পাতা বাহার পর্ব-৪৫+৪৬+৪৭

0
693

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৫

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

-” অরুণ মাথা ঠান্ডা কর! এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়লে পড়ে হিতে বিপরীত না হয়ে যায়! আমাদের কাছে কিন্তু এখনো সলিড প্রমাণ নেই!”

শুভর কথায় অরুণ যেন ক্ষেপে যায়। টেবিলের উপর রাখা কলমদানি ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। রাগে গজগজ করতে করতে হিসহিসিয়ে বলে,

-” সলিড প্রমাণের নিকুচি করেছে! একবার ওকে হাতের কাছে পাই ওর প্রত্যেকটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পিস পিস করে কুকুরকে খাওয়াবো! শালা ****। ওর কত বড় কলিজা আমার কলিজার দেহ ক্ষতবিক্ষত করে!! ওর কলিজা ভুনা করে ওকেই খাইয়ে দিবো! ***!

অরুণের মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে আছে কপালের প্রত্যেকটা শিরা উপশিরায় যেন ক্ষোভ প্রকাশ করছে। হাত মুঠো করে কাঠের টেবিলে সজোরে আঘাত করে! উপস্থিত বন্ধুরা সবাই অরুণ সরকারের রাগের সাথে পরিচিত! যেখানে অরুণ সরকারের কলিজায় আঘাত করবে আর সে চুপ করে বসে থাকবে সেটা বড্ডই বেমানান। তাদের কাছে অরুণের এমন বিহেভিয়ার ডালভাত! রাসেল গালে হাত দিয়ে বসে অরুণের দিকে তাকিয়ে আছে। একটু আগেই এসেছে তাঁরা। বাড়ির গেটের সিসিটিভি ফুটেজ! গেটের আশপাশের দোকান, বাসাবাড়ির গেইটের সিসিটিভি ফুটেজ কালেক্ট করেছে অরুণ নিজেই। বন্ধুদের নিয়ে গতকাল সহ বেশ কয়েকদিনের ফুটেজ মনোযোগ সহকারে দেখে।‌ মাস খানিক হবে একটা কালো গাড়ি সরকার বাড়ির কিছুটা দূরে প্রায়ই দেখা যায়। গাড়ি থেকে কিছু লোককে মাথায় ক্যাপ, চোখে কালো চশমা ও মাস্ক পড়ে বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়! মাঝে মাঝে তাদের সাথে দুটো কুকুর দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে একটা লোক দাড়োয়ানের সাথে অনেক আলাপ সালাপ করে। চা বিড়ি সিগারেট খায়! অরুণের চোয়াল শক্ত হয়! লোকটাকে চিনতে অরুণ ও রাসেলের বেশি অসুবিধা হয় না‌। এতো শুকলা মন্ডলের ছেলে! নামটা মনে নেই তাদের! গতকালের ফুটেজে অরুণ সবটা দেখে কিভাবে একটা লোক কুকুর গুলোকে ফোন বের করে ছবি দেখালো; ভিতরে প্রবেশ করালো! সব দেখে অরুণ ভয়ঙ্করভাবে রেগে যায়। ল্যাপটপ ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। সেটা ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে গেছে সাথে সাথেই।
রাসেল গাল থাকা হাত সরিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে সোজা হয়। হামি তুলে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,

-” অরু কুল ম্যান। এতো হাইপার হলে হবে? একটু ঠান্ডা মাথায় ভাব! ওই শুকলা আর ওর ছেলের দ্বারা এতো কিছু ঘটানো সম্ভব? ট্রেইনড কুকুর! এতো এতো প্ল্যান আদৌ ওদের মতো ছোচা কুকুরের মাথা থেকে বেরোবে?”

শুভ , জীবন, ফয়সাল, দীপ্ত ভাবনায় পড়ে। কথা সত্য! তাহলে এসবের মাস্টার মাইন্ড কে? অরুণ লম্বা শ্বাস টেনে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রনে আনে। মাথা ঠান্ডা রেখে স্বাভাবিক রাশভারী গলায় বলে,

-” আরেকটা জানোয়ার পিটিয়েছিলাম না? আলম! ওর ছেলে কি যেন নাম আবাল না আকাশ! ওই এসবের মাস্টার মাইন্ড!”

রাসেল মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালো। অরুণের পাশে টেবিলের উপর বসে অরুণের চুল গুলো মুঠোয় ভরে টানাটানি করে বলে,

-” ঠিক ধরেছিস! আমার এক টিম আছে। সাম কাইন্ড ওফ গোয়েন্দা টাইপ! টোটালি ব্যাকডোর! আমি ওদের সাথে কথা বলে মামলাটা দেখছি! তুই আগে পাকনামি করিস না‌। ওরাও কম ডেঞ্জারাস না। তোর কথা বাদ দিলাম তোর পরিবারের সেফটির একটা ব্যাপার আছে না? তাই একটু চুপ থাক দুটো দিন! ওদের তোর হাতেই তুলে দিবো!”

অরুণ ভাবে! কথাটা মন্দ নয়! নিজের চুলের মুঠো থেকে রাসেলের হাত ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলে,

-” ঠিকাছে।যতদিন না ওদের জামাই আদর করতে পারছি ততদিন এই অরুণ সরকার শান্তিতে বসতে পারবে না।রাসেল ওই ***** বাচ্চাদের আমার হাতে তুলে দিতে হবে। এরপর আর তোর টিম নাক গলাতে পারবেন না বলে দিলাম!”

রাসেল আরুণের পিঠ চাপড়ে হেসে বলে,

-‘ তা তো একটু গলাবেই। আইনের লোক কি না! এই খুন টুনের কথা ভাবলে ঝেড়ে ফেল!”

-” মেরে ফেলার মধ্যে কি মজা বন্ধু! মজা তো কেটে কাটা ঘায়ে মরিচের গুঁড়া ছিটানোর মধ্যে! ব্লেড দিয়ে ভালোবেসে আঁচর দেয়ার মধ্যেই। ছুরি দিয়ে হাতের আঙ্গুল…”

থেমে যায় অরুণ! কেউ দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে। সুফিয়ার হাতে খাবারের ট্রে! অরুণ ধমক দিয়ে বলে,

-” নক করে ঘরে ঢোকা যায় না? হ্যাঁ?”

আরো কিছু বলবে পেছনে পাতাকে দেখে চুপ করে যায়। পাতার হাতেও ট্রে যাতে চা বিস্কিট!
পাতার আগমন! অরুণের চুপ হয়ে যাওয়া দেখে অরুণের সব বন্ধুরা মিটমাট করে হাসে। পাতা ও সুফিয়া ভিতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ট্রে কোথায় রাখবে বুঝতে পারে না। স্টাডি রুমে গোটা কয়েক কাঠের চেয়ার একটা টেবিল।আর সব বুক সেলফ! চেয়ার টেবিল সবাই দখল করে রেখেছে। সুফিয়া একটা ফাঁকা চেয়ারে ট্রে রেখে বেড়িয়ে যায়। ধমক শুনে তার পাঁচ আত্না স্রাধ করতে বেড়িয়েছে। এই বাড়িতে আসার পর সে এই লোকটার ধমক গুনে গুনে সাতবার খেয়েছে। প্রতিবারি তার ছোট রুহ টা ধ্বক করে উঠেছে। তাই সে পুনরায় ধমক শোনার আগে কেটে পড়ে। পাতা এবার খেয়াল করে রুমের ফ্লোরে কলমদানি পড়ে আছে; রং পেন্সিল কলম হাবিজাবি ফ্লোরে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কর্নারের দিকে লোকটার ল্যাপটপ পড়ে আছে দুই টুকরো হয়ে! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে কি হয়েছে এখানে? পাতা অরুণের দিকে তাকায়। লোকটা তার দিকেই তাকিয়ে ছিল তার তাকানোয় নজর লুকিয়ে নেয় সাথে সাথেই! পাতাও নজর সরিয়ে নেবে হঠাৎ খেয়াল করে লোকটার হাতের আঙ্গুল গুলো লাল জখমের ন্যায় হয়ে আছে। পাতা উদ্বিগ্ন হয়। লোকটার কি হয়েছে? সাথে খানিক অস্বস্তিতে পড়ে। ট্রে কোথায় রাখবে? সবাই এরকম সাইলেন্ট মুডে আছে কেন?

অরুণ রাসেলকে ইশারা করে টেবিল থেকে নামতে। রাসেল অরুণের কাঁধ শক্ত করে ধরে তার কোলের উপর বসে পড়লো। পাতা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে দুজনকে! মনে হচ্ছে কপোত কপোতী রোমান্টিক মুডে একজন আরেকজনের কোলে বসে আছে।
পাতার হাতের ট্রেতে থাকা চায়ের কেতলিই ঝন ঝন শব্দ করে নড়েচড়ে ওঠে;সাথে চায়ের কাপ। পড়ে বুঝতে পারে তার হাত কাঁপার দরুণ ওগুলো নড়ছে। কিন্তু কথা হলো পাতার হাত কাঁপছে কেন?
জীবন, ফয়সাল ও দীপ্ত হু হা করে হেসে উঠে।শুভর মুখেও চাপা হাসি! অরুণ বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

-” উঠ?”

রাসেল ওঠে না। অরুণের গাল জোড়া টেনে পাতাকে চোখ টিপে দেয়। পাতার হাত থেকে ট্রে পড়তে নিবে শুভ ধরে! ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর রাখে। অরুণ আড়চোখে সবটা খেয়াল করে। জীবন গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” পিচ্চি ভাবী? এসব তো কিছুই না! আরো কতকিছু চলে দুজনের মাঝে?”

পাতা গোল গোল করে তার দিকে চায়! রাসেল অরুণের কোল থেকে উঠে এসে জীবনের পিঠে লাগায়। জীবন পিঠ ডলে বলে,

-” সত্যি কথা বলেছি আর ওমনেই ছ্যাৎ করে উঠেছে। এদের দুজনের গলায় গলায় ভাব। ভার্সিটি লাইফে কোনো কপোত যুগলও এতো চিপকাইতো না যতোটা এরা দুজন চিপকে থাকতো! ফয়সাল কথা ঠিক না?”

পাতা গোল গোল করে ফয়সালের দিকে চায়। ফয়সাল শয়তানী হেসে মাথা নেড়ে বলে,

-” ঠিক। আমাদের সময়ের আরেকটা ফেমাস জুটি অরু রাসেল!”

অরুণের মুখটা দেখার মতো হয়েছে! তবে সে চুপচাপ বসে থাকে। রাসেল দুটোকে কয়েক ঘা লাগিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,

-” গ্রুপের মধ্যে আমার আর অরুণের বনতো বেশি! এরা সবাই হিংসেয় জ্বলে পুড়ে এসব বলে!”

পাতার বেশ হাসি পায়। হাসি লুকিয়ে রাখাও দায়। সে ফ্লোরে বসে রং পেন্সিল কলমদানিতে তোলে। দীপ্ত হায় হায় করে ওঠে,

-” আরে ভাবী করছেন টা কি? উঠুন! অরুণ সরকারের কুইন আপনি! যাকে বলে মহারানী! আপনাকে এসব মানায় না!”

-” আমি তুললে কি হবে ভাইয়া?”

পাতার কথায় দীপ্ত মুচকি হাসলো। পাতাও ভদ্র সুলভ হেসে ফ্লোর পরিষ্কার করে কলমদানি টেবিলে রাখে। অরুণের পাশের কর্নারে গিয়ে ল্যাপটপ তুলে অরুণের কোলে রাখে। সবাইকে চা নাস্তা নিতে বলে বেরিয়ে আসে।
পাতা বেড়িয়ে যেতেই অরুণ যেন আঁটকে রাখা শ্বাস টেনে নেয়। ফয়সাল ও জীবনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকে।হাত বাড়িয়ে বুকশেলফ থেকে বই বের করে জীবনের দিকে ঢিল ছুড়ে। জীবন ক্যাচ করে নেয়,

-” বউ বেড়িয়ে গেল অমনিই আপন রূপে ফিরে এলি! শালা গিরগিটি!”

-” আও ফাও কথা বলে মাথা খারাপ করাস না!”

সিরিয়াস গলায় বলে অরুণ। জীবন থোরাই কেয়ার করে।সে ট্রে থেকে সেমাইয়ের বাটি হাতে নিয়ে মুখে ভরে বলে,

-” তোর আদরের বউকে শান্ত শিষ্ঠই ভাবছিলাম! কিন্তু গতরাত হাসপাতালে সে তো পুরাই টাইম বোম্ব রেরোলো। ঝাঁঝ আছে ভাই!”

অরুণ বিরক্ত হয়। পাতাকে নিয়ে এভাবে কথা বলা তার মোটেও ভালো লাগে না। ফয়সাল কাপে চা ঢেলে বলে,

-” এখানে অরুণের দোষ আছে। বেচারিকে সবার সামনে কাল কিভাবে থাপ্পড় দিলো! দোষী বানালো অথচ সি’জ ইনোসেন্ট! মেয়েটা শান্ত প্রকৃতির তাই ওতটা রিয়েক্ট করে নি।”

অরুণ ঘারে হাত রেখে মাথা এদিক ওদিক করে। রাসেল কপালে ভাঁজ ফেলে বন্ধুর পক্ষ নিয়ে বলে,

-” এখানে অরুণেরও দোষ আমি খুঁজে পাই না। সবাই জানে অরুণ জান হারায় ছেলের উপর! ছেলেকে অমন অবস্থায় দেখে কারই বা মাথা ঠিক থাকে? পাতা মেয়েটা ভালো! ভোরকে অনেক ভালোবাসে স্নেহ করে অরুণ জানে। তাই তো অনুতপ্ত হয়ে স্যরিও বলেছিল! পাতার হাসপাতালে ওভাবে সবার সামনে সিনক্রিয়েট করা মোটেই ঠিক হয় নি।”

অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাসেলকে কিছু বলবে এর আগে শুভ কঠিন গলায় বলে,

-” তুই জীবনে অরুণের দোষ খুঁজে পাবিও না! শোন একটা মেয়ে নিজের পরিবার ছেড়ে স্বামীর হাত ধরে নতুন জীবনে পদার্পণ করে। সে শতভাগ আশায় থাকে তার ব্যাক্তিগত মানুষটা যেন সবসময় তার পাশে থাকে। তাকে বিশ্বাস করে সাথে একটু সম্মান করে। অরুণ গতকাল কি করলো? মেয়েটার সব আশা ভেঙে চুরমার করে দিল! সবার সামনে সপাটে চড় বসিয়ে দিল! চরটা পাতার গালে না সম্মানে লেগেছে। কাল রাতে পাতা সিনক্রিয়েট করলো ওটা চোখে বাজলো আর অরুণ সবার সামনে ওকে চর মারলো, ধাক্কা দিলো, গলা চড়িয়ে কথা বলল সেটা কি তবে?”

কথাগুলো চরম সত্য হলেও শুভর মুখ থেকে নিঃসৃত হওয়ায় মোটেও ভালো লাগলো না। কেন? শুভ পাতাবাহারের এক কালের ক্রাশ ছিলো তাই? কি সব ছেলেমানুষী চিন্তা ভাবনা। অরুণ আওলা ঝাওলা চিন্তা ঝেড়ে নিয়ে খিটখিটে গলায় শুভর উদ্দেশ্যে বলল,

-” সব আমার দোষ! আমি স্বীকার করছি! গলা জড়িয়ে মাফও চাইবো! হয়েছে? এই টপিক অফ যা তোরা! নাস্তা পানি খেয়ে তারাতাড়ি কেটে পড়। তোদের সহ্য হচ্ছে না একটুও!”

ফয়সাল ছোট ছোট করে অরুণের দিকে তাকিয়ে দাঁত কপাটি বের করে বলে,

-“ওটা গলা জড়িয়ে না পা জড়িয়ে হবে। আর কাজের বেলায় কাজি কাজ ফুরোলেই পাজি! বাহ্ অরু! যাবো না কি করবি? ডিনার সেরে তবেই ফিরবো!”

অরুণ বিরক্ত হয়ে তার দিকে তাকায়! বাকি সবাই হেসে ওঠে। তাদের হাসির শব্দে অরুণের বিরক্তের রেশ যেন তরতরিয়ে বেড়ে যায়। কেতলি থেকে কাপে চা ঢেলে নেয়। চা খেয়ে মাথা একটু ঠান্ডা করা যাক!

এর মাঝে আরো একজোড়া পায়ের আগমন ঘটে স্টাডি রুমে। পড়নে শুধু হাফ প্যান্ট! হাতে পায়ে অন টাইম ব্যান্ডেজ। শরীরের কিছু কিছু জায়গায় লালচে আচরের দাগ। সেখানে সাদা সাদা ক্রিম জাতীয় ওষুধ লেপ্টে আছে।হালকা গুলুমুলু ভোর সরকার একদিনের ব্যবধানেই যেন শুকিয়ে গেছে অনেকটা। ভোর একটা ছোট বাটিতে কিছু বরফ কুচি নিয়ে এগিয়ে যায় বাবার দিকে। আম্মু তাকে বরফ নিয়ে আসতে বলেছিল তাঁর আব্বুর জন্য। ভোর গাল ফুলিয়ে মানা করে সে পারবে না। আব্বুর সাথে তাঁর আড়ি! পাতা যখন বলে যে তাঁর বাবা হাতে ব্যাথা পেয়েছে! ব্যস ভোরের মুখটায় বাবার জন্য উদ্বেগ ফুটে ওঠে। ভোর আর কিছু না বলে পাতার হাত থেকে বরফের বাটি নিয়ে স্টাডি রুমের দিকে রওনা হয়।

উপস্থিত অরুণের বন্ধুরা ভোরের আগমনে খুব খুশি হয়। তবে ভোরের হাতে বরফ কুচি দেখে এখে অপরকে ইশারায় কিছু বলে মিটিমিটি হাসে। তবে মুখে কিছু বলে না আপাদত। অরুণের মুখের সকল বিরক্তের রেশ নিমিষেই গায়েব হয়ে যায় ছেলের মায়াময় মুখটা দেখে।
ভোর বাটিটা অরুণের কোলে রাখে‌। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে চায়ের কাপ রেখে ভোরকে কোলে নেয়ার জন্য উদ্যত হয়। ভোর কোলে ওঠে না। অরুণের বলিষ্ঠ হাত এপিঠ ওপিঠ করে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে। বা হাতের উল্টো পিঠে লাল হয়ে গেছে।ভোর হাতের মুঠোয় এক টুকরো বরফ কুচি তুলে বাবার হাতে ঘষে দেয়। অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো। ছেলের হাত থেকে ঠান্ডা বরফ কুচি নিয়ে বাটিতে রেখে হাত জোড়ায় ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দেয়।

দীপ্ত বাবা ছেলের আবেগপ্রবণ মুহুর্ত দেখে মোটেও আবেগপ্রবণ হলো না। সে টিপ্পনী কেটে বলল,

-” যে বরফ এনেছে তার হাত জোড়ায় চুমুতে ভরিয়ে দিলি! আর যে সবটা খেয়াল করে বাচ্চাটাকে দিয়ে বরফ পাঠালো তাকে কি করবি?”

-” তোর না জানলেও চলবে!”

অরুণের ফটাফট জবাব। উপস্থিত সবাই ‘ওহ হো’ বলে হেসে ওঠে। জীবন লজ্জার ভান করে বলে,

-” কি আর করবে! চুমু দিতে দিতে বেচারি পাতাকে খেয়েই..”

অরুণের চোখ রাঙানোতে থেমে যায় জীবন। তবে মুখে না বললেও ইশারা ইঙ্গিতে চোখে ঠোঁটের দুষ্টু হাসিতে সব বুঝিয়ে দেয়! অরুণ তার দিকে বিরক্তিকর চাহনি নিক্ষেপ করে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় যত্ন করে। তবে গায়ের সাথে লেপ্টে নেয় না। ছেলের গায়ে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছে পাতাবাহার! ভোর বাবার কোলে বসে আবার বরফ হাতের মুঠোয় নিয়ে অরুণের জখমে ঘষতে থাকে। অরুণ এবার বাঁধা দেয় না। জীবন দুঃখি দুঃখি মুখ বানিয়ে বলল,

-” ইশ কত ভালোবাসা মিয়া বিবির! আর আমারটা মেরেই কুল পায় না যত্ন নিবে কখন!”

ফয়সাল ও রাসেল হেসে ওঠে শব্দ করে। ছোট ভোর কিছু না বুঝেই হেসে দেয় তাদের সাথে। শুভ এসে ভোরের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। অরুণের দিকে বিরক্তের সহিত তাকিয়ে বলে,

-” এমন যত্ন শীল সুন্দরী বউ বাচ্চা থাকতেও তোর মুখ রসকষহীন! এই কোনো সমস্যা দেখা গিয়েছে? হরমোনজনিত? বন্ধু হই তোর। শেয়ার করতেই পারিস!”

অরুণ শানিত নজরে শুভর দিকে চায়। শুভসহ সকলের মুখেই চাপা হাসি। জীবন তো চুকচুক শব্দ করে বলে,

-“বেচারি পাতার কপাল পুড়ল! অরুণ হারবাল চিকিৎসা নিতে পারিস। একেবারে ঘোড়ার তেজে..”

বাকি টুকু শেষ করে না। অরুণ চোখ বুজে নেয়। মুখটা তার অসম্ভব লাল হয়ে আছে। সে ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো! স্টাডি রুমের বাইরে ছেলেকে রেখে দরজাটা আলগোছে লাগিয়ে দেয়। বন্ধু নামক শত্রুদের দিকে ফিরে দাঁত কপাটি পিষ্ট করে বলে,

-” হয়ে যাক টেস্ট?”
_____

ভোর দরজার দিকে কাঁদো কাঁদো চোখে চেয়ে থাকে। নাক টেনে ফোপাতে থাকে। আব্বু তাকে এভাবে বের করে দিলো? সে আব্বুর উপর রেগে ছিলো। তবুও আব্বু ব্যাথা পেয়েছে শুনে বরফ কুচি এনে লাগিয়ে দিলো! আর আব্বু তাকে এভাবে বের করে দিতে পারলো? সে রাগে পা দ্বারা ফ্লোরে সজোরে আঘাত করে হনহন করে চলে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা মিনুর ঘরে চলে যায়।
মিনু ঘরে একলা বসে মিষ্টি খাচ্ছিলো। আভারি এনে দিয়েছে এক হাঁড়ি মিষ্টি। সাত মাস চলছে তাঁর। ইদানিং কিছুই খেতে পারে না। গন্ধ গন্ধ লাগে তার কাছে। হঠাৎ মিষ্টি খেতে ইচ্ছা করে খুব। আভারিকে বললে এক হাঁড়ি এনে দিয়েছে। মাত্রই মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে বসেছে। দুটোর মতো খেয়েছে। ভোরকে হনহন করে আসতে দেখে মিনু আত্মহারা হয়ে ওঠে। ছেলেটার উপর দিয়ে কাল কি একটা ঝড় বয়ে গেল!! ভোর চুপচাপ বিছানায় উঠে মিনুর সামনে বাবু হয়ে বসে। মিষ্টির হাঁড়ি দেখে গালটা আরেকটু ফুলিয়ে নিয়ে বলে,

-” কেউ ভালোবাসে না ভোরকে! আব্বুও না‌। কিভাবে বের করে দিলো আমাকে। কথা বলবো না একটুও! তুমিও ভালোবাসো না ভোরকে!”

-” আমি আবার কি করলাম ভোর বাবা?”

ভোর ফোঁস ফোঁস করে হাত বাড়িয়ে মিনুর বাড়ন্ত পেটে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলে,

-” তোমার বাবু আসছে! তুমি শুধু তাকেই ভালোবাসো! তাকে পেয়ে আমাকে ভুলেই গেছো! মিষ্টি এনে লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছো!”

মিনু মুচকি হেসে ভোরের মুখে মিষ্টি তুলে দেয়। ভোর পুরোটি মুখে পুরে নেয়। তার ফুলো গাল ফুলে একাকার। মিনু তাঁর কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” ভোর বাবারে আমি অনেক ভালোবাসি! তাকে কি কইরে ভুইলে যাবো? এই বাবুরে নিয়ে হাঁটবার পারি না। বসবার পারি না। সারাক্ষণ ঘর বন্দি থাকি! তুমিও তো একটু দেখবার আসো না এই খালারে!”

ভোর কুটুর কুটুর করে চায়। সময় নিয়ে মুখের মিষ্টি চিবিয়ে চিবিয়ে গলাধঃকরণ করে। পাশে রাখা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খায়‌। মিনু তার আঁচল দিয়ে সযত্নে মুখ মুছে দেয়। ভোর পুলকিত হেসে বলে,

-” আব্বু বলেছিল তুমি অসুস্থ থাকো। তাই যেন তোমাকে বেশি করে ডিস্টার্ব না করি!”

-” তুমি আইলে আমার ভালো লাগে ভোর বাবা!

মিনুর কথায় ভোর মিষ্টি করে বলে,

-” তাহলে কিন্তু আমি বেশি বেশি আসবো! তোমার বাবুকে বলে দিও আমাকে দেখে হিংসে না করে?’

মিনু ভোরের গাল টিপে বলে সায় জানালো ! ভোর মিনুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। মিনু মুচকি হেসে তার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ভোর এটা ওটা বলে মুহুর্তেই মহল জমিয়ে নেয়। তার গল্পের মাঝে নিরানব্বই টি অভিযোগ দায়ের করেছে বাবার নামে। ‘বাবা কেন অল্প সময়ের জন্য মায়ের সাথে নানু বাড়ি যেতে দিলো না? তাকে বোকা বানিয়ে লুকিয়ে রাখলো? আবার একেবারে মায়ের কাছে রেখে আসার কথা কেন বলবে? ভোরের কষ্ট হয় এক কথা শুনলে! সে কি মায়ের সাথে একেবারে যেতে চেয়েছে নাকি। মা অনেক দূরে চলে যাবে তাই একটু যেতে চেয়েছিল। তারপর বলে কিনা কালই বিয়ে করিয়ে বউ আনবে! ভোরের কি লজ্জা করে না? আব্বুকেই বিয়ে করতে বলিও! হুম!’ আরো কতশত অভিযোগ তাঁর। মিনু তার কথা শুনে হাসে। ভোর গাল ফুলিয়ে বলে,

-” তুমি হাসছো খালা? তুমিও ভোরকে ভালোবাসো না!”

মিনু হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক মুখে বলে,

-” ভোর বাবা? তোমার মা’য়ের কথা আমি বলবো না। তোমার আম্মুর কথা বলি! আচ্ছা?”

