অতল গহ্বরে নীরবতা পর্ব-২৭+২৮

0
341

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২৭

রায়ানের কথাগুলো শুনে একরাশ ভালো লাগা কাজ করে গেল আমায়রার মনে। আমায়রা মুগ্ধ চোখে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান আলতো হেসে সামনে তাকিয়ে বলল,
“যমরানী এভাবে তাকিয়ো না। তোমার যমরাজের বুকে লাগে যে। মন চায়…,”

আমায়রা রায়ানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“দয়া করে চুপ করুন।”

নেহা রায়ানের সামনে এসে দাঁড়ালো। রায়ান ওর দিকে না তাকিয়েই আবিরকে বলল,
“আবির দেখ তো তোর বোন কি বলবে?”

নেহা ঝটপট বলে উঠলো,
“ধন্যবাদ রায়ান ভাই।”

নেহা কথা শুনে আবির আর রায়ান ভ্রুকুচকে তাকালো নেহার দিকে। নেহাকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। আবির নেহার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
“কিরে নেহা তোর মতিগতি তো ভালো ঠেকছে না?”

নেহা আবিরকে পাত্তা না দিয়ে বলল,
“রায়ান ভাই তাড়াতাড়ি বিয়ে করে অনেক ভালো কাজ করেছো। ভাবিও বেশ মিষ্টি হয়েছে।”

নেহার কথা শুনে বিষম উঠে গেল আবিরের। তাহসানও কেবলি এসে কথাটা শুনে মুখে থাকা কোকটা কুলি করে দিলো। রায়ান গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে নেহার দিকে। নেহা নাঁচতে নাঁচতে চলে গেল।

রায়ান সেদিকে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে বলল,
“আবির তোর বোনের দিকে নজর দে।”

“হ তাই দেওয়া লাগবে দেখছি। আমি বড় ভাই হইয়া প্রেমপ্রীতি করতে পারলামনা। আর আমার ছোটবোন হইয়া। ইহা মহা অপরাধ।”

তাহসান আবিরের মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“বড় ভাইদের সামনে এগুলো বলতে লজ্জা লাগে না।”

আবির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,
“আরেক বড় ভাই বলছে লজ্জা সরম করলে জীবনে উন্নতি করা যায়না। ছেলেদের নাকি লজ্জা থাকা উচিত না।”

তাহসান হতাশার শ্বাস টেনে বলল,
“তোদের সঙ্গে আর পারলামনা। দুটোই এক।”

আবির নিজ মনেই বিরবিরালো,
“এক হতে যাবো কোন দুঃখে। ওই খারুশ পোলার মতো আমি জীবনেও না। আমি কত ভালো একটা ছেলে।”

———————

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে বাজে রাত আটটা। রায়ান আর আবির কালো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছে তাদের আস্তানা থেকে। দুইজনের গায়েই কালো হুডি। আবির ড্রাইভিং করছে। আর রায়ান পাশের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। আবির আড়চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি চালানোতে মন দিলো।

রায়ান গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“নজরুল ছাড়া পেলো কিভাবে?”

আবির ঢোক গিললো। রায়ানের কন্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে সে প্রচন্ড রেগে আছে। আবির আমতা আমতা করে বলল,
“মানে স্যার, মানে ভাই”

রায়ান চোখ বুজেই বলল,
“আস্তানায় নেই এখন। ভাই বলেই ডাক। আর আমতা আমতা না করে বল।”

আবির জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“নজরুলের কিছু লোক এসে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছে।”

রায়ান গাড়ির সামনের জায়গাটায় বারি দিয়ে বলল,
“কিভাবে পারলো ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। তোর লোকেরা কি করে? বসে বসে কি আঙ্গুল চোসে।”

আবির ভীতু কন্ঠে বলে উঠলো,
“আসলে নজরুলকে ছাড়ানোর পিছনে সবচেয়ে বড় হাত এখানকার এমপি রাজ্জাকের। সেই টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিছে।”

রায়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ওই মহিলা কিছু বলেছে?”

“না ভাই ওই মহিলা তো কিছুতেই মুখ খুলছে না।”

“ওর বখাটে ছেলে আছে না?”

