#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ১৯
বিকেলের দিকে বৃষ্টিটা থেমে আকাশে আবার রোদও উঠেছে।নুসফার বাপের বাড়িতে এসেছে নিলয়ের সাথে।মিলিকেও নিয়ে এসেছে শাহ বাড়িতে। সকাল দশটার দিকে এসেছিলো।মিলি সারাটাদিন নুজাইশের জন্যই অপেক্ষা করেছে।আজ ভার্সিটি যাওয়া হয় নি। সারাদিন তার জন্য ঠিক করা রুমে বসে বারান্দা থেকে গেইটের দিকে তাকিয়ে ছিলো।তার রুমটা নুজাইশের রুমের বিপরীত পাশে।এখন বিকেল চারটা বাজলো।তাও কেন আসছে না এই নিয়ে চিন্তা করছে।তখনই গাড়ির আওয়াজ শুনলো।বারান্দায় গিয়ে দেখলো নুজাইশের কালো গাড়িটা।মিলি তো মহাখুশি।তাড়াতাড়ি রুমে গিয়ে নিজেকে আয়নায় ঠিকঠাক আছে কিনা একবার দেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।সিড়ির কাছে গিয়ে নিচে উঁকি দেয়।নুজাইশ শার্টের টপ দুইটা বোতাম খুলে উপরেই উঠে আসছে।মিলিও একটা বড় শ্বাস ফেলে নিচে নামার প্রস্তুতি নেয়। নুজাইশ একমনেই উপরে উঠে আসছিলো সামনে থেকে কাউকে নামতে দেখে তাকালো।আর মিলিকে দেখেই অবাক হলো আর জিজ্ঞাসা করলো,
“তুমি এখানে?”
মিলি হতচকালো,
“ভাইয়া আর ভাবীর সাথে এসেছি।”
নুজাইশ ভ্রু কুঁচকে বললো,
“ভার্সিটি যাও নি কেন আজ?তোমরা এতো ক্লাস মিস দাও কেন?”
“আসলে আগামীকাল থেকে যাব।”
নুজাইশ আর কিছু বললো না উপরে উঠে চলে গেলো।পেছনে মিলি নুজাইশের যাওয়ার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো। নুসফার রুম থেকে বেরিয়ে এসে মিলিকে সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।কাছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো,
“মিলি তুমি এখানে কি করছো?”
মিলি হেসে বললো,
“কিছু না ভাবী।নিচে যাচ্ছিলাম।তোমাদের বাড়ির বাগানটা দেখার জন্য।”
“ঠিক আছে চলো আমি তোমায় নিয়ে যায়।”
মিলিও রাজী হলো।নিচে আসতেই নুসফারের মা আবিদা বেগম তাদের দুজনকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কোথায় যাচ্ছিস তোরা?”
নুসফার জবাবে বললো,
“মিলিকে আমাদের বাড়ির বাগানটা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।”
আবিদা বেগম মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“একা বোর হচ্ছো বুঝি?একা লাগলে আমার সাথে গল্প করতে চলে এসো মা।”
মিলি মিষ্টি হেসে মাথা নাড়লো।নুসফার আর মিলি চলে গেলো।মিলিকে খুবই পছন্দ করেছেন আবিদা বেগম।কি অমায়িক আর ভদ্র মেয়েটা।মনে মনে ভাবলেন ছেলের বউ হলে খুব একটা খারাপ হবে না।কথাটা মাথায় আসতেই স্বামীর কাছে গেলেন। নওয়াজ শাহ স্টাডি রুমে ইজি চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন।রাজনীতিবিদ হয়েও বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি।আজ শরীর খারাপ থাকায় পার্টি অফিসে যান নি।আবিদা বেগম যেতেই নওয়াজ শাহ স্ত্রীর দিকে একপলক তাকিয়ে আবারও বই পড়ায় মনোযোগ দিলেন।আবিদা বেগম স্বামীর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। গলা ঝেড়ে কেঁশে বললেন,
“শোনো আমি একটা কথা ভাবছি।”
নওয়াজ শাহ বই পড়তে পড়তেই বললেন,
“বলে ফেলো আবার কি জগাখিচুড়ি ভাবনা ভাবছো?”
