প্রেমময়ী সন্ধ্যা পর্ব-২৫+২৬

0
3

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পরৃব_২৫
#লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

ঝুমুরের পরীক্ষা শুরু হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার দিন শুরু হয় পড়ার টেবিলে। বই-খাতা ছাড়া যেন কিছুই মাথায় থাকে না। ওয়াহিদ এ সময় বাসায় বেশি সময় কাটায়। ঝুমুরের মা হাসতে হাসতে বলতেন, “এবার মনে হচ্ছে আমার মেয়েটা পড়াশোনা ঠিকঠাক করবে,ওয়াহিদ নিজে ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে বলে কথা !”

ওয়াহিদ ঝুমুরের পড়াশোনার প্রতি অসম্ভব যত্নশীল। প্রতিদিন সকালে ঝুমুরের জন্য নিজের হাতে নাস্তা বানিয়ে নিয়ে আসে। পড়ার ফাঁকে এক চামচ মধু মিশিয়ে লেবু পানি কিংবা হালকা স্যুপ এনে বলে, “খেয়ে নাও, মাথা ঠান্ডা থাকবে। পরীক্ষার সময় শক্তি থাকা দরকার।” ঝুমুর মাঝে মাঝে রাগ করে বলে, “আপনার এসব বেশি বেশি কেয়ার আমাকে আরো টেনশনে ফেলে দিচ্ছে।”

ওয়াহিদ হেসে বলত, “আমি কেয়ার করি বলে টেনশন বাড়বে? বরং এটা ভাবো, আমি আছি বলে তোমার টেনশন কমবে।” ঝুমুর কোনো জবাব দিত না, চুপচাপ চুপচাপ শুনে নেয়।

রাতে ঝুমুর যখন দীর্ঘক্ষণ পড়তে বসত, ওয়াহিদ তখন টেবিলের এক পাশে বসে থাকত। কোন জায়গায় সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে বোঝাত। ঝুমুর বলত, “আপনার এত ধৈর্য কোথায় পেয়েছেন?” ওয়াহিদ মৃদু হেসে বলত, “তোমার জন্য ধৈর্য দরকার, ঝুমুর। তুমিই আমার প্রথম শেষ এবং একমাত্র প্রিয় ছাত্রী।”

একদিন পরীক্ষার আগের রাতে ঝুমুর খুব টেনশনে ছিল। ওয়াহিদ তার পাশে এসে বলল, “কী হলো? এত চিন্তিত কেন?” ঝুমুর বলল, “কিছুই মনে থাকছে না। মনে হচ্ছে আমি সব ভুলে গেছি।”

ওয়াহিদ একটু এগিয়ে এসে বলল, “তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার মতো এত ভালো প্রিপারেশন নিয়েও যখন কেউ এ কথা বলে, তখন সেটা শুধু অযথা চিন্তা। চলো, একটু হাঁটতে যাই, মাথা হালকা হবে।”

দুজনে বাসার সামনের খোলা জায়গায় হাঁটতে বের হলো। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল, আর আকাশে ছিল অসংখ্য তারা। ঝুমুর একটু ভালো লাগা নিয়ে বলল, “আপনি সবকিছু এত সহজ করে দেন। জানেন, আমার পরীক্ষার এই সময়টা এত সুন্দর কাটবে, কখনো ভাবিনি।”

ওয়াহিদ হেসে বলল, “তোমার এই সুন্দর সময়টা আরও সুন্দর করতে চাই। তোমার স্বপ্ন পূরণ করার দিন আসছে, আর সেটা দেখার জন্য আমি সবসময় পাশে থাকব।”

পরীক্ষার দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। ঝুমুর ওয়াহিদের এই যত্নের জন্য একদিকে কৃতজ্ঞ, আবার অন্যদিকে তার এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতি অজান্তেই বারবার মুগ্ধ হয়ে পড়ে। যদিও সে কিছুই প্রকাশ করত না, কিন্তু তার চোখের গভীরতায় সবটাই স্পষ্ট হয়ে উঠত।

