প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব-০৯

0
5

#প্রথম_ভালোবাসার_সুর❤️
#লেখনীতে:অনুসা_রাত(ছদ্মনাম)
#পর্ব:০৯

-“তোমাকে তো পাক্কা রাঁধুনি লাগছে ভাবী।”

মীরার কথায় মেহের হেসে ফেললো।শাহীন খানও তাল মিলিয়ে বললেন,

-“একদম ঠিক বলেছিস মীরা।শেহনাজ,এবার বলো।কেমন লাগছে বউমার হাতের রান্না।”

শেহনাজ পারভীনের মুখ বেশ গম্ভীর। উনি খেতে খেতে বললেন,

-“খাওয়ার সময় কথা বলা আমার একদমই পছন্দ না।বাজে অভ্যাস।”

মেহের এটা শুনে মনে মনে ভাবলো,

-“এটা আমারও পছন্দ না।”

মীরা তার মায়ের কথাটা এত পাত্তা দিল না।আরবাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,

-“ভাইয়া!কেমন লাগলো ভাবীর হাতের রান্না?”

আরবাজ খাবার থেকে চোখ সরালো।মীরার দিকে একবার তাকিয়ে পাশে থাকা মেহেরের দিকে তাকালো।মেহেরও আরবাজের উত্তরের অপেক্ষায় তার মুখপানে চেয়ে আছে।আরবাজ ধীর গলায় বললো,

-“খুব সুন্দর!”

মেহের কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকালো আরবাজের দিকে।মীরা তাড়া দিলো,

-“কিরে ভাইয়া?বল!”

আরবাজ চোখ সরিয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“হ্যা ভালো।”

বলে খাওয়ায় মনোযোগ দিল।শাহীন খান খেয়ে উঠে চলে গেলেন।মীরা ফোন দেখতে দেখতে খাচ্ছিল।তা দেখে শেহনাজ পারভীন বললেন,

-“খাওয়ার সময়ও ফোন!ফোনটাই খা না রে মা।”
-“বলছ মা?খেয়ে দেখব?”

বলেই ফিক করে হেসে দিল।শেহনাজ পারভীন চোখ গরম করে তাকালেন মেয়ের দিকে। তারপর হাত ধুয়ে প্লেট টা তুলতে নিলে মেহের বলে উঠলো,

-“আপনি রেখে দিন আন্টি।আমি সব গুছিয়ে তারপর ঘুমাব।”

শেহনাজ পারভীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,

-“আমি করে নিতে পারব।”
-“আপনি রাখুন আন্টি।এই শীতের সময় আপনাকে আর এত রাতে পানি ধরতে হবে না।আপনি রাখুন,আমি করে দিব ”

শেহনাজ পারভীন তবুও প্লেটটা তুললে মীরা বলতে লাগলো,

-“রেখে দাও মা।ভাবী যেহেতু বলছে।”

শেহনাজ পারভীন রেখে দিলেন।মীরার দিকে তাকিয়েই বললেন,

-“প্রথম প্রথম এসব সবাই করে।দেখব নে এসব কতদিন থাকে।”

বলেই চলে গেলেন ঘরের দিকে।মীরা সেটা শুনে মেহেরের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচালো।মেহের হালকা হাসলো।এখন আর তার শ্বাশুড়ির কথাগুলো গায়ে লাগে না।একে একে সবাই খেয়ে উঠে গেল।
আরবাজ নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।এক ঘন্টা কেটে যাওয়ার পরেও মেহের আসছে না দেখে আরবাজের খুব রাগ হলো।
এই মেয়ের জন্য কি সে রাত জেগে অপেক্ষা করবে নাকি?তার সকালে অফিস রয়ে। মেহের আসতে লেট করলে লাইট নিভিয়ে ঘুমাবে কখন!
ভাবতে ভাবতে আরবাজ ঘর থেকে বের হয়ে গেল।রান্নাঘরে গিয়ে মেহেরকে পেল না।আরবাজ বেশ অবাক হলো।কিন্তু ধরে নিল মেহের মীরার ঘরে।
মীরার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো আরবাজ!
যা ভেবেছিলো ঠিক তাই!মেহের মীরার ঘরে বসে বসে কি যেন কথা বলছে।আরবাজ গিয়ে দরজায় নক করলো।মেহের ঘাড় ঘুরিয়ে আরবাজকে দেখে অবাক হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।মীরাও বেশ আশ্চর্য করে জিজ্ঞেস করলো,

-“ভাইয়া তুই এখানে!”

