#প্রিয়_বিকালফুল(৩৩)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বাসায় সবাইকে জানিয়ে, এক রকম তাড়াহুড়ো করেই নিতুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো উৎস। প্রথমে ডাক্তার দেখিয়ে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ কিনে নিজেদের বাসায় ফিরল। জলপট্টি, খাবার, ওষুধ ইত্যাদির পর একটু ফ্রি হলো উৎস। নিতুকে সোফায় বসিয়ে রেখে নিজেই টুকটাক রুমটা গুছিয়ে ফেলল যতটুকু অগোছালো ছিল। বিছানা পরিষ্কার করে নিতুকে বিছানায় শুইয়েও দিল। রাত বেড়ে চলেছে। উৎস নিতুর পাশে এসে বসলো। নিতু চোখ বন্ধ করে আছে। উৎস কপালে হাত রাখতেই চোখ খুললো সে। উৎস মৃদু গলায় বলল,
“এখন কেমন লাগছে? ব্যথাটা হয়তো সকালেই কমে যাবে।”
নিতু ডান হাতে নিজের কপাল ডলে বলল,“এখন একটু ভালো লাগছে।”
নিতুর মন খারাপ স্পষ্ট না হলেও বোঝার মতো। তবে যে কেউ দেখে ভাববে অসুস্থতায় শরীরের সাথে মনটাও খারাপ। উৎসেরও তাই হলো। নিতুর মুখ মলিন দেখে একবার অসুস্থতা আবার আরেকবার অন্যরকম কিছু ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে তার। মনের দোটানা ঘুচাতে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,
“তোমার মন খারাপ নাকি অসুস্থতার জন্য এমন দেখাচ্ছে তোমায়? বিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছি বলে রাগ করেছ আমার ওপর?”
নিতু কিছুক্ষণ চুপ রইল। ধীরে ধীরে উঠে বসার চেষ্টা করতেই উৎস উঠে বসতে সাহায্য করল। দুই পা মেলে দিয়ে বসে দুই হাতের আঙুল কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে মাথানিচু করে বলল,
“জুই তোমাকে এখনো ফোন করে?”
উৎস ভ্রু কুঁচকে শুধালো,”আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“উল্টো প্রশ্ন না করে উত্তরটা দাও প্লিজ।”
“তোমার কি আমাকে নিয়ে কোন কারণে ভয় জন্মালো?”
“আবার প্রশ্ন!”
নিতু রাগি চোখে তাকাতেই উৎস দুই হাত উঁচু করে নিতুকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলে উঠল,“আচ্ছা আচ্ছা, শান্ত হও।”
উৎস নিতুর দিকে এগিয়ে এসে বসল আরও কিছুটা। চোখে চোখ রেখে শুধালো,“কিছু হয়েছে?”
নিতু চকিতে জবাব দিল,”আপনাকে জুই এখনো কল দেয় কি না আমি শুধু সেটাই জানতে চেয়েছি।”
“শেষ কল দিয়েছিল হয়তো মাস ছয়েক আগে।”
“না।”
“কী না?”
“তার শেষ কল ছিল আজ।”
অবাক হলো উৎস। ভাঙা ভাঙা শব্দে শুধালো,
“আ আজ!”
“হ্যাঁ আজ। ও বাড়িতে থাকাকালীন।”
“রিসিভ করেছিলে?”
“না। রিসিভ করা উচিত ছিল?”
উৎস দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে বেশ বুঝতে পারছে, কোন এক সমস্যা এখান থেকে তৈরি হতে পারে। জুইয়ের কল করার পিছনে উৎসের কোন হাত নেই সেটা বুঝেও জুই ফোন করেছে এই বিষয়টা নিতু কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। এ থেকেই সৃষ্টি হতে পারে বড় কোন সমস্যা। সবকিছু ভেবেই উৎস বলল,
“আমার সিমটা ব্যবহার করছি অনেক বছর যাবৎ৷ কাজের জায়গায়, আত্মীয় সব জায়গায় এই নম্বর ব্যবহার করা হয়। এমন কিছু জায়গায় যোগাযোগের জন্য দিয়ে রাখা যেখানে আমি আমার নতুন নম্বর পৌঁছে দিতে পারব না। বাকি রইল জুইয়ের কথা। তোমার মনে হয়, সে আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেই আমি তাকে সফল হতে দেব? আমাকে এমন মানুষ মনে হচ্ছে যে কি না প্রাক্তনকে বর্তমান করার কথা ভাববে?”
