সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৩৩+৩৪

0
7

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#পর্বঃ৩৩
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক,পি করা নিষিদ্ধ🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]

একটি অপার্থিব সকাল, সেই শুরুর দিন গুলোর মতোই নিরিবিলি, নিস্তব্ধ,শুনশান পরিবেশ, দীর্ঘ ঝড়ের তান্ডব আর ঝুম বর্ষাকে সর্বেসর্বা বিদায় জানিয়ে, খুব ভোরেই সূর্য কীরন উঁকি দিয়েছে পূব আকাশে। দক্ষিণ জানালার কাঁচ গলিয়ে সেই একফালি মিঠে রোদ এসে আঁচড়ে পরছে অত্যাধুনিক ধাঁচের রুমটিতে। অরুর কাছে এই পরিবেশ, এই আবহাওয়া নতুন কিছু নয়, বরঞ্চ অনেকদিনের অভ্যেস।

তবে আজ এই নিস্তব্ধতার সাথে প্রথমবার নতুন করে যা যোগ হয়েছে,তা হলো চন্দন কাঠের মন মাতানো সুঘ্রাণ। রুমের আনাচে-কানাচেতে ম ম করছে এই চেনা পরিচিত পুরুষালী সুঘ্রাণ। বিছানা, বালিশ, কুশন,কম্ফোর্টার সব কিছুই বেশ স্নিগ্ধ লাগছে চনমনে এই স্যন্ডল উড পারফিউম আর মাস্কি সৌরভে। অরুর মনে হচ্ছে গত পনেরোটা দিনের নির্ঘুম রাতের কাছে আজকের এই আড়ামদায়ক ঘুমটুকু অমৃত সম। আর ও এই অমৃত সম ঘুমটুকু পুরোপুরি আহরন করতে চায় নির্বিগ্নে, তাইতো ঘুমের মাঝেই অরুর হৃদয়ে গিয়ে ঠেকছে নিদারুন এই সুগন্ধ,বারংবার মনে হচ্ছে এতোটা আরামের ঘুম কোনোদিন ঘুমায়নি ও।

ব্যথাতুর শরীরটাকে একটুখানি নাড়িয়ে চারিয়ে আরও খানিকটা সময়ধরে নতুন এই অনুভূতির সাথে পরিচিত হবে বলে ভেলভেটের মতো মসৃন কুশনের মাঝে মুখ দাবিয়ে, মিঠে রোদটুকু পিঠে পিছলে দিয়ে অন্য দিকে ঘুরে শুলো অরু। এলোমেলো হয়ে ঘুমানোর দরুন ওর রেসমের মতো সিল্কি চুল গুলো ছড়িয়ে পরে আছে পুরো বিছানা জুড়ে। সেগুলোকে গোছানোর কোনোরূপ প্রয়াস না চালিয়েই আবারও ঘুমের দেশে পারি জমালো অরু। তবে অরুর এই অমৃতসম আরামদায়ক ঘুম গাঢ় হতে পারলো না খুব একটা, তার আগেই কানে ভেসে এলো ইলেকট্রনিক্স মেশিনের ভসস ভসস আওয়াজ।

এহেন আওয়াজে ঘুমের মাঝেই বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে গেলো অরুর।কোথা থেকে এই আওয়াজের উৎস তা ঠাওর করার জন্য খানিকটা চোখ ও খুললো বটে। ঘুমের রেশ কাটিয়ে আড়মোড়া ভে’ঙে চোখের পাতা খুলতেই সফেদ রঙা সিলিং এর দিকে চোখ গিয়ে ঠেকলো ওর, যা দেখে হুট করেই বড্ড অপরিচিত লাগছে অরুর। কিন্তু চারপাশের স্নিগ্ধ সুঘ্রাণটা বড়োই পরিচিত। অগত্যাই ঘুমের ঘোর কাটিয়ে চারিদিকে চোখ ঘোরালো ও, সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পরে যায় ঝড় আর বৃষ্টিস্নাত নির্ঘুম বিগত রাতের কথা। কিছু ঘোর লাগানো মূহুর্ত আর তারপর জায়ান ক্রীতিকের অনেকটা কাছে চলে আসা। সব কিছুই সুস্পষ্ট অরুর মস্তিষ্কে এখন। সেসব কথা মাথায় আসতেই তীব্র লজ্জায় চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে নিলো অরু।

অরু যখন ঘনিষ্ঠ মূহুর্তের কথাই ভাবছিল, ততক্ষনে ছক্কা লাগার মতো আরও একটা প্রশ্ন এসে মাথায় লাগলো ওর, মনেমনে ভাবলো,
— তখন তো গাড়িতে ছিলাম, তাহলে এখন কোথায়?

কথাটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় কানে ভেসে এলো সেই বিরক্তিকর ভসস ভসস আওয়াজ। আওয়াজের উৎস খোজার জন্য অরু এবার চোখ ঘুরিয়ে চাইলো ওয়াল মিরর এর দিকে, দেখলো ওর থেকে খানিকটা দূরত্বে আয়নার সামনে দাড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে ব্যাকব্রাশ করে করে চুল শোকাচ্ছ ক্রীতিক, পরনে তার ট্রাউজার সেট। ক্রীতিককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে অরু তরিৎ গতিতে কম্ফোর্টারের মধ্যে মুখ লুকালো,মুখ ঢাকা দিতে দিতেই নিচু স্বরে বিড়বিড়ালো,
— নির্লজ্জ,নির্দয় লোক।

ওদিকে অরুর নড়নচড়ন টের পেয়ে ক্রীতিক হাতের কাজ চালাতে চালাতেই ডাকলো,
— মিসেস অরোরা জায়ান!

ক্রীতিকের এহেন সম্মোধনে, কম্ফোর্টারের মাঝে বসেই উষ্ণতায় ছেয়ে গেলো অরুর সর্বাঙ্গ। লজ্জারা র’ক্তিম হয়ে ঘীরে ধরেছে মুখ মন্ডলের আনাচে কানাচে, সেই সাথে যোগ হয়েছে তলপেটের উড়ন্ত প্রজাপতি। লজ্জায় রাঙা হয়ে অরু যখন ঠোঁট কামড়ে মটকা মে’রে পরেছিল, তখনই পুনরায় ডেকে ওঠে ক্রীতিক,আয়নার দিকে তাকিয়েই বলে,
— এটা আপনার বাপের বাড়ি নয় মিসেস জায়ান, এটা আপনার স্বামীর বাড়ি, তাই বারোটা পর্যন্ত ঘুমানোর বদ অভ্যেস দূর করতে হবে, কজ আপনার হাসবেন্ডকে সকাল সকাল ভার্সিটি যেতে হয়।

ক্রীতিকের এহেন খোঁচামা’রা কথায় অরু আর শুয়ে থাকতে পারলো না, অগত্যাই মুখ কাচুমাচু করে উঠে বসে পিঠ ঠেকিয়ে দিলো খাটের ব্যাক স্ট্যান্ডে। ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের সফেদ রঙা শার্ট। সামনের দিকে শার্টের দুটো বোতাম খোলা, অরু নিজের অপটু হাতে বোতাম দুটো লাগিয়ে, একটু একটু চোখ উঁচিয়ে ক্রীতিককে দেখলো অতঃপর মিনমিনিয়ে শুধালো,
— বাসায় কি করে এলাম?