এভাবেই জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে ওয়াহিদ যেন ঝুমুরের জন্য হয়ে উঠছিল এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

*

দুই মাস কেটে গেল। নিরবদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আর এখন সবাই কিছুটা অলস সময় কাটাচ্ছে। পড়ালেখার চাপ নেই, তাই সময়টা যেন কিছুটা স্থবির হয়ে আছে। একদিন সন্ধ্যায় নীরব আর আদিল তাদের রুমে বসে কথা বলছিল। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।

নিরব উঠে গিয়ে দরজা খুলল। দরজা খোলার পর যা দেখল, তাতে সে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। আফরা দাঁড়িয়ে আছে। হালকা শাড়িতে চেহারায় যেন ক্লান্তি, কিন্তু চোখে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।

নিরব অবাক হয়ে বলল, “আপনি এখানে? এতদিন পর হঠাৎ?”

আফরা চুপচাপ এক পা এগিয়ে এলো। তার চোখে ছিল একধরনের অপ্রতিরোধ্য স্পষ্টতা। কোনো ভণিতা ছাড়াই সে সরাসরি বলল, “নিরব, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। বিয়ে করবে আমায়?”

নিরব যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। মনে হলো, এ যেন কোনো স্বপ্ন।

আদিল পাশ থেকে হাসতে হাসতে বলল, “নিরব, স্বপ্নে নয়, বাস্তবে যা দেখছিস!”

নিরব ধীর গলায় বলল, “আপনি… আপনি এটা সত্যিই বলছেন?”

আফরা মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ, নিরব। আমি অনেক ভেবেছি। তোমার মতো একজনকে আমার জীবনে খুব প্রয়োজন। জীবনে ভালো থাকতে হলে খুব বেশি টাকার প্রয়োজন নেই আমি এটাও জানি। আমি আমার মায়ের পছন্দ করা পাত্র রেখে চলে এসেছি।”

নিরবের চোখ ভিজে উঠল। সে বলল, “আপনি জানেন, আমি আজীবন শুধু আপনার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি। আপনার বলা কথাগুলো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।”

আফরা হেসে বলল, “তাহলে আর দেরি কেন! বলো, তোমার উত্তর কী?”

নিরব গভীর ভালোবাসায় বলল, “হ্যাঁ, আমি আপনাকে বিয়ে করব। সবসময় আপনার পাশে থাকব।”

এই মুহূর্তে যেন তাদের চারপাশে সময় থেমে গেল। দুজনের চোখে ছিল পরস্পরের জন্য নিখুঁত ভালোবাসা আর আত্মবিশ্বাস। আদিল পাশ থেকে মজা করে বলল, “এবার তো বিয়ের প্রস্তুতি নিতে হবে, নাকি?”

নিরব হেসে বলল, “হ্যাঁ, তবে সেটা ধীরে ধীরে।”

কিন্তু নিরবের কথায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আফরা বলে ওঠে,”না নিরব আমরা আজকেই বিয়ে করব।”

নিরব আফরাকে রুমে বসতে বলল। আফরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসল। নিরব দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে তার হাতে দিল। আফরা ধীরে ধীরে পান করছিল, যেন মাথার ভেতর চিন্তাগুলো গুছিয়ে নিতে চাইছে।

নিরব বলল, “আপনার সিদ্ধান্ত এত তাড়াতাড়ি? বাড়ি থেকে পালিয়ে আসলেন কেন?”

আফরা শান্ত গলায় বলল, “মা আমাকে তার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি জানতাম, ওটা আমাকে কখনো সুখ দেবে না। আমি তোমার কথা ভেবেই চলে এসেছি নিরব। যদি আজ বিয়ে না করি, মা নতুন অজুহাত দেখিয়ে আমাকে আবার সেই একই পরিস্থিতিতে ফেলবেন। আমি সেটা আর চাই না, নিরব।”

নিরব কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর বলল, “ঠিক আছে। আপনি আমাকে ভরসা করেছেন, সেটা আমি কখনো ভাঙব না।”

