#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১৯
রাত তখন বারোটা ত্রিশের কাঁটায়। বড়ো ভাইয়ের হাতে হাতে শুভ কাজ করে যাচ্ছে। তার আপাদমস্তক দেখে যে কেউ বলবে, প্রফুল্ল মনে খুবই ব্যথিত সে। আদিলের মুখে রা নেই। লোকবল নিয়ে বাহিরের পরিবেশ ঠিকঠাক করছে সে।
ফুল নিচে এসে শাশুড়ির পিছু পিছু ঘোরাঘুরি করছে। ভুলেও শুভর সামনে পড়ছে না। নিচে আসার পর একবার শুভ ডাকতে এসেছিল। ফুল শাশুড়ির আড়ালে লুকিয়েছিল। শুভ বুঝল না তার ফুলবউয়ের ঠিক কী হয়ে গেল। এরপর যতোবার ফুলের সাথে কথা বলতে গিয়েছে ততবারই নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে।
ভাবুক মনে শুভ বাহিরে চেয়ারে বসে রইল। একদম প্রধান ফটকের মুখোমুখি হয়ে। যেখান থেকে ফুলকে দেখা যাচ্ছে। ফুল শাশুড়ির আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সুইটি খানম যেদিকে যাচ্ছে ফুলও পিছু পিছু যাচ্ছে। শুভ লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। এখন সে বউহারা স্বামী। যার বউ কেনো দূরে দূরে থাকছে বুঝতে পারছে না।
হঠাৎই শুভর চিঠির কথা মনে পড়লো। আজকের চিঠিকে একটু দুষ্ট কথা লেখেছিল। মেয়েটা এজন্য লজ্জায় কাছে আসছে না তো! শুভর হাসফাস রোগটা আবার দেখা দিল। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো। সে তো, ফুলের সাথে! নাহ আর ভাবতে পারছে না। ফুলের সাথে যেভাবেই হোক এখন কথা বলতেই হবে।
শুভ উঠে দাঁড়ালো। চেয়ারটায় পা দিয়ে আঘাত করে ফেলে দিল। তার রাগ হচ্ছে না কিন্তু অনুশোচনা হচ্ছে। শুভ ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল। একদম ফুলের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আদিল সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতে নামতে মায়ের উদ্দেশে তখন বলল,” আমার ফ্ল্যাটে ফুফুদের শোয়ার ব্যবস্থা করে দাও, মা! আমি শুভর ঘরে থাকব।”
শুভ চোখ বড়ো করে তাকাল। ফুলের দিকে চোখ পড়তেই দেখল, ফুল দুষ্ট হাসছে। শুভ ব্যথিত, খুউব ব্যথিত হল। মনে মনে একশোটা বকা দিল আদিলকে।
বিগত দুই ঘণ্টা ধরে বিবস্ত্র অবস্থায় প্রিয়া শুভর ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছে। শুভর আসার নাম গন্ধ নেই। ছোট ছোট মশার কামড়ে শরীরের অধিকাংশ জায়গা ফুলে গেছে। প্রিয়া আর থাকল না। জামাকাপড় পরে শুভর ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো। ফ্ল্যাট থেকে বের হতে নিতেই আদিলের দেখা পেল প্রিয়া। এতরাতে শুভর ঘরের দরজা নড়তে দেখে বুঝলো মেয়েটা শুভর ঘর থেকেই বের হয়ে এসেছে। আদিলের মুখের রং সাথে সাথে পালটে গেল। মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে প্রিয়ার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। এতেও ক্ষান্ত হয়নি আদিল। প্রিয়ার বাম গালে আরেকটা দিয়ে বসলো। প্রিয়া গালে হাত রেখে ন্যাকাবোকা কান্না করতে করতে বলতে শুরু করল,” শুভ ভাইয়াকে গুড নাইট জানাতে গিয়েছিলাম, আদিল ভাইয়া।”
” তোকে শেষবারের মতো সাবধান করছি, প্রিয়া।আমার ভাই ও তার স্ত্রীর আশেপাশে তোকে দেখলে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”
” ভাইয়া, আমি তো!”
