ইতি তোমার সুখফুল(দুখীফুলের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-০৯

0
84

#ইতি_তোমার_সুখফুল
#দুখীফুলের_দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৯

শুভ ভেবেছিল, এই বুঝি অপেক্ষার অবসান ঘটল। এই বুঝি শক্ত পাথর নরম হলো। অথচ শুভর ভাবনা ভুল।
শুভ ভেবেছিল, ফুলের অভিমান বোধহয় কমে গেছে। ফুলের চোখের কোণে আজকের আলো একটু নরম, গলার স্বরটাও যেন আগের মতো তীক্ষ্ণ নয়। শুভ তাই ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। এক পা, দু’পা যেন সময়কে থামিয়ে দিতে চায়। কাছে এসে মৃদু স্বরে ডাকল,
“ফুল।”

ফুল নিশ্চুপ। চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। শুভ আরও সাহস পায়, হাত বাড়ায় ফুলের দিকে। ঠিক তখনই ফুল সরে গেল, যেন এক ঝটকায় শুভর সমস্ত আশা ভেঙে গেল। ফুল, হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকল। শুভ আরেকটু কাছে এগিয়ে আসলে হাতের ইশারায় ফুল বাঁধা দিল। একরাশ অপরাধবোধ ঘিরে ধরলো শুভর মনকে। শুভ আওয়াজ করল,” সব তো ঠিক ছিল। তবে এখন দূরে কেনো?”

ফুল তখনো কাঁদছে। যন্ত্রণায় শুভ একা নয় ফুলও পুড়ছে। ফুলের যতোবারই সময়ের কথা মনে পড়ে যায় তখনই এলোমেলো হয়ে যায়। চাইলেও শুভকে ইগনোর করতে পারে না। শুভ অন্তরে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে আসতে নিলে ফুল বলে উঠলো, “ আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করো না, শুভ?”

ফুলের কণ্ঠ কঠিন, তবু ভাঙা। পুনরায় বলতে শুরু করলো,“তুমি কি ভাবো, আমি কিছুই টের পাইনি? সব কিছু ভুলে গিয়ে তোমার হাত ধরে আবার হাসব? এত সহজ? চারটা বছরের চোখের পানি ফিরিয়ে দিতে পারবে? চারটা বছর আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। চারটা বছর ধরে আমি রংহীন জীবন কাটাচ্ছি। আমাকে চারটা বছরের সুখগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবে?”

শুভ থমকে যায়। কিছু বলতে গিয়েও আটকে যায় কণ্ঠস্বর। ফুলের চোখে এখন অশ্রুর ঝিলিক চিকচিক করছে। কিন্তু সেই অশ্রু উষ্ণতার নয়, অভিমানের। ফুল পুনরায় বলতে থাকল, “ তুমি শুধু নিজেরটা ভেবেছো, শুভ। চার বছর আমার পাশে থাকলে ডাক্তারি পড়তে অসুবিধা হতো, তাই দূরে সরে গিয়েছিলে। তুমি ভেবেছিলে, দূরে গেলে আমিও তোমার উপযুক্ত হয়ে উঠবো। তোমার ধারণা ভুল, শুভ। কখনো কি ভেবেছো, আমার মনের কথা? কতটা কষ্ট নিয়ে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি? তোমাকে সরাসরি কিছু বলিনি মানে এই নয় যে আমি কিছুই অনুভব করিনি। আমি করেছিলাম, শুভ। তোমার ভালোবাসা অনুভব করেছিলাম। কিন্তু এখন সব ফিকে। আমার অনুভব শক্তিও তোমাকে খুঁজে না। যেমনভাবে চারটা বছর তোমার মন আমাকে নিয়ে ভাবেনি।”

শুভর হাত নিচে নেমে যায়। ফুল আরও কিছুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর মৃদু হেসে বলে, “তুমি হয়তো চেয়েছিলে সব ঠিকঠাক হয়ে যাক। কিন্তু কিছু ক্ষত থাকে, যেগুলো মুছতে সময় লাগে। হয়তো চিরকাল!”

