সঙ্গিন প্রনয়াসক্তি পর্ব-৫৭ এবং শেষ পর্ব ও সারপ্রাইজ পর্ব

0
20

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি 🍁🍁
#অন্তিম_পর্ব
#লেখনীতে_suraiya_rafa

(কপি করা নিষিদ্ধ 🚫)
(কঠোর ভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)

প্রায় তিন বছর পরে…….

ক্যালেন্ডারের পাতায় ডিসেম্বর মাস চলমান, পৃথিবীর সর্বত্র এখন শীত বুড়ির রাজত্ব। কৃত্রিম তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রক মেশিনে আবর্তিত ঘরের বাইরে পা রেখে, দু’দন্ড দাঁড়ালেই যেন তুষারে ঢেকে স্নো ম্যানে রূপান্তরিত হয়ে উঠবে সমস্ত শরীর,ঠিক এতোটাই ঠান্ডা পরেছে চারিদিকে।

ক্যালিফোর্নিয়াতে সাধারণত তুষার পাত হয়না খুব একটা, কিন্তু এবছর বিভিন্ন যায়গায় স্নো ফলের খবর পাওয়া যাচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়ার যে যে স্টেট গুলোতে এ বছর স্নো ফল হয়েছে, ক্রীতিকের শহরতলীও তার অন্তর্ভুক্ত এরিয়া। পুরো শীতের অনেকটা সময় ধরে দিনরাত তুষার পাত দেখে দেখে ওদের সময়গুলো উড়ন্ত মেঘের মতোই মসৃণতায় ভেসে গিয়েছে কোথাও। জীবনটাকে মনে হয়েছে তুষারের মতোই শুভ্র আর সহজ। হাত লাগাতেই কেমন পেজা তুলোর মতো গলে যায় সব।

ঠিক তেমনই তুষারে ঢাকা মসৃণ দিনগুলোকে পেছনে ফেলে আজকের সকালটা শুরু হয়েছে তীক্ষ্ণ সূর্য কীরনের এক ছটাক সোনালী আলোক রশ্মির আগমনে।

বাংলাদেশ আজ রোদ্রজ্জল, ইট পাথরে ঢাকা শহুরে বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে সেই উজ্জ্বল টুকরো টুকরো রোদের ছটা আঁচড়ে পরছে যত্রতত্র। বহুদিন বাদে চোখের সামনে আজ এই সূর্যালোক বড়’ই আনন্দিত করলো অরুকে। আলো ছায়ার সুন্দর সমীকরণ দেখতে দেখতেই এক টুকরো প্রশান্তির হাসিতে প্রসারিত হলো তার দু’ঠোঁট। আলোগোছে চোখ দুটো বুঁজে বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে অস্ফুটে বিড়বিড়ালো সে,

—- আহ, আমার দেশ।

***********************************
“সাইনিং ইভেন্ট ২০২৭।অথর, অরোরা জায়ান চৌধুরী। ”

মাঝারি সাইজের হলরুমটার স্টেজ বরাবর উপরিভাগের বোর্ডে ঝুলছে লেখাগুলো। স্টেজের সামনেই বসে আছে কিছুসংখ্যক পাঠক পাঠিকা।তাদের সবার হাতে একটা করে পুরু বই। বইগুলোর কভার পেজ দেখে মনে হচ্ছে কোন থ্রীলার রোমান্টিক জনরার উপন্যাস হবে হয়তো। পুরোটা প্রচ্ছদে ফুটে উঠেছে রঙ তুলিতে ধারন করা জীবন্ত তুষার পাতের প্রতিচ্ছবি। তার মাঝেই ভীষণ ব্যাকুল দুজন কপোত-কপোতীর গভীর চাহনি। যেন একজন আরেকজনকে দেখে ভূবণ ভুলে গিয়েছে তারা। তার ঠিক উপরে রক্তরঞ্জিত বাংলা অক্ষরে লেখা,
“গোধূলি বেলার রোদ্দুর”

এমন তুষার পাতের দৃশ্য পটের মাঝে হঠাৎ গোধূলি বেলার রোদ্দুর কোথা থেকে এলো সেটা রহস্যই বৈকি।

পাঠক পাঠিকাদের একটা বিরাট অংশের তুমুল আকর্ষন কেড়ে নিয়েছে এই রহস্যময়ী প্রেমের উপন্যাস। তাইতো এ বছরের বেস্ট সেলের শীর্ষে রয়েছে নোবেলটি।

প্রথম উপন্যাসেই এতো ভালো সারা পেয়ে, পাঠক পাঠিকাদের সম্মানার্থে একটা সাইনিং ইভেন্ট না করলেই নয়, তাইতো ক্রীতিক কে হাজার বারবার বলে কয়ে, দেশে আসার জন্য রাজি করানো হয়েছে।যদিও এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ওর বন্ধু মহলের। অরুর কথা হলে তো এককান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতো সে।

সাইনিং ইভেন্টে আগত সমগ্র পাঠক পাঠিকাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে, স্টেজ থেকে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে একজন এ্যাংকর মতোন মহিলা ঘোষণা দিয়ে মঞ্চে ডাকলেন অরুকে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও তো অরু নেই। আমন্ত্রিত পাঠক পাঠিকারা এদিকে ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছে লিখিকাকে, কিন্তু দেখা নেই তার। ব্যাপারটা হতাশা জনক। লেখিকা মানুষ এইটুকুনি তো কমনসেন্স থাকা উচিত ছিল। পাবলিকেশনের এ্যাংকর মেয়েটা নিজেও হুট করে ঘোষণা দিয়ে বেশ বিব্রত বোধ করছেন সবার সামনে।

এমনই একটা সময় ঘোষনার প্রায় মিনিট পাঁচেক পরে, হলের মধ্যে প্রবেশ করে শাড়ি পরিহিত একজন রমনী। ছাই রঙা শীফনের শাড়িটার কুঁচি ঠিকঠাক করতে করতেই মেয়েটা উঠে এলো মঞ্চে। হাটু অবধি নেমে আসা লম্বা চুলগুলো আলগোছে কানের পাছে গুঁজে, এ্যাংকরের অনুমতি সাপেক্ষে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে মেয়েটি বলে ওঠে,
—- শুভ সকাল পাঠকবৃন্দ। এতোক্ষন যাবত অপেক্ষা করিয়ে আপনাদের মূল্যবান সময় করার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখীত আমি। আসলে বিলম্বটা ইচ্ছাকৃত নয়, আজ সকালের ফ্লাইটেই বাংলাদেশে এসেছি আমি, ফ্লাইট কিছুটা ডিলে হওয়ার দরুন এই বিলম্ব। তবুও নিজের অপরিনামদর্শীতার জন্য আমি ক্ষমাপার্থী। অনুগ্রহ করে ক্ষমা করবেন আমায়।

এই পর্যায়ে পাঠক পাঠিকাদের করতালির আওয়াজ শোনা গেলো, যার অর্থ তারা সকলে লিখিকার ক্ষমা প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন।
সকলের করতালির আওয়াজে মিষ্টি করে হাসলো লিখিকা, অতঃপর পুনরায় মাইক্রোফোনটা মুখের সামনে এনে বললো,
—- আমরা উপন্যাস নিয়ে কথা বলবো,এর চরিত্র গুলোর যথাযথ বিশ্লেষন করবো।তার আগে নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই,
আমি অরোরা জায়ান চৌধুরী। গ্রাজুয়েশন ফাইনাল ইয়ারে অধ্যয়নরত, সেই সাথে পারিবারিক কোম্পানিতেই ইন্টার্নশীপ করছি এ বছর। লেখালেখিটা আমার পেশা নয়, আর না তো আয়ের কোনো উৎস। শখ করে লেখি আমি, কারণ আমি কল্পনাবিলাশী। কলমের আঁচড়ে কল্পনাগুলোকে জীবন্ত ফুটিয়ে তুলতে পারলে আত্মতৃপ্তি পাই আমি। যেহেতু আমার মূল পেশা কিংবা পড়াশোনার অংশ সাহিত্য নয়, তাই একটা উপন্যাস বইয়ের পাতায় আনতে আমার তিনবছর লেগে গেলো। তবুও আমার এইটুকু ক্ষুদ্র জ্ঞানকে এতোটা সমাদর করার জন্য আমি আপনাদের সবার প্রতি কৃতার্থ পাঠকবৃন্দ। আ…

— আমার মেয়ে তখন থেকে কাঁদছে, আর তুই এখানে ভাষন দিচ্ছিস?