ভোর পিটপিট করে চায়। মিনু বলতে শুরু করে,

-” তোমার আম্মু কিন্তু ভালো একজন মা! তোমারে কত্তো ভালোবাসে! আদর যত্ন করে। কখনো তার মুখে সামান্য বিরক্ত প্রকাশ হয় নাই। সবসময় তোমার সাথে হাসিখুশি কথা বলবে। খাইয়ে দিবে, তোমার সাথে খেলবে! তোমার পড়া পইড়ে দিবে। তোমার ছোট খাট সব ব্যাপারে তার বিশাল আগ্রহ কাজ করে। করে না?”

ভোর মাথা নাড়ল। মিনু্ তার গাল টিপে বলে,

-” তো তোমাকে সে ভালোবাসে, তোমার পাশে থাকে, তোমার যত্ন কইরবে! তোমারে বুকে আগলাইয়া রাইখবে! তোমার মায়ের অল্প একটু সময়ের আদরের জইন্যে তোমার আম্মুরে ভুইলে যাইবে? কাইল তোমারে ওই পঁচা কুকুরের হাত থাইকে বাচাইলো! সেও কত ব্যাথা পাইলো। আর তুমি কি করলা? রূপ বাবা তোমার আম্মুরে মা ডাকলে তোমার খারাপ লাগে রাইগে যাও তো তোমার আম্মুর কি তখন খারাপ লাগে নাই? হয়তো তোমারে বুঝতে দেয় নাই কিন্তু খারাপ তো তারও লাগছে ভোর বাবা।”

ভোর মুখে আঁধার নামে। অরুণ সরকারের মতো গম্ভীর গম্ভীর ভাব বিরাজ করে মুখশ্রী জুড়ে। সে কতক্ষণ চুপ করে ওভাবেই শুয়ে থাকে। তারপর আস্তে করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মিনু ডাকে,

-” ভোর বাবা রাগ কইরছো আমার কথায়? এই বাবা শোনো?”

ভোর শোনে না। থমথমে মুখে হাঁটতে থাকে এলোমেলো। ড্রয়িংরুমের দিকে গেলে আনিকা ডাকে,

-” এই ভোর আয় লুডু খেলি! আয় না?”

ভোর তাঁর কাছেও যায় না। ফ্লোরে খেলনা নিয়ে বসে থাকা রুপের কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। রূপ উ উ শব্দ করে ভোরকে তার খেলনা দেখায় একটা একটা করে। ভোর হঠাৎ করে তাঁর পিঠে একটা চড় লাগিয়ে চলে যায়। রূপ তাঁর যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উল্টায়। কেঁদে দিবে তখনি আসমানী বেগম এসে কোলে নেয়। রূপের আর কাঁদা হয় না।
ভোর বাড়ির ভিতর এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পায় পাতাকে। ডায়নিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে। তার সঙ্গী সুফিয়া। ভোর দ্রুত পা চালিয়ে সেখানে যায়। পাতার আঁচল টেনে ধরে। পাতা নিচের দিকে তাকিয়ে ভোরকে দেখে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে বলে,

-” কি হয়েছে ভোর সোনার?”

ভোর মাথা নাড়ে কিছু হয়নি। পাতা আবার জিজ্ঞেস করে,

-” তোমার আব্বুর হাতে বরফ ঘষে দিয়েছিলে?”

ভোর আবার মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলে না। পাতা তার গাল টেনে সব খাবার সাজিয়ে রাখে। ভোর পাতার আঁচল মুঠোয় পুরে পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে।

অরুণ ও তার বন্ধুরা নিচে নেমে আসে। জীবন ফয়সাল বিড়বিড় করে অরুণের গুষ্টির তুষ্টি বের করে। শালা! এক নম্বরের বজ্জাত! তার লাইফে মায়ের হাতেও এতো মার খায় নি যতোটা অরুণের হাতে খেয়েছে। শুভর মুখটার দেখার মতো! বেচারা ভদ্রলোকটাও বাদ যায় নি। সবার মধ্যে শুধু রাসেলের মুখে চাপা হাসি। তাঁরা সবাই এসে ডাইনিং টেবিল দখল করে। আরিয়ানও মেয়েকে নিয়ে বসে পড়লো। অরুণ, আসমা বেগম ও আসমানী বেগমকে ডাকে বসার জন্য। তাঁরা মানা করে বলে ‘তোমরা খেয়ে নাও আমরা পড়ে বসবো!’ আদুরি এসে ভাইয়ের পাশে বসে। ভোর এখনো পাতার আঁচলের আড়ালে লুকিয়ে আছে। আদুরি ডাকে সাঁড়া দেয় না! পাতা জিজ্ঞেস করে,

-” খাবে না? যাও তোমার বাবার সাথে বসো?”

ভোর মাথা নাড়িয়ে মানা করে। পাতা ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে বলে,

-” আমার সাথে খাবে?”

ভোর মাথা নাড়ল খাবে। শুভ উঠে এসে ভোরকে কোলে নিতে চায়। ভোর হাত পা ছুড়তে থাকে যাবে না। অগত্যা শুভ ছেড়ে দিয়ে বলে,

-” আজ সাইলেন্ট মুডে আমাদের ভোর! শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

ভোর আবার পাতার আঁচল ধরে লুকায়। কারো প্রশ্নের জবাব দেয় না। অরুণ ছেলের হাত ধরলে ভোর ঝটকায় সরিয়ে দিলো। অরুণ কিছু বলবে এর আগে পাতা বলে,

-” আপনারা শুরু করুন। ভোরকে আমি খাইয়ে দিবো। ও আমার হাতে খাবে!”

সবাই খাওয়া শুরু করে। সুফিয়া অরুণকে দেখে আগেই কেটে পড়েছে এই বলে,

-” ম্যাডাম আপনার ওনারে আপনেই সামলান। বেডায় খালি ধমকায়। আমি আগে পিছে নাই!”

পাতা অরুণ পাশে দাঁড়িয়ে সব কিছুর তদারকি করে। অরুণ রুটি ছিঁড়ে ভোরের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ভোর হা করে তবে মুখে খাবার না নিয়ে অরুণের হাতে কামড় বসিয়ে আবার লুকায়! অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। ছেলের রাগ তাহলে এখনো পড়ে নি। অরুণ খাওয়ায় মনোনিবেশ করে‌। ফয়সাল খায় কম পাতা ও অরুণের দিকে আড়চোখে চায়। প্রতিশোধ তো সে নিয়েই ছাড়বে! তাঁর পাশে বসা জীবনকে কনুই দিয়ে কিছু ইশারা করে‌। জীবন হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

-” পিচ্চি ভাবী? ডালের বাটিটা পাস করুণ তো?”

পাতা এগিয়ে দিবে এর আগে অরুণ এগিয়ে দেয় বাটি। জীবন হাসে। চোখের ইশারায় অরুণকে কিছু বোঝায়‌। বন্ধুদের ইশারা বুঝতে তার সেকেন্ড সময়ও লাগে না। সে চোখে চোখে শাসায়। ফয়সাল দাঁত কপাটি বের অরে হেসে বলে,

-” আচ্ছা ভাবী আমাদের অরুণের পারফরমেন্স কেমন? ঠিক ঠাক ভাবে..”

আর বলতে পারে না। অরুণ বিষম খায় সাথে সাথেই। এরকম কয়েকপিস বন্ধু থাকলে জীবনে আর কি লাগে? পাতা গ্লাসে পানি দেয়। অরুণ ঢক ঢক করে খেয়ে নেয় সবটুকু। জীবন মিছে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে,

-” ভাবী পিঠ ডলে দিন ঠিক হয়ে যাবে। ইশ্ বেচারা কি হাল হয়েছে চোখ মুখের!”

অরুণ এমন ভাবে তাকালো যেন জীবন হরিণ শাবক আর সে বন্দি খাঁচার বাঘ। পাতা সত্যি সত্যিই অরুণের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। অরুণের বন্ধুরা মিটমিট করে হাসে। অরুণ হতাশ হয়। তাঁর পাতাবাহারটা খুবই সরল সোজা। একদম জামাই পাগল!
ফয়সাল আবার পাতাকে জিজ্ঞেস করে

-” বললেন না ভাবী অরুণের পারফরম্যান্স কেমন? খেলতে পারে?”

পাতা বুঝতে পারে কথার মানে! লজ্জায় তার কান ভারী হয়ে আসে। পানির জগ হাতে নিয়ে সরে যায় ডায়নিং থেকে। অরুণ ভয়ঙ্কর রেগে যায়। এসব কেমন কথাবার্তা? তাও সবার সামনে? আদুরি, বাচ্চারা উপস্থিত আছে। সে শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফয়সালের দিকে। ফয়সাল যেন বুঝতে পারে বন্ধুর দৃষ্টির ভাষা। সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। সে ইশারায় স্যরি বোঝায়।
আরিয়ান এতক্ষণ চুপচাপ সবার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছিল আর মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। তবে আর চুপ থাকে না। অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভাই তোমার বন্ধুদের একটু চুপ থাকতে বলো! তাদের কি একটুও সোদবোধ নেই? বাচ্চারা আছে এখানে তোমার বুড়ো বন্ধুদের কি নজরে পড়ে না?”

ফয়সালও যেন খানিকটা লজ্জায় পড়ে। কনুই দিয়ে জীবনের পেটে গুঁতো মারল। যার অর্থ এই পরিস্থিতি সামলা? জীবন হাত বাড়িয়ে রুটি নেয় দু’টো! আরিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” শালার ঘরের সম্বন্ধি তুই চুপ থাক! নেই সোদবোধ তোর আছে তুই ফুট! আর বুড়ো বলে কি প্রমান করতে চাস টা কি? হুম?”

আরিয়ান মুচকি হাসে। ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে তাঁর সম্পর্ক একটু ভিন্ন টাইপের।

-” এটাই প্রমাণ করতে চাই যে তোমরা বুড়ো হয়ে যাচ্ছো জীবন ভাই! এখন তো একটু শুধরে যাও? আর ক’দিনই বা বাঁচবে!”

জীবন ক্ষেপে যায়,

-” তুই বুড়ো তোর শশুর বুড়ো! এখনো হাজার মেয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজে প্রেম নিবেদন করে। রাস্তায় বেরোলে মেয়েরা চোখ দিয়েই গিলে খায়! আর তুই বলছিস বুড়ো হয়ে যাচ্ছি?”

আরিয়ান মজা পায় বেশ। সে চেয়ারে গা এলিয়ে বলে,

-” প্রেম নিবেদনের কথা ভাবীকে জানাবো?”

জীবন থেমে যায়। আমতা আমতা করে বলে,

-” তোর ভাবীকে আমি ভয় পাই নাকি? সে আমার কথায় উঠবস করে।”

-” তাই না?”

জীবন অসহায় বনে যায়। বউ জানলে তো তার বনবাস কনফার্ম! ফয়সাল এবার মুখ খোলে,

-” আরু? তোর সাহস তো কম না? আমাদের বন্ধুকে ভয় দেখাস?”

আদুরি তার ভাই ও ভাইয়ের বন্ধুদের খুনসুটি এনজয় করছে। তার ভালো লাগে যখন সবাই মিলে এরকম টক ঝাল মিষ্টি টাইপ ঝগড়া করে। এবার সে হেসে সবার উদ্দেশ্যে ভাব নিয়ে বলল,

-” আল্লাহর গজব পড়বে তোমাদের উপর; ‌যা শুরু করে দিয়েছো তোমরা!”

হঠাৎ আদুরির কথায় সকলের নজরে আদুরি আসে। পিটপিট করে তাকিয়ে সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে। আদুরিও যোগ দেয় তাদের সাথে। সকলের খুনসুটির ঝগড়ায় ডায়নিং টেবিল যেন ডিবেটিং ক্লাব বনে যায়। তবে সবার মাঝে অরুণ চুপচাপ খেয়ে চলেছে। যেখানে সবার মুখেই হাসি লেপ্টে সেখানে তার গোমড়া মুখ। অরুণ খাওয়া শেষ করে বেসিনে যায় হাত ধুয়ে সোফায় বসে। রুবির কোল থেকে রূপকে নিয়ে আদর করে। রুবির সাথে অফিসের বিষয়ে টুকটাক কথা বলে। তার বন্ধুদের খাওয়া শেষ হলে বন্ধুদের এগিয়ে দিতে যায়। গেট অবধি গিয়ে ফয়সালকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” সব কিছুরই একটা লিমিট থাকে। তুই আমাকে নিয়ে আনলিমিটেড মজা উড়াবি ইটস ওকে বাট আমার পাতাবাহার! ইটস নট ওকে! সাবধান।”

ফয়সাল হেসে অরুণের পিঠ চাপড়ে বলে,

-” হয়েছে আর ফুটেজ খেতে হবে না। আমি বুঝতে পেরেছি সবার সামনে ওরকম বলা মোটেও উচিত হয় নি‌। স্লিপ ওফ টাঙ ইয়ার!”

অরুণ কিছু বলে না চুপচাপ থাকে। ওর বন্ধুরা গাড়িতে উঠে বসে। রাসেল গাড়ি এনেছে ‌আজ সেই সকলের সারথি! তাঁরা গাড়িতে উঠে বসে; গাড়ি স্টার্ট করে এমন সময় ফয়সাল গ্লাস খুলে সিরিয়াস মুখে বলে,

-” ভাই আমার মনে হচ্ছে ভাবী তোর পারফরমেন্সে খুশি না!”

জীবন তার পাশ থেকে মাথা বের করে গলা উঁচিয়ে বলে,

-” আই ওলসো এগরি উইথ হিম! দেখলি না তোর পাতাবাহার কেমন দুঃখি দুঃখি ফেস বানিয়ে চলে গেলো!”

অরুণ পায়ের স্লিপার খুলে ঢিল ছুড়ে গাড়িতে। সঠিক সময়ে গ্লাস লাগানোর দরুণ কারো লাগে না। তবে উচ্চ স্বরে হাসির আওয়াজ শোনা যায়। শুভ ফ্রন্ট সিট থেকে অল্প একটু গ্লাস নামিয়ে নিয়ে বলে,

-” অরুণ? চিন্তা করিস না। আমি কালই তোর জন্য কলিকাতা হারবাল অর্ডার করবো। আর নয় হতাশা আর নয় দুরাশা..”

আর শোনা যায় না‌। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। অরুণ ক্ষেপে যায়। পায়ে থাকা আরেকটা স্লিপার তুলে গাড়ির উদ্দেশ্যে ঢিল ছুড়ে। শালাদের একবার হাতের কাছে পাক! পুরো ওয়ানডে ম্যাচ দেখিয়ে দেবে!
_____

জোৎস্নার আলোয় আলোকিত ধরনী। হেমন্ত কালের স্বচ্ছতায় ঘেরা আকাশে শশীধর পূর্ন যৌবনে পা দিয়েছে। তার জোৎস্নার মধুর ম্লান আলো বেশ উপভোগ্য। হেমন্তের ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব! এরকম রোমাঞ্চকর মুহূর্তে জোৎস্না বিলাস কপোত কপোতীর রোম খাড়া করে দেয়ার জন্য মুখিয়ে। রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। এখনো ঘুম নেই ভোরের চোখে। ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে কম্ফোর্টের ভেতর ঢুকে গল্পে মেতেছে। সঙ্গী পাতা ও পাতাবাহার। পাতাবাহার সোফায় বসে আছে চুপটি করে। আর পাতা ভোর বিছানায় শুয়ে আছে। ভোর গল্প করছে পাতা পিটপিট করে তাকিয়ে শুনছে। কখনো ভোরকে উৎসাহ দেয়ার জন্য হু হা বলছে। অরুণ সরকারের এখনো রুমে আগমন ঘটে নি। পাতা কয়েকবার উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে। লোকটা স্টাডি রুমে হাবিজাবি কিসব করছে। মুখটা নিত্য সময়ের মতো গোমড়া মুখো! পাতা মনে মনে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে ‘নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য ঘারত্যাড়া লোক’! সে রেগে আছে লোকটার উপর অথচ লোকটার কোনো ভাবান্তর নেই? কোথায় তাড়াতাড়ি ঘরে এসে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে বউয়ের রাগ ভাঙাবি! একটু আহ্লাদ করে সোনা মোনা জানটুস ডাকবি‌! কান ধরে উঠবস করে স্যরি বলবি‌‌। তা’না লোকটা চশমা পরে স্টাডি রুমে স্টাডি করতে ব্যস্ত। শালার জামাই! পাতার কপালটাই ফুটা! পাতা ঠোঁট উল্টায়। কালই সে স্কুল থেকে ওবাড়ি চলে যাবে। সাথে ভোরকেও নিয়ে যাবে। তখন বুঝবে মজা! পাতা উদাসীন হয়ে ভোরের কথা শুনতে থাকে। কিছু সময় আগেও ভোর সাইলেন্ট মুডে ছিল! একদম বাবার মতো! যা বলবে শুধু মাথা নাড়বে। পাতা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? সে না বোধক মাথা নেড়ে বোঝায় কিছু না। শেষে পাতা ভাবে মায়ের সাথে যেতে পারে নি তাই মন খারাপ! ভাবতেই তার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। তবুও হাসি মুখে ভোরকে মজার মজার গল্প শোনায়! ফানি গল্প! ব্যস ভোর হেসে কুটিকুটি। সাথে চড়ুইয়ের বুলিও ফুটেছে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে ভোর পাতা দরজার দিকে তাকালো। বাবাকে দেখে ভোর কম্ফোর্ট মাথা অবধি ঢেকে নিলো। সাথে পাতাকেও ঢেকে দিলো!

অরুণ দরজা বন্ধ করে বুকে হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কতক্ষণ। দৃষ্টি বিছানায় ঢাকা দুই চড়ুইয়ের ঢাকা দেহখানে নিবদ্ধ।

-” পচে গেছি তো আমি! আমার সাথে কথা বললে ঘোর পাপ হবে তাই না? না বললে কথা ! আমার কি? অরুণ সরকার একাই থাকতে শিখেছে!”

বলে হনহন করে ওয়াশ রুমে চলে যায়। ভোর উঁকি দিয়ে বাবাকে না দেখতে পেয়ে বিজয়ী হাসে‌। পাতার কপাল কুঞ্চিত! লোকটার শেষের কথাটা কেমন শোনালো যেন! একটু পরে অরুণ বেরিয়ে আসে। শার্টের বোতাম একে একে খুলে ছুঁড়ে ফেলে। কোথায় পরে সেদিকে খেয়াল নেই। পাতাবাহার অবশ্য খেয়াল করে। সুস্থ থাকলে সে দৌড়ে যেতো নখ দিয়ে শার্ট টেনে আনতে। অরুণ বিছানায় ওঠে। পাতার পাশ থেকে কম্ফোর্ট টেনে ভিতরে ঢুকে গেলো। পাতার পাশ ঘেঁষে কাত হয়ে শোয়। কনুই বালিশে ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথা রেখে উঁচু হয়। পাতা খানিক সময় পিটপিট করে তাকালো তার দিকে। অরুণের চোখে চোখ পড়তেই সে ভোরের দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়বে অরুণ কাঁধ ধরে চিৎ করে শুইয়ে দেয়। এক পা তুলে দিয়ে আটকে নেয় পাতাকে। পাতা গোল গোল করে চায়। সাথে ভোরও। অরুণ তাদের দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাশভারী গলায় ধীমে সুরে বলে,

-” আমার বিপক্ষে দল ঘোষণা করা হয়েছে! ওকে আমি কালকেই পুত্রবধূকে নিয়ে আসবো। ভোর? বি প্রিপেয়ারড! বিয়ে কালকেই পড়িয়ে দেবো! ”

ভোর উঠে বসে। ফোঁস ফোঁস করে তাকায় বাবার দিকে। তার ফুলো গাল দুটো কাঁপছে নাকের পাটা ফুলে উঠেছে বারংবার। অরুণ কিছু বলার উদ্যোগ নেয় কিন্তু বলতে পারে না। ভোর কম্বল সরিয়ে অরুণের উন্মুক্ত বুকে উঁকি দেয়া কালো লোম টেনে ধরে। পাতা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ভোরের হাত ধরে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। ভোর ছাড়ে না। পাতা চেষ্টা অব্যাহত রেখে অরুণের দিকে তাকায়‌। আশ্চর্য! লোকটা কি ব্যাথা পাচ্ছে না? চোখে মুখে ব্যাথা পাওয়ার কোনো ছাপ ঠাহর করতে পারলো না‌। তবে পাতার ব্যাথা হয়‌। তার চুলে অল্প টান পড়লেই ব্যাথায় চিল্লিয়ে ওঠে অথচ লোকটা ব্যাথা পাচ্ছে নিশ্চিন্ত; কিন্তু প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে না। এ কেমন রোবট মানব? পাতা শান্ত গলায় ‘ভোর’ বলে ডাকে! ভোর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল কম্বল মুড়িয়ে। পাতা আড়চোখে নির্লিপ্ত অরুণের দিকে তাকিয়ে নিজেও এপাশ ফিরে ভোরকে এক হাতে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। অনুভব করে একটা বলিষ্ঠ হাত আলগোছে তাঁর কোমড় ছুঁয়ে দিচ্ছে। পাতা ঝট করে এদিকে ফিরে। সাথে সাথেই আক্রমণের স্বীকার হয়। অরুণ আবারো ঠোঁট দাবিয়ে চুমু দেয় রক্তিম গালে‌। পাতা নিজেকে ধাতস্থ করে ঝুঁকে আসা অরুণকে সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অরুণ হাত বাড়িয়ে ভোরের গলায় কাতুকুতু দেয়‌। ভোর ছটফটিয়ে উঠে এপাশ ফিরে। অরুণ নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে ভোরকে কাতুকুতু দেয় একনাগাড়ে। ভোর ছটফট করে আর খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। পাতা অরুণের হাত সরিয়ে দিতে চায় কিন্তু পারে না। পাতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে বাবা ছেলের কান্ড। অরুণ ছেলের কাতুকুতুর ডোজ বাড়িয়ে দিয়ে তাঁর অলক্ষ্যে পাতার গালে আবার চুমু দেয়। থুতনিতে গাল ঘষে। পাতা কেঁপে কেঁপে ওঠে সাথে বিরক্তও হয়। অরুণ থামে না তার কার্যক্রম চালিয়ে যায়‌। ভোর হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে ওঠে। পাতা বিরক্ত হয়ে অরুণের বলিষ্ঠ হাত ঠেলে বলে,

-” কি হচ্ছে টা কি ভোরের বাবা?”

অরুণ থামিয়ে দেয় কাতুকুতু দেয়া। ভোর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে তার হাসি থামে নি। অরুণ ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে দেয়। পাতার দিকে তাকিয়ে বিজয়ী হাসে। অবশেষে মহারানীর মুখ কথা ফুটলো।

-“কি হয়েছে ভোর? তোমার আম্মু এতো রেগে যাচ্ছে কেন?”

পাতা কটমট করে চায়। অরুণ ছেলের চোখে মুখে হাত রেখে পাতার অধরে অধর ছুঁয়ে দেয় আলতো ভাবে। পাতা অরুণের কাঁধ ঠেলে সরিয়ে দেয়। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

-” ভোর? মাঝখানে এসো! রাত অনেক হয়েছে ঘুমোও!”

অরুণ ভোরের চোখ মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেয়। ভোর নাক মুখ কুঁচকে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভোর আব্বুর পাশে ঘুমাবে না। আব্বুর সাথে কথাও বলবে না!”

অরুণ তৎক্ষণাৎ পাতাকে ডিঙিয়ে ভোরের গালে মুখে চুমু দেয় বেশ কয়েকটি। পাতার মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে যাবে ভাব! এই ক্ষ্যাপা ষাঁড় তাকে পিষ্ট করে চ্যাপ্টা বানিয়ে দিবে। অরুণ ছেলের কপালে ছোট ছোট দুটো চুমু দিয়ে সরে আসে।

-” ভোরের বাবাও ভোরের পাশে ঘুমাবে না।”

ভোর মিটমিট করে হাসে। অরুণ তাকাতেই চোখ বুজে ওপাশে ফিরে শুয়ে পড়ে।পাতা পড়ে বিপাকে। অসভ্য লোকটা পা দিয়ে তার পায়ে সুরসুরি দিচ্ছে। পাতার থামিয়ে রাখা হাসি ঠিকরে বেড়িয়ে আসতে চায়। অনেক কষ্টে হাসি লুকিয়ে অরুণের দিকে রাগি চোখে চায়। অরুণ পাতার টপসের ভিতরে হাত গলিয়ে দেয়। পাতা রেগে বলে,

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য বর্বর লোক!”

অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে উঠলো। ঝুঁকে পাতার কানে অধর নিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু বলে। পাতার কপোল জোড় লালিমায় ছেয়ে যায়। অধরকোণে হাসি প্রস্ফুটিত হয়।অরুণকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। অরুণ হাসতে হাসতেই সরে যায়।পাতা ভোরের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ে। সময় যায় টিক টিক টিক। ঘরের আলো নিভে ড্রিম লাইট জ্বলে ওঠে।পাতার চোখে ঘুম নামে না। এদিকে ভোর ঘুমে কাত! পাতার মনটা আনচান করে। লোকটাও কি ঘুমিয়েছে?সে ভোরের গায়ে হাত বুলিয়ে এপাশ ফিরে। ফিরেই যেন ভুল করে। লোকটা ঘুমায় নি। কাত হয়ে এদিকে ফিরেই চেয়ে আছে জ্বল জ্বল চোখে। ড্রিম লাইটের আলোয় নয়নে নয়নে মিলন হয়! পাতা সোজা হয়ে শুয়ে থাকে। মনের পড়ে গতকাল দুপুরে সবার সম্মুখে চড় খাওয়ার দৃশ্য! সাথে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার দৃশ্যটিও! পাতার চোখ ভিজে যায়। সেই মুহূর্তে পাতার মনের অবস্থাটা কেমন হয়েছিল পাতা নিজেও বলতে পারবে না। কেমন দম বদ্ধকর মুহূর্ত। মনে হচ্ছিল সে মরে যাবে। একটা সুখের সংসারের স্বপ্ন দেখছিল সেটা বোধহয় সম্ভব নয়। ভয় হয়েছিল লোকটা বোধহয় তাকে দূরে ঠেলে দিবে। পাতার কার্নিশ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। নাক ভরে যায় নিমিষে।পাতা নাক টানে। সে কেন লোকটার উপর রেগে থাকতে পারে না? তার কি সত্যিই আত্মসম্মানবোধ নেই? নেই বোধহয়! সে লোকটাকে ভালোবাসে ভয়ঙ্কর ভাবে। পাতা খুব কম লোকের কাছ থেকেই ভালোবাসা, আদর, যত্ন পেয়েছে। তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে অরুণ সরকার উপরে অবস্থান করছে। লোকটার মত কেউ কখনোই তার যত্ন করেনি। পাতার মনে পড়ে না বুঝ হওয়ার পর কেউ কখনো তাকে খাইয়ে দিয়েছিল কি না! কেউ যত্ন করে ভেজা চুল মুছে দেয় নি। কেউ এতটা ভালোবেসে কেউ কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায় নি। অথচ লোকটা দিনে একবার হলেও নিজের হাতে তুলে যত্ন সহকারে খাইয়ে দিবে। ছোট খাট সব বিষয়ে যত্ন নেবে ;তার সর্বোচ্চ খেয়াল করবে। ক্ষুধা পেটে ঘুম হয় না তাঁর। উশখুশ করে। লোকটা রাত বিরেতে রান্না করে খাওয়াবে।কিভাবে যেন বুঝতে পারে তার সব অসুবিধা! অথচ কাল সকলের সম্মুখে চর দিলো! পাতা খুব কষ্ট পেয়েছিল! কাল রাতেও ভেবেছিল কথা বলবে না লোকটার সাথে। অথচ রাত গড়িয়ে দিন হতেই পাতা গলে যায় আইসক্রিমের মতো। এখন লোকটার প্রতি রাগ আসে না সে কি করবে?

