#প্রিয়_বিকালফুল(৪৪)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বেশ রাত করে গাড়ি এসে থামলো বাড়ির সামনে। নিতু একপ্রকার জোর করেই বন্যাকে নিজের সাথে নিয়ে এসেছে। রাত হলেও বন্যা নিজের বাসায় ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু নিতু সেটা হতে দেয়নি। এর মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছে দুজনের একসাথে থাকা হয়নি, রাতভর আড্ডা বা খাওয়া দাওয়া করা হয়নি। নিতুর এখন সংসার হয়েছে। যদিও উৎস সবসময় বাসায় থাকে না বন্যা চাইলেই মাঝেমাঝে বান্ধবীর কাছে আসতে পারে, নিতু নিজেও বন্যাকে আসতে বলে কিন্তু বন্যা আসে না। তার কথা বান্ধবী যত কাছেরই হোক না কেন, ভালোবাসা কথাবার্তা, ব্যবহার আর একে অন্যের পাশে থাকার মধ্যেই থাকতে হয়। বান্ধবীর অতিরিক্ত বাসায় আসা দৃষ্টিকটু দেখায়। নিতুও মেনে নেয়। কী আর করার! বন্যা খুবই হিসেবি মেয়ে। তার ধ্যান ধারণা অন্যদের চেয়ে আলাদা আর উন্নত।
বেল বাজাতেই মিনিট দুয়েকের মাঝে কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুলে দিল। দুজনে বাসায় প্রবেশ করল। ড্রয়িংরুমে আলো জ্বলছে। কাজের মেয়েটাকে নিতু শুধালো,
“আম্মা ঘুমিয়েছে?”
মেয়েটি ওপর-নিচে মাথা নাড়ল। নিতু ফের জানতে চাইলো,“তুমি খেয়েছ?”
“হ্যাঁ। আম্মারেও খাওয়াইছি। আপনেরা হাত-মুখ ধুয়ে আসেন আমি খাইতে দিচ্ছি।”
নিতু নিষেধ করে বলল,“আমাদের খেতে দিতে হবে না। রাত হয়েছে। তুমি ঘুমোও যাও৷ আমরা খেয়ে নেব।”
“খাবার গরম করে দেই?”
“সেটাও করতে হবে না। তুমি ঘুমোও।”
মেয়েটা আর কথা বাড়ালো না। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে পা বাড়ালো। নিতু বন্যাকে ইশারা করে ওপরের দিকে যেতে যেতে বলল,
“যা খেয়েছিলাম তার সবই দুশ্চিন্তা আর দৌঁড়াদৌঁড়িতে হজম হয়ে গেছে। ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি খেতে বসব। জলদি চল।”
বন্যা নিতুর পিছু নিল। সিঁড়ি বেয়ে যেতে যেতে মৃদু গলায় বলল,“আমার ওতটা ক্ষুধা পায়নি। না খেলেও চলবে।”
নিতু খোঁচা দিয়ে বলল,“তোমার কেন রাতে খেতে হবে, তোমার কেন ক্ষুধা লাগবে? তোমার তো আশরাফকে নম্বর দিয়েই পেট ভরে গেছে।”
বন্যা প্রতিবাদের স্বরে বলে উঠল,“আজেবাজে কথা বলবি না, নিতু।”
“বাজে কথা নিতু বলে না৷ এই নম্বর দিয়েছিস দিয়েছিস, কখনো যদি শুনি দুজনের লটরপটর চলছে একদম খবর খারাপ করে দেব।”
“আপনি বেশি বেশি চিন্তা করে ফেলছেন। স্যরি দুশ্চিন্তা। এসব কিছুই হবে না। ছেলেটাকে দেখে খারাপ মনে হলো না। সেদিন কীভাবে তোদের সাথে এতকিছু হলো কে জানে!”
নিতু দাঁড়িয়ে গেল। শাসিয়ে বলল,“সাবধান! বিড়ালকে দেখতে- ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না টাইপ লাগলেও সে কিন্তু সুযোগ পেলে চুরি করে খায়৷”
বন্যা ভ্রু কুঁচকে শুধালো, “এসব আমাকে বলছিস কেন?”
