়ে ভোর এসে মা’ কে পায় নি! আম্মু বলেছে সে নাকি চলে গেছে। কিন্তু ভোর যানে মা যায় নি! আব্বু পাঠিয়ে দিয়েছে।
পাতা ও আনিকা ভোরকে ডাকে। ভোর সাঁড়া দেয় না। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রেডি হয়ে মা’ কেনা পেয়ে ভোরের সে কি কান্না? থামানোই যাচ্ছিল না! অরুণ জোড়ে এক ধমক দিয়ে বলেছিল,

-” এই চুপ? আরেকবার আওয়াজ হলে রেখে আসবো ওই মহিলার কাছে! একেবারের জন্য! আর আনবো না। তখন থেকো মা’ য়ের কাছে!”

তখন ভোরের কান্নার আওয়াজ থেমে যায়। সে মায়ের সাথে থাকতে চায় নি তো! সে মা’কে ভালোবাসলেও মা’ তো তাকে ভালোবাসে না! তবে সে শুধু একটু সময় কাটাতে চেয়েছিল! সে আব্বু আম্মুর সাথেই থাকতে চায়! আব্বু তাকে ওখানে রেখে আসার কথা বলতে পারলো?

-” আব্বু তুমি মিথ্যুক! বলেছিলে যেতে দিবে!

-” কখন বলেছি? আমি শুধু বলেছি আসো রেডি করিয়ে দিচ্ছি!

ভোর তখন বিছানায় উঠে আপাদমস্তক কম্বলে মুড়িয়ে নেয় নিজেকে। কারোর সাথেই কথা বলছে না। আসমা বেগম, আদুরি ,সাবিনা চৌধুরী, আভারি এসে ডেকে গেছে কথা বলে নি!এমনকি পাতার সাথেও না। পাতা তখন থেকেই ভোরকে ডাকছে। এটা ওটা বলে বোঝাতে চেষ্টা করছে। ভোর শুনছে তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না। অরুণ সরকার কিন্তু একবারও ডাকে নি। পাতা জানে লোকটা এসে একটু আদর করে ডাকলেই ভোর উঠবে। কিন্তু লোকটাও আরেক জেদের খাম্বা। সেই যে বেড়িয়েছে আসার নাম ডাক নেই! আনিকা ভোরের কম্ফোর্ট টেনে ধরে; ভোর শক্ত করে ধরে রাখে ছাড়ে না। আনিকা বিরক্ত হয়ে বলে,

-” উফ চাচিমনি ছাড়ো তো পঁচা ভোরকে! তুমি যখন আমাকে, রূপকে আদর করো তখন ভোর কেমন করে? তাহলে আজ ভোর ওর ওই পঁচা মায়ের সাথে কথা বলেছে আদর করেছে! তুমিও ওর সাথে রাগ করে থাকো! কথা বলো না। তখন বুঝবে মজা!”

পাতা আনিকার গাল জোড়া টিপে দিয়ে কপালে চুমু দেয় সশব্দে। ভোর গাল ফুলিয়ে কান খাঁড়া করে রাখে। তার আম্মুকে পচা বুদ্ধি দিচ্ছে শয়তান আনিকা! ভোর কম্ফোর্ট পেঁচিয়েই গড়াগড়ি খায় বিছানায়। পাতার অবস্থান বুঝতে পেরে পিঁপড়ের মতো গুটি গুটি করে পাতার কোলে মাথা রাখে। হাত বাড়িয়ে আনিকার হাতে জোড়ে চিমটি কাটলো। আনিকা চেঁচিয়ে উঠলো সাথে সাথেই।

-” দুষ্টু ভোর! চাচিমনি তুমি ওকে সরিয়ে দাও তো! ওর সাথে একটুও কথা বলবে না!”

পাতা সত্যিই সরিয়ে দেয় ভোরের মাথা তাঁর কোল থেকে। এ পর্যায়ে ভোর কষ্ট পায়! কম্ফোর্ট সরিয়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,

-” বলতে হবে না কথা! ভোর আরেকটু বড় হলেই চলে যাবে এখান থেকে! ভোরের কারোর দরকার নেই!”

