#প্রিয়_বিকালফুল(৫৩)
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
উৎস একটা বড় বক্স হাতে রুমে প্রবেশ করল। নিতু ততক্ষণে হাত থেকে ফোন নামিয়ে রেখেছে। বুকের ভেতর তার অজানা আশঙ্কার ঝড় উঠেছে। মনে মনে শুধু একটাই প্রশ্ন- উৎস কি নিতুর অতীত জেনে নুরুল ইসলামকে বন্দি করেছে?
উৎস বক্সটা খাটের ওপর রেখে মৃদু হেসে বলল,“নাও, জাদুর বাক্স।”
নিতু উৎসের দিকে চাইলো। শুধালো,“কী আছে এতে?”
“এখন বলেই দেই কী বলো?”
“হুম।”
“এখানে বাবুর জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস আছে। তোমার একটা একটা করে খুঁজে খুঁজে কিনতে হবে না। সুবিধা করে দিলাম না?”
অন্য সময় হলে হয়তো নিতু অনেক বেশি খুশি হতো, আগ্রহ দেখাতো, নিজের সন্তানের জন্য কেনা প্রথম উপহার বলে কথা কিন্তু এখন সে কিছুতেই খুশি হতে পারছে না। মনের মধ্যে বসে গেছে সেই একটা কথা-
“স্যার, সিংহপুরুষের অবস্থা তো নাজেহাল। ডোজ কি কমিয়ে দেব?”
নিতুর সেরকম প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে উৎস বক্সটা আনপ্যাক করা বন্ধ করে বলল,“তুমি খুশি হওনি?”
নিতু আমতা আমতা করে বলল,“খুশি হব না কেন?”
“তাহলে সেটা দেখতে পাচ্ছি না কেন?”
নিতু উৎসের কথার জবাব না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করল,“তুমি কাকে আটকে রেখেছ?”
নিতুর এমন প্রশ্নে চকিতে চোখ বড় বড় হলো উৎসের। বক্স রেখে তড়িঘড়ি করে ফোনটা হাতে নিল। স্ক্রিনে তখনও সেই মেসেজটা। উৎস বুঝলো, লুকোনোর আর কিছুই নেই এখন৷
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“নুরুলকে আটকে রাখা হয়েছে। খাতিরযত্ন চলছে। আমার বউকে এত বছর এত সুখে শান্তিতে রেখেছিল তার জন্য তো আমি তার জন্য কিছু করতেই পারি।”
নিতুর মধ্যে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা দিল। ক্ষেপাস্বরে বলে উঠল,“ মে***রে দাও ওকে। ওর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছে একেবারে। বেঁচে থাকার স্বাদ আমি হারিয়ে ফেলেছি। সবসময় আতঙ্কে থাকতে হয়েছে আমাকে। ভয়ে ভয়ে এত বছর বাঁচতে হয়েছে।”
উৎস বলল,“তুমি নিজে থেকে আমাকে কিছুই বলোনি, নিতু। আমাদের তো কম সময় একসাথে কাটছে না। তোমার উচিত ছিল আমাকে সবটা জানানো।”
নিতু মাথা নিচু করে বেশ কিছুটা সময় নিশ্চুপ রইল। আসলেই সে উৎসকে কিছুই জানায়নি। তার কাছে থেকে নুরুলের শা*স্তি সে কীভাবে আশা করে? যদিও নিতুর উচিত ছিল সবটা জানানো কিন্তু নিজের মায়ের দ্বিতীয় এবং বর্তমান স্বামী তাকে রে***প করার চেষ্টা করেছে এটাও কি বলার মতো কোন কথা? কী বলতো সে উৎসকে? তার সৎবাবা তাকে…..
এসবও আবার বলা যায়? একটা মেয়ে তো ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন উপায়ে এই পুরুষজাতির নোংরা স্পর্শ থেকেই বাঁচিয়ে এসেছে। সব কথা কি বলার মতো? তবে নুরুলের কথা হয়তো উৎসকে বলার মতোই ছিল।
নিতুর চোখ থেকে দুই ফোটা পানি বিছানায় টুপ করে পড়ল। সে নাক টেনে বলল,“আমি পারিনি, উৎস। সেই নোং*রা স্পর্শগুলোর কথা মনে করে করে তোমাকে বলতে আমি পারিনি৷ কীভাবে বলতাম আমি যে, আমার সৎবাবা…..