আদিল আগের তুলনায় জোরে ধমক দিয়ে বলল, ” আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হো।”
প্রিয়া প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ে নিচে চলে গেল। এদিকে আদিল দুই আঙুলের সাহায্যে কপাল ঘেঁষে বলল,” পৃথিবীতে বিবাহিত পুরুষদেরও শান্তি নেই। ”
রাত তখন দুটো পয়তাল্লিশের ঘরে। ফুল খুশিমনে নিজের ঘরে চলে আসলো। দরজা আটকে ঘরেই লেহেঙ্গার নিচের অংশ খুলে চুলে হাত দিল। হাত ও মাথা থেকে কাঁচা ফুল খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখল। আলমারি থেকে সুতি জামা নিয়ে ঘরেই পরিবর্তন করে নেওয়ার কথা ভাবল। পিঠের চেইনে হাত দিলে পিছন থেকে কেউ এসে ফুলের হাত আটকে ধরল। ফুলের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল,” দোহায় লাগে, ফুল! এমনিতেই বড়ো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছো। নতুন করে আর কোনো অঘটন ঘটাবে না।”
ফুল সুতি জামার ওড়না খুলে গায়ে প্যাঁচিয়ে নিল। শুভ তখন ফুলের পিঠে আছড়ে পড়ে আছে। ফুল ফিসফিস করে বলল, ” তুমি আমার ঘরে কেনে,শুভ?”
শুভ সময় নিয়ে উত্তর দিল,” জানি না। আমি কিছুই জানি না।”
সেই একই নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার অনুভূতি। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে ফুলের পিঠে। আর ফুল! সে তো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাঙা শরীর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে একেকটা নিঃশ্বাস। আচমকাই শুভ ফুলকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। ফলস্বরূপ গায়ের ওড়না ঝরঝর করে নিচে পড়ে গেল। ফুলের পেটের উপর হাত রেখে শুভ শুয়ে পড়লো। ফুল মাথা তুলে চোখের দিকে তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। শুভর র’ক্ত’মা’খা চোখজোড়া দেখে ফুল একহাতে ঢেকে দিল। শুভর ঠোঁটজুড়ে মাতাল করা হাসি। ফুল আরেক হাত দিয়ে ঠোঁট ঢেকে দিল। শুভ সাথে সাথে ঠোঁট ছুঁয়াল সেখানটায়। ফুল হাত সরিয়ে শুভর দিকে পিঠ দিয়ে শুইয়ে বলল,” নিজের ঘরে যাও।”
শুভ ফুলের পিঠ হাতড়ে বলল, ” উহু, বউয়ের ঘরে ঘুমাব।”
ফুল অবাক হল। ঠাহর করতে পারল, অসার হয়ে যাওয়া শরীরটা আরেকটু মিইয়ে গেল। শুভ ফুলের ঘাড়ের ব্যথার জায়গায় হঠাৎই শুভ ঠোঁট ছুঁয়াল। ফুল সাথে সাথে নিঃশ্বাস আটকে শুভর দিকে ফিরে বুকে মুখ গুঁজল। শুভ পরম যত্নে ফুলকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। ফুল শুভর বুকে নাক ঘষে বলল,” পাগলামি করছো, কেনো?”
” বিবাহিতা স্ত্রীকে সোহাগ করাকে তুমি পাগলামি বলছো?”
” আমি কখন বললাম?”
শুভ তখন নিচু আওয়াজে বলল,” তাহলে কী বলতে চাইছ, সোহাগ করি?”