শুভ হাসফাস করতে থাকলো। দীর্ঘদিন পর বুকে ব্যথার রোগটা দেখা দিল। শুভর কণ্ঠনালী থেকে স্বর আসতে চাইলো না। এমন সময় গলার স্বরও শুভর সাথে বেইমানি করতে হলো? শুভ সোজা হয়ে বসলো। ফুলের কথাগুলো মিথ্যা নয়। শুভ বুকে পাথর চেপে ফুলের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। বিগত বছরগুলোতে তারও কষ্ট হয়েছিল।

নিঃশ্বাস ফেলতে তারও কষ্ট হতো। ছুটে ফুলের কাছে চলে যেতে ইচ্ছে করতো। কখনো রাতের শহরে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। ফুলের কাছ থেকে দূরে সরে আসার ব্যপারটা অভিমান হলেও শুভ তাদের ভবিষ্যতের চিন্তা করতো। সে ফুলকে একজন স্বাবলম্বী নারী হিসেবে দেখতে চেয়েছিল। ফুল আজ সেই পর্যায়ে চলেও এসেছে। কিন্তু শুভকে ভুল বুঝে।

মান অভিমান, অবজ্ঞার মাঝেও একটি সত্যি হলো, শুভ ফুলকে ভালোবাসে। জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। সে ভেবেছিল, ফুলও তার মতো ভালোবাসে। অথচ আজ মনে হচ্ছে, অভিমানের আড়ালে ফুলের ভালোবাসাও ফিকে হয়ে গেছে। শুভর, ফুলের কাছে আসতে এতোটাই দেরি হয়েছে যে ফুলের মনে শুভর জন্য এক সমুদ্র কষ্টই রয়েছে, ভালোবাসা নয়।

———————-

ভোরের আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে। শুভর ঘুম ভাঙলো প্রথমেই। অতীতের তিক্ত বিবরণ নিয়ে ভাবতে গিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল সে জানে না। শুভ দেখল, তার গায়ে পাতলা শাল দেয়া। আনমনে হাসলো শুভ। এই কাজ তার ফুলবউ ছাড়া আর কারো হতে পারে না। শুভর অতৃপ্ত চোখজোড়া ফুলকে খুঁজতে ব্যস্ত। ফুল টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। শুভ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ফুলের দিকে তাকিয়ে। ফুল তার স্ত্রী—সেই ফুল, যার সঙ্গে তার সম্পর্ক যতটা গভীর, ততটাই সূক্ষ্ম। ফুল ঘুমিয়ে আছে, তার মুখে প্রশান্তির ছাপ। শুভ খুব ভালো করেই জানে, সে তার স্ত্রী হলেও ফুলের জগতে হঠাৎ প্রবেশ করা তার মানায় না। ফুলকে তার নিজের মতো থাকতে দিতে হবে, তার ঘুমটুকু ভাঙার আগে তাকে স্পর্শ করার অধিকার নেই।

শুভ ফুলের প্রতি এক গভীর সম্মান আর ভালোবাসা অনুভব করে। তাদের সম্পর্ক শুধুই দাম্পত্য নয়, একে অপরের পরিসর বোঝার, স্পর্শের আগে অনুমতি চাওয়ার এক নীরব প্রতিজ্ঞা। সে দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, যেন ফুল নিজেই তার দিকে তাকায়, নিজেই তাকে আমন্ত্রণ জানায়।

এই অপেক্ষার মধ্যেই শুভর ভালোবাসার সত্যিকারের প্রকাশ। দাম্পত্য মানে শুধুই অধিকার নয়, বরং একে অপরের ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্বের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা। শুভ জানে, ফুলের ঘুম থেকে জাগা মানে তার প্রাণের প্রকাশ, আর সেই প্রকাশে তার কোনো তাড়া নেই। সে দূরে থেকে দেখে, প্রকৃতি আর ভালোবাসার মিলিত সৌন্দর্য কীভাবে ফুলের ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ফুটে উঠবে।