আমি পারিনি, উৎস। আমাকে মাফ করে দিও।”
উৎস নিতুর অবস্থাটা বুঝলো। আর কোন কথা না বাড়িয়ে নিতুকে আলতো হাতে নিজের কাছে টেনে নিল। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল প্রিয়তমাকে। নিতু মুখ লুকোনোর জন্য প্রিয় মানুষের বুক পেতেই ফুপিয়ে উঠল। উৎস নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করতে ব্যস্ত হলো৷
রাত আটটা। নিতু বসে বসে বাবুর জন্য কিনে আনা পুরো বক্সটা নিয়ে বসেছে। একটা একটা করে জিনিস দেখছে আর বন্যা, মালিহা, রিশাকে ছবি তুলে পাঠাচ্ছে।
উৎস নিতুকে বুঝিয়ে, শান্ত করে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। নিতুর জোরাজোরিতে উৎস তাকে সবটা জানাতে বাধ্য হয়েছে। দুজনে বসে যখন বাবুর জন্য নিয়ে আসা জিনিসপত্র দেখা শুরু করেছিল তখনই জরুরি কল আসায় বের হতে হয়েছে তাকে। উৎস ফোনকলে কথা বলার সময় নিতু যতটুকু শুনেছে তাতে সে বুঝেছে তখন যে নম্বরটি থেকে মেসেজ এসেছিল, ফোনকলটাও ঠিক সেই নম্বর থেকেই এসেছে আর সেখানে কোন বিপদ হয়েছে। উৎস তাড়াহুড়ো করে নিতুকে রেখে বাহিরে বেরিয়েছে।
___
উৎস গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ হলো। নুরুলের কাছে যাকে দায়িত্বে রেখেছিল সে একটা বোকামি করে বসেছে। নুরুলকে যখন শারীরিক অ*ত্যা*চার করছিল তখন টানা দুই থেকে তিনবার জ্ঞান হারিয়েছিল সে। শেষে অবস্থা একদম খারাপ আশঙ্কা করে লোকটা কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে যায়। তখনই হাত-পায়ের বাঁধন খুলে মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিল। তাকে মূলত দুইটা কাঠের চেয়ারে কোনমতে শুইয়ে রেখে হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছিল। ওপরে পানির পাত্র রেখে সামান্য ফুটো করে দেওয়া হয়েছিল যেন ধীরগতিতে পানির ফোটা সরাসরি নুরুলের কপালের মাঝখানে পড়ে। প্রথমদিকে নুরুলের সেরকম কোন অসুবিধা মনে না হলেও সময়ের সাথে সেটা অসহ্যকর হয়ে ওঠে। যন্ত্র*ণায় ছটফট করতে থাকে সে। মাথা এমন করে রাখা হয়েছিল যেন কোনভাবে এক ইঞ্চিও সরাতে না পারে।
উৎস সামনে গেলে অসম্ভব যন্ত্রণায় কতবার যে অনুনয় করেছে! উৎসের মন কিছুতেই গলেনি। তার কানে বেজেছে নিতুর সেই কথাগুলো। কীভাবে তাকে বছরের পর বছর ভয়ে, সঙ্কোচে কাটাতে হয়েছে। কীভাবে সে নোং*রা স্পর্শ, নোং*রা, লোলুপ দৃষ্টি সহ্য করেছে! কিছুতেই ক্ষমা করতে পারেনি সে এই লোকটাকে।
নুরুল আজ যখন দ্বিতীয়বারের মতো জ্ঞান হারালো তখন সাথে থাকা লোকটা এক প্রকার তাড়াহুড়ো করেই সকল প্রকার বাঁধন খুলে দিয়েছিল কারণ উৎসের একটাই কথা ছিল, তার সাথে যা-ই করা হোক না কেন প্রাণে যে না ম**রে। দায়িত্বরত লোকটা পাশের রুমে গিয়ে ফোন করার জন্য যে অল্প সময় নিয়েছিল সেই সময়টাই নুরুল কাজে লাগে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেখান থেকে পালিয়েছে। লোকটা উৎসের সাথে কথা বলে সামনের রুমে আসতেই নুরুলকে আর দেখতে পায়নি সে৷ ততক্ষণে সে বুঝে গিয়েছিল নুরুল তার বুদ্ধি দিয়ে শেষ চাল-টা চেলেছে। পরক্ষণেই সে পুনরায় উৎসকে জানিয়ে দিতেই উৎস বেরিয়েছে।
নুরুলকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেটা গ্রাম টাইপ ফাঁকা এলাকা। আশেপাশে সেরকম বাড়ি না থাকলেও সামনে দিয়ে মহাসড়ক চলে গিয়েছে। ব্যস্ত রাস্তা। যেহেতু আশেপাশে সেরকম লোক চলাচল নেই সুতরাং এখানে বেপরোয়া গতিতে সকল প্রকার বড় বড় গাড়িগুলো চলাচল করে।
উৎসের বাড়ি থেকে উক্ত এলাকা যথেষ্ট দূরে হওয়ায় তার সেখানে এসে পৌঁছতে অনেকটা সময় লেগে যায়। দায়িত্বে থাকা লোকটা উৎস এলে জানিয়েছে সে আশেপাশে সাথে সাথে খুঁজে দেখেছে কিন্তু তাকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এত মুমূর্ষু অবস্থায় কেউ এত তাড়াতাড়ি কীভাবে পালাতে পারে সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছে উৎস।
দুজনে মিলে দুইদিকে বেরিয়েছে নুরুলকে খুঁজতে। উৎসের কথা তাকে কিছুতেই পালাতে দেওয়া যাবে না। যেভাবেই হোক জীবিত বা মৃত, খুঁজে বের করতেই হবে। এমন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
উৎস ধীরগতিতে গাড়ি ড্রাইভ করে চোখ-কান খোলা রেখে খুঁজে চলেছে। ব্যস্ত রাস্তায় কোথায় পাওয়া যাবে কে জানে। সামনে একটা স্টল দেখে সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছিল উৎস। নুরুলকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখান থেকে অল্প কিছুদূর এসেছে সে। স্টলের সোজাসুজি রাস্তার অন্যপাশে মানুষ জড়ো হয়েছে। হয়তো সেখানে কিছু একটা হয়েছে ভেবে উৎস সামনে এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামালো। এপাশে কাউকে সেরকম দেখতে পাচ্ছে না সে।
একজন পানির ছোট কলস নিয়ে দুইপাশে গাড়ির অবস্থান বুঝে দৌঁড়ে এপাশে এলো। পানি প্রয়োজন। সামনেই স্টলের পাশে একটা টিউবওয়েল। উৎস গাড়ি থেকে নেমে লোকটার দিকে এগিয়ে গেল। উৎসকে দেখেও লোকটা ব্যস্ত ভঙ্গিতে টিউবওয়েল চাপছে। উৎস শুধালো,
“ভাই, কী হয়েছে?”
লোকটা উৎসের দিকে না দেখেই বলল,“একটা মধ্যবয়স্ক লোক গাড়িতে ধা*ক্কা খেয়ে ছিট*কে পড়েছে। অবস্থা খারাপ।”
#চলবে……