সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-২১+২২

0
14

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ২১
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫
[শুধুমাত্র প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]
[সকল দৃশ্যপট কাল্পনিক ]

ক্যালিফোর্নিয়াতে আজ বেজায় ঠান্ডা পরেছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় কনকনে ঠান্ডা হাওয়া এসে একেবারে নাক মুখ চিড়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। এলোমেলো বাতাসের তীব্রতায় ঝড়ে পরা আকর্ষনীয় ম্যাপল পাতায় ভরে উঠেছে রাস্তাঘাট। আজকে আর যেন-তেন শীতের পোশাক পরে শীত নিবারন করার সুযোগ নেই, তাইতো উষ্ণ কোর্ট, গ্লোভস,পায়ে বুট,মাথায় উলের বিনি হ্যাট পরে, একেবারে রয়েসয়ে বাইরে বেরিয়েছে অনু। আজ বাইরে না গিয়ে ভেলভেট কম্ফোর্টারের মধ্যে শুয়ে আরাম করে ঘুমালে হয়তো সবচেয়ে বেশি ভালো হতো। কিন্তু আগামী কাল মায়ের অপারেশন, আজ না গেলে কেমন করে হবে? গত দুদিন ধরে অরু আর ক্রীতিক বাড়িতে নেই, এই দুদিনে ওর যথেষ্ট খেয়াল রেখেছে প্রত্যয়, সব সময় ফোন করে খোঁজ নেওয়া, সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে দেওয়া, কিংবা নার্সিংহোমের কোনোরূপ জরুরি প্রয়োজনে ছুটে আসা।কি না করেছে?

এতো যত্ন, এতো মূল্যয়নে অনুর মতো কঠোর হৃদয়ের মেয়েটাও আজকাল প্রত্যয়ের প্রতি দূর্বলতা অনুভব করে। ইচ্ছে তো করে হৃদয়টা বের করে হাতে তুলে নিয়ে প্রত্যয়কে উপহার দিয়ে দিতে,আফটার অল হি ডিজার্ব ইট।
.
প্রত্যয়কে নিয়ে অসংখ্য দানাবাঁধা স্বপ্ন আর ভাবনারা মাথায় কিলবিল করছে অনুর। মাঝে মাঝেই অযাচিত মনে একাই ফিক করে হেসে উঠছে ঠোঁট জোড়া। একমনে প্রত্যয়কে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে বাস স্টপেজের কাছে চলে এসেছে তা টেরও পায়নি অনু। যখন টের পেলো তখন দেখলো বাস এখনো আসেনি, অপেক্ষা করতে হবে কিছুক্ষন, তাই এগিয়ে গিয়ে একটা শিশিরে ভেজা বেঞ্চি হাত দিয়ে সামান্য পরিস্কার করে সেখানটায় বসে পরলো ও। বেঞ্চিতে বসার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় চোখের সামনে দৃশ্যগত হলো পূর্বের ন্যায় একই ঘটনা। এই নিয়ে পরপর তিনদিন ওই মেয়েটাকে প্রত্যয়ের সঙ্গে দেখেছে অনু। রাস্তার ওপাশেই ক্যাফেটেরিয়াতে দাড়িয়ে আছে ওরা দুজন। প্রত্যয় কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে কিছু একটা বলে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। প্রত্যয় চলে যেতেই হুট করে, একদম হুট করে অজ্ঞাত মেয়েটার চোখে চোখ পরলো অনুর। এভাবে চোখাচোখি হওয়ায় ভেতরটা কেমন আঁতকে উঠল ওর। তৎক্ষনাৎ তরিৎ গতিতে চোখ নামিয়ে নিলো অনু।জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
— কে এই মেয়ে? সব সময় প্রত্যয় সাহেবের সাথেই কেন দেখা যায় তাকে? ওনার বোন? কই চেহারাতে তো মিল নেই।

— এই যে!!

অনুর অস্পষ্ট বিড়বিড়ানির মাঝেই স্পষ্ট বাংলায় ওকে ডেকে উঠল কেউ। অনেকদিন পর অচেনা মুখে বাংলা আওয়াজ শুনে চট করে মাথা তুলে চাইলো অনু, তবে সেই মানুষটিকে দেখে খুশি হওয়ার বদলে উল্টে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গেলো ওর। এতো একটু আগে প্রত্যয়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বাঙালি মেয়েটা, এখানে কি করছে সে? অনু চুপচাপ তাকিয়ে আছে দেখে মেয়েটা পুনরায় বললো,
— কানে শুনতে পাওনা নাকি?

মেয়েটার কথায় চড়ম ক্রো’ধের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। কওয়া নেই বলা নেই হুট করে এসে এভাবে খিটখিটে আওয়াজে কথা বলাটা মোটেই পছন্দ হলোনা অনুর, মেয়েটার আচরনে সুন্দর মেজাজটা হঠাৎ করেই কেমন বিগড়ে গেলো, তবুও যতটুকু সম্ভব নিজেকে সংবরণ করে কাঠকাঠ আওয়াজে অনু বললো,
— কি চাই?

অনুর থেকে বোধ হয় এতোটা কাঠিন্য আশা করেনি মেয়েটা, তাই ওকে চোখ পাকিয়ে গলার স্বর কঠিন করে সে বললো,
— এ্যাই মেয়ে, কাকে কি বলছো তুমি?

অনু এবার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো, দু’হাত বুকের উপর ভাঁজ করে রেখে ,ভ্রু উঁচিয়ে সাভাবিক ভঙ্গিমাতে বলে,
— আপনাকে বলছি, কি চাই?

মেয়েটা এবার তাচ্ছিল্য করে হেসে বললো,
— প্রত্যয়ের সাথে যে এতো ঢলাঢলি করছো, আমি কে সেটা নিশ্চয়ই বলেছে?

— না বলেনি, হয়তো সেরকম ইম্পর্ট্যান্ট কেউ না তাই বলার প্রয়োজনবোধ করেনি, আপনার খুব বেশি বলার ইচ্ছে থাকলে আপনিই বরং বলুন, আমি শুনছি, আর হ্যা একটু জলদি বলবেন প্লিজ, আমার তাড়া আছে।

মেয়েটা খিটখিট করে বলে উঠলো,
— বেশি স্মার্ট সাজার চেষ্টাও করোনা,তাহলে পস্তাবে, হি ওয়াজ জাস্ট ইউজিং ইউ,টু ফরগেট সামওয়ান, এন্ড দ্যাট ওয়াজ মি। আমি ওর বিগত সাত বছরের ভালোবাসা।

মেয়েটার কথায় অনু শুষ্ক ঢোক গিললো, মনের ভেতর বিশ্বাস হারানোর ভয়টা কুন্ডলী পাঁকিয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তবুও ভেতরের শ’ঙ্কাটাকে নিঃশব্দে আড়াল করে বললো,
— আপনাদের ভালোবাসা যদি এতোই পিওর হয়, এতোই দৃঢ় হয়,তাহলে আমার কাছে কি চাইতে আসে আপনার বয়ফ্রেন্ড, ধরে রাখতে পারেন না?

অনুর কথায় মেয়েটার আত্নবিশ্বাসে ভাঁটি পরলো, সে কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বললো,
— আমি ওকে চিট করেছি, বাট আই স্টিল লাভ হিম। আর আমি এও জানি ও আমার কাছেই ব্যাক করবে। কারণ সাতদিনের ভালোবাসা, সাত বছরের ভালোবাসার কাছে কিছুই না।

অনু ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললো,
— স্টুপিড।

অনু শব্দটা উচ্চারণ করার সাথে সাথেই ওর চুল খাম’চে ধরলো মেয়েটা, তারপর প্রচন্ত ক্রো’ধে কাঁপতে কাঁপতে মেয়েটা বললো,
— তুই আমার প্রত্যয়ের ধারে কাছেও আসবি না, নয়তো আমার সুগার ড্যাডিকে দিয়ে তোর খবর করিয়ে ছাড়বো। আমার হাত যে কতটা লম্বা সেটা তোর ধারণারও বাইরে।

