#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২
আমায়রা মায়ের কথা শুনে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলো। রুমের দরজা হালকা ভিড়িয়ে দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ফর্সা গালে থাপ্পড়ের দাগটা কেটে বসেছে। পাঁচ আঙুলের বলিষ্ঠ ছাপ যেন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। গালটা টনটন করে ব্যথা করছে আমায়রার।
আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের গালের এমন বেহাল দশা দেখে ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো তার। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে জামা কাপড় নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে। ফ্রেশ হচ্ছে আর ওই ছেলের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে সে।
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো সে। অনেকক্ষণ যাবত পানিতে ভেজায় গায়ের রঙ ফেকাসে হয়ে গেছে তবুও থাপ্পড়ের দাগ রয়েই গেছে। সদ্য গোসল করায় আমায়রার লম্বাচুল গুলো দিয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে। সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে ব্যস্ত গালের থাপ্পড়ের দাগ লুকাতে। খুব সাবধানতার সাথে গালে আচ্ছামতে মেকাপ ঘষলো সে।
বেশকিছুক্ষণ খাটাখাটনির পর নিজের গালের থাপ্পড়ের দাগ লুকাতে পেরে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো আমায়রার। চুলগুলো অন্য আরেকটা শুকনা গামছা দিয়ে পেচিয়ে রুম ছেড়ে পা বাড়ালো রান্নাঘরে।
রান্নাঘরে আমেনা বেগম নানা পদের রান্না করতে ব্যস্ত। আমায়রা কপাল কুচকে পাশে থাকা বাটি থেকে কাজু বাদাম খেতে খেতে বলল,
“আম্মু কে এমন আসবে যার জন্য এতো আয়োজন করছো?”
আমেনা বেগম এক পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে আবারো খুনতি নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“তোর ফুপুরা আসছে। তোর ফুপাতো বোন বন্যার বিয়ের দাওয়াত দিতে। আর কিছুদিন পর ওর বিয়ে।”
আমায়রা যেন টাশকি খেল। অবাক কন্ঠে বলল,
“আম্মু এসব তুমি কি বলছো! বন্যা আপুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, আর আমি জানতেও পারলাম না।”
“হুট করেই ঠিক হয়েছে। এতো না ভেবে খেয়ে কাজে হাত দে। আর মুখে একগাদা মেকাপ লাগিয়েছিস কেন,কি হয়েছে?”
আমায়রা নিরেট গলায় বলল,
“তেমন কিছু না আজ একটু সাজতে মন চাইলো তাই সেজেছি।”
আমেনা বেগম কপাল কুচকে বললেন,
“তোর যে কখন কি মনে চায় আল্লাহ ভালো জানে।”
আমায়রা গাল ফুলিয়ে বলল,
“আম্মু তুমিও না।”
“আচ্ছা বাবা আর গাল ফুলাতে হবেনা। খেয়ে নে বেলা গড়িয়ে গেল।”
আমায়রা আর কথা না বলে খাবার টেবিলে এসে বসলো। আজ ভার্সিটি থেকে আসতে আসতে দেড়ি হয়ে গেছে। ইশরার থেকে নোট নিতে নিতে। তার উপর ওই পোলার হাংগামাতে প্রচন্ড বিরক্ত আমায়রা। দুপুর পেড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। ক্ষিধাও মরে গেছে বলেই চলে। তারপরও মায়ের বকুনির ভয়ে কয়েক লোকমা ভাত খেয়ে নিলো আমায়রা। ভাতটুকু কোনোমতে শেষ করতেই সেখানে এসে হাজির হলো অনুভব।
অনুভব আমায়রার মাথা গাট্টা মেরে বলল,
“কিরে তাড়ছিড়া মুখে এতো আটা ময়দা মেখেছিস কেন?কাকে ভয় দেখাতে যাবি এই বিকালে?”