এর পরের বাক্যটা আর শেষ করতে পারলো না অরু, তার আগেই কোথা থেকে যেন একটা লম্বা মতো সুদর্শন যুবক উঠে এলো স্টেজে, তার কোলে দুই কি আড়াই বছরের একটা পিচ্চি মেয়ে বাবু, বাবুটার চোখ ছলছল করছে, চেরীর মতো কোমল মিষ্টি নিষ্পাপ অধর খানা উল্টে গিয়ে ঠেকেছে চিবুক বরাবর, দেখেই বোঝা যাচ্ছে এতোক্ষণ ধরে কান্নাকাটি করেছে সে।

মুখের সামনে মাইক্রোফোন থাকায়, হলে উপস্থিত সকলে শুনতে পেল তাদের লিখিকা মহোদয়াকে বাচ্চাকে কাঁদানোর অপ’রাধে বড়সড় ধমক দিয়েছে একজন লোক।ক্রীতিকের এহেন ঝাড়িতে অরু সামনে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসলো,অতঃপর ক্রীতিকের পানে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দু’হাত বাড়িয়ে কোলে নিলো মেয়েকে।

মায়ের উষ্ণ স্পর্শ পেতেই মেয়ে কা’ন্নাকাটি ভুলে আলতো করে মাথাটা এলিয়ে দিলো মায়ের বুকে। মেয়ে তার মাকে কাছে পেয়ে শান্ত হয়েছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো ক্রীতিক। মেয়েটাও হয়ে বাবার ফটোকপি, সে অরুকে ছাড়া কিছুই বোঝেনা। এদিকে ক্রীতিকের দুনিয়া তার একমাত্র মেয়ে, মেয়ের কোনো অসন্তোষ কিছুতেই বর্দাস্ত করে না সে।

অরু স্টেজে দাড়িয়েই কিছুক্ষণ মেয়েকে আদর দিলো,অতঃপর ক্রীতিকের দিকে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করে ঠোঁট উল্টাল, ক্রীতিক তাতে কোনোরূপ পাত্তা দিলোনা, উল্টো অরুর হাত টেনে ধরে ওকে স্টেজ থেকে নামাতে নামাতে বললো,
— হয়েছে আর ভাষন দিতে হবে না তোর, আমার মেয়ের খিদে পেয়েছে ওকে খাওয়াতে হবে, চল এক্ষুনি।

অরু করুন কন্ঠে বললো,
— তাই বলে এভাবে ইভেন্টের মাঝখানে চলে গেলে ওরা তো আমাকে জরিমানা করবে।

ক্রীতিক যেতে যেতে জবাব দেয়,
— করলে করুক, তোকে না এই মাসে স্যালারী দিয়েছি? সেখান থেকে দিয়ে দিবি।

অরু মুখ কালো করে বললো,
— আমার প্রথম স্যালারী ছিল ওটা।

—তাহলে আর কি জরিমানা না দিতে পেরে জেলে যাবি।

— তখন আপনার মেয়ের কি হবে?ও তো কাঁদবে।

অরুর কথায় থেমে গেলো ক্রীতিক,পেছনে ঘুরে নিজের ঘুমন্ত মেয়ের দিকে নিস্প্রভ চোখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এটা তার সত্তা, তারই অংশ, ভাবলেই ভেতরটা কেমন গলে যায়। মায়ার জোয়ারে ফুলেফেঁপে ওঠে হৃদয়টা, ক্রীতিকের জীবনে এখন দুইটা মেয়ে, যাদের কাছে ও ভীষণ অসহায় আর ভীষন কৃতজ্ঞ। এদের ছাড়া যে ওর দুনিয়া অচল।আর এই বাচ্চা মেয়েটা ওর সব সবকিছু, এই মেয়ের জন্য জীবনটা দিয়ে দিতেও বোধ হয় দ্বিতীয়বার ভাববে না ক্রীতিক। ক্রীতিকের জীবনে কখনো নারীর টান ছিল না, আর না তো ও মেয়েদের খুব একটা পছন্দ করতো কোনো কালেই, ওই জন্যই হয়তো উপরওয়ালা ওকে দুজন ভালোবাসার মেয়ে উপহার দিয়েছেন, যারা এই মূহুর্তে ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে,

— কি হলো, কি ভাবছো?

আজকাল অরু, আপনি তুমি গুলিয়ে ফেলে। ব্যাপারটা দারুণ লাগে ক্রীতিকের, এই মূহুর্তেও সেই তুমি শুনেই ধ্যান ভঙ্গ হলো ওর। মেয়ের দিক থেকে নজর সরিয়ে অরুর কাছাকাছি এগিয়ে এসে ক্রীতিক বললো,
—- ঠিকাছে যা, আমার মেয়ের জন্য তোর জরিমানার টাকা মওকুফ। এখন চল, তোদের কে ক্রীতিক কুঞ্জে ড্রপ করে দিয়ে আমি একটু ফ্যাক্টরী ভিজিটে যাবো।

কথাশেষ করে অরু সমেত আবারও হনহনিয়ে হাটা দেয় ক্রীতিক। অরু পুনরায় ক্রীতিককে বাঁধা দিয়ে বললো,
— আস্তে হাঁটুন না, শাড়ি পড়ে আছি, বাবুকে নিয়ে পরে যাবো তো।

ক্রীতিক থামলো, এরপর দু’কদম পিছিয়ে অরুর কোমড় চেপে ধরে ওকে নিজ বাহুতে তুলে নিতে নিতে বললো,
— বেইবি, মেয়েকে শক্ত করে ধর।

ক্রীতিকের কান্ডে থতমত খেয়ে গেলো অরু, সামনেই হাইওয়ে, সবাই তাকিয়ে আছে,অথচ ক্রীতিকের তাতে কোনোরূপ হেলদোল নেই, সে মা মেয়েকে কোলে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে পার্কিংলটের দিকে। এমন একটা বিব্রতকর পরিস্থিতে পরে অরু দাঁত খিঁচিয়ে তেঁতো কন্ঠে ক্রীতিককে বললো,
—- কি হচ্ছে টা কি? সবাই দেখছে, ভুলে যাচ্ছেন কেন এটা আমেরিকা নয় বাংলাদেশ।

অরুর কথায় কর্ণপাত না করেই গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ক্রীতিক ধমকালো ওকে,
— শাট আপ, সবার দিকে কে নজর দিতে বলে তোকে? জাস্ট ফোকাস অন মি,এ্যান্ড মাই ডটার।

************************************************
—- গ্রাম্মা!

মেরীর রংমহলের সবচেয়ে কর্ণারে যে রকিং চেয়ারটা রয়েছে, সেখানেই বসে বসে বেশ মনোযোগ দিয়ে ফিলোসোফির একটা চমৎকার বই পড়ছিলেন আজমেরী শেখ। আজকাল অবসরের বেশিরভাগ সময়ই এখানে কাটান তিনি, একাই কাটান, নিজের পছন্দের বইগুলোর সাথে, আজমেরী শেখের মতে বইয়ের মাঝে অন্যরকম একটা সুঘ্রাণ রয়েছে, যা তাকে প্রশান্তি দেয়। আর নীরবে বসে একা একাই সেই বইয়ের সুঘ্রাণ বিশ্লেষণ করলে তো আর কথায়ই নেই। কিন্তু আজ সেই নীরবতায় বিঘ্ন ঘটিয়ে বই পড়ার মাঝখানেই মনোযোগ ক্ষুন্ন করে ভেসে এলো একটা ছোট্ট বাচ্চার আধো আধো গলার আওয়াজ।

আচানক সেই অযাচিত ডাকে পেছনে ঘুরলেন আজমেরী শেখ, দেখলেন,
তার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে, একটা ছোট্ট বার্বি ফর্ক পরিহিত বাচ্চা মেয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে, পায়ে তার আটকানো ভেলভেটের তৈরি লাল রঙা দুটো ব্যালেরিনা জুতো, পিঠ অবধি ছড়ানো রেশমের মতো হালকা বাদামী চুলগুলোকে সাবধানে হ্যালোকিটি হেডব্যান্ড দিয়ে আটকানো। ফর্সা তুলতুলে তার শরীরের গঠন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো আলালের ঘরের দুলালি হবে হয় তো। যার মাথার চুল থেকে থেকে পায়ের নখ অবধি ভীষণ যত্ন আদরে মোড়ানো। বাচ্চা মেয়েটার হাসিহাসি মুখ দেখে আজমেরী শেখের চোখে সবার আগে ভেসে উঠল জায়ান ক্রীতিকের রাগি চেহারাটা, কিন্তু মেয়েটা তো হাসছে, কি আশ্চর্য!

আজমেরী শেখ খুব একটা ভাবলেন না,বরং হাতের ইশারা করে কাছে ডাকলেন বাচ্চা মেয়েটাকে। আস্কারা পেয়ে মেয়েটা তৎক্ষনাৎ কুরকরিয়ে দৌড়ে এলে, তিনি হাতের বইটা সাইডে রেখে হাঁটু মুড়ে মেয়েটার মুখোমুখি বসলেন, অতঃপর নরম গলায় বাচ্চাটাকে শুধালেন,
— গ্র্যান্ড মা কাকে বলে, তা কি তুমি জানো?

অবুঝ শিশুটি উপুর নিচ মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে জানে, তারপর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পারদর্শীতা দেখিয়ে নিজেই উচ্ছ্বাসিত গলায় বলে উঠলো,
—- পাপা বলেচে গ্রাম্মা মানে দাদু নানু দুতোই।

আজমেরী শেখ বেশ অবাক হলেন, ভাবলেন এইটুকু মেয়ে ভালোই কথা জানে, তাই তিনি আরেকটু আগ বাড়িয়ে শিশুটিকে শুধালেন,
—- আমিই যে তোমার গ্র্যানি সেটা কে শেখালো তোমায়?

মেয়ে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
— পাপা।

আজমেরী শেখ ক্ষনে ক্ষনে আশ্চর্য হচ্ছেন আজ,ক্রীতিক তাহলে তার পরিচয় মেয়ের কাছে এভাবে তুলে ধরেছে? সারাজীবন তো দা কুমড়োর মতোই আচারন করে এসেছে, এই তিন বছরে চিকিৎসার জন্য বহুবার ইউ এস এ গিয়েছেন আজমেরী শেখ , সেখানে তিনি অনুর বাসায় থাকলেও, ক্রীতিকের বাড়ির রাস্তাও মাড়ান’নি কোনো কালে, আর না তো ক্রীতিক কখনো যেচে পড়ে নিজ বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাকে। অথচ সেই ক্রীতিকের মতো মানুষই কিনা নিজের মেয়েকে এরকম সুশিক্ষা দিয়ে বড় করছে? ব্যাপারটা কল্পনাতীত।

আজমেরী শেখ নিজের কানকে’ই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাচ্চা মেয়েটা তার গোলগোল ভাসমান চোখদুটো মেলে তাকিয়ে আছে আজমেরীর পানে, তাই তিনিও এবার নিজের ভ্রম থেকে বেরিয়ে এসে পিচ্চিকে জিজ্ঞেস করলেন,
— তোমার নাম কি বাচ্চা ?