অনু বিপরীতে কিছু বলবে তার আগেই কোথা থেকে যেন ছুটে এসে এক ঝটকায় ধা’ক্কা মে’রে মেয়েটার হাত সরিয়ে দেয় প্রত্যয়, অন্য হাতে অনুকে আগলে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,
— আর ইউ ক্রে’জি? রাস্তার মধ্যে কি করছো এসব? নেক্সট টাইম এভাবে পেছনে পরে থাকলে আমি তোমার নামে পুলিশে কমপ্লেইন করতে বাধ্য হবো তিন্নি।

এতোক্ষণে বাস এসে পরেছে পাবলিক প্লেস হওয়াতে চারিদিকে মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। সবার দৃষ্টি এখন ওদের তিন জনের দিকে। কেউ কেউ তো সুযোগ পেয়ে ভিডিও করা আরম্ভ করা দিয়েছে, অনু এতোক্ষণ যাবত চুপ করেই ছিল কিন্তু এই মূহুর্তে প্রত্যয়ের এসব আগলা দরদ ওর মোটেই ভালোলাগছে, গা ঘিনঘিন করছে, ইচ্ছেতো করছে প্রত্যয়কে সপাটে একটা চ’ড় মে’রে দিতে,কিন্তু পাবলিক প্লেসে নাটক করে কারোর হাসির পাত্র হতে চায়না অনু, তাই যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে প্রত্যয়ের বাহু থেকে নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে, হাঁটা ধরলো রাস্তার উল্টো পথে, ওকে এভাবে চলে যেতে দেখে প্রত্যয়ও হাটা দিলো অনুর পিছু পিছু। প্রত্যয় পেছনে আসছে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অনু ঘাড় ঘুরিয়ে কাঠকাঠ গলায় বললো,
— ওখানেই দাঁড়ান, আর আসবেন না। অনুরোধ নয়,নিষেধ করছি।

অনুর নিম পাতার মতোন তেঁতো কথায় প্রত্যয় আর এগোতে পারলোনা, অগত্যাই দাঁড়িয়ে পরলো রাস্তার মাঝখানে, অনু চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেলো সেখান থেকে। যতক্ষণ পর্যন্ত অনুকে দেখা যায়, ঠিক ততক্ষন ওর যাওয়ার পানে নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে রইলো প্রত্যয়।এক পা ও নড়লো না।
*****************************************
খুব ভোর নয়, সকাল পেরিয়ে বেলা গড়িয়েছে অনেকটা। চারিদিকে সূর্যের সোনালী আলোর ঝলকানি, অরু সেই কখন থেকে ক্রীতিকের রুমের সামনে দাড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে পায়চারি করছে। মনে মনে ভাবছে,
— শুনেছি ভোর রাতে রুমে ঢুকেছে এখনো ঘুমিয়ে আছে কিনা কে জানে? নক করবো কি করবো না? করবো কি করবো না? না থাক চলে যাই, না একবার করেই দেখি।

অরু যখন কি করবে না করবে ভেবেই কুল পাচ্ছিল না, তখনই ভেতর থেকে ডেকে ওঠে ক্রীতিক,
— তোর পায়চারি তে মাথা ঘোরাচ্ছে আমার ভেতরে আয়।

অরু চট করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
— আপনি কি করে বুঝলেন আমি দাঁড়িয়ে আছি?

কথাটা বলে ভেতরে ঢুকতেই চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে দ্রুত পেছনে ঘুরলো অরু। ক্রীতিক গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে, ওর জিম করে কৃত্তিম উপায়ে বানানো ভি শেইপ পৃষ্ঠদেশ স্পষ্ট দৃশ্যমান অরুর চোখে। এভাবে অসময়ে এসে পরে নিজেই লজ্জিত হলো ও। অরুর কথার জবাবে ক্রীতিক সামনে ঘুরে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,
— মেইবি, আমি তোর শরীরের গন্ধ পাই।

অরু এখনো পেছনে ঘুরে দাড়িয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
— হয়ে গিয়েছে তাকাতে পারিস।

অরু যেন কিছুই বোঝেনি, লজ্জাও পায়নি, সেভাবে করেই মুখ ভঙ্গিমা সাভাবিক রেখে ঘুরে বললো,
— আপনি কি ভ্যাম্বায়ার? না মানে শুনেছি ভ্যাম্পায়াররা মানুষের গন্ধ পায়।

ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ব্ল্যাক বেল্ট ঘড়িটা হাতে পরতে পরতে ক্রীতিক বলে,
— বেশি বেশি ফ্যান্টাসী বই পড়লে এই হয়, মাথার মধ্যে সব ভুত প্রেত ভর করে বসে আছে, ক্লাসের বই তো খুলেও দেখিস না, এবার ইউ এস এ ফিরে তোকে দেখে নিচ্ছি আমি।

পড়াশোনার কথা আসতেই অরু দ্রুত কথা ঘুরিয়ে কাজের কথায় চলে এলো, মিনমিনিয়ে বললো,
— আপনার ফোনটা একটু দিবেন আপাকে কল করতাম।

— রাতের ফ্লাইটে তো ফিরেই যাচ্ছি কল করার কি আছে?

জবাবে অরু ঠোঁট উল্টে বলে,
— আপার জন্য মন খারাপ লাগছে, আমি কথা বলতে চাই।

ক্রীতিক নিজের হাতের কাজ করতে করতে বললো,
— জ্যাকেটের পকেটে আছে খুঁজে দেখ, আর হ্যা, আমার সামনে বোনের সাথে একদম ন্যাকামি করবি না, যা কথা বলার নিজের রুমে গিয়ে বল।

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ফোন নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। তারপর আবারও কি ভেবে যেন ফিরে এসে বলে,
— ফোনের পাসওয়ার্ডটা…

— তোর আর আমার বার্থডে।

অরু হতবাক হয়ে পুনরায় শুধালো
— কিহ?

ক্রীতিক ঘাড় ঘুরিয়ে ধমকের সুরে বললো,
— কানে কম শুনিস?

অরু ভয়ে তটস্থ হয়ে এদিক ওদিক ঘাড় নাড়িয়ে,আবারও দৌড়ে চলে যায়। যেতে যেতেই লক খুলে কল লাগায় অনুর নাম্বারে।

একবার, দু’বার, তিনবার,গিয়ে চারবারের মাথায় কল তুললো, অনু।
— হ্যালো আপা!

এপাশ থেকে অরুর উৎসুক গলা শুনেই তেতে উঠলো অনু, গলারস্বরে হাজারো বিরক্তি টেনে এনে ঝাঁজ নিয়ে বললো,
— কি সমস্যা কল দিয়েছিস কেন? আমাকে একা রেখে সৎ ভাইয়ের টাকায় থাইল্যান্ড গিয়েছিস,ঘুরছিস,ফিরছিস, খাচ্ছিস, এনজয় করছিস, তবুও স্বাধ মিটছে না? নাকি আমাকে ইউজ করে আমার ঘাড়ে পা দিয়ে জীবন কাটানোর শখ এখনো মেটেনি?

অনুর তিক্ত কথায় চড়াৎ করে মস্তিষ্কটা ঝাঁজিয়ে উঠলো অরুর, ও নিজেও তেজি স্বরে বললো,
— মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছিস তখন থেকে, কি হয়েছে কি করেছি আমি?

অনু উল্টো ক্রো’ধ দেখিয়ে বললো,
— যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি, বুঝেশুনে বলেছি, তোরা সবাই আমাকে ব্যাবহার করিস নিজেদের প্রয়োজনে। কেন বলতো? সব সময় তোদের চিন্তাই আমার কেন করতে হবে? আমার কি ইচ্ছা অনিচ্ছা বলে কিছু নেই?

অরু এবার নরম সুরে শুধালো,
—কি হয়েছে আপা?

অরুর প্রশ্নের কিঞ্চিত পরোয়া না করে,অনু মুখে যা আসছে উন্মাদের মতো তাই বলে যাচ্ছে, অরু জানে আপার রা’গ উঠলে মাথা ঠিক থাকেনা, পরে আবার নিজেই সব সামাল দেয়, তাই এতোএতো তিক্ত কথার বিপরীতে
অরু নিজের রাগ সংবরন করে আবারও জিজ্ঞেস করল,
— কি হয়েছে বলনা আপা? কে কি বলেছে তোকে? মা ঠিক আছে, আমি…

ওর একাধারে প্রশ্নের একপর্যায়ে অনু নিজের খেইর হারিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
— তুই এবার আমাকে বিচারকদের মতো প্রশ্ন করা বন্ধ কর অরু, আমি বিরক্ত তোর এসব প্রশ্নে, তোর এতো আনন্দ আমার সহ্য হচ্ছেনা, আমার ঘাড়ে পা দিয়ে এভাবে জীবন কাটাতে লজ্জা হয়না তোর? আর কতদিন আমার উপর ভরসা করে বাঁচবি? তোদের দেখভাল করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি আমি, এবার একটু রেহাই দে, এবার অন্তত আমাকে ইউজ করা বন্ধ কর।

— আমি তোকে ইউজ করি?