“হুম আছে তো কলেজের সামনে মেয়েদের বিরক্ত করে।”

“ওরে তুলে নিয়ে আয়। পরবর্তী ব্যবস্থা আমি করছি।”

“ভাই বাসার সামনে এসে পরেছি।”

রায়ান তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
“তুমি গাড়ি পার্কিং করে একটু পরে আয়। আর হুডি গাড়িতেই খুলে রাখ। বাসায় লোকজন আছে সমস্যা হতে পারে। আর সাবধান তোর ভাবি যেন কোনোমতেই সন্দেহ না করে। এমনিতে গাড়ি দেখে চিনে ফেলছে। আমি কোনোমতে সামলে নিয়েছি।”

কথাগুলো বলেই হুডি খুলে পাশে রাখলো। ভিতরের টিশার্টটাও খুলে আবারো আকাশী রঙের পাঞ্জাবীটা গায়ে দিলো। নিজেকে ঠিকঠাক করে নেমে পরলো গাড়ি থেকে।

রায়ান চলে যেতেই আবির বিরবিরিয়ে বলল,
“আরে ব্যাটা বিটকেল সন্দেহ কি আমি ঢুকিয়েছি তোর বউয়ের মনে। শালা তুইই তো শশুরবাড়ি সামনে গাড়ি নিয়ে বসে থাকতি। তখন মনে ছিলো না বলদের ঘরের বলদ।”
—————

বসার ঘরে বসে সবাই গল্প করছিলো আমায়রাকে মাঝে বসিয়ে। বড়রা ছাড়া সব ছোটরাই আছে। অনুভব আর আমায়রার বাবা-মা বিকালেই চলে গেছেন। রায়ান তাদের বিদায় দিয়েই বের হয়েছিলো। বন্যা, রাকিব, সুরাইয়া, সুমন ওরা সবাই থেকে গেছে।

রায়ান ভ্রুকুচকে আমায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। আমায়রা হেসে হেসে কথা বলছে সবার সাথে। রায়ান নিজ মনেই বিরবিরালো,
“আমার সাথে তো এমন হেসে হেসে কথা বলে। ছুটে আসে ঝগড়া করতে। আর সবার সাথে কি সুন্দর হেসে হেসে কথা বলছে। ঢং দেখলে শিরা উপশিরা তরতর করে কাঁপে।”

কথা বলতে বলতেই নাইমার চোখ পরলো রায়ানের উপর। রায়ান দূরে দাঁড়িয়ে কিযেন বিরবির করছে। নাইমা রায়ানকে ডেকে বলল,
“এই রায়ান দূরে দাঁড়িয়ে কি বিরবির করছো? এখানে আসো। আর এতক্ষন কোথায় ছিলে শুনি।”

রায়ান নিজের ভাবনাকে আকাশের মেঘের সাথে উড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
“ক্ষুধা পেয়েছে ভাবি খেতে দেও। বন্ধুদের এগিয়ে দিতে গিয়ে দেড়ি হয়ে গেছে।”

তাহসান ভ্রুকুচকে বলল,
“তাই বলে রাত নয়টা। বড়রা খেয়ে শুয়ে পরেছে। আবির গাধা কোথায়?”

আবির কেবলি মেইন দরজা দিয়ে ঢুকছিলো তাহসানের উক্ত কথা শুনে নাকমুখ কুচকে আবির বলল,
“তাহসান ভাই ভালো হবে না বলে দিলাম।”

তাহসান পাত্তাই দিলো আবিরের কথায়। আবির নাইমার কাছে এসে বলল,
“ভাবি দেখো ভাইয়া কেমন করছে!”

নাইমা তাহসানে দিকে চোখ রাঙিয়ে বলল,
“চলো খেতে চলো।”

আবির মুখ বাঁকিয়ে হাসলো। তাহসান ভেংচি কাটলো। রায়ান আমায়রার দিকে তাকিয়ে আছে। আমায়রা নূরকে নিয়ে ব্যস্ত। রায়ানের বেশ হিংসা হলো নূরের উপর। রায়ান হুট করে আমায়রার হাত থেকে নূরকে কেড়ে কোলে তুলে নিলো। আমায়রা খানিকক্ষণ আগে যে গালে চুমু খেয়েছিলো। তা হাত দিয়ে মুছে দিলো। নূর ভ্রুকুচকে তাকালো রায়ানের দিকে। রায়ান আলতো হেসে বলল,
“আম্মু তোমার গালে ময়লা ছিলো।”

নূর একগাল হেসে রায়ানের গলা জড়িয়ে বলল,
“চাচ্ছু চকলেট খাবো।”

রায়ান সরু চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আম্মু সকালে কে যেন আমার রাখা চকলেট থেকে দুটো চকলেট নিয়ে খেয়েছে। তুমি কি জানো?”