-” পাতাবাহার?”

অরুণের ডাকে ঘার ঘুরিয়ে চায় পাতা। চোখের পানি মুছে নিয়ে নাক টানে। অরুণ হাতরিয়ে টিস্যু বক্স খোঁজে। তার বিছানায় এটা আবশ্যকীয় একটা বস্তু। ছিঁচকাদুনে মানুষের বসবাস কি না? অরুণ টিস্যু পেপার দিয়ে পাতার গাল মুখ মুছে নাকটাও মুছে দেয়। অন্ধকারে টিস্যু ছুঁড়ে ফেলে বিড়বিড় করে ‘ছিঁচকাদুনে’ বলে। পাতা আড়চোখে চাইলে অরুণ মুচকি হেসে বলল,

-” তোমার বুকটায় একটু মাথা রাখি?”

পাতা যেন একটু ঝটকা খেলো। বাহ্ এ তো সাধু পুরুষ। একটু আগে জোড় জবরদস্তি চুমু খেলো এখন অনুমতি চেয়ে কি প্রমাণ করতে চাইছে? পাতা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ নীরবতাকে সম্মতির লক্ষণ ভেবে এগিয়ে যায়। পাতার ছোট বুকে মাথা রেখে পিঠ গলিয়ে হাত রেখে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে নেয়। পাতা কেঁপে উঠলো। অরুণ বুক ভরে শ্বাস টানে। কোনো কথা হয় না। দুজনেই চুপ থেকে একে অপরকে বোঝার খেলায় মেতে ওঠে। সময় গড়ায়। অরুণ আবার আবদার করে,

-” মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেবে পাতাবাহার? আব্বু বাদে কে কবে ভালোবেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল মনে নেই!”

আবেগি পাতার বুকটা ধ্বক করে ওঠে অরুণের কথা শুনে। সময় ব্যয় না করে হাত গলিয়ে দেয় চুলের ভাঁজে। যত্ন, ভালোবাসা ঢেলে বুলিয়ে দেয়! নিজে কষ্ঠের সাগরে হাবুডুবু খেলেও অন্যের তিল পরিমাণ দুঃখে তাঁর বুকটা কেঁপে ওঠে। সে আস্তে ধীরে টেনে দেয়। অরুণ আরাম পেল বোধকরি। পাতার বুকে মুখ গুঁজে অস্পষ্ট গোঙায়! ফিসফিসিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার তুমি অনেক ভালো একটা মেয়ে।”

পাতার হাত থেমে যায়। অরুণ তার বুকে নাক মুখ ঘষে। যার অর্থ হয়তোবা এই যে, হাত বুলিয়ে দাও! পাতা হাত চালিয়ে থমথমে গলায় বলে,

-” ভালো? হয়তো! তাই সবাই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে; পরে ছুঁড়ে ফেলে। প্রয়োজনে পাতা; প্রয়োজন ফুরোলেই সে আগাছা!”

অরুণ মাথা তুলে পাতার মুখোমুখি হয়। গালে অধর ছুঁয়ে রেখে বলে,

-” সবার কথা বলতে পারবো না। আমার কথা বলি? আমি আগেই বলেছিলাম আমি লোকটা খুব খারাপ। লোকের সাথে মিশতে পারি না।সৌজন্য মূলক কথা বলতে পারি না। সামাজিকতা জানি না। শেখাই নি কেউ! থাক সেসব কথা! কাল হুঁশ ছিল না আমার। ভোরের ওমন অবস্থা দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। বুকের ভিতর কেউ ছুড়ি দিয়ে খোঁচাচ্ছিলো! আমি কাজটা মোটেও ঠিক করি নি। স্যরি বললে মোটেও সেই ঘায়ে মলমের প্রলেপ পড়বে না। তবুও আ’ম স্যরি পাতাবাহার! আই প্রমিজড ইয়ু আর কখনো হবে না। আর ব্যবহার করেছি তোমায়? নিজ স্বার্থে? ভালোবাসি নি?”

পাতা নিরুত্তর। কি বলবে সে? অরুণ পর পর চুমু দেয়। এই গালেই তো মেরেছিল বোধহয়! নাহ্ ওই গালে! অরুণ অপর গালেও ছোট ছোট চুমু দেয়।

-” কষ্ট দিয়েছি তাই না? শতগুন আদর ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিবো!”

পাতার অধরকোণে এবার হাসি ফুটে ওঠে। রাগ ধরে রাখতে পারে না। কি হবে রেগে? ঘুরে ফিরে সে যে অরুণ সরকারের দ্বারপ্রান্তে! অরুণ অঢেল ভালোবাসা ঢেলে পাতার হৃষ্টপুষ্ট অধরে অধর বসিয়ে চুমু খায়। পাতার চোখ বন্ধ হয়ে যায়। অরুণ বেশি সময় নেয় না। সরে এসে পাতার বুকে মাথা রেখে বলে,

-” মানিয়ে নিতে হবে না তোমার। আমিই মানিয়ে নিবো। কখনো আমার উপর খুব রেগে গেলে অভিমান করো! চুপ থেকো! চিল্লিও! শুধু কখনো ছেড়ে যেও না। আর ভোরের সকালের আচরণে কষ্ট পেও না। ও অবুঝ! বুঝলে..”

-” ওটা আমার আর আমার ছেলের ব্যাপার! আমরা বুঝে নিবো। আপনার বোচা নাক ঢুকাতে হবে না!”

অরুণকে বলতে না দিয়ে পাতা বলে ওঠে। অরুণ হাসে না এবার। আবার মাথা তুলে মুখোমুখি হয়। পাতার নাকে দাঁত বসিয়ে গম্ভীর মুখে বলে,

-” আমি বোচা?”

পাতা কথা বলে না। এই না ঠিক ছিলো? হঠাৎ মুড সুয়িং? গিরগিটি কোথাকার! অরুণ পাতার কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” এখনো রাগ আছে? অভিমান? হুম? পাতাবাহার? আমি জানি তুমি জামাই পাগলী! আর তোমার আদরের জামাইকে খুব ভালোবাসো!”

পাতা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বরফ শীতল গলায় বলে,

-” জামাই তো আর ভালোবাসে না!”

অরুণ তার গালে দাঁত বসিয়ে দিল। পাতা নাকের পাটা ফুলে ওঠে। অরুণ পাতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে খুবই ক্ষীণ আওয়াজে গম্ভীর গলায় বলে,

-” ভোরের আম্মু? ভোরের বাবা আপনাকে একটু আকটু ভালোবাসে!”

বলেই পাতার উপর থেকে সরে আসে। পাতা সন্দেহ নজরে তাকায়। কুঞ্চিত কপালে বলে,

-” সত্যিই? নাকি মিছে মিছে!”

অরুণ বালিশে মাথা রেখে বলে,

-” মিছে মিছে!”

পাতা হেসে অরুণের গলা জড়িয়ে ধরে!

-” একটু আকটু কতটুকু?”

-” এক বুক!”

যথেষ্ট পাতার জন্য। সে অরুণের বুকে মুখ গুঁজে শ্বাস টেনে নেয়। তার পরিচিত প্রিয় নেশালো ঘ্রাণ! অরুণ বাহুতে বেঁধে নেয় তার পাতাবাহারকে! পাতা অরুণের পিঠে হাত গলিয়ে গায়ে পা তুলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বুকে নাক মুখ ঘষে ছোট্ট করে চুমু দেয় যেন বুঝতে না পারে। অরুণ বুঝতে পারে। পাতাকে বুকের সাথে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে। চুলের রেবন খুলে দিয়ে চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দেয়।

চলবে…..

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৬ (প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

সময়টা বিকেল বেলা। হেমন্তের রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সাথে গা ঠান্ডা করা শীতল পবনের দোলা‌। না গরম না শীত এক মনোরম পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার বাড়ির আঙিনায় হরেক রকম অতিথি পাখির আগমন যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। তাদের কলতানে পরিবেশ যেন মুখরিত হয়ে আছে।এমন পরিবেশে পাতা কোমড়ে আঁচল গুঁজে মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ পড়ে ক্রিজে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্রিকেট খেলার খ টাও জানে না অথচ ভোরের জেদে সে এখন ব্যাটিং করতে এসেছে। আর ছোট ভোর জার্সি,প্যান্ট ও ক্যাপ পড়ে বল হাতে সামনে বল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আনিকা ফিল্ডিং করছে।আভারি স্ট্যাম্পের পেছনে দাঁড়িয়ে। অদূরে আসমা বেগম ও আরিয়ান রূপকে নিয়ে বসে আছে। ভোর পাতার দিকে তাকায়। মুচকি হেসে থাম্বস আপ দেখায়! পাতাও প্রতিত্তরে মুচকি হেসে প্রস্তুত হয়। ভোর বল ঘুরিয়ে বল করে। পাতা কি করবে ভেবে পায় না। চোখ বন্ধ করে ব্যাট চালালো। বল ব্যাটে স্পর্শ না করে সোজা স্টাম্পে আক্রমণ করে। অন্যসময় হলে ভোর বোল্ড করার খুশিতে নেচে দিতো কিন্তু এবার গম্ভীর মুখে পাতার কাছে যায়।

-” আম্মু এভাবে না! ব্যাট দাও আমি দেখিয়ে দিচ্ছি!”

পাতা ব্যাট দেয়। ভোর খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয়‌। পাতা হা করে শোনে। কে বলবে এই ছেলে পিচ্চি! এতো ওর বাপেরও বাপ! ভোর ভালো ভাবে বুঝিয়ে আবার বল করে। এবার একটু ধীর গতিতে করে। পাতা ব্যাট দ্বারা বলে আঘাত করতে সক্ষম হয়। একেবারে আরিয়ানের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে। ছোট রূপ বাবার কোল থেকে নেমে বল হাতে তুলে খুশিতে আ’মা আ’মা বলে উল্লাস প্রকাশ করে।দূর থেকে ভোর শুনতে পায় না তবে ঠাহর করতে পারে রূপ কি বলছে। সে গাল ফুলিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বল আনতে যায় না। আনিকাকে হুকুম তামিল করলো,

-” আনি যা বল নিয়ে আয়? ফাস্ট ফাস্ট!”

আনি যাবে তার আগে আরিয়ান বল নিয়ে আসে। রূপ তার দাদির কোলে বসে আ আ বলে চেঁচাতে থাকে। আরিয়ান এসে ভোরের মাথার ক্যাপটা খুলে নিজের মাথায় লাগিয়ে বলে,

-” এই আম পাতা জোড়া জোড়া?”

পাতা চোখ বড়বড় করে চায়। এই লোক তাকে যদি এক ফোঁটা সম্মান দিতো! সবসময় তাঁর সাথে ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে থাকে। আরে শালার দেবর! বয়সে ছোট হতে পারে কিন্তু সম্পর্কে তো বড়। সেই হিসেবে একটু সম্মান দিলে কি তাঁর ইগো পুকুরে ডুবে যাবে? সে ব্যাট উঁচিয়ে শাসনের সুরে বলে,

-” গিভ মি সাম রেসপেক্ট! আমি আপনার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। আপনার বড় ভাবী লাগি!”

আরিয়ান পাতার আপাদমস্তক দেখে হেসে দেয়। ভোর কোমড়ে হাত রেখে বাবার মতো রাশভারী গলায় বলে,

-” চাচ্চু? আমার আম্মুর নাম পাতা! ওরকম বলে একদম ডাকবে না বলেদিলাম!”

আরিয়ান তাঁর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বল শূন্যে ছুঁড়ে ক্যাচ করে।

-” টি টোয়েন্টি ম্যাচ হয়ে যাক? তোমরা সবাই এক টিম আমি একা! যদি তোমরা জিততে পারো পার্কে নিয়ে যাবো ঘুরতে সাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া!”

ভোর কপালে ভাঁজ ফেলে কতক্ষণ ভাবে। চাচ্চু একা! আর তাঁরা কত গুলো! সে ,আনি, আম্মু ও ভারি কাক্কু! চারজন। চাচ্চুকে হারানো একদম ইজি হবে।

-” আগে বলো তুমি জিতলে আমাদের কি করতে হবে?”

আরিয়ান ভোরের মাথায় টোকা দিয়ে বলে,

-” কিছু না। তখন আমি একাই ঘুরতে যাবো! ডিল ফাইনাল?”

আরিয়ানের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত মেলায় ভোর! পাতা ব্যাট রেখে বলে,

-” তাহলে তোমরা খেলো! আমি যাই!”

ভোর চোখ বড়বড় করে পাতার হাত টেনে ধরে বলে,

-” না যাবে না। তুমিও আমাদের দলে খেলবে! নইলে কিন্তু ভোর রাগ করবে!”

-” আমি খেলতে পারি না রে বাবা!”

-” আমি আছি না?”

পাতা মুচকি হাসলো। কি মিষ্টি করে বলল ‘আমি আছি না?’ এ ছেলে পুরোই অরুণ সরকারের কার্বন কপি! অরুণ সরকার নাক উঁচু ম্যানারলেস গাম্ভীর্যে ভরপুর লোক! আর ভোর মিষ্টি চঞ্চলতায় ভরপুর এক আদুরে বাচ্চা। তবে মাঝে মাঝে ছোট ভোর বাবার মতো গম্ভীর আচরণ করে।

-” তোমরা খেলো! আমি তোমাদের চিয়ার্স করবো!”

বলতে দেড়ি ভোরের ফুলো গাল ফুলতে দেড়ি হয় নি। আরিয়ান ব্যাট তুলে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-‘ এই তেজপাতা? তেজ ফুরিয়ে গেলো নাকি? ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছো?”

পাতা দাঁতে দাঁত পিষে। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-” বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?”

আরিয়ান এক ভ্রু উঁচিয়ে চায়। পাতা কটমট করে বলে,

-” ওকে ফাইন ভোর খেলবো আমি!”

ভোর ইয়ে বলে পাতাকে জড়িয়ে ধরে। আরিয়ান সব রুলস বলে দেয়। টস জিতে ব্যাট করতে নামে ভোরের দল! প্রথমে ভোর ও আভারি নামে। আভারি প্রথম তিন ওভার খেলেই আউট! ঝুলিতে মাত্র পনেরো রান। এরপর আনিকা নামে। ব্যাট হাতে বাবাকে বলে,

-” আব্বু? আস্তে বল করবে কিন্তু? আর মোটেও ক্যাচ করবে না! তুমি না আমার সোনা আব্বু?”

আরিয়ান মেয়ের কথা শুনে গমগমে গলায় বলে,

-” এখন আমি কারো আব্বু নই! আমি তোমাদের বিরোধী দল! তাই পাম দেয়া‌ বন্ধ করো মামুনি!”

আনিকা ভেংচি কাটলো। আরিয়ান হেসে আস্তে বল করে। আনিকা শূন্যে বল মারে। বল গিয়ে বাউন্ডারির বাইরে! ছক্কা বলে ভোর ব্যাট উপরে তুলে ইয়ে ইয়ে সুরে নাচতে থাকে। পাতা তার নাচ দেখে হাসতে হাসতে শেষ। আভারি বল এনে দিলে আরিয়ান আবার বল করে এবার একটু গতিতে। আনিকা ব্যাট দিয়ে জোড়ে আঘাত করে বল উঁচুতে উঠে যায়। আরিয়ান দাঁত কেলিয়ে হাত পাতে ক্যাচ করার জন্য। আনিকা কাঁদো কাঁদো চোখে ভোরের দিকে চায়। ভোর জিভে কামড় বসিয়ে আরিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বল নিচে পড়ে। ক্যাচ মিস! আনিকা নাচতে থাকে আর চিল্লিয়ে বলে,

-” থ্যাংক ইয়ু ভোর!”

আরিয়ান ছোট ছোট করে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ইটস চিটিং!”

-” চাচ্চু চিটিং কিভাবে করে? আমি তো তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম। বলটা তোমার মাথার উপর পড়লে ইয়া বড় আলু গজাতো!”

কিউট কিউট ফেস বানিয়ে বলে ভোর। পাতা বাহবা দেয়! এই না হলে ভোর সরকার! আরিয়ান তাঁর গাল টেনে আবার বল করে। বেশ রান করে তাঁরা।মোট চল্লিশ! ভোর পঁচিশ। আনিকা দশ! আভারি পাঁচ করেছিল! এরমধ্যে আনিকা বোল্ড হয়ে যায়। সে ব্যাট ফিক্কে দিয়ে বলে,

-” আব্বু তুমি একটুও ভালো না। তোমার সাথে আড়ি!”

আরিয়ান হাসে। আনিকা রেগে মেগে আগুন হয়ে চলে যায়! পাতা বুকে ফুঁ দিয়ে ভালোভাবে কোমড়ে আঁচল গুঁজে ক্যাপ মাথায় ক্রিজে যায়। ব্যাট তুলে দোয়া দরুদ পাঠ করে। ভোর এগিয়ে এসে তাকে বাহবা দেয়। কিভাবে কি করতে হবে বলে বিপরীত ব্যাট হাতে দাঁড়ায়। আরিয়ান শয়তানী হাসে। পাতা ভেংচি কাটলো। বল আসার সাথে সাথে ভোরের সব থিওরি ভুলে চোখ বুজে আন্দাজে ব্যাট করে। বল দূরে যায় না। ভোর চিল্লিয়ে দৌড়াতে বলে! দৌড়ে একরান নেয় দুজনে। এবার ভোর ব্যাট করে। একটা ছক্কা হাঁকিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ী হাসি দেয়। পাতা সিটি বাজায়। ভোর মুচকি হাসলো। আরিয়ান আবার বল করে ভোর এবার সিঙ্গেল নিয়ে এপাশে আশে। এবার পাতার পালা সে আবার দোয়া দরুদ পাঠ করতে থাকে। ইয়া আল্লাহ বাচ্চাটার সামনে মানসম্মান রেখো! ঝগরুটে পেঁচা মুখো দেবরের মুখে ঝামা ঘষিয়ে দিও! বল এলে পাতা আবার ভোরের শেখানো থিওরি ভুলে চোখ বুজে ব্যাট তোলে। কথায় আছে না ‘ঢিলে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’! এখানে খাপে খাপ মিলে যায়। বল একেবারে বাউন্ডারির বাইরে। ভোর ছক্কা বলে উল্লাস করে। পাতা মুচকি হেসে আরিয়ানের দিকে চায়। আভারি বল কুড়িয়ে আনে। আরিয়ান আবার বল ছুঁড়ে। তবে এবার আর কেরামতি হয় না‌ স্ট্যাম উড়িয়ে বোল্ড হয় পাতা! ব্যস খেলা শেষ! পাতা গোমড়া মুখ বানিয়ে ভোরের দিকে চায়। ভোর হেসে বলে,

-” ইটস ওকে আম্মু! অনেক ভালো খেলেছো তুমি!”

পাতা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। কোমড়ে গোঁজা আঁচল ঘামে ভেজা মুখটা মুছিয়ে দেয়। ইশ্ ঘেমে নেয়ে একাকার বাচ্চাটা। সবাই পাঁচ মিনিট ব্রেক নিয়ে আবার ক্রিজে নামে। আরিয়ান ব্যাট করে; ভোর বল হাতে তাঁর জাদু দেখায়। ছেলেটা ছোট হলে কি হবে? কি সুন্দর বল করছে!! একেবারে প্রসংসনীয়। আরিয়ান তো তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভাইয়ের সাথে কথা বলে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবে! এ ছেলে বড় হয়ে ভালো একজন বলার হতে পারে! মুস্তাফিজ, তাসকিনের মতো। আরিয়ান চার ছয় হেঁকে সাত ওভারেই পঁয়তাল্লিশ বানিয়ে ফেলেছে। দুই বার শূন্যে উঠেছিল। ক্যাচ করা যেতো কিন্তু পাতার হাত থেকে ছুটে যায়। পঞ্চান্নতে টার্গেট! আর মাত্র দশ রান করতে হবে আরিয়ানকে। আরিয়ান এটা ওটা বলে ভোর ও আনিকাকে লেগপুল করছে। আনিকা বাবার সাথে গলা মিলিয়ে ঝগড়া করছে। পাতাও দুই একটার জবাব দিচ্ছে। তবে ভোর চুপচাপ বল করায় মনোযোগী। সে হার কিছুতেই মানবে না। শেষ অবধি লড়াই করবে। ভোর গম্ভীর মুখে হাত ঘুরিয়ে বল করে। আরিয়ান বলে আঘাত করে; বল এবার উঁচুতে উঠে। পাতা চোখ বড় বড় তাকিয়ে থাকে! তার দিকে প্রবল বেগে ছুটে আসছে ঘূর্ণায়মান ছোট বল! পাতা ফট করে কোমড়ে গোঁজা বাড়তি লম্বা আঁচল খুলে পেতে ধরে। বলটা খপ করে তার পেতে রাখা আঁচলে পড়ে। উল্লাসে পাতা মাতোয়ারা। হেসে বলটা হাতে নিয়ে বলে,

-” আরিয়ান ভাই? আউট! আমরা জিতে গেছি!”

আরিয়ান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এদিকে ভোর আনিকা ছুটে এসে পাতাকে ধরে। ইয়ে ইয়ে বলে চিল্লিয়ে বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে। আসমা বেগম রূপকে নিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে। আরিয়ান চিল্লিয়ে বলে,

-” এটা চিটিং! আউট যাই নি আমি!”

ভোর হেসে বলে,

-” চাচ্চু? তুমি তো হেরে গেছো! এখন বাহানা দিয়ে লাভ নেই!”

-” চিটিংবাজ! তোমাদের দলে চিটারে ভরপুর!”

পাতা হেসে বলে,

-” হেরে গেছেন আরিয়ান ভাই! এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না!”
_____

ফোন হাতে দাড়িয়ে আছে অরুণ সরকার। মুখের আদল অতিব গম্ভীর। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। ফর্সা হাতের নীলচে রগ ফুলে স্পষ্টত হয়ে আছে। ফোনের অপাশের ব্যক্তির কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ে অরুণ! পাশের টবে লাথি দেয় সজোরে। হিসহিসিয়ে দাঁত কপাটি পিষ্ট করে রাশভারী গলায় বলে,

-” ঘটনার সাতদিন পেরিয়ে গেছে। ওই
শু*য়োরের বাচ্চারা এখনো মুক্ত বাতাসে আর তুই আমাকে শান্ত হতে বলছিস? **** জা*নোয়ার গুলো কোন **** ঘাপটি মেরে আছে তোর টিম এখনো বের করতে পারলো না! এতোটা নিকম্মা টিম আদৌ হয়!”

রাসেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-” ভাই ওরা যথেষ্ট চেষ্টা করছে। ওই আকাশকে আমরা যতটা হালকা ভাবছি সে ততটা নয়। শালা ****! তবে কতদিন লুকিয়ে থাকবে? তুই টেনশন করিস না। বাড়িতে সিকিউরিটি রেখে দেয়া হয়েছে। আর ভাবী আর ভোরের জন্যও স্পেশাল গার্ড রাখা হয়েছে। তোদের ওই দাড়োয়ানকে কি বের করে দিয়েছিস?”

-” হুম। কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিয়েছি। ভাই যেখানে আমার ছেলের কথা ওঠে আমি খুবই নির্দয়! আর তুই একটু ভালোভাবে খোঁজখবর নে! আমিও আমার লোক লাগিয়ে দিচ্ছি! জানোয়ারদের পিঠের চামড়া তুলে লবণ না দেয়া পর্যন্ত আমি অরুণ সরকার শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না। রাখছি!”

বলেই ফোন কেটে দেয়। ফোনটা সজোরে আছাড় মারতে নিয়েও মারে না। সুজনকে কল করে ভিতরে আসতে বলে। মিনিটের ব্যবধানে সুজনের আগমন ঘটে। অরুণ লম্বা শ্বাস টেনে সুজনকে বলে,

-“আমার লোক লাগিয়ে দাও! ওই শুয়া পোকার বংশধর, আবাল সবকটার পুরো হিস্ট্রি জিওগ্রাফি চাই!”

সুজন সায় জানিয়ে বলে,

-” ওকে বস!”

চলে যাবে হঠাৎ সে থেমে বলে,

-” স্যার আজকে একটু পর মিটিং আছে। এই অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে! খসরু নোমানের সাথে!”

অরুণ তার কেবিনে বসে কালো ফ্রেমের চশমা লাগায়। ল্যাপটপ ওপেন করে বলে,

-” আই নো! তুমি সঙ্গে যাচ্ছো। সব কালেকশন গুছিয়ে নাও। ফাস্ট!”

সুজন মাথা নাড়ল। তবে রুম থেকে বেড়োয় না। অরুণ ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বলে,

-” কিছু বলবে?”

সুজন খানিক জড়তার সাথে বলে,

-” রুবি ম্যাম কিছু ডিজাইন করেছে। ইউনিক এন্ড গর্জিয়াস। সো তিনি চাচ্ছেন আজকের মিটিং এ এই ডিজাইন শো করাবেন।”

অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে চশমা খুলে ভাবুক সুরে বলে,

-” উম! আমি রুবির সাথে কথা বলে নেব! মি. নোমান সুবিধার লোক নয়।”

‘হুম’ বলে সুজন বেড়িয়ে যায়। অরুণ ল্যাপটপে কিছু ই-মেইল সেন্ড করে উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বেড়িয়ে রুবির কেবিনে গিয়ে নক করে। অনুমতি পেয়ে অরুণ ভিতরে প্রবেশ করে। রুবি তাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,

-” আমি মাত্রই আপনার কাছে যাচ্ছিলাম ভাইয়া!আজকের মিটিংএ আমিও যেতে চাইছি।এই ডিজাইন গুলো একবার দেখুন? আশাকরি মি. নোমানের পছন্দ হবে!”

