#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_১
গোলাপ ফুলে সজ্জিত ঘরটা আজ শূন্য অবস্থায় পড়ে আছে। ঘরের সকল আসবাবপত্র যথাস্থানে থাকলেও, নেই মেয়েটার কাঙ্খিত মানুষটি। বধূর সাজে ধীরপায়ে মেয়েটা এগুচ্ছে। মেয়েটার ছন্নছাড়া জীবনটায় দুঃখই রয়ে গেল। শাড়ির আঁচল জমিনে অবিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে রইলো।মানুষটা থাকলে হয়তো বলতো,” ওগো ফুলবউ, তোমার আঁচল গোছানোর দায়িত্বটা কী আমায় দিবে?”
অথচ আজ কথাটা বলার মতো সেই মানুষটি নেই। মাথার ওড়না আলগোছে ফেলে ফুল বিছানার ঠিক মধ্যিখানে গুটিশুটি হয়ে বসলো। তার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝড়ছে। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলার সময় যত্নে আঁকা কাজল লেপ্টে গেল। তাতে মেয়েটার কোনো মাথা ব্যথা নেই। হাতজোড়ায় দখল করে রাখা চুড়িগুলো ঝুনঝুন শব্দের মুখরিত হচ্ছে সারাঘরে। অথচ যার জন্য এতো সাজসজ্জা সে-ই নেই ফুলের জীবনে। ফুল কাঁদতে কাঁদতে বালিশের উপর মাথা রাখল। চোখ বন্ধ করে বলিশের স্থানে মানুষটির বক্ষস্থল অনুভব করে বিড়বিড় করল,” আমার রঙহীন জীবনের রং ছিলে তুমি। আজ একাকীত্বের জীবনও দিয়ে গেলে তুমি।”
দুই সময়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজলে বলা যাবে, দুখীফুল আগের মতোই দুখী রয়ে গেল। পূর্বে ছিল আপনজন থেকে প্রতারণার দুখ আর এখন হল আপনজনকে হারিয়ে ফেলার দুখ। চোখের পানি মুছে চোখ বন্ধ করে নিলো। নিয়মিত ঔষধ নেওয়ার ফলে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লো।
শাশুড়ির ডাকে ঘুৃম ভাঙলো ফুলের। আলগোছে উঠে চুলে খোপা করতে নিতেই গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো। বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুঁটে খুঁটে দেখলো। চার বছরে নিজের মধ্যে অঘাত পরিবর্তন এসেছে। বিগত বছরগুলোর আদরে যত্নে বেড়ে উঠা শরীর অনেকটাই শুঁকিয়ে গেছে। চোখের নিচের কালো আবরণ বলে দিচ্ছে হাজারো নির্ঘুম রাতের কথা। শাশুড়ির দ্বিতীয়বার ডাকে উত্তর দিল ফুল,” আসছি, মা!”
উত্তর দিলেও ফুল ঘর থেকে বের হলো না। সারা ঘরে চোখ বুলিয়ে নিল। প্রতি বছর এই দিনটায় শাশুড়ির অলক্ষ্যে ফুল নিজেকে সাজায়, শুভর ঘরটা সাজায়। গতকাল রাত ছিল শুভ ও ফুলের ষষ্ঠতম বিবাহবার্ষিকী। এই দিনটায় শুভর করা পাগলামোগুলো মনে করে নিজেও কিছু পাগলামি করে বেড়ায়। বিগত বছরগুলোর মতো এবারও তাই করলো ফুল। এই রাতটায় ফুল, শুভর জন্য অপেক্ষা করে। রাত ফুরিয়ে আসলে দুর্বল পায়ে ফুল, শুভর ঘরে আসে। নিজের কর্মের জন্য কষ্ট পায়। নিশ্বাস আঁটকে আসে ফুলের। তবুও সে বেঁচে আছে। সে জানে, তার কিছু হলে শুভ বাঁচবে না। তবে আজকাল ফুলের মনে কঠিন চিন্তা আসে। এতো বছরে শুভ তার ফুলবউয়ের খবর নেয়নি। একটিবার জানতে চায়নি তার ফুলবউ কেমন আছে। একটিবার তার ফুলবউকে ছুঁয়ে দিতে আসেনি। একটিবারও ফুলবউকে দেখার তৃষ্ণা জাগেনি। তাহলে কী ফুলের বাবুবর পালটে গেছে? অভিমানের দেয়াল এতোটাই মজবুত হয়ে গেছে যে, আজ ফুলবউ পর হয়ে গেছে!