ক্রীতিক এদিকে না ঘুরেই জবাব দিল,
— ভুতে নিয়ে এসেছে তোকে।

অরু জানে ক্রীতিক মজা করছে, কিন্তু ওর কেন যেন কথা বলতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে, কথা তো দূরে থাক ক্রীতিকের চোখের দিকে তাকাতেও লজ্জা লাগছে এই মূহুর্তে । শান্ত,সাবলীল চোখ দুটোর দিকে তাকালেই বারংবার মনে পরে যাচ্ছে কাল রাতের অশান্ত, আর ঘোর লাগানো দৃষ্টিপাতের কথা, যা অরু উপেক্ষা করতে পারেনি,নিজের অজান্তেই আপন করে নিয়েছিল সেই মিষ্টি যন্ত্রনাটুকু। অথচ এখন সেসব কথা মনে পরলেই লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে অরুর। অরু চুপ হয়ে আছে দেখে ক্রীতিক বললো,
— ঘুম না হলে,ঘুমাতে পারিস, ডিস্টার্ব করবো না।

অরু না সূচক মাথা নাড়িয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
— আপনার মাথার ব্যন্ডেজ কোথায়?

ক্রীতিক বললো,
— ফ্রেশ হওয়ার ছিল তাই খুলে ফেলেছি।

অরু ভ্রু কুঁচকে বললো,
— তাই বলে পুরো ব্যন্ডেজ খুলে ফেলতে হবে? আপনি এতো ছন্নছাড়া কেন বলুন তো?

অরুর কথায় ক্রীতিক এবার ঘুরে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
— কাল পুরোপুরি স্বামীর অধিকার দিয়েছিস, আর আজই শাসন করার স্টার্ট?

ক্রীতিকের কথা গায়ে না মেখে অরু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো, ক্রীতিকের শার্টটা ওর হাঁটুতে গিয়ে ঠেকেছে, অরু সেটাকে টেনে হিঁচড়ে আরও খানিকটা নিচে নামাতে নামাতে বললো,
— এখানে তো আমার কোনো জামা কাপড় নেই কি পরবো?

ক্রীতিক বললো,
— ক্লজেট ভর্তি জামাকাপড় আছে যা খুশি পর গিয়ে।

— ওগুলো তো আপনার, আমি কিভাবে পরবো?

ক্রীতিক এবার ম্যাকবুক নিয়ে ডিভানের উপর বসতে বসতে বললো,
— আমার যা, তাই তোর। এখন থেকে আমার ড্রেসই পরবি তুই,সব তোর।

ক্রীতিকের কথায় অরু দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে বিড়বিড়িয়ে বললো,
— আশ্চর্য লোক, এমনভাবে বলছে যেন সে ইনার ও পরে।

— পরার দরকার নেই।

ক্রীতিকের রাশভারি আওয়াজ কানে ভেসে আসতেই, অরু হকচকিয়ে বললো,
— কিহহ!

ক্রীতিক এবার ম্যাকবুক থেকে চোখ সরিয়ে অরুর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বললো,
— আমার সামনে ইনার পরার দরকার নেই।তোকে এসব ছাড়াই সুন্দর লাগে।

ওর এহেন কথায় অরু দ্রুত মাথা নিচু করে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
— নির্লজ্জ, বেহায়া লোক মুখে লাগাম নেই কোনো। ওনার লজ্জা নাই থাকতে পারে, তাই বলে কি আমারও নেই?

তবে ওয়াশরুমে আর ঢোকা হলো না অরুর, তার আগেই ওর চোখ আটকালো পায়ের নুপুরে, পা দুটো এদিক ওদিক ঘুরিয়ে নুপুরজোড়া ভালোমতো পরখ করে অস্ফুটেই অরু বললো,
— অদ্ভুত তো আমার নুপুর গুলো এমন সোনালী রঙের হয়ে গেলো কেন?

অরুর কথায় ক্রীতিক ডিভান ছেড়ে উঠে এসে ওর সামনে দাড়িয়ে দু’পকেটে হাত গুঁজে বললো,
— আর কবে বড় হবি অরু? তুই বড় হতে-হতে তো আমি বুড়ো হয়ে যাবো।

অরু মাথা তুলে করুন সুরে বললো,
— কেন কি হয়েছে?

ক্রীতিক ঠোঁট কামড়ে বললো,
— না কিছু না,আমার পিচ্চি বউ সোনা আর রূপার পার্থক্য বোঝেনা তাই বললাম আর কি। অবশ্য দোষটা আমারই।
মনেমনে বললো,
— যখন পরিয়েছিলাম তখন তুই ঘুমের ঘোরে ছিলি, জানার কথাও নয়।

ক্রীতিকের কথায় মন খারাপ হয়ে গেলো অরুর,ও মুখ কালো করে শুধালো,
— এভাবে কেন বলছেন কি করেছি আমি?

অরুর কথায় ক্রীতিক বললো,
— কিছু করিস নি, হেটে যেতে পারবি নাকি হেল্প করবো?

আবার সেই লাগাম ছাড়া কথাবার্তা, ক্রীতিকের কথায় অরু দ্রুত ওই যায়গা থেকে প্রস্থান করতে করতে দাঁত কিরমিরিয়ে বলে,
— পারবো আমি, সরুন তো।
*****************************************
দিনের দ্বিপ্রহর চলমান। সকালের মিঠে রোদ টুকু মিয়িয়ে গিয়ে কালো মেঘের আড়ালে ঠায় নিয়েছে সূয্যি মামা। যার দরুন অত্যাধুনিক হলরুমটা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটা লম্বা হট শাওয়ার শেষে অন্ধকারের মাঝেই পা টিপে টিপে হলরুমে এসেছে অরু। নিচে নেমে কোনোকিছু না ভেবেই সবার আগে স্ফটিকের সবগুলো আলো জ্বালিয়েছে ও। এবার সবকিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। ফিকে হয়ে যাওয়া নিরিবিলি রুমে উপস্থিতি মাত্র দুজনার, অরু পাশ ঘুরে কাউচের দিকে তাকিয়ে দেখলো ক্রীতিক কাউচে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে বসে বাইক রেচিং গেইম খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অরু ক্রীতিককে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,অযাচিত মনটা লাফিয়ে উঠে শুধালো ,
— আপনি কি করে থাকেন এতোটা একা একা? কষ্ট হয়না বুঝি?

অরু সেই তখন থেকে করুন চাহনিতে তাকিয়ে আছে দেখে গেইমটা পজ করে কানের হেডফোন নামিয়ে, ক্রীতিক বললো,
— এভাবে ডিস্ট্রাক্ট করতে মন চাইলে রুমে চল,আমিও একটু মন ভরে দেখি তোকে। কাল রাতে মন ভরেনি।

ক্রীতিকের কথা গায়ে না মেখে অরু কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো,
— খিদে পেয়েছে, কি রান্না করা যায় বলুন তো?

অরু কিচেনের দিকে দু’কদম এগিয়ে যেতেই কঠিন সুরে বাধ সাধে ক্রীতিক, ওকে আর এক পাও বাড়াতে না দিয়ে ক্রীতিক বলে,
— খবরদার কিচেনে যাবি না তুই।

ক্রীতিকের কথায় অরু ভ্রু কুঞ্চিত করে পেছনে তাকিয়ে শুধালো,
— কিচেনে না গেলে রান্না কিভাবে করবো?