সে দ্রুত ঝুমুর আর কেয়াকে ফোন দিল। ঝুমুর কে বলল ওয়াহিদ কে সঙ্গে নিয়ে আসার কথা। দুই বন্ধু অবাক হলেও কিছু না জিজ্ঞেস করেই আসতে রাজি হলো। মিনিট কয়েকের মধ্যে ঝুমুর ওয়াহিদকে নিয়ে এলো, আর কেয়া একাই হাজির হলো।

সবাই বসার পর নিরব পুরো বিষয়টি সংক্ষেপে জানাল। ঝুমুর বলল, “আপনি আসলেই খুব সাহসী আপু। কিন্তু আমি বলব আপনি সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

কেয়া বলল, “তাহলে দেরি কেন? কাজী অফিসে চল। আজকেই সব শেষ করবি।”

ওয়াহিদ মাথা নেড়ে বলল, “আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি। চল, সবাই একসাথেই যাই।”

সবাই মিলে কাজী অফিসে গিয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করল। ছোট পরিসরে, ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের উপস্থিতিতে নীরব আর আফরার বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ের পর সবাই মিলে ওদের বাসায় ফিরে এলো। কেয়া বলল, “দেখ, আফরা আজ রাতে আমার কাছে থাকবে। তুই ফ্রেশ হয়ে রুমে চলে যা। কয়েকদিন পর থেকে নাহয় নতুন জীবন শুরু করবি। তার আগে একটা আলাদা বাসা তো ঠিক করতে হবে। যতদিন না বাসা ঠিক হবে ততদিন আমার সাথেই থাকবে।”

নীরব কৃতজ্ঞতায় হাসল। আফরাকে কেয়ার সাথে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে রুমে ফিরে এলো। বিছানায় শুয়ে পড়ার পর মনে হলো, জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো। একটা ভরসা, একটা প্রতিশ্রুতি, আর একসাথে পথচলার শপথ—সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতো সুন্দর।

*

সবাইকে বিদায় জানিয়ে ঝুমুর আর ওয়াহিদ তাদের বাসায় ফিরল। রাতটা বেশ নীরব, চারপাশে শুধু হালকা হাওয়ার মৃদু শব্দ। ঝুমুর বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দূরের আকাশে জ্বলজ্বলে তারা আর পূর্ণিমার আলো তার মুখে পড়ে যেন আরো উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে।

ওয়াহিদ দুটো গরম কফির কাপ নিয়ে এসে ঝুমুরের পাশে দাঁড়াল। কফির ধোঁয়া তাদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। ঝুমুর চুপচাপ কফি হাতে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল।

ওয়াহিদ একটু হেসে বলল, “তোমার মুখটা এত গম্ভীর কেন? কিসের এত চিন্তা?”

ঝুমুর মৃদু হেসে বলল, “না, এমনিই…সবকিছু কেমন যেন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর ভাবছিলাম, আজকের রাতটা ঠিক কতটা সুন্দর।”

কফি শেষ করে ঝুমুর আবার রেলিংয়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওয়াহিদ কাপ দুটি বেসিনে রেখে ফিরে এসে দেখল, ঝুমুর এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে পেছন থেকে ঝুমুরকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।

তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কি ভাবছো এত, আমার চন্দ্রমল্লিকা?”

ঝুমুর লজ্জায় একটু হেসে বলল, “তেমন কিছুই না।”

ওয়াহিদ মুচকি হেসে বলল, “তাহলে তো আমার অধিকার আছে তোমার এই চিন্তা আর মুহূর্তটা আমার করে নেওয়ার।”

সে আলতো করে ঝুমুরের ঘাড়ে চুমু খেল। ঝুমুর শিহরিত হয়ে চোখ বন্ধ করল। চারপাশে যেন এক মায়াবী পরিবেশ তৈরি হলো। পূর্ণিমার আলোয় তাদের মুখে একধরনের স্বর্গীয় ছাপ পড়ল।

ওয়াহিদ মৃদু স্বরে বলল, “চলো, আজ তোমার সব চিন্তা আমি দূর করে দিই।”

