#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৪
শুভর ধারণা ঠিক হল। ফুল, শুভকে খুঁজতে খুঁজতে ঘরে আসলো। টেবিলের কাছে এসে শুভর লেখা চিঠি দেখতে পেয়ে খুশিতে বাকবাকুম হল। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পুরো চিঠি পড়ে লজ্জায় লাল নীল হতে লাগল। তার পিছনে কখন শুভ এসে দাঁড়াল বুঝতেই পারল না। শুভ গোসল সেরে ফুলের পিছনে এসে দাঁড়ালো। ফুল এখনো শাড়ি খুলেনি কিন্তু কেনো খুলেনি, কে জানে!
জানালার পাশে দাড়িয়ে চিঠি পড়ছিল। শুভর কাছে এই দৃশ্য স্মৃতি হিসাবে রেখে দিতে ইচ্ছে করল। সে নিঃশব্দে ক্যামেরা বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল। আওয়াজ পেয়ে ফুল তাকিয়ে লজ্জায় চিঠিতে মুখ লুকালো। শুভ সেই দৃশ্যেরও ছবি তুলল। ফুল মুখ লুকিয়ে বলল,” থামো!”
শুভ ফুলের কাছে এগিয়ে আসলো। একদম কাছাকাছি। ফুল তার বাবু বরকে কাছে পেয়ে তার বুকে মুখ লুকালো। শুভ এবারও মূর্তির মতো দাড়িয়ে রইলো। হৃদপিণ্ডের আওয়াজটা আবার বেড়ে গেল। গলার স্বর নিচু করে বলল,” ” আমাকে ছুঁয়ে দিলে, এই দেখো মনে হচ্ছে কেউ বুকে ছু’ড়ি মেরে দিয়েছে। এ কেমন যন্ত্রণা বলতে পারবে, ফুল!”
ফুল মাথা তুলে পিটপিট করে তাকালো। কিছুক্ষণ বিজ্ঞদের মতো ভেবে মাথা নাড়ালো যে সে জানে না। শুভ ফুলের বোকাসোকা চেহারাই দেখতে লাগল।
——————
এই বাড়িতে আসার পর অনেক কিছুই বদলে গেছে। বদলে গেছে ফুলের দুঃখময় জীবন। ফুল এখন সুখের সাগরে সাঁতরে বেড়ায়। নিজের জীবন নিয়ে এখন আর ফুলের আফসোস নেই। সে খুবই খুশি নতুন পরিবার নিয়ে। বাবার কথা একদমই মনে পড়ে না। কেনোই বা মনে পড়বে? এবাড়িতে আসার পর একদিনও ফুলকে দেখতে আসেনি। ফুলের জীবনে এত পাষাণ পিতা কখনো দেখেনি। ফুলের মা বাবা আসে না তা নিয়ে তার শ্বশুর বাড়িতেও কোনো অভিযোগ নেই। ফুল চায় না তারা আসুক। এবাড়িতে ফুলকে মেয়ের মতো আদরে রাখে সবাই।
বিকালবেলা ফুল শাশুড়ির সাথে ছাঁদে গেল। শুভ বকশি কাকার সাথে বাজারে গেছে। ছাঁদে এসে বাগানবিলাসের পাশে বড়ো সরো দোলনা দেখে মন ভাল হয়ে গেল। ছাঁদে হরেক জাতের ফুলের গাছ। ফুলের শাশুড়ি গাছগুলোর পরিচর্যা শুরু করে দিলেন। ফুলকে বললেন, দোলনায় বসে থাকতে। ফুল তাই করল, দোলনায় বসে পা দুলিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। মেঘেঢাকা আকাশ দেখে এবার মন খারাপ হল না বরঞ্চ বৃষ্টির আগমনে মন আনন্দে নেচে উঠলো। আওয়াজ তুলে শাশুড়িকে ডেকে বলল,” বৃষ্টি হলে আমি যদি ভিজি, তাহলে তুমি রাগ করবে, মা?”