ফুল ধ্যাৎ বলে শুভর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইল। শুভ ছাড়ল না বরঞ্চ কঠিন কাজ করে বসলো। বিবাহিত জীবনের এই পর্যন্ত যেই কাজ সে করেনি। ফুলকে কাছে পেয়ে শুভর নষ্টালজিক নাগরিক হওয়ার দোষ গায়ে মাখিয়ে নিচ্ছে। আর ফুল! সে স্বামীর থেকে প্রথম স্পর্শ পেয়ে সারাজীবনের জন্য নিজের গায়ে সিলমোহর মেরে দিয়েছে। শুভ ফুলকে তখন ছাড়ল, যখন বুঝতে পারল ফুল ঘুমিয়ে পড়েছে। ঠোঁটে চুমু খেলে কেউ ঘুমিয়ে যায় ভেবেই অবাক হচ্ছে শুভ। ফুলের ঠোঁটজোড়ায় হাত বুলিয়ে কয়েকবার আস্তে করে চুমু খায় তাতে। আড়মোড়া ভেঙে ফুলের গায়ে কাঁথা দিয়ে বিছানা ছাড়ে সে। শরীরের সাথে মাথাটাও ভাড় লাগছে শুভর। এখনই গোসল নিতে হবে। নয়তো নিঃশ্বাস আটকে ম’রে যাবে।
দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ভিজিয়ে বের হল শুভ। কোমড়ে তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বের হয়ে নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে গেল সে। ফুলের ঘরে তার কোনো পোশাক নেই। একদিকে বিরক্তি অপরদিকে ভালোলাগা। জীবনের প্রথম চুমু ফুলের জন্য বরাদ্দ ছিল। শুভ এই চুমুর নাম দিল, হালাল চুমু। যার ভাগিদার একমাত্র তার ফুলবউ ছিল।
শুভ ঘর থেকে বের হল না। টেবিল থেকে খাতা কলম নিয়ে ফুলের পাশে বসে চিঠি লেখা শুরু করল,
প্রিয় আদরফুল,
আজকাল তোমাকে দেখলেই আদর আদর লাগে। ইচ্ছে করে একটু ছুঁয়ে দেই। অবশ্য সুযোগ পেলে হাতছাড়া করি না। নিজের প্রাপ্য বুঝে নেই। আজকের ভয়ংকর কাণ্ডের জন্য তুমিই দায়ী। কে বলেছিল, আমাকে অবহেলা করতে! এমনটা না করলে কী আর তোমার ঘরে লুকিয়ে থাকতাম! আর লুকিয়ে……..!
কখনো কী শুনেছো! আদর খেলে ঘুমিয়ে পড়তে! তুমি ঘুমিয়েছো। অবশ্য ভাল হয়েছে, নয়তো কঠিন আবদার করে ফেলতাম।
আজ তোমার পাশে বসে চিঠি লেখছি। এটা কিন্তু প্রথম! আগে তোমাকে অনুভব করে চিঠি লেখতাম আর এখন ছুঁয়ে। দুই অবস্থানের মধ্যে পার্থক্য কী জানো! জানতে হবে না। বেশি জানলে কথা ফুরিয়ে যাবে। ঘুমানোর আগে গহনাও খুললে না। এই যে, তোমার পাশে বসে লেখছি। এই লাইনটা লেখে তোমার কানের দুল খুলে দিচ্ছি। এবার হাতের চুড়ি! তুমি জানো ফুল! তোমার চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ শুনে আমার বুকটা ধুকধুক করতে থাকে। আর থেমে যায় কখন জানো! তোমার স্পর্শ পেয়ে। না না তোমাকে স্পর্শ করলে আমি অন্য পৃথিবীতে চলে যাই। এই অনুভূতি বুঝানো কঠিন।
পায়ের নুপুর কে পরতে বলেছে? আমি তো খুলতে গিয়ে তোমার পায়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছি। আচ্ছা, পা দেখে কাউকে প্রেমে পড়তে শুনেছো! আমি হয়তো পাগল হয়ে যাচ্ছি, ফুল! এতো অনুভূতি, এতো যন্ত্রণা সইতে পারছি না। তোমাকে ছুঁয়ে দিলে মরি মরি অবস্থা, আর না ছুঁয়ে দিলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। জানি দুটো একই, শুধু ব্যক্ত করতে পারছি না।
নারী রূপী ভয়ংকর, ফুল! তোমার পাশে কখনোই আর শোবো না। তুমি আগুন, নয়তো আমি আগুন। দ’গ্ধ হচ্ছি আমি একাই, তোমাকে দ’গ্ধ হতে দিব না।
শুনো ফুল! আজ লেখা শেষ করতে ইচ্ছে করছে না। তোমার দিকে তাকিয়ে হাজার পৃষ্ঠা লিখে যেতে ইচ্ছে করছে। যেন কেউ ভাবে, রচনা লেখছি। আচ্ছা! এই রচনার নাম কী দিব? একজন স্বামীর অসহায়ত্বের রচনা নাকি ভালেবাসার কাঙ্গাল একজন অধমের সূচনা? দ্বিতীয়টাই মানাবে। আর লেখব না। এখন ঘুমাব। আগামীকাল তোমার সুমধুর কণ্ঠ শুনে ঘুম ভাঙাব। যাই হ্যাঁ!
