#প্রেমময়ী সন্ধ্যা
#পর্ব_২৭
#লেখিকা:তাসফিয়া_আনজুম
আজকের সকালটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। অন্যরকম বলতে সবার জন্য নয়, শুধু নীরবের জন্যই। বিয়ের তিন দিন কাটলেও আজ প্রথম অনুভব করলো ব্যাচলরের তকমা কাটিয়ে সে এখন বিবাহিত। আফরা ঘুমের ঘোরে কখন যে নিরবের গা ঘেঁষে শুয়েছিল তা সে নিজেও টের পায়নি। অথচ রাতে দু’জন ছিল বিছানার দুই প্রান্তে।
নীরব বিছানা থেকে নেমে কুঁচকে থাকা চাদর টেনেটুনে ঠিক করল। মোবাইল হাতে নিয়ে কি যেন ঘাটতে লাগল। হঠাৎ পাশ থেকে আফরার কণ্ঠ শোনা গেল। চোখ আধ-খোলা, ঘুমে ভরা কণ্ঠে বলল, “কখন উঠলে? আমাকে ডাকলে না কেন?”
নীরব তাকিয়ে দেখল, আফরার চোখেমুখে তখনো ঘুমের রেশ। চুল এলোমেলো। ঘুম থেকে উঠে যেন আরও সুন্দর মায়াবতী দেখাচ্ছে। কি এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা তার চেহারাজুড়ে। নীরব মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “মাত্রই উঠেছি।”
আফরা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। তারপর নিরবের উদ্দেশ্যে বলল, “আচ্ছা যাই হোক, তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আমি চা নিয়ে আসছি। আজ কিন্তু তোমাকে বাজারে যেতে হবে। ঘরে কিছু নেই। বাজার না করলে কি দিয়ে রান্না হবে?”
নীরব বলল, “হ্যাঁ, আমিও বলতে চাইছিলাম।আচ্ছা, আপনি একটা লিস্ট করে দিন। আমি সব নিয়ে আসব।”
আফরা একটা লিস্টে চাল, ডাল, তেলসহ কিছু টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের নাম লিখে দিয়েছিল। নীরব সেই লিস্ট দেখে দেখে বাজার করল। বাজার করতে করতেই প্রায় দুই ঘণ্টা কেটে গেল। ঘেমে একাকার হয়ে বাসায় ফিরল নিরব।
বাসায় ফিরেই আফরা দরজা খুলে হাসিমুখে বলল, “কতক্ষণ লাগালে! বাজারের সব তুলে নিয়ে আসলে নাকি?”
নীরব ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ আমি তো দোকানদারের শালা! যে আমার ব্যাগে পুরো বাজারটা তুলে দিবে।”
আফরা মৃদু হেসে বলল, “আচ্ছা হয়েছে। এখন রুমে এসে ফ্যানের নিচে বসো।”
নীরব চুপচাপ ফ্রেশ হতে চলে গেল। আফরা ততক্ষণে রান্নার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল।নিরব আর কোথাও গেল না। রান্নায় আফরাকে হাতে হাতে সাহায্য করে দিলো। দুপুরে ভাত, ডাল আলুভর্তা আর ডিম ভাজি করেছে আফরা। আলু ভর্তাটা যদিও নিরব নিজের হাতে করেছে।
দুপুরে খাওয়া শেষে নীরব টেবিলে বসে আফরার হাতের রান্না খেতে খেতে বলল,
“আপনার হাতের রান্না তো খুব মজা। ভাইরে ভাই আলু ভর্তা ছাড়া আর কিচ্ছু রান্না করতে পারিনা।আলু ভর্তাই ছিল এই এতিমের জীবনে একমাত্র সঙ্গী।”
আফরা লজ্জা পেয়ে বলল, “আরে কি বলো ডাল আর ডিম ভাজি কোন রান্না হলো নাকি? তোমাকে একদিন আমার হাতের মাটন রান্না করে খাওয়াবো। ওইটা খুব মজা হয়।”
হঠাৎ নিরবের মুখে আঁধার নামল। খাওয়ার মাঝে আর কোন কথা বলল না সে। চুপচাপ খেয়ে হাত ধুয়ে চলে গেল। আফর অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নিরবের যাওয়ার দিকে। মনে মনে ভাবল,”আমি কি ভুল কিছু বলে ফেললাম?”