আবিদা বেগম মুখ ফুলালেন,
“যাও তোমাকে আমি বলবোই না।আমি গেলাম।”
নওয়াজ শাহ বইটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন।চশমাটা খুলে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। নওয়াজ শাহ খুবই মজার মানুষ।স্ত্রীর সাথে মাঝেসাঝে মজা করতে ভালোবাসেন। আবিদা বেগম মুখ ভেংচে চলে যেতে নিলেই নওয়াজ শাহ বললেন,
“বাপের বাড়ি চলে গেলে আমাদের জন্য রান্নাবান্নাটাও করে দিয়ে যেও।”
বলেই হাসলেন।আবিদা বেগম ফুঁসে উঠলেন।রাগী চোখে তাকালেন স্বামীর পানে।স্বামীর ঠোঁটে হাসি দেখে আরও বেশি রেগে গেলেন।মুখ ঝামটা মেরে বের হতেই যাবেন তখনই নওয়াজ শাহ বললেন,
“এই শোনো গিন্নি, যাওয়া আগে কথাটা বলে যাও।”
আবিদা বেগম থেমে স্বামীর দিকে তাকিয়ে দাত কিড়মিড় করে উত্তর দিলেন,
“তোমায় আর কোনো কথায় বলবো না।আজই বাপের বাড়ির চলে যাব আমি।”
নওয়াজ শাহ হেসে বললেন,
“বউ তোমার জন্য একটা ডায়মন্ডের রিং অর্ডার করে রেখেছি।সামনে তো তোমার জন্মদিন তাই না?যেহেতু তুমি চলেই যাচ্ছো তাহলে অর্ডার ক্যান্সেল করে দেবো।”
থেমে গেলেন আবিদা বেগম।পেছন ফিরে স্বামীর দিকে তাকালেন।কাছে গিয়ে বললেন,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না।যেসব কথা বলার জন্য এসেছি তা শোনো।”
অরএচহি
মনে মনে হাসলেন নওয়াজ শাহ।স্ত্রীকে তিনি ভীষণ রকম ভালোবাসেন।আবিদা বেগম রসিয়ে বলা শুরু করলেন,
“পাত্রী ঠিক করে রেখেছি।”
চমকে গেলেন নওয়াজ শাহ।এসব কেমন কথাবার্তা।চোখ বড় বড় করে বললেন,
“পাগল হয়ে গেছো তুমি?এই বয়সে আমি আবার বিয়ে করবো?অবশ্য তুমি যদি রাজী থাকো করাও যায়।”
“বাজে বকা বন্ধ করো।শখ কতো বুড়ো বয়সে।তোমার ছেলের জন্য পাত্রী ঠিক করেছি।”
“ওহ আচ্ছা নুজাইশের জন্য?তা কাকে পছন্দ করলে?তোমার ছেলে যে পরিমাণ ঘাড়ত্যাড়া, সে কি রাজী হবে?”
“ও রাজী হবে না ওর বাপ রাজী হবে।”
“হ্যা আমি তো রাজীই।”
“আবারও বাজে বকছো?শোনো নিলয় বাবার চাচাতো বোনটা আছে না?ওইযে কি নাম মিলি! মেয়েটার ব্যবহার কি সুন্দর, চেহারাও তো মাশাআল্লাহ।মেয়েটাকে আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।আমি চাইছি দুজনের বিয়ে দিতে।একটা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হোক দুজনে।কত মানাবে দুজনকে।”
নওয়াজ শাহ বললেন,
“মিলি মেয়েটাকে তো আমারও ভালো লাগে।ভীষণ ভালো একটা মেয়ে।তবে মেয়ে কি তোমার ওই ভেড়ার মতো ছেলেকে পছন্দ করবে?তোমার ছেলে তো বিদেশী ব্রয়লার মুরগি।”
ছেলের বিপক্ষে কথা বলায় রেগে গেলেন আবিদা বেগম,
“আমার ছেলে কম কিসে?আমার ছেলের জন্য কতো মেয়ে পাগল।একদম আমার ছেলের ব্যাপারে উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।”
“হ্যা তাইতো।দেখো কি হয়?কথা বলে দেখো।তোমার ওই বিদেশী গৃহপালিত গরুটাকে বিয়ের জন্য মিলি রাজী হয় কিনা?”
আবিদা বেগম চোখ রাঙিয়ে চলে গেলেন।
.
ঝলমলে রোদ দেখে মনে হচ্ছে না আজ বৃষ্টি পড়েছে।তবে বাইরের গাছপালা আর ভেজামাটি দেখে বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টি হয়েছে। খান বাড়ির প্রতিটি সদস্য এখন রেডি হতে ব্যস্ত।একটু পর সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হবে।কিছুদিন থেকে তারপর এসে পড়বে। তবে বাড়ির কর্তারা দুদিন কিংবা একদিন পরই চলে আসবে অফিসের কাজে।মেহরানেরও ফিরে আসার সম্ভাবনাই বেশি।
তাজবির দৌঁড়ে নিচে নেমে আসলো।একদম ফিটফাট রেডি সে।রাউশি তো সবার আগেই রেডি হয়ে সোফায় বসে বসে কফি খাচ্ছে। বাড়ির কর্ত্রীদের রেডি হতে সময় লাগবে। সিলেট তো নয় যেনো বিয়েবাড়িতে যাবে এই সাজ দিতেই তো ঘণ্টাদেড়েক সময় লাগবে। এর মধ্যে এক মগ গরম কফি না শুধু দুই মগও খাওয়া শেষ হবে।রাউশি ধোঁয়া উড়তে থাকা গরম কফির মগে চুমুক দিয়েই দেখে মেহরান সিড়ি বেয়ে নামছে।কফির মগটা ঠোঁটের কাছটাই ধরে রেখেই তাকিয়ে দেখে বাদামী রঙের একটি শার্ট আর কালো রঙের একটি জিন্স পরিহিত মেহরানকে।চুলগুলো আগের মতোই গুছিয়ে রাখা তবে কপালে কিছু কিছু চুল পড়ে আছে।চোখে আবার কালো চশমাও দিয়েছে।শার্টের টপ দুইটা বোতাম খোলা থাকায় হালকা লোমশ বুক দেখা যাচ্ছে।শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে নিচে নামছে।চশমার জন্য বোঝা গেলো না দৃষ্টি কোনদিকে।তবে রাউশির দৃষ্টি তারই দিকে।ঢোক গিললো রাউশি।নির্লজ্জ চোখগুলো গিয়ে বারবার বুকের কাছটাই দেখতে ব্যস্ত যেন।নিজের চোখ খুব কষ্টে সংযত রেখে পাশে বসে টিভি দেখতে থাকা তাজবিরের দিকে তাকালো।বড় একটা শ্বাস ফেলে ঠিক করলো আজ আর একটুও এই লোকের দিকে তাকাবেনা।আড়চোখে একবার তাকালে সিড়ির দিকে কিন্তু মেহরানকে আর দেখতে পেলো না।মনে মনে ভাবলো লোকটা গেলো কোথায়?তখনই মেহরান রাউশির পাশে এসে বসলো আর রাউশির চুমুক দেওয়া কফি মগে নিজেও এক চুমুক দিলো।রাউশি শুধু চোখ বড় বড় করেই তাকিয়ে রইলো।তাজবিরও দেখলো সেটা।আর বললো,
“এই ভাইয়া তুমি রাউশিপুর এঁটো কফি খেলে?”
