#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৬
চার বছরের দীর্ঘ বিরতির পর যখন শুভ তার ফুলবউকে দেখল, মনের মধ্যে যেনো এক অন্যরকম ঝড় বইতে লাগল। তার ফুলবউয়ের সেই চঞ্চল যুবতীর ছায়া আজ নেই, বরং চোখে ধরা দিল এক পরিপূর্ণ, আত্মবিশ্বাসী নারী। তার গভীর চোখজোড়া মোটা করে কাজল দিয়ে আঁকা, যেন দু’টি গভীর অরণ্য, যেখানে হারিয়ে যাওয়া যায়। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকের পরশ, যা তার সৌন্দর্যকে আরও নীরব, অথচ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বেগুনি শাড়িতে মোড়ানো এই নারী যেন এক নতুন সত্তা—কিন্তু পরিচিতও, হৃদয়ের খুব গভীর থেকে। ফুল কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। ফুলের সামনে বসারত মানুষটিকে অচেনা লাগছে, ফুলের কাছে। এ যেনো ভিন্ন কোনো পুরুষ। এলোমেলো চুলগুলো সুন্দরভাবে সেট করা, পেশীবহুল হাতের বন্ধনীতে শোভা পাচ্ছে মূল্যবান ঘড়ি। গায়ের ফিটিং টি শার্টের অভ্যন্তরীণ বক্ষপিঞ্জর সাদৃশ্যমান ভেসে উঠেছে। ফুল চোখ ফিরিয়ে নিলো। কাগজগুলো কুড়াতে মনোযোগ দিল। শুভর কথার প্রত্ত্যুত্তর করল না। শুভ বুঝলো তার ফুলবউ অভিমান করেছে। সে হাত বাড়িয়ে ফুলকে ছুঁয়ে দিতে চাইলো। ফুল তখনই উঠে গেলো। কাগজগুলো ফাইলে গুছিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নায় নিজেকে একঝলক দেখল। চোখের নিচে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে নিলো, কানের দুলও ঠিক করে নিলো। শুভ পকেটে হাত রেখে ফুলকে পর্যবেক্ষণ করছে। ফুলের স্বাভাবিক আচরণ শুভর মস্তিষ্কে চিন্তার খাঁজ ফেলল। শুভ, ফুলকে বিছানা ঝাড়া দিতে দেখলো। শুভকে দাঁড়ানো রেখে ফুল চেয়ার ঠিক করলো। শুভকে দেখছেই না যেনো। শুভর দূরত্ব সহ্য হলো না। একটিবার ফুলকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য অন্তর পুড়তে শুরু করো। শুভ এগিয়ে আসতে নিতেই ফুল ব্যস্ততা দেখিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। শুভ আহাম্মক বনে গেল। ফুলের লুকোচুরি ভীষণ উপভোগ করলো।
শাড়ি পরে হাঁটাচলা করতে সমস্যা হচ্ছে। দুই কদম এগোতেই প্যাঁচিয়ে পড়ে যেতে নিচ্ছে। ফুল নিজেকে সামলে নিলো। শুধু পড়ে যাওয়া থেকে নয় বরঞ্চ শুভকে দেখে নিজের আবেগকেও নিয়ন্ত্রণ করে নিলো।
বাড়িতে প্রবেশ করে সাগরিকা সত্যি সত্যিই শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। সুইটি খানমের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। সুইটি খানমও কাঁদছে কিন্তু আনন্দে। তিনি জানতেন, আজ উনার একজন ছেলে নয় দুইজন ছেলে বাড়ি ফিরবে। শুভর আসার ব্যপারটা ফুলকে সাগরিকাই জানাতে নিষেধ করেছিল। সাগরিকা শাশুড়িকে কাছ থেকে নড়তে দিচ্ছে না। এমনকি আদিলকেও ঘেঁষতে দিচ্ছে না। বেচারা আদিল ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে বউয়ের কীর্তিকলাপ দেখে যাচ্ছে। ছোট্ট পিয়াল বাবাকে প্রশ্ন করছে,” বাবা, মাম্মার কি হয়েছে?”
” তোমার দাদুকে আদর করছে।”
ফুল সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে আসতেই উক্ত দৃশ্য চোখে বাঁধলো। আদিলকে দেখে মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,” কেমন আছো, ভাইয়া?”