নূর না জানার ভাব ধরে বলল,
“কে নিলো বলো তো চাচ্চু?”

রায়ান নূরের নাক টেনে বলল,
“আম্মু আমি কিন্তু দেখেছি কে নিয়েছি?”

নূর হেসে রায়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো। রায়ান ও আলতো হাসলো।

রাতের খাওয়া শেষ করে নিচের রুমের বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে ফোন টিচছে রায়ান। বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে দরজার দিকে। না আমায়রা তো আসছে না। গেল কোথায়। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আর ওইদিকে মহারানীর থুক্কু যমরানীর আসারই নাম নেই।

রায়ানের ভাবনার মাঝেই আমায়রা রুমে আসলো। রায়ান আড়চোখে দেখে ফোন টিপায় মন দিলো। আমায়রা চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রায়ান রাশভারী কন্ঠে বলে উঠলো,
“এটা কোনো নাটক বা সিনেমা নয় যে বিয়ের পরে আমি সোফায় শুয়ে পরবো না হয় তুমি সোফাতে শুয়ে পরবে। ঠান্ডাও পরেছে। তাই এতকিছু না ভেবে লাইট অফ করে বিছানায় আসো।”

আমায়রার বুক ধুকপুক করছে। ঠিকি তো ঠান্ডা পরেছে। সোফায় তো সে ভাবে শুয়ে পরতে পারবেনা। আর শুয়ে পরলেও ঘুম হবেনা ঠান্ডায়। বারান্দার দরজার খোলা অংশ থেকে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করছে রুমে। যা এক হামশীতল পরিবেশ তৈরী করেছে।

আমায়রা ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে লাইট অফ করে দিলো। ড্রিম লাইটের ক্ষীণ আলোতে রুমের সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। বারান্দার দরজা বন্ধ করতে যাবে তার আগেই রায়ান বলে উঠলো,
“খোলা থাক।”

আমায়রা রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ঠান্ডা বাতাস আসছে তো।”

“আসুক”
আমায়রা রায়ানের কথা না শুনেই থাই গ্লাস টেনে দিয়ে তার উপরে সাদা পর্দা টেনে দিলো। আমায়রার পরনে এখন রায়ানের দেওয়া সেই সাদা সালোয়ার কামিজ। আমায়রা ওড়নাটা ঠিক করে বেডে গিয়ে একসাইটে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো।

রায়ান আলতো হাসলো। যা চোখে পরলো না আমায়রার। রায়ান কিছুক্ষন চিত হয়ে শুয়ে রইলো সিলিং এর দিকে তাকিয়ে।

হুট করেই সে উঠে বসলো। পায়ের কাছে থাকা পাতলা কম্বলের ভাঁজ খুলে নিজের গায়ে জড়িয়ে আবারো চিত হয়ে শুয়ে পরলো।

আমায়রা এখনো ঘুমায়নি। তারও ঠান্ডা লাগছে। আর এই লোক নিজের গায়েই কম্বল দিলো। কেন রে একটা নতুন কম্বল কি বের করে দেওয়া যেতনা।

আমায়রার ভাবনার মাঝেই হুট করে তার গায়ে কম্বল দিয়ে তার পেট বরাবরা হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো রায়ান। রায়ানের উষ্ণ নিশ্বাস বারি খাচ্ছে আমায়রার ঘাড়ে। আমায়রার গা শিউরে উঠলো। সে তেতে উঠে বলল,
“এগুলোর মানে কি?”

রায়ান ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“কোনগুলো কি বউ?”