আরবাজ মেহেরের দিকে একবার তাকালো।মেয়েটা এখনো তার দিকেই তাকিয়ে।আরবাজ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

-“এখনো ঘুমাসনি!”
-“এইত ঘুমাব ভাইয়া।তোর কিছু দরকার?কফি খাবি নাকি?”

আরবাজ আমতা আমতা করছে,

-“না আসলে…আব…”
-“কি বল!”

মীরা এবার পুরোটা বুঝতে পারলো।মেহেরের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো।আরবাজ বুঝতে পারছে না যে সে কি বলবে।এখন যদি মেহেরকে ডাকে তাহলে মীরা সেটা কিভাবে নিবে!
মীরা আবার বললো,

-“ভাইয়া?ঠিক আছিস?”
-“হ্যা ঠিক আছি।”
-“তাহলে ঘুমাতে যাচ্ছিস না কেন?”
-“হ্যা যাচ্ছি।”

বলে মেহেরের দিকে একনজর তাকিয়ে আরবাজ চলে গেল।আরবাজ যেতেই মীরা দরজাটা বন্ধ করে দিলো।তারপর দরজার সামনে থেকে নাচতে লাগলো।মেহের অবাক হয়ে বললো,

-“এই মীরা!তোমাকে কি ভূতে ধরেছে নাকি?নাচছো কেন রাত-বিরেতে!”

মীরা তবুও নাচানাচি করেই চলেছে।মেহের এগিয়ে গিয়ে মীরার মাথায় গাট্টা মারতেই মীরা মেহেরের হাত টেনে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,

-“ভাবী!ভাইয়া প্রেমে পড়েছে।”
-“কিসব বলছ মীরা!”
-“আরে যা সত্যি তাই তো বলছি।”
-“তুমি থামো তো আগে।”

বলে মীরাকে থামিয়ে দিলো মেহের। জোরে শ্বাস ছেড়ে বললো,

-“বাপরে!মেয়ে নাকি অন্যকিছু।”

মীরা মেহেরের হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে বললো,

-“আজ তো তোমারই দিন ভাবী।ভাইয়া প্রেমে পড়েছে।”
-“কিসের প্রেমে।কার প্রেমে!”
-“কার আবার তোমার প্রেমে!”
-“ধূর কিসব বলো।”

বলেই মেহের অন্যদিকে তাকালো।মীরা মেহেরের গাল টেনে বললো,

-“আরে হ্যা ভাবী।তুমি বুঝতে পারছ না?”
-“না তো।কি বুঝব।”
-“দেখো ভাইয়া আজকে তোমার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল।”
-“কোথায় না তো।”
-“আরে হ্যা তাকিয়ে ছিল।কেন তুমি দেখো নি?”
-“না তো।উনি আমার দিকে কেন তাকিয়ে থাকবেন।তোমার ভুল হচ্ছে।”
-“কেন তাকাবেন মানে।তোমার দিকেই তো তাকাবে।তুমিই তো ওর বউ।আর তাছাড়া আজ তোমাকে ভীষণই সুন্দর লাগছে।”
-“আজাইরা কথা।”
-“আরে সত্যি।তারপর দেখো তুমি এঘরে ঘুমাতে এলে বলে তোমায় নিতে এলো।”

একথাটা শুনে মেহের থেমে গেল।এতক্ষণ না না করলেও মীরার একথাটা তার কেমন একটা লাগলো।বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো।