নিতু মাথানিচু করে বলল,“আমি সেরকম কিছু বলিনি।”
“মন খারাপ করেছ নিশ্চয়ই৷ যদি বলো মন খারাপও করোনি তবে আমার ভাবতে হবে তুমি আমাকে ভালোবাসোনি।”
নিতু মাথা তুলে উৎসের দিকে চাইলো। উৎস ফের বলল,“ব্ল্যাকলিষ্টে জুইয়ের অসংখ্য নম্বর পড়ে আছে। আমি বলতেও পারব না ঠিক কতগুলো নম্বর সেখানে আছে৷ আমি নিজের ওপর আস্থাশীল। আশা করব তুমিও ভরসা করবে৷ জীবনে সুখের সময়ে এরকম দুই একটা হাওয়া বইতে চাইবে, তুমি পাত্তা দিলে সব ধ্ব*ংস করে দেবে আর পাত্তা না দিলে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে৷ সুতরাং তার কলে মন খারাপ বা ভাবাভাবির কিছু নেই। ”
নিতু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল৷ উৎসের বুকে আলতো করে মুখ গুজে বলল,“তুমি শুধু আমার।”
উৎস একহাতে নিতুকে জড়িয়ে নিল। অন্যহাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল, “অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। সবসময় আমি শুধু তোমার। এটুকু ভরসা অন্তত আমার ওপর রেখো। ”
গোটা দুইদিন লেগে গেল নিতুর পুরোপুরি সুস্থ হতে৷ পায়ের ব্যথা ঠিক হতে একটু সময় নিল৷ জ্বর গতকাল অবধি হালকা ছিল। পথ্য এবং উৎসের সেবার সব অসুখ তিন দিনের মধ্যেই বিদায় নিল। এই অভিজ্ঞতা নিতুর এবার দিয়ে দুইবার। সে এবারে নিশ্চিত তার ব্যক্তিগত পুরুষ অসম্ভব যত্ন করতে জানে।
নিতু এবং উৎস আজ পুনরায় বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছে। দুজনে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। গাড়ি স্বল্প গতিতে এগুচ্ছে৷ জানালার কাচ খোলা। মৃদু হাওয়া আসছে ভেতরে। উৎস ড্রাইভ করছে আর কিছুক্ষণ পরপর নিতুকে দেখছে। নিতু একমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে।
“মন খারাপ?”
উৎসের প্রশ্নে ফিরে তাকালো। চোখে-মুখে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে বলল,
“উহু। মন খারাপ না। বাহিরটা দেখছিলাম।”
“ভেতরে আস্ত সুদর্শন একজন পুরুষ বসে আছে তাকে না দেখে তুমি বাহিরটা দেখছো?”