ঝুমুর কিছু বলার আগেই ওয়াহিদ তাকে কোলে তুলে নিল। ঝুমুর লজ্জায় মুখ লুকায় ওয়াহিদের বুকে।

ওয়াহিদ হেসে বলল, “তোমার জন্য আমি সব করতে পারি। আজকের রাতটা শুধু আমাদের।”

কোলে করে তাকে রুমে নিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর তার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমার একান্ত এই চাঁদের আলোতে আমি বাকি জীবন হারিয়ে থাকতে চাই।”

ঝুমুর লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল, আর ওয়াহিদ তার ঠোঁটে এক মৃদু চুম্বনে সিলমোহর একে দিল।

চলবে…

#প্রেমময়ী_সন্ধ্যা
#পর্ব_২৬
#লেখিকা: তাসফিয়া আনজুম

ঝুমুরের মেডিকেল ভর্তি প্রস্তুতির দিনগুলো যেন আরও কঠিন হয়ে উঠছিল। পরীক্ষার চাপ, নতুন বইয়ের বোঝা, আর অনুশীলনের অগণিত প্রশ্ন ঝুমুরকে ক্লান্ত করে তুলছিল। তবুও, ওয়াহিদ সবসময় তার পাশে ছিল, একদম অটল।

সেদিন রাতের দিকে ঝুমুর একটু বিরক্তি নিয়ে বলল, “আপনার এত আগ্রহে মনে হচ্ছে আমি ডাক্তার না হলে আপনি নিজের জীবন শেষ করবেন।”
ওয়াহিদ হেসে বলল, “একদম ঠিক ধরেছো। তুমি যদি ডাক্তার না হও, তবে আমার নিজেকে ভীষণ ব্যর্থ মনে হবে একজন স্বামী হিসেবে, একজন প্রেমিক পুরুষ হিসেবে, একজন জামাতা হিসেবে।”

ঝুমুর চুপ করে তাকিয়ে থাকল। ওয়াহিদের কথা বরাবরের মতো সরল, তবু তার গভীরতা বিশাল। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে ঝুমুর মৃদু স্বরে বলল, “আমি যদি না পারি?”
ওয়াহিদ একটুও দেরি না করে বলল, “তাহলে নতুন স্বপ্ন বুনব। কিন্তু আমি তোমাকে কখনো ব্যর্থ হতে দেব না।”

ওই রাতেই ওয়াহিদ ঝুমুরের জন্য একটি সাদা বোর্ড নিয়ে এল। তাতে ঝুমুরের পুরো সিলেবাসের পরিকল্পনা লিখে ফেলল। বলল, “এখন তোমার শুধু পড়াশোনায় মনোযোগ ধরে রাখতে হবে। অন্য সবকিছু কয়েক মাসের জন্য আলবিদা।”

ঝুমুর ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে করুন কণ্ঠে বললো,”আচ্ছা বিয়ে করার বেনিফিট কি বলুন? মানুষ যে এত বলে বিয়ে করলে পড়াশোনা করতে হয় না। আমাকে কেন এত পড়াশোনা করতে হচ্ছে বলুন?আজকে আমার সব প্রশ্নের জবাব চাই-ই চাই!”

ওয়াহিদ হাসতে লাগলো।
“আমি তো ছেলে মেয়েদের কি বেনিফিট তা আমি কি করে বলবো? তবে ছেলেদেরটা বলতে পারি। এই ধরো প্রতিদিন ঘুমানোর সময় একটা জীবন্ত কোলবালিশ, একটা জীবন্ত রেকর্ডার যেটা অনর্গল বাজতে থাকবে। যেটা থেকে মধুর সুর বের হয় আবার সারাদিন বাইরে কাটিয়ে ক্লান্ত শরীর মন নিয়ে ঘরে ফিরলে এক বুক চন্দ্রমল্লিকার সুবাস।”

