মেহেরজান পর্ব-৩৯+৪০

0
3

#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৩৯

সকালে রাউশির ঘুম ভাঙলো মুখের ওপর গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়াতে। ঘুমঘুম চোখ খুলতেই দেখলো মেহরানের ঘুমন্ত মুখশ্রী। আজকের সকালটা ভীষণ মিষ্টি মনে হলো রাউশির কাছে। এমন মিষ্টি সকাল আজীবন পেতে চায় রাউশি। মেহরানের চুলে হাত বুলালো। একটা আঙুল মেহরানের চোখ বেয়ে স্পর্শ করতে করতে ঠোঁটে এসে থামলো। রাউশি হেসে দিলো নিঃশব্দে। আঙুল সড়িয়ে তার কোমড়ে রাখা মেহরানের হাতটা সড়িয়ে উঠতে যাবে তার আগেই মেহরান হাত ধরে ফেললো।

রাউশি চমকে পেছনে ফিরে তাকাতেই মেহরান তাকে কাছে টেনে আলতো করে ঠোঁটে চুমু দিলো রাউশিকে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে এক চোখ খোলা আর এক চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল,
“এটা প্রতি সকালেও পাওনা তোর।”

রাউশি থতমত খেয়ে গেলো। মেহরান রাউশিকে ছেড়ে আবারও ঘুমিয়ে গেলো৷ রাউশি উঠে দাঁড়ালো। শাওয়ার নেওয়ার জন্য একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মেহরান তখনও ঘুমাচ্ছে। রাউশি খাটের কাছে এসে কিছুক্ষণ মেহরানকে দেখলো। সকালের স্নিগ্ধ আলো মেহরানের মুখে এসে ছিটকে পড়ছে মনে হলো। মেহরানের ফর্সা আদলে বদ্ধ আঁখিজোড়া, একখানা সুচালো নাক আর নিরেট চোয়ালে। ঘুমন্ত অবস্থায় মানুষটাকে বাচ্চাদের মতো লাগলেও যখন গম্ভীর মুখ ধারণ করে সেসময় চেহারার আদল পালটে যায় মেহরানের। রাউশি আবারও হেসে উঠলো।

রাউশি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সোজা নিচে নেমে গেলো। বাড়ির কর্ত্রীরা একেকজন একেক কাজে ব্যস্ত। রাউশি মায়ের কাছে গেলো। এই কয়মাস মায়ের সাথে ঠিক কয়বার কথা হয়েছে সেটা মনে নেই রাউশির। শুধু এটাই মনে পড়ে রাউশি সারাদিন, সারারাত বসে বসে প্রহর গুণেছে মেহরানের ফিরে আসার।

রূপা বেগম মেয়েকে সকাল সকাল নিচে দেখে বিস্মিত হলেন। আর তার চেয়েও বেশি বিস্মিত হলেন মেয়েকে হলুদ শাড়িতে দেখে। এমনিতে কখনও বাড়িতে শাড়ি পড়ে না রাউশি। রূপা বেগম মেয়ের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“মাশা-আল্লাহ, কারোর নজর না লাগুক।”

রাউশি হেসে শান্তমুখভঙ্গিতে বলল,
“মা আজ এতো কাজ কিসের তোমাদের?”

রূপা বেগম কেন যেন একটু অন্যরকম হলেন। মেয়ের হাত ছাড়িয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে বললেন,
“তুইও কাজে লেগে পড়। আগামীকাল বিকেলে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আছে।”

রাউশি প্রশ্ন করলো,
“কিসের অনুষ্ঠান?”

রূপা বেগম কথা ঘুরাতে চাইলেন,
“মেহরান উঠে নি ঘুম থেকে? আচ্ছা ঘুমাক তাহলে।”

বলে তিনি চলে গেলেন। রাউশির মনে হলো তার মা তার থেকে কিছু লুকোচ্ছে। তাই রাউশি রান্নাঘরে চলে গেলো। রোকসানা বেগম আর উর্মিলা বেগম আর দুজন পরিচারিকা সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত।

উর্মিলা বেগম রাউশিকে এখানে দেখে বললেন,
“তুই এখানে? মেহরানও উঠেছে?”