মেহরান গম্ভীর গলায় সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো,
“নিজের মানুষের খাওয়াটা খেয়েছি সমস্যা কোথায়?”
তাজবির বুঝলো না কিছু বরং টিভি দেখায় মন দিলো।আশেপাশে আর কেউ নেই।তাজবিরও টিভি দেখায় ব্যস্ত।রাউশি ভুলেও মেহরানের দিকে তাকাচ্ছে না।সেও একনজরে টিভির দিকেই তাকিয়ে আছে।টিভিতে ডোরেমন চলছে।মেহরান রাউশির গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,
“বিয়ের পর সারাদিন সারারাত তাকিয়ে থাকিস।আপাতত আমি একটা ব্যাচেলর হ্যান্ডসাম পুরুষ চোখ দিয়ে নজর লাগানো বন্ধ কর।আমার হবু স্ত্রী মৌরিন খান রাউশির জিনিস তো আর কাউকে দেখাতে পারি না।”
কথাটুকু বলেই চলে গেলো মেহরান।রাউশি হতবাক,নির্বাক ভূমিকা পালন করলো।ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গালে হাত দিয়েই বসে রইলো।আর মনে মনে বললো ‘ব্যাটা তুইও তো তাকিয়ে ছিলি।’তানিয়া খোশমেজাজে উপর থেকে নেমে এলো।মেয়েটা চোখে চশমা পড়েছে।রাউশির পাশে বসতেই রাউশি তানিয়ার কালো চশমাটা কেড়ে নিয়ে নিজে পড়লো।তানিয়া বললো,
“এই আপু, আমার চশমাটা নিলে যে?”
“এটা সিলেট পৌঁছানো অবধি আমার।”
তানিয়া মুখ ফুলালো আবারও উপরে উঠে গেলো আরেকটা আমার জন্য।এটা তার প্রিয় চশমা ছিলো।তানজিম রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নেমে এলো।রাউশি আর তাজবির টিভি দেখছিলো মনোযোগ দিয়ে। তানজিমকে দেখে তাদের দুজনের টিভি দেখার হুশ উড়ে গেলো।চোখ দুটো বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে খুব জোরে জোরে হেসে ফেললো দুজনে।হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে এমন অবস্থা।তানজিম চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।মাহতাব খান রুম থেকে বেরিয়ে বসার রুমে আসতেই সিড়ির কাছে ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘুরে আবারও নিজের রুমে চলে গেলেন। তানজিম শুধু সবার দিকে চোখ ছোট ছোট করেই তাকিয়ে আছে।মাইশা লিপস্টিক হাতে নেমে এলো নিচে।ঠোঁটে তার বিজয়ের হাসি।মাইশা তানজিমের সাথে বাজি ধরেছিলো কোনো একটা বিষয়ে।তবে তানজিম হেরে গিয়েছে তাই তো মাইশা তাকে মেয়েদের ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে দিয়েছে মুখে ধবধবে সাদা পাউডার আর বাহারি রঙের একটি হাফ হাতা শার্ট নিচে লুঙ্গি পড়িয়েছে।হেরে যাওয়ার জন্য তাকে পুরো রাস্তা এভাবে যেতে হবে।তার এমন সাজসজ্জায় সবাই হাসতে লাগলো।উজান এসে তানজিমের এমন অবস্থা সিড়ির কাছেই হাসতে হাসতে তানজিমের উপরেই পড়ে যাচ্ছে।তানজিম বিরক্ত হয়ে সড়ে যাচ্ছে।তানিয়া বড় ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসে পড়লো। মাহতাব সাহেব আবারও আসলেন সেখানে আর ছেলের কাছে গিয়ে বললেন,
“কি সেজেছিস এসব?কোন জায়গায় সার্কাস দেখাতে যাবি বাবা?যত টাকা পাবি তার অর্ধেক ভাগ আমাকেও দিয়ে দিস।”
বলেই চেঁচিয়ে স্ত্রীকে ডাকতে লাগলেন,
“রোকসানা, তোমার গুণধর ছেলেকে দেখে যাও, জোকার সেজে এসেছে।কোথায় যেন আজ সার্কাস দেখাতে যাবে।”
বাড়ির সবাই সেখানে উপস্থিত হয়ে তানজিমের এই রূপ দেখে হা হুতাশ করে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে।তানজিম মাইশার দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে জবাবে বললো,
“কিছু হয় নি।ইচ্ছে হয়েছে তাই এভাবে যাব সিলেট।গাড়িতে করে যাব কেউ তো আর দেখবে না।”
মাহতাব খান ছেলেকে বললেন,
“হ্যা তাইতো।আগে ভাবতাম ছেলেটা আধপাগল এখন তো দেখি পুরোটাই পাগল এই ছেলে।এই ছেলেকে পাবনায় পাঠানোর ব্যবস্থা যতদ্রুত সম্ভব করতে হবে।”
হেসে উঠলো ছেলেমেয়েগুলো।মেহরান সদর দরজায় হেলান দিয়ে পকেটে দুহাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে আর রাউশির হাসির দিকে তাকিয়ে আছে।উজান তার পাশে গিয়ে আস্তে আস্তে বললো,
“মনে লাড্ডু ফুটছে?”