নাকি ফুল মনে করে নিবে, ছেলেবেলার বিয়েটা ছেলেখেলা ছিল। হয়তে এখন শুভর মনে অন্যকেউ চলে এসেছে।
এলোমেলো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ফুল পড়ার টেবিলে বসলো। খাতা কলম বের করে চিঠি লেখতে বসলো,
প্রিয় পুরুষ,
শুভেচ্ছা নিও। জানি না, এই চিঠিটা তোমার কাছে পৌঁছাবে কি না, কিন্তু অনেক কথা জমে আছে মনে, যেগুলো সামনাসামনি বলতে পারছি না। কারণ, তুমি নেই।তাই এই চিঠি লিখছি।
তুমি জানো, জীবনে কখনো ভাবিনি যে আমাদের মাঝে এমন দূরত্ব তৈরি হবে। হয়তো আমার ব্যবহার তোমাকে কষ্ট দিয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমায় কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি কিছু করিনি। সবকিছু হয়তো ভুল বোঝাবুঝির জালেই আটকে গিয়েছিল। আমি শুধু চাইছিলাম যে তুমি বুঝতে পারো, এই অভিমানটুকু ভালোবাসারই একটা রূপ।
কিন্তু তুমি বুঝলে না। আমায় একা ফেলে অচীন গহীনে ডুবে গেলে যেনো আমি তোমাকে খুঁজে না পাই। এই দেখো, তোমাকে পাইনি।
আমরা একসাথে এত স্বপ্ন দেখেছিলাম, প্রতিটা ছোটখাট হাসি, ভালো লাগা আর মনের একান্ত মুহূর্তগুলো যেন এখনো চোখে ভাসছে। জানো, প্রতিদিন মনে হয়, তোমার সাথে কথা বলি, একটুখানি অভিমান করি, তারপর আবার তোমার সেই ছোট্ট মিষ্টি কথা দিয়ে সব ঠিক করে ফেলি। কিন্তু তুমি যে এত দূরে চলে গিয়েছো, সেই ফাঁকটা যেন আর কোনো কিছু দিয়ে পূরণ হয় না।
আমি বুঝি, হয়তো আমার ভুল ছিল। হয়তো আমার ভালোবাসা প্রকাশ করার মধ্যে কোথাও ত্রুটি ছিল। কিন্তু তুমি যদি আরেকবার ভেবে দেখো, যদি এই ফুলের অন্তুরে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা অনুভব করতে পারো, তবেই আমার মনটা শান্তি পেতো। চলে আসো শুভ, তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব।
ফিরে এসো, এই অভিমান ভুলে। কারণ এই পৃথিবীতে আমি শুধু তোমার সাথেই আমার জীবন সাজিয়ে রেখেছি। তোমাকে ছাড়া সবকিছু একেবারে অসম্পূর্ণ। জানি না, এই চিঠির কোনো মূল্য তোমার কাছে থাকবে কি না, কিন্তু এটুকু জানি, এই কথাগুলো একান্তভাবে তোমারই। তোমার অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি
তোমার সুখফুল।
চিঠি লেখে ভাজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো, ফুল। টেবিলের উপর মাথা রেখে দেয়ালে টাঙানো হাস্যজ্বল শুভর ছবির দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষনেত্রে। বিড়বিড় করে আওড়ালো,” তুমি নিষ্ঠুর পুরুষ। ফুলকে শাস্তি দিতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছো। আমি তোমার উপর অল্প সল্প অভিমান করেছি। যেদিন অভিমানের পাল্লাটা ভারী হয়ে যাবে। মনে রেখো, সেদিন আমাকেও হারাবে।”
——————-