ফুলের শাশুড়ি হেসে বললেন,” রাগ করব কেনো? তোদের এই বয়সটাই তো আনন্দ করার বয়স। দুই এক বছর পর এই অনুভূতি অনুভব করবি না। যা করার এই বয়সেই করে নিবি।”
ফুল খুশি হলো। কিছুক্ষণ পর ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। ফুলের শাশুড়িও একদফা ফুলের সাথে ভিজলো। গাছগুলো গুছিয়ে নিচে যেতে যেতে বলল,” বেশি দেরী করিস না, ফুল। জ্বর ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ফুল দোলনায় পুনরায় দুলতে দুলতে উত্তর দিল,” আর পাঁচ মিনিট, মা!”
ফুলের শাশুড়ি চলে যেতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে জিহ্বা বের করে বৃষ্টির পানি পান করার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল। চোখ বন্ধ করে দুলে দুলে একাই হাসতে শুরু করল ফুল। আজ ফুলের জীবন সিনেমার মতো রঙিন মনে হচ্ছে। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই, কষ্ট নেই।
ফুল দুইহাত মেলে ঘুরে ঘুরে বৃষ্টি উপভোগ করতে লাগল। তখনই শুভর আগমন ঘটলো। ফুল টের পেল না। ঘুরতে ঘুরতে শুভর বুকে গিয়ে ধাক্কা খেল। শুভর মাথার উপর ছাতা দেয়া। বাজার থেকে ফুলকে খুঁজতে খুঁজতে সরাসরি ছাদে চলে আসলো। ফুলকে ভিজতে দেখে এগিয়ে এলো। এদিকে ফুল লজ্জায় মাথা নিচু করে রেখেছে। শুভর চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। শুভর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, এক সমুদ্র পানি পান করলেও পিপাসা মিটবে না। ফুল শুভর ভয়ংকর চাহনি থেকে মুক্তি পেতে পুনরায় দুলনায় এসে বসলো। পা দুলিয়ে দোল খেয়ে বলল,” আমি আরেকটু ভিজব।”
শুভ বিড়বিড় করে বলল,” তাহলে আমার প্রেমের সাগরে ভিজো না!”
শুভর অন্যরকম দৃষ্টি থেকে ফুল বাঁচতে এসে বড়ো ভুল করে ফেলল। শুভ ঠিকই ফুলের কাছে চলে এলো।দোলনার পিছনে দাঁড়িয়ে ফুলকে দোল দিয়ে বলল,” পালাচ্ছো?”
ফুল মাথা নাড়াল। শুভ বলল,” আমার দিকে এক মিনিট তাকিয়ে থাকতে পারলে ভেবে নিব তুমি পালাচ্ছো না।”
ফুল একপলক শুভর দিকে তাকিয়ে পারল না। চোখে লাজ ধরা পড়লো। শুভ হু হা করে হেসে ছাতা ফেলে দিল। কালো রঙের শার্ট ভিজে শরীরের উন্মুক্ত অংশ বুঝা যাচ্ছে। শুভ ফুলের গা ঘেঁষে এসে বসল। ফিসফিস করে বলল,” আজ থেকে আমাদের মাঝে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, ফুল।”
ফুল মুচকি হেসে মাথা নাড়লো। শুভ ফু্লের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। ফুল কেঁপে উঠল। শুভ মুচকি হেসে শক্ত করে ধরে বলল,” তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালেবাসার ফুল। তুমি আমার জীবনের প্রথম স্পর্শফুল। তুমি আমার জীবনের প্রথম বিয়েরফুল।”
ফুল হেসে বলল,” বিয়ে তো সবারই হয়।”
” উঁহু, সবার হলেও সবাই আঁকড়ে ধরে না, ফুল। আমি তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।”
দুটো বাক্য অথচ গভীরতা অনেক। ফুল শুভর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিল। জীবন নিয়ে এখন আর তার কোনো অভিযোগ নেই। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষকে সে পেয়ে গেছে।
———————–
” বউ ছাড়া আর থাকা সম্ভব না,মা! এই মাসেই কিছু একটা ব্যবস্থা করো।”
দুইদিন পর আদিল বোম ফাটানো ঘোষণা দিল। যা শুনে ফুলের শাশুড়ি লাঠি হাতে সারাবাড়ি দৌড়াল। ফুল হেসে কুটিকুটি হচ্ছিল তখন শুভও একই কথা বলল। যা শুনে ফুল লজ্জায় মাথা কা’টা গেল। ফুলের শাশুড়ি দুই ছেলের প্রতিযোগিতা দেখে সিদ্ধান্ত নিল, আগামী দুই বছরের আগে ঘরের বউকে ঘরে আনবে না। এটা শুনে শুভ দাঁত বের করে হেসে ভাইয়ের উদ্দেশে বলল,” আমার চিন্তা নাই, আমার বউ তো আমার সাথেই আছে।”
আদিল মুখ ফুলিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল। এদিকে বাড়ির সবাই হেসে ফেলল।
শুভদের প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর আদিলের বউ উঠিয়ে আনবেন বলে জানালেন ফুলের শাশুড়ি। শুভ ও ফুলের বিয়ের অনুষ্ঠান ইন্টারমিডিয়েট শেষ হলে করবেন বলে জানালেন। শুভ এটা নিয়ে দ্বিমত করেনি। বিয়ে মানেই শারীরিক সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে তা নয়। বিয়ে মানে পবিত্র সম্পর্ক। শুভ না হয় পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ থেকে প্রণয় করবে তার ফুলবউয়ের সাথে!