বলেই ভো দৌঁড় দিলো।মেহরান চক্ষু হাসলো রাউশির দিকে তাকিয়ে।
চলবে……
#মেহেরজান
লেখনীতে – #সোহামণি
পর্ব ২০ (প্রথম অংশ)
গাড়ির সামনে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে রাউশি।সবাই যাতে একগাড়িতে করেই যেতে পারে তাই একটি মাইক্রো বাস নেওয়া হয়েছে।রাউশি ভেবেছিলো সে আজ তার মায়ের সাথে যাবে তবে তার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পথে।রাউশিকে মুর্তির মতো গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নাহিন এসে ধমকে বলল,
“তোকে এখানে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য বলা হয়েছে নাকি?সড় যা।”
রাউশি চোখ গরম করে তাকালো নাহিনের দিকে।পরক্ষণেই মনে পড়লো ‘ওহ আমি তো চশমা পড়ে আছি।’ এটা ভেবে নিজেকে নিজেই গালি দিলো একটা।গাড়িতে উঠে পড়লো।সবার সামনের সিটটাই বসতে চেয়েও বসলো না।বরং দেখতে লাগলো নাহিন কোন সিটে বসে।নাহিন গিয়ে সবার পেছনের সিটের আগের সিটে বসেছে। রাউশিও নাহিনের পাশে গিয়ে বলল,
“এই নাহিন সড় আমি তোর পাশে বসবো।”
নাহিন বিনাবাক্য ব্যয়ে জানালার পাশে বসলো।রাউশি এখানে জানালার কাছে বসতে চেয়েও বসলো না কারণ জানালার কাছের সিটটাই বসলে মেহরান যেকোনো মুহুর্তে এসে নাহিনকে সড়িয়ে সেখানে বসতে পারে। তাইতো এই পরিকল্পনা করে নিজেই বাঁকা হাসলো।একে একে সবাই উঠে পড়লো।বড়রা সামনের সিটগুলোতে বসলো স্বামী স্ত্রী মিলে।আর ছেলেমেয়েরা পেছনের দিকে আসা শুরু করলো।মাইশা কানে হেডফোন গুজে সামনের সিটে হাটু ভর দিয়ে কেমন অদ্ভুতভাবে বসে ছিলো।মাইশাকে ধাক্কা দিয়ে জানালার পাশের সিটে ফেলে তানজিম সেখানে বসে পড়ে।মাইশা হেডফোন সড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“এটা কি হলো?”
তানজিম উত্তর দিলো,
“যা হওয়ার হলো।”
“আমি তোমার পাশে বসবো না।”
“কিন্তু আমি তো তোর পাশেই বসবো।”
মাইশা উঠে যাওয়ার জন্য রেডি হতেই তানজিম ওর হাত ধরলো আর জোর করে বসিয়ে মাইশার পাশে একটু চেপে গিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
“একদম ওঠার চেষ্টা করবি না। নয়তো ফল খারাপ হবে।”
উজান পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো।ওদের তানজিম আর মাইশাকে একসাথে দেখে হেসে ফেললো।তানজিমের কাঁধে চাপড় মেরে বলল,
“ভালোই তো চলছে মামা।টেম্পু কতদূর গেলো আমাকেও জানিও মাঝেসাঝে। সবারই হয় শুধু আমারই হয় না।”
বলে আফসোস করতে করতে রাউশির বিপরীত পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। রাউশি উজানকে দেখে হাসলো।উজানও মিষ্টি হাসি উপহার দিলো।উজান রাউশির পাশে থাকা নাহিনকে দেখে আফসোসের সুরে বলল,
“হায় আল্লাহ।আজ যে নাহিনের কি হবে আমি সেটাই ভাবছি?”
কথাটা শুনে তড়িৎ বেগে উজানের দিকে তাকালো নাহিন।চোখেমুখে খেলে গেলো বিস্ময়।জানতে চাইলো,
“কি হবে?”