আদিল ফুলের দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ মুখ দেখে বুঝতে চেষ্টা করল, মনের নিদারুণ অবস্থা। আদিল বুঝলো না। ফুল পিয়ালকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খেলো। আদিল উত্তর দিল,” ভালো আছি।”
শুভ তখনই নিচে নেমেছেন আসলো। আদিলের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো শুভ। আদিল কিছু বলল না। শুভ আকস্মিক আদিলকে জড়িয়ে ধরলো। সেই আগের মতো বায়না করার সুরে বলল,” কোলে নাও, ভাইয়া।”
আদিল গম্ভীর সুরে উত্তর দিল,” পারব না।”
শুভ পুনরায় বলল,” মা বউয়ের সামনে অপমান করছো তো! আমারও সময় আসবে।”
আদিল শুভকে নিজের কাছ থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। শুভ পুনরায় বলল,” আমি আর আগের মতো ছোট নেই, ভাইয়া। তোমার মতো দশটা মৌমাছিকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারব।”
আদিল শুভর কান মলে দিল,” খবরদার শুভ আমার গা ঘেঁষবি না। তুই এতো বছর যা করেছিস তারজন্য আমি অন্ততপক্ষে ক্ষমা করব না।”
শুভ, আদিলকে ছেড়ে ফুলের কাছে আসলো। তার উদ্দেশ্য ছিল, পিয়ালকে কোলে নেওয়ার ছলে ফুলকে ছুঁয়ে দেওয়ার। ফুল, শুভর এই ইচ্ছে পূর্ণ করতে দিল না। শুভর হাত বাড়িয়ে দেয়াকে উপেক্ষা করে পিয়ালকে নিয়ে নিচে বসে পড়লো। পিয়ালের জুতা ঠিক করার অজুহাত দেখিয়ে সাগরিকার উদ্দেশে বলল,” আজ প্রথমদিন বলে তোমাকে কিছু বলছি না,ভাবী। নয়তো আমার মায়ের ভাগ কারো সাথে শেয়ার করব না বলে দিলাম।”
সাগরিকা উঠে আসলো। ফুলও তখন দাড়িয়ে গেল। সাগরিকা, ফুলকে জড়িয়ে ধরলো পরম যত্নে। ফুলের তখন কি হলো কে জানে? মনের কোণে জমানো কষ্টগুলো দুমড়েমুচড়ে বের হয়ে আসলো। চোখের কোণে জমা হলো অবাধ্য অশ্রুকণা। ফুল কৌশলে চোখের পানি মুছে নিলো। সাগরিকাকে ছেড়ে নাসিমা বলে হাঁক ছাড়লো। শুভ অবাক হয়ে এই ফুলকে দেখছে। আগের ফুল ছিল নরম তুলোতে ভরা আর বর্তমানে শুভর সামনে ঘুরাফেরা করা ফুল শক্ত কাঠিন্যে ভরা। নাসিমা খাবার গরম করছিল। ফুল টেবিলে খাবার দিতে বলে সাগরিকাকে ফ্রেস হয়ে নিতে বলল। পিয়ালকে কোলে তুলে ফুল শাশুড়ির ঘরের দিকে ছুটলো।
শুভর মনে অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। গাড়িতে সাগরিকার সাথে সারাটা পথ গল্প করে এসেছে। মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় সাগরিকা যখন শুভকে ফুলের ব্যপারে বুঝাচ্ছিল। শুভ তখন শর্ত জুড়ে দিয়েছিল। সে সাগরিকার কাছে বলেছিল ফুলকে পরিবর্তন করতে। পৃথিবীতে নরম মেয়েরা টিকে থাকতে পারে না। ফুল যদি সবসময় আদিল ও শুভর উপর নির্ভর করে চলাফেরা করে তবে নিজের ক্ষতি করবে। শুভ দ্বিতীয়বার ফুলকে হারাতে চায়না। তাই সাগরিকাকে বলেছিল যেন ফুলকে পড়াশোনায় আগ্রহ দেখায়। সাগরিকা তাই করেছিল।
এতকিছুর মধ্যে শুভ সেদিন ফুলের ব্যপারে নেয়া সিদ্ধান্তই ভুল ছিল। শুভ ফুলের ভালোর জন্য দূরে গেলেও তার পরের কাজটা ঠিক করেনি। কারন চারটা বছর কম সময় না। সময় হারিয়ে গেলে কখনো ফিরে পাওয়া যায় না এই চার বছরে অনেক কিছুই হতে পারত ফুলের। ভালো, খারাপ অনেক কিছুই ঘটতে পারতো। আদিলও ছিল না এই চার বছর। ফুল এত সহজে শুভকে ক্ষমা করবে?
