#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৩
#লেখিকা_তাসফিয়াহ_আনজুম
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল তিন সপ্তাহ। বিয়ের আরো এক সপ্তাহ বাকি। ঝুমুরের বাবা চেয়েছিল মেয়ের পরীক্ষার পর বিয়েটা হবে। কিন্তু ওয়াহিদের বড় ভাই ওয়ালিদের স্ত্রী প্রেগনেন্ট হওয়ার তার মা কয়েক মাসের জন্য বড় ছেলের কাছে যাবেন।আর মেয়ে যেহেতু পছন্দ করাই তাই আর দেরি করতে চাচ্ছেন না তারা। ঝুমুরের কলেজ আর কোচিং সেন্টার বেশ কাছেই ওয়াহিদদের বাসা থেকে। এছাড়াও ওয়াহিদের বাবা নিজেই যেহেতু ঝুমুরের কলেজের প্রফেসর তাই ঝুমুরের বাবা আর না করতে পারেন না। এখন হোক অথবা দু বছর পরে মেয়ে সুখি হলেই বাবা-মায়ের শান্তি ।
বছর খানিক আগে,
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। কম্বল মুড়ি দিয়ে বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে ঝুমুর। আজ তাদের কলেজে নবীন বরণ অনুষ্ঠান।প্রচন্ড উত্তেজনায় আর করেছে নিদ্রাহীন রাত্রি। শুয়ে শুয়ে ভাবছি কি কি করবে।কেয়া আর তার একই রকম শাড়ি পরার কথা ছিল। অনলাইন পেইজ থেকে শাড়িও পছন্দ করেছিল তারা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের হাতে সময় কম থাকায় আর নিতে পারলো না।
“কিরে তুই এখনো শুয়ে আছিস! রেডি হবি কখন?”
মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে দেখলো একদম সেজেগুজে সবুজ পরি হয়ে হাজির কেয়া।” আরে বাহ দোস্ত! তোকে তো হেব্বি লাগছে!” কেয়াকে দেখেই বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো ঝুমুর।
“হইছে আর পাম দেয়া লাগবে না। তাড়াতাড়ি রেডি হ!”বলে একরকম ধাক্কা দিয়ে ঝুমুরকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিল কেয়া। কেয়ার সঙ্গে ঝুমুরের বন্ধুত্ব ছোটবেলা থেকেই।কেয়া মেয়েটার গায়ের রং কিছুটা শ্যামলা। তবে গোলগাল চেহারার ছোটখাটো মেয়েটাকে দেখতে বেশ মিষ্টি লাগে।
মায়ের একটা সোনালী পাড়ের গাঢ় নীল শাড়ি পড়ে নিল ঝুমুর।হালকা সাজগোজ করলো। পিঠময় ছড়িয়ে দিল লম্বা কেশ। তাদের দুই বান্ধবীকেই আজ খুব সুন্দর লাগছে। বাড়িতে থেকে বের হতে এগারোটা বেজে গেল। অনুষ্ঠান শুরু হবে বারোটার পর।দুজনেই রিক্সায় চড়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ঝুমুর ঠিক করল আজ দুই বান্ধবী বাইরের থেকে খেয়ে আরেকটু ঘুরাঘুরি করে বাসায় ফিরবে। বাড়ি থেকে অনুমতিও নিয়ে নিল। প্রথমে কেয়া রাজি না হলেও ঝুমুরের জোরাজুরিতে শেষমেষ আর না করতে পারলে না। যেই ভাবা সেই কাজ।
ঝুমুর আর কেয়া একটা রিক্সা নিয়ে তাদের শহরের বেশ নামকরা একটা রেস্টুরেন্টে চলে গেল। ভেতরে ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল দুজনার,বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট দিনের বেলার চাইতে রাতে বেশি সুন্দর দেখায়। চারপাশে হালকা লাইটিং, বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের একুরিয়াম, আবার খুব সফট মিউজিক চলছে ব্যাকগ্রাউন্ডে সবমিলিয়ে পরিবেশটা বেশ চমৎকার হয়ে উঠেছে। খাওয়া-দাওয়া, গল্প গুজব শেষ করতে করতে প্রায় দুই ঘন্টা লেগে গেল। বিল মিটিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো রিক্সার খোঁজে। একটাও খালি রিক্সা আসছে না, আর যা কয়েকটা আসছে তা অন্যদিকে যাবে। তাই উপায় না পেয়ে হাঁটতে শুরু করল দুজন।
******
হাটতে গিয়ে ঘটলো আরেক বিপত্তি! ইটের সাথে ধাক্কা লেগে ঝুমুরের একটা জুতা ছিড়ে গেল। কি করবে বুঝতে না পেরে ব্যাগটা রাস্তার পাশেই রেখে জুতাজোড়া খুলে নিল। যেই ব্যাগটা ধরতে যাবে অমনি পেছন থেকে একটা কুকুর এসে ব্যাগটা নিয়ে দিল দৌড়। প্রথম কয়েক সেকেন্ড ঝুমুর ঠাই দাঁড়িয়ে রইল।যেন সব মাথার উপর দিয়ে গেল সব। পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কুকুরের পেছনে পেছনে সে ও দৌড়াতে লাগলো।আর পেছনে কেয়া দৌড়াচ্ছে ঝুমুরকে ধরার জন্য।
“এই আমার ব্যাগ, আমার মোবাইল!” দিয়ে যা।চিল্লাতে চিল্লাতে বলতে লাগলো ঝুমুর।কিন্তু কে শোনে কার কথা!