আমায়রা মাথার পিছনে হাত রেখে বিরক্তিতে চোখ নাক মুখ কুচকে বলল,
“ভাইয়া ভালো হয়ে যাও বলে দিলাম। আর আমি আটা ময়দা মাখিনি। এগুলো মেকআপ। আর যাকেই ভয় দেখাইনা কেন তোমার কি! আর আমি তাড়ছিড়া না তুমি তাড়ছিড়া, তোমার চৌদ্দগুষ্টি তাড়ছিড়া।”
অনুভব সোফায় আয়েশ করে বসে বলল,
“দম নে একটু। এক নিশ্বাসেই সব বলবি নাকি। আর আমার চৌদ্দগুষ্টির মধ্যে কিন্তু তুইও পড়িস। আফটার অল তুই আমার বাপের একমাত্র মাইয়া।”
আমায়রা রাগে ফসফস করতে করতে বলল,
“আম্মু দেখ তো ভাইয়া কি শুরু করছে!”
আমেনা বেগম রান্নাঘর থেকে চেচিয়ে বলে উঠলেন,
“তোরা কি শুরু করেছিস বল তো। তোরা কি এখনো ছোট। একে তো মেহমান আসবে আর তোরা কি শুরু করেছিস! আমায়রা ঘুর গোছা ভালো করে। আর অনুভব নিচের দোকান থেকে চিনি আর চা পাতা আন তো ফুড়িয়ে গেছে।”
আমায়রা ভেংচি কেটে ঘর গোছাতে লাগলো। অনুভবও মায়ের কথামতো দোকানে চলে গেল।
————————–
রায়ান বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে হর্ণ বাজাতে লাগলো। গেটম্যান দ্রুত এসে গেট খুলে দিলো। রায়ান বাইক সজোরে টান দিলো। বাইক পাকিং এ রেখে গটগট পায়ে বাড়িতে ঢুকলো।
সোফায় রায়ানের মা রাবেয়া বেগম বসে টিভি দেখছিলেন। ছেলেকে এমন ভাবে বাড়িতে ঢুকতে দেখে কপাল কুচকে জিঙ্গাসা করলেন,
” বাবা রায়ান কিছু কি হয়েছে?”
রায়ান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“না কিছু হয়নি।”
বলেই গটগট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। রাবেয়া বেগম ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
রায়ান রুমে গিয়ে পড়নের সাদা রঙের শার্টটা খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল। রাগের চটে চোখমুখ লাল হয়ে আছে তার। এর আগে তার সঙ্গে কেউ তর্ক করেনি। আর এই মেয়ে তর্ক তো করেইছে। আবার তার পছন্দের শার্ট নোংরা করে বলে নাকি সে ছুচো মেরে হাত নোংরা করে না। তাকে ছুচো বলল। যাকে মেয়েরা দেখলে পাগল হয়ে যায় আর ওই মেয়ে তাকেই ছুচো বলল। রায়ানের তো মন চাইছে ওই মেয়ের সামনে গিয়ে ওরে আরো দুইটা ঠাটিয়ে লাগাতে।
রায়ান নিজের রাগ কমাতে পরপর জোরে কয়েকটা নিশ্বাস ছেড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল শাওয়ার নিতে।
দীর্ঘক্ষণ শাওয়ার নিয়ে টাওয়েল পড়েই ওয়াশরুম থেকে বের হলো রায়ান। বের হতেই কপাল কুচকে এলো তার নেহাকে দেখে। নেহা রায়ানের চাচাতো বোন।
রায়ান রাশভারী কন্ঠে বলল,
“এখানে কি?”
নেহা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে রায়ানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ভাইয়া এমন করে কথা বলছো কেন? আমি কি আসতে পারিনা তোমার রুমে?”