মেয়েটা যেন কথা বলতে খুব আগ্রহী, তেমন করেই চনমনিয়ে উত্তর দিলো সে,
— কিয়ালা জায়ান চৌদুলী।

যতদূর বোঝা গেলো ওর নাম কিয়ারা, যা শুনে বিস্মিত আজমেরী শেখের মাথায় খেলে গেলো আরেকটা নাম, কিয়ারা রোজারিও। তিনি নিজ মনের আগত প্রশ্নগুলোকে আবারও বাচ্চা মেয়েটার নিকট উগড়ে দেবেন, তার আগেই কিয়ারাকে ডাকতে ডাকতে দরজায় এসে হাজির হলো অরু।

—- কিয়ারা, মামুনি তুমি কোথায়?

চোখের সামনে অরুকে দেখতে পেয়ে উঠে দাড়ালেন আজমেরী শেখ, মনের মধ্যে দানাবাঁধা অন্য সকল প্রশ্নকে বাদ দিয়ে, অস্ফুটেই তিনি মেয়েকে শুধালেন,
—- ওর নাম কিয়ারা?

অরু হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।

—- কে রেখেছে এই নাম?
আবারও শুধালেন আজমেরী।

অরু মেয়ের লম্বা চুলগুলো রাবার ব্যান্ডের সাহায্যে উপরে তুলে বেধে দিতে দিতে বললো,
—- ওর পাপা।

আজমেরী শেখ অমায়িক হাসলেন, জানালেন,
— ভারী মিষ্টি হয়েছে তোমার মেয়ে, পুরোই বাবার ফটোকপি।

মায়ের কথা শুনে আশ্চর্য বনে গেলো অরু, কিছুটা কৌতুহল নিয়েই বলে উঠলো,
—- ও ওর পাপার মতো দেখতে হয়েছে, আর তুমি কিনা ওকে মিষ্টি বলছো মা? কিন্তু তুমিতো ওর পাপাকে খুব অপছন্দ করো, এক কথায় দেখতেই পারোনা।

অরুর কথা শুনে হাটিহাটি পা পা করে এগিয়ে গিয়ে ডিভানে বসলেন আজমেরী, চোখের সামনে প্রসস্থ দেওয়ালে ফ্রেমবন্ধী হয়ে আছে তার যৌবন কালের আটপৌরে একখানা ছবি। সেদিকে একধ্যানে পরখ করতে করতেই কিছু মনে করার মতো করে আজমেরী বলে ওঠেন,
—– আমি আসলে জায়ান ক্রীতিককে নয়, তোমার প্রতি তার মাত্রাতিরিক্ত আসক্তিকে অপছন্দ করি অরু। এখন হয়তো কারনটা জিজ্ঞেস করবে কেন করি, তাইনা?

অরু হ্যা না কিছুই বললো না, শুধু প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো মায়ের পানে।

আজমেরী শেখ পুনরায় বললেন,
—- তোমাদের বাবার স্বভাব চরিত্র খানিকটা ক্রীতিকের মতোই ছিল, ক্রীতিক যেমন তোমার প্রতি ভীষণ ভাবে আসক্ত, ইশতিয়াক ও আমার প্রতি আসক্ত ছিল। ওর আসক্তি গুলো ছিল ভ’য়ানক। কিন্তু আমি সেই আসক্তির মাঝেই তীব্র সুখ অনুভব করতাম, মনে হতো এমন একজন মানুষ জীবনে থাকলে আর কি চাই? সেই মুগ্ধতার জের ধরেই ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম তোমার বাবাকে। কিন্তু বিয়ের কিছু বছর যেতেই লোকটার মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা অসুস্থ ভালোবাসায় পরিনত হতে থাকে, কেউ আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেও দিন দুপুরে তাকে কঠিন শা’স্তি দিতো তোমার বাবা, ছেলে বন্ধু তো দূরের থাক আমার মেয়ে বান্ধবীদের পর্যন্ত আমার হাত ধরার অপ’রাধে হাতের রগ কে’টে দিতো সে। তারপর বাড়িতে এসে চোটপাট মা’রামারি অশা’ন্তি তো ছিল প্রতিদিনের রুটিন।

আমি যদি তাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইতাম,তো সে আমার সামনেই নিজেকে এমন ভাবে আঘা’ত করতো যা দেখে আত্মা শিউরে উঠতো আমার, বারবার ক্ষমা করে দিতাম এই ভেবে যে মানুষটা আমার জন্য পা’গল, আমাকে ভালোবেসে পা’গল। কিন্তু না, দিনকে দিন তার অসুস্থ ভালোবাসায় হাঁপিয়ে উঠছিলাম আমি, কারণ সময়ের সাথে সাথে লোকটা আরও বেশি ভয়’ঙ্কর হয়ে উঠলো,বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে আগে যাদের শুধু শা’স্তি দিয়ে ক্ষান্ত হতো, তাদের এবার কৌশলে হ’ত্যা করতে শুরু করলো সে। আর কি বিভৎস তার খু’নের ধরন তা ভাবতেও পারবে না তুমি।

কথার এই পর্যায়ে এসে চোখ মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে ফেললেন আজমেরী। কিছুটা সময় নিলেন নিজেকে শান্ত করার জন্য, অতঃপর চোখ খুলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
—- তখনই বুঝেছিলাম লোকটা আসলে সাধারণ মস্তিষ্কের কোনো স্বাভাবিক মানুষই নয়, সে সাইকোপ্যাথ।

— কিন্তু জায়ান তো সাইকোপ্যাথ নয় মা।

অরুর কথায় ওর পানে দৃষ্টি নিক্ষেপন করলেন আজমেরী। অরু এগিয়ে এসে মায়ের পাশের ডিভানে বসতে বসতে, শান্ত স্বরে বললো,
— জায়ান ক্রীতিক প্রচন্ড রাগি, বদমেজাজি, বেপরোয়া,চরম উগ্র, কিন্তু সে সাইকোপ্যাথ নয় মা। নিজের কন্ট্রোললেস রাগটুকুর বাইরে গিয়ে আমাদের মা মেয়েকে ভীষণ যত্ন সহকারে আগলে রাখতে জানে জায়ান। নিজের দু’বছরের মেয়ের প্রতি তার কতটা অগাধ মায়া,চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না তুমি।

অরুর কথায় আজমেরী মৃদু হাসলেন, ওর গালে আলতো হাত ছুয়িয়ে তিনি বললেন,
—- তাতো দেখতেই পাচ্ছি, তোমার আর তোমার মেয়ের খুশিই বলে দেয় তোমরা আদতে কতটা সুখে আছো। জায়ান ক্রীতিক তোমাদের কতটা ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছে।

**************************************
আজ প্রায় মাস তিনেক হলো ফাইনাল সেমিস্টার পরীক্ষা দিতে ছোট্ট নিনিত কে নিয়ে দেশে এসেছে নীলিমা। ওদিকে বউ ছেলের শোকে বেশিদিন একা একা থাকতে না পেরে আজ ক্রীতিকদের সাথে একই ফ্লাইটে বাংলাদেশে উড়ে এসেছে সায়র ও।গন্তব্য পুরান ঢাকার চিপাগলি, অবশ্য এছাড়া উপায় কি? পুরান ঢাকার চিপাগলি নিবাসী শ্যামলতা মেয়েটাকে যে বড্ড ভালোবাসে ও।

সায়র যখন নীলিমাদের দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালো, তখন দেখলো মা ছেলে দু’জনই অপেক্ষারত তার জন্য । ছাদে ওঠার সরু সিঁড়িতে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে তারা, এতোগুলা দিন পর বাবাকে দেখে উৎকন্ঠায় চেঁচিয়ে উঠলো ছোট্ট নিনিত, গালে হাত দিয়ে বসে বসে ঝিমুতে থাকা নীলিমাকে ঝাঁকিয়ে আলতো কন্ঠে বলে উঠলো,
— মাম্মাহ, পাপা!

ছেলের কথা শুনে নীলিমা সামনে তাকাতেই দেখলো তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সায়র। এতোগুলো দিন পর সায়রকে দেখতে পেয়ে ছেলেকে রেখেই একছুটে গিয়ে স্বামীর কোলে উঠে পরলো নীলিমা। অতঃপর ওর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো,
— উই মিসড ইউ সায়র।

— আই মিসড ইউ টু জান, কেমন আছো তুমি?

সায়রের গলায় মুখ লুকিয়ে নীলিমা বাচ্চাদের মতো এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললো,
—- ভালো নেই, তোমাকে ছাড়া আমি একটুও ভালো নেই।

প্রত্যুত্তরে মৃদু হেসে ওর পিঠে আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে সায়র বললো,
—- এইতো এসে গিয়েছি, এবার আর না নিয়ে ফিরছি না তোমাদের।

ওদিকে ছোট্ট নিনিত ছলছলে চোখে বাবা মায়ের প্রেমলীলা দেখতে দেখতে হাতদুটো উপরে বাড়িয়ে ঠোঁট উল্টে ভীষণ করুন সুরে বলে উঠলো,
—- পাপাহ কোলে।

*
গেইট দিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ক্রীতিকের নজরে এলো একটা ইয়ামাহা খচিত বাইক। ওর স্পষ্ট মনে আছে বছর তিনেক আগে দেশে ফিরে এই বাইকটা’ই প্রত্যয়ের সাহায্যে কিনেছিল ও। কিন্তু এটা তো গ্যারেজে পরে থেকে মরীচা ধরে যাওয়ার কথা, এখানে এনে কে রাখলো এটাকে? তাও একদম ঝকঝকে তকতকে পরিস্কার।

এককালে ক্রীতিকের অন্যতম আবেগ ছিল বাইক রাইডিং, বাইক মানেই ওর কাছে থ্রীল, এডভেঞ্চার, সবকিছু। যার দরুন এতোদিন পর চোখের সামনে বাইকটাকে দেখতে পেয়ে সেটাকে এদিক ওদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করতে লাগলো ক্রীতিক। ওদিকে সারাদিন পর পাপাকে দেখে, অন্দরমহল থেকেই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দৌড়ে বেরিয়ে এলো কিয়ারা। ক্রীতিকের কাছে এসে আধো আধো কন্ঠে ডাকলো সে,
— পাপা, অপিচ সেস?