————-
আজকাল নাফিস ফুলের থেজে দূরে দূরে থাকে। ফুলের সাথে কথা বলে না। সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। ফুল ভাবল আজ সে যেভাবেই হোক নাফিসের সাথে কথা বলবে। কয়েকদিন পর প্রথম সাময়িক পরীক্ষা। এরপর লম্বা ছুটি। নাফিসের সাথে কথা না বললে খারাপ লাগবে।
টিফিনের সময় ফুল শ্রেণীকক্ষেই বসে ছিল। শুভ বাহিরে গিয়েছিল, দোকান থেকে ঝালমুড়ি কিনে নিয়ে আসলো। সুযোগ বুঝে ফুলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,” অর্ধেক খাবে, বাকী অর্ধেক আমার জন্য রেখে দিবে। ভাগাভাগি করে খেলে ভালবাসা বাড়ে।”
শেষের কথা চোখ টিপে বলে শুভ চলে গেল। শুভ না বললেও ফুল রাখতো। কেননা, এতোদিনে শুভর সকল অভ্যাস সম্পর্কে ফুলের ধারণা হয়ে গেছে। ঝালমুড়ি খেয়ে ফুল বাহিরে বের হল। শুভ তার বন্ধুদের সাথে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। ফুল পিছনে গিয়ে শুভর হাতে ঝালমুড়ি ঠোঙা ধরিয়ে দিয়ে চলে আসলো। কলেজে এভাবেই তাদের লুকোচুরি প্রেম চলে। দুজনই খুব উপভোগ করে।
ফুল নাফিসকে আরিফার সাথে পেল। আজকাল দুজনের মধ্যে খুব ভাব হয়েছে। কলেজের মধ্যে অনেকেই তাদের লাভবার্ডস বলে সম্মোধন করে। ফুলের কাছেও তাদের বন্ডিং বেশ লাগে। দুহাত ভরে তাদের সম্পর্কের যেনো একটা নাম হয়, এই প্রার্থনা করে।
ফুলকে এগিয়ে আসতে দেখে নাফিস চলে যাচ্ছিল। আরিফা আটকাল। ফুল আগেই আরিফাকে বলে রেখেছিল। নাফিসের কাছে এসে ফুল তার পিঠে দুরুমদারুম কয়েকটা ঘা বসিয়ে বলতে শুরু করল,” তুই এতো নিষ্ঠুর কী করে হতে পারলি রে, নাফিস?”
নাফিস নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। ফুল আবারও বলল,” কি হয়েছে আমাকে বলবি তো? আমার বিয়ে হয়ে গেছে বলে ছোটবেলার বন্ধুকে দূরে ঠেলে দিবি?”
