#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ২৭
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[কপি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক এবং মুক্তমনাদের জন্য]
দিনের দ্বিপ্রহর চলমান, অথচ বাইরে ঝুম বর্ষন, তীব্র বর্ষনে চারিদিকের প্রকৃতি সন্ধ্যারূপ ধারন করেছে। বৃষ্টির ছাট আর দমকা হাওয়ায় বারবার জানালার ভারী পাল্লা দুলেদুলে উঠছে। খানিক বাদে বাদে বৈদ্যুতিক ঝলকানি আর বাজ পরার প্রকান্ড আওয়াজে শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবুও হাট করে রাখা খোলা জানালা গলিয়ে বাইরের অঝোর বারিধারার পানে ধ্যানমগ্ন হয়ে চেয়ে আছে অনু। অসময়ে বৃষ্টি নামার সাথে সাথে মনটাও কেমন বিষাদপূর্ন হয়ে উঠেছে ওর।অযাচিত মনে বারংবার একই প্রশ্ন এসে উঁকি দিচ্ছে অরু ঠিক আছে তো?
মনেমনে ভাবছে,
— মেয়েটাকে কেন যে একা রেখে আসতে গেলাম, ক্রীতিক ভাইয়া আদৌও ওর সাথে আছে, নাকি ওকে রেখেই চলে গিয়েছে,কে জানে?
অনু যখন অরুকে নিয়ে হাজারো দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তখনই হাতে দু’কাপ গরম গরম দুধ চা নিয়ে ওর সামনে হাজির হয় প্রত্যয়। এটা প্রত্যয়েরই ফ্ল্যাট। তাই নিজ হাতে অনুর জন্য চায়ের বন্দবস্ত করেছে সে। অনুর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে প্রত্যয় শুধালো,
— হঠাৎ মনমরা হয়ে গেলে যে, কি ভাবছো?
অনু হাঁটু মুড়ে বসে তাতে মাথা ঠেকিয়ে বললো,
— অরুর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। এই বৃষ্টির মাঝে একা রেখে এলাম,কি জানি কি করছে?
প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে বললো,
— একা কোথায় ভাই তো আছে।
অনু ঠোঁট উল্টে বললো,
— ক্রীতিক ভাইয়ার মতো মানুষ কি আর অরুর জন্য বসে থাকবে?
অনুর কথায় প্রত্যয় মনেমনে একটু হাসলো, অনু তো আর জানেনা তার বোনের শরীরটা ব্যক্তিগত হলেও আত্নাটা সয়ং জায়ান ক্রীতিকের। আপাতত এসব জানানোও যাবেনা,অরুর বারণ আছে, তাই প্রত্যয় কথা ঘুরানোর উদ্দেশ্যে অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
— তুমি সবার জন্য কতো ভাবো, সবার প্রতি তোমার কত দায়িত্ববোধ, আচ্ছা আমার কথা কখনো ভাবোনা কেন?
— কে বললো আপনার কথা ভাবিনা? ভাবি বলেই তো মাকে এতোগুলো মিথ্যে বলে বের হলাম, শুধু আপনাকে দেখবো বলে।
প্রত্যয় অনুর কথাতে আস্বস্ত হয়ে বললো,
— তুমি শুধু আমার অনু। তোমার উপর শুধু আমার দখলদারি। আমি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ তোমার জীবনে আসবেনা,কোনোদিন না।
অনু লজ্জামাখা হাসিতে রাঙা হয়ে বললো,
— আমি শুধু আপনার, আপনিই আমার প্রথম ভালোবাসা, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম। আপনার অতীত আপনাকে কতটুকু দুঃখ দিয়েছে তা আমি জানিনা, তবে আমি চেষ্টা করবো তার চেয়ে দ্বিগুণ ভালোবাসায় আপনাকে মুড়িয়ে দিতে।
একজন আরেকজনকে প্রতিশ্রুতি দিতে দিতে কখন যে ওরা এতোটা কাছাকাছি চলে এসেছে টের পায়নি কেউই। ব্যাবধান মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার মাত্র, প্রত্যয় হয়তোবা আজকেও বেসামাল হয়ে পরেছে হৃদয়টা নিয়ন্ত্রণে নেই ওর, অগত্যাই ঠোঁট দুটো এগিয়ে দিয়েছে অনুর ঠোঁটের পানে। তৎক্ষনাৎ ওর ওর ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ালো অনু, না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—এখন নয়, বিয়ের পরে, এটা অন্যায়।
প্রত্যয় নিজের হুশে নেই ও অনুর হাত সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
— একটু আধটু অন্যায় করলে কিছু হবেনা ডিয়ার।
প্রত্যয়ের এমন বেসামাল রূপ দেখে উপায়ন্তর না পেয়ে একটানে ওর চশমা খুলে নিজের চোখে লাগিয়ে নিলো অনু,এবার প্রত্যয়ের চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে এসেছে। ফলস্বরূপ না চাইতেও মাঝপথে থেমে যেতে হলো ওকে।
চশমা টাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনু শুধালো,
— দেখুন তো আমাকে কেমন লাগছে, বাবাহ! কি পাওয়ার।
প্রত্যয় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললো,
— এটা কিন্তু মোটেই ঠিক হলোনা অনু।
— কি ঠিক হলোনা? চশমা ছাড়া কি আপনি পুরোপুরি কানা?দেখুন তো এখানে কয়টা আঙুল।
আঙুল উঁচিয়ে শুধালো অনু।
প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমি এতোটাও কম দেখিনা অনু, দুইটা আঙুল।
অনু চমকে উঠে বললো,
— সর্বনাশ, কি বলছেন?এখানে তো তিনটা আঙুল।
প্রত্যয় এবার নিজের দূর্বলতা এড়াতে একটু গলা খাঁকারী দিয়ে বললো,
— আমিতো মশকরা করে বলেছি, যাতে তুমি এন্টারটেইন হও।
অনু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— বুঝলাম, পরক্ষণেই বুদ্ধিদীপ্তদের মতো চোখ বড়বড় করে বললো,
— আরে আপনি কানা হলেও তো সমস্যা নেই, আমিতো আছি, আমি আপনাকে ঠিক সামলে নেবো।
নিজের শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে প্রত্যয় শুধালো,
— তুমি সারাজীবন থাকবে আমার সাথে ?
অনু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— আপাতত বাসায় যাবো, মাকে মিথ্যে বলে বেরিয়েছি, সেটা মা ঘুনাক্ষরেও জানতে পারলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
প্রত্যয় এবার অনুকে নিজের পাশে বসিয়ে শুধালো,
— আচ্ছা সত্যি করে বলোতো,তোমরা দু’বোন তোমার মাকে এতো ভয় পাও কেন?
অনু এবার ভাবুক হয়ে পরলো, একটু ভেবে চিন্তে উত্তর দিলো,
— কারণ মা অনেক বিচক্ষণ আর কঠিন প্রকৃতির মানুষ। মায়ের মতে মিথ্যা বলা সত্যি লুকানোর মতো জ’ঘন্য অ’পরাধ আর কিছু নেই। এছাড়া মায়ের খুব বেশি আহ্লাদী আহ্লাদী ভাব ও পছন্দ নয়, বুঝতেই তো পারেন বিজনেস ওয়েম্যান। ওই জন্যইতো আমি আর অরু ছোট বেলা থেকেই ম্যাচিউর। অরু যা একটু ছেলেমানুষী করে কিন্তু আমার দ্বারা সেসব কোনোকালেই হয়নি।
জানেন, মাঝে মাঝে আপসোস হয় আমার, ছোট বেলার দিনগুলো ফিরে পেতে ইচ্ছে করে,এটা-ওটা বায়না ধরতে মন চায়, কিন্তু আপসোস এখন আর কে মেটাবে আমার আবদার?
অনুর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওকে টান মে’রে নিজের বুকের উপর ফেলে দিলো প্রত্যয়, অকস্মাৎ ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে অনুর মাথা গিয়ে ঠেকলো প্রত্যয়ের বুকে। প্রত্যয় অনুর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
— আমি মেটাবো সব আবদার, একবার করেই দেখো।
হুট করে এমন কাছাকাছি আসাতে অনু একটু ভরকে গেলো, ও তাড়াহুড়ো করে প্রত্যয়ের বুকের উপর থেকে মাথাটা তুলতে নিলে প্রত্যয় ওকে পুনরায় নিজের সাথে মিশিয়ে বলে,
— মাত্র পাঁচ মিনিট, তারপর ছেড়ে দিচ্ছি, প্রমিস এর বাইরে কিচ্ছু করবো না।
প্রত্যয়ের কথায় আস্বস্ত হয়ে অনুও এবার শরীরের সবটুকু ভার ওর উপর ছেড়ে দিয়ে , চোখদুটো বন্ধ করে নিলো পরম আবেশে।
*****************************************
বৃষ্টি মাথায় নিয়েই অনেকটা তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরেছে ওর দু’বোন। এবার শুধু চুপিচুপি রুমে ঢুকে যাওয়ার পালা। তাহলেই ঝামেলা শেষ। কিন্তু বসার ঘর পেরিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আজমেরী শেখের গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো কর্ণকূহরে,
— কোথায় গিয়েছিলে, ফিরতে সন্ধ্যা হলো কেন?
অরু মুখ কাচুমাচু করে অনুর দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে, অনু ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে,
— ইয়ে মা, বাজার করতে গিয়েছিলাম সুপার শপে। তোমাকে না বলে গেলাম অনেক কিছু কেনার আছে।
— মিথ্যে কেন বলছো,বাজার তো সেই কখন নিয়ে এসেছে রাজ।
অরু একটু আগ বাড়িয়ে বললো,
— আআসলে মা আজকে ব্ল্যাক ফ্রাইডে তো সব কিছুতে ডিসকাউন্ট চলছিল, তাই আমরা দু’বোন একটু লেডিস সেকশনে গিয়েছিলাম ওই জন্যই দেরি হয়ে গেলো।
আজমেরী শেখ ভ্রু কুঁচকে বললো,
— এতো দেরি করে ফিরলে তা কিছু কেনোনি কেন?
অনু বললো,
— পপছন্দ হয়নি মা।
— পছন্দ হয়নি, নাকি টাকার জন্য কেনার সাহস করোনি? তোমাদের আমি খুব ভালো করে চিনি, মনে রেখো জেকে গ্রুপের থার্টি পার্সেন্ট শেয়ার আমার নামে, তোমাদের প্রয়াত আঙ্কেল খুশি হয়ে আমাকে লিখে দিয়ে গেছেন, সে হিসেবে তোমরাও তার মালিক। তাহলে কিসের এতো টাকার চিন্তা তোমাদের?