মেয়ের আদুরে গলার আওয়াজ শুনে চোখ ঘোরালো ক্রীতিক, আসলে এটা কিয়ারার অভ্যেস, ক্রীতিক বাড়িতে এলেই ও এই প্রশ্নটা করে, কারন ওর মাম্মা বলে,
— তোমার পাপা অফিসে গিয়েছে।

ক্রীতিক হাঁটু ভেঙে বসলো মেয়ের মুখোমুখি হয়ে, অতঃপর আলতো হাতে ওর চুলগুলো ঠিকঠাক করে দিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
—- এখানে তো অনেক গরম পাপা, চুলগুলো কেন খুলে রেখেছো তুমি? তোমার মাম্মা কোথায়?

কিয়ারা বাচ্চা মানুষ, সে হাত দিয়ে পাপার শার্টের বোতাম নিয়ে খেলতে খেলতেই জবাব দিলো,
—- জানিনা।

মেয়ের কথায় তৎক্ষনাৎ কপাল কুঁচকে গেলো ক্রীতিকের,অরুর উপর মেজাজটা চড়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে দু চোয়াল, কতটা কেয়ারলেস হলে এতো বড় বাড়িতে বাচ্চা মেয়েটাকে একা ছেড়ে দিতে পারে মানুষ? সেই ভেবেই রাগ লাগছে ক্রীতিকের, ও তখনই কোনোকিছু না ভেবেই বাইরে থেকে গলা উঁচিয়ে ডাকলো অরুকে,
—- অরুউউ, অরুউউ!

ক্রীতিকের আওয়াজ পাওয়া মাত্রই অন্দরমহল থেকে ছুটে এলো অরু, ক্রীতিক অরুকে কিছু বলবে তার আগেই মেয়েকে শাসিয়ে উঠলো অরু, চোখ পাঁকিয়ে বললো,
—- খুব দুষ্ট হয়েছো তুমি কিয়ারা, সারা বাড়ি খুঁজছি আমি তোমায়,আর তুমি এখানে? পাপার পঁচা মেয়ে একটা তুমি।

মায়ের কথা কিয়ারার গায়ে না লাগলেও, ক্রীতিক কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে অরুকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
— খবরদার আমার মেয়েকে বকবি না তুই।

— বকবো না মানে? দেখেছেন ওকে খুঁজতে গিয়ে আমার হাতের কি অবস্থা হয়েছে?

এই বলে নিজের ছিলে যাওয়া কোমল হাতটা ক্রীতিকের চোখের সামনে তুলে ধরলো অরু। অরু ব্যথা পেয়েছে, ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই হকচকিয়ে উঠলো ক্রীতিক, অকস্মাৎ ওকে কাছে টেনে উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
— বেইবি বেশি লেগেছে?

— তুমি মাম্মাকে বেবি কেন ডাকচো? বেবি তো আমি।

মেয়ের কথায় অরু ক্রীতিক দুজনই হতবাক,
মেয়ে রাগ করেছে, গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, তা দেখে অরুকে ছেড়ে কিয়ারাকে কোলে তুলে নিলো ক্রীতিক। কিয়ারা মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে আছে, ক্রীতিক মেয়েকে মানানোর চেষ্টা করে বললো,
—- তোমার মাম্মা আমার বেইবি, আমার হার্টবিট, আমার সব তাই ডাকছি। কিন্তু তুমি তো বেইবি নও পাপা, তুমি তো আমার মা, কিয়ারা জায়ান চৌধুরী। ভুলে গেলে?

বাবা মেয়ের খুনসুটির মাঝে হুট করেই পেছন থেকে অর্ণব এলিসার আওয়াজ শোনা গেলো, ক্রীতিক পেছনে তাকিয়ে দেখলো,
—- অর্ণব, এলিসা, সায়র নীলিমা তাদের পুচকু সমেত দাঁড়িয়ে আছে। সবার মুখে বিরক্তির ছাঁপ স্পষ্ট। শীত কাল হলেও দুপুর বেলা ভালোই সূর্যের তেজ বেড়েছে, সেই তেজি সূর্যের আলোয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে সবকটার মুখ মন্ডল। ক্রীতিক ওদের দেখে আশ্চর্য হলোনা, সবসময়ের মতোই ভাবলেশহীন গলায় বললো,
—- কি’রে তোরা এখানে কি করছিস? বাড়িঘর নেই?

নিজ বন্ধুদের দেখে ক্রীতিকের কপাল কুঁচকে এলেও, এই অচেনা দেশে পাপার বন্ধুদের দেখে কিয়ারার আনন্দ হলো খুব, কারণ কিয়ারা এই মানুষ গুলোকে প্রায়ই তাদের ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়িতে দেখতে পায়। সে পাপার কোলে বসেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গলা ছেড়ে ডাকলো,
—- আর্থাল ভাইয়া।

সঙ্গে সঙ্গে অর্ণবের কোল থেকে সারা দিলো ওদের সারে তিন বছরের ছেলে আর্থার সায়ন্ত। সে গলা উঁচিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,
— কিয়ারা মনি!

ওদিকে নিনিত যে এতো করে চাইছে কিয়ারা তার সাথে একটু কথা বলুক, বন্ধুত্ব করুক, সেদিকে কোনো হেলদোল নেই কিয়ারার,সে পাপার কোল থেকে জোর জবরদস্তি করে নেমে দৌড়ে ছুটে গেলো আর্থারের কাছে। পিচ্চি গুলোকে সাইড করে সায়র এগিয়ে এসে ক্রীতিককে বললো,
— তোর সমস্যাটা কি জেকে? আমরা সবাই মিলে এতোটা পথ জার্নি করে এসে গিয়েছিলাম অরুর সাইনিং ইভেন্টে, সেখানে গিয়ে শুনি তুই নাকি ইভেন্ট শুরু হওয়ার আগেই অরুকে নিয়ে চলে এসেছিস? এর মানেটা কি?

— হ্যা নিয়ে এসেছি, আমার মেয়ে কাঁদছিল তাই।
সোজাসাপটা জবাব ক্রীতিকের।

ক্রীতিকের কথায় চিড়বিড়িয়ে উঠলো সায়রের মাথাটা, ও দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
—- পাবলিকেশনের লোকেরা তোর উপর বেজায় চটে আছে। তাদের এতো বড় ইভেন্ট, এতোগুলো টাকা, সব পন্ড করে দিয়ে এসেছিস তুই, তারা বসে থাকবে মনে হয়? মামলা করবে তোর আর তোর মেয়ের নামে।

সায়রের কথায় দু পয়সা পাত্তা না দিয়ে, ক্রীতিক চটে গিয়ে সায়রের কলার চেপে ধরে বললো,
—- অরু অরু করছিস কাকে তুই? শালা কতবার বলেছি আমার বউয়ের নাম মুখে আনবি না তুই। কানে কথা যায় না?

ক্রীতিককে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, সায়র গম্ভীর গলায় বললো,
— সম্মান দিয়ে কথা বল জেকে, ভুলে যাস না আমি তোর আগে বাবা হয়েছি।

ক্রীতিক ছাড়েনা উল্টে হাতের জোর বাড়িয়ে সায়র কে চেপে ধরে বললো,
—- হ্যা একদিন আগে হয়েছিস,ওই একদিন কেউ গোনায় ধরে বলে আমার মনে হয় না।

সায়র ক্রীতিকের হাত দুটো টেনেটুনে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,
—- হিটলারের বাচ্চা ছাড় আমাকে, বাচ্চারা দেখছে, একদিন আগে হই আর একঘন্টা আগে, তোর আগে বাবা তো হয়েছি, সো আ’ম ফার্স্ট।

— তোর একদিনের ফার্স্ট আমি মানিনা।

কথাটা বলেই সায়রকে আরও জোরে চেপে ধরলো ক্রীতিক। ওদের কান্ড দেখে এবার এগিয়ে এলো এলিসা। দু্টোকে দুদিকে সরিয়ে, বিরক্ত গলায় বললো,
—- উফফ, তোদের এই ফার্স্ট সেকেন্ড ঝগড়া দেখতে দেখতে বিরক্ত আমি। সেই হসপিটাল থেকে শুরু করেছিস, এখনো শেষ হওয়ার নাম নেই।

সায়র নিজের মুচড়ে যাওয়া কলারটা ঠিক করতে করতে বললো,
—- আমি ফার্স্ট সেটা আমি সারা জীবন বলবো, দরকার পরলে মাইক হাতে নিয়ে ঢোল পিটিয়ে বলবো, ওর মেয়ের জামাইকে বাড়ি বয়ে গিয়ে ভাঙানি দিয়ে পর্যন্ত বলে আসবো, যে তার অলরাউন্ডার শশুরকে হারিয়ে দিয়েছি আমি। আমিই ফার্স্ট।

—- শালা তুই বেশি কথা বলিস।

এই বলে ক্রীতিক তেড়ে মে’রে সায়রের দিকে এগিয়ে যাবে, তার আগেই পেছন থেকে ওকে ডেকে উঠলো অরু,
— চলুন রাইডিং এ যাবো, আমি রেডি।

রাইডিং ছেড়ে দেওয়ার এতোগুলো বছর পরে অরুর মুখে এমন একটা কথা শুনতে পেয়ে অকস্মাৎ পেছনে ঘুরলো ক্রীতিক।

দেখলো, লেদার জ্যাকেট, সেইফটি প্যাড সবকিছু পরে, কালও রঙা দুটো হেলমেট হাতে সটান দাঁড়িয়ে আছে অরু। দেখে মনে হচ্ছে ঘর সংসার ছেড়েছুড়ে এখনই বাইক আর স্বামী সমেত নিরুদ্দেশ হতে চায় সে।

অরুকে এভাবে হেলমেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্রীতিক এক ভ্রু কুঞ্চিত করে শুনতে পায়নি এমন ভাব দেখিয়ে শুধালো,
—- কি বললি, কোথায় যাবি?