পরবর্তীতে রাউশিকে শাড়ি পড়া দেখে কেমন মজার সুরে বললেন,
“মেহরান তো আজ তোর থেকে চোখই সড়াতে পারবে না।”

রাউশি লজ্জা পেলো,
“কি যে বলো না বড় মা।”

উর্মিলা বেগম আর রোকসানা বেগম হেসে উঠলেন।রাউশি একটু উর্মিলা বেগমের কাছে গেলো। আর জিজ্ঞাসা করলো,
“মা বললো আগামীকাল নাকি কিসের অনুষ্ঠান?”

উর্মিলা বেগম কেমন করে যেন রাউশির দিকে তাকালেন। তারপর আবারও কাজে মন দিয়ে বললেন,
“মেহরানের আসার খুশিতে আর কি ছোট খাটো কিছু করবো।”

রাউশির কেমন যেন লাগলো। একটা মানুষের বাড়িতে ফেরাতে অনুষ্ঠান করে নাকি কেউ? রাউশি মাথায় এক জটলা প্রশ্ন নিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। উর্মিলা বেগম রোকসানা বেগমের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসলেন।

রাউশি এবার সোজা চলে গেলো তানিয়ার রুমে। তানিয়াকে দেখা গেলো বিছানায় একটা ছবি নিয়ে ঘুমাচ্ছে। দরজা খোলা থাকায় রাউশি ঢুকতে পেরেছে। তানিয়ার পাশের খালি জায়গাটায় গিয়ে শুয়ে পড়লো রাউশি। তানিয়ার হাতে থাকা ছবিটা হাতে নিয়ে দেখলো একটা ছেলের ছবি। নিচে নাম লেখা আছে ফুয়াদ। রাউশির মনে পড়লো এই ছেলেই তানিয়ার হবু স্বামী। রাউশি মনে মনে খুব হাসলো। এই মেয়ে সারারাত ছবি দেখেছে নাকি ফুয়াদের?

সকাল দশটা বাজে। একে একে সবাই নিচে আসা শুরু করেছে। বাড়ির কর্তারা সেই ভোরেই নিজেদের কাজে চলে গিয়েছে। এখন শুধু বাড়ির ছেলেমেয়েরাই রয়েছে। আর তারাই একেকজন করে নিচে আসছে। গতকালকে নাহিন,মাইশাও এসেছিলো বাড়িতে। আজ নাকি রাউশির ফুফুরাও আসবে। আবার উজান ভাইও আসবে। রাউশির মনে হচ্ছে আজ বাড়িতে ঈদের দিন।

রাউশির কাঁধে হাত রেখে মাইশা বলছিলো,
“আমি এক নতুন রিলেশনে গিয়েছি৷ ছেলেটা দেখতে একদম ঝাক্কাস। কেমন হবে বলোতো আপু, যদি আমি বিয়ে পর্যন্ত আগায়।”

রাউশি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ভালো হবে।”
“সত্যি?”
“হ্যা।”
“আব্বু-আম্মুকে বলি।”
“তোর ইচ্ছা।
” তুমি বলে দাও।”
“পারবো না।”

মাইশা হতাশ হলো,
“তাহলে আমিও পারবো না বলতে।”
“তাহলে বিয়ে করতে হবে না।”
“তোমার বিয়ে হয়ে গেলো। তানিয়ার বিয়ে হবে।আমি কেন সিঙ্গেল থাকবো।”
“সিঙ্গেলই ভালো।”

নাহিন এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“ওহ তাই নাকি? মেহরান ভাইকে কি এখন আর ভালো লাগছে না? মেহরান ভাইকে বলবো? দাঁড়া আজ আসুক মেহরান ভাই।”

নাহিন এবার বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তুই বেশি পেঁকে গিয়েছিস। দাঁড়া মা কে বলে দেব আমি।”

বিরক্ত হলো মাইশা। নাহিনের মাথায় গাট্টা মেরে চলে গেলো। নাহিন রাউশিকে বলল,
“দেখেছিস? এই মেয়ে যে বাড়িতে বউ হয়ে যাবে, সে বাড়ির সবার কপাল পুড়বে।”

মেহরান তখন সিড়ি বেয়ে নামছিলো। রাউশিকে আর নাহিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ দুটো বারবারই রাউশিতে মুগ্ধ হচ্ছিলো। যেন হাজার বছর পর রাউশিকে দেখছে তাও আবার শাড়িতে। রাউশি খেয়াল করে নি মেহরানকে। নাহিনই প্রথমে খেয়াল করলো মেহরানকে। আর চেঁচিয়ে বলল,
“মেহরান ভাই আসছে।”

রাউশি কানে হাত দিলো,
“তাই বলে এতো জোরে চেঁচাতে হবে?”