-“যাহ।আমাকে কেন নিতে আসবে?”
-“হ্যা।তোমাকে ছাড়া ভাইয়া হয়ত ঘুমাতে পারে না।আহারে।বেচারা আমার ভাইটা।”
-“ম..মোটেও না।”
-“তুমি সামান্য সত্যি কথাটা মেনে নিতে চাইছ না কেন বলোতো?ভাইয়া কখনোই রাতে আমার ঘরে আসেনা।ঘুমিয়ে যায়। সকালে অফিস তাই।”
-“ধূর চুপ করো তো।ঘুমাও।”

বলেই মেহের শুয়ে পড়লো।মীরা নিজে নিজেই বলতে লাগলো,

-“আহা!কি ভালোবাসা!হয় হয় প্রথম প্রেমে পড়লে এমনই হয়।আমার ভাইয়ারও হয়েছে!”
-“তুমি ঘুমাবে?”

মেহেরের কথা শুনে মীরা শুয়ে পড়লো।মেহেরের বুকটা কেমন ধক ধক করছে।চুপচাপ চোখ বন্ধ করতেই আরবাজের মুখটা ভেসে উঠলো।আজ তার দিকে তাকিয়ে ছিল।মেহের আবারো চোখ খুললো।জোরে একটা শ্বাস নিয়ে আবারো চেষ্টা করতে লাগলো ঘুমানোর।
এদিকে ঘরে এসে আরবাজ ধুপ ধাপ আওয়াজে বিছানায় শুয়ে পড়লো লাইট নিভিয়ে। কম্বল গায়ে দিতে দিতে নিজে নিজেই বললো,

-“আমার ঘরে রাত-বিরেতে আসা চলবে না। আমারো সকালে কাজ রয়েছে।এতই গল্প করার ইচ্ছে থাকলে সারাদিন করতে পারে না?রাত-বিরেতে করতে হয়!অসহ্যকর।”

আরবাজ কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়লো।কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসছে না।চোখ বন্ধ করলেই মেহেরের মুখটা ভেসে উঠছে।আজকে মেহেরকে বেশ আলাদা লাগছিল।কোমড়ে আঁচল গুঁজে চুলগুলো এলোমেলো। আরবাজের বারবার মেহেরের সেই রূপটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।আরবাজ বিরবির করলো,

-“কি হচ্ছে টা কি আমার সাথে!এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবা বন্ধ করতে হবে।”

পরক্ষনেই আবার বলতে লাগলো,

-“মেহের এখনো কেন এলো না?আচ্ছা ওকি এখানে ঘুমাবে না তারমানে?”

আরবাজের হঠাৎ গতকালের কথা মনে হলো।মেহের তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল।আরবাজের হাত চলে গেলো তার ঘাড়ে।ঘাড়ের ব্যাথাটা এখন আর নেই।আরবাজ সোফার দিকে তাকিয়ে রইলো।মেহের আজ এখানে নেই।তারমানে কি মেহের এখানে আর আসবে না?
আরবাজ উঠে বসলো।নিজে নিজে বলতে লাগলো,

-“মেহের কি এখন থেকে মীরার ঘরে থাকবে?কেন?
আমি সোফায় ঘুমাতে বলি তাই?কিন্তু ওর সাহস কি করে হলো এটা করার।আমাকে বলেছিল একবারো?
যাই করুক!একবার বলে তো যাবে যে আজ থেকে আর এখানে ঘুমাবে না মীরার সাথে থাকবে।ও যা ইচ্ছে করুক আর যার সাথেই থাকুক,আই ডোন্ট কেয়ার।কিন্তু আমাকে বলার প্রয়োজনবোধ করলো না!
আমার ঘরে থাকে অথচ আমাকে কি ইগনোর করলো!
ওর এত বড় সাহস!”