আমায়রা রায়ানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
“ছাড়ুন আমায়”

রায়ান আমায়রার ঘাড়ে নাক গুজে দিয়ে বলল,
“ছাড়ার জন্য তো ধরিনি বউ।”

#চলবে

#অতল_গহ্বরে_নীরবতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২৮

আমায়রা চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস টেনে বলল,
“দেখুন আমাদের বিয়াটা কিন্তু আর চার পাঁচটা বিয়ের মতো হয়নি। আর আপনি কি মনে করেছেন একটা ছুরি এনে হাতে টান দিছেন বলেই আমি বিয়েতে রাজি হয়েছে।”

কিছুটে দমে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আমায়রা আবারো বলতে লাগল,
“আমি মেয়ে মানুষ জনাব। যতই সাহস দেখাইনা কেন, বাবার মুখের উপর না করতে পারিনা। যতই আপনি ভালো হন না কেন? সম্পর্কে একটা বোঝাপড়া দরকার। হুট করে বললাম আর হয়ে গেল এমনটাতো নয়।”

রায়ান চুপ করে শুনলো আমায়রার কথাগুলো। হুট করে আমায়রাকে টান দিয়ে নিজের দিকে ঘোরালো। আমায়রার চোখে চোখ রাখলো সে। ড্রিম লাইটের ক্ষীণ আলোতেই দুইজন দুইজনের দিকে তাকালো। রায়ান নরম গলায় বলল,
“দেখো মেয়ে বহুত পাঁকা পাঁকা কথা বলে ফেলেছো। বিয়েটা কেন করেছি, কেন করলাম সবটা না হয় না জানাই রইলো। কিন্তু এটা ভুলে যেও না আমি আইনগত ভাবে বলো আর ধর্মীয় ভাবে বলো সবদিক দিয়েই তোর একমাত্র বর। তুমি আমাকে চাও বা না চাও। আমি তোমাকে চাই মানে চাই। এই রায়ান ইশতিয়াক চৌধুরী যা চায় তাই পায়।”

আমায়রা তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে রেখেই বলল,
“ভালোবাসাটাও কি জোর করে হয়। আচ্ছা আপনি কি আমায় ভালোবাসেন?”

রায়ান আমায়রার কথায় চুপ করে গেল। সত্যি কি সে আমায়রাকে ভালোবাসে? রায়ানকে চুপ থাকতে দেখে আমায়রা হাসলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এটা আপনার মোহ। কয়েকদিন পর শেষ হয়ে যাবে ছুড়ে ফেলে দিবেন।”

রায়ান আমায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“ছাড়ার জন্য ধরিনি। ধরেছি যখন আগলে রাখার দায়িত্ব আমার। তাই বলছি চুপচাপ যা হচ্ছে তা হতে দেও।”

আমায়রার দম বন্ধ লাগছে এভাবে থাকতে। রায়ানের বুকে ধাক্কা দিতে দিতে আমায়রা বলল,
“ছাড়ুন আমাকে আমার দম বন্ধ লাগছে।”

রায়ান না ছেড়েই চুপ করে রইলো। আমায়রা অনেকক্ষন ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতে করতে হাঁপিয়ে দিয়ে চুপচাপ রায়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকলো। রায়ানের হৃদস্পন্দন কানে আসছে আমায়রার। আমায়রাকে চুপ করে যেতে দেখে হাসলো রায়ান। আমায়রার অগোচরে তার চুলের ভাঁজে একটা চুমু খেলো রায়ান। চোখ বুজ ফেলল সে।

আমায়রাও বেশকিছু সময় রায়ানের হৃদস্পন্দন শুনে ঘুমিয়ে পরলো।

——————

সকালের ক্ষীণ আলো সাদা পর্দা ভেদ করে চোখে পরতেই ঘুম ভেঙে গেল রায়ানের। চোখ পিটপিট করে তাকাতেই বুকের উপরে ভারী কিছু অনুভব হতেই কপালে ভাঁজ ফেলে তাকাতেই আমায়রাকে দেখতে পেল। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। রায়ান নিজ মনেই ব্যঙ্গ করে বলল,
“এই নাকি তার দম বন্ধ লাগে, বিরক্ত লাগে, মোহ, আবেগ ব্লা ব্লা এখন আবার নিজেই জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।”