*

এদিকে, আদিল যশোরে ফিরে গেল তার বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিতে। সেই তার মায়ের একমাত্র ভরসা। কেয়া নিজেও তার এডমিশন প্রিপারেশন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাবার কড়া আদেশ ভালো ইউনিভার্সিটিতে চান্স না পেলে বিয়ে দিয়ে দিবে। আর বিয়ে দিলে তো নিশ্চয়ই বাবার পছন্দ করা ছেলের সাথেই দিবে। সেই ভয়ে এখনও পড়াশোনায় লেগে আছে। না হলে কবে বিয়ে করে তিন বাচ্চার জননী হয়ে যেত! আদিলের সাথে কথা হয় দিনে রাতে মিলিয়ে দুইবার।

সেদিন রাতে কেয়ার একটা ফেসবুক পোস্ট দেখে আদিল রেগে গেল। ছবিতে একটি ছেলে কমেন্ট করেছে: “Wow, looking gorgeous!”। আদিল সাথে সাথে কেয়াকে ফোন দিল।
“ওই এইসব কী পোস্ট দিছিস? আর ঐ ছেলেটা কে?”

কেয়া হেসে বলল, “কেন? তোমার কি সমস্যা?”কেয়া এখন মাঝে মাঝে আদিলকে তুমি করে বলার চেষ্টা করে।

আদিল গলা চড়িয়ে বলল, “আমার কি সমস্যা মানে?যেই ঢাকা থেকে আসলাম আর এমনিই ছেলেদের নিজের ছবি দেখানো শুরু হয়ে গেছে, তাই না?”

কেয়া চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর মজার ছলে বলল,”তো আমি কি করবো? নিজেও তো কোনদিন দেখতে চাও না!”

এই কথা শুনে আদিল স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আচ্ছা এখন আমি দেখতে চাই না? দেখতে চাইলে বুঝি খুব ভালো লাগতো?”

কেয়া আদিলের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে লজ্জা পেল। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল,”এই তুমি আমাকে ফোন দিবে না তো আর শুধু ঝগড়া শুরু করে দাও।”

আদিল রাগে ফেটে পরল,”ও আচ্ছা, এখন তো মানুষ পেয়েছিস আমি আর ফোন দিব কি করতে!”

কেয়া হাসলো। হাসতে হাসতেই বললো,” হ্যাঁ ঠিক ই বলেছ। নতুন পেলে আর পুরাতন দিয়ে কি করব?”

আদিল ফোন কেটে দিল। কিন্তু কেয়া কিছুই রিয়েক্ট করল না, কারণ সে জানে ঘুরে ফিরে আবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফোন আসবে।কেয়া এটাও জানে আদিলের রাগ, অভিমান সবকিছুই যে তার প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

*

অন্যদিকে, আফরা আর নীরবের নতুন জীবন শুরু হলো। নীরব তার বাবার পাঠানো টাকা দিয়ে একটি ছোট বাসা ঠিক করল। বাসাটা একদম সাদামাটা—এক রুম, এক রান্নাঘর, আর ছোট একটি বারান্দা।

সন্ধ্যায় আফরা আর নীরব একসাথে মার্কেটে গেল। একটা মাঝারি সাইজের তোষক, বালিশ, দুইটা প্লেট, একটা গ্লাস, দুইটা পাতিলসহ সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনল। বাসায় ফিরে আফরা ঘর গোছাতে লাগল। ঘরটি ছোট হলেও তাদের কাছে যেন এক পৃথিবী।

নীরব কিছুক্ষণ বাইরে গিয়ে ফিরে এলো। আফরা তাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় গিয়েছিলে?”
নীরব হেসে বলল, “তেমন কিছুই না। এক বন্ধু কয়েকটা টিউশনির কথা বলেছিল সেগুলোই ঠিক করতে গিয়েছিলাম। এতদিন না লাগলেও এখন সেগুলো দরকার।”

আফরা রান্নাঘরে গিয়ে রং চা বানাল। চা ঢালতে গিয়ে দেখল ঘরে কাপ নেই। পরে নতুন কিনে আনা একটা গ্লাসে নিরবের জন্য চা নিল। ঘরে একটাই গ্লাস ছিল তাই আর নিজের জন্য নিতে পারল না। রুমে এসে দেখলে আদিল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আফরা চায়ের কাপটা রান্নাঘরের তাকে রেখে নিরবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আলতো করে হাত রাখল নিরবের কাঁধে। নিরব আফরার স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকালো।