রায়ান চরম বিরক্তি নিয়ে বলল,
“না আসতে পারিস না। বের হয়ে যা রুম থেকে।”
“ভাইয়া”
“বের হতে বললাম না।”
নেহা আর কিছু বলতে পারলো না। ধপধপ পা ফেলে গাল ফুলিয়ে রুম ছেড়ে চলে গেল।
রায়ান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে কার্বাট থেকে একটা কালো রঙের টিশার্ট আর একটা কালো রঙের টাউজার বের করে পড়ে নিলো। তখনি রুমে রাবেয়া বেগম এলেন খাবার নিয়ে। রায়ান ভ্রুকুচকে তাকালো মায়ের দিকে। মেজাজটা এখন একটু কমেছে তার শাওয়ার নিয়ে।
রায়ান গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“আমি এখন খাবো না।”
রাবেয়া বেগম রায়ানের হাত ধরে বেডে বসালেন। নিজেই বেডে বসে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন,
“খাওয়ার উপরে রাগ দেখাতে নেই। আর তুমি নাকি নেহার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছো?”
রায়ান কি যেন বিরবির করলো। তারপর নিরেট কন্ঠে বলল,
“বিরক্ত করছিলো আমায়।”
রাবেয়া বেগম ছেলের মুখে এক লোকমা ভাত তুলে দিয়ে বললেন,
“বাবা রাগ কমাতে শিখো। রাগ নিজের নিয়ন্ত্রনে না আনলে তো সমস্যা। আর নেহা ছোট মানুষ ওকে বুঝিয়ে বললেই ও বুঝবে।”
রায়ান মনে মনে বলল,
“ছোট মানুষ নাকি ছাই। সুযোগ পেলে গলায় ঝুলে পড়ে, অসহ্য।”
রায়ানকে আনমনে বিরবিরাতে দেখে রাবেয়া বেগম বললেন,
“কি ভাবছো?”
রায়ান মুখ ফুলিয়ে কিছু না বলে খেতে লাগলো।
রাবেয়া বেগম ও আর কথা না বাড়িয়ে সব খাবারটুকু রায়ানকে খাইয়ে দিয়ে ওকে রেস্ট নিতে বলে চলে গেলেন।
রায়ান মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা তপ্তশ্বাস ফেলে ধপ করে বেডে শুয়ে পড়লো। সিলিং এর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রায়ান। ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার। আর কিছু না ভেবে রায়ান চোখ বুজলো।
অন্যদিকে, নেহাকে মুখ কালো করে ফিরতে দেখে ওর মা শাহানারা বেগম একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“কি হইলো আজকেও তাড়ায় দিছে। তোর দ্বারা কিছু হবেনা।”
নেহা গাল ফুলিয়ে বলল,
“আম্মু আমি কি করবো তুমিই বলো। রায়ান ভাইয়া তো আমাকে সহ্যই করতে পারে না।”
শাহানারা বেগম জোর গলায় বললেন,
“সহ্য করতে পারেনা বললে হবে না সহ্য করাইতেই হবে। তোর উপর আমার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সামান্য একটা ছেলেকে পটাতে পারছিস না।”
নেহা রাগী কন্ঠে বলল,
“যাও তুমি গিয়ে পটাও।”
বলেই হনহনিয়ে রুম ছেড়ে চলে গেল নেহা।
শাহানারা বেগম বেশ বিরক্ত হলেন মেয়ের কাজে। নিজ মনেই বিরবিরিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
——————-
আমায়রার ঘর গোছানো প্রায় শেষ। ঘরের চারপাশে আবারো ভালো করে দেখে নিলো সে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখে সস্থির একটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারো আমেনা বেগমের কাছে গেল আমায়ারা।
আমেনা বেগম মেয়েকে আসতে দেখে বললেন,
“তোর বাবাকে একটু কল দে তো। কখন আসবে সে? আর বন্যারাই বা কোথায়?”
আমেনা বেগমের কথার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলো। আমেনা বেগম একবার দরজার দিকে তাকিয়ে আবারো আমায়রার দিকে তাকালেন। আমায়রা গায়ের ওড়নাটা ঠিক করে দরজা খুলতে ছুটলো।
#চলবে
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)