রায়ান দুষ্টু হেসে ফোন বের করে পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। মনে মনে বলল,
“এই ছবি না দেখালে তো মিস থুক্কু মিসেস ঝগড়ুটে মানবেই না।”

রায়ান ছবি তুলে ফোনটা পাশে রেখেই আমায়রার চুলে হাত বোলাতে লাগল। এত গভীর ঘুমে মেয়েটা যেন কিছুই টের পাচ্ছে না।

হঠাৎ আমায়রার চোখের পাতা নড়ে উঠলো। একটু পরে আলস্য ভরা চোখ মেলে তাকাতেই রায়ানের দিকে পড়লো তার দৃষ্টি। কয়েক সেকেন্ডে যেন হাজারটা ভাবনা তার চোখে ছুটে গেল।

“আপনি…!”

আমায়রা প্রায় ফিসফিস করে বলল। নিজের অবস্থান বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ উঠে বসে চুল ঠিক করতে লাগল।

“আপনি এখানে… মানে আমি এখানে… এটা কীভাবে হলো?” কথাগুলো বলার সময় তার কন্ঠে স্পষ্ট অস্বস্তি।

রায়ান হেসে বলল,
“তোমার এত প্রশ্ন কেন, মিসেস ঝগড়ুটে? রাতটা তো শান্তিতেই কেটেছে, না?খুব তো ঘুমানোর আগে পকপক করছিলে। যে আমি ঘুমিয়ে গেছি আর তুমি…!”

আমায়রা লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে যেতে বলল, “আমি কিন্তু…।”

রায়ান তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি জানো, ঘুমের মধ্যে তুমি আমাকে কীভাবে ধরে রেখেছিলে?”

আমায়রা কপাল গুটিয়ে তাকাতেই রায়ান ফোনটা হাতে তুলে ছবিগুলো দেখিয়ে বলল,
“এগুলো দেখো, তারপর না হয় কথা বলো।”

ছবিগুলো দেখে আমায়রা ক্ষোভে ফেটে পড়ল। “আপনি এমন ছবি তুললেন কেন? ডিলিট করুন এখনি।”

রায়ান মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“করবোনা কি করবে তুমি?”

আমায়রা রায়ানের হাত থেকে ফোন নিতে যাবে তার আগেই রায়ান সেটা সরিয়ে ফেলল। আমায়রা গাল ফুলিয়ে আবারো চেষ্টা করলো। রায়ান ফোনটা বেড সাইড টেবিলে রেখে আমায়রার বাহু টেনে নিজের সামনে বসালো। তীক্ষ্ণচোখে আমায়রার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এমন করো কেন বউ? সকাল সকাল কোথায় বরকে একটু চুমুটুমু খাবে তা না। পাশের বাসার আন্টির মতো ঝগড়া করছো।”

আমায়রা বিরক্তি নিয়ে বলল,
“সকাল সকাল আপনার এমন নাটক ভালো লাগছে? ফোনটা দিন, আমি নিজেই ডিলিট করি।”

রায়ান ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি রেখে বলল,
“একটা শর্তে দিতে পারি।”

আমায়রা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“এবার আবার কী শর্ত?”

রায়ান বাঁকা হেসে বলল,
“চুমু দেও”

আমায়রা তেতে উঠে বলল,
“অসভ্য লোক একটা। লাগবেন ডিলিট করার। যা খুশি করেন।”

বলেই আমায়রা বেড থেকে নেমে গটগট পায়ে চলে গেল ওয়াশরুমে। হাসলো রায়ান।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়েও সোজা রুমের বাহিরে চলে গেল। রায়ান হাসতে হাসতে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। আজকে আস্তানায় কিছু কাজ আছে। সেগুলো শেষ করতে হবে। কাল আবার অফিস আছে।

—————

কালো রঙের হুডি, জিন্স, কালো স্নিকার্স পড়ে রায়ান একেবারে রেডি হয়ে নিচে নামলো। খাবার টেবিলে শাহানারা বেগম, তাজওয়ার সাহেব, নেহার বাবা, আবির, তাহসান বাদে সবাই আছে।

রায়ানকে রেডি হয়ে নামতে দেখে রাবেয়া বেগম বললেন,
“কিরে আজ তো শনিবার কোথায় যাচ্ছিস?”