অরুণ ডিজাইন গুলো হাতে নেয়। বেশ গর্জিয়াস লুক। অরুণ সবগুলো দেখে বলে,

-” ইম্প্রেসিভ! বাট তুমি মিটিং এ যাচ্ছো না। ডিজাইন গুলো আমিই নিয়ে যাচ্ছি। ওগুলোর সাথে এগুলো এড করে দেবো।”

রুবির হাস্যোজ্জ্বল মুখে আঁধার নামতে শুরু করে। সে জিজ্ঞেস করে,

-” আমি গেলে কোনো প্রবলেম ভাইয়া?”

-” কিছুটা! নেক্সট ক্লায়েন্টের মিটিংএ যেও!”

রুবি ভদ্র সুলভ হাসে। তবে সে কিছুটা নারাজ হয়। সে খুব এক্সাইটেড ছিলো। নিজ উদ্যোগে কিছু ডিজাইনও করেছে। অরুণ ভাইয়া তাকে মানা করবে এটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো!

অরুণ ডিজাইন গুলো নিয়ে বেড়িয়ে আসে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ল্যাপটপ সমেত সুজনকে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে মি নোমানকে কল লাগায়। তাঁরা জানায় ওন দা ওয়ে। মিনিট খানেক পর তাঁরা আসে। অরুণ খাবার অর্ডার করে কালো ফ্রেমের চশমা পড়ে তাদের সব কালেকশন দেখায়! ডিজাইনে বর্ননা দিয়ে তারা কিছু ডিজাইন সিলেক্ট করে সাথে সব ডিজাইন ইমেইলে পাঠাতে বলে। খাবার সেরে সবাই আরো কিছু প্রয়োজনীয় কথা বার্তা বলে। কাজের আলাপন শেষ হলে ক্লায়েন্ট বিদায় নেয়। অরুণ চশমা খুলে টেবিলে রাখে। সুজনকে বলে ঠান্ডা আইসক্রিমের অর্ডার করতে বলে। আইসক্রিম খেয়ে মাথা ঠান্ডা করা যাক! সুজন আইসক্রিম অর্ডার করতে উঠে যায়। অরুণ টেবিলে মাথা রেখে ঝুঁকে আসে। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। মনে হচ্ছে ব্যাথায় রগ টগ ছিঁড়ে যাচ্ছে ‌।

-” অরুণ সরকার?”

মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে অরুণ বিরক্ত হয় বেশ! মাথা তুলে সম্মুখে চায়। মেয়েটি মুচকি হেসে সামনে ফাঁকা জায়গায় বসে।পার্স টা টেবিলে রেখে বলে,

-” চিনতে পারলেন না? আমি শ্রাবনী আহসান!”

অরুণ স্বাভাবিক ভাবে বলে,

-” জি চিনতে পেরেছি।”

মেয়েটি হেসে উঠলো।

-” আপনার উপর কিন্তু আমি অনেক রেগে আছি! কন্টাক্ট করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারি নি! আব্বু দেয় নি আপনার নম্বর!”

অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটি আবার হেসে বলে,

-” আপনাদের তরফ থেকে যখন প্রস্তাব পাঠানো হয় আমি মোটেও রাজি ছিলাম না। আটত্রিশ বছরের বুড়ো সাথে ছেলে! কিন্তু আপনাকে দেখার পর আমার ধারনা পাল্টে যায়। আমি স্ট্রেট কথা বলতে পছন্দ করি। আপনাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু আব্বু বলল আপনারা মানা করে দিয়েছেন। আমি অনেক রেগে গিয়েছিলাম। আব্বুর কাছ থেকে আপনার কন্টাক্ট নম্বর চেয়েছি বেশকয়েকবার সে দেয় নি। আপনার সাথে যোগাযোগও হয় নি। আপনি কি সেদিন আমার কথায় কিছু মনে করেছিলেন?”

অরুণ স্বভাব সুলভ গম্ভীর। তার মোটেও ভালো লাগছে না এই বকবক। তাই সে জবাব দিলো না। শ্রাবনী অরুণের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে।লোকটা আগের থেকে হ্যান্ডসাম হয়েছে। বলিষ্ঠ আকর্ষণীয় বডি! কালো স্যুড বুটে বেশ লাগছে। গাম্ভীর্যে ভরপুর ব্যক্তিত্বে ভরাট এক সুপুরুষ! সে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করেই দেখেছিল। কিন্তু তাঁর সাথে আরো কিছু লোক থাকায় অপেক্ষা করছিল। যেই তাঁরা চলে যায় সুযোগ হাতছাড়া করে নি। তবে লোকটাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে ইতস্তত বোধ করে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,

-” আপনার বাচ্চাটা কেমন আছে?”

-” আলহামদুলিল্লাহ!”

ছোট জবাব অরুণের। শ্রাবনী কথা বলার বাহানা খুঁজেছে কিন্তু লোকটা তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এই লোক এমন কেন? ভদ্রতার খাতিরেও তো টুকটাক কথা বলা যায়। হঠাৎ সে খেয়াল করে তার সামনে অর্থাৎ অরুণ সরকারের পেছনের দিকে এক টেবিল পরে বসা এক মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চাহনিতে কিছু একটা আছে। কেমন করে তাকিয়ে আছে যেন তাকে ভস্ম করে দেবে। সে যে তাকিয়ে আছে মেয়েটা তবুও নজর সরায় নি। কেমন কটমট করে তাকিয়ে আছে। শ্রাবনী ভালো করে খেয়াল করে কম বয়সী মেয়ে। তাঁর সাথে তিনটা বাচ্চা ও একটা লোক বসে। লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সে। তবে আন্দাজ করে মেয়েটার হাসবেন্ড হবে। কিন্তু কথা হলো ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে মেয়েটার দিকে দৃষ্টি রেখে অরুণের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” আপনার পেছনের এক টেবিল পড়ে একটা মেয়ে বসে আছে ‌। ছোট মেয়ে বিশ বাইশ বছর হবে! সাথে তিনটা বাচ্চা আর হাসবেন্ড। কিন্তু মেয়েটা আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে যেন! মনে হচ্ছে আমি তার হাসবেন্ডের সাথে ডেটে এসে ধরা পড়েছি!”

বলেই আবার হাসে। অরুণের বিরক্তের সীমা আকাশ ছোঁয়। তবুও কৌতুহল মেটাতে পেছনে তাকায়। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয় অরুণের! সে সামনে ফিরে স্বাভাবিক ভাবেই। তখনই সুজনের আগমন ঘটে। হাতে তাঁর আইসক্রিমের বাটি! সুজন শ্রাবনীকে দেখে কৌতূহলী মনে অরুণের দিকে চায়। অরুণ তার হাত থেকে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে বলে,

-” তুমি এখন যেতে পারো! আর হ্যাঁ আমি আর অফিসে যাচ্ছি না। রুবিকে বলবে এখানে আসতে! এখুনি!”

-” ওকে বস!”

বলেই সুজন সুরসুর করে চলে যায়।শ্রাবনী খুশি হয় ঢের। সে ভাবে তার সাথে আলাপ করার জন্য অফিসে যাবে না। সে মুচকি হেসে বলে,

-” কেমন চলছে লাইফ? বিয়ে টিয়ে করেছেন নাকি?”

-” কাম?”

বলেই অরুণ উঠে দাঁড়ায়। শ্রাবনী আগা মাথা কিছুই বুঝল না তবে সেও অরুণের পিছু গেলো! অরুণ সরকার সেই টেবিলের সামনে যায়।একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাচ্চা ছেলে ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। আ আ বুলি আওড়াতে থাকে। টেবিলে সবাই তার দিকে তাকায়‌। ভোর মাথা তুলে বাবাকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে। অরুণ আইসক্রিমে বাটি টেবিলে রেখে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। আরিয়ানের পাশে বসে ছেলের আদুরে মুখটায় চুমুতে ভরিয়ে দেয়। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে গালে সশব্দে চুমু দিয়ে আগ্রহ সমেত বলে,

-” ও আব্বু জানো কি হয়েছে?”

অরুণ মাথা নাড়ে সে জানে না। ভোর মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

-” আজ আমরা টি‌ টোয়েন্টি খেলেছি! আমি আম্মু, আনি, ভারি কাক্কু এক টিম! আর চাচ্চু একাই এক টিমে। আমরা সবাই মিলে চাচ্চুকে হারিয়ে দিয়েছি। আমরা ম্যাচটা জিতে গেছি!”

অরুণ ছেলের অধরকোণে চুমু দিয়ে বলে,

-” সত্যিই? কনগ্রেটস আব্বু!”

ভোর খুশিতে বাকবাকুম! আরিয়ান ছোট ছোট করে তাকিয়ে হেসে বলে,

-” চিটিং করলে জেতাই যায়!”

ভোর সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।

-” মোটেও চিটিং করি নি আমরা! তুমি হেরে গিয়ে এখন বাহানা বানাচ্ছো!”

-” তাই?”

ভোর মাথা উপর নিচ করে সায় জানালো।

শ্রাবনী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এটাই তাহলে লোকটার ছেলে। বেশ আদুরে; আর কি সুন্দর পাকা পাকা কথা! পুরাই রসগোল্লা টাইপ! কিন্তু বাকিরা কারা?
অরুণ পাতার দিকে চায়। মেয়েটার মুখটা থমথমে। কারণটাও বুঝতে বাকি রইলো না! হায়রে মেয়ে মানুষ! সন্দেহ এদের রগে রগে রক্ত কনিকার মতো ঘুরে বেড়ায়। সে ঘার ঘুরিয়ে শ্বাবনীকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এখানে বসুন!”

শ্রাবনী যেন খুশি হলো খুব। পাতার পাশে বসে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এনারা?”

আরিয়ান অবাক চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে। শ্রাবনীকে দেখে তার চিনতে অসুবিধা হয় নি। কিন্তু এই মেয়েটা ভাইয়ের সাথে? সে এবার পাতা দিকে চায়। মেয়েটার মুখের আদলও সন্দেহভাজন!
অরুণ শ্রবনীর কথার প্রেক্ষিতে আরিয়ানকে দেখিয়ে বলে,

-” এটা আমার ভাই! এগুলো বাচ্চা কাচ্চা! আর আপনার পাশের জন আমার ওয়াইফ!”

পাতা যেন এবার আটকে রাখা শ্বাস টেনে নিলো! তবুও মুখের আদল পরিবর্তন হয় নি। তাঁরা রেস্টুরেন্টে এসেছে বেশ কিছু সময় হলো। পার্ক থেকে ঘুরে তারপর আরিয়ান ভাই এখানে নিয়ে আসে। খাওয়ার মাঝেই পাতা খেয়াল করে তাদের সামনে এক টেবিল পরে একটা লোক বসে।যদিও ব্যাক সাইড দেখেছে তবুও পাতার চিনতে অসুবিধা হয় নি লোকটা তাঁর নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। কিন্তু লোকটার সাথে একটা মেয়েকে দেখে পাতার মাথা হ্যাং হয়ে যাবার উপক্রম। ভালো করে দেখে পাতার স্মরণে আসে এই মেয়েটাকে সে এর আগেও দেখেছে। কিন্তু কখন কোথায় মনে পড়ে না। কিন্তু সেটা কথা না! কথা হলো তার জামাইকে কেন অন্য মেয়ের সাথে দেখা যাবে?

শ্রাবনী অবাক লেচনে পাশে তাকায়। পাতাকে দেখে অরুণের দিকে চায়। লোকটা বিয়ে করে নিয়েছে? অরুণ যেন তাঁর না বলা প্রশ্ন বুঝতে পারলো তাই ছোট করে জবাব দিলো,

-” চার পাঁচ মাস হবে বিয়ের!”

শ্রাবনী ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে পাতার সাথে পরিচিত হয়। আরিয়ানের সাথে টুকটাক কথা বলে। হাত বাড়িয়ে আনিকা ও ভোরের গাল টিপে দিয়ে বাহানা দিয়ে কেটে পড়ে। সে চলে গেলেই অরুণ ছেলেকে নিয়ে উঠে এসে পাতার পাশে বসে। আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে,

-” এখানে কি সমস্যা হচ্ছিল?”

-” ঘামের উদ্ভট গন্ধ বেড়োচ্ছিলো গোসল করিস নি?”

আরিয়ান নিজেকে শুকে। কই কোনো গন্ধ টন্ধ নেই তো! সে গোসলও করেছে আবার বেরোনোর আগে পারফিউমও লাগিয়েছে তাহলে? সে ভাইয়ের দিকে তাকায়। অরুণের মুখাবয়ব সিরিয়াস থাকলেও আরিয়ানের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে কটমট করে বলে,

-” গোলাপের সুবাসে অভ্যস্থ ভাই আমার! শিমুলের ফুলে গন্ধ খুঁজে পায়! ভালো বেশ ভালো!”

পাতা খানিকটা ইতস্তত বোধ করে। কি শুরু করলো দুই ভাই! সে অরুণের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” মহিলাটি কে ছিলো? হুম?”

অরুণ আইসক্রিমের বাটির ঢাকনা খুলে দেয়‌। এক চামচ তুলে ছেলের মুখে দেয়। পরপর সামনে বসা আনিকার মুখে দিলো। ছোট রূপ আরিয়ানের কোল থেকে টেবিল চাপড়াতে আ আ করে। সেও খাবে। অরুণ অল্প করে তার মুখেও দেয়। রূপ মুখে নিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসি উপহার দেয়! আরিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলে সে নেয় না। তাঁর মতে আইসক্রিম বাচ্চারা খায়! অরুণ নিজের মুখে নেয়। পাশে বসা পাতার মুখটা এইটুকু হয়ে যায়। একে তো তাঁর কথার উত্তর দিলো না ;তাঁর উপর সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ালো অথচ তার কথা মনে নেই। পাতা চুপচাপ কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।অরুণ আড়চোখে একবার পাতার ফুলো গাল দেখে, তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। এখন কি ছোট ভাইয়ের সামনে বউকে আইসক্রিম মুখে তুলে খাইয়ে দিবে? কি ভাববে আরিয়ান? কচি বউ পেয়ে আহ্লাদ করছে।
আরিয়ানও চামচ ভর্তি বিরিয়ানী মুখে তুলে বলে,

-” ওই মেয়েটা এখানে কেন? আর তুই বা এখানে কেন?”

পাতার কানটা সজাগ হয়। প্রথমবার আরিয়ানের কথাটা তার ভালো লেগেছে। অরুণ ছেলের মুখে আইসক্রিম দিয়ে বলে,

-” ডেট করতে এসেছিলাম!”

আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে। ভাইয়ের মিথ্যে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে পাতার দিকে চায়। বোকা মেয়েটা থম মেরে আছে যেন এখনই স্ট্রোক করবে! তার হাসি পায় বেশ।

পাতা সত্যিই ঝটকা খায়! কি বললো লোকটা? মজায় বলেছে নাকি সিরিয়াস? কিন্তু তাঁর কথা হলো বলবে কেন? তাঁর চোয়াল শক্ত হয়। তবে কিছু না বলে গপাগপ বিরিয়ানী মুখে পুরে। আরিয়ান তাঁর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে বলে,

-” দেখ তোর আম পাতা জোড়া জোড়া! হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।”

পাতা কটমট করে তাকালো তার দিকে। শালার দেবর! একে তো পদ্মা সেতুর উপর থেকে টুপ করে ফেলে দেয়া উচিত!
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,

-” এখানে একটা মিটিংএ এসেছিলাম। মিটিং শেষ হতেই মেয়েটার আগমন!”

-” আর মেয়েটা হচ্ছে ভাইয়ের না হওয়া ফিয়ন্সে! মানে ভাইয়ের সাথে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিল। ভাই মানা করার পর কথাবার্তা আর এগোয় না!”

আরিয়ান কনফেস করে ব্যাপারটা। পাতার খেয়াল হয় লোকটার সাথেই এক রেস্টুরেন্টে দেখেছিল মহিলাকে। পাতা আবার নিজের খাওয়ার মনোনিবেশ করে। ভোরের মুখেও চামচে করে বিরিয়ানী তুলে দেয়। ভোর বাবার কোলে বসে একবার আইসক্রিম খাচ্ছে তো একবার বিরিয়ানী মুখে পুরছে। অন্যসময় হলে অরুণ বাঁধা দিতো এখন বাঁধা দিতে মন চাইলো না। আরিয়ান ভাইয়ের জন্য বিরিয়ানী অর্ডার দিতে চাইলে অরুণ মানা করে। মাত্রই চাইনিজ খেয়েছে সে। এরই মাঝে রুবির আগমন ঘটে। সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আসে। সবাই সিদ্ধান্ত নেয় পার্কে যাবে। ভোর আনিকা তো সেই খুশি! পারে না গাড়িতেই নেচে ওঠে। সন্ধ্যার দিকে হলেও পার্ক খোলা থাকে। বিশেষ করে এই সময়টা যেন আরো জমে ওঠে। সবাই মিলে একটা শিশু পার্কে যায়।অরুণ ভিড় ঠেলে টিকিট কেটে নেয়। পার্কে প্রবেশ করে ভোর আনিকা সামনে সামনে হাঁটতে থাকে। তাঁরা দুজন ঘোর আলাপের মাঝে ডুবে। কে কোন রাইডে উঠবে! ভুতের ঘরে যাবে। ঘোড়ার উঠবে! আরো কতশত প্ল্যান তাদের! ভোর মাঝেমধ্যে বাবাকে জিজ্ঞেস করছে,

-” আব্বু আমি কিন্তু সব রাইডে চড়বো। তুমি কিন্তু একদম মানা করতে পারবে না!”

অরুণ চুপচাপ হ্যাঁও বলে না; আবার নাও করে না। সে পকেটে হাত গুটিয়ে ছেলের পেছনে হাঁটছে। তাদের পিছনে আরিয়ান রূপকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আর রুবি তাঁর বাহু আঁকড়ে ধরে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। মাঝে মাঝে দু একটা প্রেম বাক্য পাঠ করছে দুই কপোতী! পাতা সবার পেছনে অবস্থান করছে। সে আস্তে ধীরে হাঁটছে আপনমনে। শাড়ি পড়ে সবার সাথে হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। সে লোকটার উপর ভয়ঙ্করভাবে রেগে আছে। লোকটা কেমন যেন তাকে গ্রাহ্যই করছে না! এমন কেন করছে? সকালেও তো ঠিক ছিল তাহলে? পাতার চোখ জোড়া ভিজে ওঠে। আরিয়ান ভাই আর রুবি আপু কি সুন্দর করে হেঁটে যাচ্ছে। আর লোকটা তাকে ফেলেই আগে আগে যাচ্ছে। রসকষহীন আনরোমান্টিক লোক কোথাকার! তাঁর যে একটা আদুরে বউ আছে সেই সেটা ভুলেই বসেছে!
____

ভোর আনিকা পুরো পার্ক ঘেটে দেখেছে। ট্রেন, বোর্ড, নাগরদোলা সব কিছুতেই ওঠা শেষ। শুধু ভুতের ঘরে যাওয়া হয় নি। সেটা আপাদত বন্ধ আজ। এখন দুজন দোলনায় বসে দোল খেতে ব্যস্ত। পাতা তাদের ধাক্কা দিচ্ছে। আরিয়ান রুবি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ছবি উঠতে ব্যস্ত তাঁরা সাথে রূপও আছে। আর অরুণ সরকার? সে সামনে ব্রেঞ্চে চুপচাপ বসে। পাতা ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। লোকটা কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম চুপ হয়ে আছে। লোকটা গম্ভীর চুপচাপ কিন্তু ছেলের সামনে সে অন্য অরুণ সরকার। এর আগেও তাঁরা এসেছিল পার্কে! সে, ভোর ও লোকটা। তখন তো নাক উঁচু লোকটা হাসিখুশিই ছিলো। অথচ আজ কেমন যেন; লোকটা তাদের সাথে থেকেও নেই! আনমনা! এমনকি ভোরের সাথেও! অন্যসময় হলে ভোরের উপর শতখানি নিষেধাজ্ঞা জারি করতো। ভোর ওটা করবে না! এটা করবে না। ব্যাথা পাবে। আমার কাছে থাকো! কিন্তু আজ সে ভোরকে কোনো কিছুতেই নিষেধ করে নি‌। ভোর নিজের মতো লাফালাফি ছোটাছুটি করেছে যেন মুক্ত বিহঙ্গ। আর অরুণ সরকার পুরোটা সময় চুপ ছিলো।

-” ও আম্মু? তুমিও চড়ো না দোলনায়? আমি ধাক্কা দিবো!”

ভোরের কথায় পাতার ধ্যান ভঙ্গ হয়। অরুণের উপর থেকে নজর সরিয়ে ভোরকে বলে,

-” না সোনা তুমিই দোল খাও! আমি একটু আসি! আস্তে আস্তে কিন্তু? ব্যাথা পাবে!”

ভোর মাথা নেড়ে সায় জানালো। পাতা শাড়ির কুচি ধরে‌ এগিয়ে যায়। অরুণের পাশে বসে। অরুণ তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। পাতা ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,

-” কি হয়েছে আপনার? কেমন চুপচাপ আছেন! কিছু হয়েছে?”

অরুণ পাতার মাথার স্কার্ফটার পিন ঠিক করে দেয়। কাঁধে হাত রেখে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

-” কিছু হয় নি! আই’ম ফাইন। শুধু টায়ার্ড লাগছে একটু আকটু!”

পাতার বিশ্বাস হয় না। তবে কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলে না। বললে দেখা যাবে লোকটা রেগে বোম হয়ে আছে। সে হাত বাড়িয়ে অরুণের কপালে রাখে। নাহ্ জ্বর তো নেই! অরুণ মুচকি হেসে পাতার হাত মুঠোয় ভরে আলতো করে চুমু দেয়। হাতটা মুঠোয় বন্দি রেখে শান্ত গলায় বলে,

-“হেডেক হচ্ছে। যন্ত্রণায় মাথা মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে!”

পাতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। লোকটার মাথা ব্যাথা! কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! লোকটা কখনো বলে না তাঁর খারাপ লাগছে বা কোনো অসুবিধা হচ্ছে। সবসময় নিজের ভিতর কথা চেপে রাখবে।পাতা উঠে দাঁড়ালো। অরুণের পরিপাটি চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে শাসনের সুরে বলে,

-” এই জন্যই চুপচাপ বসে ছিলেন! বললে বাড়ি চলে যেতাম! ইশ্! ওষুধ খেয়েছিলেন?”

অরুণের ভালো‌ লাগে মিষ্টি শাসন। সে বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে খায় নি। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে চলে যায়! আরিয়ানকে ডেকে বলে,

-” আপনারা কি আরো কিছুক্ষণ থাকবেন?”

আরিয়ান জিজ্ঞেস করে,

-” কেন কোনো সমস্যা? বাড়ি যাবে? মাত্র তো সারে আটটা বাজছে!”

-” তাহলে আপনারা থাকুন আমরা চলে যাচ্ছি! ভালো লাগছে না আর!”

পাতার কথায় রুবি ভেবে বলে,

-” একসাথেই যাই! চলো? অনেক হয়েছে। ছেলেটার ঘুমোনোর সময় হয়ে গেল!”

আরিয়ান আর দ্বিরুক্ত করে না।
_____

রাত এগারোটার কাছাকাছি। পাতা তড়িঘড়ি করে ঘরে আসে। রুম জুড়ে অন্ধকার! ড্রিম লাইটও জ্বালানো হয়নি! পাতা লাইট জ্বালানোর জন্য দেয়াল হাতরে সুইচের খোঁজ চালায়! পেয়েও যায় এরমধ্যে গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে,

-” পাতাবাহার? লাইট জ্বালিও না!”

-” অন্ধকার তো! ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিন?”

-” আলো অসহ্য লাগছে! বন্ধই থাক!”

পাতা আর কিছু বলে না। অন্ধকারে পা টিপে টিপে বিছানায় গিয়ে বসে‌।শাড়ি চেঞ্জ না করেই গা এলিয়ে দেয়! কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারে লোকটা মাঝখানে শুয়ে আছে। পাতা কাত হয়ে একটা হাত অরুণের কপালে রেখে টিপে দিতে থাকে।

-” কমে নি তাই না? খুব খারাপ লাগছে? মাথায় পানি দিবেন?”

অরুণ বুজে রাখা চোখ খুলে নেয়। অধরকোণে মিষ্টি হাসির রেখা। যেই মিষ্টি হাসি সচরাচর দেখা যায় না। অরুণ লম্বা শ্বাস টানে! মাথা ব্যাথা থাকলেও সেটা এখন তাকে মোটেই কাবু করতে পারছে না। করবে কিভাবে? ছেলে, ছেলের আম্মু যেন উঠে পড়ে লেগেছিলো! ভোর তো বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে কত চুমু দিয়েছে! বিড়বিড় করে সুরা পাঠ করে পঁচিশ বার ফু দিয়েছে। আরো বিড়বিড়িয়ে বলছিলো ‘আল্লাহ আমার আব্বুর মাথা ব্যাথা ঠিক করে দাও’। অরুণের কাছে ছেলের এসব আদুরেপনা বেশ পরিচিত। কিন্তু আজ পাতাবাহারের কান্ডকারখানায় সে হেসেছে! পারে না পাগলী মেয়েটা তাঁর মাথা ব্যাথাকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বের করে দিতে! তার সেসব কান্ডের কথা বলার মতো নয়। অরুণ কপাল থেকে পাতার হাতটা সরিয়ে দিয়ে অন্ধকারেই পাতার বুকে মুখ গুঁজে বলে,

-” একটুও কমে নি! খুউব খারাপ লাগছে!”

পাতার চিন্তার মাত্রা বেড়িয়ে যায় তরতরিয়ে। বুকটা কাঁপছে অনবরত। সে অরুণের ঘন সাদাকালো মিশেলের চুলের মাঝে হাত চালিয়ে বলে,

-” ওষুধ খেয়েও কমে গেলো না কেন? ডাক্তারের কাছে একবার কল করুণ তো?”

অরুণ পাতাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” ডাক্তারে কিছুই হবে না। তবে আমার আদুরে পাগলী বউটা একটু আদর করলেই কমে যাবে! একশ দেড়শতাধিক চুমু দিলে একটু কমতে পারে!”

পাতা হাসে। সে কি কোনো সতেরো আঠারো বয়সী নিব্বি প্রেমিকা নাকি? যে এসব রোমান্টিক কথাবার্তায় আবেগে আপ্লুত হয়ে যাবে! পাতা অরুণের মাথার চুল টেনে ধরে বলে,

-” তাহলে থাক..”

আর বলতে পারে না। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায়।

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য বর্বর লোক কোথাকার!”

অরুণ আবার দাঁত বসিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে। পাতা অরুণকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলে,

-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা? ছাড়ুন?”