ক্রীতিক মনিটরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— ফ্রীজে স্যালাড, আর পাস্তা রাখা আছে গরম করে খেয়ে নে।

অরু নাক সিকোয় তুলে বললো,
— আমি এসব খেতে পারিনা, তাছাড়া রান্না করলে সমস্যাটা কোথায়?আগেও তো রান্না করতাম, আর আপনি খেতেনও। তাহলে এখন কিসের অসুবিধা আপনার?

ক্রীতিক চোয়াল শক্ত করে বললো,
— আগের কথা ভুলে যা,এখানে তোকে রান্না করার জন্য আনিনি আমি।

অরু কিচেন কাউন্টারে হেলান দিয়ে, দুহাত বুকে ভাজ করে বললো,
— তাহলে কেন এনেছেন শুনি?

অরুর শেষ কথাতে ক্রীতিক মনিটরের গেইমটা পজ করে রিমোট কন্ট্রোলটা কাউচের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে উঠে দাড়ালো, অতঃপর ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে অন্যহাত দিয়ে লম্বা ঘাড় ছুঁই ছুঁই চুল গুলো ব্যাকব্রাশ করতে করতে অরুর দিকে এগিয়ে এসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে হাস্কি আওয়াজে বললো,
— দুটো রিজন, এক ইচ্ছে মতো আদর করার জন্য, আর দুই আমাকে অভ্যেসে পরিনত করার জন্য।

ক্রীতিকের কথায়, অরু খানিকটা ভরকে যায়, অযাচিত লজ্জায় মিয়িয়ে যাওয়া মুখখানা হুট করেই আড়াল করে দাড়িয়ে পরে উল্টো দিকে।
ক্রীতিক সেভাবেই দাড়িয়ে অরুর আগাগোড়া পরখ করতে থাকে। ক্রীতিকের ক্লজেটে কালোর সমাহার, সেখান থেকেই বেছে নিয়ে একটা একটা ব্ল্যাক ওভারসাইজ টিশার্ট, আর একটা থ্রী কোয়ার্টার পরেছে অরু। ক্রীতিকের থ্রী কোয়ার্টার অরুর ফুল প্যান্টে পরিনত হয়েছে। দেখতেও বেশ কিউট লাগছে ওকে। অরুকে ভালোমতো পরখ করে ওর কনের কাছে মুখ নিয়ে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,
— আমার ড্রেসে তোকে মারাত্মক লাগছে হার্টবিট।এখন থেকে আমার সামনে অন্যকিছু পরার দরকার নেই।

অন্য কিছু পরার দরকার নেই মানে? এ আবার কেমন কথা?অরু কি এখন সারাজীবন এসব দানবীয় সাইজের পোশাক আশাক পরে ঘুরে বেড়াবে নাকি আশ্চর্য? মানুষ কি বলবে? কথাটা ভেবেই বিরক্ত হলো অরু, বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে পেছনে ঘুরে ক্রীতিককে হালকা ধাক্কা মে’রে সরিয়ে কাউচে গিয়ে বসতে বসতে বললো,
— খিদে পেয়েছেতো আমার,সালাদ খেতে পারবোনা, অন্যকিছুর ব্যবস্থা করুন।

ক্রীতিক পকেট থেকে ফোন বের করে, সেটা স্ক্রল করতে করতে বললো,
— আমি রান্না টান্না করতে পারিনা, কি খাবি বল অর্ডার করে দিচ্ছি।

অরু একঝলক ক্রীতিককে পরখ করে কিছু একটা ভেবে বললো,
— বলছি তার আগে এদিকে আসুন।

ওর অকস্মাৎ সম্মোধনে ক্রীতিক ফোন থেকে নজর সরিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
— সিরিয়াসলি তুই আমাকে কাছে ডাকছিস? তাহলে কাল এতো কান্নাকা’টি করার কি মানে ছিল অরু?

আবার সেই ভুলভাল কথা টানছে ক্রীতিক, এই লোকের মাথায় আর কিছু নেই নাকি? ভেবে পায়না অরু, এমনকি ভাবার জন্য খুচরো সময় নষ্ট ও করেনা, বরং উঠে এসে কোনোরূপ কসরত না দেখিয়েই অনেকটা অধিকার নিয়ে নিজের হাত দিয়ে ক্রীতিকের খরখরে পুরুষালি হাতটা ধরে ওকে টেনে এনে কাউচে বসালো। অরুর কান্ডে ক্রীতিক আর বাঁধ সাধলো না, উল্টে কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে অরুকে নিজের কোলে বসিয়ে নরম সুরে শুধালো,
— এখানে কেন?

অরু পেছনে ঘুরে ক্রীতিকের ক্ষতস্থানে আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
— আপনার এখন হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে ফ্রুটস খাওয়া উচিৎ, তা না করে আমাকে কথা দিয়ে পিষ্ট করছেন।কতটা গভীর ক্ষত হয়েছে একবারও খেয়াল করেছেন?

ক্রীতিক অরুর কথার দু’পয়সা তোয়াক্কা না করে নিজ হাত দিয়ে ওর গালদুটো চেপে ধরে বললো,
— কতবার বলেছি আমাকে তুমি করে বলবি, কথা শুনিস না কেন?

অরু ক্রীতিকের চোখ থেকে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে অস্পষ্ট সুরে বললো,
— পারবোনা,আমার লজ্জা লাগে ভীষন।

ক্রীতিক ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বললো,
— এখনো লজ্জা?

অরু ক্রীতিককে কিভাবে বোঝাবে কাল রাতের কথা উঠলেই কান দিয়ে ধোয়া বের হয় ওর, ভীষণ লজ্জায় শিহরণ জেগে ওঠে ক্ষুদ্র নারীদেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সেই শিহরণে কেঁপে ওঠে অষ্টাদশীর হৃদয়,মন সবকিছু। হৃদয়ের সাথে কম্পিত হয় ধনুকের মতো বাঁকানো নারী শরীরটাও।
পরমূহুর্তেই নিজেকে সামলে নেয় অরু, শখের পুরুষের সেই শিহরণ জাগানো প্রথম ছোঁয়াকে পুরোপুরি মাথা থেকে সরিয়ে, মনের মাঝে জেঁকে বসে তার প্রতি একটুকরো ব্যাথাতুর ভালোবাসা, বারবার মনে হতে থাকে,
—- কেন আপনি এতো একা জায়ান ক্রীতিক? আপনার জীবনটা অন্যসবার মতো সাভাবিক নয় কেন? এতোগুলা বছর কি করেই বা একা একা বেঁচে আছেন আপনি? আমি কি আপনার জীবনের এই একাকিত্ব আদৌও দূর করতে পারবো কোনোদিন?

অরু চুপচাপ বসে আছে দেখে ক্রীতিক আগ বারিয়ে শুধালো,
— কি ভাবছিস?

অরু এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে টি টেবিল থেকে ফাস্ট এইড বক্স হাতরিয়ে, ক্রীতিকের কোল থেকে নেমে গিয়ে পাশে বসে বললো,
— এ্যা’ক্সিডেন্ট কিভাবে করলেন?