ইতি
শুদ্ধ ফুলের অশুদ্ধ স্বামী
পুনশ্চঃ আমার তোমার পাশে ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।
চলবে…………..
#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২০
শুভকে ফুলের ঘর থেকে বের হতে একমাত্র প্রিয়াই দেখল। সে এসেছিল, আদিলের ফ্ল্যাটের দিকে। তাদের ঘুমানোর জায়গা দেয়া হয়েছে সেখানটায়। অর্ধাবৃত শরীরের লোভনীয় অংশ দেখে প্রিয়ার ইচ্ছে করছিল এখনই নিজেকে সপে দিতে। সে সিনেমায় দেখেছিল, এভাবেই তো প্রেমের সূচনা হয়! একবার কলঙ্ক মাখাতে পারলেই ঐ মেয়েটা দূরে সরে যাবে। তারপর! তারপর শুভর একমাত্র বউ প্রিয়া হবে। শুভর মনও তখন প্রিয়ার, শুভর শরীরও। ভাবতেই প্রিয়ায় গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। তবে তার শকুনের মতো দৃষ্টি ফুলের ঘরের দরজার দিকেই আটকে থাকল। এই মেয়ের যেকোনো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
———————–
পরেরদিন সকালটা অন্যরকম হল ফুলের জন্য। ঘুম ভাঙলেও চোখ খুলেনি ফুল। গতকাল রাতের কথা ভাবতেই লাজে ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। বিছানার একপাশে শুয়ে আছে ফুল ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাচ্ছে না। শুভর মুখোমুখি সে কখনোই হতে পারবে না। কিন্তু ফুলের তো এখন উঠতে হবে। আজ সাগরিকাদের বাড়িতে যাবে। বিয়ের দিন শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ করারও একটা ব্যপার আছে। ফুল উপুড় হয়ে পাশ ফিরল। বাম চোখ খুলে তাকল। পাশের বালিশটা খালি দেখতে পেয়ে অবাক হল। সে তো শুভর কাছেই ছিল, একদম পাশে। ফুল উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে উঠে যেতে নিয়ে বিছানার উপর গহনা পড়ে থাকতে দেখল। ফুল মনে করতে চেষ্টা করতে থাকল সে কখন এগুলো খুলল কিন্তু মনে করতে পারল না। গহনা হাতে নেয়ার সময় কাগজের উপর চোখ গেল। বালিশের নিচে রাখা ছিল। ফুলের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। চটকরে কাগজ খুলে পড়তে শুরু করল। চিঠি পড়া শেষ করে ফুল লজ্জায় লাল নীল হতে লাগল। চিঠি ভাজ করে কয়েকটা চুমু খেল তাতে। পোশাক পালটে দৌড়ে চলে গেল শুভর ঘরে।
শুভ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। বিছানার একপাশ খালি, আদিল কোন সকালে উঠে পড়েছে। অথচ ছোট রাজপুত্রের জাগার কোনো নামগন্ধ নেই। ফুল সাবধানে পা ফেলে দরজা আটকে দিল। বিছানায় শুভর পাশে বসে একমনে তাকিয়ে রইলো। কানের পাশের তিলটা ফুলকে খুউব টানে। ইচ্ছে করে আদর বসাতে যেভাবে শুভ হুটহাট বসিয়ে দেয়! ফুল তিলের উপর হাত বুলাল। শুভ তখন