নাফিস মুখ খুলল,” তেমন কিছু না। তুই পাল্টে গেছিস তাই ডিস্টার্ব করি না।”
” ডিস্টার্ব না ছাই! আমি আগের মতোই আছি। কিন্তু তুই আগের মতো নাই। আমার জন্য এখন আর আগেরদিন আনা খাবার রেখে দিস না।”
আরিফা খুব ইমোশনাল মেয়ে। কষ্টের কথা শুনলে দু চোখ ভরে পানি গড়িয়ে পড়ে। সেই পানিতে কলেজের সকলে সাঁতার কেটে প্রথম পুরস্কার পাবে বলে মনে করে।
দুই বন্ধুর অভিমানী কথা শুনে আরিফা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” তোমরা কথা বলো। এখানে থাকলে আমি কলেজ ভাসিয়ে পরের এলাকায় নিয়ে চলে যাব।”
আরিফা চলে যেতেই নাফিস ফুলের দিকে তাকালো।ফুল তখনে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নাফিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেদিন ফুলের বাড়িতে যাওয়ার পরের ঘটনা জানাল। সবকিছু শুনে ফুল নাফিসের পিঠে আরো কয়েকটা ঘা বসিয়ে বলল,” তুই আমাকে চিনিস না? আমি কী এমন মেয়ে?”
” তুই ক্লিয়ার করার পর বুঝেছি। এতোদিন নিজের নিকৃষ্ট ভাবনার উপর ঘৃণা করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিস,ফুল!”
ফুল হেসে হাত বাড়িয়ে বলল,” আচ্ছা আচ্ছা। আজ কী এনেছিস?”
নাফিস পকেট থেকে দুইটা চকলেট বের করে বলল,” একটা তোর জন্য আরেকটা তোর বরের জন্য।”
ফুল খিলখিল করে হাসতে লাগল। নাফিসের পাশে বসে বাকীটা সময় শুভর করা পাগলামোর গল্প শুনাল।
চলবে…………
#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৫
পরীক্ষার সময়টায় শুভ কেমন বড়ো হয়ে গেল। যেখানে ফুলের শাশুড়ির পড়তে বসানোর কথা সেখানে শুভ ফুলকে পড়তে বসার তগাদা দিল। নিজের বানানো সিট দিয়ে বসিয়ে রাখল যতক্ষণ না তার পড়া শেষ হল। ফুল এই সুযোগের ফায়দা উঠালো অন্যভাবে। প্রতিটা পরীক্ষার জন্য একটি করে চিঠি বরাদ্দ করে দিল। শুভর চেহারা তখন দেখার মতো অবস্থায় ছিল! ঠোঁট উলটে বলল,” তুমি একটা দুষ্ট ফুল। সুযোগের সৎ ব্যবহার এভাবে করছো তাই না! আমার যেদিন সময় আসবে দামী কিছু চেয়ে বসব।”
ফুল শুভর কথায় হাসে। শুভর পাগলামিগুলো উপভোগ করে। বাংলা পরীক্ষার আগেরদিন ফুল শুভর ঘরে গেল না। নিজের ঘরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকল। কেননা শুভ কথা দিয়ে কথা রাখেনি। আগামীকাল চার নাম্বার বিষয় পরীক্ষার দিন অথচ ফুল একটা চিঠিও পেল না। সন্ধ্যায় শুভ বাড়ি ফিরল। ফুলকে নিজের ঘরে না পেয়ে মায়ের কাছে আসলো। সেখানেও পেল না। গেইটের কাছে এসে শিউলি ফুলের গাছের নিচে তাকালো সেখানেও নেই। শুভ চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর মনে পড়ল, শুভ ফুলের ঘরে তো দেখেনি! সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠে ফুলকে নিজের ঘরে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফুলের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফুল বাবুবরের আগমনের আভাস পেয়ে পড়ার টেবিলে বসে মনোযোগ সহকারে পড়ার নাটক করতে লাগল। শুভ ফুলকে ডাকল,” কি হলো! আমার সাথে পড়বে না?”
