প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৩৫

0
680

#প্রিয়_বিকালফুল(৩৫)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

“তোমার প্রাক্তন স্ত্রী কল করেছিল। তার বোধ হয় তোমার প্রতি ভালোবাসা উথলে ওঠে মাঝেমাঝে। নিজেকে সামলাতে না পেরে ফেলা থুথু জিহ্বায় তুলতে আসে।”

উৎসের প্রশ্নের উত্তরে নিতু এতটুকু বলে চুপ রইল না। সে বসা থেকে উঠে এসে উৎসের সামনে দাঁড়িয়ে ফের বলল,

“আমার খু**ন করার অভ্যেস নেই। তোমার প্রাক্তন যদি আবার ফিরে আসার চেষ্টা করে তবে আমি তাকে খু**ন করে ফেলব। মেজর সাহেব এতটুকু বিষয় ঠিক সামলে নিতে পারবে তাই না? তাকে খু*ন করে জেলে তো আমি যেতে চাই না। পথের কাঁ*টা সরিয়ে শান্তিতে সংসার করতে চাই আমি।”

উৎস হাতের তোয়ালেটা কাধে রাখল।
“কল রিসিভ করেছিলে? নম্বর ব্লক করিনি আমি? ভুলে গিয়েছিলাম বোধ হয়। এবার নিজের নম্বরটা চেঞ্জ করতেই হবে দেখছি।”
“আচ্ছামতো কথা শুনিয়ে দিয়েছি। এরপরও যদি কল দেয় তাহলে ভাববো ওকে জন্মের সময় লজ্জার নাড়ি ছোঁয়ানো হয় নাই৷ একবার পছন্দের মানুষকে, প্রথম মাথাচাড়া দেওয়া দারুণ অনুভূতিকে বিসর্জন দিয়েছিলাম এবার বরকে কিছুতেই দিতে পারব না।”

উৎস নিতুর নাকে টোকা দিয়ে বলল,“বরকে দিয়ে দিলেই কি বর অন্য কারও হবে নাকি? পুরুষের ভালোবাসা এত সস্তা না। কিছু কিছু পুরুষ সস্তা হয় কিছু সময়। যারা নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসতে জানে
তাদের বাহিরে থেকে অন্য নারীরা যতই হাতছানি দিক না কেন তারা পুরুষের নজরে আসে না।”

নিতু কিছুক্ষণ চুপ রইল। উৎসের কাছে থেকে তোয়ালে নিয়ে একটা ঝারা দিয়ে বলল,“কল রিসিভ করেছি, ফোন ধরেছি বলে কিছু মনে করোনি তো? যদিও কারও ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিতে নেই।”

“তোমার আর আমার মাঝে কোনকিছু আড়াল করার মতো পর্দা নেই। এখন আর ব্যক্তিগত জিনিস বলতেও কিছু নেই। তোমার কাছে থেকে লুকোনোর মতো কিছুই নেই আমার।”

নিতু চুপ রইল। উৎস বলল,“সবাই বের হবে আবার। আমাকেও বলছিল বের হতে। কী করব?”

নিতু চকিতে জবাব দিল,“বের হও সমস্যা নেই। আমিও একটু বের হব।”
“ঘুরতে নাকি কোন কাজে?”
“রিশার সঙ্গে একটু আশেপাশে ঘুরে দেখব ভাবছিলাম৷ বরের তো সময় নেই। ননদকে দিয়েই কাজ চালিয়ে নিই।”

উৎস নিতুর দুই কাধে দুই হাত রেখে কাছে এসে বলল,“কাল থেকে বেশ কয়েকদিন তোমার জন্য একদম ফ্রি।”
“আমি যাব?”
“অবশ্যই যাবে। লোকেশন অন রেখো আর কোন বিপদ বুঝলে অবশ্যই আমাকে কল করবে।”

নিতু মৃদু হেসে শুধালো,“তারপর কি আমার হিরো এসে আমাকে বাঁচাবে?”
“ শুধু বাঁচানো? তোমার জন্য কারও প্রাণ নিতে হলেও আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না।”