উজান এখন কিভাবে বলবে যেখানে রাউশিই বসে আছে।এই নাহিনও না অনেক বোকা।এই ছেলেকে বললেও বুঝবে না।চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়লো।নাহিনও আর পাত্তা না দিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।রাউশি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।মেহরান এখনও উঠে নি।পাশ ফিরে উজানকে দেখে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে আর হেলান দিয়ে বসে আছে।আবারও সামনে তাকাতেই রাউশি চমকে গেলো।মুখ ফুটে আওড়ালো,
“এই লোক এখানে কি করছে?”
নুজাইশ বাসে উঠতেই চোখ গেলো সর্বশেষে থাকা রাউশির দিকে।রাউশিকে দেখা মাত্রই হাত নাড়ালো নুজাইশ।রাউশি চশমা পড়ে থাকাই বুঝলো না কোনদিকে তাকিয়ে আছে।মাহবুব খানকে সালাম জানালো নুজাইশ।মাহবুব খান বললেন,
“তোমাকে আশা করি নি।”
“আসলে আঙ্কেল বাসায় একটা বড়সড় সমস্যা হয়েছে আমাকে নিয়ে।বাঁচার জন্য মেহরানের থেকে পরামর্শ চেয়ে মেহরান আমাকে আপনাদের সাথে সিলেট যাওয়ার কথা বললো।আমিও রাজী হয়ে গেলাম।”
মাহবুব খান বললেন,
“ভালো করেছো।আমাদের সাথে ঘুরে ফিরে এসো কয়েকদিন মন ভালো হয়ে যাবে।আর তোমার বাড়ির পরিস্থিতিও ভালো হয়ে যাবে।”
“থ্যাংকস আঙ্কেল।”
নুজাইশ সামনে এগিয়ে গেলো।তার বাবা মায়ের তার আর মিলির বিয়ের ব্যাপারটা শুনেছিলো নুজাইশ।আজ রাতেই যে তার মা তাকে এই বিষয়ে বলে কয়ে রাজী করানোর গোপন প্ল্যান করেছেন সেটা জেনে নুজাইশ মেহরানের থেকে সাহায্য চাইলে মেহরান তাদের সাথে যাওয়ার জন্য বলে।নুজাইশও এক পায়ে রাজী হয়ে যায়।মিলি ভালো মেয়ে তবে নুজাইশের পক্ষে দ্বিতীয় কাউকে জীবনে আনা সম্ভব নয়।সে একা থাকতে চায় আজীবন।রাউশিকে পায় নি তো কি হয়েছে তাই বলে যে খুব সহজেই ভুলে যাবে এমনটাও নয়।তবে পাওয়ার আশা বা আকাঙ্ক্ষাও যে করবে এমনটাও নয়।প্রিয় বন্ধুর হবু স্ত্রী রাউশি তার দিকে তাকাতেও কেমন দ্বিধা হলেও এক পাক্ষিক একটা অনুভুতি সেটা আজীবন রয়ে যাবে নুজাইশের মাঝে।নুজাইশ হতাশ নয় বরং খুশি যে রাউশি অন্তত ভালো বাকি জীবনে খুব সুখী হবে।এমন একটা পর্যায়েই থাকবে যেখানে ভালোবাসা যাবে না,আশা রাখা যাবে না তবে দূর থেকে শুধু দেখা যাবে। নুজাইশ মনে মনে ভাবে এটাই থাকুক। এতেই নুজাইশ সুখী হবে।তবুও জীবনে কাউকে আনা সম্ভব নয় তার পক্ষে।
নুজাইশের পেছন পেছন মেহরানও উঠলো গাড়িতে।প্রথমেই চোখ গেলো নাহিনের পাশে বসা রাউশির দিকে।নুজাইশ রাউশির কাছে আসতেই জিজ্ঞাসা করলো,
“এই রাউশি কেমন আছো?”
রাউশি সৌজন্য হেসে জবাবে বলল,
“ভালো আছি স্যার।আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো ছিলাম না।তবে খান পরিবারের সাথে সিলেট যেতে পারবো তাই এখন ভালো আছি।”
রাউশি হাসলো।নুজাইশ কথা না বাড়িয়ে পেছনে গিয়ে বসলো।মেহরানও আসলো। আড়চোখে রাউশির দিকে একবার তাকালো।রাউশি চশমা পড়ে থাকাই দেখলো তা তবে মেহরান রাউশির চাহনী দেখতে পেলো না।মেহরান গিয়ে নুজাইশের পাশে বসলো।নুজাইশ ফোনটা হাতে নিয়ে কিছু একটা করলো।মেহরানও নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।রাউশি পড়েছে বেকায়দায়।এখানে এত ছেলের মাঝে সে একা পড়েছে।সামনে দেখতে থাকে কোথায় সিট খালি আছে?তখনই চোখ যায় তানিয়ার দিকে।তানিয়ার পাশের সিটটা খালি।রাউশি শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়িয়ে তানিয়ার পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়ে।তবে এদিকে নাহিন ব্যাথায় কুকড়ে ওঠে।রাউশির পা দ্বারা ভুলবশত নাহিনের পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। নাহিন চোখমুখ কুঁচকে বলে,
“তুই তো হাতি রে।এই শরীর নিয়ে চলিস কিভাবে?”