শুভরও মনে হলো, তার কিছুটা শাস্তি পাওয়া উচিত। অভিমান ভালোর থেকে খারাপটাই বয়ে আনে বেশি। কিন্তু ফুলের স্বাভাবিক আচরণগুলো শুভকে ভাবাচ্ছে। মেয়েটার কোনো অসুখ হয়নি তো!
শুভ সারা রাস্তায় ফুলকে নিয়ে দুইটা ভাবনা এসেছিল, প্রথম ভাবনা হলো, ফুল তাকে দেখা মাত্রই অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিবে। দ্বিতীয় ভাবনা হলো, ফুল পাগল হয়ে শুভকে জড়িয়ে ধরবে। শুভড ভাবনাগুলোর মধ্যে একটিও হয়নি। ফুল খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছে।
ইতিমধ্যে শুভ প্রধান ফটকের সামনে ফরিদকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলো। ফুলকে দেখার জন্য তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফরিদের কথা ভুলে গিয়েছিল, শুভ। শুভ এগিয়ে আসলো। ফরিদের হাত থেকে নিজের ব্যাগখানা নিলো। নাসিমা তখন খাবার টেবিল সাজাচ্ছিল। শুভ নাসিমাকে ডাকলে,” শুনুন! নিচের গেস্টরুম কী খালি আছে?”
নাসিমা মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। শুভ বলল,” ও ফরিদ, আমার সাথে এসেছে। ওকে গেস্টরুমটা দেখিয়ে দিন।”
নাসিমা পুনরায় মাথা দোলায়। ফরিদকে ঘর দেখিয়ে দেয়।
খাবার টেবিলে এলাহি আয়োজন দেখে শুভর চোখ চড়কগাছ হয়ে গেছে। সবথেকে বেশি অবাক তখন হয়েছে যখন সুইটি খানম জানালেন রান্নাগুলো সব ফুল করেছে। শুভ ফ্রেস হয়ে নিচে নেমে আসলো। বিরিয়ানির ঘ্রাণে তখন চারপাশ মো মো করছে। শুভর পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। ফুল পিয়ালকে বিরিয়ানি খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। শুভ বেছে বেছে ফুলের চেয়ারের পাশে বসলো। সুইটি খানম ছেলেকে দেখে ফুলের হাত থেকে খাবারের প্লেট কেড়ে নিয়ে বললপন,” দে আমি খাইয়ে দিচ্ছি। তুই শুভর প্লেটে বিরিয়ানি পরিবেশন কর।”
আদিলও তখন আসলো। ফুল দুই ভাইয়ের জন্য বিরিয়ানি বাড়লো। এই যে, ফুল নিঃশব্দে মায়ের কথা শুনে কাজ করলো এই বিষয়টা নিয়েও শুভকে ভাবিয়ে তুলছে। আদিল ও শুভ খাওয়া শুরু করে দিলো। ফুল পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এমনটা নয় যে, সে পুরুষদের খাওয়ার পর খাবে। মূলত সাগরিকার জন্য অপেক্ষা করছে। শুভ এক লোকমা বিরিয়ানি মুখে পুড়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। সেই স্বাদ, সেই রান্না কিন্তু অনুভূতি অন্যরকম। দেখা গেল, শুভ তিন প্লেট বিরিয়ানি খেয়ে নিয়েছে। চতুর্থবার নেওয়ার সময় আদিল বাঁধা দিল,” তোর বিরিয়ানি কেউ খেয়ে ফেলবে না। অনেক রান্না হয়েছে। একসাথে এতো খেলে পেট খারাপ হবে। তখন না হওয়া ডাক্তারকে নিয়ে আমাদের দৌড়াতে হবে।”
শুভ তখন মুচকি হাসলো। চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল। মূলত শরীর এলিয়ে দেয়াটা ফুলকে দেখার বাহানা মাত্র। ফুলের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল,” এই বিরিয়ানিতে ভেজাল নেই, ভাই। না দেয়া আছে, বিষ। এই বিরিয়ানি আমাকে সারাজীবন বিরিয়ানি খেতে বললে, অনায়েসে খেয়ে যেতে পারব।”
ফুলের মুখাবয়বের কনো পরিবর্তন হলো না। শুভ এবারও হতাশ হলো। মেয়েটা কিছু তো বলবে? এদিকে চার বছরের দূরত্ব ঘুচতে শুভ ফুলকে সময় দিচ্ছে।হুট করে কাছে যেতেও ভয় করছে। সাগরিকা আসলে ফুল অপরপাশে বসতে নেয়। সাগরিকা বাঁধা দিয়ে বলে,” আরে এখানেই তো জায়গা আছে, ফুল। তুই আমার পাশে বোস।”
