#প্রিয়_বিকালফুল(৩৭)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
মুহূর্তের মধ্যে থানার ভেতরে প্রবেশ করল তিনজন লোক। একজনের পাশেই দুইজন্য পিছু পিছু এলো। দরজার দিকে আশরাফকে দাঁড়িয়ে কারও সাথে কথা বলতে দেখে মাঝের জন বলে উঠল,
“কী হইছে, আব্বা?”
আশরাফ নিজের বাবাকে থানায় দেখে একটু স্বস্তি ফিরে পেল যেন। উৎসের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো সে। বাবার দিকে পা বাড়াতেই উৎসও ঘুরে তাকালো। সাথে সাথে আশরাফের বাবা মহসিন সাহেব হেসে বলে উঠলেন,
“আরে উৎস স্যার যে! আপনি এখানে? আছেন কেমন? অনেক দিন পর দেখছি।”
থেমে গেল আশরাফ। বাবার মুখের দিকে চেয়ে আবার উৎসকে দেখতে থাকলো। উৎস নিজেও এবার হাসলো৷ মহসিন সাহেবের সাথে করমর্দন করে বলল,
“আপনার ছেলে?”
“হ্যাঁ। ও কিছু করেছে?”
“পুরুষের চারটা বিয়ে অবধি জায়েজ আছে। একটায় আপনার ছেলের না-ও চলতে পারে। হয়তো দেখা গেল ঘরে বউ রেখেও বাহিরে চলে এলো মেয়েদের গা ঘেষে দাঁড়ানোর জন্য, ওড়না টেনে ধরার জন্য, কাম দেখা দিল, রে**পও করে ফেলল আর এসবের সাথে যদি আমার মতো মানুষ জড়িয়ে যায় তাহলে তো ছেলেকে আর খুঁজে পাবেন না৷ ঘরে বউ নাই বলে বাহিরের মেয়েদের বিরক্ত করে বেড়াচ্ছে। তাই বলছি কি, ছেলেকে প্রয়োজনে চারজনের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেন যেন একটারে ভালো না লাগলে অন্যগুলোকে ভালো লাগে। বাহিরের মেয়েগুলো যেন শান্তিতে চলতে পারে।”
মহসিন সাহেব রাগী চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। আশরাফ নিজেও বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যকেউ উৎসের কথাগুলো বলার সাহসই পেত না কোনদিন তার আগেই তার বাবা তার অবস্থা খারাপ করে ফেলত কিন্তু আজ তার অন্যথা দেখে একটু অবাক হচ্ছে। মহসিন সাহেব বললেন,
“আজকের দিন দেখার জন্য তোকে পেলেপুষে বড় করেছি আমি? মেয়েরা সম্মানের মানুষ, তাদের মাথায় করে রাখতে হয়। যা উনাদের কাছে থেকে আর স্যারের কাছে ক্ষমা চা।”
মহসিন সাহেব অফিসার এবং উৎসের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন। যাওয়ার পূর্বে ছেলেকে বললেন উৎসের কাছে ‘স্যরি’ বলতে বললেন। ছেলে মাথানত করতে নারাজ। মহসিন সাহেব ছেলেকে ঠেলে পাঠালেন উৎসের কাছে। মাড়ি শক্ত করে বললেন,
“জলদি ভুল স্বীকার করে চলে আসবি। আমি তার সাথে কোন ঝামেলা চাই না। আর কোন মেয়ে পেলি না রাস্তায়? এদেরই চোখে পড়ল, হতচ্ছাড়া! ”
আশরাফ মাথানত করতে নারাজ। উৎসের সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,“জানি না, বাবা পল্টি কেন খেল। তবে ভবিষ্যতে কখনো না কখনো আমি আপনাকে দেখে নেব, মনে রাখবেন।”
উৎস মৃদু হেসে আশরাফের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,“তোমার হুম*কিতে আমি ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। এই রে প্যান্টও ভিজে গেল। খুলে দেব? মহাশয় যদি পরিষ্কার করে দিতেন একটু দয়া করে।”
আশরাফ কটমট করে চাইলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে পুনরায় উৎসের দিকে ফিরে বলল,“দেখে তো আমি নেবই আপনাকে।”
উৎস ফের ফিসফিস করে বলে উঠল,“ কী দেখবি? ভালো কিছু তো দেখবি না। একটা ছবি তুলে নিয়ে যা আমার। দিনে তিনবেলা করে নিয়ম করে দেখিস।”
উৎস নিতু এবং রিশাকে নিয়ে বেরিয়ে এলো থানা থেকে। উৎস গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল। রিশা গিয়ে পিছনের সিটে বসল। নিতুও সাথে যাবে তখনই উৎস বলে উঠল,
“আমারে কি ড্রাইভার ড্রাইভার লাগছে? দুজনই গলাবেঁধে পিছনে গিয়ে বসছো কেন?”