নিতু কিছু বলল না শুধু মৃদু হেসে সামনে থেকে প্রস্থান করল।

রিশা আর নিতু নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছেসে অনেকক্ষণ আগেই। খোলা মাঠ। আশেপাশে মানুষের ভিড়। বিকেলের দিকটায় আশেপাশের সবাই হয়তো কাজের ফাঁকে ফ্যামিলি বা প্রিয়জনদের নিয়ে এখানে ঘুরতে আসে। মাঠের সর্বস্তরে জায়গায় একটু করে বনের ঝোঁপ। কিছুদূর ফাঁকে ফাঁকে টঙদোকান। চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা। সেখানেই অনেকে বসে বিভিন্ন ধরণের স্ট্রিট ফুড খাচ্ছে, ছবি তুলছে, চলছে নানারকম কথাবার্তা।

নিতু, রিশা এসে একটা টেবিল নিয়ে বসেছে। জুবায়েরকে কল দিতেই সে জানালো পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবে। সময় পাঁচ মিনিট নিলেও সময় পুরোটা যাওয়ার আগেই পৌঁছে গেল। জুবায়েরের দুইহাত ভরতি বিভিন্ন উপহার। সামনে এসে দাঁড়াতেই দাঁড়িয়ে গেল রিশাও। চোখ দুটো অস্বাভাবিকভাবেই ছলছল করে উঠল তার। বুকের ভেতরটা কেমন হুঁহুঁ করে উঠল। এতগুলো বছর পর প্রিয় মানুষকে সামনে পেল সে। নিতু বসে থেকেই দুজনকে দেখতে থাকলো। দুজনে দুজনের দিকে এক পলকে চেয়ে আছে। নিতু গলা খাঁকারি দিতেই রিশা নিজেকে সামলে নিল। জুবায়ের মৃদু হেসে রিশার দিকে উপহার বাড়িয়ে দিয়ে নিতুর দিকে চাইলো।

“আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।”

নিতুও হাসিমুখে সালামের জবাব দিল। বসতে বললে জুবায়ের একটা চেয়ার টেনে রিশার পাশাপাশি বসলো। আন্তরিকতার সাথে তিনজনের কথা চলল অনেকক্ষণ। নিতু প্রথম থেকে ববন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ চালিয়ে গেল। খাবার অর্ডার করা হলো। খেতে খেতে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা চলল তিনজনের। এক সময় নিতু জুবায়েরের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,

“পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সবই তো হলো। এবার বিয়ে করছেন কবে দুজন?”

জুবায়ের রিশার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল রিশা। জুবায়ের স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের জবাব দিল,

“বিয়ে আমি অনেক আগে থেকেই করতে চাইছি। আপনার ননদ আজ রাজি হলে বিয়ে আজই হবে।”

রিশা মৃদু হেসে নিতুর দিকে চাইলো। নিতু বলল,
“আমি তাহলে বাসায় খালাকে আর ভাইদের জানাই। আপনার বাসায় কথা বলা আছে?”

জুবায়ের শান্ত গলায় বলল,“আমি বাহিরে থাকাকালীন আমার বাবা মারা যান। আমার আপনজন বলতে রিশা, আমার বোন, দুলাভাই আর আমার আম্মা। আম্মা আগে আপার কাছেই থাকতো এখন আমি চলে আসায় নতুন ফ্ল্যাট নিয়েছি। আমার আম্মা অনেক আগে থেকেই রিশাকে পছন্দ করে। বোন, দুলাভাইও জানে। তাদের কোন অমত নেই৷ এখন সবকিছু আপনাদের ওপরই নির্ভর করে। আমার দিক থেকে কোন আপত্তি নেই।”

“তাহলে তো ভালোই হলো৷ আমি তবে খুব তাড়াতাড়ি বাসায় কথা বলি। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। ভালোবাসার মানুষগুলো এভাবে দূরে থাকুক সেটা আমি চাই না। খুব দ্রুত দুজনে সঠিক বন্ধনে আবদ্ধ হন দোয়া করি৷ আল্লাহর পর আমার একমাত্র ননদকে ভালো রাখার দায়িত্ব কিন্তু আপনার। যদি কখনো শুনি তাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিয়েছেন তাহলে কিন্তু আজ যেমন আমি আপনাদের পাশে আছি সেদিন এই আমিই কিন্তু চরম বিরোধিতা করব আপনার।”