**
ওয়াহিদ হসপিটাল থেকে ফিরলো বিকেল তিনটায়। আজ একটা মিটিং থাকায় দেরি হয়েছে। রুমে ঢুকে দেখল ঝুমুর সামিয়ার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। ওয়াহিদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো ঝুমুর রুমে নেই। হাতে এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে রুমে আসলো ঝুমুর। গ্লাসটা ওয়াহিদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আজ এত দেরি হল কেন? দুপুরে খেয়ে কোথায়?”
ওয়াহিদ শরবতটা খেয়ে গ্লাসটা ঝুমুরের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলে। আজকে একটা মিটিং ছিল সেজন্য দেরি হয়েছে। নতুন কিছু ডাক্তার জয়েন হয়েছে তাদের সাথেই। আর লাঞ্চ করতেই হল সবার জোরাজুরিতে।
“তুমি খেয়েছো তো? আম্মু-আব্বু খেয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
ঝুমুর হাতের গ্লাসটা রাখতে রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছিল। ওয়াহিদ সেই সময় পিছন থেকে ডেকে বলে।
“ঝুমুর হসপিটাল থেকে সব ডক্টরদের নিয়ে একটা পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে আগামীকালের। ফ্যামিলি সহ। শহর থেকে একটু দূরে তবে জায়গাটা অনেক সুন্দর তোমার ভালো লাগবে। একদিন থাকবো মনে হয়।জিনিসপত্র গুছিয়ে নিও।”
ঝুমুর পড়ালেখার চাপে অনেক বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। ওয়াহিদের কথায় খুশিতে ফেটে পড়লো।”হ্যাঁ অবশ্যই! কখন যাব?”
ওয়াহিদ বলল,”এইতো কাল সকালেই বের হব। আর তোমার যদি কোনো কিছুর দরকার হয় তাহলে চলো আজ শপিংয়ে নিয়ে যাই।”
ঝুমুর তো কোথাও ঘুরতে যাবে শুনেই খুশিতে আটখানা! তারপর দুজনে শপিংয়ে বের হলো। ওয়াহিদ ঝুমুরের জন্য নিজের পছন্দের কিছু ড্রেস কিনে দিল। সুন্দর কয়েকটা শাড়ি আর তার মায়ের জন্যও শাড়ি কিনল।
*
আফরা প্লেট বাটি ধুয়ে,টেবিল গুছিয়ে রুমে গিয়ে দেখল নিরব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এক মনে বাইরের দিকে কি যেন দেখছে। আফরার নিরবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুটা সময় কাটল নীরবতায়। নিচু কন্ঠে আফরা বলে ওঠে,
“নিরব তোমার বাবা মা কোথায়? তুমি তাদের সাথে থাকো না কেন?”
হঠাৎ এমন প্রশ্নের নীরব আফরার দিকে তাকালো। কিছুই বলল না নিরব।
আফরা আবার জিজ্ঞেস করল,
“কি হয়েছে কিছু বলছো না কেন?”
নিরব নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আফরা দেখল নিরবের চোখগুলো হঠাৎ কেমন লালচে হয়ে উঠেছে। নিরব বললো,
“আমার কেউ নেই। আমি এতিম।”
“মিথ্যে কথা বলো না নিরব। আমি জানি তুমি এতিম না।”
“মিথ্যে কেন বলব? আমার কেউ নেই এটাই সত্যি।”
“তোমার যদি কেউ নাই থাকে তাহলে তোমাকে মাস শেষে এত টাকা পাঠায় কে?”