অরু নির্লিপ্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
— বাইক রাইডিং এ যাবো, আপনার সাথে।

— অসম্ভব, আমরা কোনো বাইক ফাইক রাইডিং এ যাচ্ছি না, এক্ষুনি ভেতরে গিয়ে এসব ড্রেস চেঞ্জ করে আয়, সন্ধ্যা হোক মেয়েকে সহ লং ড্রাইভে নিয়ে যাবো ,এখন নয়।

সবার সামনে ক্রীতিকের স্পষ্ট ধমকে মুখ কালো হয়ে গেলো অরুর, তবুও গলায় কিছুটা সাহস ধরে রেখে বললো,
—- আমার জন্যই তো আপনি আপনার শখের রাইডিং বাদ দিয়েছেন, এখন না-হয় আমার জন্যই করুন।

ক্রীতিক স্থীর মূর্তির ন্যায় দু’পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে, শক্ত গলায় বললো,
— রাইডিং আমার শখের সেটা কে বললো তোকে? লিসেন, এই পৃথিবীতে কিয়ারা জায়ানের চেয়ে শখের জিনিস আমার আর কিচ্ছু নেই, আর সেটা তুই আমাকে উপহার দিয়েছিস। আর কোনো শখ অপূর্ণ নেই আমার।

ক্রীতিক রেগে যাচ্ছে দেখে এলিসা এবার এগিয়ে এসে ওদের মধ্যে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো,
—- নিয়ে যা না জেকে, এমন করছিস কেন? অরু শখ করে তোর কাছে আবদার করেছে।

—- নো ওয়ে।

স্বামী স্ত্রীর মাঝখানে এলিসা এভাবে কাকুতি মিনতি করছে, তবুও ক্রীতিক নিজের কথায় অনড়, ব্যাপারটাতে বেশ অপ’মানিত হলো অরু, ও তৎক্ষনাৎ হেলমেটটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলো অন্দরমহলের দিকে। তবে ভেতরে প্রবেশ করার আগেই ওকে হ্যাঁচকা টানে কোলে তুলে নিলো ক্রীতিক।

সবার মাঝে বকবেও আবার নির্লজ্জের মতো কোলেও নেবে, ক্রীতিকের এসব পাগলাটে বিহেভিয়ার দেখে দেখে অভ্যস্ত অরু, তাই ও নিজেও বিরক্ত হয়ে ক্রীতিকের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে ঝাঁজিয়ে উঠে বললো,
— ছাড়ুন আমাকে।

ক্রীতিক অরুকে সামলে, বাইকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
— এতো জিদ কেন তোর বেইবি? কোনো কিছুতে এখন আর তোর সাথে পেরে উঠি না আমি, সবসময় হেরে গিয়ে স্যারেন্ডার করি।মেয়েটাকে উপহার দিয়ে একেবারে জায়ান ক্রীতিকের মাথা কিনে নিয়েছিস, উল্টাপাল্টা যা মন চায় তাই আবদার করে বসে থাকিস, কিচ্ছু বলতে পারি না আমি।

ক্রীতিকের কথার পাছে অরু চেঁচিয়ে উঠে বললো,
—- যাবো না আমি আপনার সাথে ছাড়ুন।

ক্রীতিক অরুকে বাইকে বসিয়ে দিয়ে বললো,
—- তুই যাবি তোর ঘাড় ও যাবে, চুপচাপ বস।

অতঃপর হেলমেট পরে, বাইক স্টার্ট করতে করতে ক্রীতিক এলিসার দিকে তাকিয়ে বললো,
—- মেয়েটাকে দেখে রাখিস এলি, মেয়ের মায়ের রাগ ভেঙে গেলেই ফিরে আসবো, আর যদি আজ রাতে না ফিরি, তাহলে বুঝবি মেয়ের বাবা একটু প্রাইভেসী চায়,হি জাস্ট ক্রেভিং ফর হিজ ওয়াইফ,সবকিছু সামলে নিস, আর ফোন করিস।

সবসময়ের মতো বন্ধুকে আস্কারা দিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো এলিসা, তৎক্ষনাৎ ক্রীতিক কুঞ্জের গেইট ছাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো বাইকটা। ক্রীতিক চলে গেলে সায়র একাই বিড়বিড়ালো,
— শালা নির্লজ্জ একটা, মেয়েটাকে অবধি নিয়ে গেলোনা।

এলিসা সায়রের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে দাঁত কটমটিয়ে বলে উঠলো,
— চুপ করবি তুই? আমি জেকে কে খুব ভালো করেই চিনি,ও যেখানেই যাক, আর যে কাজেই যাক না কেন, রাতের আগেই ফিরে আসবে। তাছাড়া কিয়ারা আর্থার কে পেলে আর কিছু লাগেনা ওর, দেখছিস না কেমন খেলছে।

এলিসার কথায় বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে, মৃদু হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সায়র, কি জানি কেন? হয়তো ওদের গল্পটার সমাপ্তি চলে এসেছে সেই বিরহে।

গেইট ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই অরুদের সাথে দেখা হলো অনু আর প্রত্যয়ের, ওরা অরুর সাথে দেখা করার জন্য ক্রীতিক কুঞ্জেই যাচ্ছিল, আর মাঝপথেই দেখা। অনুর কোলে ঘাপটি মেরে বসে আছে ডোরা। দূর্ভাগ্য বশত সেবার মিসক্যারেজ হয়েছিল অনুর, তারপর থেকে শত চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি আর। তাইতো অরু সেবার আপার দুঃখ ভোলাতে নিজের শখের ডোরাকে তুলে দিয়েছিল অনুর হাতে। এখন অনুই ডোরার মা। অনেক গুলো দিন পর ডোরাকে দেখতে পেয়ে মাঝরাস্তায় বাইক থামিয়ে ডোরাকে মন ভরে আদর করলো অরু, তারপর পুনরায় ওকে অনুর কোলে তুলে দিয়ে, দ্রুত পায়ে বাইকের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
—- এখন আসি আপা, রাতে আড্ডা হবে।

ক্রীতিকের ডেনিম জ্যাকেট খামচে ধরে বাইকে উঠে গিয়েছে অরু, ঠিক সে সময় পেছন থেকে হাঁক পেরে অনু বলে,
—- আরেহ যাচ্ছিসটা কোথায়? সেটা তো বলে যা?

অরু হেলমেটটা মাথায় চড়াতে চড়াতে খুশি মনে গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে,
—- মেয়ের পাপার সাথে রাইডিং এ যাচ্ছি আপা, বাকি কথা এসে বলবো।

অরু যতক্ষণে কথাগুলো শেষ করেছে, তৎক্ষনে স্পিডোমিটারের গতি বাড়িয়ে হুঁশশ করে বাইকে টান দিয়েছে ক্রীতিক। না বলে হুট করে এভাবে গতি বাড়ানোর দরুন,আচমকা ক্রীতিকের পিঠের উপর ঝুকে পড়লো অরু, ক্রীতিক লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে ডাকলো অরুকে,
— বেইবি,

— হুম।

—- আমি স্পিড বাড়াবো, ধরে বস।

ক্রীতিকের কথার জবাবে অরু ঠোঁট উল্টে বললো,
—- ধরেছি তো।

ক্রীতিক লুকিং গ্লাসে চোখ রেখেই হাস্কিস্বরে বললো,
—- আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধর, তোকে ফিল করতে পারছি না।

ক্রীতিকের কথায় লাজুক হেসে নিঃসংকোচে পেছন থেকে ওকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে চিবুক ঠেকালো অরু,

সঙ্গে সঙ্গে ক্রীতিক সবসময়ের মতোই বলে উঠলো,
— নাও পার্ফেক্ট।

বাইকের তীব্র গতির সাথে তাল মিলিয়ে শীতের কনকনে ঠান্ডা হাওয়া নাক মুখ চিড়ে ভেতরে প্রবেশ করছে, হাড় হাড্ডি সব কনকনে ঠান্ডায় হীম হয়ে আসছে, তবুও হৃদয়ের উষ্ণতা প্রশমিত হচ্ছে বারে বারে, অরু জানে এ উষ্ণ কমার নয়, আজ আর কমানোর সুযোগ দেবেও না ওর বেহায়া বরটা।শরীরের শীতলতা আর হৃদয়ের উষ্ণতা মিলেমিশে একাকার হয়ে অনুভূতির জোয়ার আজ বানভাসি হয়েছে, অরু সেই প্লাবিত অনুভূতি গুলোকে হৃদ গহীনে লালিত পালিত করতে চায় সারাজীবন। প্রতিদিন একই ভাবে একই মানুষকে বারবার হাজার বার জানাতে চায়,
—– আমার ভালোবাসার উপন্যাসের প্রতিটি পাতায়, সূচনা থেকে সমাপ্তি জুড়ে শুধুই আপনি জায়ান।