রাউশির চোখ গেলো সিড়ির দিকে। মেহরান তারই দিকে তাকিয়ে নিচে নামছে। চোখের চাহনীতে আলাদা এক শীতলতা যা রাউশির হৃদয় শীতল করে দিলো। নাহিন মেহরানের কাছে গিয়ে কোলাকুলি করলো। তারপর এক হাত দিয়ে রাউশির কাছে যেতে বললো নাটকীয় ভঙ্গিতে। নাহিন সে স্থান থেকে সড়ে গেলো। মেহরান রাউশির দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো।

“এই সাজ কি আমার জন্য?”

রাউশি ব্যঙ্গ করে বলল,
“অবশ্যই না।”

মেহরান রাউশির নিকটে এগিয়ে এলো। এপাশে কেউ নেই। মেহরান সেই সুযোগটা কাজে লাগালো। রাউশির কোমড় জড়িয়ে ধরলো। মেহরানের শীতল হাত রাউশির শাড়ি ভেদ করে পেটে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলো রাউশি। মেহরান রাউশির দিকে ঝুকে বলল কণ্ঠে মাদকতা মিশিয়ে বলল,
“তাই নাকি? তবে আমার দুষ্টু মেহরান তো বলছে তার মেহেরজান তার জন্যই আজ এমন সাজে, এমন রূপে।”

রাউশি ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হলো। কাঁপা গলায় বলল,
“ছেড়ে দিন। কেউ এসে পড়বে।”

মেহরান আরেক হাত রাউশির গালে রেখে বলল,
“আসুক।”

এরপর রাউশির গালে নাক ঠেকিয়ে একটা শ্বাস নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়ে বলল,
“তোর এমন রূপে আমি বারবার বশিভূত হতে চাই।”

.

নিশিদের ভিড়ে আলো সংকটাপন্ন। এমনই এক বদ্ধ রুম থেকে একটি মেয়ের চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। তবে আশেপাশে তাকে সাহায্য করার মতো মানুষ তো দূর কোনো কাকপক্ষীও বসে নেই। মেয়েটি সাহায্য চাইছে বারবার।

হুট করেই দরজা খুলে গেলো। পরপর ভেতরে ঢুকলো তিনজন পুরুষ। মেয়েটা টের পেলো কিছুটা। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“ইয়্যু বাস্টার্ড, তোদের আমি কাউকেই ছাড়বো না। সাহস হয় কি করে? আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে আসার?”

“আমার আবার সাহস একটু বেশিই।”

কেউ একজন সুইচ টিপে লাইট জ্বালালো। সামনের পুরুষগুলোকে দেখে মেয়েটা চমকে গেলো। এ যেন এক অন্য রূপ মনে হলো তার। একদিকে মুগ্ধতা,অন্যদিকে বিস্মিত ভাব তো আবার রাগান্বিত ভাব নিয়েই বিড়বিড় করে আওড়ালো,
“মেহরান!”

চলবে…..

#মেহেরজান
লেখনীতে- #সোহামণি
পর্ব ৪০

মেহরান একটা চেয়ার টেনে আরিয়ার সামনে বসলো। আরিয়া ভয় পেলেও মেহরানের এমন পুরো কালো গেট-আপে একদম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলো। কালো শার্টে মেহরানকে এতো সুন্দর মানায়! আরিয়া জানতো না। একমুহুর্তের জন্য ভুলে গেলো তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। চোখ গেলো নুজাইশের দিকেও। এই মেহরান সুদর্শন বলে কি ওর সব বন্ধুরাও সুদর্শন নাকি ভাবতে লাগলো আরিয়া।

নুজাইশ নিজের আকাশী রঙা শার্টের হাটা গুটিয়ে মেহরানের পাশে একটা চেয়ারে বসলো নিজেও। আরিয়া ভাবলো মেহরান তো বিবাহিত সে নুজাইশকে পটানোর চেষ্টা চালাবে। এদিকে তুষার দেয়াল ঠেসে দাঁড়িয়ে আছে। এবার মেহরান গমগমে আওয়াজে বলল,
“তা মিস. আরিয়া, এবার বলুন রাউশিকে কেন মারতে চেয়েছিলেন?”