ক্রীতিক কাউচের ব্যাকসিটে গা এলিয়ে দিয়ে বললো,
—- সেদিন তোর মায়ের বাসা থেকে বেরিয়ে বাইকে রাইডিং এ গিয়েছিলাম, ইম্পর্টেন্ট ম্যাচ ছিল তাই না করতে পারিনি,হয়তো মেন্টালি ডিস্ট্রাক্ট ছিলাম, তাই নিজের উপর কন্ট্রোল ছিলনা।

ক্রীতিকের কথায় ভয়ের চোটে অরুর শরীরের লোমকূপ দাড়িয়ে গেলো। কোনোমতে ওর মাথায় সফেদ ব্যান্ডেজের আস্তর লাগাতে লাগাতে অরু বললো,
— আপনার রা’গটাকে ভীষন ভয় করে আমার। কোনোদিন যদি..

অরু কথা শেষ করতে পারলো আর,তার আগেই ওকে টান মে’রে নিজ বুকের উপর ফেলে দিয়ে ক্রীতিক আগের মতো করেই হিসহিসিয়ে বললো,
— নিজের হার্টবিটকে কেউ আ’ঘাত করে?

অরু ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
— তাহলে নিজেকে কেন করছেন? আপনি একটুখানি ব্যাথা পেলে আমারও তো কষ্ট হয়।

অরুর কথায় ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো, শেষ কবে, কোথায়,কখন ওকে কেউ এভাবে বলেছে। ওর ক্ষত,ওর ব্যাথা এসব নিয়ে চিন্তা করেছে, ওকে একটু আপন করে আগলে ধরেছে, ক্রীতিকের মনে নেই, তাই বোধ হয় অরুই জীবনে প্রথম যে ক্রীতিককে অদৃশ্য মায়ার বাঁধনে বেধেছে। আজ ক্রীতিকের অশান্ত হৃদয়টা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলছে,

— এতো বছরের অপেক্ষা খুব একটা কষ্টের ছিলনা অরু, এখন তো সেসব শুধুই স্মৃতি মাত্র, আমার অরু এখন আমার বুকেই আছে, আর কক্ষনো কেউ এই দূরত্ব বাড়াতে পারবে না, তোর আমার মাঝে যদি কেউ দুঃসপ্নেও চলে আসে, তবে তারাও বাকিদের মতোই আমার আসল পৈচাশিক রূপটা স্ব চোখে দেখতে পাবে। অর মেইবি লাইফটাও দিয়ে দিতে হতে পারে হু নোজ?
*****************************************
ইজি চেয়ারের নরম গদিতে বসে বারবার গা দোলাচ্ছেন গভীর চিন্তাগ্রস্থ আজমেরী শেখ।মনেমনে কষছেন একের পর এক ছক। তার ছোট মেয়েকে যে জায়ান ক্রীতিক নিয়ে গিয়েছে তা বুঝতে বাকি নেই সুকৌশলি মস্তিষ্কের আজমেরী শেখের। তার এতো কড়া শাসন, এতোটা তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, এতোটা দাম্ভিকতা সবকিছুকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে গেলো তারই সৎ ছেলে। যে সবসময় আজমেরী শেখের সাথে টেক্কা দিয়ে চলতে পছন্দ করে, কিন্তু আজমেরী নিজেও তো চুপচাপ বসে থাকার মানুষ নয়, কৌশলে কিভাবে চেক মেট দিতে হয় সেটা তারও জানা।
তাছাড়া সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো মান সম্মান, জায়ান ক্রীতিকের মতো বে’য়াদব, বেহায়া ছেলে যে সমাজের ধার ধারে না কোনোকালেই তার দ্বারা সবই সম্ভব, নিজের সৎ বোনকে বিয়ে করাও সম্ভব।
কিন্তু আজমেরী শেখের চরিত্র পুরোপুরি ক্রীতিকের বিপরীত,সে সব কিছুতে সবার আগে সমাজকে প্রাধান্য দেয়, সে মতোই প্রতিটা কাজ করে ,ওই জন্যই হয়তো তাদের মাঝে এই দীর্ঘ স্নায়ুযুদ্ধ।

—আমেরিকায় তোমাদের রেজিষ্ট্রি হয়েছে, বাংলাদেশে তো নয়। এখন আমিও যদি তোমার মতো কৌশলে চালি তাহলে কি করবে তুমি জায়ান ক্রীতিক চৌধুরী?

বেশ অনেকক্ষন ধরে ভাবতে ভাবতে কিঞ্চিৎ ক্রুর হেসে বিড়বিড়ালেন আজমেরী শেখ।
*****************************************
চলবে……

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#পর্বঃ৩৪
#লেখনীতে_suraiya_rafa
[ক’পি করা নিষিদ্ধ 🚫]
[কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য ]

আকাশে শুক্লপক্ষের মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে, তার চারিপাশে তারকারাজির নির্ভীক অবস্থান। মিটিমিটি জ্বলন্ত তারকারাজি আর চাঁদের রূপোলী আলোয় ভেসে যাচ্ছে নির্জন পাহাড়ি শহরতলীর রাস্তাঘাট।
ভোরের দিকে সেই যে একপশলা ঝুম বৃষ্টি হলো, তারপর থেকেই আকাশ পরিস্কার। রাতের আকাশে পেজা তুলোর মতো উড়ো মেঘের আড়ালে ক্ষনে ক্ষনে গা ঢাকা দিচ্ছে শুক্লপক্ষের সুন্দরী চাঁদ। তাই জোস্ন্যা রাতের নিয়ন আলো ছাপিয়ে একটু একটু আলোছায়া এসে খেলা করছে পর্দা সরিয়ে রাখা অত্যাধুনিক মাস্টার বেড রুমের আনাচে কানাচে ।

অরু আজ সন্ধ্যা হতে না হতেই রুমের সবকটা আলো নিভিয়ে পারি দিয়েছে ঘুমের দেশে , যদিও বা ক্রীতিক মুখে অনেক কিছুই বলেছিল, তবে কার্যত অনলাইনে অরুর সবরকম প্রয়োজনীয় জিনিস অর্ডার করে দিয়েছে সে। কারণ আর যাই হোক অরুকে কোনোরূপ অসস্থিতে দেখতে চায়না ক্রীতিক,তাও ওর নিজের বাড়িতে বসে।

এই যেমন আজ সারাদিন অরুর ভীষণ মন খারাপ ছিল। ক্রীতিকের ভ’য়ে বেচারি বলতেও পারছিল না যে, ও আপা আর মাকে মিস করছে।দুদিন ধরে অরু নেই,তারা কি করছে, কেমন আছে, আদৌও অরুকে খুজছে কিনা সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অরু। সেদিন হৃদ মাঝারে সদ্য গজিয়ে ওঠা প্রনয়ের টানে ক্রীতিকের সঙ্গে চলে এলেও, এখন মা আর আপার কথা মনে পরতেই হৃদয় খামচে ওঠে অরুর। বুকের মাঝে দানাবাঁধে কষ্টরা,সেই কষ্ট প্রতিফলিত হয় ওর চোখে মুখে।
অরুর চুপসে থাকা মলিন মুখ দেখে কিছুটা হলেও ঘটনা আঁচ করতে পারে ক্রীতিক, কিন্তু ওর ও তো কিছু করার নেই, অরুকে যেতে দেওয়া, কিংবা ভুলে যাওয়া, দুটোই পুরোপুরি অসম্ভব ক্রীতিকের পক্ষে। কারন ক্রীতিক ভালো করেই জানে অরুকে যেতে দিলে ও নিজেই বাঁচবে না।তবে ক্রীতিক তো ভারী কঠিন হৃদয়ের মানুষ, তাই নিজের দূর্বলতাটুকু পুরোপুরি আড়াল করে, একটা টিভি আনিয়ে সেটাকে সেট করে দিয়েছে হলরুমের মাঝ বরাবর, নিজের গেমিং মনিটরের পাশেই। এতো বড় টিভি দেখে অরু যখন শুধালো,
— এটা কেন এনেছেন?

