প্রিয় বিকালফুল পর্ব-৪৭

0
629

#প্রিয়_বিকালফুল(৪৭)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)

প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিতু। কিট সামনেই রাখা। ধীরে ধীরে একটা দাগ স্পষ্ট হয়ে দ্বিতীয় দাগ পেরিয়েছে। স্পষ্ট হয়নি এখনো। নিতু একহাত বুকে চেপে নিঃশ্বাস যেন বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হতেই দু’চোখ অশ্রুতে টলমল করে উঠল। ঠোঁট জুড়ে দেখা দিল মৃদু হাসি। দাগ দুটো স্পষ্ট হয়েছে। নিতু চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে গা কাঁপিয়ে হেসে ফেলল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল দু’ ফোটা চোখের পানি।

কিছুক্ষণ সময় ওভাবেই পার করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে গাল মুছে উৎসের দিকে এগিয়ে গেল।

উৎসের পাশে বসে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল নিতু। নিজেকে ধাতস্থ করে নরম গলায় ডাকলো উৎসকে। নিতুর ডাকে সাঁড়া দিল না উৎস। শুধু একটু নড়েচড়ে আবার শান্ত নদীর মতো ঘুমিয়ে গেল৷ নিতু পুনরায় ডাক জোরালো করল। উৎস পাশে ফিরে ঘুমঘুম চোখে নিতুর দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ দেখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,

“হুম! কিছু হয়েছে? তুমি ঠিক আছো?”

নিতু ডানে-বামে মাথা নাড়ল। যার অর্থ সে ঠিক নেই৷ উৎস চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল। প্রশ্নসূচক দৃষ্টি মেলে বলল,

“কী হয়েছে?”

নিতু মুখে কিছু না বলে প্রেগন্যান্সির কিট এগিয়ে দিল। বাম হাতে কিট এবং ডান হাত টেনে নিজের পেটের ওপর রাখল। উৎস পরিস্থিতি বুঝে উঠতেই নিতুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে চাইলো। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জানতে চাইল,

“এটা সত্যি!?”

নিতু মৃদু হেসে ওপর নিচ মাথা নাড়ল। উৎস তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। বেশ উত্তেজিত দেখালো তাকে। প্রেগন্যান্সির কিট হাতে নিয়েই আরও কিছুটা এগিয়ে এলো নিতুর দিকে। নিতুর গালে, কপালে, ঠোঁটে এক নাগাড়ে কিছুক্ষণ চুমু খেল। উৎসের এমন ব্যবহারে হাঁপিয়ে উঠল যেন নিতু। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

“ছাড়ো! দম আটকে যাবে তো আমার।”

উৎস এক টানে বুকে জড়িয়ে নিল নিতুকে। বুকের সাথে তার মাথা চেপে ধরে বলল,“তুমি জানো, এরকম একটা খবরের জন্য কত অপেক্ষায় ছিলাম আমি! আমার জীবনের দ্বিতীয় খুশি আসতে চলেছে। আল্লাহ! আমি কীভাবে শুকরিয়া আদায় করব! সবই তো কম কম লাগবে। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। আজকের সকালটা জীবনের সেরা সকালগুলোরও সেরা। আমার এ যাবতকালের সবচেয়ে দামি উপহারটা তুমি দিতে চলেছ, নিতু। তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না আমি ঠিক কতটা খুশি। ঠিক কতটা!”

নিতুর চোখ টলমল করে উঠল। উৎসের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে নিয়ে তার গালে হাত স্পর্শ করে বলল,

“আমাদের মাঝে আরও একটা ছোট্ট প্রাণ আসছে, উৎস। বিছানায় ঠিক ওখানে মাঝখানে ও থাকবে। ছোট ছোট নরম হাত-পা, আঙুল, নরম গাল, ঠোঁট! আমি আর ভাবতে পারছি না।”

উৎস নিতুর দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে চুমু খেলো এরপর পুনরায় কপালে চুমু খেয়ে বলে উঠল,“জুনিয়র নিতু বা উৎসের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাও। তোমার ব্যস্ততা বাড়িয়ে দিতে সে আসছে।”

নিতু মৃদু হেসে বলল,“শুধু আমি কেন? তার বাবারও কাজ কমবে না সেটাও মাথায় রাখুন। এখন আমাকে সামলাচ্ছেন ভবিষ্যতে আরও একজন বা দুজনকে সামলাতে তৈরি হন।”
______
শুক্রবার। রিশার বিয়ের দিন। বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের ভিড় জমেছে। সবাই বিয়ে বাড়িতে কোন না কোন কাজে ব্যস্ত। বসে বসে সবকিছু দেখছে শুধু নিতু। উৎস তাকে কোন কাজ করতে দেওয়া তো দূরের কথা অতিরিক্ত চলাফেরা অবধি করতে দেয়নি৷ প্রেগন্যান্সি টেস্টের পর থেকে প্রায় অনেকটা পরিবর্তন এসেছে নিতুর জীবনে। গত কয়েকদিনে উৎস ধরাবাঁধা নিয়ম করে দিয়েছে তাকে। আপাতত সবরকম কাজ তার বন্ধ। বাহিরে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া বের হওয়া নিষিদ্ধ। উৎস নিজে সকাল সকাল তাকে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। বাহিরের খাবার বন্ধের সাথে সাথে বাসায় প্রতিদিন নিত্যনতুন ফল আসা শুরু করেছে।
সারাক্ষণ নিতু কী খাবে না খাবে জিজ্ঞেস করার ওপরেই থাকছে উৎস।