সাগরিকা বাম পাশের চেয়ারে আদিল বসেছে। ডানপাশের চেয়ার ফাঁকা তারপরের চেয়ারে শুভ বসে আছে। অবশ্য শুভর খাওয়া শেষ। সাগরিকার কথা শুনে পায়সের বাটি হাতে নিলো সে। আদৌও খাবে কি না সন্দেহ। ফুল শুভর পাশেই বসলো। ফুল বিরিয়ানি ছুঁয়ে দেখলো না। সাদা ভাতের সাথে রুই মাছের এক টুকরো দিয়ে খাওয়া শেষ করে ফেলল। শুভ এবার চুপ থাকতে পারল না। ফুলকে বলল,” বাড়িতে কী খাবার কম পড়েছে? এতটুকু খেয়ে উঠে যাচ্ছো কেনো?”
ফুল এবার শুভর চোখের দিকে তাকালো। এই চোখের ভাষা শুভ বুঝতে পারে না। শুভ দেখলো, তার সামনে অপরিচিত চোখ থেকে অগ্নি ঝড়ছে। ফুল উত্তর দিল,” বাড়ির বউ হিসাবে এতটুকু স্বাধীনতা তো পেতেই পারি, তাই না? আশাকরি, ভবিষ্যতে আমার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করতে আসবে না!”
ফুলের কথা উপস্থিত সকলেই শুনলো। সকলেই বুঝলো, ফুলের মনের রুষ্টতার কারণ। সুইটি খানম চুপ করে রইলেন কিন্তু মনের মধ্যে ফুলকে বলার জন্য কিছু কথা সাজিয়ে নিলেন।
————-
রাত তখন দশটার বাজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। অভ্যাস মোতাবেক ফুল শাশুড়ির ঘরে গেল। খাওয়ার পরের ঔষধ দিল। সুইটি খানম তখন বললেন,” শাড়ি পাল্টে ফেললি কখন?”
” খাওয়ার পর। কেমন যেনো অস্বস্তি হচ্ছিল।”
সুইটি খানম পুনরা বললেন,” আমি কিন্তু জানতাম, ওরা দুইজনই আজ আসবে।”
ফুল উত্তর দিল না। সুইটি খানম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” আমার দুই ছেলে ছিল হীরার টুকরো। তাদের বউ দুটোও এনেছি রত্ন হিসাবে। তোদের মেয়ের মতো আদর করেছি। তোরা দুজন যেমন আমার মেয়ে আদিল ও শুভ আমার ছেলে। একজন অপরাধ করলে অবশ্যই শা’স্তি দিব। অতীতে তোর সাথে সাথে আমার পরিবারের সাথেও খারাপ হয়েছে। আমি বলব না, তুই শুভকে ক্ষমা করে দে। বরং বলব, জীবনটা দ্বিতীয়বার সুযোগ দিয়েছে। জীবনটা তোর, একটু ভেবে নে।”
ফুল শাশুড়ির পাশে বসে কোলে শুয়ে পড়লো। ফুলের চোখের অবাধ্য অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নিয়ম মেনে। সে বলতে শুরু করল,” সেদিন আমার একা দোষ ছিল না, মা। দোষী সেও ছিল। তার প্রথম দোষ ছিল, আদরে আহ্লাদে তৈরি করা ফুলকে ভালোবেসে আগলে রাখা। দ্বিতীয় দোষ ছিল, সেদিন প্রথম ফুলকে না বুঝে কষ্ট দেওয়া। সেদিন আমার দোষ একটাই ছিল, সেটা হলো বাবার কথা বলা। আমর বাবা ভালো ছিল না কিন্তু তিনি বাবা ছিলেন। মায়ের মন যেমন সন্তানের জন্য ছটফট করে ঠিক সন্তানের মনও তেমন। সেদিন শুভ আমাকে নিয়ে গেলে এতো কিছু হতো না। পরিস্থিতিটা ভিন্ন ছিল, মা! আমাদের ভাগ্য এমন স্থানে নিয়ে গিয়েছিল যে, সেখানে আমাদের কারো হাতই ছিল না। অথচ সমস্ত দোষ আমার ঘারে ফেলল তোমার ছেলে। আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে চারটা বছর নষ্ট করলো। সে কী আমার এই চার বছর ফিরিয়ে দিতে পারবে? সেদিন রাগ করে চলে না গিয়ে আমাকে আপন করে নিলে কী খুব দোষ হতো! বলো মা! আমি ঠিক আছি। খুব ভালো আছি এই জীবন নিয়ে। আমি নিজেকে এমনভাবে তৈরী করে নিয়েছি। কিন্তু তার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন,দীর্ঘ চার বছরের চোখের পানির মূল্য দিতে পারবে?”