তখন জবাবে ক্রীতিক বলে,
— বউয়ের আঁচল ধরে বসে থাকার মতো টাইম আমার নেই,তাই সময় কাটানোর জন্য এনে দিয়েছি, আমি যখন না থাকবো তখন বসে বসে নেটফ্লিক্স দেখবি।

ক্রীতিকের গমগমে রুষ্ট কথায় মেজাজ খিটখিটিয়ে উঠলো অরুর, তবে এখন পর্যন্ত ঝাজিয়ে তেঁতো গলায় কথা বলার সাহস ওর হয়ে ওঠেনি, তাই অরু সহসাই স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—- সময়ই যখন নেই,তাহলে অমন মাঝরাতে রাস্তা থেকে নিয়ে এলেন কেন?

ক্রীতিক রিমোট কন্ট্রোলটা ভালোমতো চেক করতে করতে জবাব দেয়,
—- থাকতে পারছিলাম না তাই,তোকে দেখতে ইচ্ছে করলে হাজারটা ব্যস্ততাকেও পায়ে ঠেলে দিতে পারি আমি। তাই আমার ফিলিংস নিয়ে এতো ভাবতে হবে না তোর। নিজে কেন বাংলার পাঁচের মতো মুখ বানিয়ে রেখেছিস সেটা নিয়ে ভাব।

অরু আর জবাব দিলোনা, ক্রীতিকের সাথে বেহুদা তর্ক করার এনার্জি নেই ওর,মনটা বিষিয়ে আছে সেই সকাল থেকেই, তাই কথা না বাড়িয়ে গটগট করে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতলায় চলে গেলো অরু। দোতলায় গিয়ে ক্রীতিকের রুমের দিকে আর পা বাড়ালো না ও, বরং উল্টো ঘুরে বিপরীত পার্শে ওর আর অনুর জন্য বরাদ্দ কৃত সেই আগের রুমটায় প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই নিঃশব্দে তলিয়ে গেলো ঘুমের দেশে।
.
অরু অন্যরুমে গিয়ে শুয়েছে ব্যাপারটা নজরে আসতেই, ক্রীতিকের তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠলো। অকস্মাৎ র’ক্ত টগবগিয়ে উঠলো ধমনীর শিরায় শিরায়, এমনিতেই অরুর বিষন্ন মুখ আর উদাসীনতায় ক্রীতিকের মেজাজটা বিগড়ে ছিল সারাদিন , তারউপর এখন আবার অরুর এমন কান্ড। ক্রীতিকের শক্তপোক্ত চওড়া বক্ষ ছাড়া অরু অন্যকোথাও মুখ দাবিয়ে ঘুমাবে সেটা বোধ হয় ক্রীতিক কল্পনাতেও ভাবতে চায়না,আর অরু কিনা একদিনের মাথায়ই অন্য রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো? কথাটা ভাবতেই ক্রোধটা তুঙ্গে উঠে এসেছে ওর। হঠাৎ বেড়ে ওঠা তীব্র ক্রোধটাকে কোনোমতে ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে,দু’আঙুলে নিজের গলাটা ঘষতে ঘষতে কিছু একটা ভাবলো ক্রীতিক। অতঃপর চট করেই উঠে চলে গেলো দোতলায় অরুর ঘরের দিকে ।
.
প্রকট আক্রোশ আর চরম বিরক্তি নিয়ে রুমের মাঝে পা বাড়াতেই, ঘুমন্ত অরুকে দেখা মাত্র পা দুটো সহসা ধীর হয়ে যায় ক্রীতিকের, সেই সাথে মস্তিষ্কের জ্বলন্ত ক্রোধে ভাটি পরে তৎক্ষনাৎ, রুমের পর্দাগুলো আলগোছে ঠেলে ধীর পায়ে, ঘুমন্ত নিষ্পল অরুর দিকে এগিয়ে আসে ক্রীতিক।

খানিকক্ষন সেই ঘুমন্ত মুখটা মনদিয়ে পরখ করে ওকে দু-হাতে তুলে নিয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরে যেতে যেতে হিসহিসিয়ে ক্রীতিক বলে,
— তোর ঘুম তোকে বাঁচিয়ে দিলো অরু, নয়তো আজ আমি তোর ঠিক কিই হাল করতাম সেটা নিজেও জানিনা। আজ তুই টের পেতিস জায়ান ক্রীতিকের রোমাঞ্চ আদতে কতটা মারাত্মক। যেটা সহ্য করতে পারবি না তার জন্য উইশ করিসনা হার্টবিট।কষ্টটা তোরই হবে।
***********************************************
অরু সন্ধ্যাবেলায় ঘুমিয়েছে, আর এখন রাতের শেষ প্রহর চলমান, ঘড়ির কাটায় ঠিক কয়টা বাজে জানা নেই অরুর, জানার অবশ্য কথাও নয়, ও তো ঘুমের ঘোরে বুদ হয়ে আছে এখনো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, অরুর মনে হচ্ছে কয়েকক্রোশ দূর থেকে ওকে কেউ গলা উঁচিয়ে ডাকছে, গলার আওয়াজ স্পষ্ট নয়, তাই অরু এবার ঘুমের ভ্রম কাটিয়ে একটু সচকিত হলো, অতঃপর খেয়াল করে শোনার চেষ্টা করলো সেই দূরের আওয়াজ। এবার চোখ বুজেই সুস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে এলো অরুর কানে, কয়েকক্রোশ দূর থেকে নয় বরং খুব কাছে, একেবারে কানের কাছে মুখ ঠেকিয়ে হাস্কিস্বরে ডাকছে ক্রীতিক,
— আমার ঘুম পরী উঠে পরো।

ক্রীতিকের তপ্ত নিঃশ্বাস, আর আলতো ঠোঁটের পরশ ক্রমশই কানে গলায় এসে স্পর্শ করছে ওর,ক্রীতিকের এহেন নেশা ধরানো স্পর্শে অগত্যাই ঘুম ছুটে গেলো অরুর। ও চট করেই চোখ দুটো খুলে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
—- কি বললেন? আবার বলুন।

ক্রীতিক উঠে দাড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
—- বলেছি অনেক ঘুম হয়েছে, এবার উঠে পর,বের হবো আমরা।

অরুর স্পষ্ট মনে আছে, ক্রীতিক বেশ নরম গলায়, আদুরে ভাষায় সম্মোধন করেছিল ওকে,অথচ এখন তার পুরোপুরি বিপরীত, তবে এসবের বাইরেও যেই প্রশ্নটা সবার আগে অরুর মস্তিষ্কে গিয়ে ঠেকলো সেটা হলো,
—- এই ভোর রাতে কোথায় যাবেন উনি?

অরুকে ভাবতে দেখে ক্রীতিক বললো,
— এখন আবার দিবাস্বপ্ন দেখা শুরু করলি নাকি?

অরু শোয়া ছেড়ে উঠে বসে শুধালো,
— এতো রাতে কোথায় যাবো?

