#প্রিয়_বিকালফুল(৩৮)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
“ছুটিতে বাসায় এসে আপনার আবার এত কী কাজ?”
“বাসায় ফিরলেই টের পাবে।”
“এখন কেন নয়?”
“কারণ আছে। চলো এখন।”
“না বললে আমি কিছুতেই যাব না এখান থেকে।”
“তুমি নিজে থেকে না গেলে আমি কোলে তুলে নিয়ে যাব। আম্মা কোনভাবে দেখে নিলে লজ্জা তোমারই পেতে হবে। বলো যাবে নাকি তুলে নেব?”
নিতুও দুই হাত বাড়িয়ে দিল উৎসের দিকে। বলল,
“হেঁটে যেতে ইচ্ছে করছে না। প্লিজ কোলে নেন।”
উৎসও আর সময় নষ্ট করল না। এদিক ওদিক খেয়ালে না এনে দুটো সিঁড়ি ওপরে উঠে নিতুকে কোলে তুলে নিল। নিতু কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে শুধু নিজেকে সঠিক অবস্থানে রাখতে উৎসকে ধরে রাখলো আলগোছে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠেও উৎসকে স্বাভাবিক দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো নিতু। চেয়ে রইল তার মুখের দিকে৷ উৎস সামনে দিকে চেয়ে রুমের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
“এভাবে দেখছ কেন? পুরুষ মানুষকে এভাবে দেখতে লজ্জা লাগে না?”
নিতু মুখ বাঁকিয়ে দৃষ্টিনত করল।
“তুমি তো আর পরপুরুষ নও যে তোমাকে দেখতে পারব না। তোমাকে দেখলে তোমার বউ আমার চুল ধরে টেনে সারাদিন পাক খাওয়াবে।”
উৎস হেসে বলল,“তার মানে আমাকে কেউ এভাবে দেখলে তুমি এসব করবে?”
নিতু বেশ কনফিডেন্সের সাথে বলল,“অবশ্যই। তবে এর চেয়েও বেশি কিছু করতে পারি। ”
রুমে ঢুকের খাটের কাছাকাছি এসে নিতুকে নামিয়ে দিল উৎস। মেঝেতে পা রাখতেই নিতু বলে উঠল,
“এখনই কেন নামিয়ে দিলে? আরও কিছুক্ষণ রাখতে। ভালোই তো লাগছিল কোলে উঠে থাকতে।”
উৎস কপালে হাত দিয়ে বলল,“তোমাকে দেড়,দুইঘণ্টা কোলে করে রাখা কোন ব্যাপার না কিন্তু আমার হাতে সময় নেই। তৈরি থাকো। প্রয়োজনে সারা রাত কোলে করে ছাদে হাঁটাহাঁটি করব।”
“হ্যাঁ আর পাশের বাসাগুলো থেকে ভূত ভেবে পাথর ছুড়বে।”
“ভূতকে মানুষ পাথর ছোঁড়ে না। ভয় পেলে জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে যাবে। ডোন্ট ও্যরি।”
উৎস ফ্রেশ হতে যেতে যেতে বলল,“আমি আগে ফ্রেশ হয়ে আসছি তারপর তুমি যেও। দুজনের ফ্রেশ হওয়া হলে একসাথে নিচে যাব।”
নিতু একপাশে মাথা নেড়ে বলল,“ঠিক আছে। ”
সকালে নাশতা শেষ করে উৎস বেরিয়েছে। এই সুযোগে নিতু টুকটাক বাড়ির সব কাজ শেষ করেছে। আজ কাজ শেষ করতে করতে বড্ড ক্লান্ত সে। শরীরটা ম্যাশম্যাশ করছে। সব ময়লা যেন পরিষ্কার হওয়ার সাথে সাথে নিতুর শরীরে এঁটে বসেছে। কিছুক্ষণ পরপর শরীরটা চুলকাচ্ছে। তাড়াতাড়ি দুপুরের রান্নাটাও বসাতে হবে। সেই ভাবনা মাথায় রেখেই তাড়াতাড়ি করে গোসলে গেল নিতু। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হবে না আর সেটা ঠিকও হবে না। ঝটপট করে গোসলটাও শেষ করে রান্নার দিকে চলে গেল।