ফুল কথা বলল না। যেনো সে শুনতেই পারেনি এমন ভাব ধরল। শুভ পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর ভয়ংকর একটা কাজ করল। ফুলের গালে টুপ করে চুমু বসিয়ে দিল। ফুলের চোখ তখন বড়ো হয়ে আসলো। গালে হাত দিয়ে শুভর দিকে তাকাতেই শুভ দাঁত বের করে হেসে বলল, ” ঘরে না গেলে ডাবল হবে।”
ফুল তৎক্ষনাৎ বইপত্র গুছিয়ে শুভর ঘরের দিকে ছুটলো। এদিকে শুভ নিজের ঠোঁটে হাত ছুঁয়ে বলল,” টেস্টটা খারাপ না।”
শুভ ঘরে গিয়ে দেখল, ফুল পড়ছে। এবারের পড়া শুভর চোখ ফাঁকি দেয়ার জন্য। চেয়ার টেনে শুভ পড়তে বসলো। প্রতি পরীক্ষার মতো প্রয়োজনীয় পাড়াগুলো দেখিয়ে দিল।
—————-
শেষ পরীক্ষার দিন নাফিস ফুলের জন্য কেনা ওড়নাটা আবারো নিয়ে আসলো। ফুলের সামনে নাফিস খুব স্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করল। তার মনের অন্তপটের লুকানো কথা কাউকে বুঝতে দিল না। শেষ পরীক্ষার দিন সকলেই বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। শুভ তার কাছের দুই বন্ধুকে নিয়ে কলেজ থেকে বের হয়েছে। ফুলকে বলে গেছে, শুভর জন্য অপেক্ষা করতে।
গতকাল বিকালে বাজার থেকে ফেরার পথে বাদামের ক্ষেত দেখতে পেল। চাষীরা বাদাম তুলছে। নাফিস একশো টাকার বাদাম কিনে বাড়ি নিয়ে আসলো। মাকে বলল, ভেজে দিতে। সেখান থেকে ফুলের জন্য বাদাম নিয়ে এসেছে নাফিস। ফুলকে পেল শ্রেণীকক্ষের ভেতরে। আরিফার সাথে গল্প করছে। নাফিসের কথা ভুলেই বসেছে ফুল। আগে নাফিসের সাথে কলেজে আসা যাওয়া করতো শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার পর নাফিস প্রতিদিন বকুল গাছের নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। সে জানে ফুল আর এই পথে আসবে না। কিন্তু অভ্যাস তো মানুষের দাস! নাফিস রোজ দাঁড়িয়ে থাকে।
নাফিস গিয়ে ফুলদের সামনে বেঞ্চে বসে পড়লো। আরিফা স্বভাবসুলভ নাফিসকে দেখে লাজে নুয়ে যেতে লাগল। লজ্জায় মোচড়ানো শুরু করল। ফুল হাসল। নাফিসকে প্রশ্ন করল,” আজকের পরীক্ষা কেমন দিয়েছিস?”
” ভাল। তোর?”
” ভাল।”
নাফিস আরিফার সামনেই ফুলকে ওড়না দিয়ে বলল,” তোর জন্য অনেক আগে কিনেছিলাম। না নিলে ফেলে দিস।”
ফুল হাসিমুখে নিয়ে বলল, ” ফেলে দিব কেনো? এটা কেমন কথা নাফিস? ওড়নাটা খুব সুন্দর।”
আরিফার সামান্য মন খারাপ হয়ে গেল। ফুলকে তার সামনেই তার ভালোবাসার মানুষটা উপহার দিল। অথচ তার জন্য কিছুই আনলো না! ফুল বিষয়টা লক্ষ্য করল। নাফিসের উদ্দেশে বলল,” আরিফার জন্য যেই গিফট এনেছিলি সেটা দিয়েছিস?”
নাফিস অবাক হল। সে তো আরিফার জন্য কিছু আনেনি! এদিকে আরিফার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো।তারমানে তার ধারণা ভুল! নাফিস তার জন্যও এনেছে! নাফিস প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। ফুল ইশারায় নাফিসকে বুঝিয়ে বলল,” তোর জন্য রেশমি চুড়ি কিনেছে নাফিস। কিন্তু আহাম্মকটা ভুলে বাসায় রেখে চলে এসেছে।”
নাফিস মাথা নীচু করে রাখল। তার মিথ্যা বলতে ইচ্ছে করল না। আরিফা যদি সত্যি ভেবে নেয়, ভাবুক। ফুল যদি এটাই চায় তাহলে নাফিস করবে কিন্তু মন দিতে পারবে না।
আরিফা খুশিতে ফুলের হাত ধরে বলল,” সত্যি? ”
ফুল উত্তর দিল,” আরে, হ্যাঁ রে! তুই মন খারাপ করিস না। কলেজ খোলা হলে নিয়ে আসবে।”
” আরে মন খারাপ করার কী আছে? আমি তো!”
