প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪০

0
665

#প্রিয়_বিকালফুল(৪০)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

সকালের নাশতা শেষ করে সাজেকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হলো। কয়েকজন করে কয়েকটা দল গঠন করে শাপলা চত্বর থেকে চাঁদের গাড়ি নিয়ে রওয়ানা দিল সবাই। নিতু আর উৎসও উঠে বসলো একটা গাড়িতে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি চলতে শুরু করল। দীঘিনালাসহ বেশ কিছু জায়গা ছেড়ে আর্মিক্যাম্পে পৌঁছলো। প্রায় দশটায় সেখানে থেকে আবার রওয়ানা দিতে হলো৷ কিছুক্ষণ দেরি হওয়ায় উৎস সেখানে থেকে নিজেদের জন্য ফলসহ কিছু খাবার কিনে নিল যেন খাবারের কোনরকম অসুবিধা না হয়। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্তশ্রান্ত শরীর, মন নিয়ে সবাই পৌঁছল সাজেক ভ্যালিতে৷ বুক করা রিসোর্টে যার যার রুমেও চলে গেল।

উৎস নিজেদের জন্য একটা কক্ষ নিল। ভেতরে ঢুকতেই নিতু নিজের হাতের ছোট ব্যাগটা বিছানার এক পাশে ছুঁড়ে মেরে নিজে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল বিছানায়। উৎস নিজেও বসে রইল কিছুক্ষণ নিতুর পাশে। কিছুক্ষণ পর দুজনে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিল এখন ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিকেল থেকে দুই, একটা করে জায়গায় ঘুরবে। হাতে যেহেতু বেশ খানিকটা সময় আছে সুতরাং অসুবিধা হবে না।

দুজনে বের হলো বিকেলবেলা। তারা প্রথমে গেল লুসাইগ্রামে। এদিক সেদিক ঘুরলো বেশ কিছুক্ষণ। সেখান থেকে যখন বের হবে তখন হঠাৎই নিতুর এক পায়ের জুতো ছিঁড়ে গেল৷ নিচু হয়ে জুতো হাতে নেওয়ার সময় পিছনের দিকে চোখ যেতেই বুঝল কেউ একজন আড়াল হলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই সেদিকে তাকালো নিতু। এগিয়েও গেল কিছুটা। উৎস এসে নিতুর হাতে থেকে জুতো নিয়ে বলল,

”এখন রিসোর্টে ফিরে যাই চলো। আগামীকাল বের হব আবার। আজ যতটুকু পারি ওখানেই একটু এদিকে ওদিকে ঘুরব। রুমের বাহিরে থেকে অনেকটা দেখা যাবে।”

নিতু নিশ্চুপ৷ নজর সেদিকেই একভাবে অবস্থান করছে। উৎস নিতুকে চুপ থাকতে দেখে নিতুর নজর অনুসরণ করল। তেমন কিছু চোখে পড়ল না। সে নিতুর বাহু স্পর্শ করতেই চমকে উঠল সে। উৎসের দিকে চেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে শুধালো,

“হুম?”
“কোথায় আছো মনে মনে?”

নিতু পুনরায় পেছন দিকে চেয়ে বলল,“মনে হলো কেউ আমাদের দেখছে৷ ফলো করছে কেউ৷ জুতো খোলার সময় ওদিকে চোখ যেতেই মনে হলো কেউ সরে গেল।”

উৎস এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল৷ কাধ ঝাঁকিয়ে বলল,“কোথাও তো কেউ নেই আর তাছাড়া এরকম অপরিচিত জায়গায় আমাদের ফলো করবে কে? চলো তো এখান থেকে।”

নিতু উৎসের সাথে রওয়ানা দিল৷ তবে মনটা ওখানেই পড়ে রইল কিছুক্ষণের জন্য। বের হয়ে আসার সাথে সাথে উৎস নিজের জুতো জোড়া খুলে নিতুর দিকে বাড়িয়ে দিল। নিতুর জুতো তার হাতে। নিতু খালি পায়ে হাঁটছিল। উৎস পায়ের দিকে নিজের জুতো জোড়া দেখিয়ে বলল,