“কোন কিছুর প্রতি বেশি আগ্রহ কখনোই ভালো না আফরা। আপনি আমাকে যত জানতে চাইবেন ততোই ব্যর্থ হবেন। আর যদি আমার সম্পর্কে জানতেও পারেন তবে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই পাবেন না। তাই এসব নিয়ে আর ভাববেন না।”
নিরব তার মুখে এই প্রথম আফরার নাম উচ্চারণ করল। এবার যেন আফরার জেদ আরো বেড়ে গেল।
“না নিরব তোমাকে বলতেই হবে। কি এমন কথা যেটা শুনলে আমি দুঃখ পাবো? আমি এসব দুঃখ নিয়ে আর ভাবি না তুমি বলো। আমি শুনতে চাই।
নিরব তার লাল হয়ে যাওয়া চোখ নিয়ে আফরার দিকে তাকালো।
সত্যিই জানতে চান? আসুন আমার সাথে।”
নিরব আফরার হাত ধরে সেই মুহূর্তেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
*
পরের দিন সকালে দুজনে বের হল। হসপিটালে সামনে থেকে বাস ঠিক করা হয়েছে। সেখানেই গেল সাথের সবাই। শহরের বাইরে নিরিবিলি জায়গায় পৌঁছে ঝুমুর মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখতে লাগল। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কটেজে পৌঁছেই ঝুমুর বলল, “এ জায়গা এত সুন্দর! আপনারা কোথায় থেকে এত সুন্দর জায়গার কথা জানলেন?”
ওয়াহিদ বলল, “আমাদের অফিসের এক কলিগ জানিয়েছে। জায়গাটা কিন্তু আসলেই সুন্দর।”
খুব সকাল সকাল চলে আসায় কেউই নাস্তা করে আসেনি। কটেজের ভেতর থেকে প্লাস্টিকের টেয়ার চেবিল নিয়ে এসে খোলা জায়গায় বসানো হলো। টেবিলে বিভিন্ন রকমের নাস্তা সাজানো হলো। সবাই একসাথে বসে নাস্তা করলো। তারপর নাস্তা করে ঝুমুর আর তার সাথে অন্যরা মিলে নদীর পাড়ে হাঁটলো কিছুক্ষণ। এরই মধ্যে ছেলেরা রান্নার আয়োজন শুরু করে দিল। মাটিতে গর্ত করে ইট বসানো হলো। সবাই হই হই করে হাতে হাতে কাজ করছে। অনেকে মজা করে বলছে আজকে তো ওয়াহিদ রান্না করবে। ওয়াহিদ আসলেই ভাল রান্না পারে। রান্নার প্রতি ছোটবেলা থেকে কিছুটা আগ্রহ ছিল তার। সেই আগ্রহ থেকেই মায়ের কাছ থেকে রান্না শিখেছিল। যদিও ঝুমুরকে কখনো কিছু বানিয়ে খাওয়ানো হয়নি। দুপুরে রান্না হলো ভুনা খিচুড়ি,খাসির মাংস ,ইলিশ ভাঁজা, ডিম ভুনা, বিভিন্ন রকমের ভর্তা,চাটনি আর মিষ্টি দই। বেশিরভাগ রান্নাই ওয়াহিদ করল। ওয়াহিদের হাতের রান্না খেয়ে বরাবরের মতোই সবাই তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। ঝুমুর তো খাবার মুখে দিয়েই হা হয়ে রইলো। সে নিজেই রান্না পারে হাতেগোনা কয়েকটা। এই ভাত, আলু ভাজ, ডিম ভাজি, ডাল, আলুভর্তা, মাছ তরকারি। নাহ মাছও রান্না করতে পারে না ঠিকঠাক ভাঁজতে নিলেই পুড়িয়ে ফেলে। যাক সমস্যা নেই, সে রান্না পারে না তো কি হয়েছে তার জামাই তো এত ভালো রান্না করে!
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই কিছুক্ষণ যার যার রুমে রেস্ট নিয়ে হাঁটতে বের হলো। ওয়াহিদ আর ঝুমুর কটেজ থেকে একটু দূরেই নদীর পাড়ে হাটতে গেল। ঝুমুর নদীর ধারে পা ভিজিয়ে বসেছে। ওয়াহিদ হঠাৎ পাশ থেকে ছবি তুলতে লাগলো।
“আরে আমার এত ছবি তুলছেন কেন?”
“কোথায় আমি তোমার ছবি তুলছি?ঘাসের উপর বসে থাকা একটা প্রজাপতি ছবি তুলেছি।”
“আচ্ছা তাহলে দেখান আপনার সেই প্রজাপতির ছবি?”