— হ্যা করিস, তোরা সবাই মিলে আমাকে নিজেদের সার্থে ইউজ করিস, এবার আমাকে আমার মতো বাঁচতে দে অরু, একনাগাড়ে চোখ খিঁচে কথাগুলো বলে মুখের উপর ফোন কেটে দিলো অনু।

ওদিকে অনুর বলা শেষ কথায় মাথার মধ্যে অ’গ্নিস্ফুলিঙ্গ অনুভব হলো অরুর,কষ্টের সীমানা পেরিয়ে, মেজাজ চড়ে এসেছে সপ্তম আসমানে। ইচ্ছে করছে আশেপাশের সব কিছুর ভে’ঙে গুড়িয়ে ফেলতে,নিজের অজান্তেই ধপ করে মেঝেতে বসে পরে দু’হাতে নিজের লম্বা চুল গুলো মু’ঠিবদ্ধ করে, নিরবে চোখের জ্বল ফেলতে ফেলতে অস্পষ্ট সুরে অরু বললো,
— তারমানে মায়ের অবর্তমানে আপাও আমাকে করুনা করে এসেছে। কোনো ভালোবাসা নেই সবটা করুনা, সবাই করুনা করে আমাকে।
*****************************************
এলিসার বাবাকে থাই পুলিশ এ্যা’রেস্ট করেছে, এবার আর প্রমান ছাড়া নয় সুস্পষ্ট প্রমান সমেত তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
—যেহেতু ওর বাবা জেলে আছে সেহেতু এলিসাকে ব্ল্যা’কমেইল করার মতো আপাতত কেউ নেই, বলতে গেলে এলিসা এখন পুরোপুরি নিরাপদ।

সায়রের কথায় অর্নব আর ক্রীতিক হ্যা সূচক মাথা নাড়ালো।

অর্নবের হ্যা সূচক সম্মতি শুনে সায়র এবার উচ্ছ্বাসিত সুরে বললো,
—তাহলেতো আমাদের মিশন কম্পিলিট, আজ রাতে পার্টি করলে কেমন হয়?

এবার অর্নব বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বললো,
— তুই কি পা’গল? এলিসার মন ভালো নেই, আর তুই আছিস তোর পার্টি নিয়ে।

ক্রীতিক কিছু একটা ভেবে পায়ের উপর পা তুলে বললো,
— আমার হাতে সময় নেই কাল ভার্সিটিতে এক্সাম ফিরতে হবে।

সায়র হতাশ হয়ে বললো,
—তোরা না থাকলে আমি কি জ্বিন ভুতের সাথে পার্টি করবো নাকি?চল রাতেই ফিরে যাই তাহলে।

কথাটা শেষ করে সায়র কেবলই বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে, ওর সামনের ডিভানটাতে এখনো ক্রীতিক পায়ের উপর পা তুলে বসা, তখনই কোথা থেকে যেন অরু এসে এক প্রকার হামলে পরলে সায়রের উপর, ওর চেহারা বি’ভৎস, চুল গুলো এলোমেলো, চোখদুটো টলছে, সেথা থেকে গড়িয়ে পরছে অস্রুসিক্ত নোনাজল। অরু আশেপাশের কারোর দিকে নজর না দিয়েই, সায়রের কলার দুটো শক্ত করে চেপে ধরে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললো,
— সায়র ভাইয়া! বিয়ে করবেন আমায়? আপনার তো কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই, তাছাড়া আপনার মাথার সবগুলো তাড় ও ঠিকঠাক আছে, আমার আপনাকে বিয়ে করতে কোনো আপত্তি নেই, আমি কারও বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা,কারও করুনার পাত্রীও হতে চাইনা আর এক মূহুর্ত ও না, বিয়ে করবেন আমাকে? হতে পারে আমি আপনার চেয়ে বয়সে একটু বেশিই ছোট তাতে কি আসে যায়?ভালো করে তাকিয়ে দেখুন আমি সুন্দরী।

এদিকে সায়র অরুকে কি দেখবে, অরুর পেছনে দাড়িয়ে থাকা ক্রীতিককে দেখেই ওর গলা শুকিয়ে এসেছে। ক্রীতিকের জ’লন্ত আ’গ্নেয়গিরির দাবানলের মতো চোখ দুটো দেখেই ওর হাত পা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে, চোখ দিয়ে বারবার ক্রীতিককে ইশারা করে বোঝাচ্ছে,
— ভাই আমি কিছু জানিনা,তোর জানের জান পরানের পরান অরুই আমাকে ইচ্ছে করে ফাঁসা’চ্ছে।

ক্রীতিক একনজর সায়র কে পরখ করে কপালে দু আঙুল ঠেকিয়ে কিছু একটা ভাবলো, তারপর হুট করেই উঠে দাড়িয়ে, অরুর হাতটা শ’ক্ত করে চেপে ধরে ওকে ইচ্ছে মতো টানতে টানতে বেডরুমে নিয়ে ছু’ড়ে মা’রলো, অকস্মাৎ টাল সামলাতে না পেরে অরু হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পরে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। দাঁড়ানো থেকে এভাবে হুট করে মেঝেতে পরায় কনুই আর হাঁটুর অবস্থা বেগতিক। কাঁদ’তে কাঁ’দতে অরু নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে খুব , কিন্তু প্রচন্ড আ’ঘাতে হাত পা গুলো যেন অসার হয়ে পরেছে ওর। ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্রীতিক নিজের দু’পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট কন্ঠে বললো,
— আমি আসছি ততক্ষণ এখানেই পরে থাক, অন্যকারও শরীরে হাত ছোঁয়ানোর শা’স্তিটা সময় হলে টের পাবি।
*****************************************অরুকে নিজের রুমে আটকে রেখে ক্রীতিক আবারও ওদের কাছে ফিরে আসে, অর্নব,সায়র, এলিসা তিনজনই ভ’য়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের পানে। সবাইকে নিশ্চুপ হয়ে থাকতে দেখে
সায়র একটু সাহস করে বলে ওঠে,
— কি করেছিস ওর সাথে?

সা’পের ফনা তোলার মতো তরিৎ গতিতে সায়রের দিকে হিং’স্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক বলে,
— যা ইচ্ছে করেছি, আমাদের প্রাইভেট কথাও তোকে শেয়ার করতে হবে?

সায়র কিছু বলতে যাবে, তার আগেই অর্নব ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— আর একটাও কথা বলবি না সায়র। নয়তো ক্রীতিকের হাতে আজই তোর খেল খতম।

বার কয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে ক্রীতিক নিজের পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করে অর্নবের হাতে দিয়ে বলে,
—ডকুমেন্টস গুলো যত দ্রুত সম্ভব বের কর।

পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে,সেটাকে উল্টে পাল্টে দেখে,অর্নব নিজের ঠোঁট কা’মড়ে বললো,
— একটু বেশি তারাহুরো হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা?