সুইটি খানমের চোখেও অশ্রু। মেয়েটার মনের কিছু তিক্ত কথা শুনলো সে যা আজ পর্যন্ত উনাকে বলেনি। সুইটি খানম নিয়ত করলেন, তিনি আর কখনোই ফুল ও শুভর বিষয়ে কথা বলবেন না। ফুলের উপরই সব ছেড়ে দিলেন। মেয়েটার পরিশ্রম, সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাওয়ার লড়াইটা উনি দেখেছেন। ফুলের মাতঅয় হাত বুলিয়ে বললেন,” তোর যা ভালো লাগে, তাই করিস।।”
—————–
ফুল ঘরে আসলো বারোটায়। ক্লান্ত, বিধ্বংসী ফুল ঘরে প্রবেশ করে বিছানায় শুভকে দেখে চমকাল। দরজা আটকাতে নিয়েও আটকালো না। শুভ তড়িৎ বেগে বিছানা ছেড়ে ফুলের সামনাসামনি দাঁড়ালো। ফুলের মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে বলল,” এই ফুলবউ, তুমি আমার একদম অচেনা।”
ফুল দূরে সরে গেল। শুভ ফুলের পিছু গেল। পুনরায় বলল,” আমাকে ক্ষমা করা যায় না?”
ফুল অভিমানী কণ্ঠে বলল,” উল্লেখ্য আছে, অভিমানের পাহাড় আকাশ ছুড়ে আমি আর তোমার থাকবো না। সম্পর্কের বেড়াজালে আমাকে আটকাতে এসো না, শুভ। আমি নিজের জন্য আলাদা জগত তৈরি করেছি। সেখানেই খুশি আছি। তুমি তোমার জীবনকে গুছিয়ে নাও। কোনো দুখীফুলের জন্য নিজের জীবনে দুখ এনো না। দুখীফুলরা দুখ সয়ে যায়। তাদের মনের কথা মনকেই বুঝায়।”
ফুল চলে যেতে নিলে শুভ বাঁধা দিল,” পালাচ্ছো?”
ফুল না ফিরে উত্তর দিল,” তোমার ধারণা ভুল, আমি পালাচ্ছি না বরং প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে যাচ্ছি।”
শুভ থমকে গেলো। ফুল কী শুভর উপস্থিতি গলার কাটা মনে করছে? শুভ কিছু বলতে চাইলেও ফুল শুনলো না। কয়েক কদম আগাতে নিলে শুভই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এদিকে ফুল দরজা আঁটকে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়লো। দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো। অনেকদিন পর, ফুলের দ্বিখণ্ডিত মন ভেঙে চুড়ে একাকার হয়ে গেল। এতো বছরের দাগ এতো সহজেই মিশে যাবে কী না প্রশ্ন থাকলো। ফুল উঠে দাঁড়ালো। ড্রয়ার থেকে বের করল শুভর লেখা সেই চিঠি। যেখানে লেখা ছিল,” আমাকে আর চিঠি লেখো না, ফুল। অভিশাপের পাল্লা ভারী হয়ে গেছে। ভাঙা ড্রয়ারে না পড়া চিঠিগুলো অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে।”
চলবে……..