তবে আজ শুভ ফুলের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করলো না। ঘুম ভাঙার পর শুভকে দেখলে যদি পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে পড়ে। শুভ সব সহ্য করে নিবে কিন্তু ফুলের চোখে ঘৃণা সহ্য করতে পারবে না। দরজার কাছে এগিয়ে গেল শুভ। হাত বাড়ালো দরজার হাতলের দিকে। শুভ আশ্চর্য হলো, দরজার ভাঙা নব ঘুরাতেই দরজা খুলে গেল। গতকাল রাতে শত চেষ্টা করেও খুলতে পারেনি অথচ! শুভ আলগোছে বেরিয়ে আসলো। মেয়েরা এখনো উঠেনি। শুভ আরো আশ্চর্যিত হলো, বাহিরে কাউকে দেখতে না পেয়ে। সংগঠন থেকে বেরিয়ে শুভ রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। ফুলের রাগ করা যথাযথ কিন্তু শুভ কেনো যেনো সহ্য করতে পারছে না অথচ ফুল চার চারটা বছর সহ্য করে এসেছে।

শুভ ফুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। যেভাবেই হোক ফুলের মনের সকল কষ্ট দূর করে শুভ ঠিক আগের মতো ফুলকে গড়ে নিবে। যেই ফুলের পাপড়ি পর্যন্ত লাজুক ছিল, শুভ সেই ফুলকে ফিরিয়ে আনবে।

——————

ফুল আর শুভর সম্পর্কের মধ্যে কিছুদিন ধরেই মান-অভিমান চলছে। দু’জনেই একটু দূরে দূরে থাকে, কিন্তু ভালোবাসা কোথাও হারিয়ে যায়নি। শুভ জানে, ফুলের সংগঠনে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে। দিনের এক তৃতীয়াংশ সেখানেই কাটায় ফুল। শুভ আড়াল থেকে ফুলের উপর নজর রাখে। কাছে গেলেই তো মেয়েটার হাসিমাখা মুখে বিশাদ নেমে আসে। দুপুরবেলায় ফুল সংগঠনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তার মোড়ে শুভ বসে ছিল একটা ছোট চায়ের দোকানে, ফুলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। ঠিক তখনই শাহিন এসে হাজির। ফুলকে দেখে তার মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটে ওঠে। রাস্তার মাঝখানে ফুলের পথ আটকে দাঁড়ায়, “তোমার মতো মেয়েদের একা পথ চলাচল করা ঠিক না, বুঝলে? তুমি চাইলে, তোমার সৌন্দর্যটাকে কাজে লাগাতে পারো। রাতের আঁধারে তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারো। কয়েকঘন্টায় হাজার হাজার টাকার মালিক হয়ে যাবে।”

ফুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু মুখে একটা দৃঢ় ভাব।
দূরে বসে থাকা শুভ পুরো ঘটনাটা দেখছিল। তার চোখে ক্রমেই রাগ জমতে থাকে। সে দ্রুত এগিয়ে আসে, “তোমার সাহস হয় কী করে এরকম কথা বলার?”

শুভ কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল। শাহিনও কম যায় না। সে বিদ্রুপের হেসে বলল, “তোমার কী সমস্যা, ভাই? এটা তোমার ব্যাপার না। নাকি তোমারও মেয়েটাকে লাগবে?”

শুভ আর কিছু বলার আগে ফুলই এগিয়ে আসে।

“থামো, শুভ।”

ফুল শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “এটা আমার লড়াই।আমাকে আমার কথা বলতে দাও।”

শুভ চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। সে জানে, ফুলকে এই মুহূর্তে থামানো ঠিক হবে না। ফুল শাহিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ আপনি কতদিন ধরে এই নোংরা কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছেন? নারীদের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আজ আমি আপনাকে একটা কথা জানাতে চাই, আপনার মতো লোকেরা এই সমাজে টিকে থাকে না। কারণ সত্যের সামনে মিথ্যার কোনো শক্তি নেই। আর যাকে আপনি দুর্বল ভাবছেন, সে নিজের জায়গায় দাঁড়ানোর সাহস রাখে।”

শাহিন থতমত খেয়ে যায়। তার মুখে আর কোনো কথা আসে না। শুভ দাঁড়িয়ে ফুলের কথা শোনে, তার চোখে মুগ্ধতা। ফুল শেষ করে বলতে থাকল, “আজকের পর যদি আপনাকে এখানে দেখি, তাহলে এই সমাজের আইন আপনাকে শায়েস্তা করবে। মনে রেখবেন, তুমি যে খেলায় নেমেছো, সেখানে হেরে যাওয়াটাই নিশ্চিত।”

শাহিন অপমানিত হয়ে সেখান থেকে চলে গেল। শুভ ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফুল শুভর দিকে না তাকিয়ে বলল,” এসময়ে এখানে কেনো?