ভাবতেই আরবাজের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।বিছানার উপর হাত দিয়ে জোরে আঘাত করে বললো,

-“ফালতু মেয়ে একটা।আর আমিই বা কেন ভাবছি ওকে নিয়ে এত!”

ভেবেই আরবাজ শুয়ে পড়লো।ফোন বের করে দেখলো অলমোস্ট ১২:৩০ বেজে গেছে। তার সকাল ৭ টায় উঠতে হবে।আরবাজ বিরক্ত হয়ে বললো,

-“এত বেজে গেছে আর আমার ঘুম ই আসছে না।”

আরবাজ নেট অন করলো।ভাবলো কিছু সময় ফেসবুকিং করবে।হঠাৎ আরবাজের সামনে একটা হাসিমাখা প্রোফাইলের পিকচার চলে এলো।মেহেরেরই পিক।কিন্তু তাকে চেনাই যাচ্ছে না।আরবাজ অবাক হয়ে দেখছে।নিচে নাম লেখা,’মেহের আফরিন আলিশা’

আরবাজ বিরবির করলো,

-“মেহের আফরিন আলিশা।বাহ।”

মেহেরের আইডিতে ক্লিক করলো আরবাজ।আইডি লক করা না।তাই অনেকগুলো ছবি দেখতে পেল আরবাজ।মেহেরের কলেজের নবীণ বরণ থেকে শুরু করে অনেক অনেক ছবি।এতে আবার অনেকেট কমেন্ট আর মেহেরের দুষ্টুমি।আরবাজের বেশ রাগ হলো।সারাদিন কি এসব করা নিয়েই ব্যস্ত থাকত নাকি এই মেয়ে? আর এত এত ছেলে বন্ধু।একটা গ্রুপ পিকচারও পেল আরবাজ।সেখানে মেহেরের পাশে দুই দুইটা ছেলে।আরবাজের ভ্রু কুঁচকে গেল।বিরবির করে বললো,

-“দেখতে তো লাগে সতীসাবিত্রী।”

মেহেরের কিছু ছবিতে আরবাজের চোখ আটকে গেল।
না চাইতেও আরবাজ কিছু ছবি সেভ করে ফেললো।
আর কি ভেবে যেন এড ফ্রেন্ডে ক্লিক করে দিলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পৌনে দুইটা বাজে।আরবাজ তাড়াতাড়ি করে ফোন রেখে ঘুমিয়ে গেল।
সকাল বেলা মেহেরের ঘুম ভাঙতেই সে প্রথমে নামাজের জন্য ডাকলো মীরাকে।দুজনে নামাজা পড়ে নিল।মীরা আবারো ঘুমাতে চলে গেল।আর মেহের কুরআন শরীফ পড়লো অনেক সময়।তারপর চলে গেল রান্নাঘরে।নাশতার জন্য গরম পানি বসিয়ে মীরা ভাবলো আরবাজ কি উঠেছে?
এসব ভেবে মীরা আরবাজের ঘরের সামনে গিয়ে দেখলো আরবাজের ঘরের দরজা খোলা।
তবে কি গতকাল দরজা খোলা ছেড়ে ঘুমিয়ে গেছিল?
এত ঠান্ডায় আরবাজ এসি ছেড়ে রেখেছে।
এগিয়ে গিয়ে দেখলো বিছানা খালি।আর ওয়াশরুম থেকে শব্দ আসছে।তারমানে আরবাজ ওয়াশরুমে গিয়েছে।
মেহের সুন্দর করে আরবাজের বিছানাটা গুছিয়ে দিল।তারপর আরবাজের জামা-কাপড় বের করে সে চলে গেল রান্নাঘরে।
এদিকে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আরবাজ দেখতে পেল তার পুরো ঘর গুছানো আর বিছানায় তার প্রয়োজনীয় সবকিছু রাখা।আরবাজ অবাক হয়ে গেল।আর বিরবির করে বললো,

-“বাহ!বউ আসার তো একটা ভালো দিকও আছে!এত সেবা-যত্ন পাইনি তো কখনো।”

চলবে…..