-” তাই নাকি?”

ভোর বাবার গলা শুনে গোল গোল চায়! ঝাপিয়ে পড়ে পাতার উপর! গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” শুধু আম্মু হলেই হবে;আব্বু দুষ্টু! আম্মু তুমি আর আমি চলে যাবো এখান থেকে আচ্ছা?”

পাতা ‘আচ্ছা’ বলে ভোরের পিঠে আস্তে করে চাপড় দিলো! অধরকোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলেও আঁখি যুগল ভরে গেছে। বর্ষা নামক মহিলার কাছে যাওয়ার পরে এই প্রথম তার বুকে এলো! পাতা বোধকরি জানে প্রাণ ফিরে পেলো! সাথে এটাও ঠাহর করতে পারলো বাচ্চাটা তার হৃদ কুঠিরে কতটা জুড়ে আছে!
অরুণ টি টেবিলে ট্রে রাখে। ট্রে’তে খাবার সরঞ্জাম! গরম ভাত সাথে শিং মাছের ঝোল! বড় রুই মাছের ডিম ভুনা! রুই মাছের বড় মাথা! সে প্লেটে ভাতসহ মাছ নিয়ে বিছানায় বসে। মাছের কাটা বেছে নিয়ে বলে,

-” কে কোথায় যাবে দেখা যাবে! আমি মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি। কালই গিয়ে বিয়ে পড়িয়ে ছেলের বউকে নিয়ে আসবো‌। লাল টুকটুকে বউ রেখে সে কোথাও যেতেই পারবে না!”

আনিকা হু হা হা করে হেসে ওঠে।

-” ভোরের বউ?চাচ্চু সত্যিই কাল ভোরের বিয়ে?”

ভোর গাল ফুলিয়ে পাতার গলা ছেড়ে আনিকার চুল টেনে ধরে।জোড়ে না, আবার আস্তেও নয়! আনিকা চেঁচিয়ে উঠলো। ভোরের কপালে আবার ধমক জোটে। ভোর পাতার কোলে মাথা রেখে কাঁদত কাঁদতে বলে,

-” আম্মু? কেউ ভালোবাসে না আমায়! আমি বিয়ে করবো না? আব্বুকেই বলো বিয়ে করতে!”

অরুণ মুচকি হাসলো। পাতা কটমট করে চায়। বিয়ের কথা শুনে কি লোকটার মনে লাড্ডু ফুটলো? সে ভোরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

-” তোমার বাবা মজা করছে তো! এত ছোট বাচ্চা বিয়ে করে? বিয়ে করতে একুশ বছর হতে হবে! তুমি তো সবে ছয় বছর একদিন!”

-” একুশ বাইশ চব্বিশ আমি কখনোই বিয়ে করবো না! না মানে না!”

চিল্লিয়ে বলে ভোর! আনিকা তার চিল্লাচিল্লিতে হেসে কুটিকুটি! ভোর তার হাসি দেখে আরো রেগে যায়! পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে!

-” কেন বিয়ে করবে না?”

ভোর পাতার দিকে পিটপিট করে চায়। নাক টেনে বলে,

-” বিয়ে করলে সবাই লজ্জা দিবে!”

পাতা ফিক করে হেসে দেয়। আনিকা তো কংস মামার মতো করে হাসছেই! অরুণও হাসে শব্দহীন! ভোর আরো লজ্জিত হয়। দু হাতে নাক মুখ ঢেকে নিয়ে বলে,

-” তোমরা একটুও ভালো না! শুধু শুধু ভোরকে লজ্জা দিচ্ছো!’

পাতা হাসি থামিয়ে বলল,

-” আচ্ছা আর দিবো না লজ্জা! এখন ওঠো তো ভোর?”

ভোর উঠে পাতার কোলে বসে। অরুণ ভাতের লোকমা মুখে দেয়! ভোর অন্যদিকে তাকিয়ে খাবার চিবোতে থাকে। কথা বলবে না বাবার সাথে! অরুণ আনিকার মুখে দেয় খাবার! আনিকা হাসিমুখ নেয়। পাতার বারি এলে পাতা হা করে না! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থাকে! অরুণ শান্ত চোখে চেয়ে থাকে।

-” পাতাবাহার? খাওয়ার সাথে কিসের গোস্বা? হা করো?”