“খুব শখ না? আমার প্রজাপতির ছবি তোমাকে দেখাবো কেন? পরে তোমার নজর লাগবে।”
“হুহ ঢং! আপনার প্রজাপতি নিয়ে আপনি নাচেন।”
ওয়াহিদ আসতে শুরু করল ঝুমুরের কথায়।
“দরকার হলে তা-ই করবো!”
চলবে…
#প্রেমময়ী সন্ধ্যা
#পর্ব_২৮
#লেখিকা: তাসফিয়া_আনজুম
নীরব চুপচাপ আফরার হাত ধরে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে একটি রিকশা ডেকে উঠে পড়ল। আফরা সারা রাস্তায় কোন কথা বলল না। চুপচাপ নিরবের সাথে গেল।
রিকশাটা থামল শহরের এক নির্জন পার্কের সামনে। পার্কের এক কোণায় পাথরের বেঞ্চে দুজন বসলো। নীরব যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। কিছুক্ষণ নীরবতার পর নিরব বলল,
“আপনি কেন আমার সম্পর্কে এত কিছু জানতে চাইছেন বলুন?আমার সম্পর্কে জানলে হয়তো আমার প্রতি আপনার মায়া হবে নয়তো আমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন। কিন্তু সেটা আমি বেঁচে থাকলে সহ্য করতে পারবো না।”
আমি জানি না। তবে আজ আপনার জেদের সামনে কিছু লুকাতে পারলাম না। আমার কাহিনী না হয় পরে শুনবেন। এখন বরং একটা গল্প শুনুন। নিরব বলতে শুরু করল….
এক গ্রামে ছিল এক ভীষণ সুন্দরী কন্যা। সেই কন্যার সঙ্গে ছিল গ্রামের চেয়ারম্যানের একমাত্র ছেলের গভীর প্রেমের সম্পর্ক। কিন্তু সেই কন্যার সঙ্গে চেয়ারম্যানের সম্পর্ক ভালো ছিল না। একদিন চেয়ারম্যান ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের সব দম্ভ আড়াল করে প্রস্তাব নিয়ে গেল সেই কন্যার বাবার কাছে। কিন্তু তিনি তার কথায় অটল ছিলেন এবং চেয়ারম্যান কে অপমান করে নিজের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রাগ,ক্ষোভ কয়েকগুণ বেড়ে গেল চেয়ারম্যানের। তারপর তিনি তার ছেলেকে সেই কন্যার সাথে মেলামেশার কড়া নিষেধাজ্ঞা দিলেন। কিন্তু সেই কন্যা আর চেয়ারম্যানের ছেলে একে অপরকে এতটাই ভালোবাসতো যে পালিয়ে গেল গ্রাম থেকে। তারপর ঢাকা গিয়ে দুজনে বিয়েও করে ফেললো।ছেলেটা একটা গার্মেন্টসের চাকরি নিল। আয় খুব অল্প হলেও দুজনের জীবনে ছিল অঢেল সুখ।
কিন্তু তারপর,,,
নীরব এক মুহূর্ত থেমে গভীরভাবে শ্বাস নিল।
সেই মেয়ের আস্তে আস্তে চাহিদা বাড়তে লাগলো। সে শহরের চাকচিক্যে নিজেকে জড়িয়ে নিতে লাগলো। ছেলেটা মেয়েটাকে সুখী করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করত। তার ছোট ছোট ইচ্ছে, খুশিগুলোকে ভীষণ প্রাধান্য দিত। কিন্তু মেয়েটার এসব কিছুই ভালো লাগতো না তখন। ছেলেটার যত্ন, ভালোবাসা তখন তার কাছে একটু বাড়াবাড়িই মনে হতো।
এরপর একদিন হঠাৎ তাদের মাঝে তৃতীয় একজন আশার খবর শোনা গেল। ছেলেটা ভীষণ খুশি হল। কিন্তু মেয়েটাকে এত খুশি দেখা গেল না। সে চুপচাপ বসে থাকতো, কোনো কথা বলত না তেমন। নিজের প্রতি যত্নও নিত না।
কয়েকদিন ধরে ছেলেটা লক্ষ্য করল, মেয়েটা ফোন নিয়ে বেশি সময় কাটায়।(ঢাকা যাওয়ার পর ছেলেটা তার কয়েক মাসের বেতনের টাকা থেকে কিছু টাকা রেখে মেয়েটাকে একটা বাটন ফোন কিনে দিয়েছিল)। ছেলেটা কিছু জিজ্ঞেসও করত না কোনোদিন। প্রথম প্রথম একসাথে খাওয়ার জন্য বসে থাকলেও পরে মেয়েটা নিজেই একা খেয়ে ফেলত।