আজ সারাদিনের এত এত পরিশ্রমে মনে ইশ কেউ একজন যদি একটু হাতে হাতে সাহায্য করত তাহলে কতই না ভালো হতো! যদিও ফরিনা বেগম এসেছিলেন টুকটাক সাহায্য করতে কিন্তু নিতু কিছুতেই কোন কাজ উনাকে করতে দেয়নি। নিজে একা হাতে সামলাচ্ছে সবকিছু।
নিতু গোসল শেষ করে যখন রান্নাঘরের দিকে আসছিল রান্না করতে তখন ফরিনা বেগম জানিয়েছেন আজ একটু পোলাও, মাংস রান্না করতে সাথে একটু সাদাভাত আর ডাউল। নিতু খালাশাশুড়ির বাসায় যে কয়েকদিন ছিল প্রায় প্রতিদিন মাংস খেতে খেতে আর ইচ্ছে করছিল না কিন্তু শাশুড়ি যেহেতু বলেছে সুতরাং সেটা রান্না না করলেও খারাপ দেখায়৷ দুই চুলায় তাড়াতাড়ি কিছু পদের রান্না করে ফেলেছে সে।
রান্না শেষ করে ফরিনা বেগমকে খেতে ডেকেছিল নিতু। ফরিনা বেগম জানিয়েছেন উৎস বাসায় ফিরলে একসাথেই খাবে। দেরিতে খাবার খেলে শরীর খারাপ করতে পারে আশংকায় নিতু কয়েকবার জোর করলেও ফরিনা বেগম খেতে বসেননি।
নিতু খাবার টেবিলে সবরকম খাবার সাজিয়ে রেখে রুমে এলো। পুনরায় একটু ফ্রেশ হয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নিল। সারাদিন কাজ করে কেটে গেল বলে কাজের মেয়ের মতো তো আর দেখতে দেওয়া যাবে না। নিজেকে ভালোবাসা এবং নিজেকে যেকোন পরিস্থিতিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে নিতু।
বেলা প্রায় আড়াইটার দিকে উৎস বাসায় ফিরল। নিতু শুয়ে শুয়ে একটা বই নিয়ে পড়ছিল। পড়াটা সময় কাটানোর বাহানা মাত্র। সে অপেক্ষা করছিল উৎসের ফিরে আসার। কিছুক্ষণ আগ অবধি কয়েকবার কলও করেছিল সে কিন্তু উৎস রিসিভ করেনি।
উৎস রুমে ঢুকতেই তাকে দেখে নিতু উঠে বসল। বলল,
“কোথায় গিয়েছিলে? এত দেরি হলো? তোমার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে সেই কখন থেকে! সারাদিন এত কাজ করে প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। আম্মাও খায়নি। একসাথে খাবে বলে আর তুমি এত দেরি করে ফিরছো!”
উৎস এসে নিতুর পাশে বসল। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,“একসাথে এত কথা আর এত প্রশ্ন হলে কোনটার শুনব আর কোনটার জবাব দিব বলো তো?”
নিতু গোমড়া মুখে বলল,“আগে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে। আমি আর না খেয়ে থাকতে পারছি না। পরে সব শুনব।”
উৎস মৃদু হেসে বলল,“তুমি নিচে যাও। খাবার রেডি করো। আমি ফ্রেশ হয়েই চলে আসছি।”
“যাব?”