শুভ মৃদু হেসে ফুলের কথার প্রত্ত্যুত্তর না দিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলতে শুরু করল, “তোমার মতো সাহসী স্ত্রী আছে বলে আমি গর্বিত। এভাবেই থেকো, প্রতিবাদী আর দৃঢ়।”

ফুলের মুখাবয়বের কনো পরিবর্তন হলো না। শুভ হতাশ হলো। একরাশ মন খারাপ নিয়ে এগিয়ে গেল। শুভ চাইলেও আগের মতো হতে পারছে না। তারমধ্যে গাম্ভীর্যতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ফুলের মান ভাঙানোর উপায়ও মাথায় আসছে না। এমনটা কী দূরত্বের কারণে হয়েছে? শুভর এখন খুব আফসোস হচ্ছে। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হচ্ছে। সে স্বার্থপরের মতো কাজ করে ফেলেছে। নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের চিন্তা করতে গিয়ে যাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়বে তাকেই হারিয়ে ফেলেছে।

ফুল বিনাবাক্যে শুভকে অনুসরণ করে পথ চলল। তাদের যাত্রা একসাথে শুরু হলেও দূরত্ব ছিল দীর্ঘ।
——————–

ফরিদকে নিয়ে আসার কোনো কারণ নেই। পরীক্ষা শেষ করে ফ্ল্যাটে ফিরতেই ফরিদের দেখা মিলে। ফরিদের চাকরি নাকি চলে গেছে। প্রিয় মানুষটাও অন্যের হয়ে গেছে। শুভর খুব মায়া হলো। ফরিদকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসলো। বকশি কাকার সাথে হাত বাটবে সে। কাজের পারিশ্রমিকও পাবে। আদিল চলে যাওয়ার আগে বকশি কাকার উপর বড়ো দায়িত্ব দিয়ে গেল। আদিলের বাবার রেখে যাওয়া কিছু সম্পদ বিক্রি করে সেই মূল্য দিয়ে গরুর খামার দিয়ে গেল। প্রথমে দশটা গরু দিয়ে শুরু করলেও এতো বছরে গরুর সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়েছে। বকশি কাকার একা হাতে কাজ করতে করতে হিমশিম খেয়ে যায়। অবশ্য সাত আটজন কাজের লোক রাখা হয়েছে কিন্তু সবাই কী আর বিশ্বস্ত হয়? ফরিদকে আদিলের খুব পছন্দ হলো। তাকে গরুর খাবারের উপর দায়িত্ব দেওয়া হলো। প্রতিদিন কত বস্তা সবুজ ঘাস লতাপাতা আনা হচ্ছে, সেগুলোর হিসাব রাখে ফরিদ।

শুভদের বাড়ি থেকে একশো গজ দূরে গরুর খামার। ফরিদ সকাল সকাল খামারে গেল। বস্তা থেকে লতাপাতা ও ঘাস বের করে কা’টার মেশিন দিয়ে কা’ট’তে লাগলো। সন্ধ্যা হতে চলল। ফুল ও নাসিমা মিলে বাড়ির সবার জন্য নাস্তা বানালো। নাস্তার পর্ব শেষ করে নাসিমার মনে হলো ফরিদের জন্য নাস্তা নিয়ে যেতে। এমনটা মনে হবার কারণ জানে না নাসিমা। একটি বক্সে খাবার ঢুকিয়ে নাসিমা বের হয়ে আসলো। ফরিদ ঘাস কাটছে। ঘোমটা মাথায় কাউকে আসতে দেখে কাজ থামিয়ে দেয় সে। নাসিমা কাছাকাছি এসে মাথার ঘোমটা সরিয়ে বক্স এগিয়ে দেয় ফরিদের দিকে,” নাস্তা আনছিলাম। খাইয়া লইন।”

ফরিদ অবাক হলো। ময়লা হাত বাড়ালো নাসিমার দিকে। নাসিমা মুখ বাঁকাল,” শহরের মানুষ বুঝি খাচ্চর হয়?”