পাতা বাচ্চাদের দিকে চায় আড়চোখে। দু’জনেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। পাতা হা করে অরুণ তার মুখ ভর্তি ভাত দিয়ে বলে,

-” আমি খুবই বাজে একজন মানুষ! খুবই বাজে।এখন কি আর করার তোমাদের কপাল খারাপ তাই আমার ঘরে অবস্থান করছো! এর থেকে তো নিস্তার পাওয়ার কোনো অবকাশ ই নেই! এই বাজে লোকটাকেই সহ্য করতে হবে সারাটা জীবন !”

আনিকা এগিয়ে এসে অরুণের গাল জোড়া টেনে দিয়ে বলে,

-” বড় চাচ্চু তুমি খুব খুব খুব ভালো! ইস্ট ওর ওয়েস্ট চাচ্চু ইজ দা বেস্ট!”

-” থ্যাংক ইয়ু আনিবুড়ি!”

আনিকা অরুণের গালে চুমু বসিয়ে দিয়ে নিজ স্থানে বসে পড়লো। ভোর আর পাতা আড়চোখে তাকিয়ে তাদের দিকে। অরুণ ভোরের মুখে খাবার দিয়ে বলে,

-” কলিজা? সবসময় জেদ করো তুমি! পড়ে বকলে আমার দোষ?”

ভোর খাবার গিলে ঘার মুড়িয়ে আম্মুর দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমি জেদ করি? একটু গেলে কি হতো?”

-” যে ভালোইবাসে না তাঁর সাথে কেন যাবে?”

ভোর মুখটা মলিন দেখায়। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” আমি তো ভালোবাসি!”

অরুণ আর একটা শব্দও উচ্চারণ করে না। বাসুক ভালো! সে তো আর থামাতে পারবে না। অরুণ পাতার দিকে তাকায়! মেয়েটার মুখটা মলিন হয়ে গেছে নিমিষেই। মলিনতার কারন বুঝতে সময় লাগে না। ভোর বাবার নজর দেখে নিজে ঘার মুড়িয়ে আম্মুর দিকে চায়! পাতা অধর বাঁকিয়ে হাসে। কিন্তু সেই হাসিতে যেন দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ছে না। ভোর পাতাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

-” আম্মু তুমি মন খারাপ করেছো? ভোর তোমাকেও অনেক ভালোবাসে! আমি মা’কে একটু একটু ভালোবাসি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি! সত্যিই বিশ্বাস করো?”

-” মন খারাপ করি নি তো! আমি জানি ভোর আমাকে অনেক ভালোবাসে! তবে মা’কে পেলে আম্মুকে ভুলে যায়! থাক সেটা কোনো ব্যাপারই না!”

ভোর পাতাকে ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

-” ভোর একটুও ভুলে যায় নি তার আম্মুকে। সত্যিই বলছি! আম্মুকে কখনো ভোলা যায় না কি? হুম?”

পাতা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বলল,

-” যায় না?”

-” কখনো না! ইস্ট ওর ওয়েস্ট ভোরের আম্মু ইজ দা বেস্ট! আই লাভ ইয়ু আম্মু”

পাতা তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে হাসে। ভোর উঠে দাঁড়িয়ে পাতার গালে কপালে চুমু খায়। পাতার মন খারাবির রেশ! হালকার উপর ঝাপসা অভিমান! সব উবে যায় কর্পূরের মতো।বর্ষা ভোরের মা! ভোর ভালোবাসতেই পারে। এতে কোন দোষ নেই। সেও তো তাঁর মাকে ভালোবাসে শত অভিমানের মাঝে।মোদ্দা কথাটা হলো বর্ষা তাদের জীবন থেকে অনেক দূরে! ফিরে আসার চান্স শূন্যের কোঠায়!
অরুণ আস্তে ধীরে সবটুকু খাবার খাইয়ে দেয় তিনজনকে! খাওয়া শেষে ওষুধ পত্র খাইয়ে দিয়ে সব গুছিয়ে নিয়ে নিচে যায়। আনিকা অরুণের সাথেই বেড়িয়ে আসে। ডাইনিং টেবিলে আরিয়ানকে দেখে সে বাবা কাছে যায়! অরুণ সব কিচেনে রেখে নিজেও ডাইনিং টেবিলে বসে। সুফিয়া তার প্লেটে খাবার দেয়! অরুণ আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” রুবি অফিসে?”