অরুণ ছেড়ে দেয় সাথে সাথেই। অপাশ ফিরে ভোরকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সবকিছু পাতার মাথার উপর দিয়ে যায়। কিছু পল চুপচাপ ওভাবেই শুয়ে থাকে। লোকটা কি রেগে গেলো? পাতার মনটা খারাপ হয়ে যায় নিমিষেই। সে অরুণের বালিশে মাথা রেখে এক হাত অরুণের পেটে রেখে জড়িয়ে নেয়। অরুণ প্রতিক্রিয়াহীন। না সরিয়ে দেয় না আকরে ধরে। পাতার হাতটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে। উন্মুক্ত পিঠে অধর ছুঁয়ে যায়। এতেও যেন কাজ হয় না। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। সে উঠে বসে অরুণের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,

-” এই ভোরের বাবা?”

অরুণ চোখ মুখ খিচে নিয়ে শুয়ে থাকে। এতো আদুরে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায়? পাতা আবার ডাকে,

-” এই?”

না আর থাকা গেলো না। সে ঝটকায় পাতার হাত ছাড়িয়ে ধমকে বলে,

-” শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না? এমনিই মাথা ব্যাথায় ভালো লাগছে না। অসহ্যনীয় হয়ে উঠেছে।”

পাতা বসে থাকে ওভাবেই। এভাবে ধমক দিতে পারলো? সে লোকটাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিচ্ছেনা?সে অসহ্যনীয় হয়ে উঠেছে?পাতা আবছা অন্ধকারে অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের উপর হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লোকটা। তার ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পাতার কানে বাজছে। পাতা তাকিয়ে থাকে শুধু। নড়ে না চড়েও না; চুপচাপ ওভাবে বসে থাকে।
অরুণ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। অন্ধকারে পাতার অবয়ব বুঝতে পারে। নাক টানার শব্দও ভেসে আসে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে; এদের কি করবে সে? অরুণ হাত বাড়িয়ে দেয়। আবছা আলোয় পাতার কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার কাম?”

বলতে দেড়ি পাতার আসতে দেড়ি হয় না। একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ব্যাক্তিগত মালিকানায়! দু গালে হাত রেখে মুখোমুখি হয়। কপালে ছোট বেশ কয়েকটি চুমু দেয়! সুযোগ বুঝে গালে থুতনি জুড়ে চুমুর বর্ষন হয়! প্রথমবারের মতো বোচা নাকটায় আলতোভাবে কামড় দিয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়! অরুণ শব্দ করে হেসে উঠে। দু হাতে জড়িয়ে ধরে ধীমে গলায় বলে,

-” মাত্র সাতাশ! এখনো একশত তেইশটা বাকি আছে!”

পাতার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হবে! সে বিড়বিড় করে,

-” শালার অসভ্য জামাই!”

অরুণের কর্ণ গহ্বরে বাক্যটা পৌঁছানো মাত্র তার মুখের আদল পরিবর্তন হয়। পাতাকে বুকের নিচে ফেলে বলে,

-” বন্ধু নই তোমার! আই’ম ইয়ুর হাসবেন্ড! শালা কেমন ভাষা? হুম?”

স্পষ্ট ধমকের সুর! পাতা কাঁচুমাচু মুখে তাকায়। এখন মুখ ফসকে বেড়িয়ে এলো সে কি করবে? সে মিনমিনে গলায় বলে,

-” স্লিপ অফ টাঙ! আর হবে না। এই বালিশ ছুঁয়ে বলছি!”

অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। পাতা নজর সরিয়ে নেয়। লোকটার চোখের গভীরে তাকানোর সাহস এই মুহূর্তে তার নেই! অরুণ পাতার কপালে চুমু দিয়ে তার নিজ কার্যে অগ্রসর হতে থাকে। মিষ্টি মধুর আলিঙ্গনে ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নেয় পাতাকে। পাতা একবার বাধা দেয়! অরুণ চোখ রাঙায়! আবছা আলোয় গরম চোখের চাহনি দেখে পাতা আর কিছুই বলতে পারে না। সময় যতো পেরিয়ে যায়‌ রাত ততটাই অন্ধকারে ধাবিত হয়। সাথে নিশীথ গভীরে ডুব দেয়। অন্ধকার ঘরে দম্পতি প্রণয়ের জোয়ারে ভাসমান। চাপা ঘন নিঃশ্বাস পুরো ঘর জুড়ে। হঠাৎ ক্ষীণ সুরে ‘আব্বু’ ডাক ভেসে আসে। অরুণের কান সজাগ হয়। অন্ধকারে পাশ হাতরে নিজের খুলে রাখা শার্ট খুঁজে পাতার গায়ে গলিয়ে দুটো বোতাম লাগিয়ে সরে আসে। হৃদস্পন্দন তার অস্বাভাবিক। ছেলের কাছে গিয়ে আদুরে গলায় বলে,

-” ঘুম ভেঙ্গে গেছে কলিজার? বাজে স্বপ্ন দেখছো?”

ভোর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুম জড়ানো ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,

-” হুম! খুবই বাজে স্বপ্নটা! দেখি তোমার মাথা ব্যাথা বড় হয়ে দুটো সিং গজিয়েছে! একদম ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছে!”

অরুণ তার কপালে চুমু দেয়। ভোর বলে,

-” তোমার মাথাব্যথা কমেছে আব্বু? লাইট জ্বালাও না?”

অরুণ লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ভোর বাবার কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” কমেছে?”

-” হুম! তুমি আল্লাহকে বলেছো! তিনি সারিয়ে দিয়েছেন!”

ভোর খুশি হয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে চায়।পাতা কম্ফোর্ট সরিয়ে উঠে বসে। ভোর তাকে দেখে বলে,

-” আম্মু আব্বুর মাথা ব্যাথা ভেনিশ হয়ে গেছে!”

পাতা তাঁর মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে বলে,

-” ভোর এতো দোয়া‌ করেছে হবে না? আচ্ছা ভোর সিং গজানো বাবাকে কেমন দেখলে?”

ভোর দাঁত বের করে হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অরুণের থুতনি ধরে এদিকে ওদিকে করে বলে,

-” আম্মু একদম ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছিল! মাথায় দুটো সিং! বড় বড় দুটো রাক্ষুসে দাঁত! চোখ দুটো লাল টুকটুকে ছিলো!”

পাতা পিটপিট করে তাকালো।

-” একটা ছবি তুলে রাখতে। আমিও দেখতাম!”

ভোর ভাবনায় পড়ে।

-” স্বপ্নে ছবি তোলা যায় আম্মু?”

পাতা হেসে দেয় খিলখিলিয়ে। অরুণ ছেলেকে শুয়ে দেয়। পাতার হাসি থামে না। তার হাসি দেখে ভোর বলে,

-” আম্মু হাসছো কেন?”

পাতা কিছু বলে না শুধু হাসতেই থাকে যেন হাসির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অরুণ বিরক্তের সাথে তাকায় পাতা তবুও থামে না। ভোর আম্মুর হাসি দেখে হাসতে নিবে অরুণ শক্ত গলায় বলে ,

-” ঘুমাও?”

ভোর বাবার পেটের উপর এক পা তুলে বুকে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজে নেয়। পাতা হাসি থামিয়ে পিটপিট করে চায়। অরুণও তাকায় তার দিকে। পাতা ঠোঁট ভেঙে আবার হেসে দেয়। লোকটার উপর তাঁর করুণা হচ্ছে, আহারে!

-” বেয়াদব রাত দুপুরে পেত্নি ভর করেছে? ঘুমাও?”

অরুণে ধমকে পাতা ধপাশ করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তবে তার হাসি মোটেও বন্ধ হয়ে যায় নি‌! অরুণ হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে নেয়।

চলবে….

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৭

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

শীত শীত ভাব বিরাজমান তবে ধরনীতে এখনো শীতের আগমন ঘটে নি। কিন্তু শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে শত শত বিহঙ্গের আগমন লক্ষনীয়! সাথে ভোর রাতে হালকা শীতের আমেজ। ভোর বেলায় হালকা ধোঁয়া উড়ানো কুয়াশা। শিশিরে ঘেজা সবুজ ঘাসের মাঠ, গাছের পাতা! এ হেমন্ত যেন শীতকে বরণ করে নিতে মুখিয়ে আছে! পাতা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে গাছের টবগুলোয় পানি দিচ্ছে আর সকালের এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটা উপভোগ করছে। সাথে ছোট বেলার তিক্ত স্মৃতি হাতরিয়ে কিছু মধুর মুহূর্ত চোখের পাতায় ভেসে উঠছে। ছোটবেলায় সে, জুবাইদা, কাওছার ভাই, পাবেল ও গ্রামের কিছু ছেলেমেয়ে মিলে মক্তব পড়তে যেতো। একদম কাকডাকা ভোরবেলায়! হিজাব পড়ে আমপাড়া, রেহাল বুকে জড়িয়ে শীতকে উপেক্ষা করেই সব ছেলেমেয়ে ধল বেঁধে যেতো! আজ অনেকদিন পর সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বাইরের পাখির কিচিরমিচির ও হালকা কুয়াশায় ঘেরা দৃশ্য দেখে মনে পড়ে গেলো শৈশবের কিছু অমূল্য রত্ন! পাতা সবগুলো গাছে পানি দেয়ার পর খেয়াল করে তাঁর পিছনে কেউ আছে। একটা ছোট্ট প্রানী তার গা ঘেঁষে মিও মিও করছে। পাতা বিরক্তবোধ করে না। তবে মুখাবয়বে কৃত্রিম বিরক্ত বোধ ফুটিয়ে বলে,

-” কি চাই মহারাজার পাতাবাহারের? হুম?”

বিড়াল শাবকটি মিও মিও করে। পাতা মুচকি হেসে বলল,

-” আপনার কর্তা মশাই এখনো ফেরেনি!”

পাতাবাহার পাতার পা ঘেঁষে ‘মিও মিও’ করে পানির মগটা খামচে ধরলো। পাতা মগটা নিচে রাখলে সে মুখ নামিয়ে পানি চেটে খেতে শুরু করে। পাতা মুচকি হেসে ভেংচি কাটে। বিড়ালটা মোটামুটি সুস্থ হয়েছে। ঘাও শুকিয়ে এসেছে। এখন আগের মতোই দুষ্টুমি করে বেড়ায়। পাতা প্রথমবারের মতো বিড়ালটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। অবুঝ বোকা প্রানী! মালিকের জন্য কুকুরের ভয়, কামড়কে উহ্য করে ছুটে এসেছিল!

এরই মাঝে অরুণের আগমন ঘটে। সে বেলকনিতে পাতাকে দেখে খানিক অবাক হয়।মেয়েটা ঘুম পাগলী! তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাবে আবার উঠবেও দেড়িতে! গত চার মাসে এই মেয়েটা হাতেগোনা কয়েকবার সকাল সকাল উঠেছে আজ তার মধ্যে একদিন।অরুণ এগিয়ে যায়।

-” বাহ্! আজ সূর্য মামা কোনদিকে উঠলো!”

পাতা দরজার দিকে চায়। অরুণকে দেখে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে আসে। দুই হাত অরুণের টি শার্টটায় ঘষে মুছে নেয়। অরুণ নাক সিঁটকায় বিড়ালের পশম লেগেছে। পাতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো সাথেই। হাসতে হাসতেই বলে,

-” একদম নাক সিকায় তুলবেন না। এমনিতেই বোচা আরো বুচুন বুচুন লাগে।”

অরুণ প্রতিবারের মতো শান্ত গম্ভীর। পাতার কথায় তার মুখাবয়বে হাসির রেখা ফুটে ওঠে নি। তাঁর সিরিয়াস মুড দেখে পাতা হাসি থামিয়ে নেয়। ভেংচি কেটে বলে,

-” একটু হাসি খুশি থাকতে পারেন না? হাসলে কেউ আপনার স্বর্ণের উপর ট্যাক্স বাড়াবে না!”

অরুণ তার কথা সম্পুর্ন উপেক্ষা করে। পাতা তার উপেক্ষাকে উপেক্ষা করে বেলকনির টবগুলোকে দেখিয়ে বলে,

-” নিন আপনার কাজ করে দিলাম!সব টবেই পানি দিয়েছি!”

-” একদিন দিয়েই বাহবা কুড়াতে চাইছো? রোজ রোজ দিলেও পারো!”

অরুণের কথায় পাতার মুখ খানি চুপসে যায়। তার আড়ামের ঘুমের সাথে কেন লোকটার আড়িবাদ! সে আমতা আমতা করে বলে,

-” এখন ঘুম আমাকে না ছাড়লে আমি কিভাবে উঠি বলুন তো?”

অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। পাতা পিট পিট করে তাকিয়ে হাসলো। যাকে বলে বেক্কেল টাইপ হাসি। অরুণ হাত বাড়িয়ে পাতার গাল টিপে দিয়ে বলে,

-” কাল থেকে ফজর নামাজ শেষে আর ঘুমাবে না।এক কাজ করতে পারো আমার সাথে হাঁটতে বের হবে। সকাল বেলা হাঁটা ইটস্ আ গুড হ্যাভিট! শরীর মন দুটোই ভালো রাখে। আর এমনিতেও শুয়ে বসে থেকে একটু মুটিয়ে গেছো পাতাবাহার!!”

পাতা গোল গোল করে চায়। লোকটা তাকে ইনডিরেক্টলি মোটা বললো? মানছে সে আগের থেকে একটু, বেশি না কিন্তু এই এইটুকুনি স্বাস্থ্যবতী হয়েছে। বিয়ের পর সব মেয়েরাই হয়! তাই বলে মোটা বলবে? পাতা গাল ফুলিয়ে ফোঁস ফোঁস করে। দাঁত কপাটি পিষ্ট করে বলে,

-” নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! আপনি আমাকে ইনডিরেক্টলি মোটা বললেন? আমি‌ মোটা? কোন দিক দিয়ে ভাই?”

পাতা অরুণের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার নাকের পাটা ফুলে উঠেছে বারংবার। অরুণ পকেট থেকে হাত বের করে। কপালে ভাঁজ ফেলে এক হাত পাতার অল্প মেদ যুক্ত পেটে রেখে চিমটি কাটে। পাতা শ্বাস টেনে হালকা ফুলো পেটটা লুকিয়ে নেয় নিমিষেই। খানিক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে। লোকটা এভাবে প্রমাণ পেশ করবে? অরুণ পাতার ফুলো গাল চেপে ধরে শক্ত করে। নিজে খানিক ঝুঁকে রাশভারী গমগমে গলায় বলে,

-” ভাই? আ’ম ইয়্যুর হাসবেন্ড পাতাবাহার! আর মোটা বলি নি! বলেছি হালকা মুটিয়ে যাচ্ছো! ইট স্যুটস ইয়ু! প্রিটি লাগে।”

বলেই ছেড়ে দেয়। পাতা আটকে রাখা শ্বাস টানে। অসভ্য জালিম লোক!! পাতা গালে হাত বুলায়। তার নরম গালটার বারোটা বাজালো! অরুণ দাঁড়ায় না রুমের ভিতরে এসে সোফায় গা এলিয়ে দেয়‌। পাতা হন হন করে এগিয়ে আসে। গায়ে থাকা ওভার সাইজের শার্টটার কলার ঠিক ঠাক করে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-” আমি আপনার নামে নারী নির্যাতনের কেস দেবো। আমার আদরের গালটা লাল করে দিয়েছেন! আর আমাকে মোটা বলছেন? মাত্র আটচল্লিশ কিলো আমি! আমি যদি মোটু হই তাহলে আপনি কি?”

অরুণ বিরক্ত হয়ে বলে,

-” ক বলতে কিশোরগঞ্জ বোঝা মহিলা? করো কেস! আমি অরুণ সরকার মোটেই ভয় পাচ্ছি না।”

পাতা ভেংচি কেটে ব্যঙ্গ করে বলে,

-” আমি অলুন তলকাল মোতেই ভয় পাই না!”

অরুণ চোখ গরম করে তাকায়। পাতা বত্রিশ পাটি বের করে হাসে। লোকটাকে বিরক্ত করতে তার বেশ লাগে। সে সোফায় অরুণের পাশ ঘেঁষে পা তুলে বসে। অরুণের বাহু জড়িয়ে দুঃখি দুঃখি ভাব ফুটিয়ে বলে,

-” আপনার ঐতিহ্যবাহী ধমক খুউব মিস করছি! কত দিন হলো আপনার ধমক খাই না।”

অরুণ ঘার ঘুরিয়ে পাতার দিকে চায়। পাতা মুচকি হেসে বলে,

-” ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? সত্যি বলছি! সাত আট দিন হয়ে গেলো আপনি একটাও ধমক দেন নি!”

অরুণের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তের ছাপ।পাতার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার যথেষ্ট হয়েছে! বিরক্ত হচ্ছি আমি!”

পাতা চোখ ছোট ছোট করে চায়। শালার জামাই! মজা খুনসুটি কিছুই বোঝে না। রসকষহীন লোক কোথাকার! পাতা পা ভাঁজ গুটিয়ে বসে। হাঁটুতে থুতনি রেখে গম্ভীর মুখে বসে থাকে। করবে না বিরক্ত!
অরুণ কিছু বলে না। হাত বাড়িয়ে পাতার এলোমেলো খোলা চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বলে,

-” আমার শার্টটাই পড়ে আছো।এখনো চেঞ্জ করোনি কেন?”

-” ভুল হয়ে গেছে।এখনি চেঞ্জ করে আপনার মহামূল্যবান শার্ট ফিরিয়ে দিচ্ছি! ওয়েট!”

বলেই পাতা পা নামিয়ে নেয়। অরুণ চুল টেনে ধরায় যেতে পারে না। পাতা ভরা চোখে তাকায় অরুণের দিকে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে তাঁর গালে একটা চুমু দেয়।

-” রেগে যাচ্ছো কেন? আমার শার্ট তোমার শার্ট! যতক্ষণ খুশি পড়ে থাকতে পারো! বাট এই ওভার সাইজ শার্ট পড়ে তো সবার সামনে যেতে পারবে না। কলিজা উঠলো বলে!”

একদম শান্ত আর আদুরে গলা। পাতার মাঝে যেন একবুক সাহসের সঞ্চার হয়। মুচকি হেসে অরুণের পায়ের উপর বসে গলা জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। অরুণ অল্প হেঁসে এক হাতে জড়িয়ে নেয়। এরমধ্যে বিড়াল শাবকটির আগমন ঘটে। টি টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে মিও মিও করতে থাকে। পাতা আড়চোখে তাকে চোখ রাঙায়। শালার লাজ লজ্জা হীন বিড়াল !
অরুণ তাকে সরিয়ে দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” কলিজাকে ডেকে দাও!”

পাতা ‘হুম’ বলে কিন্তু অরুণকে ছাড়ে না। তার ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। চোখটা ভারি হয়ে আসছে। হামি উঠছে বারংবার। চোখের পাতায় ঘুম উড়ে বেড়ায়। অরুণ পাতার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে ঘুমন্ত ছেলের দিকে চায়। কম্ফোর্ট ঢাকা সম্পূর্ণ শরীর শুধু মাথাটা উঁকি দিচ্ছে অল্প সল্প। ছোট বাচ্চাদের মতো টকটকে ঠোঁটজোড়া ফুলিয়ে নিদ্রায় মগ্ন। অরুণের ইচ্ছে করে ছেলের ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে ঘুম ভাঙাতে;আদর করে বুকে জড়িয়ে রাখতে!

-” পাতাবাহার? কলিজার জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করা উচিত! তাই না?”

পাতার ঘুম ছুটে যায়। অরুণের গলা ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। কি বলল লোকটা?
অরুণ পাতার চোখে চোখ রেখে বলে,

-” কালকে খুব একটা অপ্রিতিকর অবস্থায় পড়েছিলাম! তাই নয় কি? ভোর বড় হচ্ছে ধীরে ধীরে!”

পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে সোফায় বসে। কথা ঠিক! কালকের মুহূর্তটা খুবই দৃষ্টিকটু! ভোর এখন বড় হচ্ছে। একটু স্পেস তো দরকার। লোকটা ছেলেকে পাশের ঘরে রেখে আসে। তাদের একান্ত মুহূর্তের সমাপ্তির পর ছেলেকে কাছে এনে তবেই ঘুমোবে। ছেলেকে ছাড়া লোকটা একটুও ঘুমোতে পারে না।

-” থাকতে পারবেন ছেলেকে ছাড়া?”

অরুণ উঠে বিছানায় ছেলের শিয়রে বসে বলে,

-” এক মুহূর্তও না। ওকে ছাড়া চোখের পাতায় ঘুমই নামবে না আমার! কিন্তু এখন বড় হচ্ছে। আজ হোক কাল হোক আলাদাভাবেই রাখতে হবে!”

পাতা মাথা নাড়ে। কথা ঠিক! কিন্তু এ ব্যাপারে সে কিছুই বলবে না। একটা কথাও না। কারণ সে জানে আগে হোক পরে এ নিয়ে তাকে একটু হলেও খোঁচা শুনতে হবে। অরুণ সরকার না দিলেও আরো অনেকেই আছে। বলবে দূরে ঠেলে দিচ্ছে ভোরকে; তিন চার মাস যেতে না দিতেই সৎ ছোট ছেলেকে আলাদা ঘরে রাখার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।

-” তুমি কি বলো?”

অরুণের প্রশ্নে পাতা মুচকি হেসে বলে,

-” আমি কিছুই বলবো না। এটা সম্পূর্ণ আপনার ব্যাপার। আমি কিছু বললেই ভাবতে পারেন ছেলেকে দূরে রাখার পাঁয়তারা করছি। সৎ মায়ের ট্যাগ লাগিয়ে দিবেন! আবার এও হতে পারে আপনি এই কথাটা আমাকে পরীক্ষা করার জন্যই করেছেন! যে দেখি মেয়েটা কি বলে!”

অরুণের চোয়াল শক্ত হয়ে যায় নিমিষেই। শক্ত গম্ভীর মুখে বলে,

-” ডোন্ট সে দ্যাট ওয়ার্ড এনি মোর! মার্ক মায় ওয়ার্ড‌। সৎ মা! সৎ ছেলে! কথাটা তোমার মুখে যেন আর না শুনি! কখনোই না! আর প্রতিবারের মতো একটু বেশি বোঝো পাতাবাহার! কিছুই বলতে হবে না তোমাকে। তবে এই শব্দ গুলো বলে আমাকে বা আমার ছেলেকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।”

পাতা থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কি ভুল কিছু বলে ফেলেছে? মনে তো হচ্ছে না!
অরুণ ছেলের গা থেকে কম্ফোর্ট সরিয়ে গালে হাত রাখে। ফুলো ঠোঁটজোড়ায় চুমু দিয়ে ডাকে,

-” আব্বু? কলিজা? এই আব্বু?”

ভোর চোখ মুখ কুঁচকে ওপাশ ফিরে শোয়! অরুণ আবার ডাকে,

-” মানিক সোনা? ওঠো? এই আব্বু?”

ভোর কাঁদো কাঁদো ফেস বানিয়ে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,

-” আব্বু? একটু ঘুমালে কি হবে? একটু ঘুমাই না? প্লিজ আব্বু?”

অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশ রুমে যায়।

-” আমার ছোট্ট আব্বু?এই একটু না ঘুমালে কি হবে? হুম?”

-” অনেক বড় লস হবে! ভোর আরো ঘুমাবে!”

-” আমার ভোর এখন ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট করবে!”

ভোর গাল ফুলিয়ে নেয়!
____

-” আচ্ছা বুঝলাম না! আজ অফিস ছুটি কেন হলো?”

আরিয়ান আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখে তার আকাশ সম ঘুম। হামি তুলে ঘুমন্ত ছেলের ডায়পার চেক করে খুলে রাখে। রুবির কথার জবাবে বলে,

-” সত্যিই জানো না?”

রুবি মানা করে সত্যিই সে জানে না! আরিয়ান বালিশে পুনরায় মাথা এলিয়ে বলে ড্রেসিন টেবিলের সামনে দন্ডায়মান রুবির দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভাইয়ের মরহুম মা স্বপ্না চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ!”

-” ইশ্ ভুলেই বসেছিলাম!”

-” হুম! ভাই এই দিনে অফিসে যাবে না আবার বাড়িতেও থাকবে না। এলোমেলো ঘুরবে। দান সদকা করবে গরীব দুঃস্থদের হাতে খাবার পানি তুলে দিবে। মাদ্রাসা গুলোয় কোরআন শরীফ খতম পড়িয়ে দোয়া করবে! তাদের খাওয়াবে! এইসব! তবে কোনো আয়োজন করে না‌।”

রুবি বিছানার কিনারায় বসে জিজ্ঞেস করে,

-” আচ্ছা উনার মৃত্যু কেমন করে হয়েছে?”

-” অসুস্থ ছিলেন উনি; হার্টে সমস্যা! ভাই হওয়ার পর থেকেই অসুস্থতা বেড়ে যায়। অপারেশন করা হয়! ডায়েবেটিসের রুগি ছিল তাই খুব একটা সুবিধার করতে পারে নি। অপারেশনের সাতদিনের মাথাই হঠাৎ চলে যায়!”

বলে আরিয়ান উঠে ওয়াশ রুমে চলে গেল। রুবি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
_____

ড্রেসিন টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অরুণ সরকার। অন্যসময়ের মতো ফরমাল ড্রেস আপে নয়। সাধারণ শার্ট প্যান্ট ও পড়নে চটি জুতো! চুলগুলোও পরিপাটি নয় এলোমেলো তবে উস্কো খুস্কো নয়। একদম সাধারণ বেশে; নরমাল লুক! মুখায়ব নিত্যদিনের মতোই ঠাহর করা মুশকিল। অরুণ হাত ঘড়ি পড়ে।
পাতা তার পাশেই বুকে হাত খুঁজে দাঁড়িয়ে। ভোর বিছানায় শুয়ে বসে গড়াগড়ি খাচ্ছে খুশিতে। আজও স্কুলে যেতে হবে না। তার মানে অনেক অনেক খেলা! সাইকেল চালানো! মোবাইলে গেম খেলা! কার্টুন দেখা!আর একটু আকটু পড়াশোনা! ইশ প্রতিদিনই যদি এমন হতো? পড়াশোনা করতে তাঁর মোটেও ভালোলাগে না।পড়ালেখা তো একটা ভ্যাম্পায়ার! স্টুডেন্টদের রক্ত চুষে খায় অনবরত। পড়াশোনার নামে সে চাচ্চুর কাছে একটা মামলা করবে; জেলে পাঠিয়ে দেবে! কেন পড়াশোনা বাচ্চাদের ডিস্টার্ব করে! ভেবেই ভোরের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে বালিশ শূন্যে ছুঁড়ে লাফিয়ে ওঠে আনন্দে! পাতা ছোট ছোট করে তাকিয়ে তাঁর উল্লাস দেখে। ভোর আম্মুর চাহনি দেখে চুপচাপ গুড বয় হয়ে বসে থাকে। পাতা অল্প হেসে অরুণের দিকে তাকিয়ে বলল,

-“হয়েছেটা কি জানতে পারি? কেন স্কুলে যেতে পারবো না আমরা? পাঁচদিন হলো স্কুলে যেতে দিচ্ছেন না! আমরা এখন সুস্থ আছি!”