অরু এবার কিছু বুঝে না পেয়ে বললো,
— বাকি সেভেন্টি পার্সেন্ট তাহলে কার মা?
অনু ওকে কনুই দিয়ে গুঁতো মে’রে থামিয়ে বললো,
— চুপ কর।
আজমেরী শেখ সর্বদা সুস্পষ্টবাদী তাই তিনি সহসা উত্তর দিলেন,
— জায়ান ক্রীতিকের।
অতঃপত মনেমনে বললেন,কিন্তু ছেলেটার খুব বেশি আত্ন অ’হংকার, শুধুমাত্র আমি চেয়ার ওয়েম্যান বলে, কোম্পানির ধারেকাছেও ঘেঁষেনা সে। এবার আমিও দেখতে চাই নিজের এতোবড় সাম্রাজ্য ঠিক কতদিন হাতছাড়া করে রাখতে পারে জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী।
মায়ের অ’গ্নিমূর্তি তরলে পরিনত হতেই অরু, অনু দু’বোন একসাথে রুমে ঢুকে গেলো। অরু একবার ভিজেছে, শরীরটাও কেমন কুটকুট করছে, তাই রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অরু চলে গেলো শাওয়ার নিতে।
একটু পরে শাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরোতেই পিলে চমকে উঠলো ওর, দেখলো অনু একটা চেকের পাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, যেটা থাইল্যান্ড বসে ক্রীতিক দিয়েছিল অরুকে,বিয়ের মোহরানা সরূপ। কিন্তু সেটা নিয়ে আপা কি করছে? ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে অরু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে চেকের পাতা টা ছো মে’রে নিয়ে সেটাকে ড্রয়ারে রাখতে রাখতে বললো,
— এটা দিয়ে কি করছিস তুই?
অনু ঠোঁট উল্টে বললো,
— তোর জামাকাপড় গোছাতে গিয়ে আলমারিতে পেলাম, ক্রীতিক ভাইয়ার নাম মনে হলো, উনি তোকে চেক কেন দিয়েছে?
অরু জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
— আরে ভার্সিটির সেমিস্টার ফি দিয়েছিলেন,কিন্তু আমি বোকার মতো সেটা ঘরে তুলে রেখেছি, জমা দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
অরুর কথা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য হলোনা অনুর, কারণ চেকের এমাউন্ট বেশ বড় ছিল, তবে ও পুনরায় কিছু জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পেলোনা, তার আগেই চোখ গিয়ে ঠেকলো অরুর ঘাড়ের কাছে র’ক্তিম হয়ে যাওয়া কালচে বেগুনি দাগের উপর ।দেখে মনে হচ্ছে কেউ বাইট করেছে। অনু সহসা এগিয়ে গিয়ে, অরুর গলায় হাত দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— গলায় কি হয়েছে তোর? কে কামড় দিয়েছে?
অনুর কথায় অরু দ্রুত গিয়ে আয়নার সামনে দাড়ালো, দেখলো গলার আর ঘাড়ের মাঝ বরাবর ছোপ ছোপ কালচে দাগ, তৎক্ষনাৎ মনে পরে গেলো দাগগুলোর আসল উৎস। বিকেলের সেই বেসামাল অনূভুতি, ক্রীতিকের ঘোর লাগা চাহনী, আর তারপর হুট করেই অনেকটা কাছাকাছি আসা। এখন সেসব মনে পরতেই কানদুটো কেন গরম হয়ে উঠছে অরুর।
— কি হলো কিছু বল?কি করে ব্যাথা পেয়েছিস?
অনুর কথায় অরু থতমত খেয়ে বললো,
—কি বলতো আপা, তখন অনেক বৃষ্টি হলো না? সেই বৃষ্টির মাঝেই একটা বড়সড় পোকা কোথা থেকে যেন উড়ে এসে কামড় বসিয়ে দিলো, আমি টের পাইনি, এখন দেখছি এমন লালবর্ণ হয়ে আছে।
অনু অরুর গলায় হাত বুলিয়ে অসহায় সুরে বললো,
— কি পোকা কামড়ালো বলতো? পাছে না আবার ইনফে’কশন হয়ে যায়, আয় তো একটু মলম লাগিয়ে দিই।
অরু হ্যা না কিছুই বলতে পারলো না, চুপচাপ বসে বসে দেখতে লাগলো, তার আপা তার স্বামীর তৈরি করা প্রথম ভালোবাসার চিহ্নতে কি সুন্দর করে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।
*****************************************
ব্যস্ততম দিনকে হটিয়ে, সন্ধ্যা নেমেছে সমগ্র ধরনী জুড়ে, সারা বিকেল ঝুম বর্ষনের ফলস্বরূপ এখন ইকোপার্কটা পুরোপুরি খালি পরে আছে। আশেপাশে মানুষজন তো দূরে থাক একটা কাকপক্ষীও নজরে আসছে না। ইকোপার্কের সরু রাস্তায় ম্যাপল পাতার ছড়াছড়ি, তকতকে সুন্দর সারিসারি ব্যঞ্চি গুলো ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে বৃষ্টির পানিতে। সন্ধ্যা বেলা একটু খানি একা একা হাটবে বলেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মাঝেই ট্র্যাকস্যুট পরে বের হয়েছে এলিসা।সাথে আর কেউ নেই। ওর অবশ্য একটা থাকতে ভালোই লাগে,ওই জন্যই তো এই নির্জন ইকোপার্কে হাটতে আসা।
কিন্তু হাটতে হাটতে কিছুদূর যেতেই ঘটলো বিপত্তি, চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো এক সুপরিচিত মুখ। ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে একটা অল্পবয়স্কা মেয়ের সাথে কি যেন কথায় মশগুল হয়ে আছে অর্নব। কিন্তু এমন নির্জন নিরিবিলি পরিবেশে কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছে ওরা দুজন? আর মেয়েটাই বা কে? ভাবনায় পরে গেলো এলিসা।
ওদিকে অর্নব কথা বলায় এতোটাই ব্যস্ত যে ওর পেছনে সেই কখন থেকে এলিসা দাড়িয়ে আছে, ও সেটা টেরই পায়নি।
এলিসা বরাবরই অর্নবের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়ে অভস্ত্য, তাই হঠাৎ এমন অগ্রাহ্য ব্যাপারটা সহ্য হলোনা ওর, উল্টে বিরক্ত লাগতে শুরু করলো প্রচন্ড রকম।এলিসা কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এসে পেছন দিক থেকেই অর্নবের বাহুতে জোরে জোরে হাতদিয়ে টোকা দিলো। অর্নব পেছনে ঘুরে আচমকা এলিসাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
— এলিসা তুই এখানে?
পরক্ষণেই সামনের মেয়েটার দিকে একনজর পরখ করে এলিসাকে নিয়ে একটু দূরে গিয়ে দাড়িয়ে অর্নব শুধালো,
— তুই এখানে কি করছিস একা একা?
অর্নবের কথায় বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে, এলিসা বিরক্তি নিয়ে বললো,
— মেয়েটা কে অর্নব?
অর্নব পেছনে ঘুরে মেয়েটাকে একনজর পরখ করে, চোখ ঘুরিয়ে এলিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
— আছে বলা যাবে না।
সঙ্গে সঙ্গে অর্নবের কলার খা’মচে ধরলো এলিসা, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— তুই আমার সাথে মজা করছিস?
এলিসার এই হঠাৎ রেগে যাওয়াটা অর্নবের ভালোই লাগলো, ও এলিসার রাগে আরেকটু ঘি ঢেলে দিয়ে বললো,
— মজা কেন করবো, সব সিক্রেট কি আর সবাইকে বলা যায়? প্রাইভেসি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে, এতো বড় মেয়ে হয়েছিস বুঝিস না সেটা?
— মেয়েটা কে অর্নব?
অর্নব ভাবলেশহীন হয়ে বললো,
— হবে আমার লাইফের ইম্পর্টেন্ট কেউ। তুই এতো রিয়াক্ট কেন করছিস?
এলিসা এবার অর্নবের কলার ছেড়ে দিয়ে বললো,
— খুব ইম্পর্টেন্ট কেউ তাই না?
— হ্যা খুবই ইম্পর্টেন্ট।
অর্নব কথাটা বলেছে ঠিকই, কিন্তু এর পরবর্তীতে এলিসার এমন পদক্ষেপ মোটেও কল্পনা করেনি ও। অর্নব দেখলো রাস্তার পাশ থেকে একটা বড়সড় ইটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে রে’গেমেগে মেয়েটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এলিসা। এলিসার এমন রণমূর্তি দেখে অজ্ঞাত মেয়েটা নিজেও ভ’য় পেয়ে গিয়েছে, এই পা’গলীর হাতে নিজের গায়ে আ’ঘাত প্রাপ্ত হওয়ার আগেই আতঁকে উঠে সহসা ছুট লাগালো মেয়েটা। এলিসাও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়, ও নিজেও সমান তালে ছুটতে লাগলো মেয়েটার পিছু পিছু। এদিকে সকল ঝামেলার উৎস বেচারা অর্নব কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলিসা মেয়েটাকে তা’ড়া করে করে হাঁপানী রো’গী বানিয়ে ছেড়েছে। এবার অর্নবও আর দাঁড়িয়ে থাকলো না ছুটে গিয়ে দু-হাতে চেপে ধরলো এলিসার বাঁকানো কোমড়। এলিসা ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— ছাড় আমাকে তুই, ইম্পর্টেন্ট মানুষ হওয়া দেখাচ্ছি ওকে আমি, বজ্জাত মেয়ে অন্যের জিনিসে নজর দেয়।
অর্নব ওকে আঁটকে রাখতে না পেরে চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
— বিশ্বাস কর এলিসা, জান আমার।ও কোনো ইম্পর্টেন্ট মানুষ না, ও আমার ক্লায়েন্ট, ক্লায়েন্ট। তুই থাম একটু, আমি খুলে বলছি।
অর্নবের কথায় এলিসা একটু শান্ত হলে,অর্নব ওর হাতের ইটের টুকরোটা ছু’ড়ে ফেলে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
— আমাদেরই ভার্সিটিতে পড়ে মেয়েটা, ক্রীতিকের স্টুডেন্ট। গত কয়েকদিন যাবত ওর ছোটবোন হঠাৎ করে মিসিং, তাই ক্রীতিক ওকে আমার এজেন্সির কার্ড দিয়ে আমার সাথে দেখা করতে বলেছে, একমাত্র বোনকে খুজে না পেয়ে মেয়েটার অবস্থা দূ’র্বিষহ, তখন থেকে সেটা নিয়েই আলাপ করছিলাম আমরা।
এলিসা এবার দিগুণ ঝাঁজ নিয়ে বললো,
— তাহলে আমাকে মিথ্যে কেন বললি?কি সুখ পাস তোরা আমাকে মিথ্যে বলে?