রাউশি মুখ ভেংচালো নাহিনকে।পেছনে বসা নুজাইশ হাসলো।উজানও হাসলো।তবে মেহরান গম্ভীর ভঙ্গিতে ফোন চালাতেই ব্যস্ত। যেন এই মুহুর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখন ফোন চালানো।রাউশি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিলো।তখনই একটি মেসেজের নোটিফিকেশন আসলো তার ফোনে।রাউশি সেখানে ক্লিক করতেই দেখলো মেহরানের মেসেজে।একপলক পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেহরান স্বাভাবিক ভাবেই বসে আছে।আবারও ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেহরান মেসেজে লিখেছে,
“তোর এমন বাজে কাজের জন্য, সিলেট পৌঁছানোর পরপরই গুরুতর একটি শাস্তি দেব তোকে।”
রাউশির পিলে চমকে উঠলো।কি বাজে কাজ করেছে রাউশি ভাবতে লাগলো। রাউশি এটাও চিন্তা করতে লাগলো কিভাবে এই লোকটার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবে। পরমুহুর্তেই মনে পড়লো সিলেটে গেলে রাউশি সবসময়ই তার মায়ের পিছু পিছু থাকবে।তাহলে তো হলোই।রাউশি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সিটে হেলান দিলো।রাত নয় তবুও রাউশির খুব ঘুম পাচ্ছে।সিদ্ধান্ত নিলো এখন কিছুক্ষণ ঘুমাবে।তানিয়া নিজমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।রাউশি সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। এখন কিছুক্ষণ ঘুমানো জরুরি তার।চোখ বুজতেই ঘুমিয়ে গেলো রাউশি।
রাউশির ঘুম ভাঙলো গাড়ির হর্নের শব্দে। ঢুলুঢুলু চোখ খুলতেই আগে পাশে ফিরে দেখলো সে গাড়ির জ্যাম রাস্তায়।তাদের গাড়িটাও এই জ্যামের কবলেই পড়েছে। রাউশি আবারও চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো। রাউশির নাকে পরিচিত একটি পারফিউমের ঘ্রাণ ভেসে আসলো।এই পারফিউমের ঘ্রাণ তার খুব পরিচিত।রাউশির মস্তিষ্ক জাগ্রত হলো মুহুর্তেই।চোখ খুলে পাশে ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো গম্ভীর মুখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকা মেহরানকে।এটা দেখেই চমকে উঠলো রাউশি।রাউশি দেখলো সে জানালার কাছে বসে আছে আর মেহরান তার পাশেই বুকে দুহাত গুজে চোঝ বুজে বসে আছে।রাউশি মাথা উঁচিয়ে দেখলো সামনে পেছনে।তানিয়াকে দেখলো নাহিনের পাশে বসে ঘুমাচ্ছে।এমনকি গাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে।শুধু পেছনে নুজাইশকে জাগ্রত অবস্থায় বসে থাকতে দেখলো রাউশি। রাউশি হাতের নখ কামড়ানো শুরু করলো। ভাবছে কিভাবে কি করবে?
“এভাবে নখ কামড়াচ্ছিস কেন?ক্ষুদা লাগলে বল খাবার দিচ্ছি।কিন্তু নখ কামড়ে কি বোঝাতে চাইছিস তোকে ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না বাড়িতে?”
চলবে…..
#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ২০ (শেষ অংশ)
মেহরানের এমন রাশভারী আওয়াজে কটাক্ষ করে কথাটা শুনে থমথমে মুখে মেহরানের দিকে তাকালো রাউশি। মেহরান তারই দিকে তাকিয়ে।লাল আলোয় মেহরানের মুখের প্রতিক্রিয়াটা ততোটা বোঝা গেলো না।তবে রাউশি বুঝলো এই লোক তাকে এখন আর ছেড়ে দেবে না। রাউশিকে চুপ থাকতে দেখে মেহরান পুনরায় বলল,
“আজকাল গম্ভীর হয়ে গেছিস নাকি?”
রাউশি এই কথারও জবাব দিলো না। চশমাটার কথা মনে পড়তেই খেয়ালে আসলো চোখে চশমা নেই।এই লোকটাই সড়িয়ে দিয়েছে হয়তো।রাউশি মুখ ভার করে বসে রইলো ঠিকই তবে এতে আবার রেগে গেলো মেহরান।রাউশির দিকে ভালোভাবে ঘুরে ভারী আওয়াজে বলল,
“কথা বলছিস না যে? বোবা তো নোস!”
“সব কথার জবাব দিতেও বাধ্য নই।”
মেহরান চমকালো,
“ওরে বাবা।মুখে খই ফুটেছে দেখছি।”
“মাঝে মাঝে ফোটাতে হয়ে মেহরান ভাই।”
“চুপ থাক।এখন বল আমায় ইগনোর করছিলি কেন?”
রাউশি স্বভাবতই স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো এবার,
“আমি ইগনোর করিনি।আপনার যদি একান্তই ইগনোর মনে হয়ে থাকে তবে আমি_”
বাকি কথা বলতে পারলো না রাউশি মেহরান রাউশির হাত চেপে ধরে বলল,
“দু একটা চুমু খেয়েই যদি এমন অবস্থা হয় তোর, আমি ভাবছি ভবিষ্যতে কি হবে? আমাদের বাসর রাতেই বা কি হবে?”