“এটা পরে নাও। খালি পায়ে তুমি হাঁটতে পারবে না।”

নিতু মলিনমুখে বলল,“পারব।”
“পারলেই আমি তোমাকে খালিপায়ে এভাবে হাঁটতে দেব কেন? নাও পরে নাও।”

নিতু আর কথা না বাড়িয়ে জুতো জোড়া পরে নিল। নিজের পায়ের মাপের চেয়ে ঢের বেশি বড় হওয়ায় হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছিল তবুও সেটাকে পাত্তা না দিয়েই গন্তব্যের দিকে চলল সে। সাথে সাথে উৎস নিজেও চলল নিতুর সাথে।
___

পরদিন সকাল থেকে খাবার খাওয়ার সময়টুকু ছাড়া প্রায় সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরাঘুরি করল উৎস আর নিতু। আশেপাশে যেগুলো দর্শনীয় স্থান আছে তার একটিও বাদ গেল না। প্রথমেই সকালে তারা গিয়েছিল হেলিপ্যাডে। যারা সাজেকে আসবে, সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসা যেন বাধ্যতামূলক। প্রকৃতি ঠিক কতটা মনমোহিনী সেটা এখানে না আসলে বোঝা দায়।

হেলিপ্যাড থেকে বেরি গাড়ি নিতে হলো পুনরায়।কংলাক পাহাড়ের দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার যা হেঁটে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। তার ওপর পাহাড়ের বেশ খানিকটা ওপরের দিকেও যেতে হয় হেঁটে। সুতরাং উৎস কিছুতেই রিস্ক নিতে রাজি হলো না। এই পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি এমনিতে ধীর গতিতে চলাচল করে সুতরাং হেঁটে হেঁটে প্রকৃতি উপভোগ করার কোন মানে নেই।

বেশ কিছু সময় পাহাড়ের সন্নিকটে এসে গাড়ি থামলো। সবাই গাড়ি থেকে যার যার মতো নেমে হাঁটা ধল পাহাড়ের চূড়ার দিকে। প্রায় দশ মিনিট হাঁটার পর একদম পাহাড়ের ওপরে ওঠা যায়। এখানে থেকেই পর্যটক সূর্যাস্ত দেখতে পায়। অনেকেই এখানে সন্ধ্যার আগে অর্থাৎ বিকেলের দিকে আসে সূর্যাস্ত দেখতে।

নিচ থেকে ওপরের দিকে এতক্ষণ হেঁটে আসায় পাহাড়ে পৌঁছে বসে পড়ে নিতু। হাঁপাতে থাকে সে। উৎস নিজে ক্লান্ত না হলেও নিতুর অবস্থা দেখে খারাপ লাগলো তার৷ পাশেই একটা দোকান থাকায় সেখান থেকে পানীয় আনতে গেল নিতুর জন্য। নিতু ওভাবেই বসে রইল। উৎসের ফিরে আসা দেরি হচ্ছে দেখে এক পর্যায়ে নিজেই উঠে দাঁড়ালো।

দোকানের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেই দেখতে পেল উৎস কারও সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সেদিকে পা বাড়াতেই একজন মহিলা এসে সামনে দাঁড়ালো। বয়স নিতুর মতোই হবে। শারীরিক গঠন, বাহ্যিকভাবে এমনই লাগলো নিতুর কাছে৷ পরনে লং কূর্তি, জিন্স, গলায় একটা কালো রঙের ওড়না জড়ানো, মুখে কালো মাস্ক। সে একটা পানির বোতল নিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

“এটা আপনার বর দিল৷ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন উনি সম্ভবত আপনার বর-ই হবেন। একজনের সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন বলে এটা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে অনুরোধ করলেন।”