রায়ান নরম গলায় চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল,
“আম্মু কিছু কাজ আছে।”

“ওই তো কি কাজ সেটাই তো শুনতে চাচ্ছি।”

রায়ান খাবার মুখে তুলে বলল,
“জানিনা আহাদের কি যেন কাজ আছে।”

রাবেয়া বেগম ছোট্ট করে বলল,
“ওও”

রায়ান খাওয়া শেষ করে বলল,
“আবির কোথায়?”

নেহা উত্তর দিলো,
“ভাইয়া এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।”

রায়ান আর দেড়ি না করে চটজলদি বড়বড় পা ফেলে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। আবিরের রুমের দরজা লাগানো ছিলোনা। রায়ান দরজায় হালকা ধাক্কা দিতেই দেখলো আবির কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। রায়ান তা দেখে বিরবির করতে করতে আবিরের রুমে ঢুকে পরলো। আবিরকে ঘুমন্ত অবস্থায় টেনে বসালো। আবির চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
“ভাই আর একটু”

রায়ান দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“অলরেডি দশমিনিট দেড়ি হয়ে গেছে।”

আবির হুট করেই চোখ খুলে ফেলল। চোখ বড়বড় করে তাকালো দেয়াল ঘড়ির দিকে। ঘড়িতে নয়টা দশ বাজে। আসলেই তো দেড়ি হয়ে গেছে।

আবির তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে গেল।

হুডি গায়ে জড়িয়ে নিচে নেমে কোনোমতে মুখে কিছু তুলে ছুট লাগলো। রায়ান গাড়িতেই বসে ছিলো। আবির এসে হাঁপাতে লাগল। রায়ান আড়চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে ফোন টিপতে লাগল। আবির গাড়ি চালাতে লাগল।

কিছুসময় পর তারা আস্তানায় পৌঁছে গেল। ডানপাশের একটা রুমে ঢুকে দেখলো অনেকগুলো যুবক একসঙ্গে কম্পিউটারে কাজ করছে। রায়ান আসতেই সবাই দাঁড়িয়ে গেল। রায়ান হাতের ইশারায় সবাইকে বসতে বলল। নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ারে গিয়ে বসে পরলো সে।

আবির ওর পাশের চেয়ার টেনে বসলো। রায়ান গম্ভীর গলায় বলতে লাগল,
“যেহেতু আমরা সাইবার ক্রাইম দমনের জন্য নিজ উদ্যোগে কাজ করছি সেহেতু গোপনেই কাজ করতে হবে আপনাদের সবাইকে। এর আগে হয়তো আপনাদের জানানো হয়ে থাকতে পারে। তবুও আমি বলে দিলাম। আপনাদের যাদের কম্পিউটারের উপরে অভিজ্ঞতা আছে আর যাদের সমাজসেবা করতে ভালো লাগে তাদের দিয়েই এই কাজটা করানো হচ্ছে। আর কোনো সমস্যা হলে আপনারা আবিরকে দেখাতে পারেন। ও সমাধান করে দিবে। আর আপনাদের প্রথম কাজ হলো অনলাইনের প্রতারক যারা মেয়েদের ব্লাকমেল করে টাকা নেয় তাদের লিস্ট তৈরি করা। লিস্ট করে আবিরের হাতে দিবেন। ধন্যবাদ সবাইকে। বাকি কথা আপনাদের আবির বুঝিয়ে দিবে।”

আবির মুখ বাঁকিয়ে বিরবির করে বলল,
“আবির এই করবে সেই করবে কেন আমিই কেন সব করবো? আমারে সব কাম দিয়ে নিজে বউয়ের লগে ভালোবাসার কথা বলবে। টুরু লাভ,ঢং যতসব।”

রায়ান আবিরকে একসাইডে নিয়ে এসে বলল,
“আহাদ আর ইয়াসিন আমাকে ডাকছে। তুই এইদিকটা সামলে নে আমি যাই তাহলে।”

আবির জোরপূর্বক বলল,
“আচ্ছা”

রায়ান মুচকি হেসে আবিরের পিঠ চাপড়ে চলে গেল। আবির রায়ানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নিজ মনে রায়ানের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগল।

#চলবে