নাফিসের এখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করল না। পকেট থেকে বাদাম বের করে বলল,” আম্মা তোদের জন্য বাদাম ভেজে পাঠিয়েছে, বসে বসে খা।”
নাফিস দ্রুতই চলে গেল। ফুল নাফিসের দিকে তাকিয়ে আরিফার উদ্দেশে বলল,” বুঝলি দোস্ত! লবন ছাড়া বাদাম আর হাসি ছাড়া নাফিস, একই।”
আরিফা রাক্ষসীর মতো হাসতে লাগল। ফুল বন্ধুর হাসি শুনে কানে হাত দিয়ে রাখল।
নাফিস শ্রেণীকক্ষ থেকে নয় বরঞ্চ কলেজ থেকে বের হয়ে আসলো। পথিমধ্যে নাফিসের দেখা হল, শুভর সাথে। নাফিস দেখেও না দেখার মতো চলে যেতে নিলে শুভ বাঁধা দেয়,” হেই বউয়ের হিংসুটে বন্ধু! পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
নাফিস বরাবরের মত উত্তর দিল না। শুভকে এড়িয়ে চলে যেতে নিলে শুভ আবারও পথ আটকায়। নাফিসের কাঁধে হাত রেখে বলে,” বউয়ের বন্ধু মানে আমারও বন্ধু। চলো বন্ধু চা খেয়ে আসি।”
নাফিসকে টেনে লতিফ চাচার চায়ের দোকানে বসলো শুভ। কলেজে ভাল ছাত্রদের মতো কিছু দুষ্ট ছাত্রও থাকে। যাদের পাওয়া যায় চা ওয়ালা মামাদের দোকানের পিছনে। নাফিসের চোখ সেদিকে পড়লো। শুভ খেয়াল করল তা। নাফিসের কানের কাছে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল,” সিগারেট চলবে?”
নাফিস ভ্রু যুগল কুঁচকে উত্তর দিল,” দিনে কয়টা লাগে?”
শুভ দুষ্টু স্বরে বলল,” সিগারেটের অভ্যাস করলে বউ কী বাড়িতে জায়গা দিবে? আমার অসব অভ্যাস নাই।”
নাফিসের মনে হল, শুভ ইচ্ছে করেই তার কানের কাছে বেশি বেশি বউ বউ ডাকে যেনো নাফিসকে ক্ষ্যাপাতে পারে। চা চলে আসলে শুভ নাফিসের দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে বলল,” বউ আপনার গল্প করেছিল, আপনারা খুব ভাল বন্ধু। ভাবলাম বউয়ের বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব করে নিলে ওর চোখে ভাল থাকতে পারব। বুদ্ধিটা কেমন?”
নাফিস তাদের দাঁত চেপে পাল্টা প্রশ্ন করল,” বিয়ে কি তুমি একাই করেছো? আর কেউ কি বিয়ে করেনি? নাকি আমার কানের কাছে ইচ্ছে করেই বউ বউ বলে জিভ ভেজাও!”
শুভ দাঁত বের করে হেসে বলল,” তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার সামনে বউকে বউ ডাকতে সেই মজা লাগে।”
——————-
শুভদের বাড়িতে তাদের পরীক্ষার পরের দিন থেকেই বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। শুভ আর ফুল সারাদিন মায়ের সাথে একটা না একটা কাজে লেগেই থাকে। অবশ্য শুভ ইচ্ছে করেই ফুলের আশে পাশেই থাকে। এই কাজটা করতে তার খুব ভালো লাগে। শুভর মা বার বার নিষেধ করলেও শোনে না।
বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বড় বিপদে শুভ পড়েছে। যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া পড়শীর ঘুম নাই এমন অবস্থা হয়েছে তার সাথে। বিয়ে নিয়ে আদিলের কোনো চিন্তা নাই। সে নিজের ঘরে বসে পরীক্ষার খাতা দেখে। অবসর সময়ে সাগরিকার সাথে কথা বলে কা’টা’য়। শুভ বুঝতে পারে, আদিল ইচ্ছে করেই শুভকে খাটাচ্ছে। সে মনে মনে ভাবে,” আমারও দিন আসবে।”
হলুদের আগেরদিন আদিলের সামনে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে শুভ দাঁড়াল। আদিল খাতা দেখছিল। শুভ খাতার উপর বালিশ ফেলে বলতে শুরু করল,” তুমি আমার বড়ো ভাই নাকি জাত শত্রু?”