আরিয়ার ধ্যান ফিরলো। মনে পড়লো তাকে এরা তুলে নিয়ে এসে বেঁধে রেখেছে। আরিয়া মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
“মেহরান তোমার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছি না। কোন সাহসে তুমি আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছো৷ আমার বাবা জানতে পারলে তোমাকে এখানেই জ্যান্ত পুতে দেবে৷”

“ওহ আচ্ছা।কিন্তু তোমার বাবা জানবেই বা কি করে?”

নুজাইশ রেগে ছিলো সেই অনেক্ষণ যাবৎ। কপালের রগগুলো ফুলে উঠেছে। যখন থেকে জেনেছে এই আরিয়াই সেদিন রাউশিকে এক্সিডেন্ট করিয়েছে তখন থেকে খুব কষ্টে নিজেকে সামলে রাখছে, দমিয়ে রাখছে। নুজাইশ দাতে দাত চেপে বলল,
“আগে এটা বলো রাউশিকে এক্সিডেন্ট কেন করালে?”

আরিয়া কপাল কুঁচকালো। সাথে কিছুটা ভয়ের আভাস দেখা দিলো তার মাঝে। চোখ লুকাতে লাগলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“কি বকছো তোমরা?আমি কিন্তু চেঁচাবো।”

তুষার হেসে বলল,
“চেঁচালেও লাভ নেই মিস.। এখানে কেউই আপনাকে বাঁচাতে আসবে না। তবে হ্যা মারতে আসবে। ভয়ানক সব হিংস্র প্রাণীরা।”

পিলে চমকে উঠলো আরিয়ার৷ মেহরানের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে বলল,
“দেখো মেহরান। আমায় ছেড়ে দাও। এতে তোমারই ভালো হবে।”

মেহরান উঠে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে হেঁটে আরিয়ার পেছনে গেলো। আর বলতে লাগলো,
“আজ তোমার এক পা কেঁটে ফেলা হবে। কেমন হবে বলোতো আরিয়া?”

আরিয়া যেন আরও বেশি ভয় পেলো। এবার কান্না করার উপক্রম হয়ে গেলো তার। এখানে তিন তিনটে যুবক আছে। এদের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না। আরিয়া একপ্রকার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“দেখো মেহরান তুমি এমনটা কিছুতেই করবে না। আমি তো, আমি তো ওই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারি না বলেই মারতে চেয়েছি। ওই মেয়েটা নাকি তোমার স্ত্রী।আমার থেকে সুন্দর নয়। তুমি কিভাবে ওই মেয়েকে বিয়ে করতে পারো? এইজন্য রেগেই ভুলবশত_”

“ভুলবশত মেরে দিতে চেয়েছিলে তাই তো?”
“হ্যা।”

আরিয়ার এসব কথাবার্তা শুনে নুজাইশ ভীষণ রকমের রেগে গেলো। আরিয়াকে চড় মারতে যাবে তার আগেই মেহরান থামিয়ে দিলো। তুষারকে বলল,
“নুজাইশকে নিয়ে যা।”

তুষার নুজাইশকে ধরলো। নুজাইশ যাওয়ার আগে আরিয়াকে বলল,
“মেহরান জ্যান্ত ছেড়ে দিলেও আমার হতে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত আরিয়া।”

আরিয়া এদের এসব ভয়ানক সব কথাবার্তায় তার প্রান যায় যায় অবস্থা। কলিজা হাতে নিয়ে বসে আছে আপাতত। না জানি এরা তাকে কিভাবে কি করবে? খারাপ কিছু করবে না তো আবার? এসব ভাবতেই তার নারী সত্ত্বা কিছুটা থমকালো। নুজাইশ আর তুষার বেরিয়ে গেলো। মেহরান আবারও আরিয়ার সামনে চেয়ার টেনে বসে বলল,
“দেখো আরিয়া, তুমি কি করেছো তো জানো! এখন বলো তোমার শাস্তি কি দেওয়া যায়?”