ফরিদ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে কোমরে বেঁধে রাখা গামছায় মুছে নিল। এরপর হাত বাড়িয়ে বলল,” আপনারে দেখে অবাক হইছি। তা আজ নাস্তা আনলেন যে?”

” এমনি ইচ্ছা হইলো। খাইয়া তাড়াতাড়ি বক্স ফেরত দেন।”

ফরিদ কাজ ফেলে একপাশে বসলো। পুনরায় হাত গামছায় মুছে বক্স খুলে দেখল, দুইটা শিঙাড়া নিয়ে এসেছে নাসিমা। ফরিদ হেসে গপাগপ দুইটা শিঙাড়া খেয়ে নিলো। নাসিমা হা হয়ে ফরিদের খাওয়া দেখলো। ছেলেটার জন্য খুব মায়া হলো। সে ভাবল, এখন থেকে প্রতিদিন কিছু না কিছু নিয়ে আসবে।
ফরিদ বক্স ফেরত দিয়ে বলল,” সন্ধ্যার পর এমনিতেও বাজারে যাইতাম। শুভ ভাইয়া টাকা দিয়েছে।”

নাসিমা বক্স হাতে নিয়ে বলল,” বাইরের খাবার খাওয়া ভালা না। আমি প্রতিদিন নাস্তা নিয়া আসমু নে।”

ফরিদ মাথা নাড়ালো। নাসিমা চলে যেতে নিলে ফরিদ পিছন থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, শুভ ভাই আর ভাবীর সম্পর্ক কেমন?”

নাসিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উদাসীন হয়ে বলল,” এরা একে অপরকে ছাড়া থাকতে পারে না। অথচ পরিস্থিতির জন্য এরা দূরে। ফুল আপার মনে অনেক কষ্ট। শুভ দাদাকে নাকি চিঠির উপর চিঠি পাঠাইছিল শহরে থাকতে। উত্তর দেয় নাই। এখন ফুল আপা রাগ করে বসে আছে। উপরওয়ালা জানে, কবে আপার রাগ ভাঙবো।”

ফরিদ ভাবল, সেই চিঠি দুটোর কথা। যেগুলো ফরিদ পাঠিয়েছিল। ফরিদ চিঠিতে কি লেখা ছিল পড়ে দেখেনি। কিন্তু যতটুকু বুঝতে পেরেছিল, সেই চিঠি দুটো পড়লে ফুল রাগ করে থাকতো না।

—————–

বিকালের নাস্তা সবাই খেলেও শুভ খেলো না। সে দুপুর থেকে কিছু খায়নি। ফুলকে নিয়ে আসার পর ঘরে ঢোকে। তারপর থেকে কিছুই মুখে তুলেনি। শুভর মা অনেকবার ডাকাডাকি করে গিয়েছেন কিন্তু শুভ ক্ষুধা নেই বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। বিকালের নাস্তা নিয়ে নাসিমা গিয়েও ফেরত আসে। ফুল, রাতের খাবার তৈরির করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাগরিকা দেখল, ফুল অন্যমনষ্ক হয়ে তরকারি কুটছে। পিয়ালকে নুডলস খাওয়াচ্ছিল সাগরিকা। সামনেই শাশুড়ি বসা। ফুলকে শুনিয়ে শুনিয়ে সাগরিকা বলতে শুরু করল,” শুভ নাকি একমাসের ছুটিতে এসেছে। তোমাকে এই নিয়ে কিছু বলেছে, মা?”

ফুলের শাশুড়ি স্বাভাবিক সুরে বলল, ” না, তোকে কিছু বলেনি?”

সাগরিকা হা করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” না গো মা!”

তারপর ফুলের উদ্দেশে বলল,” তোকে কিছু বলেছে, ফুল?”