“এই বয়সে একটা ছেলে অন্তত এক সন্তানের পিতা আর একটা মেয়ে দুই সন্তানের মাতা হয় আর তুই বিয়েই করিসনি। নম্বর দেওয়াতে আমার সন্দেহ হচ্ছে। কবে যেন বিয়েতে বসে যাস।”
“এই ভরসা আমার ওপর?”
“বিন্দুমাত্র ভরসা করতে পারছি না।”
বন্যা মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,“তোর মতো হুট করে বিয়ে করে নেব না। যাকেই করি তোকে জানিয়েই করব।”
“ওই লোককে বিয়ে করার সম্ভাবনা আছে?”
“বালের কথা বলিস না তো। নম্বর দিয়েই আমার ভুল হয়ে গেল।”
নিতু হেসে বন্যার কাধে হাত দিয়ে একসাথে ওপরে যেতে যেতে বলল,“আচ্ছা বিয়ে করিস তাও রাগ করিস না, চল।”
____
রিশা আর জুবায়েরের বিয়ের কথা চলছে। আজ জুবায়েরের পরিবার রিশাকে দেখতে এসেছে। সকল কথাবার্তা সম্পর্কে নিতুকে আগে থেকেই জানানো হয়েছিল। ফরিনা বেগম সারাক্ষণ সেখানে উপস্থিত থাকতে পারলেও নিতু থাকতে পারেনি। ইদানীং কাজে ফিরেছে বলে প্রায় সবটা দিনই কাজের মধ্যে দিয়েই যায় তার। ব্যস্ততা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। রিশার দেখতে আসার দিন নিতুর অন্তত বিকেলে তাদের বাসায় পৌঁছানোর কথা থাকলেও ফটোশ্যুট শেষ করে পৌঁছাতে পারেনি। কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠেই ফরিনা বেগমকে কল করল নিতু। হাতে ফোন থাকায় রিসিভ করতে সময় নিলেন না ফরিনা বেগম।
“তুমি কতদূর? আসবে কখন? কাজ শেষ হয়নি?”
ফরিনা বেগমের একাধারে তিন তিনটা প্রশ্ন শুনেও তার জবাব না দিয়ে নিতু উল্টো জানতে চাইলো,
“জুবায়েরের বাড়ির মানুষ কি চলে গিয়েছে?”
ফরিনা বেগম বললেন,“ওরা এসেছেই দেরি করে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো৷”
“আমি বেরিয়েছি, আম্মা। বেশি সময় লাগবে না।”
“সাবধানে এসো।”
“আপনার ছেলে কল দিয়েছিল?”
“গতকাল কথা হয়েছে, কেন?”
“সে রাতে ফিরবে সম্ভবত। আমাকে কল করেছিল। বিকেলের দিকে বলল।”
“বাহ! ভালো খবর। রিশার বিয়েতে হয়তো দেরি হবে না। ছেলের মা ছেলের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাইছে। দেখা যাক কী হয়! তুমি চলে এসো।”
“আচ্ছা, আম্মা।”
নিতুর বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো৷ রাস্তায় অতিরিক্ত জ্যাম থাকায় গাড়ি একই জায়গায় প্রায় আধাঘণ্টা থেমে ছিল। কিছুতেই এদিক,ওদিক, সামনে-পেছনে নড়ছিল না। যে সময়ে পুরো রাস্তা আসা যেত সেখানেই সেই সময়টা লেগে গিয়েছে।
নিতু বাসার ভেতরে ঢুকতেই সবাইকে ড্রয়িংরুমেই পেল৷ রিশাও সেখানেই বসে আছে। পাশেই আছে জুবায়ের। নিতু গিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। নিতুর উপস্থিতি বুঝতেই রিশার মা মৃদু হেসে জুবায়েরের মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“এই যে, এটা আমার বোনের ছেলের বউ। যার কথা হচ্ছিল তখন।”
জুবায়েরের বোন পাশে থেকে বলে উঠল,“আপনি! আপনাকে তো আমি চিনি। আপনার বেশ কিছু কাজ দেখেছি। কী সুন্দর আপনি, মাশাআল্লাহ!”