আদিল তখন গম্ভীর সুরে বলল,” তুই তো আস্ত খারাপ। বড়ো ভাইয়ের কাছে কৈফিয়ত চাস?”
শুভ আকিলের পাশে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে। ক্লান্ত শরীরে বলে,” আমি এতো তাড়াতাড়ি বড়ো হতে চাই না, ভাইয়া। আমি ঘুরব, ফিরব, পড়ব আর বউকে জ্বালাব। তোমার বিয়ের কাজ তুমি করো।”
আদিল খাতাগুলো গুছিয়ে শুভর পাশে শুয়ে বলতে শুরু করল,” বিয়ে করেছিস, এখন তোর অনেক দায়িত্ব। মেয়েটাকে সুখে রাখতে হবে। পুরুষরা শুয়ে বসে থাকলে কী চলবে? আজ যার জন্য এতো সাজসজ্জা করছি বছর যেতেই তার চোখের পানি। এতোটা কাপুরষ হওয়া যাবে না। ঘরে নারীরা সংসারের যাবতীয় কাজ করবে ঘরে এসে পুরুষরা স্ত্রীদের কাজে হাত দিবে এতে ভালেবাসা বাড়ে। বছর পেরুতেই সংসারের প্রতি অনিহা আসবে না। সারাদিনের কাজের পরও একটা নির্দিষ্ট সময় রাখতে হবে, যেই সময়টা স্ত্রীর জন্য বরাদ্দ। একটা কথা মনে রাখিস শুভ, আমরা পরিশ্রম করলেই আমাদের স্ত্রীদের সুখে রাখতে পারব।”
শুভ মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনল। এটা নতুন নয় যে, আদিল ছোটভাইকে বুঝাচ্ছে। শুভ বড়ো ভাইয়ের আদর্শে বড়ো হয়েছে। জীবনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগলেই ভাইয়ের কাছে চলে আসে। আজ আসার কারণটা ছিল ভিন্ন। দুই ভাই বিয়ে করলেও এতোদিন সিঙ্গেল ছিল। বউ থাকতেও বউহীনা থাকতে হয়েছে তাদের। দুইদিন পর ভাবী চলে আসবে, ভাইয়ের সাথে এভাবে সময় কাটাতে পারবে কী না সন্দেহ। দুইভাই গল্প করতে করতে কতোটা সময় পাড় করে ফেলল তারা জানে না।
————–
বিকালবেলা বকশি কাকা হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকলো। উনার চোখে মুখের অদল বলে দিচ্ছে অপ্রত্যাশিত কোনো খবর আছে। আদিল ও শুভ কেউ বাড়ি নেই। হলুদের কিছু জিনিস কেনার বাকী আছে। দুইভাই মিলে সেগুলো আনতে গিয়েছে। ফুল সোফায় বসে ছিল। বকশি কাকাকে হাঁপাতে দেখে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসলো,” কি হয়েছে, কাকা? সব ঠিকঠাক তো?”
বকশি কাকা জানাল,” তোমার আব্বার বাড়ি থেকে খবর আসছে। তোমার আব্বার অনেক অসুখ।”
ফুল চমকাল। মনের কোথাও ব্যথা অনুভব হল। হয়তো জন্মদাতা পিতা বলে! ফুলের শাশুড়িও খবরটা শুনতে পেল। ফুল শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর জানতে চাইলো। তখনই শুভর কণ্ঠস্বর শোনা গেল,” বাবাকে দেখে আসো, ফুল!”
চলবে…………..