ঘড়ির ক্রিংক্রিং আওয়াজে ঘুম ভাঙলো যুবকটির। গায়ের উপর থেকে পাতলা চাদর সরিয়ে বিছানা ছাড়লো সে। অভ্যাস মোতাবেক টেবিল থেকে পানির পাত্র তুলে নিল। মধ্যমা আঙুলের সাহায্যে পাত্রের উপর থেকে আচ্ছাদন ফেলে দিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে নিল। আড়মোড়া ভেঙে পেশিবহুল শরীর নিয়ে এগিয়ে গেলো বারান্দার দিকে। সূর্যের উত্তাপ গায়ে মাখিয়ে ঠোঁট নাড়ালো যুবকটি,” শুভ সকাল, পৃথিবী। শুভ সকাল, সুখফুল।”
দ্বিতীয় বাক্যটি বলার পর নিজের উপরই বিরক্ত হলো যুবকটি। মুহুর্তেই চোখ বন্ধ করে নিল সে। দেয়ালের উপর মুষ্টিবদ্ধ হাতটায় আঘাত করে বসলো। ফর্সা লোমহর্ষক হাতটি তখনই লাল বর্ণ ধারণ করল। যুবকটির সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে আনমনে, অনুরাগে নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে রইলো।
বিছানারা উপর রাখা মুঠোফোন অবিচ্ছিন্নভাবে বাজতে থাকলো। যুবকটি এপর্যায়ে হাতে চিনচিন ব্যথা অনুভব করল। হাত দুবার ঝেড়ে নিল। আশ্চর্যজনকভাবে যুবকটির মুখ সাথে সাথেই স্বাভাবিক হয়ে গেল। ধীরপায়ে এগিয়ে গেল বিছানার উপর অযত্নে রাখা মোবাইল ফোনের দিকে। উলটো হয়ে পড়ে থাকা ফোনটা হাতে নিতেই দেয়ালে ‘ তেলবাজ’ নামটা স্পষ্ট ভেসে উঠলো। চেহারায় বিরক্তির ভাব ফুটে উঠলো তখনই। না চাইতেও রিসিভ করলো ফোন। কানে রাখতেই অপরপ পাশ থেকে মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো সে। মেয়েটি বলছে, ” আরিব মাহমুদ শুভ, তোমার ক্লাস ঠিক ছয়টা ত্রিশে শুরু হওয়ার কথা। আর বিশমিনিট বাকী আছে। আসতে পারবে? নাকি লেকচারগুলো নোট করে রাখব।”
কপালে দুই আঙুল ঘষে শুভ উত্তর দিল,” তোমাকে আমার রিলেটিভ মনে হয় না আর না মনে হয় চাকর। নিজ ইচ্ছায় পাশের বাসার আন্টি সাজতে এসো না। বিষয়টা তোমাকে মানায় না, মিস নোভা।”
অপরপাশ থেকে উত্তর পেলো না শুভ। কেননা অনেক আগেই অপরপাশের ব্যক্তিটি লাইনচ্যুত করে ফেলেছে। শুভ কিছুই হয়নি ভাব নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে বাথরুমের দিকে চলে গেল।
গায়ে সাদা এপ্রোন জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই আয়নার প্রতিবিম্বে কারো চেহারা যেনো ভেসে উঠলো। বিগত বছরগুলো যার থেকে দূরে সরে এসেছে তার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠলো। শুভ আয়নায় হাত বুলিয়ে দিল। আনমনে বলল,” আমার সুখফুল, আমার শ্রেয়সী, আমার আদুরী। তোমাকে ভুলে থাকার চেয়ে মৃত্যুর যন্ত্রণা হয়তো সহজ হতো।”
পরমুহূর্তে মুখে কাঠিন্যভাব এনে বলল,” তোমার শাস্তি এখনো শেষ হয়নি,ফুল। আমার কথা অমান্য করার জন্য তোমাকে আরো কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি পেতে হবে।”
ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার তৎক্ষনাৎ খুলল শুভ যেখানে না পড়া অনেক চিঠি জমা হয়েছে। শুভ বিগত বছরগুলোতে একটা চিঠিও খুলে দেখেনি। দুয়ারে অনেকবারই চিঠি কড়া নেড়েছে। শুভ কোনোদিন নাম দেখেছে তো কোনোদিন দেখেনি। এতো অভিমান লুকিয়ে রেখেছে মনে যে, ফুলের অনুভূতির মূল্য শুভর কাছে নেই। ড্রয়ারে রাখা চিঠিগুলোর উপর হাত বুলিয়ে শব্দ করে আটকে দিল। চোখে কালো সানগ্লাস লাগিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,” শুভ দুর্বল নয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আজকের শুভ খুবই কঠোর, নিষ্ঠুর। ফুল কী তার পাপড়িও শুভকে কাবু করতে পারবে না।”