“আমায় ক্ষমা করো মেহরান৷ আমি আর এমনটা কখনোই করবো না। তোমাদের দিকে নিজের ছায়াও মারাবো না। তোমাদের, তোমাদের কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চাইছি মেহরান।”

মেহরান হাসলো,
“ছায়া যতদিন থাকবে তোমার ততদিন ঠিকই আমাদের পিছু মারাবে। সেই ছায়া কিভাবে স্থির রাখতে হয় সেটা আমার খুব ভালোভাবেই জানা আছে আরিয়া।”

মেহরান ‘ভেতরে আসুন’ বলতেই দুজন নার্স ভেতরে আসলো। একদম আরিয়ার সামনে এসে আরিয়াকে কিছু একটা ইনজেকশন পুশ করা হলো। আরিয়া শুধু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছটফট করলো। সাথে কান্নাও জুড়ে দিলো। মেহরান উঠে দাঁড়ালো। এবার খুবই সিরিয়াস আর গম্ভীর ভাবে বলল,
“অবশ্যই তুমি আমার দৃষ্টিকোণে সবচেয়ে বড় অপরাধী, কারণ তুমি আমার জানে আঘাত করেছো। এর জন্য তোমার শাস্তি প্রাপ্য ছিলো। না আমি তোমাকে মৃত্যু দেবো না তবে তোমার মস্তিষ্কসহ তোমাকে অচল করে দেবো। এই তুমি আর কাউকে ক্ষতি করার কথা ভাবতে পারবে না।”

আরিয়ার শরীরে স্লো পয়েজনিং এর ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। মেহরান বলে রেখেছে আরিয়াকে এখানে পুরো একমাস যাবৎ বন্দি রেখে প্রতিটা সময় স্লো পয়েজনিং এর ইনজেকশন যাতে দেওয়া হয়। কারণ এই মেয়েকে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় তবে এতে করে এ আবারও ভবিষ্যতে কারও না কারও ক্ষতি করবে। যেভাবে সেদিন লোক লাগিয়ে রাউশিকে ট্রাকের নিচে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। অবশ্য খানিক সফল হয়েছেও। রাউশির পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে সারাজীবনের জন্য। রাউশি এখনও খুড়িয়ে খুড়িয়েই হাঁটে। মেহরান নিজ হাতে মারতে পারতো। তবে তার বাবা মায়ের বুক খালি করে দিতে চায় না মেহরান। থাকুক আরিয়া বেঁচে তবে বেঁচে থেকেও যাতে মনে হয় সে বেঁচে নেই।

মেহরান বাইরে বের হতেই নুজাইশকে দেয়ালে ঠেসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তুষার এগিয়ে এসে বলল,
“এই মেয়ের বাপ তো সারা শহরে লোক লাগিয়ে দেবে মেয়েকে খোঁজার জন্য। তখন কি করবো?”

“ওর বাড়িতে বলা হয়েছে একমাসের জন্য বিজনেস ট্রিপে দেশের বাইরে গিয়েছে। সমস্যা হবে না।”

নুজাইশ খুব শান্ত আওয়াজে কথাটা বললো। তুষার হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো।

.

মিলির ব্যাপারে সকালে নুজাইশকে বলেছিলেন নুজাইশের মা তবে নুজাইশ সরাসরি না করে দিয়েছে। মাকে আর বাবাকে শুধু একটা কথাই বলেছে নুজাইশ,
“আমি এমন কিছুতে আটকে গেছি যেখান থেকে বের হতে পারছি না। আর না বের হতে চায়। এমন একজন নিষিদ্ধ নারীর মায়ায় আটকেছি যে আমার কাছে দূরদর্শিনী নামেই পরিচিত। তাকে দেখা যাবে শুধু তবে ভালোবাসা পাপ। তাকে ছোয়া যাবে না। এই আক্ষেপ আর সুখ নিয়েই আমি আমার এই জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। তোমরা আর আমায় জোর করবে না মা বাবা।”

কথাটা বলেই নুজাইশ বেরিয়ে গিয়েছিলো। রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে এসব ভাবলো। রাস্তার ওপরপাশে মিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো নুজাইশ। মেহরান পাশের সিটে বসে মোবাইল টিপছে। পেছনে তুষার মিলি,রাউশিদেরই ফ্রেন্ড রুনার সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত। ছেলেটা একটা গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে। এ নিয়ে বন্ধুমহলে কতশত হাসি ঠাট্টা হলো।