নিতু আর রিশার সাথে না বসে সামনের সিটে গিয়ে বসলো। এক মুহূর্ত দেরি না করে উৎস এবার ড্রাইভ শুরু করে দিল।
রিশা খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত গলায় শুধালো,“ভাইয়া, আর কেউ জেনেছে এই ঘটনা?”
উৎস একবার নিতুর দিকে চাইলো তারপর রিশাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“আজকের এই ঘটনার কথা বাড়িতে কেউ জানলে তোকে আর বের হতে দেবে বলে মনে করেছিস?”
রিশা মাথানিচু করে বলল,“সেজন্যই জিজ্ঞেস করছি।”
”কেউ জানে না। আপনারাও কেউ গল্পে গল্পে বাড়িতে কাউকে বলিয়েন না।”
“বলব না।”
নিতু রিশাকে আশ্বস্ত করে বলল,“তুমি এত চিন্তা করছো কেন? এত চিন্তা কোরো না। কিছু হবে না।”
____
বাসায় যেহেতু কোনকিছু বলা হয়নি সুতরাং পরিবেশ স্বাভাবিক রইল। প্রতিদিনের মতোই আমেজে কাটলো সময়টা। বাড়িতে মানুষ বেশি হলে আনন্দও বেশি হয় উৎসের খালার বাড়ি যেন তারই প্রমাণ। ভাই-বোন, বাড়ির বড়রা, বউয়েরা খাওয়া দাওয়া, আড্ডা সবকিছুতে মুক্তমনাভাবেই উপস্থিত থাকে।
পরবর্তী দুটো দিন বাড়ির মানুষের সাথে উৎস আর নিতুরও খুব ভালো কাটলো। নিতুর সাধারণত এত মানুষের মধ্যে এভাবে সময় খুব একটা কাটানো হয়নি। মিশুকে স্বভাবের খানিকটা হলেও মনের মতো মানুষ পায়নি সে। বন্ধু বলতে বর্তমানে শুধু একজনই আর সে হচ্ছে বন্যা। নিয়ম করে প্রতিদিন কথা না হলেও বলার মতো কিছু ঘটলেই মুহূর্তের মধ্যে তাকে কল করতে কোনরকম দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয় না তাকে। জীবনে হয়তো প্রত্যেকেরই এমন একটা বন্ধু থাকা প্রয়োজন অন্তত মনের ভারি ভাবটা হালকা করে নেওয়া যায়।
ফরিনা বেগম, উৎস এবং নিতু তিনজনই বাসায় ফিরেছে গত রাতে। কয়েকদিন বাসায় ঠিকমতো না থাকায় অপরিষ্কার হয়ে রয়েছে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যাওয়ায় বাসা পরিষ্কারের কাজ করা সম্ভব হয়নি। রাতে শুধু সহজ কিছু রান্না করে তিনজন খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। নিতু আজ সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। প্রথমে রান্নাঘরটা পরিপাটি করে নাশতা বানিয়ে নিল। টেবিলে সাজিয়ে ঘড়ি দেখল, নাশতার সময় এখনো হয়নি। সুতরাং এখনো কিছু কাজ করে নেওয়া যাবে। নিতু ভাবনানুযায়ী কাজ শুরু করে দিল।
গতকাল থেকে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে নিতুর। যদিও একদিন অথবা দুইদিন পরপর মায়ের সাথে কথা হয় তবুও মাকে বেশ কিছুদিন দেখে না সে। আগে মাকে না দেখে বছরও পেরিয়ে গেছে এত খারাপ লাগেনি কিন্তু এখন মাস পেরিয়ে যাওয়াতেই বুকের ভেতরটা টনটন করছে। ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে শান্তিতে একটু ঘুমোতে। মায়ের হাতে রান্না করা নিজের পছন্দের খাবারগুলো খেতে। নিজের না বলা অনেক কথা আজ মাকে বলতে ইচ্ছে করছে।