-” হুম! সে তো অফিস জয়েন করে স্বামী বাচ্চা ভুলতে বসেছে!”

হাসতে হাসতে বলে আরিয়ান। প্রতিত্তরে অরুণ মুচকি হেসে খাবার মুখে নেয়।

-” ও কাজে খুবই আগ্রহী! সে যাক বিড়ালটিকে ওষুধ লাগিয়েছে কে?”

আদুরি এবার হাসিমুখে বলে,

-” আমি পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম! তাঁরাই ওষুধ লাগিয়ে দিল! টিকাও দিয়েছে!”

-” থ্যাংকস আদু!”

আদুরি মুচকি হেসে বলে,

-” মেনশন নট বিগ ব্রো!”

আরো টুকটাক কথার মাঝেই অরুণ খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুয়ে নেয়।‌সবার থেকে বিদায় নিয়ে রুমে রওনা হয়। রুমে প্রবেশ করে অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। কেউ নেই তো! সে ওয়াশ রুমে বেলকনিতে খোঁজে পায় না। বেলকনির সেই ছোট দরজা খুলে উঁকি দিতেই নজরে আসে দুজন! নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছেন তার চড়ূই জোড়া! অরুণের অধরকোনে মিষ্টি হাসির ডালপালা ছড়িয়ে পড়ে। সে কতক্ষণ তাকিয়ে দেখে। ভোর পাতার দিকে পিঠ করে পাতার একটা হাতের উপর মাথা রেখে হা শুয়ে আছে। আর পাতা হাত পা গুটিয়ে শুয়ে আছে তার শাড়ির অবস্থা যাচ্ছে তাই! অরুণ রুমে ফিরে আসে।দরজা বন্ধ করে বিছানা থেকে কম্ফোর্ট নিয়ে ও ঘরে যায়! দু’জনের গায়ে জড়িয়ে আধ খোলা পর্দা বন্ধ করে দেয়! বাইরের আলো আর গ্লাস ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। অরুণ ফ্লোরে পাতানো বিছানায় বসে। ঝুঁকে ছেলের কপালে চুমু দেয়। এরপর গায়ের টি শার্ট খুলে পাতার ওপাশে গিয়ে তারই বালিশে মাথা রেখে কম্ফোর্টের ভিতর গা এলিয়ে দেয়। ভোরের মাথার নিচ থেকে সন্তঃপর্নে পাতার হাতটা বের করে পাতাকে সোজা করে শুইয়ে দেয়। কপালে পরপর ছোট ছোট চুমু দিয়ে গায়ে জড়িয়ে থাকা এলোমেলো আঁচল সরিয়ে দেয়। সেথায় মুখ গুঁজে উন্মুক্ত উদরে বলিষ্ঠ হাত রাখল। পাতার হালকা ঘুম ছুটে যায় নিমিষেই! তাঁর নড়াচড়ায় অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,

-” পাতাবাহার ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! ঘুমোবো আমি!”

পাতা নড়াচড়া থামিয়ে দেয়। কিছু পল চুপচাপ থেকে ঝটকায় অরুণকে সরিয়ে দিয়ে এপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
অরুণ বালিশ বিহীন বেশ সময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে! তাঁর পর উঠে টি শার্ট গায়ে গলিয়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। পাতা তাকিয়ে থাকে তার প্রস্থানের দিকে। লোকটা রেগে গেলো? তার ওভাবে সরিয়ে দেয়া মোটেই ঠিক হয় নি! লোকটা কষ্ট পেয়েছে বোধহয়! পাতার ঘুম হাওয়া হয়ে যায়। মাথায় একরাশ চিন্তা ঘুরপাক খায় লোকটাকে ঘিরে।

চলবে….