ক্রীতিক অরুর কথা শোনেনি ঠিকই তবে ওর মন বলছে,
—- শুধু উপন্যাস কেন? এই জীবনে এমন কোনো অধ্যায় অবশিষ্ট নেই যেখানে তোর আবির্ভাব ঘটেনি হার্টবিট, যদিও তা থেকে থাকে, তবে সেই অধ্যায় ছিল নিছকই মূল্যহীন, অনুভূতিহীন, আর পরিশেষে অস্তিত্বহীন।

দুজনার মনগহীনের বিস্তৃত সুপ্ত অনুভূতির আদান প্রদান বোধ হয় শেষ হবে না আজ আর, আর না তো সমাপ্তি ঘটবে সঙ্গিন প্রনয়াসক্তির।শুধু পাল্টে যাবে দৃশ্যপট, ইয়ামাহা খচিত নীলচে বাইকটা মাইলের পর মাইল পেরিয়ে গিয়ে একসময় আড়াল হয়ে যাবে দৃষ্টি সকলের। পশ্চিমাকাশ সিঁদুর রাঙা হয়ে ধীরে ধীরে আঁধারের ভীরে তলিয়ে যাবে সূর্য কীরন । অস্ত যাবে ধরনী।তবুও মুক্ত শালিকের ন্যায় ডানাঝাপ্টানো একজোড়া হৃদয়ের আজ আর পায়তারা মিলবে না নীড়ে ফেরার। তারা আজ পাখির মতোই অবাধে দাপিয়ে বেড়াবে পুরো শহর জুড়ে । এ যেন তাদের দৃঢ় প্রতীজ্ঞা।
[ সমাপ্ত]

#সঙ্গিন_প্রনয়াসক্তি🍁🍁
#সারপ্রাইজ_পর্ব
#লেখনীতে_suraiya_rafa

🚫(কঠোরভাবে প্রাপ্তমনস্ক ও মুক্তমনাদের জন্য)
🚫( আজকের পার্ট সবার জন্য নয়, যাদের পসেসিভ রোম্যান্স কিংবা ডমিনেটিং লাভ পছন্দ নয়, তারা আজকের পার্টটা এরিয়ে যাবেন দয়াকরে)

বাইরে হালকা হালকা তুষার পাত হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরেই রোদের দেখা নেই,চোখের সামনে কাঁচের দেওয়াল গলিয়ে পেজা তুলোর মেঘের মতোন ঝরে পড়ছে শুভ্র বরফ কনা, বরফের আস্তরণে পুরো শহরতলী শুভ্রতায় ছেয়ে গিয়েছে, দেখলেই কেমন প্রান জুড়িয়ে আসে।

গেইটের সামনে চেরিব্লোসম গাছ দু’টো ন্যাড়া হয়ে পরে আছে,রঙিন ফুল তো দূরে থাক, তরতাজা সবুজ পাতার ছিটেফোঁটাও নেই তাতে, যতদূর চোখ যায় শুধু বরফের আস্তরণ।

ক্রীতিকের মাস্টার বেডরুমের বিশালাকৃতির জানালাটার পর্দা সরিয়ে বাইরের ফ্রন্ট ইয়ার্ডটায় একঝলক চোখ বুলিয়ে নিলো অরু, অতঃপর হাতে এক কাপ কফি নিয়ে, ফায়ারপ্লেসের পাস ঘেঁষে বসে পরলো গিয়ে জানালার মুখোমুখি হয়ে।

আজ সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছে ক্রীতিক, কি নাকি ক্লায়েন্ট ফ্লায়েন্ট এর সাথে দরকারি মিটিং রয়েছে, না গেলেই নয়।নয়তো অরুর বাবু পেটে আসার পর থেকে খুব একটা প্রয়োজন ছাড়া স্ব’শরীরে অফিসে যায়না সে। বাড়িতে বসেই নিজ দ্বায়িত্ব গুলো বেশ নৈপুণ্যতার সহিত সামলে নেয়। যদি কখনো প্রয়োজন পরে তো প্রত্যয়ই বাড়ি বয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।

সারাজীবন একা থাকতে পছন্দ করা ক্রীতিক গত দু’মাস ধরে দু’জন সার্ভেন্ট ও রেখেছে বাড়িতে, অরুর আন্ডার এইজ প্রেগন্যান্সি, ডক্টর বলেছে খুব সাবধানে থাকতে, মিসক্যারেজ হওয়ার সম্ভাবনা ও প্রকট, তাই রান্না বান্না থেকে ঘরের যাবতীয় কাজ, সবকিছু সার্ভেন্ট দ্বারাই করানো হয়। অনুর মিসক্যারেজের কথা চিন্তা করে অরু নিজেও বেশ ভয়ে থাকে এসব নিয়ে, তাই মন চাইলেও খুব বেশি একটা ধকল দেয় না নিজের শরীরকে। অবশ্য এই ক্রুটিপূর্ণ প্রেগন্যান্সির পেছনে মোক্ষম কারন রয়েছে। কারণটা আর কেউ নয় , স্বয়ং মাথা গরম, রগ চটা, বেপরোয়া ক্রীতিক নিজেই।

ক্রুটিপূর্ণ প্রেগন্যান্সির কথা ভাবতে গিয়েই ছয়মাস ধরে বেড়ে ওঠা নিজের ছোট্ট উদরে আলতো হাত ছোঁয়ালো অরু। মনে মনে ভাবতে লাগলো সেদিন সকালের কথা,

সেবার নেদারল্যান্ডের টিউলিপ গার্ডেনে ঘুরতে যেয়ে ভ্যাকেশনটা বেশ ভালোই কেটেছিল ওদের সবার।সায়র নীলিমা, অর্ণব এলিসা সহ মোট তিন জোড়া কাপল একসাথে যাওয়ায় টিউলিপ গার্ডেনের পাশেই একটা মস্তবড় ভিলা রেন্ট করেছিল ওরা, যেই ভিলাতে দু’তলার প্রত্যেকটা বারান্দা থেকে টিউলিপের বাগান স্পষ্ট দেখা যেত।

নেদারল্যান্ডস পৌঁছানোর পরে তিন চারটা দিন সবাই একসাথে ঘুরে ফিরে, হইহুল্লোর করে ভালোই আনন্দে কেটেছিল ওদের সবার। কিন্তু বিপত্তি ঘটে পাঁচ দিনের মাথায়, সেদিন হঠাৎ করেই ঘুম থেকে উঠে অরুকে পাশে পেলোনা ক্রীতিক। এমনটা সাধারনত কখনো হয়না,কারণ আড়মোড়া ভেঙ্গে যাওয়ার পরেও, ওই শক্ত চওড়া বুকের মধ্যে ঢুকে খানিকটা সময় ধরে ওম না নিলে, মোটেই ভালো লাগেনা অরুর। অথচ আজ সে সকাল সকাল গায়েব।

আগের রাতে অনেক বেশি দেরি করে ঘুমাতে যাওয়ার দরুন ক্রীতিক ভেবেছিল হয়তো ওর নিজেরই ঘুম থেকে উঠতে বেলা হয়ে গিয়েছে, তাই অরু হয়তো আছে লিভিং রুমে কিংবা অন্য কোথাও। কিন্তু কিসের কি? পুরো ভিলাতে কোথাও অরু নেই।

শেষমেশ না পেরে দরজায় নক করে করে ওদের সবার ঘুম ভাঙিয়েছে ক্রীতিক। তবে ওরাও কোনো হদিস দিতে পারলো না অরুর। এমন একটা অচেনা দেশে, অচেনা যায়গায় এসে হুট করে কোথায় হারিয়ে গেলো মেয়েটা? কোনো বিপদ আপদ হলোনা তো আবার? এক আকাশ পরিমান হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই একহাত দিয়ে নিজের চুল নিজেই খাঁমচে ধরলো ক্রীতিক। ওকে এভাবে উদ্বিগ্ন হতে দেখে এলিসা মানানোর স্বরে বলে,
— শান্ত হ জেকে,ঠান্ডা মাথায় ঠিক করে ভাব কোথায় যেতে পারে মেয়েটা? আচ্ছা ফোন করেছিলি নিশ্চয়ই?

এলিসার কথায় দাঁত দাঁত চাপে ক্রীতিক, অতঃপর বিরক্তির সুরে বলে,
— ফোনটা নিয়ে গেলে তো করবো? ইডিয়েট একটা, আজ ওকে খুঁজে পেলে খবর আছে, আমি যে ওর কি হাল করবো নিজেও জানিনা।

ক্রীতিকের কথার মাঝে ওকে থামিয়ে দিয়ে, ওর দিকে টিস্যু বক্স এগিয়ে দিতে দিতে সায়র বললো,
—- তোর নোজ ব্লেডিং শুরু হয়েছে আবার।

ক্রীতিক এক টুকরো টিস্যু হাতে নিয়ে, সেটা দ্বারা নাক মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো,
—- এই মেয়েটা আর আমাকে শান্তি দিলোনা। আমার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে ওকে খুঁজে বের করতে করতে।

কথা শেষ করে টি টেবিল থেকে গাড়ির চাবিটা কুড়িয়ে নিয়ে বাইরের দিকে হাটা ধরে ক্রীতিক, ওকে চলে যেতে দেখে অর্ণব উদ্বিগ্ন গলায় বলে ওঠে,
— কোথায় যাচ্ছিস তুই একা একা? আমরা আসবো?

ক্রীতিক যেতে যেতে জবাব দেয়,
—- দরকার নেই, আসেপাশের টুরিস্ট এরিয়া গুলো একটু খুজে দেখে আসছি আমি, তারপরেও যদি না পাই, তো পুলিশের কমপ্লেইন করা ছাড়া আর উপায় দেখছি না।

ক্রীতিকের কথার পাছে অর্ণব পুনরায় বলে,
—- কিন্তু তোর তো নোজ ব্লেডিং হচ্ছে, কার ড্রাইভ করতে পারবি তো?