জুবায়ের রিশার দিকে তাকালো। রিশাও জুবায়েরের দিকেই তাকিয়ে আছে। জুবায়ের ওভাবেই বলে উঠল,
“যার ভালো থাকার সাথে আমার ভালো থাকা মিশে আছে তাকে খারাপ রাখার প্রশ্নই ওঠে না।”

আরও প্রায় আধাঘণ্টা রইল সেখানে জুবায়ের। জবের ব্যাপারে একজনের সাথে ইমিডিয়েট দেখা করা প্রয়োজন বলে তাকে প্রস্থান করতে হলো। যদিও সম্মান রক্ষার খাতিরে আরও কিছুক্ষণ থেকে নিতু আর রিশাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে তারপর যেতে চেয়েছিল কিন্তু নিতু সেটা হতে দেয়নি। এক প্রকার জোর করেই জুবায়েরকে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। জুবায়েরকে রিশার জন্য বেশ পছন্দ হয়েছে তার৷ দেখতে সুদর্শন, ব্যবহার সুন্দর সবদিক দিয়ে পারফেক্ট।

নিতু এবং রিশা বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠার আগে ঘটে গেল এক বড় অঘটন। দুজনে জুবায়েরকে বিদায় দিয়ে আরও কিছুক্ষণ এটা ওটা নিয়ে কথা বলছিল। সন্ধ্যা হতে বেশি দেরি নেই দেখে দুজনে হেঁটে রাস্তার দিকে আসতে শুরু করে। তখনই কয়েকজন ছেলে মিলে রিশা এবং নিতুকে উ*ত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। প্রথমদিকে নিজেদের মধ্যে মজা করে এটা ওটা বলতে থাকে। শিস বাজিয়ে চার-পাঁচজন মিলে পিছু পিছু আসতেও শুরু করে। প্রথম দিকে ঝামেলা যেন না হয় সেই জন্য দুজন সেদিকে পাত্তা না দিয়ে এগুতে থাকে।

সামনের দুজনকে নির্বিকার ভঙ্গিতে হেঁটে যাওয়া দেখতে বোধ হয় ভালো লাগল না ছেলেগুলোর। নিতু আর রিশা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছিল। তখনই একজন এসে রিশার ঠিক পেছনটায় খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। এত কাছে কোন পুরুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে গা গুলিয়ে উঠল রিশার। ছেলেটা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলে উঠল,

“এই সুন্দরী, কখন থেকে পাত্তা চাইছি একটু ফিরেও তাকাচ্ছো না যে? দেখতে সুন্দর নই বুঝি?”

বিষয়টা সহ্য হলো না নিতুর। ছেলেটাকে ঠাঁটিয়ে বসিয়ে দিল এক চ*ড়। আচমকা গালে এমন থাপ্প*ড় পড়ায় অবাক হলো সাথে রেগে কটমট করে তাকালো ছেলেটা। চেহারা হয়ে উঠল হিং*স্র ক্ষুধার্ত সিংহের ন্যায়। গর্জন করে নিতুর দিকে পা বাড়াতেই পুনরায় আরও একটা থাপ্প*ড় বসিয়ে দিল নিতু।

রিশা শুকনো ঢোক গিলে নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,“ভাবি, চলো এখান থেকে।”

নিতু ছেলেটার দিকে আঙুল উঠিয়ে বলল,“ছেলে হয়েছিস কিন্তু পুরুষ হয়ে উঠতে পারিসনি। আমার বরের কাছে আসিস, দুইদিনের ক্লাসে পুরুষ বানিয়ে দেবে। মেয়েদের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় সেটা শিখিয়ে দেবে।”

পেছনে দাঁড়ানো ছেলেগুলো এগিয়ে আসতে চাইলে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা হাতের ইশারায় থামিয়ে দিল সবাইকে। বলে উঠল,

“একে আমি দেখে নিচ্ছি।”

#চলবে……