নড়েচড়ে যেভাবে ছিল সেভাবেই শুয়ে রইলো। শুভর চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করল, তার বাবুবর জেগে আছে নাকি ঘুমে। যখন বুঝল ঘুমাচ্ছে তখন বিশাল একটা কান্ড করে বসলো। শুভর কানের পাশের তিলটায় আলতোভাবে ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শুভ এতক্ষণ ঘুমের অভিনয় করছিল। ফুল ঠিক কী করে দেখতে চাচ্ছিল। ফুল ঠোঁট ছুঁয়ে সরে এসে লজ্জায় মুখে হাত দিয়ে রাখল। সে তখনও জানে না শুভর জেগে যাওয়ার ব্যপারে। শুভও ফুলকে লজ্জায় ফেলল না। তবে মনে মনে ভীষণ সন্তুষ্ট হল।
কিছুক্ষণ পর ফুলের নরম হাতজোড়া শুভর ঘন চুলের ভেতর চলে গেল। আলতোভাবে কয়েকবার হাত বুলিয়ে শুভকে ডাকল,” এই, উঠবে না?”
ছোট্ট একটা ডাক! অথচ অনুভূতি বিশাল। শুভর চোখ বন্ধ করে রাখার ইচ্ছে হল না। এই মুহূর্তে মনে হল, চোখ খুলে ফুলকে না দেখলে তার চোখ অভিশাপ দিবে। বলবে, ওহে চোখ! তুই পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয়া ফুলকে দেখলি না! পাপ লাগবে তো! ঘোর পাপ! শুভ চোখ খুলে ফুলের হাসিমাখা মুখখানা দেখে অস্পষ্ট স্বরে বলল, ” আজ সারাদিন আমার ভাল যাবে, ফুলবউ! তোমার হাসিমাখা মুখটা যে দেখেছি।”
ফুল হাসিমুখেই উঠে দাঁড়ালো। বিছানা থেকে চাদর নিজে ভাজ করতে থাকল। শুভ উঠে একেবারে গোসল সেড়ে বের হল কিন্তু কোথাও ফুলকে দেখতে পেল না। বিছানার দিকে তাকিয়ে শুভর ঠোঁটের কোণে হাসি চলে আসলো। বিয়েতে পরে যাওয়ার পোশাক ঠিক করে রেখে গেছে ফুল। তারসাথে একটি কাগজ। হয়তো চিঠি হবে! শুভ মাথার চুল মুছে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল,
প্রিয়,
আমার দেখা পৃথিবীর শুদ্ধতম স্বামী তুমি। তোমার কাছে আমি সর্ব সুখ পেয়েছি। একজন স্ত্রীকে কীভাবে আগলে রাখতে হয় তোমাকে দেখে জেনেছি। আমি গুছিয়ে বলতে পারি না। এতটুকুই বলব, আমি তোমাকে অনুভব করি। তোমার আবদার, তোমার আকুলতা, তোমার ভালেবাসা সবকিছু সম্মান করি।
নিজেকে কখনো এতোটা বিশেষ অনুভব করিনি যতোটা তুমি বুঝিয়েছো। এত বছর আমি মৃ’ত্যু কামনা করতাম। তোমার সঙ্গ পেয়ে এখন আমি মৃ’ত্যু’কে ভয় পাই। ভয় পাই, সুখের সময়ে যেনো কালো আঁধার নেমে না আসে। আমি সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে চাই, শুভ!
গতকাল রাতের জন্য দুঃখিত। আমি এমনটা করতে চাইনি। কীভাবে যেনো!
আমার একটা ইচ্ছে পূরণ করবে, শুভ! চাঁদনি রাতে তোমার পাশে বসে গল্প করার খুব শখ জেগেছে। ইদানীং কতো শতো শখ জাগে! বলা হয় না।
তুমি বলেছিলে, এবাড়িতে আসলে সপ্তাহে ছয়দিন আমার হাতের রান্না করা বিরিয়ানি খাবে। কই, একদিনও তো খেলে না!