অর্নব চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— তুই কেন এতো জেলাস? আর একটু আগে আমার জিনিস, আমার জিনিস করে চেঁচিয়ে কি যেন বললি? আমি কিন্তু শুনেছি।
এলিসা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে যেতে বললো,
— তোর সাথে আর কথা নেই। অযথা কষ্ট দিস আমাকে।
এলিসা হনহনিয়ে হাঁটছে, চোখদুটো না চাইতেও বে’ইমানি করছে ওর সাথে, বারবার জলে ভিজে ঝাপসা হয়ে আসছে সামনের সব দৃশ্যপট। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে আছে একরাশ না পাওয়ার কষ্ট। অথচ আজ অর্নব ও ওকে বোকা বানালো ওর ইমোশন নিয়ে খেললো।
তবে বেশিক্ষণ হেঁটে এগিয়ে যেতে পারলো না এলিসা, তার আগেই ওকে পেছন থেকে জাপ্টে ধরলো অর্নব, পোনিটেল করা চুলের মাঝে হাজারটা চুমু খেতে খেতে বললো,
— আ’ম সরি, আর কক্ষনো এমন হবে না, আ’ম সরি, সত্যি সরি। তুই যে আমার জন্য কিছু ফিল করিস সেটা আমার অজানাই ছিল।বুঝতে পারিনি।
এলিসা এবার ঘুরে সপাটে চ’ড় বসিয়ে দিলো অর্নবের গালে, অতঃপর কাঁদতে কাঁদতে মুখ খুলে বললো,
— কেন বুঝিস নি? তোকে আমি গ্রহন করিনি ঠিকই, কিন্তু দুরেও তো ঠেলে দিইনি কখনো, তোর এতোএতো পা’গলামি, বাচ্চামি, সবকিছু সহ্য করে এসেছি , তোর কি মনে হয় সেটা কেবলই তোর কথা ভেবে সিমপ্যাথি দেখিয়েছি আমি? আমি এতোটাও ভালো মেয়ে নই অর্নব।
তোর করা প্রত্যেকটা পা’গলামিতে আমি সুখ পাই, আনন্দে পুলকিত হই, তাইতো কখনো তোকে বারণ করিনা, কেন বুঝতে পারলি না বল? তুই না ডিটেকটিভ? হ্যা’কার? তাহলে এটুকু তোর মাথায় ঢুকলো না কেন?উমম….
এলিসার এক নাগারে করা অভিযোগের বহরে হুট করেই ইতি ঘটালো অর্নব,ওর নরম অধর যুগল কে নিজের দখলে নিয়ে। এর আগে কি অর্নব এলিসাকে চুমু খায়নি? খেয়েছে তো জোরজবর’দস্তি করে বহুবার। কিন্তু আজ একটু বেশিই আবেগ নিয়ে স্পর্শ করছে অর্নব। যেই স্পর্শে শুধুই আন্তরিকতা আর ভালোবাসার ছড়াছড়ি। অর্নবের কাতর স্পর্শে এতোক্ষণে এলিসাও কুপোকাত, শেষমেশ অর্নবের অসহনীয় ভালোবাসার কাছে হেরে গিয়ে ও নিজেও ঠোঁট মেলালো অর্নবের সাথে। তালে তাল মিলিয়ে মত্তো হলো এক নিদারুন ঠোঁটের খেলায়।
*****************************************
ক্লাস আর প্রেজেন্টেশন আছে বলে আজ সকাল সকাল ভার্সিটিতে এসেছিল অরু। কিন্তু সকাল সকাল এসেই যে গালের উপর এমন শক্ত চপেটাঘা’ত হা’মলে পরবে সেটা বোধ হয় আশা করেনি ও। এই মূহুর্তে চ’ড় খাওয়া গালে হাত দিয়ে টলটলে চোখে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে নাক টানছে অরু, মনেমনে ভাবছে, এটা স্বামী না গিরগিটি? ক্ষনে ক্ষনে রূপ বদলায়, কালই তো কত আদর দেখালো আর এখন চ’ড় মারলো।
অরুর কাঁদো কাঁদো বি’ভৎস মুখের দিকে অ’গ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ক্রীতিক। রাগের তোপে তীক্ষ্ণ চোয়ালটা আরও শক্ত লাগছে ওর।জিদের তোপে ইচ্ছে তো করছে ওর আরেকটা গালেও সপাটে চ’ড় মে’রে দিতে,তাহলে আবার বেশি ব্যাথা পাবে, তাই নিজেকে সংবরণ করে হাতদুটো মুঠিবদ্ধ করে রেখেছে ক্রীতিক। তবে দু’চোখের অ’গ্নিশিখা দ্বারাই আপাতত ভস্ম করে দিচ্ছে অরুর চিত্তকে। দোষটা অবশ্য অরুরই। অযথাই বাঘের কানে সুরসুরি দিলে বাঘ কি বসে থাকবে?
খানিকক্ষণ অরুর দিকে এভাবে তাকিয়ে থেকে দাঁতে দাঁত পিষে ক্রীতিক ধা’রালো কন্ঠে বললো,
— ফারদার যদি এসব বোকামি করতে আসিস, তাহলে অন্য গালটাতেও থা’পড়িয়ে র’ক্ত জ’মাট বাধিয়ে দেবো।
কথা শেষ করে হনহনিয়ে ক্লাসরুমে ঢুকে যায় ক্রীতিক। ওদিকে ক্রীতিকের কথায় কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছে অরুর, মনেমনে ভাবছে,
—আমি আসলেই ওনার বউতো? কবুল তো বলেছিলেন, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন ও করেছিলেন, তাহলে কিভাবে ভরা ক্যাম্পাসে আমার গায়ে হাত তুললেন উনি?
ওর ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে সায়নী এগিয়ে এসে মুখ কাচুমাচু করে বললো,
— তুমি ঠিক আছো অরু?
অরু নাক টেনে বললো,
— সব তোমার জন্য, আমি বলেছিলাম উনি এতো সহজ নয়, ওনাকে এসব লেটার ফেটার দিতে গেলে উনি রেগে যাবে।
সায়নী মাথা নত করে, অসহায় সুরে বললো,
— আ’ম সরি অরু, তুমিতো ওনার বোন হও তাই তোমার হাত দিয়ে পাঠাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি সপ্নেও ভাবিনি উনি এতোটা রে’গে যাবেন যে, রেগেমেগে তোমাকে চ’ড় মে’রে বসবেন।
অরু আর সায়নীর সাথে কথা বাড়ালো না, এই মূহুর্তে সায়নীর দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না ওর অগত্যাই চুপচাপ ক্লাসে ঢুকে গেলো অরু। ক্রীতিক ক্লাসেই ছিল, অরু পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে চুপচাপ বসে পরলো সবচেয়ে পেছনের সিটে।
মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছে না একটু আগের ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটাকে। নিজের কাজে নিজেই লজ্জিত হয়ে পরেছে ও এখন। বারংবার মনে হচ্ছে কেন যে করতে গেলাম এমন পাকামি। দোষ অবশ্য সায়নীর ও কম নয়, যেদিন থেকে শুনেছে অরু ক্রীতিকের স্টেপ সিস্টার, সেদিন থেকে ননদীনি ডাকা শুরু করে দিয়েছে ওকে। ভার্সিটিতে ঢুকলেই শুরু হয় ওর প্রশ্নউত্তর পর্ব, জেকে স্যার কোথায় যায়, কি খায়, কি করে সব কিছুর পাই টু পাই খোঁজ নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয় সায়নী, বলতে না চাইলে অরুর সাথে কেমন পরপর আচরণ করে সে।
উপায়ন্তর না পেয়ে, একমাত্র বাঙালি বান্ধবীর মনরক্ষার জন্য অরুও সবকিছুর ছাপ ছাপ স্পষ্ট জবাব দেয়। কিন্তু আজকে সায়নী একটু বেশিই করে ফেলেছে, অরুর হাতে রঙিন খামের মোড়কে বাঁধা চিঠি ধরিয়ে দিয়ে বলেছে ক্রীতিককে দিয়ে আসতে, বলেছে তো বলেছে একেবারে ঠেলে ক্রীতিকের সামনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
গতকাল ক্রীতিকের নরম সরম রূপ দেখে অরু ভেবেছিল একটা চিঠিই তো কি আর বলবে ক্রীতিক , দিয়ে দিলেই তো কাহিনি খতম, ওদিকে বান্ধবীর মনরক্ষাও রয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো কালকের ক্রীতিক আর আজকের ক্রীতিকের মাঝে এমন দিন রাত ফারাক। তাহলে কি অরু নিজের মানসম্মান খোয়ানোর মতো এতো বড় ভুলটা করতো? জীবনেও না।
— মিসেস জেকে, ফোকাস।
ঠিক এভাবেই ছোট্ট একটা বাক্য দিয়ে অকস্মাৎ ক্লাসের মধ্যে বো’ম ফাটালো ক্রীতিক। নামটা শোনা মাত্রই, হইহই করে উঠে অরুর মুখের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছে পুরো ক্লাস। সেবার বাস্কেটবল কম্পিটিশনের সময় সবাই যা অনুমান করেছিল সেটাই আজ বাস্তব হলো।
তাই বলে মিসেস জেকে? সবাইতো ভেবেছিল জেকে স্যারের বেবিগার্ল হবে হয়তো। কিন্তু না এতো সয়ং স্ত্রী। তারমানে সকলের ক্রাশ জেকে স্যার বিবাহিত?কথাটা ভাবতেই পুরো ক্লাস শোক শোক নিরবতায় ছেয়ে গেলো। ছেলেরা মেয়েদের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে, একমাত্র অরুই চোরের মতো মাথা নুয়িয়ে বসে আছে সেই কখন থেকে, সায়নী ওর দিকে সেই তখন থেকেই কটমটিয়ে তাকিয়ে আছে, মনেমনে ভাবছে,
— তাহলে অরু আমাকে বোকা বানিয়েছে এতোদিন ধরে?
.
ক্লাস শেষে বের হতেই অরুর হাতটা খপ করে টেনে ধরলো সায়নী, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামিদের মতো করে প্রশ্ন করলো,
— সত্যি করে বলো, এতোদিন ধরে বোকা কেন বানালে আমাকে? আজকেও তো বলতে পারতে।
অরু নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
— আমি তোমাকে বোকা বানাইনি, যা সত্যি তাই বলেছি।
— এতোদিন বলে এসেছো জেকে স্যার তোমার ভাই,আর এখন জেকে স্যার নিজে তোমাকে মিসেস জেকে বলে সম্মোধন করলো।কোনটা সত্যি?