নিতু আন্তরিকতার সাথে হাসলো। সবার সাথে টুকটাক আলাপ শেষ করে বাড়ির বউদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মালিহা বলে উঠল,
“এত দেরি কেন হলো ম্যাডামের? ভাবি হয়েছেন আর কাজে ফাঁকি!”
নিতু মুখ মলিন করে বলল,“আর বলিয়েন না, ভাবি। রাস্তার জ্যামই মানুষের সময় খেয়ে নিল। গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা হয়ে গেছে।”
মালিহা দুষ্টু হাসি হেসে বলল,“আমার দেবর আসছে শুনলাম। রাতে কোমর টিপে নিও।”
নিতু মুচকি হেসে বলল,“সেটা না-হয় নিলাম, সমস্যা কোথায়? জামাই তো আমারই।”
জুবায়েরের পরিবার পূর্ব পরিকল্পনা করেই রিশাকে দেখতে এসেছে। জুবায়েরের কাছে থেকে ছবি আগে থেকেই দেখেছিল তারা। অপছন্দ করার মতো কিছুই খুঁজে পায়নি তারা। শুধু সামনা-সামনি দেখার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই। সুতরাং সব চিন্তাভাবনা করেই আগে থেকে রিং নিয়ে এসেছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজই রিশাকে রিং পরানো হবে এবং বিয়েতেও দেরি করবেন না বলে রিশার পরিবারকে জানিয়েছেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু মনের মতো পেয়ে জুবায়েরের মা, বোন এবং দুলাভাই সিদ্ধান্ত নিলেন রিশাকে আজই রিং পরানো হবে। রিশার পরিবারের সবাইও আজ উপস্থিত আছে। সুতরাং সবার আলাপ-আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো রিং পরানোর।
জুবায়েরের হাতে রিংয়ের বক্স দেওয়া হয়েছে। রিশা বারবার প্রলম্বিত শ্বাস ফেলছে। পাশের মানুষটাকে দীর্ঘদিন ধরে সে চেনে এবং জানে তবুও এই সময়ে তার বুক কাঁপছে। ভাগ্য পরবর্তীতে সহায় হবে তো? এখনকার মতো সারাজীবন স্মুথলি যাবে? জুবায়ের এমনই ম্যাচিউর থাকবে? তাকে বুঝবে? ঠান্ডা মস্তিষ্ক কখনো তার কোন কাজে উত্তপ্ত হয়ে সব পু*ড়িয়ে ছাড়খাড় করে দেবে না তো! মানুষ একরকম থাকবে? নানা রকম প্রশ্ন ঘুরছে রিশার মাথায়।
রিশার মুখ মলিন দেখে নিতুসহ তার দুই ভাবি এগিয়ে এলো। কাধে হাত দিয়ে সাহস যোগালো। একটু বোধ হয় শান্ত হলো সে। তিনজন একটু সরে দাঁড়াতেই জুবায়ের আলগোছে রিশার হাতের ওপর হাত রেখে মৃদু গলায় বলে উঠল,
“তোমার হয়তো ভয় লাগছে। কাঁপছো তুমি। তোমার জুবায়েরের ওপর ভরসা নেই তোমার? তোমার এই পুরুষটি এখন যেমন ভবিষ্যতেও ঠিক এমনই থাকবে৷ আমার সব আছে। এখন শুধু তোমাকে চাই। তোমাকে ভালোবাসতে চাই। তুমি- তোমাকে আমার করে দেবে না?”
রিশা কিছুক্ষণ চেয়ে রইল জুবায়েরের দিকে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,“দেব।”
জুবায়ের মুচকি হেসে হাতের রিংখানা পরিয়ে দিল রিশার অনামিকায়। রিশার দিকে একটু চেপে এসে বিড়বিড় করে বলল,“ভালোবাসি।”
#চলবে…..