নিতু পানির বোতলটা নিল৷ সামনে দাঁড়ানো মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“ধন্যবাদ। পানিটুকুর খুব প্রয়োজন ছিল। অনেকটা হেঁটে ওপরে আসতে হয়েছে বিধায় গলা শুকিয়ে গেছে। বাই দ্যি ওয়ে, আমি নিতু।”

মহিলাটি আন্তরিক হলো। বোতলের দিকে ইশারা করে বলল,“আমি আশরিফা। আপনি আগে পানি খেয়ে নিন। আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমার একটু তাড়া আছে৷ ” বলেই প্রস্থান করল আশরিফা।

নিতু বসে পড়ল মাটিতে। দেরি না করে বোতলের ক্যাপ খুলে পানি খেয়ে নিল। ঢকঢক করে হাফ লিটার বোতলের প্রায় পুরোটা শেষ করল সে। তারপর বোতল পাশে রেখেই উৎসের অপেক্ষায় রইল। উৎসের আর দেরি হলো না ফিরতে। নিতুকে বসে থাকতে দেখে নিজেও এসে বসলো পাশে। করুণস্বরে বলল,

“স্যরি দেরি হয়ে গেল। আসলে লোকটা এমন করে চেপে ধরেছিল যে আমি আসতেই পারছিলাম না।”

নিতু অভিমানী গলায় বলে উঠল, “এদিকে বউ ম*রে গেলে কিছুই না।”
“ধুর, কী যে বলো না! এই নাও পানিটা খেয়ে নাও৷ বেশি হাঁপানো অবস্থায়ও পানি খাওয়া ভালো না৷ এখন খেলে ভালো লাগবে।” বলেই পানির বোতল এগিয়ে দিল উৎস।

ভ্রু কুঁচকে প্রথমে বোতল এবং পরবর্তীতে উৎসের দিকে চাইলো নিতু। নিজের ডানপাশের বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে। মিনিট খানেক ছুটোছুটি করে তাকে বোতল দেওয়া মহিলাকে খুঁজলো সে কিন্তু কোথাও দেখতে পেল না৷ উৎস ওভাবেই বসে থেকে নিতুকে ব্যস্ত হয়ে কাউকে খুঁজতে দেখে শুধালো,

“কী হয়েছে? কাউকে খুঁজছো?”

নিতু কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ওখান থেকেই জবাব দিল,“তুমি আগেই পানি পাঠাওনি? এই যে, এই পানির বোতলটা?”

উৎসের কপালে কিঞ্চিৎ ভাজ পড়ল। নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“আমি তো তোমার জন্য একটাই বোতল কিনেছি আর সেটা আমার হাতে। পানির বোতল কিনে আবার কাকে মাধ্যম বানিয়ে পাঠাবো বলো?”

নিতু এগিয়ে এলো উৎসের দিকে। নিজের হাতের বোতল সামনে ধরে বলল,“এই যে দেখো৷ এই বোতলটা একজন এসে আমাকে দিল আর বলল, তুমি কিনে পাঠিয়েছ৷ তুমি কথা বলায় ব্যস্ত বলে উনাকে বলেছ বোতল আমার কাছে পৌঁছে দিতে। ”

উৎস সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো,“কে ছিল?”
“হয়তো আমার বয়সীই এক মহিলা।”
“আমাকে একটা ডাক দিতে৷ বাহিরে এসে কারও দেওয়া কিছু খাওয়া একদমই উচিত হয়নি তোমার।”

নিতু ঠোঁট কামড়ে ধরল। ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,“উৎস, আমাদের আড়ালে এখানে কিছু ঘটছে। আ’ম শিওর, এখানে কিছু হচ্ছে৷ আমি তোমাকে গতকাল বলেছিলাম, কেউ আমাদের ফলো করছে। আবার আজ দেখো! কেউ তোমার নাম করে আমাকে পানি দিল৷ এখানে আমাদের ঘিরে কিছু হচ্ছে উৎস। হোক সেটা ভালো বা খারাপ। কিছু তো হচ্ছে।”

#চলবে…..

পাঠক রেস্পন্স করবেন।💜