চারদিকে অন্ধকার আর শুনশান নীরবতা। রাত এখনো বেশি হয়নি তবে অন্য দিনের তুলনায় আজকে রাস্তায় গাড়ি খুবই কম। এক বন্ধুর বাসায় পার্টি থাকায় আজ বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়েছে ওয়াহিদের। সাধারণত যেদিন তার ডিউটি থাকে না সেদিন সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই বাসায় ফিরে। যাওয়ার সময় গাড়ি নেয়নি বিধায় বন্ধুর বাইক নিয়ে বাসায় ফিরছিল সে। রাতের শুনশান রাস্তায় বাইক চালাতে খুব ভালোই লাগছিল। কিন্তু হঠাৎ দেখলো কেউ তার দিকেই দৌড়ে আসছে। সে ততক্ষণাৎ বাইকের গতি কিছুটা কমিয়ে আনতে পারলেও পুরোপুরি থামিয়ে উঠতে পারলো না তার আগেই বাইকসহ পড়ে গেল। সামনে সেই দৌড়ে আসা মেয়েটাকে পড়ে থাকতে দেখে, উঠে তাকে তুলে ধরে হাতে পায়ে কোনো আঘাত পেয়েছে কিনা এক নজরে দেখে নিল। মুখে চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় মুখে ক্ষত আছে কিনা দেখতে পারলো না।হাত বাড়িয়ে মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল। হালকা সোডিয়াম আলোয় চিকচিক করছিল মুখটা। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ছাড়া আর কোনো সাজসজ্জা নেই পুরো মুখ জুড়ে। তবুও যেন চোখের পলক না ফেলে দেখার মত মায়াবতী দেখাচ্ছিল মেয়েটাকে। কয়েক সেকেন্ড এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো ওয়াহিদ।
এরই মধ্যে দৌড়াতে দৌড়াতে কেয়া সেখানে হাজির হলো। ঝুমুরকে এই অবস্থায় দেখে চিৎকার করে উঠলো কেয়া। কেয়ার গলার আওয়াজে ধ্যান ভাঙল ওয়াহিদের।
কেয়াকে শান্ত করতে বলে উঠলো, “দেখুন ভয় পাবেন না। কিছু হয়নি। শুধু ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
ওহ আচ্ছা। কিন্তু এখন কি করবো? এই অবস্থায় বাসায় নিয়ে যাবো কি করে!
দাঁড়ান আমি দেখছি। বলে ঝুমুরকে কোলে তুলে নিল।
কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
আসুন আমার সাথে।
কেয়া আর কথা না বাড়িয়ে ওয়াহিদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলো।
একটু সামনে গিয়ে একটা যাত্রী ছাউনীর ভিতর ঢুকে ঝুমুরকে একটা বেঞ্চের মধ্যে শুইয়ে দিল।কল করে কার সাথে যেন কথা বললো।
কেয়ার এবার ভয় লাগতে শুরু করলো। অচেনা একজন লোককে বিশ্বাস করা কি ঠিক হচ্ছে তার? কিন্তু কি বা আর করবে! তার ভাবনার মাঝেই একটা গাড়ি এসে থামলো ওদের সামনে। গাড়ির ভেতর থেকে একটা মধ্যবয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো একটা পানি বোতল নিয়ে। ওয়াহিদ বোতল থেকে কিছুটা পানি নিয়ে ঝুমুরের মুখে ছিটিয়ে দিলো। ঝুমুরের জ্ঞান ফিরে এলো। উঠে পাশে দু’জন লোক দেখে চমক উঠে বলল,
“ওনারা কারা? আর আমরা এখানে কিভাবে আসলাম?”
পড়ে বলবো সব। এখন বাসায় চল।সবাই চিন্তা করছে হয়তো। বলে ঝুমুরের হাত ধরে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালো।
দাঁড়ান। এখন হয়তো গাড়ি পাবেন না। গাড়ি বসুন আমি বাসায় যাওয়ার পথে নামিয়ে দিব।
কেন? আপনার গাড়ি দিয়ে যাব কেন? আমরা হেঁটেই যেতে পারবো। বলে কেয়া কে টেনে নিয়ে হাঁটা শুরু করল ঝুমুর। কেয়া ঝুমুরকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আরে থাম! এখন তো গাড়িও পাব না,আর হেঁটে যেতেও অনেক সময় লাগবে।আয় বলছে যখন চলে যাই গাড়িটা দিয়ে,আর উনি তো বলল যাওয়ার পথে নামিয়ে দেবে তাহলে আর সমস্যা কোথায়? এমনিতেও লোকটা ভালো।
কিহ! কয়েক মিনিটেই একজন মানুষকে চিনে ফেললি? বাহ!
তোকে পড়ে সব খুলে বলব। এখন আয়,বলে ঝুমুরকে টেনে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো দু’জনে।
চলবে..?