অরু ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— দুটোই সত্যি, উনি আগে আমার স্টেপ ব্রাদার ছিলেন আর এখন স্বামী।
সায়নী তেতে উঠে বললো,
— আর ইউ কিডিং মি? স্টেপ ব্রাদার কি করে স্বামী হলো?
— নো আ’ম নট, আর কি করে স্বামী হলো সেটা বরং তোমার জেকে স্যারকেই জিজ্ঞেস করো, উনি আমাকে জোর করে বিয়ে করেছেন কিনা, তাই উত্তরটাও উনিই ভালো দিতে পারবেন। আসছি।
একনিশ্বাসে কথাগুলো বলে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যায় অরু। এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হওয়ার ভ’য়ই তো এতোদিন ধরে পেয়ে এসেছে ও,
— স্টেপ ব্রাদার কি করে স্বামী হয়?
অথচ ক্রীতিক একটাবার ওর কথা চিন্তা না করেই টেনে হিঁচড়ে জোর’জ’বরদস্তি করে কবুল বলিয়ে নিলো। এখন অরু চাইলেও এই সম্পর্কটাকে মুছে ফেলতে পারবে না, আর না এড়িয়ে যেতে পারবে জীবনের সাথে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িয়ে যাওয়া সত্যিটাকে।
*****************************************
একরাশ হৃদয়ের ব্যাথায় কাতর অরু ভার্সিটি থেকে ফিরেই,রুমের দুয়ারে খিল দিয়ে তলিয়ে গিয়েছে ঘুমের দেশে। আর ওঠেনি, অথচ এখন সন্ধ্যারাত তবুও পরেপরে ঘুমাচ্ছে সে। কিন্তু বালিশের পাশে অযত্নে পরে থাকা দামি মোবাইলটার ভাইব্রেট আওয়াজে সেই ঘুম আর বেশিক্ষণ টিকলো না। অগত্যাই ঘুমু ঘুমু চোখে ফোন কানে তুললো অরু। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো চেনা পরিচিত হৃদয়ে শিহরণ জাগানো হাস্কি কন্ঠস্বর,
— আমার ঘুমপরী, বারান্দায় এসো।
ক্রীতিকের মুখে, তুমি শব্দটা শোনা মাত্রই একলাফে উঠে বসলো অরু, মনেমনে ভাবলো —আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো? উনিতো কখনোই আমাকে এতো আদুরে গলায় ডাকেন না। তাহলে আজ হঠাৎ?
অরু চুপ হয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় বললো,
— কিরে বারান্দায় আয়, ডাকছি কথা কানে যাচ্ছে না?
ক্রীতিকের কথায় অরু তেতে উঠে বললো,
— পারবোনা, সকালে আমাকে মে’রেছেন মনে নেই?গালটা এখনো জ্বলছে।
— মা’র খাওয়ার মতো কাজ করলে আবার মা’রবো,তারপর আবার আদর করবো, এখন জলদি বারান্দায় আয়, তোকে দেখবো।
অরু মুখ ফুলিয়ে বললো,
— যাবোনা বলেছি তো।
ক্রীতিক গলার আওয়াজ খানিকটা নরম করে বললো,
— একবার এসে দেখ, তোর জন্য সারপ্রাইজ এনেছি।
সারপ্রাইজের কথা শুনে অরু আর অপেক্ষা করতে পারলো না, ছুটে চলে গেলো বারান্দায়, দেখলো আজ বাইক নয়, কালো মার্সিডিজের ডিকিতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে ক্রীতিক। ওর কোলের মাঝে ঘাপটি মে’রে বসে আছে ছোট্ট ডোরা। ডোরাকে দেখা মাত্রই অরুর মুখ আপনা আপনি হা হয়ে গেলো। দু’হাত চলে গেলো মুখের উপর, শুকনো মুখটা মূহুর্তেই প্রসারিত হয়ে গেলো খুশিতে, তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে অরু বললো,
— ডোরা?আসছি আসছি, আপনি দাড়ান আমি এক্ষুনি আসছি।
কয়েক মিনিটের মাথাতেই তিন তলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে এলো অরু, ওর পরনে ক্রীতিকের কিনে দেওয়া পাজামা সেট, চুল গুলো মেসি বান করে উপরে তুলে বাঁধা, যেভাবে ঘুমিয়েছিল সেভাবেই নেমে এসেছে আজ। নিচে নেমে কালবিলম্ব না করে অরু দৌড়ে গিয়ে ক্রীতিকের কোল থেকে ডোরাকে তুলে নিলো নিজের কোলে।
ক্রীতিক অবাক হয়ে বললো,
— আজ এতো তাড়াতাড়ি বের হলি কি করে?
অরু ডোরাকে আদর করতে করতে বললো,
— মা আর আপা বাসায় নেই, হসপিটালে গিয়েছে ফিরতে রাত হবে।
ক্রীতিক ডোরার থেকে নজর সরিয়ে বললো,
— আগামীকাল আমরা পাহাড়ে যাবো, সবাই মিলে এলিসাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান আছে, কাল সকাল সকাল বাসায় ম্যানেজ করে বের হবি।
অরু ক্রীতিকের পানে সচকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— মা জানলে মে’রে ফেলবে, তাছাড়া আপনাদের মাঝে আমি গিয়ে কি করবো?
—আমি বলেছি তাই যাবি।
অরু অসহায় মুখে বললো,
— একদিন কি বলে ম্যানেজ করবো আমি? পারবো না, আপনি বরং গিয়ে ঘুরে আসুন।
ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কর্কষ আওয়াজে বললো,
— ওকে ফাইন চল তাহলে।
অরু ক্রীতিকের হাত টেনে ধরে ব্যতিগ্রস্থ হয়ে শুধালো,
— একি কোথায় যাবো?
ক্রীতিক নিজের চোয়াল শক্ত করে বললো,
— যেহেতু তুই আমার বউ, সো তুই এখন থেকে আমার সাথেই থাকবি, দেখি কে আটকায় ।
অরু বড়সড় একটা শুষ্ক ঢোক গিলে ক্রীতিককে থামিয়ে দিয়ে বললো,
— শুনুন, শুনুননা একটু, মা কেবল একটু সুস্থ হয়েছে, এই মূহুর্তে মা এতোবড় শক নিতে পারবে না,সব কিছু জানাজানি হয়ে গেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।এমন করবেন না প্লিজ, আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো, তবুও এমন পাগলামি করবেন না কথা দিন।
ক্রীতিক পুনরায় গাড়ির ডিকিতে বসে বললো,
— ওকে ফাইন কাঁদতে হবেনা, জোর করবো না তোকে।তবে কালকের কথা যাতে মাথায় থাকে।
অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সায় জানালে ক্রীতিক কিছু একটা ভেবে অরুকে টেনে এনে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিয়ে ওর কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বললো,
— এখনো রেগে আছিস আমার উপর?
অরু নাক ফুলিয়ে বললো,
— আমার রাগ দিয়ে কি আসে যায়, আপনিতো আমাকে সারাক্ষণই মা’রেন।
— আদর করিনা বুঝি?
অরু নিশ্চুপ। ক্রীতিক অরুর গালে হাতদিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে পারলো সেখানে এখনো পাঁচ আঙুলের ছাপ পরে আছে। ও যায়গাটাতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
— তোর শরীরে আমার করা দাগগুলো মা’রাত্মক লাগে।
অরু শুষ্ক ঢোক গিলে বললো,
— তাই বলে এভাবে ব্যাথা দেবেন?
