#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ০৪
আমায়রা আর বন্যা একরুমে ঘুমাবে। আমায়রা বিছানা ঠিক করছে শোয়ার জন্য। বন্যা বারান্দায় গিয়ে রাকিবের সঙ্গে কথা বলছে। বন্যা আর রাকিব একে অপরকে ভালোবাসে চার বছর যাবত। বছর দুয়েক আগেই আমায়রা জানতে পেরেছিলো সেটা। আমায়রা বিছানা ঠিক করে ধপ করে শুয়ে পড়লো। কিছুসময় সিলিং এর দিকে তাকিয়ে রইলো। বেড সাইড টেবিল হাতরে ফোনটা হাতে নিলো।
আজকে ফেসবুকে ঢোকারই সময় পায়নি সে। আমায়রা মনের সুখে ফেসবুক স্ক্রল করছিলো। হঠাৎ করেই একটা আইডি চোখের সামনে আসতে কপাল কুচকে আসলো তার। পরমুহুর্তেই একটা শয়তানি হাসি দিলো সে।
দ্রুত ফেক আইডি থেকে ওই আইডির সব পোস্টে গণহারে হাহা দিলো। এখন মনটা বেশ শান্ত লাগছে তার। ফোনটা বিছানায় রেখে পায়ের উপর পা তুলে কুটিল হেসে নিজ মনেই আমায়রা বলল,
“রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরী এবার মজা দেখবে। আমার সঙ্গে লাগতে এসেছিলেনা । তুমি তো চান্দু আমারে চিনো না। আমিও আমায়রা রহমান নিশাত। তোমায় আমি দেখে নিবো। আমার গালে থাপ্পড় দিছো না বুঝবে মজা।”
বন্যা কথা শেষ করে রুমে এসে আমায়রাকে এমন হাসতে দেখে ভ্রুকুচকে বলল,
“কিরে আমায়রা হাসছিস কেন একা একা? কি হয়েছে তোর বল তো আমায়?”
আমায়রা বন্যার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার আবার কি হবে কিছুই না হুদাই ভেটকাই।”
বন্যা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না না ডাল মে কুছ কালা হে। আজকে আসার পর থেকে দেখছি মুখে একগাদা মেকআপ লাগিয়ে ঘুড়ছিস, খাবার সময় আবার দেখলাম গাল ফোলা, এখন আবার হাসছিস কাহিনী কি বল তো!”
আমায়রা মুচকি হেসে বলল,
“ডাল মে কুছ লালা নীলা নেহি হে। ভাবছিলাম কিভাবে মানুষরে বিপদে ফেলা যায়। তুমি বুঝবে বন্যা আপু। এখন ঘুমাও তো রাত হয়েছে অনেক।”
বলেই কাথা মুড়ি দিয়ে চোখ বুজলো আমায়রা। বন্যা কি বলবে বুঝতে পারলো। আসার পর থেকে দুইভাই বোন মিলে কাহিনী শুরু করেছে। কিছুই বুঝতে পারছেনা। শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো বন্যা।
——————————-
রায়ান সবার সঙ্গে খাবার খেয়ে নিজের রুমে আসলো। বুকশেল্ফ থেকে “Gone girl” নামক ইংলিশ উপন্যাসের বইটা নিয়ে বিছানায় গেল। রুমের বড় লাইটটা অফ করে টেবিল লাইটটা জ্বালালো। বিছানায় উল্টো হয়ে শুয়ে বই পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগল। তিন পৃষ্ঠা শেষ করে চতুর্থ পৃষ্ঠায় যেতে নিবে তখনি ফোনের নটিফিকেশনের শব্দে কপাল কুচকে এলো রায়ানের। তবুও সেদিকে না তাকিয়ে অ্যামি আর নিকের কাহিনী মন দিয়ে পড়তে লাগল সে। কিন্তু নটিফিকেশনের শব্দ যেন ক্রমেই বাড়ছে। রায়ান একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নিলো সাইলেন্ট করতে।