গতরাতেই কথায় কথায় নিতু উৎসকে বলছিল মায়ের কথা। তার মায়ের যখন দ্বিতীয় বিয়ে হলো তার প্রায় এক বছর পর থেকেই বিভিন্ন কারণে মায়ের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। মাকে সেরকম কাছে পাওয়া হয়নি আবার কিছু সময় মা কাছে আসতে চাইলেও নিজে বাঁধা দিয়েছে। একটু বড় হতেই মায়ের সাথে শত শত কি.মি এর দূরত্ব তৈরি হলো। বাহিরে পড়াশোনার জন্য যাওয়ার পর ইচ্ছে হলে কখনো কল করত আবার ইচ্ছে না হলে করত না। এভাবেই তো কেটেছে জীবনের অনেকগুলো বছর কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর থেকে মায়ের মমতা সে বুঝতে পেরেছে। এখানে আসার পর, বন্যার কাছে থাকাকালীন প্রতিদিন মা খোঁজ খবর নেয়। সাবধানে থাকতে বলে। কথা বলতে বলতেই অনুশোচনা থেকে কেঁদে ফেলে। মেয়ের কাছে বারবার মাফ চায়। নিতু আর কঠোর থাকতে পারে না। এখন তো মাকে ছাড়া থাকতেও তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। এত মায়া মায়ের প্রতি কীভাবে আর কবে জন্মালো কে জানে!
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই হাতের কিছু কাজ সেরে নিল নিতু। উৎস সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিল। প্রায় প্রতিদিনই ঘণ্টাখানেকের মতো হেঁটে বাসায় এসে বাসার সামনে দিকটায় কিছুক্ষণ ব্যায়াম করে নেয়। উৎস আজ নিতুকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু হাতে কাজ থাকায় সে যেতে পারেনি।
উৎস বাসায় ঢুকে নিতুকে কাজে ব্যস্ত দেখে এগিয়ে এসে একটু রুক্ষভাষী হলো।
“তোমাকে সকাল সকাল এসব কে করতে বলেছে? ধীরে ধীরে করা যেত না? তাছাড়া আমি তো বাসায় আছি। গোসলের আগে সব করে দিতাম।”
নিতু আপাতত কাজ বন্ধ রেখে মৃদু হেসে উৎসের দিকে চাইলো।
“ফ্লোর মুছতে পারবে?”
“হ্যাঁ, মুছে দেব।”
নিতু মজার স্বরে বলে উঠল,“না, না ফ্লোর না-হয় আমিই মুছে ফেলব। আজ তোমাকে দিয়ে ওয়াশরুম পরিষ্কার করাবো।”
উৎস নিতুর কাছে এসে বলল,“ সংসারের সব কাজ জানা আছে। করতেও হয়। সো ডোন্ট ও্যরি।”
“নিজের ভাগ্যকে একশো একটা চুমু দিতে ইচ্ছে করছে।”
“কেন?”
“এই যে এত ভালো একটা বর জুটেছে ভাগ্যে সেজন্য।”
“ভাগ্যকে চুমু না খেয়ে বরকে চুমু খান। বর খুশি হবে।”
নিতু নিজের রুমের দিকে রওয়ানা দিল। ফ্রেশ হতে হবে তাকে। শরীর, জামাকাপড়ে ময়লা আটকে আছে। বারবার হাঁচিও হচ্ছে। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বলল,
“আপাতত সকালের নাশতা খান। চুমুর কথা পরে ভাবা যাবে।”
“জি, জি তাড়াতাড়ি নাশতা দিন। আমার আবার আজকে একটু বাহিরে কাজ আছে।”
থেমে গেল নিতু। পিছনে ঘুরে শুধালো,“ছুটিতে বাসায় এসে আপনার আবার এত কী কাজ?”
“বাসায় ফিরলেই টের পাবে।”
“এখন কেন নয়?”
“কারণ আছে। চলো এখন।”
“না বললে আমি কিছুতেই যাব না এখান থেকে।”
“তুমি নিজে থেকে না গেলে আমি কোলে তুলে নিয়ে যাব। আম্মা কোনভাবে দেখে নিলে লজ্জা তোমারই পেতে হবে। বলো যাবে নাকি তুলে নেব?”
নিতুও দুই হাত বাড়িয়ে দিল উৎসের দিকে। বলল,
“হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ কোলে নেন।”
#চলবে…..