অর্নবের কথায় ওর দিকেও অ’গ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্রীতিক। ক্রীতিকের চোখের হিং’স্রতা দেখে অর্নব চোখ নামিয়ে নিলে, এলিসা এগিয়ে এসে অর্নবের কাধে হাত রেখে বললো,
— জেকে যা করতে চাইছে,সেটা ওকে করতে দে অর্নব।

অর্নব এলিসার দিকে তাকিয়ে ছলছল নয়নে বলে ওঠে,
— তুই বললে, আমি সব কিছু করতে রাজি জান, তুই শুধু একবার বল জেকের সাথে আমারটাও…

অর্নব আর কিছু বলবে তার আগেই নিজের তিন ইঞ্চি হাই হিল নিয়ে অর্নবের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে পরলো এলিসা, অতঃপর ওর কাঁদো কাঁদো মুখের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে এলিসা শুধায়,
—- কি যেন বলছিলি? আবার একটু বল।
*****************************************
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়েছে, সূর্যের আলো পুব আকাশ থেকে পশ্চিমে গিয়ে ঠেকেছে। অরু এখনো মেঝেতে বসে বিছানায় মাথাটা এলিয়ে দিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। অনেকক্ষন ধরে একটানা কাঁ’দার ফলে ক্ষনে ক্ষনে কেঁপে উঠছে ওর ক্রন্দনরত ছোট্ট শরীরটা। তখন আপার সাথে রাগ করে কি বলতে কি বলেছে, কাকে বলেছে কিছুই মাথায় ঢোকেনি। অথচ এখন সেসব কথা মনে পরলেই ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় নিজেই বা’রি মে’রে বেহুস হয়ে যেতে। সবার সামনে কতোটা নির্লজ্জের মতো সায়রকে গিয়ে বিয়ের কথা বলছে ও। এখন ভাবলেও বিরক্তিতে শরীরটা চিড়বিড়িয়ে উঠছে, সবাই কি ভেবেছে, কে জানে? যে যা ভাবার ভাবুক, তবে অরু ঠিক করেই নিয়েছে সায়রের মুখোমুখি আর এ জীবনে হবে না ও। কি করেই বা হবে, সায়রকে দেখলেই তো নিজের করা মস্তবড় বোকামির কথা বারবার মনে পরে যাবে। সকালের কর্মকান্ডের কথা ভেবেই হাত পা ছড়িয়ে আরও এক দস্তুর কেঁদে ভাসালো অরু।তারপর মনে মনে ভাবলো,
—আপাকে আরেকবার কল করে দেখলে কেমন হয়?এখন তো রাগ কমেও যেতে পারে।

যেই ভাবা সেই কাজ অরু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বিছানার আসেপাশে ক্রীতিকের মোবাইলটা খুঁজতে লাগলো, কিন্তু মোবাইলের যায়গায় অন্যকিছু হাতে এলো ওর, নরম বিছানায় মাথার পাশেই যে কুশনটা রাখা থাকে তারপাশেই ওর রুপোলি নুপুরটা আঁকাবাকা হয়ে পরে আছে, এতো বছর ধরে পায়ে পরে থাকা নিজের সুপরিচিত নুপুরটা দেখে অরু দ্রুত গিয়ে সেটাকে হাতরে নিলো,হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে বললো,
— আরে এটাতো আমার নুপুর, এলিসা আপুর জন্মদিনের পার্টিতে হারিয়ে ফেলেছিলাম। এটা ওনার কাছে কি করে এলো? আর ওনার কাছে যদি থাকবেই তাহলে সেদিন কেন জিজ্ঞেস করলো, আমার নুপুর কোথায়? আশ্চর্য মানুষ তো, আমার নুপুর দিয়ে ওনার কি কাজ?

একমনে কথাগুলো বলে অরু পা বাড়িয়ে দেয় নিজ হাতে নুপুরটা পরার জন্য। ঠিক তখনই বাইরে থেকে আগমন ঘটে ক্রীতিকের, ও হুর মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে বেডসাইড টেবিল থেকে কিছু কার্ড নিজের ওয়ালেটে ভরে নেয়, অতঃপর অরুর হাতে হ্যাচকা টান মে’রে ওকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে,
— চল।

অরু ভ্রু কুঞ্চন করে বললো,
— চল মানে, কোথায় যাবো?

ক্রীতিক জবাব দেয়না কোনোরূপ, বরং ওকে জোর জ’বরদস্তি করে টা’নতে টান’তে বাইরে নিয়ে যায়,
— হাত ছাড়ুন লাগছে আমার, আরে আমার নুপুরটা ফেলে এসেছিতো, ছাড়ুউউন।

কে শোনে কার কথা, ক্রীতিকের স্থবির চোখমুখ আর ভাবমূর্তি দেখে মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে ওর শ্রবনশক্তিই হারিয়ে গিয়েছে।

*****************************************
একমনে এলোমেলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে উত্তাল প্রশান্ত মহাসাগরের সামনে এসে দাড়িয়েছে তার হদিস নেই অনুর। মাথার উপর গোল্ডেন গেইট ব্রীজ। তাতে হাজারো মানুষের ঢল আর তার নিচে সুবিশাল সমুদ্র তট। এখানেই তো প্রথমবার প্রত্যয়ের বুকে মাথা রেখেছিল অনু, কতটা প্রশান্তি, আর কতটা আবেগাপ্লুত হয়ে প্রত্যয়ের উপর নিজের ক্লান্ত শরীরের ভার ছেড়েছিল, প্রত্যয়ের আন্তরিকতা মাখা হাসি, মাথায় বুলানো আদুরে হাতের পরশ, রাতের আধারে একান্তে বৃষ্টিস্নান, সব কিছুই কি তাহলে মিথ্যা ছিল? প্রত্যয় তার সাত বছরের ভালোবাসা ভুলে যেতে, কেবলমাত্র ওকে ইউজ করছে এটাই কি সত্যি? তিন্নি নামক মেয়েটা কি সত্যি বলছে? অনু কি তবে শুধুই অন্য একজনার যায়গা পূরন করে ইউজ হয়েছে মাত্র ? “ইউজ” শব্দটা সেই সকাল থেকেই মাথার মধ্যে গেড়ে বসে আছে ওর। কিছুতেই শব্দটাকে সরানো যাচ্ছে না মাথা থেকে। ইউজ শব্দটা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই অনুর মনে পরে যায় সকালের কথা, নিজের ব্যাতিগ্রস্থ হৃদয়কে সামাল দিতে না পেরে সকাল বেলা যা নয় তাই বলেছে অরুকে। নিজের ছোট্ট বোনের প্রতি এরূপ জঘ’ন্য আচরণ করে, প্রত্যয়ের উপর জমে থাকা রাগ অরুর উপর ঢেলে এখন অনুশোচনায় বুক ফেটে কা’ন্না আসছে অনুর। কি করছে অরু?ঠিক আছেতো? নাকি আপার উপর অভিমান করে ভুলভাল কিছু করে বসেছে ওর ডানপিঠে বোনটা? হাজারো অজানা প্রশ্ন এসে বারি খাচ্ছে অনুর মস্তিষ্কে, ও আর ভেবে সময় নস্ট করতে পারলো না, তৎক্ষনাৎ অরুর সাথে কথা বলার জন্য দ্রুতই ফোন বের করে কল লাগালো ক্রীতিকের নাম্বারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বারবার ফোন করার পরেও কেউ ফোনটা তুলছে না, কি করে তুলবে? ফোনটা যে সেই সকাল থেকেই মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
এদিকে অরুকে কলে না পেয়ে শব্দ করে কাঁ’দতে কাঁ’দত অনু বসে পরে বালু আস্তরিত স্যাতস্যাতে বেলাভূমিতে।

*****************************************
সন্ধ্যা রাতে রিসোর্টের সামনে বাইক থামিয়ে, অরুর বাহু ধরে একপ্রকার টে’নে বাইক থেকে নামালো ক্রীতিক। অরুর চোখ মুখ বিমর্ষ।ওর গালে পাঁচ আঙুলের দা’গ সুস্পষ্ট। মাথাটা নুইয়ে রেখেছে সেই কখন থেকে। ক্রীতিক নিস্প্রভ চোখে অরুর দিকেই ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে। ওর কাছে এই ফোলা ফোলা চোখের অরুকে বরাবরই সুন্দর লাগে, আজ মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সুন্দর লাগছে। অরুর পরনে ছিল সুতির ঘাগড়া আর ওভার সাইজ টপস,টপস এর উপর বানজারা কারুকাজের কোটি, লম্বা হাটুসম চুল গুলো ঢিলেঢালা করে হাতখোঁপা বাধা, এতোক্ষণ ধরে হেলমেট পরে থাকায় খোঁপাটা মনেহচ্ছে আরও ঢিলে হয়ে গিয়েছে, এখনই খুলে পরবে পরবে ভাব। দুধে আলতা রাঙা মুখটা কেঁ’দে কে’টে লাল বর্ণ ধারণ করেছে, তবে সন্ধ্যারাতের হ্যাজাকের আলোয় এই লাল লাল চেহারায় বরই মায়াবী লাগছে তাকে। যে কেউ দেখে বলবে নতুন বিয়ের ছিড়ি জেগেছে মেয়ের মুখে।