ক্রীতিক আর দাঁড়ায় না, ইতিমধ্যে ওর বুকের মধ্যে দাউদাউ করে অস্থিরতার আ’গুর ধরিয়ে দিয়েছে, এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ও আর নিজেকে সামলাতে পারবে না, নির্ঘাত বুকের ব্যথায় দম বন্ধ হয়ে মা’রা যাবে। তাই আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে তপ্তস্বরে জবাব দিলো ক্রীতিক,
—- পারবো।

*********************************************
সারাটা দিন হন্যে হয়ে এদিক সেদিক খুঁজেও লাভ হলোনা কোনো। ক্রীতিক ধারণা করেছিল অরু হয়তো বা পাকামি করে একা একাই কোনো টিউলিপ গার্ডেনে ঢুকে পরেছে, কিন্তু তেমন কিছুই নয়। অবশেষে উপায়ন্তর না পেয়ে একরাশ বিষন্নতা আর ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পুনরায় ভিলাতে ফিরে এলো ক্রীতিক, উদ্দেশ্য ফোন করে পুলিশ কে জানানো, তারা যদি কোনো সোর্স এর মাধ্যমে খুঁজে দিতে পারে ওর হৃদস্পদন কে।

তখন তাড়াহুড়োয় ফোনটাও নিয়ে বের হতে পারেনি,তাই আবারও ভিলাতেই ফিরতে হলো ক্রীতিক কে। ক্রীতিক যখন চোখ বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে ঘরের দুয়ারে পা রাখে, ভেতরে গিয়ে সবার একেক করে নানান প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, সেই ভেবে যখন ওর বক্ষপিঞ্জর ব্যথায় টনটন করে ওঠে, ঠিক তখনই ভেতর থেকে ভেসে আসে এলিসার ধমকা ধমকির আওয়াজ, কাউকে উদ্দেশ্য করে একটু রাগান্বিত স্বরেই এলিসা বলছে,
—- কোথায় গিয়েছিলে তুমি? সারাটা দিন একটা খোঁজ নেই খবর নেই, জেকে টা উদভ্রান্তের মতো খুঁজে বেরিয়েছে তোমায়, কি জানি হয়তো পুলিশেও কল করে দিয়েছে এতোক্ষণে, আজ ও ভিলাতে ফিরলে তোমার সাথে কি হবে ভাবতে পারছো?

এতোটুকু শোনা মাত্রই ক্রীতিকের কৌশলী মস্তিষ্কটা সচল হয়ে উঠলো, কারও উপর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেলো মূহুর্তেই, মাথার মধ্যে ভলভলিয়ে বেড়ে ওঠা তীব্র ক্রোধটাকে ক্রীতিক সামলালো না মোটেই, বরং দু’হাত মুঠি বদ্ধ করে হনহনিয়ে ভেতরে গিয়ে বাজপাখির মতো ছো মে’রে শক্ত হাতে চেপে ধরলো অরুর চোয়াল, ক্রীতিকের হাতের বাঁধন এতোটাই শক্ত যে অরুর মনে হচ্ছিল এক্ষুনি গালের হাড় হাড্ডি সব গুড়ো গুড়ো হয়ে ভেঙে যাবে।
— আমাকে না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলি বল?

দাঁতে দাঁত পিষে অরুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছোড়ে ক্রীতিক।

ক্রীতিকের এমন ক্ষ্যাপাটে সিংহের মতো আচরনে ভড়কে যায় সবাই , নীলিমা ভয়ে সিটিয়ে গিয়ে সায়রের শার্ট খামচে ধরে হিসহিসিয়ে বললো,
—- ভাইয়াকে থামাও, অরুকে তো মে’রেই ফেলবে আজ।

সায়র ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, অতঃপর নীলিমার মুখের কাছে মুখ নিয়ে বিড়বিড়ালো,
—- কিছুই করবে না।

ক্রীতিক চক্ষু গরম করে অরুকে ভস্ম করে দিতে চাইলো, সেভাবেই ক্ষুদ্ধ কন্ঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় গিয়েছিলি জবাব দে?তোকে না পেলে আমি যে কুত্তার মতো তোকে খোঁজার জন্য পুরো শহর চষে বেড়াবো সেই হুঁশ ছিলনা তোর ব্রেইনে? আন্সার মি!

গর্জে উঠলো ক্রীতিক, ওর এহেন কঠোর ধমকে কম্পিত হয়ে উঠলো অরু, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো ,
— আআমি তো একটু বড় টিউলিপ গার্ডেন দেখতে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম চলে আসবো তাড়াতাড়ি, কিন্তু গাড়ি পাইনি একটাও।

— এইইই! কাকে মিথ্যে গল্প শোনাচ্ছিস তুই? শহরের এমন কোন টিউলিপ গার্ডেন নেই যেখানে আমি তোকে পাগ’লের মতো খুঁজিনি, আর তুই এখানে আমাকে বানিয়ে বানিয়ে উপন্যাসের ডায়লগ শোনাচ্ছিস? কলিজায় ভয় নেই?

এই পর্যায়ে গর্জে উঠে অরুর বুকের কাছের জামাটা খামচে ধরে ওকে নিজের কাছে নিয়ে এলো ক্রীতিক।

অরুর মিথ্যে জবাবে ক্রীতিকের রাগের পারদ দিগুণ তালে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, এবার এলিসা এগিয়ে এসে ক্রীতিকের হাতটা টেনে হিঁচড়ে ছাড়ালো অরুর থেকে। অতঃপর ক্রন্দনরত অরুকে নিজের বাহুতে টেনে নিয়ে বললো,
— অনেক হয়েছে জেকে, আজকের মতো ছেড়ে দে মেয়েটাকে, কাল না হয় ঠান্ডা মাথায় শুনিস সবকিছু।

ক্রীতিক ক্রুদ্ধস্বরে বললো,
— ওকে সাফসাফ উত্তর দিতে বল এলিসা,ও সারাদিন কোথায় গিয়েছিল, নয়তো আজ আর ওকে ছাড়াছাড়ি নেই, আমি ওর সাথে যা ইচ্ছে হয় তাই করবো আজ।

এলিসা আর অরু কে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো না ক্রীতিকের সম্মুখে , বরং তাড়াহুড়ো করে অরু সমেত চলে গেলো নিজের বেডরুমে।

*
তখন গভীর রাত, সন্ধ্যা রাতে অরু ক্রীতিকের ঝামেলার দরুন, পুরো ভিলা এখন শুনশান নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, অন্য কোনো দিন হলে হয়তো এখনো সবাই লিভিং এ বসে আড্ডা আনন্দে মেতে থাকতো। কিন্তু আজ সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতি, খানিক বাদে বাদেই রাতের আঁধারকে সঙ্গ দিতে লেকের পার থেকে ভেসে আসছে কোলাব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ আওয়াজ। সেই সাথে টিউলিপের বাগান থেকে ধেয়ে আসা রাতজাগা পাখিদের ডানা ঝাপ্টানোর শব্দে গভীর ঘুমে কাঁদা হয়ে আছে সকলে। ঠিক এমন সময় অর্ণবের গভীর আরামদায়ক ঘুমের ইস্তফা দিয়ে ওর মুঠোফোনটা বেজে উঠল তার স্বরে।
এতো রাতে এই ফোনের আওয়াজ বড্ড বিরক্ত ঠেকলো অর্ণবের কানে, অগত্যাই ফোনটা কেটে দিয়ে পাশ ঘুরে শুয়ে পরলো অর্ণব। কিন্তু ফোনের ওপাশে থাকা ব্যক্তিটির বোধ হয় এই প্রত্যখ্যান সহ্য হলোনা মোটেই, যার দরুন আবারও ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল মোবাইলটা। এবার আর উপায়ন্তর না পেয়ে ঘুমু ঘুমু চোখে মোবাইল রিসিভ করে কানে ধরলো অর্ণব, তবে এপাশ থেকে কিছু বলার ফুরসত না দিয়ে ওপাশ থেকে বিরক্তির স্বর ভেসে এলো ক্রীতিকের, সে দাঁত কটমটিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে উঠলো ,
— শালা ফোন তুলছিস না কেন? ম’রে গেছিস?

অর্ণব চোখ কচলাতে কচলাতে হাই তুলে বললো,
—- ম’রিনি, তবে তুই কেন অন্য রুম থেকে বারবার কল দিয়ে আমার হা’র্টঅ্যাটাকের বন্দোবস্ত করছিস সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না?

ক্রীতিক ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর গলায় বললো,
—- আমার বউ কই?

— লাইক সিরিয়াসলি জেকে? তোর বউ কই সেটা জানার জন্য তুই আমায় মাঝরাতে কল দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিস?

ক্রীতিক দমলো না, নতুন উদ্যমে গম্ভীর গলায় বললো,
— তোর বউ তখন আমার বউকে বগলদাবা করে রুমে নিয়ে গিয়েছে, এখন দিয়ে যেতে বল, বউ ছাড়া আমার ঘুম আসেনা।

অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অসহায় সুরে ক্রীতিককে মানানোর চেষ্টা করে বললো,
—- ভাই বিশ্বাস কর, এতো রাতে এলির ঘুম ভাঙালে ও নির্ঘাত আমায় উষ্ঠা মে’রে ইউ এস এ পাঠিয়ে দেবে।

—- তাহলে ট্রিক্স খাটা।

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধালো,
—- ট্রিক্স খাটাবো মানে?