ক্রীতিক অরুকে বাচ্চাদের মতো কোলে তুলে নিয়ে বাইরের দিকে এগোতে এগোতে বললো,
—- আমি যেখানে নিয়ে যাবো, যেদিকে নিয়ে যাবো, যে দেশে নিয়ে যাবো, ইভেন ম’রতে নিয়ে গেলেও, সেখানেই চুপচাপ যাবি তুই ,উইথ আউট এনি কোশ্চেন অর এনি ডাউট ।

অরু নিজের ঝীম ধরা ঘুমুঘুমু মাথাটা ক্রীতিকের কাঁধের উপর এলিয়ে দিয়ে মনেমনে বলে,
—- করবোনা, কখনো কোনো প্রশ্ন করবো না, যেখানে খুশি নিয়ে যাও শুধু এভাবেই নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখো,আমি চোখ বন্ধ করে অনুসরণ করবো তোমায়,ইভেন উইথ আউট এনি কোশ্চেন অর এনি ডাউট।
***********************************************

হাইওয়ে রাস্তা ধরে হাওয়ার গতিতে ছুটে যাচ্ছে ইয়ামাহা খচিত গাঢ় নীল রঙের বাইকটা, স্পিডোমিটারের গতি তখনও একশোর কাটা ছুঁই ছুঁই। অরু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ক্রীতিককে, ও জানেনা ক্রীতিক ওকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তারউপর ঘুমের রেস এখনো কাটেনি ভালোকরে, কি করেই বা কাটবে? ভোরের আলো ফুটতে এখনো ঢের বাকি। অগত্যাই নিজের টাল সামলানোর জন্য ক্রীতিকের পিঠে মাথা ঠেকিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে অরু। ওর পরনে এখনো ক্রীতিকের কালোরঙা টিশার্ট আর থ্রী কোয়ার্টার। ক্রীতিকের পরনেও একই রঙের কেলভিন ক্লাইন খচিত টিশার্ট। দেখে মনে হচ্ছে ওরা দুজন পরিকল্পনা করেই একই রকম কাপড় পরিধান করে বেরিয়েছে। যাকে বলে ম্যাচিং ম্যাচিং….

ঘন্টা খানেকের দূর্বার রাইডিং এর পর বাইক এসে থামলো একটা পাহাড়ি রিসোর্টের সামনে, সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় তার অবস্থান।অন্যদিক দিয়ে এলে সোজা রিসোর্টের গেইটে গাড়ি দাড় করানো যেত, অযথা এতোখানি ঘুরে এই পাহাড়ি রাস্তার ঢালে বাইক থামানোর কি মানে আছে জানেনা অরু। রিসোর্টে টাঙানো ল্যানটার্ন আর ফেইরী লাইটের কৃত্তিম আলোয় পাহাড়ের চূড়া থেকে শুরু করে আঁকাবাকা রাস্তা অবধি যতদূর চোখ যায় সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। অরু চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ক্রীতিককে শুধালো,
—- এখানে কেন নিয়ে এলেন? এখান থেকে হেটে হেঁটে সিঁড়ি ডিঙিয়ে অতো উপরে উঠতে গেলে জান বেরিয়ে যাবে। আমি পারবো না।

ক্রীতিক নিজের হেলমেট খুলে বাকেট হ্যাট টা পরে নিয়ে তীক্ষ্ণ আওয়াজে বললো,
—- তোকে উঠতে বলেছি আমি?

অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—- তাহলে?

ক্রীতিক আর জবাব দিলো না অরুর প্রশ্নের, বরং এগিয়ে এসে অরুকে কোলে নিয়েই, একে একে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলো পাহাড়ের চূড়ায়,
ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরুর চোখ কপালে উঠে গিয়েছে,সেই সাথে শুকিয়ে গিয়েছে গলার তরল টুকুও, নিজের শক্ত হাতে ক্রীতিকের গলা জড়িয়ে ধরে, জিভ দিয়ে অধর ভিজিয়ে কম্পিত কন্ঠে অরু বলে,
—- এভাবে কোলে নিয়ে অতো উপরে ওঠা টা রিস্ক হয়ে যাচ্ছেনা? না মানে এধারওধার হলে যদি কিছু হয়ে….

ক্রীতিক অরুর দিকে না চেয়েই পা চালাতে চালাতে জবাব দিলো,
—- ম’রলে দুজন একসাথে ম’রবো, আর কোনো আপসোস থাকবে না,সেটাই ভালো নয় কি?

—- কিন্তু আপনার তো আমাকে নিয়ে উঠতে কষ্ট হচ্ছে।

ক্রীতিক অরুকে একঝলক দেখে নিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বললো,
—- আমি একবারও বলেছি তোকে কোলে নিয়ে উপরে উঠতে আমার কষ্ট হচ্ছে?

ক্রীতিকের কথায় অরু না সূচক মাথা নাড়ালে ক্রীতিক পুনরায় বলে,
—- তাহলে বেশি বোঝা বন্ধ কর নয়তো মা’র খাবি।

ক্রীতিকের এহেন কথায় অভিমান হলো অরুর, আগে সম্পর্ক যা-ই ছিলো মানা যায়,কিন্তু এখন তো স্বামী হয়ে গিয়েছে,এখনও কিনা ক্রীতিক মা’রতে চায় ওকে?ব্যপারটা বেশ অ’পমান জনক আর লজ্জার ।স্বাভাবিক ভাবে অরুরও খারাপ লেগেছে,তাই দরদ দেখানোর সকল ইচ্ছেকে জলাঞ্জলি দিয়ে আর একটাও কথা না বাড়িয়ে, চুপচাপ হয়ে ক্রীতিকের কোলেই বসে রইলো অরু।

ক্রীতিক যখন পাহাড়ের চূড়ায় এসে অরুকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, রিসোর্টের আবছা আলোয় অরু চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যায়গাটা সংরক্ষিত, কিন্তু আপাতত কোনো মানুষের আনাগোনা নেই এখানে, পেছনে অবস্থিত সফেদরঙা কটেজ গুলোর ব্যাক ইয়ার্ডটা বেশ সুন্দর এবং সুসজ্জিত। আর সামনে রয়েছে বিস্তৃত খোলা আকাশ, অরু যেখানে দাড়িয়ে আছে সেখান থেকে কয়েক কদম এগোলেই গভীর খাদ। সেদিকে ভুলক্রমে উঁকি দিলেও পিলে চমকে ওঠে অরুর, শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় শীতল ঠান্ডা স্রোত। অথচ সেখানে গিয়েই পা দুলিয়ে বসেছে ক্রীতিক,বসে থেকেই আঙুলের ইশারায় ডাকলো অরুকে।
ক্রীতিকের ইশারা বুঝতে পেরে অরু,না সূচক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- আমি ওখানে যাবোনা, আমার ভ’য় করছে,তাছাড়া নিচের দিকে তাকালেই আমার কেমন গা গুলিয়ে ওঠে।

ক্রীতিক খানিকটা দূরে দাড়িয়ে থাকা অরুকে আশ্চর্য কন্ঠে শুধালো,
—– আমি থাকতে ভ’য় কিসের তোর?

ক্রীতিকের এই একটা বাক্যই যথেষ্ট ছিল অরুর আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার জন্য। অরু জানে, জায়ান ক্রীতিক বেঁচে থাকতে ওর শরীরে বিপ’দের সুক্ষ্ম আঁচ ও লাগতে দেবেনা সে, অবশেষে সেই বিশ্বাসের দৃঢ়তা থেকেই সহসা এগিয়ে গিয়ে সাবধানে ক্রীতিকের গা ঘেঁষে পাহাড়ের চূড়ায় বসে পরলো অরু। অরু বসার সঙ্গে সঙ্গে ওর কোলে মাথা এলিয়ে দিয়ে কচি ঘাসে আবৃত মাটির উপর শুয়ে পরে ক্রীতিক। ক্রীতিকের এহেন কান্ডে অরু ধরফরিয়ে উঠে বললো,
—- কি করছেন, খাদে পরে যাবেন তো?