কিন্তু ফোনের দিকে তাকাতেই কপাল কুচকে গেল তার। একটা অপরিচিত আইডি থেকে তার সকল ছবিতে হাহা দেওয়া হয়েছে।
রায়ান বইয়ের পৃষ্ঠাটা ভাঁজ করে বইটা বন্ধ করে ফেসবুকে ঢুকলো। আইডির নাম দেখে রায়ানের কুচকে যাওয়া কপাল যেন আরো কুচকে গেল। নিজ মনেই বিরবিরিয়ে আইডিটার নাম পড়লো,
“তোর যম”
দেখেই বোঝা যাচ্ছে কেউ ফাতরামি করেছে। রায়ান ভাবলেশহীন ভাবে ব্লক করে দিলো আইডিটা। ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো পাশে। বইটা টেনে আবারো পড়া শুরু করলো।
————————
অনুভব রাতের খাবার শেষ করে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বারান্দায় চলে এলো। চোখগুলো জ্বলছে তার। বন্যাকে সে অনেক আগে থেকেই একতরফা ভালোবেসেছে। রাকিবের সঙ্গে বন্যার বলা সব কথাই তার কানে এসেছে। না চাইতে বুকের মাঝে তোলপাড় শুরু হয়েছে। একরাশ খারাপ লাগা এসে ভর করেছে মনের মাঝে।
অনুভব বারান্দার রেলিং ঘেষে বসলো। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। আকাশে মেঘ থাকায় চাঁদ তারার মেলা নেই। অনুভবের মনের মতোই যেন আজ সবকিছু বিষন্ন। একতরফা ভালোবাসা এমন কেন!তিলে তিলে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটায়। একবারে শেষ করে দিলেই তো পারে। প্রিয়তমা কিছুদিন পর তার প্রিয়তমকে বিয়ে করে তার সামনে সামনে ঘুড়বে। না পারবে কিছু বলতে না পারবে কিছু সইতে।
ইকবাল সাহেব বরাবরই অনুভবকে পছন্দ করেন না। তার কারণ একটাই অনুভব মাস্টার্স পাশ বেকার। তারউপর বিসিএস দিবেনা। সরকারি চাকরী করবে না। যেখানে এমনিতেই পছন্দ করে না সেখানে মেয়ের জামাইয়ের কথা উঠলে তো কথাই নেই। তারউপর যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে সে সরকারি চাকরী করে। সবচেয়ে বড় কথা বন্যার ভালোবাসা। সে নাহয় ভালো নাই থাকলো তার ভালোবাসা ভালো থাক। ভেবেই পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনুভব। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো ঘন্টার পর ঘন্টা। নিজ মনেই বিরবিরালো,
“অন্তরের নীরব ভালোবাসা তোমাকে দিলাম প্রিয়। তুমি না হয় করলে অবহেলা তাতে কি। আমি তো দিয়েছি তোমায় ফুল নিজের জন্য বেঁছে নিয়েছি কাঁটা।”
রাত গভীর হলে আমায়রা, বন্যা সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। তবে অনুভবের চোখে তখনও ঘুম নেই।
বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করে। মনটাকে শান্ত করতে একটু হাঁটার জন্য সে বাইরে বেরিয়ে যায়। একা একা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকে,যে ভালোবাসার কোনো প্রতিদান নেই, তাতে এত কষ্ট কেন?