খানিকক্ষণ বাদে ওদের পেছন পেছন উবার থেকে নেমে এলো এলিসা, অর্নব আর সায়র ও। কারও মুখে টু শব্দ নেই ওদের । চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। অরু চুপচাপ মাথা নুয়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই তখন থেকে , গলায় রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে তৈরি তাজা ফুলের মালা, হাতেও একটা ঝুলানো, এটা বোধ হয় ক্রীতিকেরটা। অরুর মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে এলিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, বন্ধুর বেলাতে বরাবরই ওরা সার্থপর হয়ে যায়, আজও তাই হয়েছে। তবে এখন অরুকে ভেতরে নিয়ে কিছু খাওয়ানো উচিৎ মেয়েটা সারাদিন না খেয়ে আছে। তাই চারিদিকের নিরবতা ভেঙে এলিসা বলে ওঠে,
— তোরা কি সারারাত এখানে দাড়িয়ে থাকার প্ল্যান করেছিস? যদি তাই হয়, তাহলে দাড়িয়ে থাক, আমি আর অরু ভেতরে গেলাম।

ওরা সবাই এখনো নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এলিসা অরুকে সাথে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে, পেছন থেকে ক্রীতিক ডেকে ওঠে ওদের,
— এলিসা শোন।

এলিসা ঘুরে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর পানে চাইলে, ক্রীতিক একটা সাইন করা চেকের পাতা এলিসার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— এটা অরুর মোহরানার টাকা, ওকে দিয়ে দিস।

এলিসা হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে চেক টা হাতে নিয়ে ভেতরে চলে যায়। ওদিকে ক্রীতিকের কান্ডে সায়র আর অর্নব অবাকের চড়ম সীমানায় গিয়ে চোখাচোখি করে দুজনে একই সুরে বলে উঠলো,
— পৃথিবীতে এটাই বোধ হয় প্রথম বিরল ঘটনা, যেখানে স্বামী তার বউকে মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে মোহরানা উশুল করে দিলো।

ওদের কথায় ধ্যান নেই ক্রীতিকের, ওতো সেই কখন থেকে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে , অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। অরু চলে গিয়েছে বহুক্ষণ আগে, তবুও তাকিয়ে আছে। অদুরে কোনো এক বাঙালি ক্যাফে থেকে তখনও কানে ভেসে আসছে বেসুরো দুটো লাইন,

“আমার কাছে তুমি অন্যরকম
ভালোবাসি বেশি, প্রকাশ করি কম”

চলবে…..

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ২২
#লেখনীতেঃsuraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]

চারিদিক জনমানবশূন্য হয়ে আছে, বিস্তৃত তিমিরে ঢাকা কালো রাতের ইতি টেনে সবে সবে ভোরের আলো ফুটেছে ধরনীতে। সূর্য এখনো তার তে’জস্ক্রিয়তা ছড়ায়নি পুরোপুরি ,প্রকৃতিতে হীম ধরা শীতল পরিবেশ বিরাজমান।

হাইওয়ে রাস্তার অদূর থেকে ভেসে আসছে দু একখানা কাভার্ড ভ্যানের শাঁইশাঁই আওয়াজ। রাস্তার দু’পাশে স্থীর মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সারিসারি বৈদ্যুতিক খুঁটির মাথায় বসেছে জোড়ায় জোড়ায় বন্য পাখিদের ঝাঁক। একের পর এক বন্য পাখিদের চোখের আড়াল করে নিভু নিভু ভোরে ফাঁকা রাস্তার মাঝ দিয়েই আপন গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের চার চাকা ব্ল্যাক মার্সিডিজ। গন্তব্য সানফ্রান্সিসকো ছাড়িয়ে নিজের নির্জন ছোট্ট বাড়িটা। এখন অবশ্য শুধু নিজের বলা যায়না, যেহেতু ও একজনের সারাজীবনের দায়িত্ব নিয়েছে,সেহেতু ক্রীতিকের যা তাতো তারও বটে।

এই হীম ধরা ঠান্ডার মাঝেও গাড়ির জানালার গ্লাস খুলে তাতে দু’হাত রেখে তারউপর চিবুক ঠেকিয়ে ফুপিয়ে কাঁ’দছে অরু। যদিও ক্রীতিক কা’ন্নাকাটি একদম পছন্দ করেনা, কিন্তু তাতে আপাতত অরুর হেলদোল নেই, জীবনটাই যেখানে এলোমেলো করে ছেড়ে দিয়েছে,সেখানে পছন্দ অপছন্দ দিয়ে কি আসে যায় আর?ক্রীতিক কি ভাববে সেসব কথা মাথায় না ঢুকিয়ে, এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়িতে ওঠার পর থেকেই কেঁদে ভাসাচ্ছে সে। মুখমন্ডল জুড়ে তার আকাশসম দুঃখের ছড়াছড়ি।

অরু প্যাসেঞ্জার সিটে বসা সত্ত্বেও পা’দুটো তুলে রেখেছে সিটের উপর । ও আরাম করে বসে আছে দেখে ক্রীতিকও বুঝে শুনেই গাড়ি ড্রাইভ করছে আপাতত, যাতে অরুর কোথাও না লাগে। অরুর বাধনহারা রেসমের মতো লম্বা সিল্কি চুলগুলো ক্রমাগত উড়ে এসে আঁচড়ে পরছে ক্রীতিকের চোখে মুখে, মাঝেমধ্যে ড্রাইভ করতেও অসুবিধা হচ্ছে খুব, তবুও ক্রীতিক কোনো কিছুরই পরোয়া করছে না, কারন ওর কাছে এই চুলের মিষ্টি গন্ধটা হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়ার মতোই প্রশান্তিদায়ক। দরকার পরলে এক ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টায় অতিক্রম করবে তবুও নিজের শরীর থেকে অরুর চুল সরাবে না।
কিন্তু অরুতো সেই ভোর রাত থেকেই বাইরে মুখ দিয়ে বসে আছে, বাইরের হীম ধরা পুরো ঠান্ডাটা ওর চোখেমুখে এসে হা’মলে পরছে, এরকম ঠান্ডার মধ্যে বাইরে মুখ দিয়ে আরও কিছুক্ষন বসে থাকলে বাড়িতে যেতে যেতেই অরুর নিউ’মোনিয়া হয়ে যাবে নিশ্চিত। তাই ক্রীতিক এবার একহাতে ড্রাইভ করতে করতেই অন্যহাত দিয়ে জানালার কাঁচ টা তুলে দিলো।

জানালার কাঁচ টেনে দেওয়াতে একটু পিছিয়ে বসেছে অরু, তবুও কা’ন্না থামায়নি। চোখ দিয়ে তার এখনো গঙ্গা যমুনা বয়ে যাচ্ছে। অরুকে এখনো কাঁদ’তে দেখে সামনে ফোকাস করেই বিরক্ত ভঙ্গিতে কথা ছো’ড়ে ক্রীতিক,
— কাঁদছিস কেন এভাবে? মে’রেছি তোকে?

ক্রীতিকের কথার পেছনে অরু মৌনতা পালন করে, শুধু মনেমনে বলে,
— এর থেকে মা’রলে বেশি ভালো হতো।

একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে, সেই কখন থেকে চুপ হয়ে আছে অরু, আদৌও উত্তর দেবে বলেও মনে হচ্ছে না। গতকাল থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে মেয়েটা। ক্রীতিক জানে কাকে কিভাবে কথা বলাতে হয়, তাই ও খানিকটা কৌশলী পন্থা’ই অবলম্বন করলো। হুট করেই মাঝরাস্তায় গাড়ির ব্রেক কষলো। এভাবে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অরু হকচকিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
— এসে গেছি?

কথাটা বলে বাইরে তাকিয়ে যেই দেখলো এটাতো মাঝরাস্তা, তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রীতিকের পানে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরু। ওর চাহনিকে পাত্তা না দিয়ে,গাড়ির ড্রয়ার থেকে একটা রুপোর নুপুর বের করে সেটাকে চোখের সামনে ধরে ক্রীতিক শুধালো,
—এটা তোর?

ক্রীতিকের প্রশ্নে অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়।

— চাই এটা?

