প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-০৬

0
6

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_৬
#লেখিকা_তাসফিয়াহ_আনজুম

সকাল থেকেই বাইরে শব্দ করে বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে। বৃষ্টির তোপে চারপাশটা বেশ অন্ধকারচ্ছন্ন। ঝুমুরের আজ ঘুম ভেঙ্গলো বেশ সকালেই। ঘুম থেকে উঠে পাশের বালিশটা ফাঁকা দেখতে পেয়ে কিছুটা স্বস্তি পেল। এই মানুষটা আশেপাশে না থাকলেই ভালো। সামনে থাকলেই শুধু কিভাবে তাকে লজ্জা দেয়া যায় তাই ভাবতে থাকে। বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিল বৃষ্টির কয়েকটা ফোঁটা। মানুষের সব মন খারাপ যেমন আকাশে গিয়ে মেঘ হয়ে জমে, তেমনি তা আবার বৃষ্টির ফোটা হয়ে গড়িয়ে পড়ে তাদের প্রফুল্ল করে তোলে। আজ যেন তেমনই মন ভালো করার বৃষ্টি নেমেছে এই ধরাধামে। গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো ঝুমুর,

এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকে না তো মন
কাছে যাব কবে পাব
ওগো তোমার নিমন্ত্রন

এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকে না তো মন
কাছে যাব কবে পাব
ওগো তোমার নিমন্ত্রন…..

হঠাৎ কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকালো ঝুমুর। সাদা টি-শার্ট নেভি ব্লু ট্রাউজার পড়ে ভিজে একাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াহিদ। পুরোপুরি ভিজে যাওয়ার কারণে সাদা টি-শার্টের উপরে ফুটে উঠেছে বলিষ্ঠ দেহ। চুল থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে ফ্লোরে। ঝুমুর সেদিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিল। ফ্লোরে পড়ে আছে ওয়াহিদের হাতের ঘড়িটা। ওয়াহিদ ধীরে ধীরে ঝুমুরের দিকে এগিয়ে আসলো, “বাহ, তুমি এতো সুন্দর গান গাইতে পারো! আমি তো জানতামই না।”
জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে ঝুমুরের মুখে বৃষ্টির ফোটা এসে পড়েছিল। ওয়াহিদ আলতো হাতে তা মুছে দিতে দিতে বলল কথাগুলো। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে কেঁপে উঠলো ঝুমুর। আচমকা ওয়াহিদের হাতটা সড়িয়ে দিয়ে বলে, “দেখুন বারবার আমাকে ছুঁবেন না। এতো কাছেও আসবেন না।”
“আচ্ছা! ছুঁবো না তো অন্য কিছু করবো? আমার বিয়ে করা বউয়ের কাছাকাছি আসবো না তো কি পাশের বাসার ভাবির কাছে যাবো!” বেশ গম্ভীর হয়ে বলে ওয়াহিদ।
শান্ত পরিস্থিতিতেও ফিক করে হেসে ফেললো ঝুমুর। হাসতে হাসতে বলে,”হ্যাঁ তাই করুন।”
ওহ আচ্ছা তাই! খুব হাসি পাচ্ছে?

ওয়াহিদের খুব ভোরেই ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। অভ্যাসবশত সকালে ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে বেরিয়েছিল।রাস্তায় থাকতেই বৃষ্টির শুরু হওয়ায় ভিজে গেছে সে। স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুব সচেতন সে। নিয়মিত ব্যায়াম, খাবার সবকিছুতেই বেশ সচেতন সে। ডাক্তার বলে কথা!