তৈরি হয়ে নিচে আসো। আমি খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছি।
ইতি
শুভর ফুল
চিঠি পড়া শেষ হলেও শুভর ঘোর ভাঙল না। অনিমেষ তাকিয়ে রইলো গোটা অক্ষরে লেখা কাগজের দিকে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তাতে। শুভ অনুভব করল তার চোখের পানি। অন্তরে শীতল হাওয়া বইছে। মেয়েটা এতো আদুরে কেনো? শুভ কখনে পারবে না মেয়েটাকে কষ্ট দিতে। চিঠিতে অসংখ্য চুমু খেল শুভ ঠিক ফুলের মতো। বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো। তারপর মনে পড়লো ফুলের বলা শেষোক্ত কথাটি। শুভ ঝটপট তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
————————
প্রিয়ার মুখে মশার কামড়ের দাগ পড়ে গেছে। মুখে গুনে গুনে বারোটা কামড় বসিয়েছে। ফোলা কমলেও লাল হয়ে আছে। প্রিয়ার পাতলা স্কিনে দেখতেও বিশ্রী লাগছে।
এগারোটার মধ্যে সাগরিকাদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দেয়া হবে। প্রিয়া টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে। যার চোখে বাঁধছে সেই প্রিয়াকে এটাসেটা প্রশ্ন করছে। ফুল রান্নাঘরে শাশুড়ির সাথে ছিল। সুইটি খানম ফুলকে ধরে রান্নাঘর থেকে বের করে দিলেন। ফুলের হাতে দুইটা খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন,” দুজনে খেয়ে নে।”
ফুল টেবিলে বসে শুভর জন্য অপেক্ষা করছিল। এরমধ্যে প্রিয়া ফুলকেই দেখছিল। মেয়েটা প্রিয়ার দিকে তাকাচ্ছে না। নজর বারবার সিঁড়ির দিকে আটকে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই বরের অপেক্ষা করছে! প্রিয়া ফুলকে ভালোভাবে দেখে উঁচু সুরেই বলতে শুরু করল,” কেমন মেয়ে তুমি, রাতে দেখলাম শুভ ভাইয়া গোসল করে তোমার ঘর থেকে বের হচ্ছে। কিন্তু তোমার চুল তো!”
প্রিয়ার মা কথাটা শুনে এগিয়ে আসলেন। ঘরভর্তি মানুষের পরোয়া না করে ফুলের শুকনো চুলে হাত বুলালেন। নাক সিটকে বলতে লাগলেন,” ছি, ছি, ছি! কেমন মাইয়া তুমি? পাক নাপাক বুঝো না নাকি? নাপাক অবস্থায় হাড়ি পাতিলও ছুঁয়েছো। ইয়াক, এই কেউ খাবার খাবেন না। তুমি কী মেয়ে হ্যাঁ! মা কী কিছু শিখায়নি?”
প্রিয়া এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে মুখে পুরে নিল। তার মাকে শুনিয়ে ফুলকে ইচ্ছেকরেই কথাগুলো বলেছে। বাকী কাজ প্রিয়ার মা করে দিচ্ছে। ফুলের পাশে আরো দুইজন মহিলা এসে দাঁড়ালো। ফুলের শাশুড়িও এলো ইতিমধ্যে। কারণ জানতে চাইলে মহিলাটি বলল,” ছেলের বউকে মাথায় তুলে রাখছো, ঠিক আছে। তোমাদের ঘেন্নাপিত্তি নাই থাকতে পারে। আমরা তো মেহমান! আমাদের আপ্যায়নটাতে অন্তত পাকসাফের ব্যপারটা খেয়াল করতা!”