অরু কথায় ক্রীতিক বাঁকা হাসিতে ঠোঁট প্রসস্থ করে, অতঃপর কোনো টু শব্দ না করেই, হাত উঁচিয়ে একটানে অরুর লম্বা চুলের গার্ডারটা খুলে নেয় নিজ হাতে। সঙ্গে সঙ্গে ঝরঝরিয়ে ক্রীতিকের শরীরে আঁচড়ে পরলো রেশমের মতো সিল্কি চুল গুলো। অরুর চুলগুলোকে নিজের বুকে যায়গা করে দিয়ে ক্রীতিক বললো,
—- খোলা চুলে তোকে বরাবরই এট্রাক্টিভ লাগে। আমি পাগল হয়ে যাই দেখলে।

ক্রীতিকের কথায় অরু ভ্রু কুঁচকালো, কি প্রশ্নে কি উত্তর দিলো এই লোক? নিজের বিরক্তিটুকু ঠোঁট কামড়ে সংবরণ করে অরু আবারও শুধালো,
—- কি বলছেন এসব?

ক্রীতিক অরুর হাতটা নিজের চুলের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো,
— হাত বুলিয়ে দে,ঘুমাবো আমি। কাল সারারাত ঘুমায়নি।

অরু কর্কষ আওয়াজে শুধালো ,
— কেন ঘুমাননি, নিষেধ করেছিলাম আমি?

ক্রীতিক চোখ দুটো বন্ধ করেই জবাব দিলো,
—- তোর জন্যই তো ঘুমাতে পারিনি, নিজের রূপ দেখিয়ে আমাকে সিডিউস করেছিস,তোর শা’স্তি হওয়া উচিৎ।

—- বা-রে আপনি বুঝি আমাকে খুব ঘুমাতে দিয়েছেন? গাড়ির মধ্যেই তো….

কথাটা শেষ করার আগেই নিজের জিভে লাগাম টানলো অরু, কথায় কথায় কিসব বলা শুরু করেছে টের পায়নি তখন, আর এখন নিজের লাগামহীন কথায় নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব, মনেমনে ভাবছে,
—- সব দোষ এই জায়ান ক্রীতিকের, ওনার সাথে দুদিন থেকেই ঠোঁট কা’টা হয়ে গিয়েছি আমি। ভবিষ্যতে যে আরও কত অভ্যেস জুটিয়ে ফেলবো তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এখন কি করি?অগত্যাই কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে অরু নরম স্বরে ক্রীতিককে বললো,

—- ঘুমাবেন যখন বাড়িতে ঘুমালেই তো পারতেন? কষ্ট করে এতো দূর রাইড করে আসার কি দরকার ছিল শুনি?

ক্রীতিক ঘুমু ঘুমু আওয়াজে জবাব দিলো,
—- কেন নিয়ে এসেছি সেটা একটু পরেই বুঝতে পারবি।
***********************************************
ক্রীতিক ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ, অরু আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ক্রীতিকের চুলের ভাঁজে, আর মনেমনে ভাবছে,
—- আগে আপনার চোখের দিকে তাকাতেও ভ’য় করতো আমার, মনে হতো এই বুঝি ভাসা ভাসা চোখ দুটো দিয়ে গিলে খাবেন আমাকে, অথচ এখন দেখুন, পুরো দুনিয়ার আড়ালে কতোটা আয়েশ করেই না ঘুমিয়ে আছেন আপনি আমার কোলে।আর আমাকে দেখুন কতোটা নিঃসংকোচে, কতোটা যত্ন করে আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কেনইবা দেবোনা বলুন, আপনাকে তো আমি ভালোবেসে ফেলেছি, আপনি কি তা জানেন?

অরুর মন গহীনের হাজারও সহজ সীকারোক্তি তখনই থেমে যায়, যখন ও দেখতে পায় চোখের সামনে বিস্তৃত আকাশে কুসুম রঙা সূর্য উদয় হচ্ছে। ভোর হয়েছে,প্রশান্ত মহাসাগরীয় হিমেল হাওয়ায় ছেয়ে যাচ্ছে শরীর,কর্ণকূহরে ভেসে আসছে পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ, আর চোখের সামনে পুরো আকাশ জুড়ে ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে একফালি র’ক্তিম সূর্য কীরন। কি অপরূপ দৃশ্য, এতোটা কাছ থেকে আগে কখনো সূর্যদয় দেখার সুযোগ হয়নি অরুর এটাই প্রথমবার, তাই নিজের ভেতরের চরম উৎকন্ঠাকে দমাতে না পেরে দু’হাতে ঘুমন্ত ক্রীতিকের চুল খামচে ধরে খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো ও।

হঠাৎ করেই চুলে বেশ জোরেশোরে টান পরায় অকস্মাৎ লাফিয়ে উঠে বসলো ক্রীতিক,চিৎকার রত অরুর দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
—- কি হয়েছে?

অরু খুশিতে টলোমলো চোখে আঙুল উঁচিয়ে সূর্যদয় দেখালো,ক্রীতিক এবার মৃদু হাই তুলে সেদিকে এক নজর তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে অরুর দিকে চাইলো, যে এই মূহুর্তে মুগ্ধনয়নে ধরনী জুড়ে সোনালী সূর্যের আগমন দেখছে।
আর ক্রীতিক দেখছে তার অরুকে, নিস্প্রভ চোখে অরুকে দেখতে দেখতেই ক্রীতিকের মন বলে,
—– আমার চাঁদ সূর্য দুটোই তোর মাঝে নিবদ্ধ অরু, তোর মাঝেই তারা উদীয়মান, আবার তোর মাঝেই তারা অস্তমান, আমি কেবল মুগ্ধ নয়নে দেখি আর ভাবি কি অপরূপ তারা।

গলে যাওয়া মোমের নিয়ন অগ্নিশিখায় তোকে প্রথমবার দেখেছিলাম আমি,সেটাই ছিল আমার দেখা সবচেয়ে অপরূপ দৃশ্য। প্রথম দেখাতেই তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছিলো হৃদয়টা,যে তৃষ্ণা আজও মেটেনি আমার, বরাবরই আমি সার্থপর,আর সার্থপরের মতোই তোকে অতিরিক্ত চাই। সেদিনের পর থেকে এক অষ্টাদশী ছাড়া আর কাউকে মনভরে দেখার ইচ্ছে জাগেনি কোনোকালেই, এ জীবনে আর কোনোদিন জাগবে বলে মনেও হয়না।

ক্রীতিক সেই তখন থেকে তাকিয়ে আছে দেখে অরু একটু ইতস্তত বনে গেলো,নিজের জামা কাপড় কোনোমতে ঠিকঠাক করে মিনমিনিয়ে শুধালো,
—- কি দেখছেন অমন করে?

