#প্রিয়_বিকালফুল(৫০)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
বাড়িতে সকাল থেকে ক্ষণে ক্ষণে এটা ওটা রান্না হচ্ছে। বেশ কয়েক মাস পর উৎস আজ বাসায় ফিরবে। নিতুর ডেলিভারির সময়ের খুব বেশি দেরি নেই। হাতে গোনা কয়েকটা দিন বাকি।
উৎস দূর থেকে যতটা সঙ্গ দেওয়া সম্ভব ততটা সঙ্গ দিয়েছে নিতুকে। কাজের ফাঁকে প্রায় সবসময় ভিডিয়ো কলে অথবা অডিয়ো কলে থাকতো। কখনো নিতুর শরীর খারাপ হলে নিজে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে না পারলেও নিজেই ডাক্তারের সাথে আগে থেকে কথা বলে মাকে আর ড্রাইভারকে পাঠাতো নিতুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাছে না থেকেও যতটা থাকা যায় তার সর্বোচ্চটা উৎস ছিল।
এবার দীর্ঘ ছুটি সে নিয়েছে। যতটুকু সে নিতুর জন্য করতে পারেনি সেটা বাকি সময়টায় পূরণ করে দেবে। এতদিন উৎস সশরীরে নিতুর কাছে কাছে থাকতে পারেনি বলে কত আক্ষেপ তার! নিতুকে প্রতিদিন নিজের আক্ষেপের কথা শুনিয়েছে সে। নিতুর কাছে, চোখের সামনে থাকতে পারছে না। নিতুর গর্ভে বেড়ে ওঠা ছোট্ট দেহখানার নড়চড় সে নিজে চোখে দেখতে পারছে না৷
উৎস আসার খবরে নিতু ভীষণ খুশি। উৎস কবে থেকে বাড়ি ফেরার চেষ্টা করছিল কিন্তু হয়েই উঠছিল না বিভিন্ন কারণে। এখন অন্তত বাড়িতে নতুন অতিথি আসার আগে দুজনের ভালো কিছু সময় কাটবে সেই একজনকে কেন্দ্র করে। সেই একজনের জন্য কত কী করা বাকি তাদের!
সকাল থেকে যা যা রান্না হচ্ছে, ফরিনা বেগম তার তদারকি করছেন। নিতুকে সামনেই বসিয়ে রেখেছিলেন বিভিন্ন খাবার টেস্ট করে দেখার জন্য। তিনি সেই প্রথম থেকে নিতুর ভীষণ যত্ন করেন। নিতুর কখন কী খেতে ইচ্ছে করে সেটা বলতে দেরি হলেও ফরিনা বেগমের সেটা এনে নিতুর সামনে তুলে ধরতে দেরি হয় না। নুরজাহান বেগম ফরিনা বেগমের কাজকর্ম দেখেন আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন মেয়ের এত ভালো ভাগ্য বলে৷
রান্নাবান্না, সব কাজ শেষ হলে নিজেরা আগেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিল নিতুরা। উৎস জানিয়েছে তার বাসায় আসতে রাত হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই নিজ নিজ রুমেই অবস্থান করছিল। নিতু নিজেও বসে বসে বন্যার সাথে কথা বলছিল। তার বিয়ের কয়েকদিন মাত্র বাকি। বন্যা খুব করে চায় নিতু কয়েকদিন আগে থেকে তার বিয়েতে থাকুক কিন্তু সেটা নিতুর পক্ষে সম্ভব নয়। এই অবস্থায় নিজের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও অবস্থান করা বড্ড বোকামি হবে। বন্যা নিতুর সব কথা শুনেও আবদারের স্বরে বলল,
“অন্তত একদিন আগে আয়। হলুদসন্ধ্যা থেকে অন্তত আমার বিয়েতে থাক। তোকে ছাড়া আমি কীভাবে আনন্দ করব বল?”
নিতু হেসে বলে উঠল,“নিজের বিয়েতে কে আনন্দ করে,ভাই? তুই তো আনন্দ করবি বিয়ের পর থেকে আশরাফ ভাইয়ের জীবন ত্যানাত্যানা করে।” বলেই খিকখিক করে হেসে উঠল নিতু।
ওপাশ থেকে বন্যা বলল,“নিজের বিয়েতে আনন্দ করব না তো কি দুঃখবিলাস করব?”