ক্রীতিক তীর্যক হেসে বললো,
— ভবিষ্যতে আরও বেশি ব্যাথা দেবো অভ্যেস করে নে।
অরু বুঝতে পারলো ক্রীতিকের কথার ধরন কেমন হুট করেই পাল্টে গিয়েছে, স্পর্শে তার তীব্র কাতরতা, গলার আওয়াজে লেগে আছে একরাশ মাদকতা, নিজ মনের অযাচিত চিন্তা গুলোকে পেছনে হটিয়ে দিয়ে অরু ডোরাকে শক্ত করে চেপে ধরে চুপচাপ হয়ে আছে,
ক্রীতিক অরুর গালে নিজের গালটা আলতো স্পর্শে ঘষে দিয়ে বললো,
— আমি ব্যাথা দিয়েছি আবার আমিই আদর করে দিলাম। হার্টবিট।
— হার্টবিট মানে হৃদস্পন্দন,যা না থাকলে মানুষ মা’রা যায়।
ক্রীতিক ওর গালের সাথে গাল মিশিয়ে বললো,
— তুই আমার কাছে তার চেয়েও বেশি।
ক্রীতিকের হঠাৎ করা উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠেছে অরুর ছোট্ট শরীর, সেই সাথে মিয়িয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কে চড়াও হওয়া রাগের ফুলিঙ্গ। পুরুষালী স্পর্শ পেয়ে অরু নিজেও খানিকটা কুঁকড়ে গেলো, গলায় দীর্ঘশ্বাস আটকে রেখেই কম্পিত কন্ঠে বললো,
—- আপনাকে আমি বুঝতে পারিনা কিছুতেই।
নিজের বলিষ্ঠ দুহাতে অরুর লতানো কোমড় টাকে জড়িয়ে ধরে অরুর গলায় মুখ ডোবাতে ডোবাতে ক্রীতিক বললো,
—- পুরোপুরি আমার হয়ে যা ঠিক বুঝতে পারবি।
চলবে……
#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ২৮
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য]
[আজকের পর্বটা কিঞ্চিৎ রোমান্টিক, যারা দূর্বল চিত্তের তারা এড়িয়ে যেতে পারো।]
রোদ্রজ্জল দিন। সূর্যের প্রখর তাপে ভালোই উত্তপ্ত ধরনী। আমেরিকার কনকনে শীতের মাঝে যেই ভালোবাসার কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল,সেই কনকনে শীত এখন অনেকটাই সহনীয় হয়ে উঠেছে, রাত আর ভোর ব্যাতীত শীতের আঁচ খুব একটা অনূভুত হয়না এখন আর। এছাড়া আবহাওয়ার হুটহাট পরিবর্তন আমেরিকার নিত্তনৈমিত্তিক কাহিনী, এসবে খুব একটা গা ভাসালে চলে না। তবে আজ সত্যিই ব্যতিক্রম চারিদিক, ভোরের মেঘভেজা বাতাস আর প্রাকৃতিক সুঘ্রাণে মো মো করছে স্নিগ্ধ সকাল। সেই সুন্দর সকালেই হাইওয়ে রাস্তা ধরে শাঁই শাঁই করে এগোচ্ছে ক্রীতিকের ব্ল্যাক মার্সিডিজ। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে টিন্ডেট জানালায় চিবুক ঠেকিয়ে বসে নিস্প্রভ চোখে বাইরে তাকিয়ে আছে অরু। ওর মনটা বিষন্ন, ব্যতিগ্রস্ত, আর ভারী ক্লান্ত।
হাইওয়ে রাস্তার দু’ধারে উঁচু নিচু অসংখ্য পাহাড় আর তারমাঝে সারি সারি উইল্ড মিলের বহর। প্রকৃতির নিদারুন বাতাসে সবগুলো উইল্ড মিলই ঘুরছে আপন গতিতে। সেই তখন থেকে সেগুলো একধ্যানে পরখ করছে অরু। ও জানেনা ক্রীতিক ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আর জানতে চায়ও না, ক্রীতিকই তো নিয়ে যাচ্ছে, অন্য কেউতো আর না। মা’রুক,কা’টুক, বকুক কিন্তু কখনো আসন্ন বি’পদে হাত ছেড়ে দেবেনা, হৃদ মাঝারে সদ্য জন্মানো ভালোবাসার প্রতি এতোটুকু ভরসা আছে অরুর।কারণ বৈবাহিক সম্পর্ক নতুন হলেও, চেনা জানা তো আর নতুন নয়।
প্রথমবার ক্রীতিকের সাথে আউটিং এ যাচ্ছে, অথচ অরুর মন মস্তিষ্ক জুড়ে অজানা আ’তঙ্করা ভর করে আছে, বারবার মনে হচ্ছে কিছু একটা ভুল হচ্ছে, কিছু একটা ঠিক নেই। একদিকে হৃদয় টা ক্রীতিকের জন্য আনচান করে, তো অন্যদিকে মস্তিষ্কটা দূর্বিষহ আর একটা তিমিরে ঢাকা ভবিষ্যতের ভয়ে সর্বদা তটস্থ থাকে। এতো অল্পবয়সে এই মন মস্তিষ্কের দোটানা মোটেই সহ্য হয়না অরুর। ক্রীতিকের মতো মানুষ কিনা শেষমেশ হাঁটুর বয়সী সৎ বোনের প্রেমে আকৃষ্ট হলো? কিন্তু কেন? অরু নিজেও ভেবে পায়না সে উত্তর।
অবশ্য ভাবতে চায়ও না,কারন আজকাল তো ও নিজেও ক্রীতিককে ছাড়া কিছু ভাবতে পারেনা, এখনতো নিজের পাশে ক্রীতিক ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের মুখ কল্পনা করলেও গায়ে কাটা দেয় অরুর, একটা সময় নিখিলের জন্য করা অযথা পা’গলামি গুলো ভাবতে গেলে এখন শুধুই হাসি পায়, নিখিলকে আজকাল জোকার বৈকি আর কিছুই লাগেনা অরুর চোখে।যার দরুন নিজের মনের উপরই সন্দেহ জন্মেছে অরুর, ও কি আদৌও নিখিল কে ভালোবেসে ছিল?যদি ভালোই ভালোবাসবে তাহলে কি করে এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো? ভালোবাসা কি ভোলা যায়? ক্রীতিককেও কি এভাবেই চাইলেই ভুলে যেতে পারবে অরু? আচ্ছা ক্রীতিক ওকে ভুলে যাওয়ার সুযোগ দেবে কি? মনেতো হয়না।
সেই কখন থেকে অরু একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে, ক্রীতিক অরুর দিকে দুএকবার পরখ করে আবারও ড্রাইভিং এ মন দেয়, এভাবে মনমরা হয়ে কি ভাবছে এতো মেয়েটা কে জানে? তবে সবকিছুরই তো একটা সীমা আছে, অরু ভাবতে ভাবতে সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে বহুক্ষণ আগেই, ক্রীতিকের কাছে অরুর ব্যবহারটাকে এখন গা জ্বালানো আর বিরক্তিকর লাগছে। অরুর মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে স্থির চিত্ত কেমন ব্যাথা করে উঠছে ওর।
কিন্তু ক্রীতিক খুব সহজে তো নরম হতে জানেনা,আর না হৃদয়ের ব্যাথাটা অহরহ প্রকাশ করে দিতে পারে। তাই ভালোলাগা,মন্দলাগা দুটোতেই একই মুখ ভঙ্গিমা পরিলক্ষিত হয় ওর মাঝে। অজান্তেই হুটহাট মেজাজ হারিয়ে কাঠিন্যতা ছড়িয়ে পরে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, এবারও তাই হলো,কখন থেকে মেজাজ চড়াও হয়ে গেলো টের পায়নি ক্রীতিক, অরুকে কোনোরূপ ভালোমন্দ জিজ্ঞেস না করেই চোয়াল শক্ত করে স্পিডোমিটারের কাটায় একশোর উপর গতি তুলে ফেললো মূহুর্তেই। এতোক্ষণ ধরে চিবোতে থাকা চুইংগামটা তীক্ষ্ণ চোয়ালের এপাশ থেকে ওপাশে নিতে নিতে ভাবলেশ নজরে সামনে তাকিয়েই এমন উদভ্রান্তের মতো হুশশ করে গাড়ি চালাচ্ছে সে। যেন আশেপাশে কোনকিছুই হয়নি, সবকিছু সাভাবিক।ওদিকে হঠাৎ করেই গাড়ির স্পীড দিগুণ বেড়ে যাওয়ায় আচমকা আঁতকে উঠল অরু,হুট করেই বাতাসের তীব্র ধা’ক্কা চোখে মুখে কাঁচের মতো এসে বিধলো, অরু সঙ্গে সঙ্গে জানালা থেকে মুখ সরিয়ে আ’তঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ক্রীতিকের পানে। ক্রীতিক আগের মতোই চুইংগাম চিবুচ্ছে, চোখে তার বিশালাকৃতির রোদ চশমা, পরনে ব্ল্যাক ওভার সাইজ হুটি, লম্বা ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো এলোমেলো হয়ে কপালে পরে আছে, এই ক্রীতিককে দেখতে ঠিক যতটা না সুন্দর লাগছে, ওর মুখে লেগে থাকা কপট হাসিটা তার চেয়েও ভয়ানক লাগছে।
সেই কখন থেকে অরু একধ্যানে তাকিয়ে আছে দেখে,এবার নিরবতা ভাঙে ক্রীতিক, সামনে দৃষ্টিপাত করেই অরুকে প্রশ্ন ছো’ড়ে,
— কি দেখছিস এতো মন দিয়ে?
অরু নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
— দেখছি আপনি কতটা হার্টলেস।
ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,
— আমি হার্টলেস নই অরু।
ক্রীতিকের কথায় অরুর অভিমানে ভাটি পরলো, মনের মাঝে জমাট বাঁধা কালো মেঘের কোলে উঁকি দিলো সূর্য কীরন , ও বললো,
— তাহলে এভাবে গাড়ি চালিয়ে কিসের হু’মকি দিচ্ছেন?
ক্রীতিক গভীর কন্ঠে বললো,
— ফোকাস অন মি।
অরু সিটের উপর দু পা তুলে দিয়ে ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে বললো,
— আপনাকে নিয়েই তো ভাবছিলাম, কবে হয়ে গেলেন এতোটা আপন? আপনার জন্য কি সুন্দর বানিয়ে বানিয়ে হাজারটা মিথ্যে কথা বলে, মা আর আপাকে বোকা বানিয়ে বের হয়ে এলাম।আমি সত্যিই পাল্টে গিয়েছি।
অরুর এরূপ প্রতিউত্তরের সাথেই সাথেই স্পিডোমিটারের গতি সহসাই ধীর হয়ে এলো। সানগ্লাসের আড়ালে আ’গ্নেয়গিরির লা’ভার মতোন জ্ব’লন্ত চোখ দুটো মূহুর্তেই শান্তরূপ ধারন করলো ক্রীতিকের। ক্রীতিক চুপ হয়ে আছে দেখে অরু পুনরায় বললো,
— না আপনাকে আমি হৃদয় থেকে মুছে দিতে পারছি, আর না আপনাকে নিয়ে সুন্দর বৈবাহিক স্বপ্ন দেখতে পারছি,শুধু মনে হচ্ছে আপনি ছাড়া আজকাল আমি অচল, আপনাকে আমার প্রয়োজন নয়তো বুকের ভেতরটা হরহামেশাই পু’ড়ে যায়। এ কেমন দহন? আমি কি প্রেমে পরেছি আপনার?
অরুর শেষ কথাতে গাড়িটা এবার পুরোপুরি থামিয়ে দিলো ক্রীতিক, হুট করে গাড়ির
ব্রেক কষানোতে অরুও একটু হুড়মুড়িয়ে উঠলো।কিন্তু ক্রীতিক ওকে পরে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে টান মে’রে নিয়ে এসে নিজের কোলের উপর বসালো। অকস্মাৎ ঘটনাপ্রবাহে অরু নিজেও ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে চোখের পলক ফেলতে লাগলো বারবার, নিজেকে সামলানোর জন্য ক্রীতিকের হুডি খামচে ধরে অস্ফুটে সুরে বললো,
— গাড়ি থামালেন কেন হঠাৎ ? এসে গিয়েছি বুঝি?
ক্রীতিক অরুর পিঠের দিকে হালকা ধা’ক্কা দিয়ে নিজের দিকে টেনে এনে বললো,
— এতোটা দূর্বল করে দেওয়ার কি মানে অরু? তুই কি চাস আমি গাড়ি চালাতে না পেরে এক্সিডেন্ট করে ম’রে যাই?
অরু বিস্মিত কন্ঠে বললো,
— এসব কি বলছেন?