লজ্জায় ফুলের শাশুড়ির মাথা কে’টে যাওয়ার মতো অবস্থা। নত মাথায় ননাসকে বললেন,” আপা, ওরা শিক্ষিত। সব বুঝেও। আপনার হয়তো বুঝতে ভুল হ’য়ে।”
” আহ! এখন এই মাইয়ার জন্য আমাকে ছাফাই দিতে হবে না৷ আমাদের খাওয়ার ব্যপার আমরাই দেখে নিব। ভাই ম’রে গেছে বলে এই বাড়িতে কোনো কদর পেলাম না।”
” চলে যেতে ইচ্ছে করলে চলে যাও,ফুফু। তাছাড়া আমরা মুরুব্বিদের কাছ থেকে শিখেছি, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের প্রমাণ লোক সমাজের চোখে যেনো না পড়ে। খুব গোপনে ছোটখাটো বিষয়গুলো সলভ করতে হয়। আধুনিক যুগে পানি খেতে হাত পাততে হয় না, মুখে অটোমেটিক চলে আসে। কাপড় হাত দিয়ে ধুইতে হয় না। মেশিনে দিলে একেবারে শুঁকিয়ে বের হয়। কোনো কষ্টই করতে হয় না। এমনভাবে চুল শুকানোরও মেশিন তৈরী হয়েছে। কয়েক মিনিটে কাজ শেষ করে ফেলে। তোমারও লাগবে নাকি, ফুফু! আচ্ছা যাওয়ার সময় একটা প্যাকেট করে দিব নে।”
আদিলের স্পষ্ট বুলি সকলেই শুনতে পেল। কেউ জিহ্বা কাটলো তো কেউ জায়গা ছাড়লো। ফুল চোখের পানি ফেলছে। ফুফুর একটি কথায় তার মনে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। ফুলের মা থাকলে হয়তো তার জীবন অন্যরকম হতো। শুভ আসলো হন্তদন্ত পায়ে। এসেই ধপ করে ফুলের পাশে বসলো। রুটি ছিঁড়ে ফুলের মুখের সামনে ধরে বলতে শুরু করল,” ছেলেদের লাজ লজ্জা খুব কম থাকে। আমরা যেখানে সুযোগ পাই সেখানেই বসে যাই। যেখানে সুযোগ পাই সেখানেই ঘুচে যাই। বাড়িটা আমাদের, বাড়ির প্রতি জিনিস আমাদের। বাথরুম অবশ্যই করোর বাপের না। যেখানে ইচ্ছে হয় সেখানেই গোসল করব। এতে এতো কৈফিয়ত দিতে হবে কেনো? আমরা তো কাউকে চাকরিতে রাখিনি।”
প্রিয়ার মা রাগে ফুলেফেঁপে উঠছে। প্রিয়া বুঝলো বিষয়টা নিয়ে ঘাটলে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাবে। এতেকরে তার পরবর্তী পরিকল্পনায় বাঁধা আসবে। মাসের পর মাস এবাসায় থেকে যাওয়া হবে না। প্রিয়া কথা টানলো,” আহা, মা! শুরু হয়ে গেল তোমার যুক্তি-বুদ্ধি কথা! মজা করতে গেলে কিন্তু দেখলে সবাই সিরিয়াসভাবে নিল।”
আদিলের দিকে তাকিয়ে বলল,” বিয়ের দিনও কথা শোনাচ্ছ ভাইয়া। মা তো ফুলের সাথে মজা করছিল। তাই না, ফুল!”
ফুল মাথা তুলে তাকাল। প্রিয়ার ইশারায় হ্যাঁ বলতে বলছে। ফুল শুনল না। শুভকে উদ্দেশ করে মিনমিন সুরে বলল,” বাদ দাও, আজকের এইদিনে রাগারাগি করো না।”
আদিলের উদ্দেশে বলল,” ভাইয়া, নাস্তা করেন। সাগরিকা আপুর সাথে কথা হয়েছে? কি বলল?”
ফুলের শাশুড়ি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ফুলের উপর কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন। আদিল কথা বাড়ালো না। তবে প্রিয়ার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” সাবধান, প্রিয়া! আবারো বলছি।”
প্রিয়া কাচুমাচু করতে থাকল।
চলবে……..