“সেটা কেন করবি? নতুন বউয়েরা যেমন মাথায় ঘোমটা টেনে মাথানিচু করে বসে থাকে, কেউ সামনে আসলে মাথা ঝাঁকিয়ে সালাম দেয় তুইও সেটাই করবি। ”
“মজা নিস না।”
“আরে তুই বল, আমি নিজেই নিজের শরীর নিয়ে এখন চলতে পারি না। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে কোনকিছুতে শান্তি পাই না। এই অবস্থায় আমি আগে আগে গিয়ে কী করব? তাছাড়া এত মানুষের মধ্যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। তার চেয়ে ভালো তাড়াতাড়ি বিয়ে কর, একবেলা অন্তত জামাই নিয়ে খেয়ে আসি আর বিয়ের পর বর নিয়ে আমার বাসায় আয়।”
বন্যা আফসোসের সুরে বলে উঠল,“কেন যে আমার বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট হতে গেলি!”
“লা**ত্থি খাবি। তোকে বলে কয়ে প্রেগন্যান্ট হওয়া লাগবে নাকি আমার? খা*টাশ কোথাকার! আর তোর সেসময় বিয়ের কথা তো দূরের কথা দেখাও হয়েছিল না। উল্টাপাল্টা কথা বললে বাসায় গিয়ে মে*রে আসব।”
“তবু আয়।”
“বিয়ে কর, বিয়েতেই যাব। কারও হবু বউকে পি**টানোর ইচ্ছে আপাতত নেই।”
দুজনের বেশ কিছুক্ষণ বিয়ে, নতুন জীবন, নিতুর বাবু, উৎস, আশরাফ, পরিবার ইত্যাদি এটা ওটা নিয়ে কথা হলো। নিতুর দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমোনোর অভ্যাস বলে ফোন রেখে ঘুমিয়েছিল কিছু সময়।
বিকেলে রিশা, জুবায়েরসহ নিতুর খালাশাশুড়ির বাড়ির প্রায় অনেকে নিতুদের বাড়িতে এসেছিল নিতুকে দেখতে। রিশা এবং জুবায়েরের বিয়ের পর এ বাড়িতে প্রথমবার আসা। নতুন বর-বউ বাড়িতে বেড়াতে এলে তাদের কিছু উপহার দেওয়া বাঙালী রীতিতে অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। এখন যেহেতু নিতুরও শারীরিক অবস্থা ভালো না, বের হতে পারবে না তাই শাশুড়ির সাথে আলাপ-আলোচনা করে ফরিনা বেগম নিজেই বের হলেন। যতই নিতুকে দেখতে আসার জন্য সবাই এ বাড়িতে আসুক না কেন নতুন জামাই-মেয়েকে তো আর খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়া যায় না। তাছাড়া মার্কেট খুব একটা দূরেও তো নয়। বাড়ির কাছেই সবকিছু।
সবাই নিতুর রুমেই এসে বসেছে৷ কাজের মেয়েটা সবার জন্য বিভিন্ন রকমের নাশতার ব্যবস্থা করে ফেলেছে অল্প সময়েই। নিতু এই কয়েকমাস ধরে খেয়াল করেছে, মেয়েটা বেশ কাজের৷ অতিথিকে আপ্যায়ন করা সম্পূর্ণ জ্ঞান এবং দক্ষতা তার আছে। নুরজাহান বেগম শুধু হাতে হাতে মেয়েটাকে সাহায্য করেছেন কিছুটা।
সবার একসাথে সময়টা খুব ভালো কাটলো। সচরাচর বাসায় সেরকম কোন অতিথি আসে না। নিতুর প্রেগন্যান্সির সময়টায় মালিহা শুধু তার শাশুড়ির সাথে কয়েকবার এসে ঘুরে গিয়েছিল। এছাড়া এ বাড়িতে আর সেরকম কারও পা পড়েনি। আজ অনেকদিন পর রুমভর্তি মানুষ, সরব পরিবেশে নিতুর মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গিয়েছে।
এত মানুষের উপস্থিতি, সবার সাথে কথাবার্তা বলে নিজের মনটা ভালো হলেও নিতু বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে নুরজাহান বেগম বেশ চুপচাপ। প্রয়োজন ছাড়া সেভাবে কোন কথা বলছেন না তিনি। মাকে দেখে কিঞ্চিৎ চিন্তা হচ্ছে নিতুর।
অতিথিদের যাওয়ার আগেই ফরিনা বেগম বাসায় ফিরে এসেছিলেন। নতুন জামাই-মেয়েকে যথেষ্ট সম্মানি দিতে পেরেছেন তিনি। বাড়ি থেকে সবার যেতে যেতে সন্ধ্যা পার হলো। সবাইকে বিদায় দিতে নিতু নিজেও নিচে এসেছিল। সবাই চলে যেতেই ফরিনা বেগম নুরজাহান বেগমকে ডেকে রুমে আসতে বলে নিজের রুমে চলে গেলেন। নুরজাহান বেগম বেয়ানের ডাক শুনে পা বাড়াবেন তখনই নিতু পিছন থেকে বলে উঠল,
“তোমার কিছু হয়েছে, আম্মা?”