— নয়তো এসব বলে কেন দূর্বলতা বাড়াচ্ছিস? নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারলে আমি কিন্তু গাড়িতেই তোকে…
কিছু একটা ভেবে থেমে গেলো ক্রীতিক, অতঃপর শুষ্ক ঢোক গিলে ওর ছোট ছোট বেবি হেয়ারগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিতে দিতে নরম সুরে বললো,
— আই ফিল ইউর পেইন অরু, খুব শীঘ্রই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুই বললে আমি এখনই সব কিছু ঠিক করে ফেলতে পারি, কিন্তু বারবার তোকে জো’রজব’রদস্তি করতে চাইছি না আমি,তাই সময় দিচ্ছি, তাই বলে এই না যে আমি ভবিষ্যতেও চুপ করে থাকবো। সময় হলে আমার অরুকে আমি ঠিক ছিনিয়ে নেবো। আই রিপিট ছিনিয়ে নেবো।এখন এসব নিয়ে ভাবিস না জান,আমার উপর একটু ভরসা রাখ, আমিতো আছি।
অরু কিছুই বলছে না অবাক দৃষ্টিতে ক্রীতিকের পানে তাকিয়ে আছে, এই লোক এতো সুন্দর করে বোঝাতেও পারে? মাত্র কয়েকটা বাক্যদ্বারা কি সুন্দর হৃদয়ে বইতে থাকা জ’লোচ্ছ্বাসের মতো উত্তাল ঢেউকে নিমিষেই শান্ত করে কানায় কানায় ভরিয়ে দিলো।
অরু তাকিয়ে আছে দেখে ক্রীতিক বললো,
— ইউ হ্যাভ টু প্রমিস মি, আর এসব নিয়ে মন খারাপ করবি না।
অরু এবার ঠোঁট উল্টে বাচ্চাদের মতো হ্যা, না দুইদিকেই মাথা নাড়ালো।
অরুর কান্ডে ক্রীতিক সামান্য হেসে বললো,
— তুই আমার থেকে অনেক বেশি ছোট অরু, তাই অনেক কিছু শেয়ার করতে দ্বিধাবোধ করিস,লজ্জিত হোস, এতে অযথা ভাবনার কিছু নেই, আমাদের মধ্যে সেরকম স্বামী স্ত্রীর সাভাবিক সম্পর্ক এখনো তৈরি হয়নি, এই দ্বিধা আর সংকোচটুকু তাই অসাভাবিক কিছু নয়। তাই বলে এই না যে আমরা কখনো নরমাল স্বামী স্ত্রীর মতো হবোনা।তুই আমার থেকে বয়সে খুব ছোট বলে আমি তোকে ছেড়ে দেবো, কখনোই নিজের একান্ত ব্যক্তিগত চাহিদা গুলোকে তোর সামনে উত্থাপন করবোনা, এটা ভেবে থাকলে এখনো ভুলের মধ্যে আছিস জান। একটা সময় আসবে যখন তোর শরীর সম্ভ্রম দিয়ে নয়, আমার শরীর দিয়ে ঢাকা থাকবে। তোর ফর্সা ত্বকের খাঁজে খাঁজে শুধুমাত্র আমার তৈরি করা ক্ষত থাকবে, আর সেটা তুই খুশি মনে ভালোবেসে গ্রহন করবি। তখন দেখবি এই দ্বিধা এই জড়তা কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না, তোর আমার সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। তখন তুইও আমাকে নিয়ে বৈবাহিক স্বপ্ন দেখবি, আই সয়ার।
এতোক্ষণ তো ভালোই বুঝাচ্ছিল, কিন্তু হুট করেই কি থেকে কিসের মাঝে চলে গেলো ক্রীতিক? একেতো দু’পা ছড়িয়ে ক্রীতিকের কোলের উপর বসা, তারউপর ক্রীতিকের এমন লাগাম ছাড়া জ্ঞানদান সব মিলিয়ে মাথা নুয়িয়ে চুপচাপ বসেবসে আঙুল দিয়ে ক্রীতিকের হুডির ফিতে ধরে টানাটানি করছে অরু। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, এই মূহুর্তে একপা নড়াচড়া তো দূরে থাক মাথা তুলে ক্রীতিকের ওই ভাসা ভাসা চোখের দিকে তাকানোর শক্তিটুকুও অরুর মাঝে অবশিষ্ট নেই।
অরু ক্রীতিকের খোলামেলা কথায় বেশ লজ্জা পেয়েছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ক্রীতিক ইচ্ছে করেই ওকে লজ্জার সাগরে ডুবিয়ে দিতে বললো,
— ডু ইউ লাইক দিস পজিশন,দ্যাট মাচ?
ক্রীতিকের কথার আসল মানে বুঝতে পেরে অরু হকচকিয়ে বললো,
— ছাড়ুন আমি নামবো।
ক্রীতিক ওকে টেনে ধরে বললো,
— নো!এখানেই বসে থাক, সময় হলে দুজন একসাথেই নামবো।
অরুর লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে, কেউ শুধু শুধু অহেতুক গাড়ির মধ্যে এভাবে কোলে বসিয়ে রাখে? মানুষ কি বলবে? ক্রীতিক যে এতোটা লাগামহীন নির্লজ্জ প্রকৃতির লোক সেটা আজ প্রথমবার উপলব্ধি করলো অরু, মনেমনে ক্রীতিকের উপর চড়াও হয়ে অরু বললো,
— আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল, এই লোক সুবিধার না, যে সারাক্ষণ ডার্ক রোমান্টিক অডিও বুক শুনে সময় পার করে সে কিভাবে ভদ্রলোক হতে পারে?
ক্রীতিক সেই তখন থেকে কোলের উপর বসিয়ে রেখেছে অরুকে,ওদিকে অরুর প্রচুর বিরক্ত লাগছে এভাবে বসে থাকতে, কতক্ষণ এভাবে বসেবসে কালো হুডির কালো বিশ্লেষণ করা যায়? কালো দেখতে দেখতে চোখ ধরে এসেছে ওর। তাই টিকতে না পেরে নিরবতা ভেঙে অরু শুধালো ,
— আপনি আমার শরীরে ক্ষত কেন করবেন? আপনিকি ডা’কাত?
ক্রীতিক এতোক্ষন ব্যাক সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল, হঠাৎ অরুর এমন প্রশ্ন শুনে নিজের হাত দিয়ে অরুর ঘাড়টা সামনে টেনে এনে মুখের কাছে মুখ নিয়ে ও হিসহিসিয়ে বলে,
— আই লাইক ডার্ক রোমাঞ্চ বেইবি। নরম সরম আদরে আমার পোষায় না। আমি যেখানে টাচ করি সেখানে ক্ষত বানিয়ে তবেই ছাড়ি। এই জন্যই বলি, এখন সময় দিচ্ছি নিজেকে প্রস্তুত কর, ছোট বলে মোটেই ছেড়ে দেবোনা। তোর কাছাকাছি এলে নিজের মধ্যে থাকিনা আমি, পরে আমাকে দোষ দিতে পারবি না।
ক্রীতিকের অসহনীয় কথায় অরুর কান বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম, মনেমনে ভাবলো
—-কি প্রশ্ন করলাম,উনি কি উত্তর দিলো,এই লোকের মাথায় কি সবসময় এইসবই ঘোরে?ছ্যাহ!
ক্রীতিক আবারও ব্যাকসিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে, অরু এবার রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিলো সায়র।
ক্রীতিক একই ভাবে অরুকে কোলে নিয়েই শুধালো,
— কি চাই?
সায়র ক্রীতিকের কথায় পাত্তা না দিয়ে অরুর দিকে চাইলো, যে আপাতত সায়রকে দেখে স্ব ওড়না দিয়ে নিজের নাক,মুখ পেচিয়ে মমি হয়ে ক্রীতিকের কোলে বসে আছে।
অরুর অবস্থা দেখে সায়র ঠোঁট চেপে হাসি সংবরণ করে বললো,
— বাবাহ ক্রীতিক,ভালোইতো উন্নতি হয়েছে তোর বাচ্চা বউয়ের, সেবার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলে থাইল্যান্ড বসে কাঁদতে কাঁদতে নাকের পানি চোখের পানি একাকার করে আমেরিকা পর্যন্ত বন্যা বানিয়ে ফেলেছিল, আর এখন কি সুন্দর কোলে বসে আছে, কি খাইয়ে বড় করে ফেললি এতো তাড়াতাড়ি?
ক্রীতিক হাই তুলে বললো,
— স্পেশাল ডোজ, তোদের মতো সিঙ্গেল মানুষ এসব বুঝবে না।
ক্রীতিকের মুখে লাগাম টানার জন্য অরু এই প্রথমবার সাহস করে একটা কাজ করে বসলো, ও এগিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে ক্রীতিকের মুখ চেপে ধরলো।
ক্রীতিক অরুর চেপে রাখা হাতের মধ্যে থেকেই অস্পষ্ট সুরে সায়রকে বললো,
— আমার বউ লজ্জা পাচ্ছে, যা ভাগ শালা।
সায়র ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— বাস ওয়েট করছে জলদি আয়, অতঃপর যেতে যেতে অসহায় সুরে বললো,
— আমার যে কবে একটা বউ হবে। হে উপরওয়ালা আর কতদিন সিঙ্গেল রাখবে তুমি আমায়?একটা আমেরিকান গার্লফ্রেন্ড জুটিয়ে দিলেও তো পারো।
*****************************************
চারিদিকে পাহাড় বেস্টিত অরন্যে ঘেরা নির্জন পরিবেশে সরু পিচঢালা রাস্তার একমাথায় দাড়িয়ে আছে মিনি সাইজের একটা অত্যাধুনিক বাস।ক্রীতিক হাতের মুঠোয় অরুর ছোট্ট হাতটা চেপে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকেই। যেন অরু কোনো বাচ্চা মেয়ে হাত ছাড়লেই দুষ্টামি শুরু করে দেবে।এদিক ওদিকে তাকিকে বাসটাকে পর্যবেক্ষন করে অরু যেতে যেতে বললো,
— এখন আবার বাসে কোথায় যাবো?
—গন্তব্যে।
ছোট্ট করে উত্তর দিল ক্রীতিক। ওর মনটা ভালো তাই হয়তো এতোটুকু উত্তর পেয়েছে অরু। যেহেতু ক্রীতিক খুব একটা কথা বলেনা,তাই আশপাশের সুন্দর পরিবেশ দেখতে দেখতেই হাটতে লাগলো অরু।
অতঃপর হাটতে হাটতে ক্রীতিকের হাত ধরেই বাসে উঠে এলো ও।
বাসের ভেতরে এলিসা, অর্নব, ক্যাথলিন আর সায়র বসা। ক্যাথলিন মাথায় বাকেট হ্যাট পরে আছে, ও অরুকে দেখেও না দেখার ভান করে বসে রইলো, তাকাতে যাবে তারপর আবার ক্রীতিক রেগেমেগে এসে কি কেটে নেবে কে জানে? তার চেয়ে না তাকানোই মঙ্গল।
অরুকে দেখে এলিসা আগ বাড়িয়ে বললো,
— অরু আমার কাছে এসে বসো।
এলিসার আন্তরিকতায় অরু এগিয়ে গিয়ে এলিসার পাশে বসলো, আর ক্রীতিক চলে গেলো পেছনে সায়র অর্নবের কাছে।
অরু পাশে বসতেই এলিসা সম্মোহনী হাসি দিয়ে শুধালো,
— আপুর উপর রাগ করে আছো বুঝি?