ফুল ইতস্তত হয়ে বলল,” আমি কিছু জানি না, ভাবী।”

সাগরিকা মিথ্যা রাগ করার অভিনয় করে বলল,” তা জানবি কীভাবে? সারাদিন স্বামীর খবর একবারও নিয়েছিস? দিনরাত স্বামী কি করছে খেয়াল করেছিস? গতকাল সকালে দেখলাম, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কারো সাথে কথা বলে যাচ্ছে। কখনো জানতে চেয়েছিস, কার সাথে এতো কথা বলে? আজ আবার দুপুর থেকে ঘরে আটকে আছে। না জানি কার সাথে কথা বলছে! শোন ফুল, অভিমান করেছিস বেশ করেছিস। সেটাকে আবার জিদ ভেবে বসে থাকিস না। সামনের মানুষটা যদি ক্ষমা চায় তাহলে ক্ষমা করে দে। বলা নেই, অবহেলা পেতে পেতে কেউ যদি তার গলায় ঝুলে পড়ে! তখন কি করবি?”

ফুল শুনলো। কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। নাসিমাকে তরকারি কা’ট’তে বলে রান্নাঘরে চলে গেল। অনেক সময় পর হাতে করে বাটি নিয়ে বের হলো। সাগরিকা উঁকি দিয়ে দেখল, তাতে পাস্তা রাখা। সাগরিকা মুচকি হাসলো। ফুলের কঠিন মন হয়তো নরম হতে শুরু করেছে। সাগরিকা নিজের বুদ্ধির প্রশংসা করল।

শুভর ঘরের সামনে এসেও ফুল কয়েকবার ফিরে গেল। দরজায় কড়াঘাত করার সাহস হচ্ছে না ফুলের। এদিকে পাস্তাও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। ফুল উপায়ান্তর না পেয়ে দরজায় কড়াঘাত করলো। শুভ ঘর থেকে উঁচু আওয়াজে জানাল,” আমি কিছু খাব না, মা! বিরক্ত করো না।”

ফুল এপর্যায়ে কথা বলল,” আমি ফুল।”

অপরপাশে নিস্তব্ধতা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলে দিল শুভ। ঘরের অবস্থাও সুবিধার নয়। জমিনে কাগজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুভর নাকের আগা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। মাথার গোছানো চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। পরিধানের শার্ট কুঁচকে রয়েছে। মনে হচ্ছে সকল তুফান শার্টের উপর গিয়েছে। ফুল ঘরে প্রবেশ করল।পাস্তার বাটি টেবিলের উপর রাখলো। বিনা শব্দে জমিনে ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলো উঠাতে লাগলো। বিছানা থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে বিছানা গুছালো। শুভ বুঝলো নাস্তা তার জন্য নিয়ে আসা। সেও বিনাবাক্যে পাস্তা খেতে শুরু করলো। ফুল বিছানার উপর ঘুমের ট্যাবলেট পেলো। অবশ্য ট্যাবলেটের পাতা পুরোটাই ভরা ছিল। হয়তো শুভ ঔষধ খাবে বলে রেখেছে। ফুল ঔষধ খানা নিজের কাছে রাখলো। সারাঘর পরিষ্কার করে শুভর দিকে তাকালো। শুভ পাস্তা হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়েই বসে আছে। নাকের আগা লাল টুকটুকে হয়ে আছে। হয়তো ঠান্ডা লেগেছে, নয়তো শুভ কান্না করেছে। শুভ মুখখানা পানসে করে বলল,” খেতে ইচ্ছে করছে না।”

ফুল, শুভর হাত থেকে পাস্তার বাটি কেড়ে নিল। ইতস্তত হয়ে শুভর কপালে হাত রাখলো। শুভর মনে হলো কেউ তার শরীরে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। কতোদিন পর ফুলের হাতের ছোঁয়া পেলো, শুভ! আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলল। যখন চোখ খুলল ফুল তখন শুভর লাল চোখজোড়া দেখতে পেলো। ফুল শুভর কপাল থেকে হাত সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,” যেই ডাক্তাররা কলেজ জীবনে পড়ার নামে ধাপ্পাবাজি করে বেড়ায় তারাই ঠান্ডার ঔষধের জায়গায় ঘুমের ঔষধ খায়। কিছু না পারলে অন্য ডাক্তার দেখিয়ে ঔষধ খাও। জ্বর আসবে বলে।”