-” বলছি যেতে হবে না মানে হবে না‌ ব্যস আর কোন কথা নয়!”

গম্ভীর মুখে আদেশ বানী অরুণের। পাতা মানতে নারাজ!

-” কেন যাবো না? কোন রিজেন তো থাকতে হবে? এক দুই মাস পর সবার এক্সাম। ভোরেরও! স্কুলে না গেলে চলবে?”

ভোর এতক্ষণ চুপচাপ শুনলেও এবার আর চুপ থেকে না। হাসিখুশি মুখে বলে,

-” আম্মু স্কুলে না গেলে তো আমাদেরই লাভ তাই না? স্কুলে গিয়ে গিয়ে আমরা টায়ার্ড হয়ে গেছি তাই আব্বু আমাদের ছুটি দিচ্ছে! তাই না আব্বু?”

অরুণ ছেলের মাথার এলোমেলো চুল আঁচড়ে দেয়। কিছু বলবে এর আগে পাতা বলে,

-” ভোর? খুব খুশি হচ্ছো দেখছি! পড়ালেখা দূরে থাকলেই বাঁচি তাই না? মনে রেখো ফাইনাল এক্সামে ফাস্ট না এলে বিয়ে করাবো! লাল টুকটুকে বউ এনে তোমাকে বউয়ের হাতে সঁপে দিবো! বলবো বউমা সামলাও আমার পড়াচোর ছেলেকে!”

ভোরের ছোট লজ্জা মাখা মুখটা দেখার মতো হয়েছে। সে গাল ফুলিয়ে বুকে হাত গুটিয়ে বসে থাকে। সবাই কিছু হলেই বলবে বিয়ে করাবো, বউমা আনবো! এটা কি ঠিক? এটা রীতিমতো শিশু নির্যাতন! তাঁর কি বিয়ের বয়স হয়েছে নাকি! সবে ছয় বছর তাঁর ‌ সে তো এইটুকু নি বাচ্চা!
অরুণ ছেলের ফুলো গালে চুমু দিয়ে আদর করে বলে,

-” বাড়িতে পড়তে বসালেই চলবে!”

-” আশ্চর্য আপনি কি শুরু করে দিয়েছেন? আমি স্কুলে চাকরি করি কারো অধীনে। এমন ভাবে বিনা রিজনে মোটেই মিস দিতে পারি না স্কুল! আচ্ছা ভোর থাকুক আমি যাবো!”

অরুণের চোখে মুখে অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট। সে কড়া সুরে বলে,

-” কেউ যাবে না!”
পাতার রাগ হয়‌। একে তো বলছে না কেন অফ দিবে উপরন্তু হুকুম জারি করা হচ্ছে। সে শান্ত গলায় বলে,

-” কেন? প্রিন্সিপাল ম্যামকে বলেছেন আমি যাবো না। কেন সেটা বলেন নি! তিনি আমাকে কল করে বলে কিছু হয়েছে কিনা! আমি কি বলবো তাকে? আমার প্রতিদিন কতো গুলো ক্লাস থাকে তাঁরা কিভাবে ম্যানেজ করবে? সৈয়দ ফোন করে! কেন আসি না..”

-” ফোনটা দাও?”

পাতাকে থামিয়ে বলে অরুণ! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। ফোন কেন চাইছে? সে বাড়িয়ে রাখা হাতে ফোন দেয়। অরুণ লক খুলে কললিস্ট চেক করে সৈয়দ নামক কন্টাক্ট ব্লক লিস্টে ছুঁড়ে মারে। পাতাকে উদ্দেশ্য করে শান্ত গলায় বলে,

-” তর্ক করবে না। আমি বলছি কিছুদিন স্কুল যেতে হবে না। ব্যস যাবে না।”

পাতা কিছু বলবে অরুণ আবার থামিয়ে বলে,

-” কোন কথা না! ম্যামের সাথে আমি কথা বলেছি আবার ইনফর্ম করবো! তোমার এ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। আর ওই অবরোধ নাকি সৈয়দ ওর সাথে এতো কথা কিসের শুনি? নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলেছি! বিকেলে এসে তোমার সোসাল মিডিয়ায় তল্লাশি চালাবো!”

পাতা থমথমে গলায় বলে,

-” আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন?”

অরুণ পাতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার গালে আলতো চাপড় মেরে বলল,

-” কাননে ফুলের সমারোহ! ছাগলের হাত থেকে বাঁচাতে হবে না?”

পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। কিছু বলবে কিন্তু পরবর্তী কান্ডে সে বাকহারা!
ভোল বাবার বাহু ঠেলে সরিয়ে রাগে ক্ষোভে ফুঁসে বলে,

-” আমার আম্মুকে মারলে কেন? হুম?”

অরুণ খানিকটা অবাক হলেও শান্ত চোখে ছেলের দিকে চায়। ছেলের রাগান্বিত মুখটা দেখে বেশ অবাক হয়। পাতা ভোরকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলে,

-” আরে পাগল‌ ছেলে! মেরেছে নাকি আমাকে! ওতটা সাহস আছে নাকি ওনার হুম? যাস্ট ক্যাজ্যুয়ালি হাত রেখেছে । এই আলতো ভাবে ! ভোর আমি শুনেছি ন্যাড়া কিন্তু বেল তলায় এক বারই যায়!”

অরুণ ছোট ছোট চোখে চায়। পাতা ভেংচি কাটে। ভোর পাতার গালে হাত বুলিয়ে দেখে।বাবার মতো মুখ বানিয়ে বলে,

-” ন্যাড়া কি আম্মু?”

অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,

-” লাড্ডু মাথাকে ন্যাড়া বলে!”

ভোর বাবার গলা জড়িয়ে মিনমিনে গলায় ‘স্যরি’ বলে। অরুণ ছেলেকে আদরে আদরে ভরিয়ে বলে,

-” বাবা? স্টাডি রুমে আমার ওয়ালেট আছে একটু নিয়ে আসো তো?”

ভোর ঠোঁট ফুলিয়ে বলে,

-” প্রত্যেকদিনই তুমি এটা ওটা আনতে বলো!ভোর গুড বয় তাই এনে দিবে‌। তুমিও গুড বয় তাই আমার জন্য রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার এনে দিবে কিন্তু?”
______

মধ্যাহ্ন গড়িয়ে বিকেল। কুসুমের ন্যায় উজ্জ্বল নক্ষত্র পিন্ড পশ্চিম দীগন্তের বুকে উঁকি দিচ্ছে। সকালের শীতের আমেজ মধ্যাহ্নে না থাকলেও বিকেলের দিকে আবার ফিরে এসেছে। হালকা পবনের তানে সেটা অনুমান করা যায়! ভোর আনিকা সাইকেল চালাচ্ছে। সাইকেল চালানো শিখেছে তাঁরা। পাতা ফোন হাতে বাড়ির আঙিনায় বসে আছে। তাঁর দৃষ্টিতে ভোর আনিকা। তার সম্পূর্ণ ধ্যান তাদের উপরেই! তবে সাথে ফোনের ডায়েল প্যাডে একটা নম্বরে। অরুণ সরকারকে কল করে করে সে ক্লান্ত। সেই সকালে বেরিয়েছে এখনো তার খোঁজ খবর নেই। ফোনটা বন্ধ রেখেছে। পাতা খুবই দুশ্চিন্তায় আছে। সে জানতো না আজ অফিস বন্ধ। তাঁরও একটু খটকা লেগেছিল। লোকটা নিত্য রূপে বেরোয় নি। একদম সাধারণ বেশে। লোকটা যাওয়ার পর নিচে নামলে তাঁর রুবির সাথে দেখা হয়‌। সে হেসে জিজ্ঞেস করেছিল ‘অফিসে যায় নি কেন?’। রুবি প্রতিত্তরে জবাব দিয়েছিল অফিস বন্ধ। পাতা কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ে। কিন্তু পরবর্তী কথা শুনে সে বাকহারা হয়ে পড়ে। আজ লোকটার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী! অথচ সে জানেই না। লোকটাও কিছু বলে নি। না ভোর জানে। পাতা তারপর থেকেই অনবরত কল করে যাচ্ছে।অথচ লোকটার ফোন প্রথম থেকেই সুইচ অফ! কোথায় লোকটা? আরিয়ান ভাইয়ের থেকে জেনেছে লোকটা এই দিনে এখানে ওখানে যায় মায়ের কবর জিয়ারত করে, দান সদকা করে! একা একাই, কারো সাথে যোগাযোগ করবে না। এর আগে ভোরকে নিয়েছিল সাথে।এবার তাও নেয় নি। পাতার মনটা সেই থেকে বিষন্নতার অতল গহ্বরে তলিয়ে আছে। নিশ্চয়ই লোকটার মন ভালো নেই। লুকিয়ে চুরিয়ে অগোচরে দু এক ফোঁটা চোখের জল ফেলছে। ভাবতেই পাতার বুকটা ভারি হয়ে আসে। চোখে নোনাজল ভিড় জমায়! ইয়া আল্লাহ লোকটার সব কষ্ট তাকে দিক! এরইমাঝে রুবির আগমন ঘটে। পাতা চোখের জল অগোচরে লুকিয়ে মুচকি হাসে। রুবি রূপকে পাতার কাছে দিয়ে বলে,

-” একটু খেয়াল রেখো বড় ভাবী! আমি গোসল সেরে আসছি!”

পাতা রূপকে কোলে নিয়ে চুমু দিয়ে সায় জানালো। রুবি চলে যায়। রূপ সেদিকে তাকালোই না। পাতাকে পেয়ে সে খুব খুশি। হাত তালি দিয়ে আ’মা আ’মা বুলি আওড়িয়ে গালে মুখে লালা মাখিয়ে দেয়‌। পাতা তার গাল টিপে দিয়ে বলে,

-” পঁচা রূপ! তোমার ভোর ভাইয়া দেখলে পিটিয়ে সোজা করে দেবে তার আম্মুকে আদর করা হুম?”

রূপ হেসে কুটি কুটি। পাতা আধো আধো বুলিতে বলে,

-” তোমার বড় চাচ্চু কোথায় গেল বলোতো? কলই ধরছে না। তোমার বড় আ’মার বুঝি কষ্ট লাগে না? বুকটা জ্বলছে তো! তাড়াতাড়ি আসতে পারে না? আসুক সে! খুউব করে বকে দিবো! সব কষ্ট দুঃখ কেন নিজের ভিতর পুষিয়ে রাখবে? শেয়ার করলে কি তার ইগোর রফাদফা হবে? তাঁর জন্য যে একজন চিন্তায় অক্কা যাবার পথে সে খেয়াল মোটেই নেই।”

রূপ আ আ করে সব শুনে পিটপিট করে চেয়ে আবার হাসে। পাতা তার গালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে সেঁটে নিয়ে গুনগুন করে,

‘সে যে কেন আসে না
কিছু ভালো লাগে না
এবার আসুক আমি তাঁরে..’

গুনগুন থামিয়ে রূপকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” কি করবো বলতো রূপ? হুম ? শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনেক গুলো আদর করে দিবো পঁচা নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটাকে! ঠিক হবে না?”

রূপ হাত তালি দিয়ে সায় জানালো।

অপর দিকে ভোর সাইকেল স্ট্যান্ড করে দাঁড়িয়ে আছে। মুখাবয়ব ভারী সন্দেহভাজন। ফর্সা ফুলো গাল লাল টুকটুকে হয়ে আছে।নাকের পাটা ফুলছে। নোনাজলে ভাসমান বড় বড় কালো চোক্ষু যুগল পাতা ও রূপের উপরে নিবদ্ধ। ভেজা চোখের কর্নিয়ায় ভাসমান পাতা রূপের আদুরে মুহূর্ত! সে রাগে সাইকেল থেকে নেমে ঠেলে ফেলে দেয়। আভারি দৌড়ে আসে। আনিকাও সাইকেল নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,

-” এই ভোর কি হলো?”

ভোর তার দৃষ্টি স্থির রেখে জবাব দেয়,

-” কিছু না। আমি সাইকেল চালাবো না!”

বলেই হনহন করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়।
পাতা দূর থেকে সবই লক্ষ্য করে। রূপকে কোলে নিয়ে সেও উঠে আসে। ভিতরে প্রবেশ করার আগে আভারিকে আনিকার খেয়াল রাখতে বলে।
পাতা তড়িঘড়ি পা চালিয়ে যায়। গিয়ে দেখে ভোর ড্রয়িং রুমে বসে আছে। নাক টানছে অনবরত। কাঁদছে না তবে চোখের পানি যেকোনো সময় বাঁধনহারা হতে পারে। পাতা রূপকে নিয়ে তার পাশে বসে। ভোর টি শার্ট তুলে নাক মুছে। পাতা আঁচল দিয়ে মুছে দিবে ভোর সরে বসে। রূপ আ আ উ উ করে হাসছে। এটাই যেন ভোরের সহ্য হলো না। সে টি টেবিলে রাখা পানি ভর্তি জগটা লাথি দিয়ে ফেলো দিলো মুহুর্তেই! পাতা অবাক হয়ে বলে,

-” এসব কি ভোর? এরকম কে করে?”

-” আমি করি!”

স্পষ্ট উত্তর। পাতার চোখে মুখে অবাকতা! ভোরের এ রূপ সে তো কখনো দেখেনি! সে রূপকে সোফায় বসিয়ে জগটা তুলে রাখে। প্লাস্টিকের হওয়ায় ভাঙ্গে নি। তবে ফ্লোর পানিতে টইটুম্বর। সে সুফিয়াকে ডাকে গলা উঁচিয়ে।
রূপ সোফায় চুপ করে বসে থাকে না। হাম্পুরা দিয়ে ভোরের কাছে যায়। ভোরের কোলে হাত রেখে উঁকি দিয়ে হেসে আ’মা আ’মা বলে! ভোর ঠাস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দেয় সাথে সাথেই। পাতা থাপ্পড়ের শব্দে এদিকে ফিরে তাকায়। কিছু বলবে এর আগেই ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটে যায়।

রূপ থাপ্পড় খেয়ে ভোরের হাতে ছোট ছোট দাঁত বসিয়ে কামড়ে দেয়। ভোর যেন অগ্নি কুন্ডের জলন্ত শিখা! সামান্য কেরোসিনেই সে ভয়ঙ্কর রূপ দেখায়। রূপকে ধাক্কা দেয়। রূপ কাঠের টি টেবিলের উপর পড়ে ফ্লোরে পড়ে যায়। সাথে সাথেই গলা ফাটিয়ে কান্নার শব্দ! পাতা তড়িৎ বেগে এগিয়ে এসে তাকে তুলে নেয়। মাথা হাত কনুই চেক করে। বাচ্চাটা সর্বোচ্চ গলা উঁচিয়ে কান্না করতে থাকে। পাতা ভোরের দিকে চায় শান্ত চোখে‌। ছেলেটার চোখে মুখে নেই কোনো অনুতাপের রেশ! যেমনটা সে রোহানকে ধাক্কা দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়ার পর দেখেছিল!পাতা এটা ওটা বলে চুপ করানোর চেষ্টা করে রূপকে। ভোর জলন্ত চোখে সেটা অবলোকন করে!

রুবি এগিয়ে এসে পাতার কোল থেকে ছিনিয়ে নেয় ছেলেকে। রূপ কান্না করতে করতে দম আটকে যায়। রুবি হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ওঠে। পাতা রূপের বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মাথা ধরে ঝাঁকুনী দেয়। রূপ আবারো কেঁদে ওঠে। পাতা তাকে নিয়ে বেসিনে চলে যায়। মাথার বা পাশে ফুলে উঠেছে নিমিষেই। পানি দিয়ে রুবিকে বলে বরফ আনতে। রুবি বরফ এনে নিজ ওড়নায় মুড়ে ছেলের মাথায় ধরে। রূপ কাঁদছে অনবরত। সাথে রূবিও। আসমা বেগম,সুফিয়া,মিনু সবাই এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে! রুবি ক্রন্দনরত ছেলেকে বুকে নিয়ে বরফ ডলতে ডলতে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” পাতা? তুমি কিন্তু সাক্ষী! আমার ছেলেটা মরতে মরতে বাঁচলো! সব ঘটনা তোমার সম্মুখেই ঘটেছে। আমিও তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী!”

রূপের কান্না কিছুটা থেমে আসে। রুবি ছেলেকে নিয়ে ভোরের সামনে বসে মাতৃদুগ্ধপান করায়! রুবির শান্ত নজর চুপটি করে বসে থাকা ভোরে নিবদ্ধ।
পাতা হাত পা কেঁপে উঠলো যেন! অজানা আশঙ্কায় বুক দুমড়ে মুচড়ে ধরে। আসমা বেগম পাতার কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর মুখে বলে,

-‘ হয়েছেটা কি?”

পাতা যেন হুঁশে ফেরে। ভোরের কাজটা একদম ঠিক হয় নি। সে জড়ানো গলায় বলে,

-” ওই রূপ পড়ে গেল মা! আমি ধরবো.”

রুবি গলা উঁচিয়ে শক্ত গলায় বলে,

-” পড়ে যায় নি আমার রূপ! সত্য কেন লুকাচ্ছো?চর মেরেছে ভোর। ধাক্কা দিয়ে ফেলেও দিয়েছে। কারণটাও আমি গেস করলাম নিশ্চয়ই ভোরের মা’কে সে মা ডেকেছে তাই নয় কি বড় ভাবী?”

পাতা অসহায় চোখে তার দিকে তাকায়। ভোর এখনো সেভাবেই বসে আছে মাথা নিচু করে। যেন কোনো পুতুল বসে আছে। আনিকা এগিয়ে এসে মায়ের কাছে বসে ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” পঁচা ভোর! আমার ভাইকে মারলি কেন? আমি চাচ্চুকে বলে দিবো!”

-” ভয় পাই না তোর চাচ্চুকে!”

শক্ত গম্ভীর গলা ভোরের! পাতা চমকে উঠে এগিয়ে যায়। ভোরের পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে টেনে তোলার চেষ্টা করে। ভোর নিরেট! সে নড়ে না শক্ত হয়ে বসে থাকে।
আসমা বেগম এগিয়ে এসে ভোরকে ধমকে বলে,

-” বেয়াদব হচ্ছো দিন দিন! রূপকে মেরেছো কেন? ছোট বাচ্চা রূপ। ভাই হয় না তোমার? হুম?”

ভোর রাগে কাঁপছে অনবরত। পাতা ভোরের আচরণে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই ভোরকে সে মোটেই চেনে না। এ কেমন ধ্বংসযজ্ঞ রূপ তার! সে ভোরকে জোড় করে তুলে জড়িয়ে বলে,

-” মা ছোট বাচ্চা। ভুল হয়ে গেছে। আমি বকে দেব! সত্যিই! রূবি আপু আমি সত্যিই শক্ত করে বকে দেবো! ওর বাবার কানে দিও না কেউ!”

আসমা বেগম কিছু বলবে এর আগে রুবি পাতার কথা টেনে বলে,

-” বড় ভাবী? এটা কোনো ছোট খাট ব্যাপার মোটেই না। প্রায়ই আমার ছেলের পিঠে গালে লাল দাগ থাকে। আমি প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও একদিন দেখি ভোর ওর গালে চিমটি কাটছে। আমি কাছে গিয়ে দেখি লাল হয়ে আছে। বুঝতে পারি এর কারণ কি! আর আজ তুমিও দেখলে আমিও দেখলাম! ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। আমার ছেলেটা দম আটকে গিয়েছিল ভাবতে পারো কি হতে পারতো? আমি এটা মেনে নেব না!”

সবাই স্তব্ধ। পাতার চোখ মুখ বিবর্ণ হয়ে আছে। ভোর পাতাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। পাতা আবার বলে,

-” রুবি আপু ছোট বাচ্চা! ওদের কি আর বুঝ আছে বলো..”

রূবি যেন ক্ষেপে গেলো।

-” ও ছোট বাচ্চা? আমারটা কি? তুমি ওর সাফাই গাইছো? ভালো! ও বাচ্চা না মেন্টালি সিক! সাইকো বলে না? সেরকম কিছু! এখন বিশ্বাস করছো না। ছেলের জন্য দরদ উথলে উঠেছে।শোন? যখন নিজের বাচ্চা হবে তখন বুঝতে পারবে! অবশ্য নাও হতে পারে। দা গ্রেট অরুণ সরকার ছেলে অন্ত প্রাণ। বাচ্চা নাও নিতে পারে!”

পাতা শান্ত চোখে তাকিয়ে থাকে কিছু পল। নিজেকে সামলে ঠান্ডা মাথায় বলে,

-” আপু বাচ্চা ছেলে ভুল করেছে। বাচ্চারাই তো ভুল করে। তাই বলে সে মেন্টালি সিক নয়। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। ভোরও স্যরি বলবে। তুমি প্লিজ কথা বাড়িও না!”

রুবি ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।রূপ কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে পূর্বের চেয়েও দ্বিগুন তেজে বলে,

-” আমি কথা বাড়াচ্ছি? হুম? আমার ছেলেটা দম আটকে মরতে বসেছিল আর আমি কথা বাড়াচ্ছি। বড় ভাবী..”

আর বলতে পারে না। ভোর সোফা থেকে একটা কুশন তুলে রুবিকে ঢিল মেরে চিল্লিয়ে বলে,

-” ভোরের আম্মুকে বকছো কেন তুমি? ভোর আর কখনো ভালোবাসবে না তোমাদের!”

পাতা ভোরকে আবার জড়িয়ে ধরে চুমু দেয়। ‘বাবা আমার শান্ত হও’ বলে বিড়বিড় করে। ভোর শান্ত হয়ে আসে। রুবি এবার কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,

-” দেখেছো বড় ভাবী? কতটা বেয়াদব বনে গেছে। এরপরও বলবে এগুলো বাচ্চামো? হি’জ মেন্টালি সিক। জলদি কাউন্সিলরের কাছে যেতে পারো! নইলে ভবিষ্যতে তুমিই বেশি পস্তাবে‌। মিলিয়ে নিও আমার কথা! কতটা ভালোবাসি ওই বাচ্চাটাকে। মা চলে যাওয়ার পর কম যত্ন নিয়েছি! এখন দেখো? কথায় আছে না আপন আপনই হয় আর পর পরই।”

আসমা বেগম এগিয়ে এসে ধমকে রুবিকে বলে,

-” অনেক হয়েছে রুবি! এখন বেশিই বলছো! যাও ছেলেকে নিয়ে!”

রুবি যায় না ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। হঠাৎ কেমন যেন নীরবতা বিরাজ করে। থমথমে ভাবটা ফুটে ওঠে। কারো মুখেই রা নেই। সব চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে; শুধু নিঃশ্বাসের আনাগোনা! ভোরের ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের আওয়াজ শোনা যায় সাথে নাক টানার ক্ষীণ শব্দ। সব মিলিয়ে যেন আগত ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস! সেই ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসে ড্রয়িং রুমে। হাতের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে আসে অরুণ সরকার। তার হাঁটার শব্দে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। শ্বাস নিতেও যেন ভূলে গেলো! এখন কি হবে? অরুণ সরকারের আগমনে সবচেয়ে বেশি ঘাবড়ে যায় পাতা ও মিনু। মিনু ধীর পায়ে এগিয়ে এসে পাতার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পাতাকে ইশারা করে ভোর নিয়ে সরে যেতে। পাতা যেন হঠাৎ স্বয়ংবৎ হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাঁর।এখন এই তীব্র বেগে ঘনিয়ে আসা তুফানকে সে কিভাবে সামাল দিবে। সে ভোরকে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে করুণ চোখে চায়। অরুণকে দেখে রুবি ছেলেকে নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,

-” ভাইয়া ভোর..!”

অরুণ হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয়। ব্যাগটা টি টেবিলে ছুড়ে ফেলে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” ওকে ছাড়ো! ভোর এদিকে এসো?”

ভোর পাতাকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর মুখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। পাতা ভোরের কাঁধে হাত রেখে বলে,

-‘ ভোরের বাবা আমি সব বলছি। বাচ্চা ছেলে..”

তাকেও থামিয়ে দেয় অরুণ! শান্ত ঠান্ডা গলায় বলে,

-” সবটা শুনেছি আমি! তুমি সরবে না? এই ভোর রুমে চলো? চলো?”

বলেই ভোরের বাহু টেনে ধরে হাঁটা দেয়। ভোর চুপচাপ পা চালায়। ভয়ে পাতার বুকটা দুরুদুরু করে। সে ভোরকে টেনে ধরে অরুণের হাত থেকে ছাড়িয়ে বলে,

-” বাচ্চা ছেলে ভুল হয়েছে ক্ষমাও চাইবে। আমি কথা বলছি ওর সাথে!”

অরুণ ভয়ঙ্কর চোখে চায়। পাতার ভেতরটা যেন নড়েচড়ে ওঠে। অরুণের লালিমায় ছেয়ে যাওয়া ওই ছোট ছোট ভয়ঙ্কর চোখের ভাষা খুবই কঠোর। চোয়ালদ্বয় কঠিন; হাতের কপালের শিরা উপশিরা ত্বকের উপরিভাগ থেকেই দৃশ্যমান!ভোর পাতার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে অরুণের হাত ধরতেই অরুণ সপাটে তাঁর ফুলো নরম গালটায় সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। ভোর ছিটকে পড়ে ফ্লোরে। মিনু ডুকরে কেঁদে ওঠে নিমিষেই। পাতা তড়িৎ বেগে ভোরকে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়। ভোর কাঁদে না, ফোপায় না। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে পাতার বুকে মুখ গুঁজে থাকে। অরুণ ঝটকায় পাতার থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এলোপাথাড়ি কয়েকটি থাপ্পড় দেয় পিঠে, বাহুতে। পাতা শব্দ করে কেঁদে ওঠে। অরুণের হাত থেকে ভোরকে ছাড়িয়ে নেয়। ছোট্ট ভোর এখনো অনুভূতিহীন! টু শব্দটি করে না। আসমা বেগম, আভারি এগিয়ে আসে পাতার কাছে। অরুণ আবার তেড়ে আসলে পাতা তাকে ধাক্কা দিয়ে চিল্লিয়ে বলে,

-” খবরদার ভোরের বাবা! আর একটা মার ছেলেটার গায়ে পড়লে আমি পাতা আপনাকে তোয়াক্কা করবো না মোটেও!”