এবারও অরু উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।

— তাহলে গাড়ি থেকে নাম।

ক্রীতিকের শেষ বারের কথায় অরু চোখ কপালে তুলে বললো,
— নামবো মানে? এই অচেনা রাস্তায় আপনি আমায় নামিয়ে দিয়ে যাবেন?

— ইডিয়েট।
অস্ফুটে কথাটা বলে ক্রীতিক নিজেই গাড়ি থেকে নেমে গেলো। অরু ক্রীতিকের যাওয়ার পানে চোখ রেখে বুঝলো এটা একটা পেট্রোল পাম্প। তারপাশেই ছোটখাটো একটা মার্ট, হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে গিয়েছে সে।
.
খানিকক্ষণ বাদে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে ফিরে এলো ক্রীতিক।অতঃপর গাড়িতে বসে সেটা অরুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— বাইরে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে আয়, তোকে পেত্নীর মতো দেখাচ্ছে, আমি রীতিমতো ভ’য় পাচ্ছি।

ক্রীতিকের কথাটা অরুর মোটেই পছন্দ না হলেও, এই মূহুর্তে চোখে মুখে আদতে একটু পানি ছিটানো প্রয়োজন, তাই গাইগুই না করে লম্বা চুল গুলোকে হাত খোঁপা বেধে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো অরু। চোখে মুখে ইচ্ছে মতো পানির ঝাপটা দিয়ে, নাক টেনে নিজেকে একটু সাভাবিক বানিয়ে পুনরায় গাড়িতে ফিরে এলো ও। অরু গাড়িতে বসতেই ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো ক্রীতিক। অরু টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
— এবারতো দিন, নুপুরটা আমার ছোট বেলার স্মৃতি ।

— নুপুরটা নিয়ে যাওয়া কি খুব দরকার? পরে নিলে হয়না?
ক্রীতিকের কথায় অরু আচমকা দৃষ্টিপাত করলো ওর চোখের দিকে, মনেমনে বললো,
— আশ্চর্য, আমার নুপুর দিয়ে ওনার কাজটা কি?

অরুর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে একটানে ওর পা দুটো নিজের উরুর উপর তুলে নিলো ক্রীতিক। এভাবে পা তুলে ফেলায় অকস্মাৎ পেছনে ঝুঁকে গেলো অরু, পুরো গাড়ি জুড়ে তখনও পিনপতন নীরবতা বিরাজমান । যার দরুন অরুর তীব্র শ্বাসপ্রশ্বাস আর হঠাৎ বেড়ে যাওয়া হৃদস্পন্দনের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ক্রীতিক ।অরুর এহেন পরিস্থিতিকে গ্রাহ্য না করে, আলতো হাতে ওর পায়ে নুপুর পরানো শুরু করে সে।নিজ পায়ে ক্রীতিকের হাতের নরম স্পর্শ অনুভব হতেই ঠোঁট কামড়ে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে অরু । নিজের এলোমেলো অজানা অনুভূতিতে বিরক্ত ও। যা সম্ভব নয় তাই সম্ভব করে ছেড়েছে ক্রীতিক। কিন্তু অরুকেই কেনো ব’লির পাঁঠা বানিয়ে এইরকম একটা অসাভাবিক সম্পর্কে জড়ালো সে?কেন অরুর সাথে সাথে নিজের জীবনটাকেও অগ্রহনযোগ্য সম্পর্কের মাঝে ঠেলে দিলো?কি চাইছে ক্রীতিক? এভাবে অরুর জীবনটা নষ্ট করে কোন ভুলের শোধ নিলো সে? একটা দু’টো নয়, অরুর মনে হাজারো দানা বাঁধা প্রশ্নের ছড়াছড়ি। কিন্তু কে দেবে এতো প্রশ্নের উত্তর?ক্রীতিক তো উত্তর দেওয়ার মতো ছেলেই নয়, অরুর প্রশ্নের তো মোটেই নয়।

অথচ এখন এই মূহুর্তে কি সুন্দর করে মনোযোগ দিয়ে অরুর পায়ে নুপুর পরাচ্ছে সে। দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে প্রয়োজনীয় আর সুক্ষ্ম কাজ কোনোদিন করেনি ক্রীতিক। অরু তখন থেকে হিজিবিজি চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে, চারিপাশে ওর খেয়াল নেই মোটেই । ক্রীতিক নিজের হাতের কাজটা শেষ করে একপলক ভাবুক অরুর চোখের দিকে তাকালো, অতঃপর নিজের হাতের বাধনটা আরও শক্ত করে, ওর পায়ে অকস্মাৎ হ্যাচকা টান মে’রে অরুকে নিজের কাছাকাছি টেনে নিয়ে এলো। আচমকা পায়ে টান দেওয়াতে সুতির ঘাগড়াটা অনেকটা উপরে উঠে গিয়ে মোমের মতো সুন্দর পা’দুটো দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে ক্রীতিকের চোখের সামনে। ক্রীতিক শুষ্ক ঢোক গিলে সেদিকে একবার পরখ করে, চোখ ঘুরিয়ে অরুর অস্রুসিক্ত নয়নে চোখ রাখলো,তারপর আরেকটু কাছে এগিয়ে গিয়ে, নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ওর চোখের জলটুকু মুছিয়ে দিতে দিতে মাদকতায় নিবিষ্ট চাহনী নিক্ষেপ করে, দু’ঠোঁট নাড়িয়ে হাস্কি স্বরে বললো,
— “বউ”

ক্রীতিক খুব আস্তে করে শব্দটা উচ্চারণ করলেও অরুর শ্রবনেন্দ্রীয়তে তা স্পষ্ট ভাবে পৌঁছেছে, কথাটা শোনা মাত্রই অজানা শিহরণে শরীর ছেয়ে গেলো অরুর। কাটা দিয়ে উঠলো শরীরের প্রত্যেকটা লোমকূপ। অজান্তেই তলপেটের মাঝে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে দিলো অসংখ্য প্রজাপতির দল। ইশশ কি অসস্থিদায়ক অনুভূতি। অরুর কেমন কেমন লাগছে, গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে মূহুর্তেই। ক্রীতিক এখনো একই ভাবে তাকিয়ে আছে। অরু আমতা আমতা স্বরে বলে উঠলো,
— আআমি পানি পান করবো।

অরুর কথায় ক্রীতিকের ঘোর কেটে যায়, ও মূহুর্তেই অরুর থেকে দুরত্ব বাড়িয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দেয়, ড্রাইভ করতে করতে মনেমনে ক্রীতিক ভাবছে,
—যাক কান্নাকাটি তো অন্তত থেমেছে।

ওদিকে অরু এক নিঃশ্বাসে ঢকঢক করে পানি পান করে পুরো বোতল খালি করে ফেলেছে। তবুও কোনো কিছুর তৃষ্ণাতে হাসফাস করছে ভেতরটা, কি অদ্ভুত এই অনুভূতি, ক্রীতিক কি জাদু জানে?

*****************************************
অনু ফ্রন্ট ইয়ার্ডেই দাড়িয়ে ছিলো। অরু অনুকে দেখা মাত্রই ফেঞ্চ গেইট ঠেলে ভেতর প্রবেশ করে দৌড়ে গিয়ে অনুর গলা জড়িয়ে ধরে হাউমা’উ করে কেঁ’দে ওঠে। অনু জানে অরুর এমন কান্নার কারন ও নিজেই। তাই নিজের কাজে বড্ড অনুতপ্ত অনু। অরুর এমন হৃদয় নিংড়ানো কা’ন্নার গতিবেগে অনুও আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না,বোনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে , ডুকরে কেঁ’দে উঠে অনু বলে,
—আপার উপর অভিমান করে এভাবে কাঁদিস না সোনা, আপা খুব সরি, আর কখনো তোকে এভাবে বকবো না, আমার ঘাট হয়েছে।

অনুর কথায় ক্রদনরত অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়ায়। অরুর ভাব ভঙ্গিমা অনুর বোধগম্য হয়নি, তাই অনু পুনরায় নরম সুরে বললো,
— বলেছিতো আর কখনো বকবো না এভাবে, এসেছিস থেকে কেঁদেই যাচ্ছিস, কি হয়েছে ক্রীতিক ভাইয়া কিছু বলেছে, দেখি আমার দিকে তাকা?