অরু এদিক ওদিক না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
— আমি তোমার উপর রেগে নেই আপু। তুমিতো আর কিছু করোনি।
— জেকে কে বাঁধাও তো দিইনি।
এলিসার কথায় অরু এবার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে ক্রীতিকের পানে চাইলো, যে খুব গভীর মনোযোগে আইপ্যাড স্ক্রল করছে আর সায়র, অর্নবের সাথে কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে। তারপর পুনরায় এলিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
— এখানে কারোরই কোনো হাত নেই আপু।আমিই বোধ হয় ওনার বুকের বা পাশের পাঁজর দিয়ে তৈরি হয়েছিলাম,তাই ডেসটিনি এড়াতে পারিনি।
অরুর এমন সহজ সীকারোক্তিতে এলিসার ঠোঁট প্রসারিত হয় মৃদু হাসিতে,অরুর হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে অবিশ্বাসের সুরে এলিসা বলে,
— তুমি কল্পনাও করতে পারবে না ও তোমার জন্য ঠিক কতোটা পা’গল। শুধু আমরাই জানি, তাইতো সেদিন ওর অন্যায় আবদারে বাঁধা দিতে পারিনি। কারণ সময়টা প্রতিকূল ছিল ঠিকই কিন্তু তোমার প্রতি ওর অনূভুতি গুলো ছিল হিরের মতো স্বচ্ছ আর দিনের মতোই সত্য। হি ইজ লিটরেলি অবসেসট উইথ ইউ অরু। আর সেদিন কেউ তোমার মায়ের অপারেশন বন্ধ করেনি,জেকে মিথ্যা বলে তোমাকে ভ’য় দেখিয়েছিল।যাতে তুমি দ্রুত বিয়েতে হ্যা বলে দাও।
এলিসার কথার পাছে অরু আর কিছুই বললো না, আজ ওর সামনে নতুন করে ক্রীতিকের আরও খানিকটা রহস্য খোলাসা হলো। তারমানে ক্রীতিক নিজেকে যেমনটা দেখায় ক্রীতিক আসলে তেমনটা নয়, পুরোপুরি ভিন্ন একটা মানুষ।
অরু যখন হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে চুপচাপ বাইরে তাকিয়ে ছিল,তখনই এলিসা ওকে হটডগ এগিয়ে গিয়ে বললো,
— নাও, এটা খাও।
সকাল থেকে না খেয়ে খেয়ে খিদেয় পেট চো-চো করছে অরুর,এখন খাবার দেখে ক্ষিদেটা যেন আরও দিগুন বেড়ে গিয়েছে, তাই দেরি না করে, হাত বাড়িয়ে খাবারটা নিতে যাবে, তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে এলিসাকে উদ্দেশ্য করে ক্রীতিক বললো,
— এলিসা অরুকে কিছু খাওয়াস না, ক্যাম্পিং ভ্যানে গিয়ে একেবারে খাবে, ওর এখন মাথা ঘুরছে। এখন খাওয়ালে বমি করে সারাদেশ ভাসিয়ে দেবে তখন আবার আমার যত জ্বালা।
এলিসা তাড়াতাড়ি করে খাবারটা অরুর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো,
— অরু, সত্যিই তোমার মাথা ঘুরছে?
অরু মেকি হেসে নিজের রাগ সংবরন করে বললো,
—- একটু আপু, অতঃপর ক্রীতিকের দিকে তাকিয়ে কটমটিয়ে বললো,
— আমি মোটেই বমি করে সারাদেশ ভাসাই না।
ক্রীতিক গভীর মনোযোগে আই প্যাড দেখছে,সেইসাথে হটডগে কামড় বসাতে বসাতে অরুকে বলছে,
— ডোন্ট টক,হার্টবিট। বমি চলে আসবে।
অরু মুখে ভেংচি কেটে সামনে তাকিয়ে বললো,
— অসহ্য।
*****************************************
জোছনা রাতে আকাশে রুপোর থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তার আশেপাশে নির্ভীক সৈন্যের ন্যায় পাহারায় দাড়িয়ে অগণিত তারকারাজি। চাঁদ আর তারকাদের রুপোলী আলোয় ভেসে যাচ্ছে পুরো পাহাড়ের এমাথা থেকে ওমাথা।
পাহাড়ের চূড়ায় তিন তিনটে ক্যাম্পিং ভ্যান পাথরের মূর্তির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো কৃত্তিম আলোয় আলোকিত। ক্যাম্পিং ভ্যানগুলোর মাঝখানে যে আঙিনার মতো ছোট্ট জায়গাটুকু পরে আছে সেখানে ক্যাম্পফায়ার জ্বালানো হয়েছে, সন্ধ্যা নামাতে একটু একটু হিমেল হাওয়া বইছে পাহাড়ের গায়ে। তবে এই মূহুর্তে কারোরই সেই বাসন্তিক হিমেল হাওয়াতে নজর নেই, আপাতত একযোগে সবার দৃষ্টি ধরে রেখেছে অর্ণব আর এলিসা।
সবাই যখন ক্যাম্প ফায়ারের চারদিকে গোলাকার হয়ে বসে গল্পগুজবে মেতে উঠেছিল, তখনই সবার মধ্যে থেকে অর্ণব উঠে এসে এলিসার সামনে হাটু গেড়ে বসে পরে, এলিসা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলে অর্ণব হাতে থাকা চকচকে হিরে খচিত রিংএর বক্সটা বাড়িয়ে দেয় এলিসা পানে।
ক্যাম্পিং করার নাম করে পাহাড়ে এসে অর্ণব এভাবে সারপ্রাইজ করে দেবে সেটা কল্পনাও করেনি এলিসা। অবাকের চড়ম সীমানায় গিয়ে মুখের উপর হাত রেখে এলিসা বললো,
— কি করছিস তুই মাথা ঠিক আছে? সবাই দেখছে তোকে।
অর্ণব বললো,
— দেখুক।এখানে সবাই আমার ভালোবাসার পাগলামি গুলো দেখেদেখে অভস্ত্য এলিসা।
তোকে প্রথম দেখে ভালোবেসে ছিলাম আমি, বলতে পারিস লাভ এট ফার্স্ট সাইড,তারপর যতগুলো বছর একসাথে বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে কাটিয়েছি, তোর প্রতি ভালোবাসাটা আমার বেড়েই গিয়েছে দিগুণ তালে, কমেনি কখনো।তোর মনটাকে জিতে নেবার আসক্তি, তোকে আপন করে পাবার নেশাটা শরীরের নিউরনে নিউরনে ছড়িয়ে পরেছে আমার। এখন মনে হচ্ছে একপাক্ষিক ভালোবাসতে বাসতে তুই আমার ব্যাধিতে পরিনত হয়েছিস, আরোগ্য ব্যাধি। আমার এই আরোগ্য ব্যাধি সারাতে তোকে বড্ড প্রয়োজন এলি।তুই কি পারবি না নিজেকে আমার নামে লিখে দিতে? এই মূহুর্তে আমাকে ফিরিয়ে দিলেও আমি এ জীবনে তোর পিছু ছাড়বো না,তুই এটা ভালো করেই জানিস। আর আমিও এটা যে জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস, তাই বলছি,
এলিসা?
উইল ইউ বি মাইন? ফর আ লাইফটাইম কমিটমেন্ট?
এলিসা চুপচাপ দাড়িয়ে আছে, হ্যা না কিছুই বলছে না দেখে, অর্ণব পুনরায় বললো,
—এখন ফিরিয়ে দিলে অসুবিধা নেই, আমি আবার তোকে প্রপোজ করবো, সমস্যা নেই। তোকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে এমনিতেই বন্ধুমহলে নির্লজ্জ খেতাব প্রাপ্ত আমি।
অর্ণবের শেষ কথায় ডুকরে কেঁদে উঠলো এলিসা। কাঁদতে কাদঁতে হেঁচকি টেনে বললো,
— কে বলেছে আমি তোকে ফিরিয়ে দেবো? আমিকি এতোটাই খারাপ, যে নিজের ভালোবাসার মানুষের মন বুঝতে পারিনা?
অর্ণব একগাল হেঁসে বললো,
— তাহলে হাতটা দে?রিং পরাই।
এলিসা তৎক্ষনাৎ নাক টেনে হাত বাড়িয়ে দিলো,
অর্ণব এলিসার অনামিকা আঙুলে রিং পরিয়ে উঠে দাড়িয়ে চট করে এলিসার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালো।
ওদের এই গভীর প্রেম নিবেদন এতোক্ষণ মন দিয়ে দেখছিল অরু, ভালোও লাগছিল এমন ভালোবাসার পূর্ণতা দেখতে। কিন্তু হঠাৎ করে এভাবে সবার সামনে এতোটা অন্তরঙ্গ আলিঙ্গন দেখে সংকোচে চোখ সরিয়ে ফেললো অরু। অরুর কাছে ব্যাপারটা বিভ্রান্তিকর হলেও, আমেরিকান কালচারে বড় হওয়া এলিসা অর্ণবের কাছে এটা দূধ ভাত মাত্র ।
অরু চোখ নামিয়ে মাথা নত করে চুপচাপ ঘাস ছিড়ছে, তখনই কোথা থেকে এগিয়ে এসে সবার আড়ালে ওকে হ্যাঁচকা টান মে’রে ক্যাম্পিং ভ্যানের পেছনে নিয়ে গেলো ক্রীতিক। চাঁদের নিয়ন আলোতে ক্রীতিকের মাদকতা মিশ্রিত চোখ দুটো দেখে অ’ন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো অরুর, ক্রীতিকের উজ্জল ফর্সা চোখ মুখ সব লালবর্ণ ধারন করেছে, সাভাবিকের চেয়ে একটু দ্রুতই শ্বাস নিচ্ছে সে, ক্রীতিকের এমন উদভ্রান্তরূপ দেখে অরু সচকিত হয়ে শুধালো —কি হয়েছে আপনার, জ্বর এসেছে?দেখি।
অরু ক্রীতিকের কপাল ছোয়ার জন্য হাত বাড়ালে ক্রীতিক সেটাকে খপ করে ধরে, বিনাবাক্যে দ্বিতীয়বারের মতো,নিজের ডার্কব্রাউন ওষ্ঠযুগল অরুর নরম তুলতুলে অধরের মাঝে ডুবিয়ে দেয়।
অরুর সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে এক অবাধ্য উন্মাদনায় ছেয়ে গিয়েছে ক্রীতিকের শরীর মন সবকিছু। যার ফলস্বরূপ অরুর ঠোঁটের গভীর থেকে গভীরতর রহস্য উন্মুক্ত করায় মত্ত হয়ে আছে ক্রীতিক, হঠাৎ করে আবারও সেদিনের বেসামাল অনূভুতির জোয়ার এসেছিল অরুর মাঝেও, কিন্তু কতক্ষণ? এখন ক্রীতিকের অতিরিক্ত চাহিদা পূরন করতে গিয়ে দম নেওয়াই দায় হয়ে উঠেছে ওর , তারউপর অবাধ্য হাতের স্পর্শ, এমন আকস্মিক আ’ক্রমণে অরুর যখন প্রান যায় যায় অবস্থা তখন ক্রীতিক নিজেই ছেড়ে দিলো ওর অধর।
একটু খানি দম নিয়ে, নিঃসংকোচে হাত নিয়ে রাখলো অরুর গলায়, অতঃপর একটানে ওড়নাটা খুলে ছুড়ে ফেলে দিলো পাহাড়ের ঢালে। এতোক্ষণ যেভাবেই হোক ক্রীতিকের করা পা’গলামি গুলো মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে অরু, কিন্তু এবার ক্রীতিকের অস্থিরতা আর নেশা ধরা চাহনী দেখে বেশ ভরকে গিয়েছে ও।সেই সাথে ক্রীতিকের পরবর্তী পদক্ষেপ আঁচ করতে পেরেছে খুব ভালোভাবেই, ক্রীতিক এগিয়ে আসছে দেখে ভীত অরু ওর শরীর স্পর্শ করার আগেই অন্যদিকে ঘুরে সশব্দে , নাহহ! বলে কেঁদে উঠলো অরু।
হুট করে, একদম হুট করেই ঘটে গিয়েছে ব্যাপারটা, ক্রীতিক নিজের মাঝেই ছিলনা, তখন কি জানি কি হয়ে গেলো, আরেক জনের ভালোবাসা দেখতে দেখতে ওর মাঝেও অরুকে একান্তে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনাটা কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, কিন্তু আচমকা এভাবে অরুর কা’ন্নার আওয়াজ কানে ভেসে আসতেই সম্বিত ফিরে পেলো ক্রীতিক, দু’হাত দিয়ে নিজের স্টাইলিশ চুলগুলো নিজেই খামচে ধরে অস্পষ্ট সুরে বললো,
— শীট।
তারপর দু’কদম এগিয়ে গিয়ে অরুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
— কি হয়েছে কাঁদছিস কেন? লেগেছে?