——————
রায়ান বইটা পড়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছে। সকাল সকাল দরজায় কড়াঘাত হওয়ায় ঘুমের মাঝেই চোখমুখ কুচকে গেল তার। দরজার অপরপাশ থেকে রায়ানের বাবা তাজওয়ার চৌধুরী রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“ইশতিয়াক ঘুম থেকে উঠো। কথা আছে তোমার সাথে।”
বাবার কন্ঠ পেয়ে বেডসাইট টেবিল হাতরে চশমাটা নিয়ে চোখে এটে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজা খুলতেই তাজওয়ার সাহেব রুমে এসে বললেন,
“তোমার নাকি মাস্টার্সের শেষ পরীক্ষা কিছুদিন পর।”
রায়ান ঘুম জড়ানো গলায় বলল,
“হুম আব্বু আর দশদিন পর।”
“ওও ভালো কথা পড়াশোনায় মনোযোগ দেও। অফিস সামলাতে হবে তোমার। তোমার বড়ভাই একাহাতে সব সামলায়। বাড়িতে ঠিকমতো সময় দিতে পারে না। তোমার চাচ্চু অসুস্থ, আমারো বয়স হচ্ছে।”
“আব্বু পরীক্ষাটা শেষ হলে আমি চেষ্টা করবো।”
রায়ানের কথায় তাজওয়ার সাহেব মুচকি হাসলেন। রায়ানের পিঠ চাপড়ে বললেন,
“এই ইশতিয়াককেই তো আমি চাই।”
তখনি রুমে প্রবেশ করলো রায়ানের বড়ভাই তাহসান নূরকে কোলে নিয়ে। নূরের হাতে চকলেট। সে তাহসানের গলা আকড়ে আছে। কিছুতেই বাবাকে সে অফিস যেতে দিবে না। রায়ান বুঝতে পেরে মুচকি হেসে নূরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“আম্মু তুমি আমার কাছে আসো। বাবা চকলেট আনতে যাবে তো।”
নূর ঠোঁট উল্টে আরো শক্ত করে ধরলো বাবাকে। তাহসান অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো রায়ানের দিকে। রোদেলা এসে নূরকে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলোনা নূর কান্না করে দিলো।
তাজওয়ার সাহেব এগিয়ে এসে নূরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তাহসান, আজকে দুপুরের পর অফিস এসো। চারটায় একটা মিটিং আছে।”
“কিন্তু,আব্বু!”
“কোনো কিন্তু না থাকো নূরের কাছে।”
নূর কান্নার মাঝেই হাসলো। তাজওয়ার সাহেব নাতনির কপালে চুমু খেয়ে অফিসে চলে গেলে।
তাহসান নূরকে নিয়ে রুমে চলে গেল। রোদেলাও পিছু পিছু গেল। রায়ান মুচকি হাসলো। ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। আজ ভার্সিটি যাবে সে।
—————–
আমায়রা আজ সকাল থেকে তড়িঘড়ি করে রেডি হচ্ছে। আজ সকালে তার ক্লাস আছে ভুলেই গেছিলো সে।
বন্যারা সকালবেলাই চলে গেছে আমায়রার আরেক চাচার বাড়ি। অনুভব বাসায় ফিরেছে একটু আগে। আমায়রাকে তড়িঘড়ি করে বের হতে দেখে অনুভব বলল,
“ভার্সিটি যাচ্ছিস?”
আমায়রা জুতা পড়তে পড়তে বলল,
“হুম লেট হয়ে গেছে আজকে।”
অনুভব এগিয়ে গিয়ে বলল,
“চল বাইকে করে তোকে দিয়ে আসি তাড়াতাড়ি হবে।”
আমায়রা মুচকি হাসলো। আমেনা বেগম অনুভবকে বলল,
“তাড়াতাড়ি ফিরিস। নাস্তা খাসনি এখনো।”
“আচ্ছা”
আমায়রা অনুভবের বাইকে উঠে বসলো। অনুভব বাইক চালাতে শুরু করলো।
কিছুপথ যেতেই আমায়রা নরম গলায় বলল,
“ভাইয়া একটা প্রশ্ন জিঙ্গাসা করি?”
অনুভব হেসে বলল,
“তুই আবার কবে থেকে আমাকে জিঙ্গাসা করে কথা বলা শুরু করলি!”
আমায়রা ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভাইয়া আমি কিন্তু সিরিয়াস।”
অনুভব হেসেই বলল,
“আচ্ছা বাবা বল কি বলবি?”
আমায়রা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“বন্যা আপুকে তুমি ভালোবাসো তাইনা!”
আমায়রার কথায় অনুভবের হাসি মিলিয়ে গেল তবুও স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ধুর, আমি কেন ওকে ভালোবাসতে যাবো। তুইও না।”
আমায়রা লুকিং গ্লাসে অনুভবের মলিন মুখটা দেখে মৃদু হেসে বলল,
“মিথ্যা বলছো ভাইয়া।”
#চলবে