অরুর গাল দুটো আঁজলা করে ধরে, মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অনু আবারও শুধায়,
—- ক্রীতিক ভাইয়া কিছু বলেছে?

অনুর প্রশ্নে অরু পেছনে দৃষ্টি নিক্ষেপন করে, তাকিয়ে দেখে ক্রীতিক নেই, হয়তো ভেতরে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। তারপর পুনরায় অনুর দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়িয়ে নাক টেনে অরু বলে,
— কেউ কিচ্ছু বলেনি।

অনু নিশ্চিন্ত হয়ে অরুর দু’চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,
— মায়ের অ’পারেশন হয়ে গিয়েছে, এখন
আই সি ইউ তে আছে, দু’একদিনেই হয়তো চোখ খুলবে মা, তারপর আমরা মায়ের সাথে কথা বলতে পারবো, মাকে নিয়ে দেশেও ফিরে যাবো আর দুঃখ নেই।

এতো বড় একটা খুশির খবরেও কেন যেন খুশি হতে পারলো না অরু, কি করে পারবে? গতকাল রাতেই নিজের সবটা সৎ ভাইয়ের নামে লিখে দিয়ে এসেছে। এসব কথা জানা জানি হলে মা আপা কেউই ওকে মেনে নেবেনা। ভালোবাসবে না। উল্টে নোংরা বলে আখ্যায়িত করবে। এতোগুলো দিন পরে একটু খানি খুশির মুখ দেখেছিল ওর পরিবারটা, অথচ অরু সবার আড়ালে সেটা ধূ’লিসাৎ করে মাটিতে মিশিয়ে এসেছে। ক্রীতিক কেন করলো এমনটা?

নিজের ভাবনার মাঝেই,অরু তৎক্ষনাৎ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে ক্রীতিককে ও প্রশ্ন করবেই করবে, তাতে যা খারাপ হওয়ার হোক। তাছাড়া ক্রীতিক তো ওর সাথে খারাপ কোনো কিছু করার বাদ রাখেনি, তাহলে এতো ভ’য় কিসের?

অরুর অজ্ঞাত ভ্রমকে ভাঙিয়ে দিয়ে ফ্রেঞ্চ গেইট ঠেলে আগমন ঘটে প্রত্যয়ের। প্রত্যয়কে দেখে অরু এক নজর অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে দ্রুত হেটে বাসার ভেতরে চলে যায়। অরু চলে গেলে অনু নিজেও পা বাড়ায় ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এই মূহুর্তে প্রত্যয়ের সাথে কথা বলাতো দূরে থাক, ওর মুখটাও দেখতে ইচ্ছে করছে না অনুর।

কিন্তু পেছনে ঘুরে কয়েক কদম পা বাড়াতেই প্রত্যয় ওকে টেনে ব্যাক ইয়ার্ডে নিয়ে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে। প্রত্যয়ের এমন কান্ডে অনু রেগেমেগে ঝাঁজিয়ে উঠে বলে,
— কি অস’ভ্যতা শুরু করেছেন, বাড়িতে ক্রীতিক ভাইয়া আছে।

প্রত্যয় ওর মুখটা শ’ক্ত হাতে চেপে ধরে বললো,
— শুউউ, ওই জন্যই তো বলছি আস্তে কথা বলো।

অনু ওর হাতটা ঝটকা মে’রে সরিয়ে দিয়ে বললো,
— কি চাই আপনার, আমাকে ইউজ করে স্বাধ মেটেনি? নাকি তিন্নির সাথে আজ দেখা হয়নি? তাই রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে আমার কাছে এসেছেন।

প্রত্যয় চটে আছে খুব, মেয়েটার তেজের সাথে কিছুতেই পেরে ওঠেনা সে, কিন্তু এই মূহুর্তে অনুর ব্লে’ডের মতো ধারা’লো কথার আ’ঘাতে র’ক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে হৃদয়টা, সেইসাথে মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য।প্রত্যয় নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে, চড়াৎ করে তুঙ্গে উঠে যাওয়া মেজাজের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো তৎক্ষনাৎ, অনুর হাতদুটো মাথার উপরে তুলে দেওয়ালের সাথে চে’পে ধরে, ওর গলার কাছে মুখ নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রত্যয় বলে,
— কথা না শুনলে জা’নে মে’রে ফে’লবো। গত দুদিন ধরে কু’কুরের মতো পিছনে পরে আছি, কিছু একটা এক্সপ্লেইন করতে চাচ্ছি। একবারও সুযোগ দিয়েছো আমায়? এতো তেজ কেনো তোমার?

প্রত্যয় এই প্রথমবার অনুকে তুমি করে অধিকার খাটিয়ে কথা বললো। প্রত্যয়ের মুখের তুমি আওয়াজটা যে এতোটা সুমধুর তা অজানাই ছিল অনুর। প্রত্যয়ের মুখে তুমি শুনে হতবাক হয়ে ওর চশমার আড়ালে ধূসর চোখ জোড়ার দিকে বিনাবাক্যে তাকিয়ে আছে অনু।
একটুখানি থেমে প্রত্যয় পুনরায় কঠিন সুরে বললো,
— আর কি যেন বললে, ইউজ। ইউজ করা কাকে বলে সেটা কি আদৌও বোঝো তুমি? নাকি বুঝেই যাকে তাকে গিয়ে এসব বলো?

অনু এবারও পুরোপুরি নিশ্চুপ, ও ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে প্রত্যয়ের চোখে।
অনুকে তখন থেকে এভাবে অবাক নয়নে চেয়ে থাকতে দেখে রা’গী আওয়াজটা মূহুর্তেই নিচু হয়ে গেলো প্রত্যয়ের, চোখ দুটোতে হিং’স্রতার জ্বল’ন্ত অ’ঙ্গার দপ করে নিভে গিয়ে তাতে জড়ো হলো একরাশ মুগ্ধতা। এলোমেলো অনুভূতি গুলো উথাল-পাতাল ঢেউ তুলে আঁচড়ে পরছে মনের তটে। অনু এতোটা কাছে দাড়িয়ে আছে, এতোটা কাছে,যে ওর তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো প্রত্যয়ের মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পরছে বারেবারে ।এবার আর কোনো কথা নয় অনুর নিস্প্রভ চোখে একপলক চোখ রেখে প্রত্যয় নিজের খেইর হারিয়ে ফেললো। মূহুর্তেই নিজের ওষ্ঠাগত করে নিলো অনুর তিরতির করে কাঁপতে থাকা অধর যুগল। অনুর ঠোঁটের ছোঁয়ায় হঠাৎ করেই যেন উন্মাদনা ছড়িয়ে পরলো প্রত্যয়ের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অনুর দিক থেকে কোনোরূপ বাঁধা না আসাতে, পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলো আপনা আপনি।

এদিকে প্রত্যয়ের নরম ঠোঁটের স্পর্শে অনুর জান যায় যায় অবস্থা। খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ রেখে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও পরক্ষণেই দু’হাত দিয়ে প্রত্যয়কে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে তরিৎ গতিতে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো অনু। অনুর ধাক্কায় প্রত্যয় নিজের সম্বিত ফিরে পেয়ে, নিজের কর্মকান্ডের জন্য লজ্জিত হয়ে নরম সুরে বললো,
— আ…আ’ম সরি।আসলে..

অনু ওকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে না ঘুরেই জবাব দিলো,
— সরি বলতে হবে না আপনি যান এখন।

আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই অনু, একান্তে, আমায় কি একটু খানি সময় দেওয়া যায়না?

অনু এবার ঘুরে দাড়িয়ে প্রত্যয়ের মুখোমুখি হয়ে শুধালো,
— প্রত্যয় সাহেব, আপনি শুধু আমার তাইতো?