লজ্জায় কান গরম হয়ে এলো রাউশির।গালে ফুটে উঠলো লজ্জার আভাস।এই লোক দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে বলে মনে হলো রাউশির।আগে তো কেমন গম্ভীর থাকতো।রাউশির মুখ দেখা না গেলেও লজ্জা যে পেয়েছে সেটা মেহরান ঠিকই বুঝলো।হাত ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল,
“সিলেট থেকে এসেই তোর একটা ব্যবস্থা করছি আমি।দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস।”
রাউশি মনে মনে বলল ‘নিজে যে খুব আদব হয়ে যাচ্ছে।’ তবে মুখে বলল,
“আমি বেয়াদব হই নি।এখনও আদবই আছি।”
মেহরান হালকা ধমকে বলল,
“চুপ থাক।ঘুমা যা।”
মেহরানের এহেন ধমক মোটেও বোধগম্য হলো না রাউশির।তবে মুখ ঘুরিয়ে গোমরামুখে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।
দূরে বসা নুজাইশ তাদের কথা ভালোভাবে না শুনলেও বুঝলো দুজনের মধ্যকার খুনশুটি।নিজেও হাসলো কিছুটা।রাউশির গোমরামুখটা দেখার একরাশ ইচ্ছা জাগলো মনে।তবে সেই অবহেলিত ইচ্ছে নিমিষেই বিসর্জন দিয়ে নিজেও ঘুমানোর জন্য রেডি হলো।বাবা মায়ের কথাও মনে পড়লো নুজাইশের।কাউকে না জানিয়েই এসেছে সে।চিন্তা করবে ভেবে নুসফারকে একটা মেসেজ করলো তৎক্ষনাৎ।মেসেজটা করে সিটে হেলান দিলো।
দীর্ঘ জ্যাম পেরোতে অনেক্ষণ সময় লেগেছিলো তাইতো সিলেটে পৌঁছাতে সময়টাও দ্বিগুণ লেগেছে।এখন সিলেটের রাস্তা ধরেই গন্তব্যে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। সকাল হয়েছে তবে সূর্য এখনও উঠে নি। শুধু পূর্ব দিগন্তে লাল লাল আভা দেখা যাচ্ছে।অর্থাৎ সূর্য আর কিছুক্ষণ পরই উদিত হবে।রাউশি সারারাত জেগে ছিলো।পাশে বসা মেহরান পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে।মাঝেসাঝে আবার রাউশির কাঁধেও মাথা রেখেছে।রাউশি অবশ্য সড়িয়ে দেয় নি কারণ মানুষটার মুখটা দেখলে কিছুটা মায়া লাগে।তবে নিজের কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে রাউশির।এইযে এখনও কেমন আরামে ঘুমাচ্ছে রাউশির কাঁধের মাথা রেখে।বাসের সবাই ঘুমন্ত অবস্থায় শুধুই রাউশি জেগে জেগে কল্পনা জল্পনা করে যাচ্ছে।বাইরের প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত সে।আবার মাঝেমধ্যে মেহরানের মাথাটাও ঠিক করে দিচ্ছে।
কাঁধে ভারী কিছুর স্পর্শ পেতেই ঘুম পাতলা হলো মাইশার।নিভু নিভু চোখ খুলে তাকাতেই দেখলো তানজিম তার কাঁধে মাথা রেখে আরামসে ঘুমাচ্ছে।সহ্য হলো না মাইশার।উল্টো কাঁধ থেকে মাথাটা সড়িয়ে দিয়ে নিজেই তানজিমের কাঁধে মাথা রাখলো।এদিকে এটা দেখে তানজিম মুচকি হাসলো।তানজিম ঘুমায় নি বরং অভিনয় করছিলো।মনে মনে ভাবলো দিনের সূচনাটা যদি এত সুন্দর হয় তবে পুরো দিনটাও নিশ্চিত অনেক সুন্দর হবে।এদিকে রাউশি একবার মাথা তুলে সামনে পেছনে তাকালো।সবাই ঘুমিয়ে আছে এখনও।তবে চোখ গেলো তানজিম আর মাইশার দিকে। তাদেরই বিপরীতে এক সিট পেছনে। তানজিমের কাঁধে মাইশার মাথা দেখে মুখ চেপে হাসলো রাউশি।তানজিমও খেয়াল করলো রাউশিকে।হাত নাড়লো রাউশিও হাত নাড়লো।তখনই আবার চোখ গেলো সবার পেছনে নুজাইশের ওপর।মানুষটা কেমন বাচ্চার মতো ঘুমাচ্ছে।আশেপাশে কোনো অবলম্বন নেই একটু ভালোভাবে ঘুমানোর।রাউশির মায়া হলো তবে তারও কিছু করার নেই।রাউশি আবারও সোজা হয়ে বসলো।আবারও চোখ রাখলো বাইরে। জানালা দিয়ে সুড়সুড় করে বাতাস আসছে আর দুজনের গা ছুয়ে দিচ্ছে।রাউশি কি মনে করে যেন পাশে থাকা মেহরানের দিকে তাকালো।ঠান্ডা হাওয়ায় মানুষটার কপালের কাছে চুলগুলো উড়ছে।সূর্য উঠেছে আর মেহরানের মুখের ওপর একটু একটু আলো এসে পড়লো।রাউশির ঠোঁটে হাসি ফুটলো। হাত বাড়িয়ে কপালের চুলগুলো সড়িয়ে দিলো।ঘুমন্ত মেহরান নড়ে উঠলো।রাউশির আদুরে বাচ্চার মতো লাগলো আর নিঃশব্দে হাসলো।আঙুল চালিয়ে কপাল হতে থুতনির কাছে আনলো।চাপ দাড়ি গুলো ছুয়ে দিলো। ঠোঁটের দিকে চোখ পড়তেই একটা শুকনো ঢোক গিললো রাউশি।কি করছে ভেবে হাত সড়াতে চাইলেই মেহরান খপ করে ধরে ফেললো।ঘুম ঘুম চোখে তাকালো রাউশির দিকে।ঘুম জড়ানো আওয়াজেই বলল,
“বিয়ের পর ধামাকা লেভেলের একটু চুমু খেয়ে নিস আপাতত নজর সামলা।”
রাউশি হতবিহ্বল হয়ে পড়লো।আর চমকালোও।এই লোক কিভাবে বুঝলো এতোসব।উনার কি কোনো অলৌকিক ক্ষমতা আছে নাকি ভাবা শুরু করলো রাউশি।মেহরান ঠিকভাবে বসে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।রাউশি ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়েছে।
.