নুজাইশ আবারও মিলির দিকে তাকালো। তার থেকে কিছুটা দূরে বৃষ্টির ওপর চোখ গেলো।নুজাইশের মনে পড়লো এই বৃষ্টির কথা। এই মেয়ে আগের তুলনায় বেশ মোটাসোটা হয়েছে। আগে তো রুগ্ন ছিলো। এখন আগের তুলনায় ভালোই হয়েছে। অনেকদিন পর মিলি, বৃষ্টি দুজনের দেখা পেলো তাও একই জায়গায়। তারা দুজন দুজনকে না চিনলেও নুজাইশ তাদের দুজনকেই চেনে। দুজনই তার জীবনের কিছুদিনের আগন্তুক। নুজাইশ নিজের ভাবনাতে নিজেই ভড়কালো। এসব কি ভাবছে সে৷ গাড়ি চালানোতে মন দিলো নুজাইশ। এখন সোজা খান বাড়িতে যাবে তিনজন।

খান বাড়িতে পৌঁছালো তিনজনে। বাইরে জবা ফুলের গাছটার নিচে পাতানো বেতের সোফার ওপরে বসে রাউশি, নাহিন, মাইশা, তানিয়া মিলে লুডু খেলছিলো। গাড়ি থেকে সবাই নেমে পড়লো।মেহরান হেঁটে সামনে রাউশিদের দিকে এগিয়ে গেলো।

এদিকে রাউশিরা গাড়ির আওয়াজ শুনলেও খুব একটা মন দেয় নি। কারণ খেলায় এখন টান টান উত্তেজনা চলছিলো। মেহরান গিয়ে রাউশির পেছনে দাঁড়ালো। রাউশি খেয়াল করে নি। তবে বাকিরা খেয়াল করলো। তবে খুব একটা পাত্তা দিলো না। কারণ খেলায় মত্ত তারা। শেষে রাউশি নাহিনের সাথে পারলো না। তবে দ্বিতীয় হয়েছে।

নুজাইশও আসলো তখন। নাহিন চেঁচাচ্ছে। ‘আমি জিতেছি, আমি জিতেছি’ বলে। রাউশি ধমকালো নাহিনকে,
“ভেড়ার মতো ভ্যা ভ্যা করিস না।”

“দেখো মেহরান ভাই। তোমার বউ আমায় হিংসে করছে।”

রাউশির খেয়ালে আসলো মেহরানকে। পেছনে ঘুরে মেহরানকে দেখলো। এদিকে নুজাইশ এগিয়ে আসতেই মাইশা নুজাইশকে দেখে একদম শকড। সে তো নুজাইশের ওপরে ক্রাশড।

রাউশিও নুজাইশের দিকে তাকালো। সালাম জানিয়ে বলল,
“কেমন আছেন নুজাইশ?”

নুজাইশকে নাম ধরে ডাকতে দেখে মাইশা বলল,
“কি বলছো রাউশি আপু? উনি তোমার স্যার? নাম ধরে ডাকছো যে?”

রাউশি হাসলো। নুজাইশই উত্তর করলো,
“আমিই বলেছি তাকে।”

তুষার নুজাইশের দিকে তাকালো। মাথা নিচে নামিয়ে একটা হাসি দিলো তুষার। নুজাইশের এই ভালোবাসার বিষয়ে মেহরান বাদে তুষারও জানে। নুজাইশ যে তার বন্ধু এ নিয়ে মাঝে মাঝে তুষার গর্ববোধ করে। এই ছেলে কিভাবে চোখের সামনে বন্ধু আর প্রিয়তমাকে একসাথে দেখতে পারে। এটাই ভাবে তুষার। কতটা সাহস আর কঠিন হলে এটা পারা যায়!

মেহরান রাউশির পেছনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“চল রাউশি।”

রাউশি পেছনে তাকিয়ে মেহরানকে বলল,
“কোথায়?”

তুষার উত্তর করলো,
“আরেহ রাউশি গিয়ে তো দেখো। চলো সবাই চলো।”

রাউশি বুঝতে পারলো না কোথায় নিয়ে যেতে চাই এরা তাকে। মেহরান রাউশির হাত ধরে রাউশির সে অবস্থাতেই গাড়ির কাছে নিয়ে গেলো। রাউশি শাড়ি বদলে লাল টকটকে একটি জামা পরিহিত ছিলো। গাড়ির কাছে এসে মেহরান নুজাইশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোরা আয়। বাকিদেরও নিয়ে আসিস।”

চলবে…..