আফরা দিকে কিছু টাকায এগিয়ে দিল। বলল, “নীরব, এই টাকাগুলো নাও। তোমার এখন কাজে লাগবে।”

নীরব বলল, “এগুলো আপনি কোথা থেকে পেলেন?”
আফরা শান্তভাবে বলল, “আমার গত মাসের টিউশনের বেতন। তোমার সাথে সংসারের খরচ ভাগ করে নিতে চাই। এখন তোমার ভার্সিটি ভর্তির প্রিপারেশনের সময়। তুমি এখন টিউশনি নিয়ো না প্লিজ আমি দেখি আমার আগের টিউশনগুলো করবো। পরে ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরে দেখো তুমি কোন পার্ট টাইম চাকরি পাও কিনা।”

নীরব কঠিন গলায় বলল, “আমার কোনো টাকা লাগবে না। আপনি রেখে দিন এই টাকাগুলো। এই সংসারের খরচ সামলানো আমার দায়িত্ব।”

আফরা কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। সে বুঝতে পারল, নীরব তার জন্য সত্যিই কতটা দায়িত্বশীল।

আফরার মুখের দিকে তাকিয়ে নিরব বলল, “আর কিছু বলবেন?”
“তোমার জন্য চা বানিয়েছিলাম।”

“ওহ আচ্ছা চলুন। একসাথে খাই।”
এই বলে নিরব রুমে গেল। রান্না ঘরের তাকের উপর থেকে গ্লাসে ঢেলে রাখা চা টা এনে বলল,”কখন বানিয়ে রেখেছেন আগে বলবেন না? চা তো প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল।”

“দাও আবার গরম করে দিচ্ছি”
নিরব সেই ঠান্ডা চায়ে চুমুক বসালো। আফরা আর কিছু বলতে গিয়েও বলল না তাকিয়ে রইল নিরবের দিকে। এই ছেলেটার সাধারণ সবকিছুই এখন তার মুগ্ধ হয়ে দেখার মত অসাধারণ লাগে। নিরব অর্ধেক চা খেয়ে আপনার দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিল। বললো,”আজকে একটু কষ্ট করে নেন। কালকেই চায়ের কাপ কিনে আনব।”

আফরা ভীষণ আশ্চর্য হল নিরব যে এই জিনিসটা খেয়াল রেখেছে এটা ভেবে। আফরা বলল,”না না তুমি খাও। আমি খাবো না।”

নীরব চায়ের কাপটা ফিরিয়ে নিল। শুধু বলল,”ওহ আচ্ছা সরি। আমিও কেমন আমার মুখেরটা আপনাকে খেতে দিচ্ছি।”

আফরা নীরবে হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে চা টা খেয়ে ফেলল।
নীরব বলে,”একি পুরোটা খেয়ে ফেললেন? আমার জন্য একটুও রাখলেন না?”
আফরা কি বলবে ভেবে পেল না। শুধু বলল,”চা আমার খুব পছন্দ।”

আফরা চুপ করে রইল কিছু মুহূর্ত। তার চোখে এক ধরনের প্রশ্ন ছিল, যেন কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তু বলতে পারছে না। তারপর অবশেষে, একটু হাসি দিয়ে, সরাসরি নীরবের দিকে তাকিয়ে বলল, “নীরব, তুমি আমাকে এখনো ‘আপনি’ করে বলো কেন?”

নীরব হঠাৎ যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সে আফরার চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না। এক অদ্ভুত অস্বস্তি তৈরি হল। নীরবতা কাটিয়ে হঠাৎ নিরব বলে উঠে,”তুমি বলার সেই অধিকার আমার হয়ে ওঠেনি তাই।”

“এখানো হয়নি বলছো?”
“হয়েছে বুঝি?”
“আমাদের বিয়ে হয়েছে নিরব। এরচেয়ে বড় অধিকার কি চাই?”

নিরব আফরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”ভালোবাসার অধিকার। যেটা সব অধিকারের ঊর্ধ্বে!”

চলবে…..