রুবি গম্ভীর গলায় বলে,

-” ভাইয়া মারছেন কেন ছেলেকে? ছেলেটাকে মেরে সমস্যার সমাধান মোটেই হবে না! আরো বিগড়ে যাবে। আর আপনি ছেলেটাকে মারলেন না মনে হলো আমি প্রতিবাদ করেছি বলে আমার গালেই মারলেন!”

অবাধ্য বেঈমান আঁখিতে ভরে ওঠা নোনা জল গড়িয়ে পড়তে চায়! অরুণ আঙ্গুল দিয়ে মুছে হেসে বলে,

-” তুমি ভুল বুঝছো রুবি! আমার ছেলেটা জেদি! একটু পসেসিভ! সবার ক্ষেত্রেই কিন্তু না। পাতাকে একটু বেশিমাত্রায় ভালোবেসে ফেলেছে তাই ওকে অন্য কেউ মা ডাকে সেটা সহ্য‌ করতে পারে না! আজ যেটা করেছে তার‌ পানিশমেন্ট পাবে সে। তবে আমার কলিজা মেন্টালি সিক নয় রুবি!”

আসমা বেগম শান্ত গলায় বলে,

-” অরুণ ঘরে যাও! পড়ে কথা হবে! যাও! রুবি? চলো আমার সাথে।”

বলে রুবির বাহু ধরে টেনে নিতে চায়। রুবি যায় না। তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অরুণের সম্মুখীন হয়ে বলে,

-” মা ব্যাপারটা এখনি মিমাংসা হওয়া উচিত! আপনি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না! বড় ভাবী সাথেই ছিল! আমার ছেলেটাকে কিভাবে থাপ্পড় দিলো। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো! দেখুন মাথায় জখম হয়ে গেছে। বড়বড় ক্ষতি হয়েছে কি না বলা যাচ্ছে না। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে মরতে বসেছিল! আমার ছেলেটার কিছু হলে তাঁর দায়ভার কে নিতো? আপনার ছেলে যেমন আপনার কলিজা আমাদের ছেলেও আমাদের প্রাণ! আপনার খারাপ লাগতে পারে বাট আমি বলবো ভোরকে কাউন্সিল করানোর দরকার!”

অরুণ পাতার বুকে লুকিয়ে থাকা ছেলের অবয়ব দেখে শক্ত গলায় বলে,

-” আমার ছেলে ভুল করেছে আমি স্বীকার করছি। আমি হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছি। ভোরও চাইবে। কিন্তু তুমি আমার ছেলেকে মেন্টালি সিক বলে পাগল‌ প্রমাণ করবে আমি অরুণ সরকার সহ্য করবো না।”

একটু থেমে আবার বলল,

-” আমার অবুঝ ছেলেটা যখন দেখতো তুমি আনি মামুনিকে আদর করছো, খাইয়ে দিচ্ছো! তখন তোমার পিছু পিছু ঘুর ঘুর করতো একটু আদরের আশায়! আবদারও করতো। তখন আনি মামুনি কেমন রিয়েক্ট করতো? ওর উপর চিল্লিয়ে উঠতো কিন্তু। ওরটা স্বাভাবিক হলে আমার ছেলে কেন মেন্টালি সিক হবে? ডোন্ট মাইন্ড!আমার ছেলে ভুল স্যরি অপরাধ করেছে আমি সর্বোচ্চ শাস্তি দিবো! চাইলে তোমরাও দিতে পারো আমি কিছু মনে করবো না।‌ বাট ওকে মেন্টালি সিক বলবে এটা আমি মোটেই সহ্য করবো না।”

রুবি এবার তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বলে,

-” আমি জানি সেটা। আপনাকে কিছুটা হলেও চিনি! আরিয়ানের থেকে আপনার স্বভাবের কথাও কিছুটা জেনেছি! আমার কথায় কিছু মনে করবেন না! আপনার স্বভাব আপনার ছেলে পেয়েছে! ওর এসব অ্যগ্রোসিভ আচরণে আজ আমার ছেলেটা মরতে মরতে বেঁচেছে ভবিষ্যতে..”

আসমা বেগম ধমকে ওঠে। রুবিকে চোখ রাঙিয়ে অরুণের উদ্দেশ্যে বলে,

-” ওর কথায় কিছু মনে কোরো না। বাচ্চার এ অবস্থায় মাথা ঠিক নেই!”

রুবি তাচ্ছিল্যভাবে তাকায়। অরুণ মুখাবয়ব আগের মতোই।

-” ছোট মা? বলতে দাও! ঠিক বলেছে। আমার ছেলে আমার মতো হবে না? লাইক ফাদার লাইক সন! আমরা দুজনেই মেন্টালি সিক! আন্তরিক ভাবে দুঃখিত যে আমাদের জন্য তোমার বাচ্চাটার এই অবস্থা! তবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারো! খুব শীঘ্রই এই অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষজন থেকে মুক্তি পেতে চলেছো!”

বলে টি টেবিল থেকে ব্যাগটা তুলে পাতার কাছে এগিয়ে যায়। ভোরকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। পাতা ছাড়ে না মোটেও। অরুণ ছোট করে বলে,

-” রুমে চলো ওকে নিয়ে!”

পাতা মিনুর দিকে একবার তাকিয়ে ভোরকে কোলে তুলে নেয়। ভোর মায়ের গলা জড়িয়ে থাকে। রুবির ও রূপের দিকে একনজর দেখে পাতার কাঁধে মুখ লুকিয়ে রাখে।

চলবে….

#পাতা_বাহার
লেখনীতে: #বেলা_শেখ
#পর্ব- ৪৭(বর্ধিতাংশ)

(কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)

থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে পুরো রুম জুড়ে;নিস্তব্ধ। পাতাবাহার চুপটি করে সোফায় বসে। ভোর গম্ভীর মুখে পাতার আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার বাবার মুখাবয়বে। পাতাও অরুণের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা দরজা বন্ধ করে সেই যে বিছানায় বসেছে। একটা কথাও বলে নি। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরুণের লাল চোখের ভেজা পাপড়ি দেখে পাতার সমস্ত রাগ উবে গেছে। ওভাবে ভোরকে মারায় সে অনেক রেগে ছিলো। কিন্তু তার লাল ক্রন্দনরত মুখটা দেখে পাতার মন খারাপ হয়। অতি আদরের ছেলেকে মেরে নিশ্চয়ই লোকটা মুছড়ে পড়েছে‌। ‌লোকটার মনের অবস্থাটা খুবই নাজুক। আজ তাঁর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী। তার উপর আজকের এই ঘটনা! পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরের দিকে তাকায়। ভোরও চায় গাল ফুলিয়ে। পাতা ইশারায় কিছু বলে! ভোর ছোট করে মাথা নেড়ে ডাকে,

-” আব্বু?”

-” আব্বু ডাকবে না। আমি কারো আব্বু নই!”

শক্ত গলায় বলে অরুণ সরকার। ভোরও কম না। সেও শক্ত গলায় বলে,

-” একশবার ডাকবো আব্বু! আমার আব্বুকে আমি আব্বু ডাকবে না তো কে ডাকবে!”

অরুণ তেড়ে আসে। ভোর পাতার পেছনে লুকিয়ে পড়ে।

-” লুকাচ্ছো কেন? সাহস থাকে বের হও! অনেক সহ্য করেছি আমি। যাস্ট পাগল‌ হয়ে যাবো আমি! দু চোখ যেদিকে যায় পালিয়ে যাবো!”

পাতার পিছনে ভোরকে ধরার চেষ্টা করে আর শক্ত গলায় বলে অরুণ। ভোর ধরা না দিয়ে গাল ফুলিয়ে বলে,

-” আমি আম্মু তোমার পিছু পিছু যাবো!”

অরুণ তার মন ভোলানো কথায় মোটেই ভুললো না। ভোরের বাহু ধরে সরিয়ে এনে শক্ত গলায় বলে,

-” মেরেছো কেন রূপকে? ভাই হয় না তোমার? বাচ্চা ছেলে একটুও মায়া হয় নি?”

-” না!”

জিদ্দি গলায় বলে ভোর অরুণ মারতে নিয়েও মারে না। পাতা অরুণের হাত থেকে ভোরকে ছাড়িয়ে নিতে চায় কিন্তু শক্ত বাঁধন থেকে মুক্ত করতে পারে না। অরুণ ভোরের চোয়াল শক্ত করে ধরে বলে,

-” বেয়াদব ছেলে! এতো জেদ, রাগ আসে কোথা থেকে শুনি? মা ডেকেছে তো কি হয়েছে! ডাকতেই পারে। এখুনি রূপ ও রুবির কাছে গিয়ে কান ধরে স্যরি বলবে! নইলে পিঠের চামড়া তুলে নিবো!”

ভোর বাবার দিকে সরাসরি তাকায়। চোখে তার পানি টলটল করছে কিন্তু গড়িয়ে পড়তে পারছে না।

-” বলবো না স্যরি! কেন বলবো? আমি ওকে কতবার বারণ করেছি ও কেন আম্মুকে মা ডাকবে? আমি ওর মাকে মা ডাকি? ওর মায়ের আদর নিই? তাহলে ও কেন নিবে?”

অরুণ ছেড়ে দেয় ভোরকে। বিছানায় রাখা ব্যাগটা থেকে একটা প্যাকেট বের করে। শত মলিনতার মাঝেও ছেলের আবদার করা রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার এনেছিল। সে প্যাকেট থেকে বের করে ফ্লোরে আছড়ে ফেলে। সেটা ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে যায়। পাতাবাহার লাফ দিয়ে এসে ভাঙ্গা খেলনার টুকরো গুলো নড়াচড়া করে মিও মিও করে ডাকে। পাতা ভোরকে আবার নিজের সাথে জড়িয়ে নিল। ক্ষ্যাপা ষাঁড় না আবার হামলে পড়ে বাচ্চাটার উপর! সে নমনীয় গলায় বলে,

-” ভোরের বাবা শান্ত হন! বাচ্চা ছেলে। বুঝিয়ে বললে বুঝতে পারবে!”

-” না বুঝবে না। ও তো ওর বাপের মতোই মেন্টালি সিক! সাইকো!”

পাতা অসহায় চোখে চায়। অরুণ আলমারি খুলে কাপড়চোপড় ছুঁড়ে ফেলে ফ্লোরে। বিড়াল শাবকটি তার পায়ের কাছে গিয়ে মিও মিও করে ডাকে। হয়তো বকছে! অরুণ ওয়াশ রুমে গিয়ে ধরাম করে দরজা লাগায়। সেই শব্দে ভোর পাতা চমকে ওঠে। পাতা ভোরকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ছোট মুখটা আঁজলায় ভরে। লাল টুকটুকে গালটায় আস্তে চুমু দেয়। ভোর নাক মুখ কুঁচকে নেয় ব্যাথায়। পাতা টি শার্ট খুলে দেয়। ফর্সা গায়ে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট। পাতা হাত বুলিয়ে বলে,

-” ভোর তো গুড বয়! এরকম কেউ করে? রূপ এই ছোট বাচ্চা। ও কি বোঝে নাকি! এভাবে মারে কেউ? তুমি না আমার সোনা ছেলে! চাচিমনি ও রূপকে স্যরি বলবে ঠিকাছে?”

-” না!”

পাতা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” তাহলে তো ভোর ব্যাড বয়!”

-” তো?”

-” আমি কোনো ব্যাড বয়কে আদর করবো না!”

ভোর মাথা তুলে তাকায়! কিছু বলে না।
এর মাঝেই অরুণ বেরিয়ে আসে। পড়নে শুধু শর্টস; হাঁটুর উপর! পাতা এমন পরিস্থিতিতেও খানিকটা লজ্জা পায়। অরুণ এগিয়ে আসে। পাতা খেয়াল করে লোকটার ডান হাতের পিঠ লাল হয়ে আছে। খানিক থেঁতলে গেছে। পাতা ঢোক গিলে বলে,

-” আপনি সত্যিই পাগল!”

অরুণ কিছু বলে না। ওষুধের বক্সটা খুলে কিছু ওষুধ মুখে পুরে ঢকঢক করে পানি পান করে। তারপর বিছানায় গা এলিয়ে দেয়! পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। ভোর আড়চোখে বাবাকে দেখে তার কাছে যায়!বাবার পিঠে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। অরুণ সরিয়ে দেয় সাথে সাথেই! পাতাকে উদ্দেশ্য করে রাশভারী গলায় বলে,

-” পাতাবাহার? ওকে বলে দাও আমাকে যেন না ছোঁয়। আমার গা না ঘেঁষে! আমার সাথে কথা না বলে!”

ভোর নাক টেনে ভঙ্গুর গলায় বলে,

-” কেন বলবো না? আম্মু আব্বু আমাকে মারলো আমি কিছু বলেছি? আমি ব্যাথা পেয়েছি অনেক তবুও কিছু বলি নি! মেরেছে আমায়! রাগ আমার করার কথা! আমি রাগ করি নি আব্বু কেন রাগ করবে? আমার সাথে এমন কেন করবে? ভোরকে আদর না করে, বুকে না নিয়ে কেন ঘুমাবে?”

কথা শেষ করে সে আবার বাবাকে জড়িয়ে ধরে। অরুণ ঝটকায় সরিয়ে দিলো। ভোরের চোখের পানি বাঁধনে ছাড়া হয়।

-” ভোরকে ভালোবাসবে না তো? ভোর মরে যাবে তখন কাঁদবে না বলে দিলাম!”

অরুণের মনে হয় কেউ তার গলা চেপে ধরেছে; শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সে। তবুও নিজেকে কঠোর রেখে বলে,

-” যাও মরে! অরুণ সরকার একা থাকতে জানে! আর একা থাকতে না পারলে আর কি হবে?সেও মরে যাবে।”

ভোর শব্দ করে কেঁদে দেয় এবার। পাতার মেজাজ বিগড়ে যায় এবার। ধমকে বলে,

-” কি শুরু করে দিয়েছেন দুজন? কষিয়ে দু’জনকেই দিবো! এতো কিসের মান অভিমান?”

ভোরের কান্নার শব্দ থেমে যায় তবে আঁখি যুগলের মাঝে এখনো অঢেল বর্ষণ! অরুণ বালিশে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকে। ভোর বাবার বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে! তবে বাবার গা একটুও স্পর্শ করে না। পাতা থমথমে মুখে কিয়ৎপল তাকিয়ে দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করে বলে,

-” অবেলায় ঘুমের প্রস্তুতি নেয়ার মানে কি? উঠুন দুজন! ভোরের বাবা? মনে হয় না সারাটা দিন কিছু মুখে দিয়েছেন! আমি খাবার আনছি!”

-” খাবার নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না!”

-” সে দেখা যাবে!”

বলেই পাতা বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। নিচে নামতেই নজরে আসে আরিয়ান সরকার। রুবি তার কাছে সব কথা গুছিয়ে বলছে। মিথ্যা বলছে না। যতটুকু ঘটেছে ততটুকুই! আরিয়ানের মুখটা গম্ভীর; ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখেছে। পাতা চুপটি করে কিচেনে যায়। সুফিয়া সেখানেই বসে আছে। পাতা তাকে খাবার দিতে বলে। এরইমাঝে আরিয়ান কিচেনের দরজায় এসে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” একটু কথা ছিল ভাবী!”

প্রথমবারের মতো মনে হয় পাতাকে সম্মানের সাথে ডাকলো আরিয়ান! পাতা মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে আসে‌ আরিয়ান বলতে শুরু করে,

-” তুমি উপস্থিত ছিলে সেখানে আশা করি কিছু বলতে হবে না! ব্যাপারটা মোটেই হালকা নয়! ভাই সবসময়ই এমন করে। বাচ্চা বাচ্চা ঝগড়া মারামারি হবে। তার কানে গেলেই কেন সে ভোরকে মারবে? এর মানে কি এটা দাঁড়ায় না যে আমাদের উপর ক্ষোভ বাচ্চাটার উপর দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে?”

পাতা একটু অবাক হয়ে বলে,

-” ভাইয়া আপনারা ভুল ভাবছেন!”

-” ভুল নয় বিভ্রান্তি! ভাই কে আমি চিনি ভাবী! রুবি ভাইকে কথা শুনিয়েছে কাজটা মোটেই ঠিক করে নি। তবে কথাগুলো তিক্ত হলেও কিছুটা সত্য! ভুল বুঝবে না আমায়! তোমরা যেদিন পার্টিতে গেলে সেদিনও ভোর হিংস্র ভাবে মেরেছে আমার মেয়েটাকে। মা ব্যাপারটা কাউকেই বলতে মানা করে কিন্তু মেয়ের গালে থাপ্পড়ের ছাপ দেখে আমার সন্দেহ হয়। আদুরিকে বলতেই ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়! ভোর মেন্টালি সিক না! তবে কিছুটা উগ্র! ওকে ভালোভাবে ভালোবেসে বুঝিয়ে বললেই হবে। কিন্তু ভাইকে এই ব্যাপারে বলতে গেলেই সে ছেলেটার উপর চড়াও হবে ভেবে আমি বলি নি। তোমাকে বললাম বুঝিয়ে বলো! আর রুবির তরফ থেকে আমি স্যরি বলছি!”

পাতার আর কিছু বলার থাকে না‌। আরিয়ান চলে যায়। পাতা সুফিয়ার দিকে তাকালে সুফিয়া আমতা আমতা করে বলে,

-” রান্না এখনো বসাই নাই বড় ম্যাডাম!গরম দুধ আর পাউরুটি আছে! দিবো?”

-” দাও! চকোসের প্যাকেটটাও দিও সাথে!”

সুফিয়া সব ট্রেতে দেয়। পাতা সেগুলো নিয়ে রুমে চলে আসে। অরুণ ও ভোরকে ডাকে‌। অরুণের কোন সাড়া পায় না। তবে ভোর উঠে বসে। পাতা অরুণের পিঠ ঝাঁকি দিয়ে ডাকে অরুণ বিরক্তের সাথে বলে,

-” ডোন্ড ইরিটেটেড মি পাতাবাহার! খাওয়ার মন মানসিকতা মোটেই নেই! দুবার যেন বলতে না হয়! ওকে খাইয়ে দাও!”

পাতা ঢোক গিলে। ভয়ঙ্কর কন্ঠ অরুণের! সে আর ডাকার সাহস করে না। ভোরকে নিয়ে বসায়। ভোর নাকচ করে বলে,

-” খাবো না!”

পাতা তার কথা উপেক্ষা করে বাটিতে চকোস ঢেলে দুধ ঢেলে দেয়। পাউরুটির স্লাইড দুধে হালকা করে ডুবিয়ে ভোরের মুখের সামনে ধরে বলে,

-” কোনো প্রকার না শুনবো না আমি!”

ভোর হাতে গাল মুখ মুছে বলে,

-” আব্বু না খেলে আমিও খাবো না!”

পাতা জোড় করে তার মুখে ব্রেড দিয়ে বলে,

-” সে খেয়ে এসেছে। তুমি খাও নইলে তোমার বাবা রেগে যাবেন আরো!”

ভোর ফোপাতে ফোপাতে বলে,

-” আমি জানি আব্বু খায় নি! তুমি ভালো করে আব্বুকে ডাকো না আম্মু!”

পাতা শান্ত চোখে চায়। ভোর ঘার ফিরিয়ে বারংবার অরুণের দিকে চাইছে। পাতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভোরের মুখে আবার ব্রেড দিয়ে বলে,

-” ভোর? আমার দিকে তাকাও?”

ভোর খাবার না চিবিয়েই গলাধঃকরণ করে পাতার দিকে তাকায়। পাতা তার গালে হাত বুলিয়ে বলে,

-” ভোর হয়েছে আর কাঁদে না! তুমি খেয়ে তোমার বাবার বুকে চুপটি করে শুয়ে থেকো! কিছু বলবে না। আমি আছি তো বাবা!”

ভোর মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। পাতা তাকে খাইয়ে দেয়। মুখটা মুছে দিয়ে কোলে বসায়! গালে মুখে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে গালে বরফ ঘষে দেয়। আদুরে গলায় বলে,

-” আমার সোনা ছেলে তুমি ভোর! আমি তো তোমার আম্মু! রুপের চাচিমনি। শোন চাচি, মামি ,খালামুনি আন্টিদের মাঝে একটু মা মা ভাইব থাকে। তুমি জানো কি না জানিনা আমরা কিন্তু চাচিদের আম্মা বলে ডাকি। বড় চাচি বড়ম্মা, ছোট চাচি ছোটম্মা! মামিদের মামুনি ডাকি! আমি তো আমার খালাকে মা ডাকি আর খালুকে বাবা! আমার খালাতো ভাই বোন কিন্তু মোটেও রেগে যায় না। একজন ভালোবেসে মা আম্মা ডাকতেই পারে। আমরা কিন্তু তিন ভাইবোন। লতাপু, লুব ভাই আর আমি! আমরা তিনজনই আমার আব্বু আম্মুকে আব্বু আম্মু বলেই ডাকি!আমরা কিন্তু কখনো এটা নিয়ে ঝগড়া করি নি। কারণ আমরা ভাই বোন।ভাই বোনের সম্পর্কগুলো খুব মিষ্টি হয়। একদম তোমার আইসক্রিমের মতো। রূপ আনিকা তোমার ভাই বোন! তুমি তো ওদের বড় ভাই। বড় ভাই হওয়া অনেক দায়িত্বের কাজ। তোমাকে ওদের দুজনকে আগলে রাখতে হবে। তোমার আব্বু যেমন তোমার আদুরি ফুপ্পি ও আরিয়ান চাচ্চুকে আগলে রাখে। তাদের স্নেহ করে তেমন তোমাকেও আগলে রাখতে হবে। কেউ ওদের ক্ষতি করতে চাইলে তুমি ঢাল হয়ে তাদের রক্ষা করবে। স্পাইডারম্যানের মতো! অথচ তুমি রূপকে কষ্ট দিয়েছো। সে তো ছোট্ট বাবু। এখনো ভালো করে হাঁটতেই পারে না। চারটে দাঁত মাত্র। কথাও বলতে পারে না। আ আ উউ পে পু করে! কিন্তু তুমি তো বড়। আমার কলিজার টুকরো ছেলে। আমি তোমাকে অন্নেক ভালোবাসি! সবচেয়ে বেশি। কারণ আমার আদুরে ছেলেটা খুব ভালো আর বুঝদার! আমাকে অনেক ভালোবাসে। সেই ভালো ছেলে হঠাৎ এরকম বাজে আচরণ করেছে। আমি কিন্তু খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার ছেলে কেন অন্য একটা বাচ্চাকে মারবে? সে রূপ বা অন্যকেউ। কখনো কাউকে আঘাত করতে নেই। তুমি তো আরবি পড়তে পারো। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কখনো কাউকে তিল পরিমাণ কষ্ট দেয় নি। তিনি বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করতেন। রূপ আনি তোমার ছোট, তুমি তাদের স্নেহ করবে! তুমি তোমার ছোট ভাইকে মারলে এটা তো খুবই বাজে কাজ! দেখো তোমার জন্য তোমার আব্বুও কষ্ট পেলো আম্মুও পেল! চাচিমনি আনি দাদি সবাই! আর রূপ কতটা ব্যাথা পেয়েছে! তুমি কাল সকালে জলদি করে উঠে রূপকে আদর করে দিও। চাচিমনির হাত ধরে স্যরি বলিও! ভোরের আম্মু ভোরকে অনেক ভালোবাসে। সাথে রূপ আনির চাচিমনি রুপ আনিকে ভালোবাসে।এতে তুমি কেন হিংসে করবে? হিংসুটে ছেলেকে কেউ ভালোবাসে না; আল্লাহ তায়ালাও না! বুঝলে?

আদর করে করে অনেক বোঝায়। ভোর কিছু বলে না। চুপচাপ শুনতে থাকে। বরফ ঘষা শেষ হলে পাতা ভোরকে নাপা সিরাপ খাইয়ে দেয়।সে বিড়ালছানার মতো গুটিসুটি মেরে বাবার বুকে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে! পাতা হাসে। বরফ কুচি সুতি কাপড়ে মুড়িয়ে অরুণের আঘাতপ্রাপ্ত হাতে ডলে দেয়। অরুণ হাত সরিয়ে নিতে চায় পাতা শক্ত করে ধরে রাখে।
______

থমথমে পরিস্থিতি আরিয়ানের রুমে বিরাজমান! রুবি চুপচাপ বিছানায় বসে। আনিকা মায়ের পাশে বসে আছে। আসমা বেগম ও আরিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ানের কোলে ঘুমন্ত রূপ! আসমা বেগম নিরবতা ভেঙ্গে রুবিকে বলে,

-” ভোর ভুল করেছে! সাথে তুমিও ভুল করেছো রুবি! বাচ্চা ছেলে ভোর। আর বাচ্চারা একটু হিংসুটে হয়। ভোর একটু বেশিই। মায়ের ভালোবাসা পায় নি; হঠাৎ পেয়ে ওর মনে একটু ভয় ঢুকে গেছে।বর্ষার ছেলেকে দেখেছে ভোর! ওর মনে হয়তো এই ধারনা জন্মেছে ওই ছেলে বর্ষাকে ভোরের থেকে দূরে নিয়ে গেছে। রূপ মা ডাকলে হয়তো ওর মনে হয় ওর মা’কে কেড়ে নেবে!”

রুবি থমথমে গলায় বলে,

-” মা এটাও এক ধরনের সিকনেস!”

-” মাইন্ড ইয়ুর ল্যাঙ্গুয়েজ রুবি! অসুস্থ নয় ভোর। এটা বাচ্চাদের একটু বাচ্চামো।আনিকাও করে‌। রূপের জন্মের পর আনিকাও কিন্তু এমন বিহেভ করতো; ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে।ভোর বুঝদার ছেলে।সেও বুঝবে। তুমি প্লিজ তোমার বিক্ষুব্ধ মনটাকে ঠিক করো!”

ধমকে কড়া সুরে বলে আরিয়ান। রুবি বেশ অপমান বোধ করে। আসমা বেগম আরিয়ানের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে। রুবির পাশে বসে নরম গলায় বলে,

-” রুবি আমি বুঝতে পারছি তোমার মনের অবস্থা ঠিক নেই। ছেলের ওমন অবস্থায় ঘাবড়ে গেছো। ভোরের ভুল আছে। পাতা যেমনটি বলল শান্ত ভাবে কথা বলে সব ঠিক করা যেতো! তুমি অরুণের কাছে জানাতে চাইছিলে সেটাও যেতো! কিন্তু সুশীল ভাবে গুছিয়ে। তাহলে ব্যাপারটা এতো দূরে এগোতো না। অরুণ নিশ্চয়ই ছেলেকে শাসন করতে কুণ্ঠাবোধ করতো না! কিন্তু তুমি ব্যাপারটা রাগের মাথায় তুললে। ইটস ওকে। তুমি ভোরকে দুটো কথা শুনিয়েছো। হয়েছে; পাতা বলেছিলো তো সে ভোরকে শক্ত করে বুঝিয়ে বলবে। কিন্তু তুমি অরুণ পাতাকে জড়িয়ে কথা শোনালে। তাদের পার্সোনাল ব্যাপার টেনে আনলে। পাতাকে ম্যানুপুলেট করার চেষ্টা করেছো অনেকটা! এটা বেশি হয়েছে! অরুণ আরিয়ানের বড় ভাই! সম্পর্ক তোমার ভাসুর! তুমি তাঁর সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে কটুক্তি করেছো। এটা তোমার ভুল ছিলো!”