রিশাকে পার্লার থেকে তিনজন মেয়ে এসেছে সাজাতে। সাজানো শেষ হওয়া অবধি নিতু সেখানেই ছিল। সাজানোর আগাগোড়া সে রিশার পছন্দ ভালোভাবে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। সাজানো শেষ হলে যারা এসেছিল পার্লার থেকে তাদের পাওনা মিটিয়ে দিয়ে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো।

উৎস সারাদিন বাহিরেই ব্যস্ত ছিল। কাজ শেষ হতেই নিতুর কাছে পৌঁছেছে সে। বাড়ির কয়েকজন খাওয়ার সময় নিতুকে ডাকলেও সে যায়নি। এমনকি ফরিনা বেগমও নিয়ে যেতে পারেননি। উৎস আগে থেকে বলে রেখেছিল দুজন একসাথে খেতে বসবে। উৎস আসতেই নিতু উঠে দাঁড়ালো তার সাথে যাওয়ার জন্য। এতক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে ক্ষুধাও পেয়েছে তার।

রিশা একা একা রুমে থাকবে সে কথা বলতেই মালিহা নিজেই এসে উপস্থিত হলো। নিতুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“বাবুর মা তো বাবুর বাবাকে ছাড়া খেতে গেল না। খাবার এনে দিতে চাইলাম সেটাও আনতে দিলে না। এখন যাও তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। ”

নিতু মুচকি হেসে বলল,“রিশা একা একা থাকবে, ভাবি?”

মালিহা রিশার পাশে গিয়ে বসল।
“একা কেন থাকবে? দুই দুইটা ভাবি এখনো আছে। তোমার চিন্তা করতে হবে না। এখন যাও। জলদি কিছু খেয়ে নাও।”

নিতু যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উৎস বলল,“খাওয়া দাওয়া শেষ করেই আমি ওকে আবার রেখে যাচ্ছি, ভাবি।”

মালিহা হেসে বলল,“তোমার বউকে তুমি আমাদের কাছে রেখে যাবে নাকি কলিজার ভেতর রেখে দেবে সেটা তুমিই জানো।”

“রাখতে পারলে তো ভালোই হতো।” বলেই নিতুকে হাত ধরে টেনে নিয়ে রুম থেকে বের হলো উৎস।

দুজনে পাশাপাশি খেতে বসেছে। নিতুর যা যা প্রয়োজন উৎস সেদিকে খেয়াল রাখছে। নিজের খাবার খাওয়া শেষ হলেও নিতু ধীরেধীরে নিজের খাওয়া শেষ করছে। উৎস চুপচাপ বসে নিতুর শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছে। উৎস বসে আছে দেখে নিতু কিছুটা খাবার শেষ না করেই উঠতে যাবে তখনই উৎস বলে উঠল,

“উঠছো কেন?”

নিতু প্লেট থেকে হাত উঠিয়ে নিয়ে বলল,“খাওয়া শেষ। উঠব না?”
“কিন্তু তুমি তো হাড্ডি খেতে পছন্দ করো।”

নিতু এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,“তাই বলে এখানে বসে এখন হাড্ডি চিবোবো?”
“কেন? সমস্যা কোথায়?”
“কোন প্রয়োজন নেই। চলো উঠি। তাছাড়া তুমি অনেকক্ষণ বসে আছো।”
“আমি বলছি তো সমস্যা নেই৷ তুমি শেষ করো। আমি আছি।”

নিতু সন্দিগ্ধ দৃষ্টি মেলে শুধালো,“শিওর?”
“ইয়েস।”

সন্ধ্যার দিকেই জুবায়ের এবং রিশার বিয়ের কাজ শুরু হলো। কাজি সাহেব এসেছেন বেশ কিছুক্ষণ আগে। কাগজপত্র সব ঠিকঠাক করে বিয়ের কাজ শুরু হলো। জুবায়ের এবং রিশাকে পাশাপাশি বসানো হয়েছে। কাজি সাহেব রিশাকে কবুল বলতে বলা হলো। রিশা চুপচাপ বসে আছে। বুক কাঁপছে তার। চোখ দুটো টলমল করে উঠল। আজকের দিন নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছে সে! অথচ সেই দিনটা এই মুহূর্তে উপস্থিত হওয়াতে ভেতরে ভেতরে এত ভয়! এত সঙ্কোচ!

চারদিক থেকে সবাই শুধু রিশাকে কবুল বলতে বলছে। রিশার অন্যপাশেই তার দুই ভাবি এসে বসেছে। বারবার তারা বলেই যাচ্ছে কবুল বলার জন্য। রিশা যেন ‘কবুল’ শব্দটা উচ্চারণই করতে পারছে না।

জুবায়ের পাশে বসে মাথানিচু করে আঁড়চোখে রিশাকে দেখছে। রিশার এমন অবস্থা দেখে সে বিড়বিড় করে বলে উঠল,

“আমার হতে এত ভাবতে হচ্ছে? এখনো ভরসা করতে পারছো না, রিশা? কীসের ভয় তোমার? কাঁপছো কেন? আমি আছি তো তোমার পাশে।”

রিশা তবুও চুপ। কারও কোন কথা যেন তার কানেই যাচ্ছে না। অবশেষে রিশার মা এগিয়ে এলেন। মেয়েকে বোঝালেন কিছুক্ষণ। জুবায়ের আরও একবার ভরসা যোগালো অতঃপর সব ভয় জয় করে আর নতুন জীবনের সূচনা ঘটাতে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে উঠল,

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

#চলবে…….