_______

ওয়াহিদদের বাড়িতে আজ প্রথম সকাল ঝুমুরের। সবাই একসাথে নাস্তা করতে বসেছে। ওয়াহিদ আর ঝুমুর সবার পরে নাস্তা টেবিলের কি উপস্থিত হয়। বাকি তাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ঝুমুর নাস্তার টেবিলের সামনে গিয়ে ওয়াহিদের বাবাকে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছিস মা? কোনো সমস্যা হয়নি তো আমাদের বাড়িতে?”
না আঙ্কেল।
কিরে আমি তোর আঙ্কেল? কোথায় ভাবলাম আমার তো মেয়ে নেই তোকেই আমার মেয়ে বানাবো। থাক কি আর করার!
সরি বাবা।আমি বুঝতে পারি নি। ঝুমুর মাথা নিচু করে রেখে বললো।
আরে ধুর বোকা মেয়ে। বাবাকে কেউ সরি বলে! আয় আমার সাথে বস বলে ঝুমুরকে টেনে নিয়ে নিজের পাশের চেয়ারটাতে বসালো।
আচ্ছা একটা কথা শোন। বিয়ে হয়ে গেছে বলে ভাবিস না যে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে। তা কিন্তু হবে না। এতদিন তো শুধু আমি তোর স্যার ছিলাম এখন আবার বাবাও হয়ে গেছি। তাই কোন ফাঁকি দেয়া যাবে না। দুইদিন রেস্ট করে পরশু থেকে কলেজ যেতে হবে কিন্তু। সামনেই তো আবার পরীক্ষা।
ঝুমুর মুখে কিছু বলল না শুধু মাথা নাড়িয়ে সায় জানানো।
এই নাস্তার টেবিলে বসে কি শুরু করলে বলতো। এত কথা না বলে এখন খাও। আর সব সময় স্যারদের মতো কথাবার্তা বলবে না। একটু শ্বশুরের মত ব্যবহার করো। ওয়াহিদের বাবার কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বললেন শায়লা বেগম।
তার কথাই হেসে উঠলেন শাকিল শেখ। হাসতে হাসতে বললেন, তো তুমি কি চাও আমি ওই সিরিয়ালের শ্বশুরদের মতো ট্রিপিক্যাল শ্বশুর হই? যে সারাদিন বলবো এই বৌমার যাও রান্না করো, ঘর থেকে একটুও বাইরে যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। তুমি তো আমাকে মিষ্টি কিছুই খেতে দাও না,যা একটু চিনি দিয়ে চা টা খাই পরে দেখা গেল শশুর সাজতে গেলে তোমার বৌমা আমাকে সেটাও দিচ্ছে না। থাক বাবা শশুর হওয়া লাগবে না আমি বাবা’ই ঠিক আছি।
তার কথায় হেঁসে উঠল সবাই। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম ঝুমুরের মুখে হাসি রেখা ফুটে উঠলো।
ঝুমুর কে দেখে শাকিল সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, সারা জীবন এমন হাসি খুশি থাকো মা। আমাদের এই বাড়িটাকে আর বাড়ির মানুষগুলোকে আপন করে নাও।
ওহ আর একটা কথা,কাল কিন্তু রিসিপশন। মনে আছে তো তোমার ওয়াহিদ?
হুম আব্বু। আমি আমার কলিগদের আগেই ইনভাইট করেছি। আর ডেকোরেশন মেনেজমেন্ট এর সাথেও কথা বলে রেখেছি।
আচ্ছা ঠিক আছে। আজ কি হসপিটাল যাবে?
হুম।
আজ না গেলেও পারতে। তুমি চাইলেই তো কয়েকদিন ছুটি নিতে পারতে।
না তার প্রয়োজন নেই। এখন এমনিতেও কয়েকজন ডাক্তার ছুটিতে আছেন।
ওহ। আচ্ছা তুমি যা ভালো মনে কর তাই কর।
নাস্তা শেষ করে ওয়াহিদ আর শাকিল শেখ যে যার উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লো।

________

ওয়াহিদ আর শাকিল শেখ চলে যাওয়ার পর ঝুমুর আর শায়লা বেগম একাই রইল বাড়িতে। ঝুমুরকে পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখালো শায়লা বেগম। বাড়ির ভেতরটা দেখানো শেষ হলে বাড়ির পাশের বাগানে নিয়ে গেল। বাগানের ভিতর ঢুকে হা হয়ে গেল ঝুমুর। চারদিকে নানা ধরনের ফুল, ফল আর শাক সবজির গাছ।এতো গাছ আপনি করছেন আন্টি?
বাহ্! ওয়াহিদের বাবা তোর আর বাবা আর আমি তোর আন্টি?
আসলে মনে ছিল না,আমতা আমতা করে বলে ঝুমুর।
আচ্ছা পরের থেকে মনে থাকে যেন! আর আমাকে আপনি বলতে হবে না তুমি করে বলবি।কন্ঠে গম্ভীর ভাব এনে বলল শায়লা বেগম।
ঝুমুর শায়লা বেগমের কথায় বললো,” জি আচ্ছা আন্টি…না আম্মু।”
হেঁসে উঠলো শাশুড়ি বৌমা দুজনেই।

শোন ফুল গাছগুলো সব ওয়াহিদের লাগানো। ও নিজেই এগুলোর যত্ন করে, পানি দেয়,আগাছা পরিষ্কার করে। ছোটবেলা থেকে ওর এগুলোর প্রতি ভীষণ শখ। ওর গাছে কারোর টোকা ও সহ্য করতে পারে না। আর ওই সবজি আর ফলগাছ গুলোর দেখাশোনার জন্য একজন লোক আছে। এগুলোও ওয়াহিদ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু ও তো তেমন সময় পায় না।
ওহ।
হুম। আর আমার ছেলে শুধু তার গাছের প্রতি যত্নশীল না।ওর আমাদের সবার প্রতি ভীষণ যত্নশীল, ছোটবেলা থেকে খুব দায়িত্ববান। আমার বিশ্বাস আমার ছেলে খুব ভালো স্বামী হবে। ও তোর কোনো অযত্ন করবে না।
হঠাৎ ঘরের ভেতর ফোনটা বেজে উঠলে শায়লা বেগমের। ঝুমুরকে আরো কিছুক্ষণ ঘুরে দেখতে বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। ঝুমুর হেঁটে হেঁটে ফুলের গাছগুলো দেখতে লাগলো। মাঝে মাঝে কিছু ফুল ছুঁয়েও দেখলো। ফুল যে তার ও ভীষণ প্রিয়। আচমকাই ঝুমুরের মনে হলো এই ফুল বাগানের মালিকটাও ধীরে ধীরে তার প্রিয় হয়ে উঠছে।

চলবে।