রুবি দমে যায় না।

-” মা আপনি শুধু আমার দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন কিন্তু আমি আমার কোন দোষ দেখছি না। আমি সত্যটা বলেছি! আর অরুণ ভাইয়া কিভাবে কথা বলল? আমি তার উচিত জবাব দিয়েছি। কিন্তু জানেন তো সত্য কথা একটু তিক্ত স্বাদের হয় তাই হজম করতে পারে নি।”

আরিয়ান কঠিন চোখে তাকিয়ে বলে,

-” তুমি আমাদের সাজানো সংসারটাকে ভাঙ্গতে চাইছো রুবি! অরুণ সরকার ভাই হয় আমার। অতিতটা জমকালো না হলেও আমি আমার ভাইকে ভালোবাসি। একসাথে মিলেমিশে থাকতে চাই। তুমি কালই ভাইয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে দ্যাটস ইট!”

রুবি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে,

-” আমি কেন ক্ষমা চাইবো? আমি কোনো দোষ করি নি! ভাইয়ের চামচামি বন্ধ করো আরিয়ান। তোমার ভাই তোমায় গোনায়ও ধরে না।”

আরিয়ান জ্বলন্ত চোখে চায়। ছেলে মেয়ে আর মা উপস্থিত না থাকলে রুবির গালটা হয়তো রঙিন হতো!

-” আমার ভাই ভাস্তে সিক নয়। তুমি মেন্টালি আনস্টেবল রুবি! তোমার মনটা কলুষিত হয়েছে মা ভাবীর কুমন্ত্রনায়!”

-” আমার মা ভাবীকে টানছো কেন? হঠাৎ ভাই ভাবীর প্রতি দরদ উথলে পড়ছে তোমার! তোমার বাবা চলে যাওয়ার আগেও না ভাইয়ের গুনগান গাইতে!”

আসমা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে রুবিকে শক্ত গলায় বলে,

-” বেয়াদবি করবে না ছোট বউ!বাচ্চা মেয়েটা উপস্থিতি হয়তো ভুলে গেছো! বড্ড বাড়াবাড়ি করছো..”

থেমে যান আসমা বেগম। দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে। আরিয়ান আসমা বেগম একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে দেয়। আগমন ঘটে পাতার। ভিতরে প্রবেশ করে আরিয়ানের কোলে ঘুমন্ত রূপের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

-” কি অবস্থা বাচ্চাটার?”

-” ভালো! সেই যে ঘুমিয়েছে!”

-” আই’ম স্যরি ভাইয়া! ভোরের পক্ষ থেকেও স্যরি বলছি! আমি ভাবতে পারি নি ভোর এমনটা করবে! আমারি দোষ! আগে থেকেই ব্যাপারটা নিয়ে ভোরের সাথে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু এখন এসব বলে লাভ নেই।বাচ্চা ছেলে ভুল করেছে আপনারা কিছু মনে করবেন না। ওর বাবা বকেছে। আমি বুঝিয়ে বলেছি আশাকরি আর এমনটা হবে না। রুবি আপু আমি সত্যিই ক্ষমা চাইছি। তুমি প্লিজ বাচ্চাটার উপর রেগে থেকো না!”

রুবি কিছু বলবে আরিয়ানের গরম চাহনিতে কিছু বলতে পারে না। আরিয়ান নরম গলায় বলে,

-” ক্ষমা চাইতে হবে না। ভোর বাচ্চা ছেলে। ভুল হতেই পারে। তুমি একটু আদর করে বুঝিয়ে বললেই হবে!”

পাতা সায় জানালো। রুবি হঠাৎ করে বরফ শীতল গলায় বলল,

-” বড় ভাবী? তুমি প্লিজ আমার ছেলে মেয়ের থেকে দূরে থেকো! ভোর কখন কি করে বসে। আমার ছেলে মেয়ের সেফটি ফাস্ট প্রায়োরিটি!”

পাতা চমকায় না। সে একটু আগেল সব কথাই শুনেছে। সে নিচে এসেছিল অরুণের জন্য খাবার আনতে। সাথে রূপকে দেখতে। রুমের বাইরে থেকেই উঁচু গলায় কিছু কথোপকথন কানে বাজে তাঁর। আড়ি না পাতলেও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনতে পায় সে। পাতা রুবির দিকে তাকিয়ে বলে,

-” রুবি আপু তোমার এই কথাটার মানে কি দাঁড়ালো? আপু ভোর একবার ভুল করেছে।এর মানে এই না সবসময় করবে। তুমি তখনও বারবার বলেছো ভোর মেন্টালি সিক! ভেবে দেখেছো এই কথাটা ভোরের উপর প্রভাব ফেলতে পারে! মানছি ছেলের অমন অবস্থায় তুমি ঘাবড়ে গিয়েছিলে তাই বলে এভাবে বলবে? তোমাদের চোখের সামনেই তো বড় হয়েছে আমার চেয়ে ভালো তোমরা চেনো তাকে। তবুও এই কথাটা বলতে একবারো বুক কাঁপে নি!?”

রুবি হেসে ওঠে শব্দ করে।‌হাসতে হাসতেই বলে,

-” তুমি আবেগী নাকি ঢংগী! যাই হোক। এখন আমার ছেলে আমার ছেলে জপছো আর কটা দিন যাক নিজের পেটের দুই একটা আসুক তখন দেখবো ছেলের প্রতি কতখানি ভালোবাসা অবশিষ্ট থাকে। বাস্তবতা বড়ই কঠিন বড় ভাবী। আপন পর হয়ে যায় সেখানে সৎ তো গলার কাটা বেড়োলো বলে!”

কথাটা পাতার গায়ে লাগে। সে শক্ত গলায় বলে,

-” বাস্তবতা সত্যিই কঠিন। যেখানে আপন মা সন্তানের মাঝেই তিক্ততা আসে; বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়; ডাস্টবিনে নবজাতককে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে সৎ নামক জটিল সম্পর্কটার কথা নাই হলো! তবে এতো সব তিক্ততার মাঝেও কিন্তু ভালোবাসা নামক ভরসার স্থান এখনো টিকে আছে। ভোর আমার গর্ভজাত সন্তান না হলেও আমি তার মা! মা’ নামক অনুভূতি থেকে অপরিচিত হলেও ভোর যখন আম্মু বলে ডাকে আমার অন্তঃস্থল যেন পরিপূর্ণতায় ছেয়ে যায়। আমি সৎ আপন বুঝতে চাই না। আমি শুধু এটুকু বুঝতে চাই আমি ভোরের আম্মু। ভোর আমার ছেলে। তবে হ্যাঁ মানুষ পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে আপনে আপ তার মাঝে পরিবর্তন সাধিত হয়। যদি এই পাতার মাতৃহৃদ কুঠিরে ভোরের জন্য তিল পরিমাণও ভালোবাসার ঘাটতি দেখা যায় তখন যেন এই পাতা অভিশাপের অনলে দগ্ধ হয়ে ছাই হয়ে ফুরিয়ে যায়।”

কথা শেষ করে দাঁড়ায় না পাতা। বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। আজ পাতা নতুন করে ভেঙ্গে গড়ে উঠলো যেন। এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলো সে। এই চ্যালেঞ্জ রুবির সাথে নয়। নিজের সাথে নিজের চ্যালেঞ্জ! উজানের ঢেউয়ে ভাসমান পাতার ঘুরে দাঁড়ানোর দৃঢ় প্রত্যয়। পাতার আঁখি যুগল এবার ভরে ওঠে না‌। সে কিচেনে গিয়ে রুটি অমলেট ও একগ্লাস গরম দুধ ট্রেতে করে নিয়ে রুমে যায়! ভেজানো দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই তার চোখজোড়া যেন শীতল আবেশ শান্ত হয়ে যায়!

অরুণ সরকার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে আলতোভাবে চুমু দিচ্ছে যেন ব্যাথা না পায়। ছোট আদুরে মুখটায়, বুকে, পিঠে, বাহুতে। বিড়বিড় করে বলছে,

-” আমার আব্বু! আমার মানিক সোনা! কলিজা। আমার জান!”

কিন্তু ছোট ভোর চুপচাপ। সে ঘুমের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছে। জেগে থাকলে দেখতে পেতো তার বাবার চুড়ান্ত পর্যায়ের পাগলামো।অরুণ ছেলের রক্তিম হয়ে যাওয়া গালে আলতো চুমুতে ভরিয়ে দিল আবার!
পাতা দাঁড়িয়ে দেখে এক পাগলাটে বাবার অসীম ভালোবাসার সমারোহ। বাবারা এমন হয়? কই তাঁর বাবা তো তাকে কখনো এভাবে আদর করে নি। এতোটা স্নেহের সাথে আদর করা দূর ডাকেই নি। পাতা টি টেবিলে খাবার রেখে দরজা বন্ধ করে আসে। বিছানার পাশে দাড়িয়ে বলে,

-” যতোটুকু ব্যাথা দিয়েছেন তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ব্যাথার ছাপ আপনার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ভোরের বাবা!”

অরুণ ছেলের মাথাটা বুকে চেপে কম্ফোর্ট দিয়ে ঢেকে পাতার দিকে তাকায়! কিছু বলে না। পাতা একটা প্লেটে রুটি অমলেট এনে বিছানায় উঠে বসলো।

-” চুপচাপ ভদ্র বাচ্চার মতো খেয়ে নিবেন। আপনার উপর কিন্তু আমি রেগে আছি!”

-” খাবো না পাতাবাহার। তুমি খেয়ে এসে শুয়ে পড়ো!”

পাতা রুটি ছিঁড়ে শাসনের সুরে বলে,

-” কোন কথা না! কি ভাবেন নিজেকে হুম? ফিল্মের হিরো! সব নিজের ভিতর চেপে রেখে দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়াবেন? শুনুন আমি পাতা আপনার টুঁটি চেপে টেনে আনবো! আসছে হিরো আলম! চুপচাপ খাবার গলাধঃকরণ করুন!”

অরুণ শুয়ে থেকেই খাবার চিবোতে থাকে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। পাতা বলে,

-” বাচ্চারা ভুল করবে স্বাভাবিক কারণ তাঁরা বাচ্চা। তাদের কাজই ভুল করা। আর বড়দের কাজ হলো তাদের ভুলটা বুঝিয়ে তাকে সাবধান করা! শাসনের নামে নির্যাতন করা নয়। ওভাবে কেউ বাচ্চাকে মারে?”

অরুণ ছেলের মাথায় চুমু দিয়ে বলে,

-” কন্ট্রোল করতে পারি নি। আমার হাত বেশি চলে পাতাবাহার‌। রুবির কথায় মাথা ভোঁ ভোঁ করছিলো!”

পাতা অরুণের মুখে রুটি অমলেট দিয়ে বলে,

-” তাই মেরে দিলেন! ছেলেটা ব্যাথা পেয়েও ট্যু শব্দটি করে নি। ভোরের বাবা নিজের রাগ টাকে আয়ত্তে আনতে শিখুন। রাগ মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়।”

অরুণ কিছু বলে না। তাঁর ছোট চোখ জোড়ায় ঘুম নামে। পাতা জোড় করে দুটো রুটি খাইয়ে দেয়। দুধের গ্লাস মুখে ধরলে অরুণ মানা করে। পাতা চোখ রাঙায়। অরুণ একটুখানি মুখে নিয়ে বারণ করে খাবে না। পাতা আর জোড় করে না। খেয়েছে এই অনেক। সে তো ভেবেছিলো ধমকে তাকে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে দিবে।

পাতা ভোরের পাশে বসে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। বালিশে কনুই ভর দিয়ে তাকিয়ে থাকে বাবা ছেলের দিকে। ভোরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কপালে গায়ে হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে। গা একটু গরম! তবে হাত পা গুটিয়ে বাবাকে জড়িয়ে শুয়ে আছে। শীত করছে হয়তো। পাতা একটু এগিয়ে এসে জড়িয়ে নেয়। অরুণের চুলের মাঝে হাত গলিয়ে কপালে চুমু দেয়। অরুণ সরকার চোখ খুলে তাকালো। পাতা খানিক অস্বস্তিতে পড়ে। লোকটা মহা ধরিবাজ! সে স্বাভাবিক গলায় বলে,

-” ঘুমান নি?”

-” ঘুমের ওষুধ খেয়েও চোখে ঘুম নামছে না। ছেলেটার গা গরম!”

অরুণের ভগ্ন কন্ঠস্বর। পাতার কেমন যেন লাগলো! তাঁর চুলের ভাঁজে থাকা হাতটা কপোলে এসে থামে আশ্বস্ত করে বলে,

-” নাপা সিরাপ খাইয়ে দিয়েছি। চিন্তা করবেন না। আপনি ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন কেন?”

অরুণ উত্তর দেয় না। সে মাঝে মাঝে খায় ঘুমের ওষুধ। ডাক্তারের অনুমতিতেই। পাতা মলিন চোখে চায়। লোকটা তাঁর সাথে কোন কথাই শেয়ার করে না। সে জিজ্ঞেস করলেও চুপ থাকে। পাতা আবার ঝুঁকে এসে অরুণের গালে চুমু দিয়ে বলে,

-“চিন্তা বাদ দিন। ঘুমিয়ে পড়ুন!”

অরুণ চোখ বুজে নেয়। পাতা তার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বালিশে মাথা রাখে! ভোর ঘুমের ঘোরে নড়ে চড়ে এপাশে ফেরে। পাতার দিকে সেটে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখে। ছোট হাতে পাতার মুখাবয়ব হাতরে ‘আম্মু আম্মু’ বলে বিড়বিড় করে। পাতা তার কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” আম্মু আছে তো!”

ভোরের বিড়বিড় থেমে যায়। পাতা ঝুঁকে ভোরের গালে চুমু দিয়ে চোখ বন্ধ করে। সাথে অনুভব করে একটা বলিষ্ঠ বাঁধনে তাকে বাঁধা হয়েছে।একজোড়া উষ্ণতায় ভরপুর ওষ্ঠাধর তার ললাট ছুঁয়ে যায়। পাতা চোখ খোলে না; পরম আবেশে ঘুমে তলিয়ে যায়।
_____

আবছা কুয়াশায় ঢাকা বাড়ির আঙিনায় ভোরের পাখি ডাকছে অহরহ। যেন ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছে এঁকে অন্যের সাথে। বেলকনির গ্রিলে আজকেও ছোট ছোট চড়ুইয়ের আগমন ঘটেছে। তাঁরা ভিতরে প্রবেশ করতে চায় কিন্তু পারে না। বেলকনির টবের সাথে ঘেঁষে বসে আছে পাতাবাহার। লেজটা তাঁর নড়ছে সাপের মতো। ভাব এমন যেন ভিতরে এলেই গিলে খাবে। কঠিন তদারকি তাঁর। তবে তাঁর চোখ ফাঁকি দিয়েই একটা চড়ুই পাখি উড়ে আসে ভিতরে। বিড়ালটি বুঝতে পেরেই মিও মিও করে লাফাতে থাকে পাখিটিকে ধরার উদ্দেশ্যে। পাখিটি নিজেকে বাঁচাতে উড়ে ঘরে প্রবেশ করে। পাতাবাহার তাঁর পিছু পিছু দৌড়ায়। পাখির ‘চিও চিও’ ও পাতাবাহারের ‘মিও মিও’ শব্দে ভোরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ ডলে পিটপিট করে চায়। ঘরে পাখি উড়তে দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু পাতাবাহারকে পাখিটার পিছনে লাগতে দেখে চিল্লিয়ে বলে,

-” এই পাতাবাহার?”

পাতা ধর ফরিয়ে ওঠে।গোল গোল করে তাকায়। ভোর জিভে কামড় দিয়ে বলে,

-” আম্মু তোমাকে বলি নি। ওই বিড়ালকে বলেছি!”

পাতার মস্তিষ্ক কার্যকর হয়। ভোরের গাল টিপে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় হামি তুলে বলে,

-” শুভ সকাল!”

ভোর পাতার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

-” আম্মু দেখো পাতাবাহার পাখিটাকে ধাওয়া করছে!”

পাতা তাকিয়ে দেখে, সত্যিই। সে কড়া গলায় বিড়ালটিকে ডাকে,

-” এই অরুণ সরকারের ছা’পোষা?”

ভোর হেসে ওঠে সম্মোধন শুনে। পাতাবাহারও যেন বুঝতে পারলো তাকে তলব করেছে। সে পাখির পিছু না নিয়ে লাফ দিয়ে বিছানায় পাতার কোলে ওঠে। পাখিটি উড়ে বেরিয়ে গেল।
পাতা বিড়ালটিকে সরিয়ে দিয়ে নাক সিঁটকায়। পাতাবাহার আড়চোখে তাকিয়ে গুটি গুটি পায়ে লেজ নাড়িয়ে সোফায় গিয়ে বসে। ভোর হাসে। পাতা তার গালে ঠোঁট ডাবিয়ে চুমু খায়। হাসলে ভোর সরকার পুরোই রসে টইটম্বুর রসগোল্লা! ভোরের হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে। সে বিছানায় তাকায়। বাবা নেই; তার ছোট মনে ভয় নামক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাবা কাল বলেছিলো চলে যাবে। সত্যিই চলে গেছে? ভোর কে ফাঁকি দিয়ে! ভাবতেই তার চোখ ভরে ওঠে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

-” ও আম্মু? ভোরের আব্বু কোথায়?”

পাতা খানিক চিন্তায় পড়ে।

-” হাঁটতে গেছে। আসলো বলে! কি হয়েছে?”

-” কিছু না। ওই ওয়াশ রুমে যাবো!”

পাতা হেসে তাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়। ফ্রেশ করিয়ে বিছানায় বসিয়ে টি শার্ট গায়ে গলিয়ে দেয়! নিজেও ফ্রেশ হতে যায়। ভোর বিছানায় বসে থাকে গালে হাত দিয়ে। কিছু সময় পরে বিছানা থেকে নামে! থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গুটি গুটি পায়ে নিচে নামে। ড্রয়িং রুমে আনি, রূপ ও চাচ্চুকে দেখে এগিয়ে যায়। কিন্তু কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। চাচ্চু যদি আব্বুর মতো মারে, বকা দেয়?

আরিয়ান ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ছেলেটার জ্বর এসেছে রাত্রেই। এখন কিছুটা কমেছে। আনিকা বাবার পাশে বসে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। ভোরকে দেখে ভেংচি কেটে বিড়বিড় করে ‘পঁচা ছেলে’ বলে। ভোর বুঝতে পেরে চোখ রাঙায়! আনিকা জিভ বের করে ভেঙায়। বাবাকে ইশারায় ভোরকে দেখায়! আরিয়ান ঘার ফিরে ভোরকে দেখে। মুচকি হেসে বলে,

-” কাম ভোর?”

রূপ ভোরকে দেখে হেসে দেয়! ‘ভু ভু’ বলে কাছে ডাকে। ভোর মাথা নিচু করে এগিয়ে যায়। রূপের জন্য তার একটু একটু কষ্ট হচ্ছে।রূপ ভোরের গলায় হাত রেখে মুখ এগিয়ে গালে মুখ লাগিয়ে লালা মেখে আ’মা আ’মা ডাকে। ভোরের একটু একটু রাগ হয়। তবে ভালোও লাগে। সে রূপকে কোলে নিয়ে গালে চুমু দেয়। বিড়বিড় করে বলে ‘ভোর অনেক গুলো স্যরি’। আরিয়ান শুনতে পায়। হেসে ভোরের চুল এলোমেলো করে দেয়। ভোর চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ভোর ভেরি ভেরি স্যরি চাচ্চু! আর হবে না। রূপ তো আমার ভাই হয়। ভোর তার ভাইকে কখনও মারবে না। শুধু স্নেহ করবে! প্রমিজ!”

আরিয়ান মুচকি হেসে বলে,

-” এই তো গুড বয়! আমাদের ভোর কতটা বুঝদার! শুধু মাঝে মাঝে একটু ভায়োলেন্ট বনে যায়। রূপ তোমার ছোট ভাই আর আনিকা ছোট বোন! তুমি তো সবার বড় ভাই! তুমি ওদের দেখে রাখবে। এটা তোমার দায়িত্ব।”

ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। তখনি কেউ ভোরের কোল থেকে রূপকে কেড়ে নেয়। ভোর চাচিমনিকে দেখে ঘাবড়ে যায়। রুবি ভোরকে কিছু না বলে আরিয়ানকে বলে,

-” সব ভুলে গেছো? হাত কাঁপে নি ওর কাছে বাচ্চা দিতে?”

-” না কাঁপে নি। একাই গেছে ছেলে তার ভাইয়ের কাছে; তাও হাসিমুখে।”

আরিয়ানের স্পষ্ট জবাবে রুবি জ্বলে ওঠে। ভোর মিনমিনে গলায় বলে,

-” ভোর ভেরি ভেরি স্যরি! আর কখনো মারবো না রূপকে। অনেক ভালোবাসবো! স্নেহ করবো!”

রুবি ভোরের আদুরে গলায় গলে না,

-” তোমার ভালোবাসা স্নেহের দরকার নেই আমার ছেলে মেয়ের! ওদের থেকে দূরে থাকবে।”

আরিয়ান শক্ত গলায় বলে,

-” রুবি বড্ড বাড়াবাড়ি করছো তুমি!”

-” ভোর সত্যিই অনেক স্যরি!”

রুবি ছেলেকে নিয়ে হনহন করে চলে যায়। ভোর ভরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখে। কেউ তার কাঁধে হাত রাখলে ভোর মাথা উঁচিয়ে তাকায়। আম্মুকে দেখে ভোর বলে,

-” আমি আব্বুর কাছে যাবো!”

পাতা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

আরিয়ান এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে গালে চুমু দিয়ে বলে,

-” চাচিমনির কথায় রাগ করে না ভোর! এখন একটু রেগে আছে। পড়ে আদর করে পুষিয়ে দেবে!”

ভোর মাথা নাড়ে। আবার বায়না করে বাবার কাছে যাবে। আনিকা চায়ে চুমুক দিয়ে বলে,

-” বড় চাচ্চু তো সেই সকাল সকাল রেডি হয়ে অফিসে চলে গেল!”

পাতার ভ্রু কুটি কুঁচকে যায়।

-” অফিসে গেছে? এতো সকালে?”

-” হুম! আমি ডাকলাম কতবার করে! ভাই ফিরেই তাকালো না। হনহনিয়ে চলে গেলো।”

আরিয়ানের কথায় ভোর এবার কেঁদে ওঠে। বাবা তাকে রেখে চলে গেছে! আব্বু তাঁর উপর রাগ করে চলে গেছে!
হঠাৎ ভোরের কান্না দেখে পাতা, আরিয়ান ঘাবড়ে যায়। আনিকা নাক মুখ কুঁচকে বলে,

-” বড় চাচ্চু ঠিকই বলে। ভোর ছিঁচকাদুনে ছেলে। কিছু হলেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদবে!”
______

-” বস? হঠাৎ ফ্ল্যাটে উঠার সিদ্ধান্ত নিলেন যে?”

-” তোমাকে যেটা বলেছি সেটা করো সুজন! বাড়তি কথা আমি শুনতে পছন্দ করি না। বিকেলের মধ্যেই ফ্ল্যাটের সব কিছু গুছিয়ে রাখবে। কাল সকালেই ফ্ল্যাটে উঠবো।”

সুজন সায় জানিয়ে চলে যায়। কিন্তু সে ভেবে পায় না হঠাৎ বস কেন ফ্ল্যাটে উঠবে? এতো বড় বাড়ি রেখে ফ্ল্যাট! স্যারের দুটো ফ্ল্যাট আছে। একটা অফিসের কাছেই; বিদেশি ক্লায়েন্ট, বায়ারদের আগমন ঘটলে সেটায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আরেকটা মেইন রোডে।

সুজন বেরিয়ে যাওয়ার পর অরুণ ল্যাপটপে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মনোযোগী হতে পারে না।‌হবেই বা কি করে প্রাণভোমরার সাথে কথা হয় নি সকালে। মন ভরে আদর করে নি। চুপচাপ চলে এসেছে। পণ করেছে কথা বলবে না যতক্ষণ পর্যন্ত ছেলে ভুল বুঝতে পারে। শত চেষ্টা করার পরেও কাজে মন না দিতে পাড়ায় অরুণ উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে। পিয়নকে ডেকে কড়া লিকারের চা দিতে বলে। মিসেস রুনার ডেস্কটপে গিয়ে কিছু অফিসিয়াল কথা বলে। হঠাৎ অতিপরিচিত প্রিয় ডাক ভেসে আসে কর্ণগহ্বরে! অরুণ এগিয়ে আসে।

ভোর আব্বু বলে ঝড়ের বেগে ছুটে আসে। অরুণের পা জড়িয়ে কেঁদে ওঠে ঝরঝরিয়ে। অরুণ ভোরকে তুলে আদরে ভাসিয়ে দেয় না। শান্ত ভঙ্গিতে বোঝার চেষ্টা করে, কি হলো? সামনে তাকাতেই পাতাকে দেখে; আসছে হনহনিয়ে। লং টি শার্টের সাথে সালোয়ার! গায়ে বড় শাল জড়ানো! অরুণ অবাক হয়! এরা এখানে?

পাতা এগিয়ে আসে। হাঁপিয়ে গেছে সে।

-” ঘুম থেকে উঠেই আপনার খোঁজে। আব্বু যাবো আব্বু যাবো বলে কাঁদছে। কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না। মনে হয় ভোর দুধের শিশু আর আপনি তার মা! নিন একটু শান্ত করুন!”

বলেই পাতা মিটমিট করে হাসে। অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে চুমু খায়। তবে কথা বলে না। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে বলে,

-” আমি রূপ, চাচ্চু, চাচিমনি সবাইকে স্যরি বলেছি! সত্যিই বলছি! আম্মুকে জিজ্ঞেস করো! ভোর আর রূপকে মারবে না। শুধু ভালোবাসবে আর স্নেহ করবে। আনি’কেও!”

অরুণ পাতার দিকে চায় সন্দেহ চোখে। পাতা পলক ঝাপটিয়ে আশ্বস্ত করে। অরুণের অধরকোণে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলেকে পাঁজা কোলে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে ডাকে,

-” আমার কলিজা! আমার আব্বু!”

চলবে….