শুভ নাক টানলো। শুঁকনো কাশি দিয়ে বলল,” আমার ডাক্তার তো তুমিই। আমার রোগও তুমি। আমার ঔষধের প্যাকেট তুমি। তুমি থাকলে,আমার আর কী চাই।”

ফুল মুখ বাঁকাল। বিড়বিড় করে কিছু বলল। শুভ শুনতে না পেলেও বুঝল, শুভর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে ফুল।
ফুল চলে যেতেই শুভ বুঝতে পারল, জ্বর তাকে কাবু করার জন্য দরজার কাছে চলে এসেছে। শুভও সুযোগ দিলো। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

রাতেও শুভ খেলো না। ফুলও নানান অজুহাত দেখিয়ে খেলো না। নাসিমাকে দিয়ে শুভর খাবার উপরে পাঠিয়ে দিলো। রাত তখন সাড়ে বারোটার ঘরে। ফুল নিজের ঘরে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। বিকালেই তার কাছে শুভর হাবভাব ভালো মনে হয়নি। রাতের খাবার খেয়েছে কীনা কে জানে? ফুল শাশুড়িকে শুভর কথা বলেছিল। ফুলের শাশুড়ি তখন উত্তর দিল,” সে কী ছোট বাচ্চা নাকি? আমার এখন কোলে তুলে খাওয়ানোর বয়স আছে? তোর মায়া লাগলে, তুই সেবা কর গিয়ে।”

ফুল বুঝলো, পরিবারের সকলের ষড়যন্ত্র। সবাই চাচ্ছে ফুল শুভর কাছে যাক। সবাই ফুলের সাথে করা অন্যায়ের কথা ভুলে গিয়েছে। ফুল রাগ করে ঘরে বসে আছে কিন্তু কতক্ষণ? শুভর নিশ্চয়ই জ্বর এসেছে। ফুল সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শুভর ঘরের সামনে গেল। দরজার নবে হাত রাখতেই খুলে গেল। ফুল অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিল। বিছানার উপর শুভকে শুয়ে থাকতে দেখে কাছে গেল। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুভ শুয়ে আছে। ফুল শুভর গা থেকে কাঁথা সরিয়ে দিল। শুভর লাল রাঙা মুখশ্রী দেখে কপালে হাত রাখলো। জ্বরে শুভর কপাল পুড়ে যাচ্ছে। ফুলের মনে হলো কেউ তার হাত আগুনের উপর ধরে রেখেছে। ফুল সাহায্যের জন্য যেতে নিয়েও থেমে গেলো। সে কিছু সময়ের জন্য ভুলে বসেছিল যে, এবাড়িতে শুভকে দেখতে কেউ আসবে না। ফুল শুভর কাছে এসে বসলো। শুভর গালে হাত রেখে কয়েকবার ডাকলো। শুভ নিভু নিভু চোখে ফুলকে দেখতে পেয়ে মলিন হাসলো। কম্পনরত হাত দ্বারা ফুলের গালে হাত রেখে কয়েকবার আওড়াল, ” আমাকে ক্ষমা করে দাও, ফুলবউ! তোমার অবহেলা আর সইতে পারছি না। আমি তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসি, ফুলবউ। আই লাভ ইউ।”

শুভ এতটুকু বলে জ্ঞান হারালো। ফুলের চোখে পানি। শুভর হাতের উপর কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো। ফুল গুনগুন করে কিছুক্ষণ কাঁদলো। একাই বলতি এনে শুভর মাথায় পানি ঢাললো। জলপট্টি কপালে দিয়ে অর্ধরাত পর্যন্ত বসে রইলো। মাথায় পানি ঢালার একপর্যায়ে শুভর জ্ঞান ফিরে আসলে ঔষধ খাইয়ে দিল। শুভর শরীর ঘামতে শুরু করলে ফুল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাত অনেক হয়েছে। ফুলেরও ঘুমের প্রয়োজন। ফুল চলে আসতে নিলে শুভ বাঁধা দিল। ফুলের হাত ধরে রাখলো, শুভ। অস্পষ্ট স্বরে বলল, ” আজ আমার পাশে থেকে গেলে খুব বড়ো ক্ষতি হবে, ফুলবউ?”

চলবে……………..