অরু বিনাবাক্যে চুপচাপ চোখের জল ফেলছে, দেখে ক্রীতিক আবারও বললো,
— অরু, হার্টবিট, প্লিজ কাঁদিস না, সবাই ওপাশে আছে, এভাবে তোকে কাঁদতে দেখলে ওরা ভাববে আমি তোর সাথে জো’রজ’বরদস্তি করেছি। কি হয়েছে বল আমায় কেন কাঁদছিস, ঠোঁটে বেশি লেগেছে?
অরু ফুঁপিয়ে উঠে বললো,
— মা, আপাকে,মিথ্যে বলে এতোদূরে এসে এই রাতের বেলা আমি কি ঠিক করেছি? মা যদি একটাবার বুঝে ফেলে আমি মিথ্যে কথা বলেছি, তাহলে আমাকে এমন ভাবে কৌশলে আটকে ফেলবে, যে আমি আর বাইরের জগতের মুখটাও দেখতে পারবো না, আর আপনাকে তো না-ই।
অরুর কথায় ক্রীতিক খানিকক্ষন চুপ হয়ে রইলো, তারপর গভীর কন্ঠে শুধালো,
— তুই আমাকে চাস কি না?
অরুর পুরো মস্তিষ্ক এলোমেলো ভাবনায় ছেয়ে আছে, এই সময় এমন একটা প্রশ্নের কি মানে হয়? বুঝে উঠতে পারলো না অরু।
অরু চুপ হয়ে আছে দেখে ক্রীতিক পুনরায় একই প্রশ্ন করলো,
— তুই আমাকে চাস, কি না?
— কি বলছেন, এ….
অরুকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে ক্রীতিক আবারও বললো,
— হ্যা অথবা না। এর বাইরে আর একটা টু শব্দও শুনতে চাইনা।
অরু দেখলো ক্রীতিকের একটু আগের সেই আবেগপূর্ণ প্রেম প্রেম চেহারা হুট করেই কোথাও গায়েব হয়ে গিয়েছে, চোখের মাঝে অনুভূতির ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। এখন যা আছে তা কেবলই বংশানুক্রমে পাওয়া আভিজাত্য আর কতৃত্বে সয়ংসম্পূর্ন ধা’রালো রূপ।
অরু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দেখে ক্রীতিক ওকে ঘুরিয়ে দাড় করিয়ে দিয়ে বললো,
— তোর হাতে পাঁচ মিনিট সময় আছে, টেইক ইউর টাইম, আমি এখানেই আছি কোথাও যাচ্ছিনা।
এবার ক্রীতিকের কথাটাকে একটু সিরিয়াসলি নিয়ে সত্যি সত্যিই ভাবতে বসলো অরু,
সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, প্রথম দিন এসে ভুল করে ক্রীতিকের বিছানায় ঘুমানো, ভরা গ্যালারীতে সবার সামনে ওর ওড়না দিয়ে নিজের ঘাম মোছা,এলিসার জন্মদিনে ক্রীতিকের অনেকটা কাছাকাছি আসা, ওর উপর ক্রীতিকের বারবার অধিকার ফলানো, প্রতিবার বিপ’দে ঢাল হয়ে রক্ষা করা, জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়ার পর হেলিকপ্টারে করে ওকে সেফ করা,নিজের হাত কে’টে হলেও ওকে বাঁচানো।নুপুর, চুলের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিসকে যত্ন করে আগলে রেখে দেওয়া,নিখিলের সত্যিটা জানার পর ওকে সামলানো, নিজের জীবনের সাথে ওর জীবনটাকে ইচ্ছে করে জড়িয়ে ফেলা, সেদিন ক্রীতিকের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় রাগের মাথায় নিজের গোপনীয় সত্যি কথাটা অজান্তেই সীকার করে ফেলা, রাতের আধারে না ঘুমিয়ে ওকে একনজর দেখতে আসা, আর সবশেষে এলিসার বলা কিছু চড়ম সত্যি,
—তুমি কল্পনাও করতে পারবে না, ও তোমার জন্য ঠিক কত টা পাগল। হি লিটরেলি অবসেসট উইথ ইউ।
হটাৎ করেই অরুর মনে হতে লাগলো, প্রথম থেকে সবকিছু যেন একই সুতোয় গাঁথা, কেবল অরুই কিছু টের পায়নি, কিছু বুঝতে পারেনি, কি করেই বা পারতো? ও তো কখনো ক্রীতিকের ভালোবাসা খুজতেই যায়নি। নিজেকে বারবার বসিয়ে এসেছে ক্রীতিকের অপছন্দের তালিকায়, অথচ এখন মনে হচ্ছে ক্রীতিকের মতোকরে ওকে কেউ কখনো ভালোবাসতে পারবেনা, কোনোদিন না। যাই হয়ে যাক ক্রীতিকের ভালোবাসাকে পায়ে ঠেলে দেওয়ার সাধ্য অরুর নেই, তাছাড়া ও নিজেও তো ক্রীতিকের প্রেমে পরেছে এটা কি করে অস্বীকার করবে?
— ইউর টাইম ইজ ওভার।
পেছন থেকে ক্রীতিকের আওয়াজ ভেসে আসতেই অরু ঘাড় ঘুরিয়ে তরিৎ বেগে বললো,
— আমি চাই।
— কি চাস?
অরু এবার ছুটে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে দুটো শরীরের মাঝে সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে বললো,
— আমি আপনাকে চাই, জেকে।
ক্রীতিক একটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে বললো,
— তুই চাইলেই বা কি আর না চাইলেই বা কি, আমার হাত থেকে তোর এ জীবনে নিস্তার নেই।
আমিতো কেবল তোর হৃদয়ের সুপ্ত অনুভূতি গুলোকে তরতাজা করলাম মাত্র ।
ক্রীতিকের কথায় কান না দিয়ে অরু আবারও বললো,
— আমি আপনাকেই চাই, নিজের স্বামীরূপে আপনাকে ছাড়া অন্যকোনো পুরুষকে আমি কল্পনাও করতে পারিনা বিশ্বাস করুন।
অরুর নিঃসংকোচ সীকারোক্তিতে, ক্রীতিকের মাঝে বছরের পর বছর ধরে জ্বলতে থাকা আ’গুনের হলকার মাঝ দিয়ে, হুট করেই যেন ঠান্ডা জলের শীতল স্রোত বয়ে গেলো। অবশেষে ক্রীতিকের মতো করে অরুও আসক্তিতে পরেছে, এই আসক্তি যে বড্ড বেসামাল আর য’ন্ত্রণাদায়ক ক্রীতিক তা হাড়েহাড়ে জানে, এবার শুধু অরুর পালা।
অরু এখনো জাপ্টে ধরে আছে ওকে, অরুর অন্তরঙ্গ আলিঙ্গন ক্রীতিককে ভেতর থেকে উন্মাদ করে দিচ্ছে, ও তৎক্ষনাৎ অরুকে কোলে তুলে নেয়, অরুর দুপা আটকে আছে ক্রীতিকের কোমড়ের দুপাশে, ওকে কোলে তুলে নিয়ে ক্রীতিক হাস্কিস্বরে বললো,
— একবার তুমি করে ডাক।
অরু ডাকলো না। ক্রীতিক আর অপেক্ষাও করলো না,কোলে নিয়েই ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতে লাগলে ওর নরম ঠোঁটের মধ্যিখানে। অতঃপর সেভাবেই ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো ক্যাম্পিং ভ্যানের দিকে।কিন্তু দূর্ভাগ্য বশত ভেতরে প্রবেশের আগেই ক্রীতিকের ফোনটা আপন সুরে বেজে উঠলো, ফোন বেজে ওঠায়, এতোক্ষণ ধরে একটু একটু করে তৈরি হওয়া অনুভূতির জোয়ারে হুট করেই কেমন ভাটি পরে গেলো। ক্রীতিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অরুকে ক্যাম্পিং ভ্যানে বসিয়ে দিয়ে বললো,
— এখানেই ওয়েট কর আমি ফোনটা পিক করে আসছি, আজ রাতে এমনিতেও ঘুম নেই তোর।
অরুকে রেখে ক্রীতিক চলে গেলে, নিজ মনের অযাচিত ভাবনায় লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় অরু,শুষ্ক একটা ঢোক গিলে, মুখ লুকায় নিজের দু-হাতে।
চলবে……