নুরজাহান বেগম একবার ফরিনা বেগমের রুমের দিকে তাকালেন। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললেন,
“তোর ব বাবা ম মানে নুরুল ছাড়া পেয়েছে।”
নিতুর মুখের রঙ যেন পরিবর্তন হলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে গলা উঁচিয়ে বলল,
“আম্মা, আমার আম্মাকে একটু পর পাঠিয়ে দিচ্ছি।” বলেই মায়ের হাত ধরে টেনে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো নিতু।
নুরুল ইসলাম কয়েদখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে গতকাল। তারই পরিচিত কেউ থানায় কথা বলে বের করেছে তাকে সেখান থেকে। বাহিরে বেরিয়ে সে যেন আরও বেশি বেপরোয়া রূপ ধারণ করেছে। বাড়ি ফিরে নুরজাহান বেগমকে বাড়িতে না পেয়ে ফোনের ওপর ফোন করে চলেছে। বাড়ির মেইনগেইটে বড় তালা ঝুলানো ছিল। চাবি নুরজাহান বেগমের কাছে। নুরজাহান বেগমের অপেক্ষা না করে নিজেই তালা ভেঙে বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেছে। এখন তার মূল উদ্দেশ্য বাড়ির দলিল। সে বাড়ি বিক্রি করতে চাইছে। নুরজাহান বেগমকে বারবার ফোন করা হচ্ছে, তিনি কিছুতেই রাজি নন বাড়ি বিক্রি করতে। ওই বাড়িটাই তো শুধু তার আছে। একটাই আশ্রয়স্থল।
নুরুল ইসলামের ব্যাপারে সবটা জেনে নিতু বলে উঠল,“আমাকে এতসব আগে জানাওনি কেন?”
নুরজাহান বেগম মাথানিচু করে বললেন,“ভেবেছিলাম তোকে জানিয়ে আর চিন্তায় ফেলব না কিন্তু চাপা রাখতে পারছিলাম না আর। আমার হয়তো তাড়াতাড়ি আরেকবার বাড়ি যাওয়া উচিত। ”
“তুমি একা গিয়ে কী করবে?”
“দেখি বাড়ি বিক্রি আটকানো যায় কি-না!”
“তোমার কি মনে হয় তুমি একা এসব আটকাতে পারবে? ওই লোক কতটা ভয়ংকর সেটা তুমি এতদিনেও বুঝতে পারোনি? আমি তোমাকে একা কিছুতেই ওখানে এখন আর যেতে দিতে পারব না৷”
“কিচ্ছু হবে না আমার। ও আমার আর কী করবে?”
নিতু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,“আম্মা, তোমার বরের ওপর এই বিশ্বাসটা আমারও ছোটবেলায় ছিল তারপর একদিন সেটারই সুযোগ নিতে উঠেপড়ে লেগেছিল। আমার সম্মান নষ্ট…..”
নুরজাহান বেগম নিতুকে থামিয়ে দিলেন। ভারি গলায় বললেন,“এসব অতীত আর মুখেও আনিস না, মা।”
নিতু ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকালো। নরম গলায় শুধালো,“কেন আম্মা? আমার তো কোন দোষ ছিল না। আমি তো প্রথমে বাবার মতোই ভেবেছিলাম। অথচ সে সুযোগ পেয়ে আমাকে কী বাজেভাবেই না ছুঁয়েছিল! সেদিন নিজে সাহস করে পদক্ষেপ না নিলে আজ আমার ধর্ষি*** উপাধি পেতে হতো। আমার গায়ে এখন তার বাজে স্পর্শের চিহ্ন আছে৷”
নিতু থামলো। পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে বলল,“আমি যদি কোনদিন সুযোগ পাই, নিজের হাতে শেষ করব তাকে৷ নিজের হাতে শেষ করব আমার ভয়ের আর ঘৃণার মানুষটাকে।”
দরজার পর্দাটা হঠাৎই নড়ে উঠল। নজরে আসতেই কথা বলা বন্ধ করে দিল নিতু। এ সময়ে বাড়ির ভেতরে বাতাস আসার কথা নয় এমনকি পর্দাও নড়ার কথা নয়। নিতু মায়ের দিকে একবার চেয়ে ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল। বাহিরের দিকে নজর নিবদ্ধ করে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠল,
“ ক কে বাহিরে?”
#চলবে…..