গন্তব্যে পৌঁছানোর কিয়ৎক্ষণ আগেই সকলেই জেগে পড়েছে।আর এখন সবাই কথা বলাবলি করছে।মেহরান ফোন নিয়ে কিসব ঘাটাঘাটি করছে আর রাউশি চোখ ছোট ছোট করে আড়চোখে সেদিকেই তাকিয়ে।গ্রামের সরু পথ ধরে গাড়িটা চলছে।রাস্তাটা বড় হওয়ায় আর পিচঢালা রাস্তা হওয়ায় চলতে বেগ পেতে হচ্ছে না।
এদিকে মেহরান ঠিক বুঝতে পারলো রাউশির নজর কোনদিকে।তাই মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
“আড়চোখে দেখিস কেন?দেখতে চাইলে আমাকেই বল, আমিই দেখিয়ে দিচ্ছি।লুকিয়ে চুড়িয়ে দেখা কোন স্বভাব?”
মাথায় হাত দিয়ে বিরোধিতা করলো রাউশি,
“এমনটা মোটেও না মেহরান ভাই।আমি তো, ও-ওই সিটের দিকে তাকিয়েছিলাম।”
“ওহ আচ্ছা তাই নাকি?তা কি দেখছিলি সিটে।”
উত্তর দিতে পারলো না রাউশি।আমতা আমতা করতে লাগলো।আর এমন সময়ই গাড়িটা বিশাল এক বাড়ির সামনে এসে থামলো।সবার মাঝেই একটা হৈ-হুল্লোড় ভাব এসে গেলো।আস্তেধীরে একে একে সবাই নামার তোড়জোড় শুরু করলো।রাউশিও নামার জন্য উঠে দাড়ালো।তবে মেহরান রাউশির হাত ধরে টেনে বসালো আর বলল,
“হুশশ, তুই পড়ে নামবি।”
রাউশি বলল,
“আমি এখনই নামবো।”
“কথার অমান করছিস রাউশি?”
“সবাঅ নামছে।আমি এখানে একা থাকবো কেন?”
“আমি বলেছি তাই।চুপচাপ বসে থাক।”
একে একে সবাই নেমে গেলো।রাউশি জানালা দিয়ে দেখলো বাড়িটা।বিশাল বড় একটি বাড়ি।রাজবাড়ীর মতোই দেখতে বাড়িটা।বাড়ির সামনে ইট বিছানো রাস্তা আর পাশে নানান ফুলের বাগান।রাউশি শুনেছে উর্মিলা বেগমদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক ভালো।আজ সচক্ষে দেখছে।একে একে সবাই নামার পর সর্বশেষে নুজাইশও নামার জন্য উদ্যত হলো।তবে সামনে এগোতেই রাউশি আর মেহরানকে বসে থাকতে দেখে মেহরানের কাঁধে হাত রেখে বলল,
“নামবি না?”
মেহরান সোজাসাপটা জবাব দিলো,
“তুই যা আমি আসছি।”
নুজাইশ হাসলো।রাউশির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে নেমে পড়লো।গাড়িতে এখন আর কেউ নেই।এবার মেহরান রাউশির দিকে ঘুরে বসলো।রাউশি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।রাউশির থুতনি ধরে মেহরান নরম আওয়াজে বলল,
“শোন রাউশি। এ বাড়িতে বেশ কয়েকজন যুবক ছেলেপেলে আছে।তাদের সাথে কথা বলবি না বলে দিলাম। আর কোথাও যাবি না আমার অনুমতি ব্যতীত।কোনোকিছুর প্রয়োজন হলে আমায় বলবি।আর ঘোরাঘুরির বিষয় সেটা আমি নিজে দেখে নেবো।”
রাউশি বাঁকা হেসে বলল,
“মেহরান ভাই আপনি জেলাস?”
মেহরান কপাল কুঁচকালো,
“কারণটা যদি তুই হোস, তাহলে হ্যা আমি জেলাস।”
চলবে…….