প্রত্যয় সেদিনের মতোই কন্ঠে দৃঢ়তা টেনে বললো,
— হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

—আগামী কাল বিকেলে সি-বিচে অপেক্ষা করবো।

অনুর এইটুকু আস্কারা পেয়ে প্রত্যয় যেন চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশির ঝিলিক ফুটে উঠেছে ওর চোখে মুখে। প্রত্যয়কে এভাবে নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসতে দেখে, অনু ভেতরে যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে আবারও পেছনে তাকিয়ে বললো,
— আর হ্যা, বাবল টি আনতে ভুলবেন না যেন।

প্রত্যয়ের নরম হাসি এতোক্ষণে পুরো ঠোঁট জুড়ে প্রসারিত হলো, ও পেছন থেকে হাঁক পেরে বললো,
— যথাআজ্ঞা মহারানী।
*****************************************
মাঝরাতে ফেইরী লাইটের নিভু নিভু আলো আর সুইমিং পুলের নীলচে পানির কলকলানি মিলেমিশে পুরো ছাঁদ বারান্দা জুড়ে ম্যাজিক্যাল আলোছায়া তৈরি করেছে। মাথার উপর খোলা আকাশ, আকাশে রুপোর থালার মতো মস্তবড় চাঁদ উঠেছে । কখনো কখনো সেই চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে, পেঁজা তুলোর মতো উড়ো মেঘে। আবার কখনো তীর্যক রুপোলী আলো ছড়াচ্ছে,পুরো ভুবন জুড়ে।
চাঁদের দিকে নিকোটিনে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেটাই তখন থেকে বেশ আগ্রহ নিয়ে পরখ করছে ক্রীতিক। রাত প্রায় দু’টো বেজে পয়ত্রিশ তাও চোখের পাতায় ঘুম আসার নাম নেই, তাইতো রুম থেকে বেরিয়ে ছাঁদ বারান্দায় এসে সিগারেট ধরিয়েছে সে। সিগারেটের কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার সাথে সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে নিজের মনে জমানো অজস্র অযাচিত ভাবনা গুলোকে, অবশ্য এখন আর ভেবে লাভটাই বা কি?অরু তো সারাজীবনের জন্য ওর।

অরু নামটা ভাবতে যতটা দেরি হলো অরুর সেখানে উপস্থিত ততটা হতে দেরি হলোনা। নিশুতি রাতে কারও নিস্তব্ধ পায়ের আওয়াজ পেয়ে ক্রীতিক পেছনে ঘুরে দেখলো অরু দাঁড়িয়ে আছে। পরনে খয়েরী রঙের সুতির চুড়িদার লম্বা চুল গুলো দিয়ে টুপটাপ করে পানি ঝড়ে শরীর ভিজে যাচ্ছে, তাতেও হেলদোল নেই অরুর, চোখে মুখে চড়ম বি’ষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। হাত পায়ের ফর্সা ত্বকগুলো ফ্যাকাসে হয়ে কুঁচকে আছে, মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে পানিতে ভিজেছে, অরুর এমন উদভ্রান্তের মতো মুখশ্রী দেখে ক্রীতিক ভ্রু কুঁচকে শুধালো,
— এতো রাতে শাওয়ার কেন নিয়েছিস? কি প্রয়োজনে?

অরু জবাব দেয়না, চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় ক্রীতিকের মুখোমুখি হয়ে, ক্রীতিকের পরনে কালো হুটি আর ওভার সাইজ ডেনিম। অরু নিস্প্রভ চোখে ক্রীতিকের কালো কুচকুচে হুডিটার দিকে চেয়ে আছে চুপচাপ , ওর কর্মকান্ড দেখে ক্রীতিক বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
— এতো রাতে না ঘুমিয়ে এখানে কি? আমার সাথে ঘুমাবি? ঘুমালে চল আমিও একটু আরাম করে ঘুমাই।

ক্রীতিকের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু-হাত দিয়ে ওর পেশিবহুল বুকের উপর ধা’ক্কা দিয়ে অরু কাঁদতে কাঁদত বললো,
— কেন করলেন এটা? কি দোষ করেছি আমি? কোন দোষের শা’স্তি সরূপ আমার জীবনটা এভাবে তছনছ করে দিলেন আপনি? বলুন কেন? কি হলো বলুন?

এবার, দু’বার, তিনবার যখন ক্রীতিকের বুকের উপর অরু ধা’ক্কা দিতে যাবে, তখনই ওর দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ক্রীতিক। চেহারায় গাম্ভীর্য টেনে এনে, কঠিন সুরে বলে,
— যা করেছি, খুব ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় করেছি, এবার এটা যত তারাতাড়ি মেনে নিবি ততই তোর জন্য মঙ্গল।

ক্রীতিকের কথায় অরু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— আপনি কি পা’গল? আপনার বাবা জামশেদ জায়ান চৌধুরী আমার মায়ের প্রয়াত স্বামী। সে হিসেবে আপনি আমার সৎ ভাই, কিভাবে ভুলে গেলেন এটা?

অরু কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক টান মে’রে একহাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে শ’ক্ত করে ওর গালদুটো চে’পে ধ’রে বললো,
— খবরদার নিজেকে আমার বোন বলবি না, একদম মে’রে ফে’লবো, তুই আমার বিয়ে করা বউ, তোর সব কিছু আমার, তোর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত এভরিথিং ইজ বিলোংস টু মি।

তীব্র রা’গে কাঁপতে কাঁপতে কথাটুকু শেষ করে অরুকে ধা’ক্কা মে’রে সরিয়ে দেয় ক্রীতিক।
ক্রীতিক ছাড়তেই অরু কাঁ’দতে কাঁ’দতে মেঝেতে বসে পরে, অতঃপর হেঁচকি তুলে অস্পষ্ট সুরে বলে,
—-সমাজ কোনোদিনও এই বিয়েকে সীকৃতি দেবেনা।উল্টে আমাকে নোং’রা বলে ধি’ক্কার দেবে।তখন নিশ্চয়ই খুশি হবেন আপনি?

ক্রীতিক হাঁটু গেড়ে ওর মুখোমুখি হয়ে বসে বললো,
— আমি সমাজ মানিনা, আর যে সমাজ আমার বউয়ের দিকে আঙুল তুলে কথা বলবে আমি সেই সমাজই ধ্বং’স করে দেবো। আই রিপিট ধ্বং’স করে দেবো।

ক্রীতিকের কথা শুনে ওর চোখে চোখ রাখলো অরু, চোখ তো নয় যেন জ্ব’লন্ত আগ্নে’য়গিরির দাবানল। যে তাকাবে সেই ভস্ম হয়ে যাবে। অথচ ফর্সা পুরুষালী তীক্ষ্ণ চোয়াল জোড়া মুখশ্রীটা কতোটাই না সুদর্শন। এক মূহুর্তের জন্য অরুর মনে হলো, এই অসম্ভব সুদর্শন মানুষটা ওর স্বামী, হুট করেই কেমন ক্রীতিককে অন্য নজরে আবিষ্কার করছে অরু। কয়েক মূহুর্তের জন্য নিজেকে বসিয়ে দিলো ক্রীতিকের বাম পাশে তার পত্নী রূপে। পরবর্তীতেই অন্যমনটা লাফিয়ে উঠে বললো,
—না না এটা কি করে সম্ভব? এমন একটা রা’গী বদ মেজাজী, বেপরোয়া লোকের সাথে সারাজীবন কাটানো অসম্ভব।
কারন আর যাই হোক সারা জীবন ক্রীতিকের হাতে মা’র খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই অরুর।

— কি হলো?

হঠাৎ করে ক্রীতিকের কথায় ধ্যান ভাঙে অরুর, বেরিয়ে আসে নিজের দিবাস্বপ্ন থেকে। ছোট্ট করে জবাব দেয়,
–কিছু না।

ক্রীতিক ওর ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আসস্থ করে পুনরায় বলে,
— অনেক রাত হয়ে গিয়েছে ঘুমিয়ে পর। চিন্তা নেই পুরো দুনিয়া আমি দু’হাতে সামলে নেবো, তোর গায়ে কল’ঙ্কের আঁচও আসতে দেবোনা, এটুকু ভরসা রাখতেই পারিস,হার্টবিট।

ক্রীতিকের শেষ কথাতে অরু চকিতে মাথা তুলে বললো,
— কিহ!

—বলেছি তুই আমার হার্টবিট।

…আআ, অরু কিছু বলবে তার আগেই ওর দিকে চোখ পাকিয়ে ক্রীতিক বললো,
— আর একটাও প্রশ্ন করবিনা, তাহলে মা’র খাবি।

অপারগ অরু আর কিইবা করবে, মা’রের ভয়ে চুপচাপ পা বাড়ায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে।
ক্রীতিক অরুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে দ্বিতীয় বার বিড়বিড়ায়,
— হার্টবিট।

চলবে….