“হ্যাঁ যাও।”
নিতু বিছানা ছাড়তে ছাড়তে বলল,“তাড়াতাড়ি আসবে কিন্তু। আমি গিয়ে সবকিছু রেডি করি।”
“ঠিক আছে। যাও।”
নিতু অনুমতি পেয়েই চলে এলো নিচে। খাবার টেবিলে সবই রাখা ছিল। শাশুড়ির রুমের দিকে পা বাড়ালো সে। উনাকে ডাকতে দরজায় নক করতেই ফরিনা বেগম ভেতর থেকে বলে উঠলেন,
“ভেতরে এসে দেখো কে এসেছে! দেখো তো চিনতে পারো কি না?”
নিতু দরজা ঠেলে ভেতরে পা রাখল৷ সামনের দিকে তাকাতেই শাশুড়ির পাশে নিজের মাকে দেখে বেশ অবাক হলো সে। থ’ মেরে দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই। নুরজাহান বেগমও এক পলকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিতুকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাছে ডাকতে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। অস্পষ্ট স্বরে বললেন,
“মায়ের কাছে আসবি না?”
নিতু দৌঁড়ে গেল মায়ের কাছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইল কিছুক্ষণ। নিতু তো প্রায় কেঁদেই ফেলল। কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেলে ফরিনা বেগম বলে উঠলেন,
“মা-মেয়ের আদর সোহাগ হলো? শেষ হলে খেতে যাওয়া যাক? বেয়াইন সাহেবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বিকেল হতে চলল।”
মা-মেয়ের আদর, ভালোবাসা আরও কিছুক্ষণ চলল। পরিবেশ স্বাভাবিক হলে সবাই একসাথে দুপুরের খাওয়াটাও সেরে নিল। খাবার টেবিলে নিতু নিজে হাতে বেড়ে বেড়ে সবাইকে খাইয়েছে। এই প্রথম হয়তো নিজের মাকে এত যত্ন করে সে নিজের হাতে খাইয়েছে। খাবার খাওয়ার পুরোটা সময় সে উৎসকে কৃতজ্ঞতার নজরে দেখেছে।
দুপুরের খাবার শেষ করে নুরজাহান বেগমকে নিজের কাছে রেখে দিলেন ফরিনা বেগম। দুইজন মিলে গল্পগুজব করবেন। ভালো সময় কাটবে। নিতুও নিজের রুমে আসার সময় বলে এসেছে কিছু প্রয়োজন হলে যেন ডেকে নেয়।
নিতু সব কাজ শেষ করে একদম ফ্রি হয়ে নিজের রুমের দিকে গেল। উৎস বোধ হয় নিতুর অপেক্ষাতেই ছিল। নিতু রুমে আসতেই সোজা হয়ে বসল সে। নিতু এগিয়ে আসতেই বলে উঠল,
“খাওয়া শেষ হয়েছে সেই কখন! তোমার এতক্ষণে সময় হলো রুমে আসার?”
নিতু জবাবে বলল,“খাবার শেষ সব পরিষ্কার করে, দুই আম্মার সাথে একটু কথা বলে তবেই এলাম।”
“বরের চেয়ে ওগুলো বেশি ইম্পর্ট্যান্ট? ”
নিতু উৎসের কাছে এসে বসল। উৎসুকভাবে জানতে চাইলো,“মহাশয় কি রাগ করেছে? তখন তুমি দেরি করে আসায় আমি রাগ করিনি৷ এখন তুমিও রাগ করতে পারবে না।”
উৎস একটা খাম এগিয়ে দিল নিতুর দিকে। বলল,
“এই নাও।”
নিতু ভ্রু কুঁচকে শুধালো,“কী এতে?”
“খুলেই দেখো।” সংক্ষেপে উত্তর উৎসের।
“বলো।”
“দেখো তুমি৷”
নিতু খামটা হাতে নিতেই বুঝল ভেতরে কোন কাগজ আছে কিন্তু কাগজটা কীসের? উৎসের দিকে তাকিয়ে দেখে খামের দিকে তাকালো সে। জিজ্ঞেস করল,
“ছিঁড়ে দেখব? আমার ভয় লাগছে। কী আছে এতে?”
#চলবে..