এরপর ধীরে ধীরে সময় কাটতে লাগল। তাদের কোল আলো করে এলো একটি ছেলে। ছেলেটা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। মেয়েটি আগের থেকে আরও বেশি পরিবর্তিত হল।মেয়েটার এমন পরিবর্তন নিয়ে ছেলেটা ভীষণ মন খারাপ করত।
এরপর একদিন কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে ছেলেটা দেখল, ঘর খালি, দরজা খোলা। খাটের উপর একটি ছোট্ট চিরকুট রাখা। তাতে লেখা ছিল,
‘বাবার কথাই ঠিক ছিল। বাবা সব সময় বলতেন, ভালোবাসা কখনো ভালো রাখতে পারে না। ভালো থাকাটাই আসল ভালোবাসা। আমি তোমার সাথে কখনো ভালো থাকতেই পারিনি। হয়তো তোমায় ভালোও বাসিনি কোনোদিন। তোমার সাথে থেকে আমার জীবনের কোনো শখ-আহ্লাদ কিছুই ছিল না। আমি একজনকে ভালোবাসি, যে শুধু আমাকে ভালোবাসে না, সে আমাকে ভালো রাখবে।তোমার ভালোবাসায় আমি কোনোদিন ভালো থাকা পাইনি, তাই নিজের ভালো থাকা নিজেই খুঁজে নিলাম। আর আমার ছেলেকে আমার সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। ভালো থাকবে।’
চিঠিটা হাতে নিয়ে ছেলেটা স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা তার বুকের ভেতর স্থির হয়ে বসেছিল।
আফরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল নিরবের দিকে।
“তারপর?”
নিরব হাসলো সামান্য।
“ওই মেয়েটার দ্বিতীয় স্বামী তার কোলের সন্তানটাকে মেনে নিতে পারেনি। তিনি বলেছিলেন যে কোন মূল্যেই এই বাচ্চাকে এই ঘর থেকে বের করে দিতে হবে। মেয়েটা নিজের ভালো থাকা বাঁচাতে মাঝরাত্রে বাচ্চাটাকে ফেলে দিয়ে গিয়েছিলেন ময়লার স্তুপের পাশে। সেই বাচ্চাটার সাথে রেখে এসেছিলেন তার বাবার একটা ছবিযেন কেউ দেখে বাবার কাছে দিয়ে আসতে পারে। বাচ্চাটার ভাগ্য হয়তো খুব ভালোই ছিল, পরেরদিন তাকে দেখতে পেল তার এক আত্মীয়। দেখেই তাকে তার বাবার কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্য এতটাই ভালো ছিল যে তার বাবাও তাকে অস্বীকার করে। সে নিজের কাছে রাখে না বাচ্চাটাকে।”
“এরপর কী হলো?” আফরা ধীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল।
নীরব কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তার মনে যেন কিছুর দোলাচল ছিল। তারপর আবার বলতে শুরু করল।
“ছেলেটা যখন কিশোর হলো, একদিন সে সেই আত্মীয়ের কাছে জানতে পারল যে তার আসল বাবা কে,কি তার পরিচয়। এক সময় লোকটাও বুঝতে পারলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল নিজের সন্তানকে অস্বীকার করা। তার ভুল বুঝতে পারতে কিছুটা সময় লেগেছিল, তবে সে যখন বুঝতে পারল, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।
আফরা গভীরভাবে নীরবের কথা শুনছিল। মনে হয় মনে হচ্ছিল দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ঘটছে। আফরা এক অদৃশ্য মায়া অনুভব করলো সেই ছেলেটার প্রতি।
“তারপর?”