——————–
ভর দুপুর। মাথার উপর সূর্য চুপটি করে বসে আছে। মনে হচ্ছে নিজের উত্তাপে ফুলকে নিঃসৃত করেই ছাড়বে। ওড়নার সাহায্যে ফুল কপালের ঘাম মুছে নিল। গলা শুঁকিয়ে এসেছে। এমুহূর্তে এক গ্লাস পানি গলায় চালান করতে পারলে ভালো হতো। কয়েককদম হাঁটতেই ফুল পরিচিত মুখাবয়বের সাক্ষাৎ পেল। ফুলের সকল ক্লান্তি এক নিমিষেই হারিয়ে গেল। পা চালিয়ে মানুষটির কাছে এসে বলল,” সরি রে! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো, তাই না? চল চল। আজ মনে হচ্ছে তোর হবু বউ তোর কল্লা চিবিয়ে খেতেও দুইবার ভাববে না।”
মানুষটি ফুলের দিকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিয়ে উত্তর দিল,” গলা ভিজিয়ে নে। আমার হবু বউ তোর বরের মতো হিংসুটে নয় যে তার ছোটবেলার বন্ধুর সাথে কথা বললে মাঝখানে ঢুকে পড়বে। সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতি।”
ফুল ঢকঢক করে পুরো বোলতের পানি গোগ্রাসে গিলে ফেলল। বোতল অদূরে নিক্ষেপ করে উত্তর দিল,” তুই ইদানীং খোঁচা দিতে শিখে ফেলেছিস, নাফিস! একবার আমার বর ফিরে আসুক। তোকে নাকে মুখে চুবানি না খাইয়েছি তো আমার নাম ফুল নয়।”
নাফিস হাসলো। তার সেই সময়কার কথা স্মরণে আসলো যখন সে শুভর সম্পর্কে জেনেছিল। নাফিসকে জ্বালাতন করার কোনো সুযোগ শুভ হাত ছাড়া করেনি। নাফিস যে প্রথম শুভকে সহ্য করতে পারতো সেটা বললেও ভুল হবে। শুভকে সহ্য হতো না। বিশেষ করে শুভ যখন জানতো, নাফিস ফুলকে পছন্দ করে তখন সে রাগ না করে বরং স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি নিয়েছিল তখন নাফিস অবাক হয়েছিল। সে শুভকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল কিন্তু শুভ মানলে তো! সে ফুলের বন্ধুকে নিজের বন্ধু বানিয়েই ছাড়লো। নাফিস প্রশ্ন করল,” এবারও কী চিঠির উত্তর দেয়নি?”
ফুলের হাসিমাখা মুখটায় আঁধার নেমে এলো। হাতের বন্ধনীতে চোখ রেখে উত্তর দিল,” হয়তো চিঠি তার কাছে পৌঁছায়নি। আমার বিশ্বাস যেদিন চিঠি তার কাছে চিঠি পৌঁছাবে সেদিনই আমার কাছে ফিরে আসবে।”
নাফিস এক ধ্যানে ফুলের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মনে সাজানো প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল, সত্যিই কী ফুলের ভাবনা সঠিক? স্বামীর প্রতি অসীম ভালোবাসা দেখে ফুলের উপর মায়া জন্মালো। নাফিস বিড়বিড় করে বলল,” তার কাছে তোর চিঠি যেন শীঘ্রই পৌঁছে যায়। তোর হাসিমুখের আড়ালের কষ্ট অন্য কেউ উপলব্ধি করতে না পারলেও আমি উপলব্ধি করতে পারি। যতোই হোক, তুই তো আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলি।”
চলবে…………