নিতু মুচকি হেসে জবাব দিল,“প্রায় তিনদিন সুদর্শন পুরুষকে দেখে দেখে বের হয়েছি।”
“খায়েশ শেষ? ”
নিতু উৎসের দিকে এক পলকে চেয়ে রইল। “আপনাকে দেখার, কাছে থাকার খায়েশ এত জলদি শেষ হলে তো কাহিনী অনেক আগেই খতম হয়ে যেত।”
রাতে গানের আসর বসেছে। সন্ধ্যা পরপরই নাশতা নিয়ে বসেছিল সবাই৷ সেখান থেকেই নাশতা শেষ করে গানের আসর, আড্ডা শুরু হয়েছে। নতুন বর-বউ বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার আগে। বিয়ের পরদিনই বাবার বাড়ি যেতে হয়েছিল এবং আজ ফিরতে হয়েছে। নিতুর সাথে নতুন বউয়ের সেরকম আলাপ না হয়ে ওঠায় নিতুর খালাশাশুড়ি স্বয়ং পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন৷ নতুন বউয়ের ভাষ্যমতে, নিতুকে সে কিছুটা চেনে পরিচিত মুখ তার কাছে।
গানের আসরে ছোট বড় সবাই বসেছে। একটা বোতল মাঝখানে রাখা হয়েছে যেটা একজন পরপর ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বোতল যার দিকে মুখ করে থাকছে তারই পূর্বের জনের গানের শেষের অক্ষর দিয়ে গান গাইতে হচ্ছে। নতুন বউয়ের পরই গান গাওয়ার পালা এলো নিতুর।
নিতুর পাশেই উৎস বসা। নিতু উৎসের দিকে তাকিয়ে মাথা বাঁকিয়ে মৃদু আওয়াজে বলল,
“তোমার পছন্দের গান গেয়েই ফেলি কী বলো?”
”কোনটা?”
“মনে করে দেখো তুমি আমাকে জানিয়েছিলে একদিন। পছন্দের সবকিছু নিয়ে কথা হচ্ছিল তখন গানের নামও বলেছিলে।”
রিশা সামনের দিকে থেকে বলে উঠল,“ভাবি, শুরু করো। অক্ষর মনে আছে তো?”
নিতু মুচকি হেসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ল। অতঃপর একটা প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে শুরু করল-
কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো
কেন দূরে থাকো?
মনে হয় তবু বারে বারে
এই বুঝি এলে মোর দ্বারে
সে মধুর স্বপ্ন ভেঙ্গো নাকো
কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো
কেন দূরে থাকো?
ভাবে মাধবী সুরভী তার বিলায়ে
যাবে মধুদের সুরে সুরে মিলায়ে
তোমারি খেয়ালে ক্ষনে ক্ষনে
কত কথা জাগে মোর মনে
চোখে মোর ফাগুনের ছবিটি আঁকো
কেন দূরে থাকো
শুধু আড়াল রাখো
কে তুমি কে তুমি আমায় ডাকো
কেন দূরে থাকো?
____
রাতে কয়েক ভাইয়ের আড্ডা বসেছে ছাদে। অনেকদিন পর সবাই আবার একসাথে হয়েছে। কত বছর যেন কেটে গিয়েছে এরকম কোন জমজমাট আসর বসে না, সবাই একসাথেও হয় না। বাড়ির ছেলেদের মতো নতুন বউয়ের রুমে জায়গা করে নিয়েছে নিতু, মালিহা, রিশা। নতুন বউয়ের সাথে বেশ হাসি-হাসি হচ্ছিল সবার। রিশা পানি খাওয়ার জন্য কিছুক্ষণ আগে রুম থেকে বের হয়েছে। সময় হিসেব করলে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় বার রান্নাঘর থেকে ঘুরে আসা যাবে। আড্ডায় বিরাম টেনে নিতু উঠে দাঁড়ালো। মালিহাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনারা কথা বলুন। আমি দেখি রিশা কোথায় গেল। চায়ের নেশা জেগেছে, খাবেন কেউ?”
চোখাচোখি হলো সবার একবার। নতুন বউ নিজে থেকে বলে উঠল,
“আমি আসব সাথে?”
নিতু নিষেধ করল।
“তোমরা কথা বলো, আমিই নিয়ে আসছি। বেশি সময় লাগবে না।”
নিতু ত্রস্তপায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ড্রয়িংরুমের আলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। নিতু বাহিরে এসে ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা অন করতেই দূর থেকে কারও ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পেল। কণ্ঠস্বর মেয়েলি। সামনের দিকে আলো ধরে বলে উঠল,
“কে ওখানে?”
#চলবে…..