“তারপর আর কি! নিজের মধুর শৈশব বাবা-মা ছাড়া কাটিয়ে দেয়া ছেলেটা বাকিটা জীবন একাই কাটিয়ে দিতে চাইলো। কিন্তু তাঁর একাকীত্ব সহ্য হলো না প্রকৃতির। তার নিঃসঙ্গ জীবনে পাঠিয়ে দিলেন একজন সঙ্গী। ছেলেটা হয়তো এখন ভালই আছে।”
আফরার চোখ জ্বলজ্বল করছে। নিজের হাত দুটো বাড়িয়ে নিরবের হাত ধরে বলে,
“নিরব তুমি সেই ছেলেটাকে বলবে, ছেলেটা সবসময় ভালো থাকবে। এই পৃথিবীতে তার কেউ না থাকলেও ওই মানুষটা সব সময় থাকবে। সেই মানুষটা তাকে অতীত ভুলে নতুন করে বাঁচতে শেখাবে।”
নিরব হঠাৎ আফরাকে জড়িয়ে ধরল। কেঁপে উঠল আফরার সম্পূর্ণ শরীর।হাত বাড়িয়ে ছুঁলো নিরবের পিঠ। নিরব ভাঙ্গা কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমি অতীত ভুলতে চাইনা আফরা। আমি শুধু আমার সেই শৈশবটা ফেরত চাই। যে শৈশবে ছেলে তার বাবার কাঁধে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, যে শৈশবে ছেলে তার বাবার আঙুল ধরে মসজিদে যায়, মায়ের বকা শুনে বাবার কাছে অভিযোগ করে। আমি চাই আমার স্কুলের খাতায় আমার নামের পাশে বাবা মায়ের নামটা থাকুক। আমি শুধু একটাবার আমার শৈশবটাকে ফেরত চাই। বাবা আর মাকে একসাথে চাই।”
আফরা নিরবকে কিছু বলার ভাষা খুজে পেলো না।
“নিরব তোমার কি মনে হয় না তোমার বাবার কাছে যাওয়া উচিত?”
“না।”
“কিন্তু কেন? তিনি তো তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত। আমি জানি তুমি তোমার বাবাকে ভালোবাসো।”
নিরব আফরার থেকে সরে জায়গায় বসলো। তারপর বললো,
“ওই মানুষটাকে আমিও ভীষণ ভালোবাসি। জানেন আফরা তার জন্য আমার অনেক মায়া হয়। একটা মানুষ এত নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার পরেও যদি কেউ ছেড়ে চলে যায়, তাহলে সেই মানুষটার ভালোবাসার প্রতি ভয় জন্মে। তিনি হয়তো ভয় পায় দ্বিতীয়বার কাউকে ভালবেসে ঠকে যাওয়ার। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আমাকে ভালবাসলে যদি আমিও তাকে ছেড়ে চলে যাই।তার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই।”
আফরা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। নিরবের উদ্দেশ্যে বলল,
“চল।”
“কোথায়?”
“আমার শ্বশুরবাড়ি।”
“কি বলছেন এসব? এটা সম্ভব না।”
“কেন সম্ভব না? বাহ রে আমার বুঝি ইচ্ছে করে না শ্বশুর বাড়ি যেতে? শ্বশুর থাকতেও কেন আমি তার আদর নিব না? তুমি বললেই হলো নাকি আমি এখন যাব মানে যাবই।দেখি কি করে আটকাও!”বলে আফরা হাঁটতে শুরু করল।
নিরব পেছন থেকে ডাকতে লাগলো। কিছু দূর গিয়ে আফরা থামল। নিরবের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে?”
“বাসায় চলুন!”
“বললাম তো যাবো না বাসায়। আমি আমার শ্বশুর বাড়িতে যাব।”
“শ্বশুরবাড়িতে কি এই কাপড় পড়ে যাবেন?”
আফরা আকাশ থেকে পড়ল নিরবের কথায়।
“কি!”
“বললাম এই ছিঁড়া ফুটা জামা পড়ে প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে যাবেন নাকি? অন্তত জামা কাপড় বদলে যাই।”
চলবে….