অরুর প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
—- আমার সূর্যদয়।
***********************************************
টিন্ডেট কটেজের জানালা দিয়ে সূর্যদয়ের দৃশ্য স্পষ্ট, অরু কাচের জানালা দিয়ে এখনো সেদিকেই তাকিয়ে আছে।পুরো দৃশ্য উপভোগ করার আগেই ক্রীতিক টেনেটুনে কটেজে নিয়ে এসেছে ওকে, ভারী নির্দয় আচরণ, কিন্তু এই মূহুর্তে ঝগড়া করার মতো সময় নেই অরুর হাতে, ও পুরোটা দৃশ্য ঠিকঠাক ভাবে দেখতে চায়, তাই কটেজের জানালা দিয়েই আপাতত উপভোগ করছে সাদামাটা সূর্যদয়।
কিন্তু এই মূহুর্তে বোধ হয় সেটাও সহ্য হলোনা নির্দয় ক্রীতিকের, ও কোনোরূপ আওয়াজ না করেই এগিয়ে এসে হাট করে লাগিয়ে দিলো জানালাটা। এবার বিরক্তিতে চিড়বিড়িয়ে ওঠে অরু। নিজের রাগটাকে কোনোভাবেই দমাতে না পেরে তেঁতো গলায় ক্রীতিককে বলে,
— কি সমস্যা?

অরুর কাঁধের উপর নিজের চিবুক ঠেকিয়ে, ক্রীতিক হিসহিসিয়ে জবাব দেয় ,
—– আমার এই টি শার্টটা তোর পরনে বি’শ্রী লাগছে অরু, খুলে ফেলি?

ক্রীতিকের কথায় অরুর গলা শুকিয়ে এলো, ঠান্ডার মাঝেও হাতের তালু ভিজে উঠলো তপ্ত ঘামে।লজ্জায় কথা আটকে আসছে,তবুও নিজের মধ্যে একটু মেকি গাম্ভীর্য ধরে রেখে কথা ছো’ড়ে অরু ,
—–ককেন?আপনিই তো কাল বললেন যে, আপনার জামা কাপড়ে আমাকে মারাত্মক লাগে।
ক্রীতিক নিজের বলিষ্ঠ হাতে অরুর পরনের টি শার্টটা টেনে খুলতে খুলতেই হাস্কিস্বরে বললো,
—- কাল পরার পরে মারাত্মক লেগেছে, আর আজ খোলার পরে, ডিপেন্ডস অন মাই মুড বেইবি।
***********************************************
একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ চারদিনের মাথায় আবারও সানফ্রান্সিসকো ফিরে যাচ্ছে অরু। ক্রীতিক নিজেই ড্রাইভ করে এগিয়ে দিয়ে আসছে ওকে। ওদিকে মনের মাঝে একরাশ ভয় আর দ্বিধা আকরে ধরে আছে অরুকে,মা আর আপার মুখোমুখি হলে ঠিক কি রকম লঙ্কাকাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে তারা, তা একমাত্র উপরওয়ালাই ভালো জানে।
কিন্তু পাশে বসা ক্রীতিকের গম্ভীর মুখটা দেখে আপাতত সেসব ভাবতে ইচ্ছে হলোনা অরুর, গত দু’ঘন্টার পিনপতন নীরবতা ভে’ঙে কোনোমতে হৃদয়ে সাহস সঞ্চার করে অরু ক্রীতিককে শুধালো,
—- কবে ফিরবেন?

ক্রীতিক স্টিয়ারিং এ হাত চালাতে চালাতে জবাব দিলো,
—- খুব শীঘ্রই।

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে আবারও শুধালো,
—–আপনি একাই যাচ্ছেন?

—– না প্রত্যয় ও সাথে যাচ্ছে।

অরু মুখ কাচুমাচু করে বললো,
—- আমাকে নিয়ে গেলে হতোনা?

ক্রীতিক অরুদের ভবনের সামনে এসে অকস্মাৎ ব্রেক কষে বললো,
— তোকে নিয়ে যেতে পারলে আমার চেয়ে খুশি আর বোধহয় কেউ হতো না অরু, কিন্তু সেটা সম্ভব নয় মিডিয়ার ধারে কাছেও তোকে আমি এলাউ করবো না।

অরু অগত্যাই হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে শুকনো মুখে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ক্রীতিকও নামলো ওর সাথে সাথে, ক্রীতিককে নেমে আসতে দেখে অরু শুধালো,
—- আবার নামতে গেলেন কেন? আপনার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে তো।

ক্রীতিক স্ব পকেটে হাত গুঁজে,অন্যহাতে অরুর ঘাড় টেনে নিজের দিকে নিয়ে এসে কাতর কন্ঠে বললো,
—- একবার তুমি করে ডাক, তারপরেই চলে যাচ্ছি।

ক্রীতিকের কথায় অরু শুষ্ক ঢোক গিলে ওর গলাটা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো,
—- ফিরে আসুন তারপর সব আবদার মেটাবো প্রমিস।

ক্রীতিক ব্যাথাতুর হাসলো, অতঃপর ক্রোধিত সুরে বললো,
—- তোর মাকে ম্যানেজ করা না করা একান্তই তোর ব্যাপার,বাট আমি ফিরে এলে আমার সাথে আমার বাড়িতে ফিরবি দ্যাটস মাই অর্ডার।

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়ায়,ওকে আসস্থ করে বলে,
— বুঝেছি এখন যান।

কথা শেষ করে সামনের দিকে এগিয়ে যায় অরু, ক্রীতিক এখনো সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে, এতোক্ষণ ধরে নাকের আসেপাশে মো মো করতে থাকা বুনোফুলের মেয়েলী সুঘ্রাণটা অরু যাওয়ার সাথে সাথে কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।
অরুর হঠাৎ দূরত্বে ক্রীতিকের কেমন দম আটকে আসছে, ব্যাথায় ভরে উঠেছে হৃদয়টা।নিজের অজান্তেই হাত চলে গিয়েছে বুকের বা পাশে, আজ এই মূহুর্তে জীবনে প্রথমবার ক্রীতিক অনুভব করলো ওর হার্টবিট ফে’ইল করছে, ক্রমশ হৃদস্পন্দন গতি হারাচ্ছে, অরুর প্রতি এট্রাকশন তো নতুন কিছু নয়, তাহলে নতুন করে এই সুপ্ত অনুভূতি কোথা থেকে উদয় হলো? ক্রীতিক চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো,তার পরক্ষনেই গলা উঁচিয়ে স্পষ্ট আওয়াজে বলে উঠলো,

—- অরু আই লাভ ইউ।

ক্রীতিকের বলা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কয়েকটা শব্দে পা দুটো অকস্মাৎ থমকে গেলো অরুর, সামনে পা বাড়ানোর শক্তি নেই আর,পুরো শরীর মন ছেয়ে গিয়েছে অজানা বৈ’দ্যুতিক শিহরনে, হৃদয়ের কানায় কানায় টইটম্বুর হয়ে উপচে পরা অনুভূতির জোয়ার, গলায় আটকে আছে তীব্র কা’ন্নার রেশ। ও আর এভাবে দাড়িয়ে থাকতে পারলো না একমুহূর্তও ,তৎক্ষনাৎ দৌড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পরলো ক্রীতিকের বুকে,একবার, দুইবার, তিনবার ক্রীতিকের আঙুলে চাপ দিয়ে কিছু একটা সংকেত বোঝালো,অতঃপর গলা খাদে নামিয়ে রিনরিনে আওয়াজে বললো,

—- আমিও তোমাকে ভালোবাসি জায়ান ক্রীতিক, খুব ভালোবাসি।
চলবে…..