ক্রীতিক নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো,
— মানে আবার কি? তুই এই মূহুর্তে এলিসাকে কল করে বলবি, তোর প্রচন্ড পেট ব্যথা করছে, ঘরে বাইরে শুরু হয়ে গিয়েছে, এক্ষুনি হসপিটালে না গেলে বাইরে যাওয়ার আর উপায় থাকবে না,ঘরেই শুরু করতে হবে।

ক্রীতিকের কথায় অর্ণব নাকটা সিকোয় তুলে বলে ওঠে,
— ইউউ, এসব বলবো? ভাই এসব আমি বলতে পারবো না, তুই প্লিজ আজকে রাতটা একটু নিজেকে সামলা, কাল ভোর হলেই তোর বউকে আমি নিজে তোর হাতে তুলে দিয়ে আসবো।প্লিজ ভাই।

অর্ণবের কন্ঠে ভীষণ আকুতি, অথচ ক্রীতিক তাতে দু’পয়াসার আবেগ না ঢেলেই কাঠ কাঠ কন্ঠে বললো,
—- যা বলেছি চুপচাপ তাই কর, নয়তো কাল এলিসা নয় আমি নিজেই তোকে কিক মে’রে ইউ এস এ পাঠিয়ে দেবো।

এরপর অর্ণব আর কিছু বলতে গিয়েও পারলো না, কারণ কথা বলার আগেই পিক পিক আওয়াজ করে লাইন কেটে দেয় ক্রীতিক।

অবশেষে অনেক ভেবেচিন্তে উপায়ন্তর না পেয়ে বুকে মাথায় ক্রুশ একে এলিসার নাম্বারে কলটা করেই ফেললো অর্ণব।

*************************************************
গভীর রাত, ঘুমে তলিয়ে আছে পুরো শহর,অত্যাধুনিক ভিলার প্রত্যেকটা জানালা হাট করে খুলে রাখা হয়েছে, সেখান থেকেই বইতে থাকা ঝিরিঝিরি হিমেল হাওয়ায় ঘুমটা গাঢ় হয়ে উঠেছে অরুর, ঠিক এমন হয় তলপেটে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হতেই ধীরে ধীরে কিছুটা তন্দ্রা কেটে গেলো ওর। ঘুমের মাঝেই মনে হতে লাগলো ও হাওয়ায় ভাসছে।

প্রচন্ড হাওয়ার তোড়ে লম্বা চুল উড়ে এসে আঁচড়ে পরছে চোখে মুখে। কিন্তু ঘুমের মাঝে এমন অদ্ভুত অনুভূতি হওয়ার কারণ টা কি? এটা কি স্বপ্ন? কথাগুলো মস্তিষ্কে ক্যাচ করতেই অকস্মাৎ চোখ খুলে ধরফরিয়ে উঠলো অরু।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে লাফিয়ে ওঠায় কোথাও একটা থেকে পরে যেতে গিয়েও পরলো না ও, কারণ কেউ একজন দৃঢ় হাতে সামলে রেখেছে ওকে। ঘুমটা পুরোপুরি ছুটে গেলো এবার, অরু চারিদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে ওকে কাঁধে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ক্রীতিক। অন্ধকারের মাঝেও ক্রীতিকের উপস্থিতি টের পাওয়ার মতো ক্ষমতা অরুর আছে, কিন্তু এভাবে ঘুমের মধ্যে অ’পহরণ করে তুলে নিয়ে যাওয়ার মানেটা কি? কেন যেন বিরক্তিতে শরীরটা চিড়বিড়িয়ে উঠলো অরুর, ক্রীতিক সবসময় বাড়াবাড়ি করে। তাই অরু এবার ধাতস্থ হয়ে ক্রীতিককে কয়েকটা কড়া কথা শোনানোর প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তার আগেই ওকে রুমে এনে বিছানায় ছু’ড়ে মা’রে ক্রীতিক। অরুকে বিছানায় রেখে এগিয়ে গিয়ে দরজা জানালা গুলো লাগিয়ে দিতে দিতে কঠিন স্বরে বলে,
— কোথায় ছিলি সারাদিন সত্যি করে বল অরু।

ব্যাস, এক বলেই ছক্কা হাঁকালো ক্রীতিক, যার ফলসরূপ অরুর সব হাওয়া ফুঁসস। অরু ভেবেছিল ক্রীতিক হয়তো ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছে এতোক্ষণে, এখন হয়তো একান্তে অরুর সঙ্গ চায় বলেই এভাবে তুলে নিয়ে এসেছে ওকে। কিন্তু না, এটা তো জায়ান ক্রীতিক, ওভার পসেসিভ, ওভার রিয়েক্টিভ। তার কাছ থেকে ছাড় পাওয়া কি এতোই সহজ?

অরু ভাবছে দেখে ক্রীতিক আবারও এগিয়ে এসে অরুর মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়, অতঃপর রাশভারি আওয়াজে শুধায়,
—- কি হলো, এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে এতো সময় লাগছে কেন? আমি কি খুব কঠিন প্রশ্ন করেছি?

অরু ভড়কালো, সামান্য তোতলানোর সুরে বললো,
— দদেখুন প্রত্যেকেরই তো এইটুকুনি প্রাইভেসির প্রয়োজন তাই না? তাছাড়া আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি আমি কোনো খারাপ কাজ করিনি।

অরুর কথায় সন্তুষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, উল্টো ক্রীতিকের দৃষ্টিতে অগ্নিস্ফুলিং ফুটে উঠলো মূহুর্তেই। তীক্ষ্ণ চোয়ালটা শক্ত হয়ে ব্লেডের মতো ধারালো হয়ে উঠলো যেন, সে এগিয়ে গিয়ে বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চকচকে হ্যা’ন্ডকাফ্ বের করতে করতে বললো,
—- তোর মাঝে এমন কি আছে? যা আমার অজানা অরু?কি এমন প্রাইভেসি এখনো অবশিষ্ট রয়েছে, যা আমি উন্মুক্ত করিনি? চল দেখবো আজ।

ক্রীতিকের গতিবিধি পরখ করে অরু এবার ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো, কাঁদতে কাঁদতে ক্রীতিককে মানানোর চেষ্টা করে কিছুটা আত’ঙ্কিত সুরে বললো,
—- এমনটা করোনা প্লিজ, এটা মোটেই উচিত হবে না, খুব বেশি অন্যায় হয়ে যাবে।

অরুর তুলতুলে নরম গালে পরম আবেশে হাত বুলিয়ে, হাস্কিস্বরে ক্রীতিক বলে,
—- আই হ্যাভ প্রোপার রাইট টু মেকিং লাভ উইথ ইউ বেইবি, এখানে অন্যায় কোথায় দেখলি? আমাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা ভুলেও করিস না।

ক্রীতিকের কথার টোনে হু’মকি সুস্পষ্ট, কিন্তু অরু তাও বাঁধা দিচ্ছে ওকে। বারবার বলছে,
—- প্লিজ এভাবে না, এটা ঠিক হচ্ছে না।

ক্রীতিক সেসবের তোয়াক্কা না করে অরুর হাতদুটো আটকে ফেললো হ্যা’ন্ডকাফ্, অতঃপর ওর কান্না থামাতে মুখে লাগিয়ে দেয় এক টুকরো ডাকট্ টেপ। এবার অরু পুরোপুরি ক্রীতিকের বশে, ব্যাপারটা উপলব্ধি করতেই অরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্রীতিক হিসহিসিয়ে বললো,
— তোর ভালোর জন্য বেঁধেছি, কারণ আজকে যতক্ষণ না সত্যিটা বলবি, ততক্ষণে আমার হাত থেকে তোর নিস্তার নেই । বি রেডি ফর ইওর হার্ড পা’নিশমেন্ট বেইবি।

অরুর মুখ বাঁধা, তাই ও কাঁদতে কাঁদতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালো শুধু, যার অর্থ,
— এটা করবেন না প্লিজ।

তবে ক্রীতিক আর অপেক্ষা করে না, নিজের সবটুকু আকর্ষন, উন্মাদনা অরুর মাঝে বিলিয়ে দিয়ে ডুবে যায় ভালোবাসার অতল গহ্বরে।

*
অবশেষে ক্রীতিকের দেওয়া অতিরিক্ত ভালোবাসাময় য’ন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে শেষ রাতে অকস্মাৎ নিস্তেজ হয়ে পরলো অরু। অরু জ্ঞান হারিয়েছে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ক্রীতিকের যেন ভ্রম কেটে যায়। নিজের মাঝের পৈচাশিক আর ডমিনেটিং ভাব উবে গিয়ে মূহুর্তেই চোখে মুখে ঝরঝরিয়ে নেমে আসে একরাশ কাতরতা। সেই কাতর স্বরেই অরুর গালটা আলতো ঝাঁকিয়ে ডেকে ওঠে ক্রীতিক,
—- বেইবি, আর ইউ ওকে না? খুব বেশি ব্যথা দিয়েছি?

অরু জবাব দেয় না, তা দেখে ক্রীতিকের পিলে চমকে গেলো, এমনটা তো কখনো হয়না, ক্রীতিকের বরাবরই ওয়াইল্ড লাভ, লাভ ট’র্চার এসব বেশ পছন্দ। ব্যাপারগুলো ক্রীতিকের নিকট রোমাঞ্চকর বলে অরুও মুখ বুঝে সহ্য করে নেয় সবটা। কিন্তু এমনটা তো কখনো হয়না। এর আগেও বহুবার এভাবে মিলিত হয়েছে তারা,কিন্তু অরু আজ প্রথম বারই জ্ঞান হারালো, কিন্তু কেন?

হাজারও অযথা চিন্তাদের বহর একসাথে ঘীরে ধরেছে ক্রীতিকের মন মস্তিষ্ক, কিন্তু এখন চিন্তা করার সময় নয়, যত দ্রুত সম্ভব অরুর জ্ঞান ফেরাতে হবে, সেই ভেবে ক্রীতিক নিজেদের মাঝের বস্রটুকু ঠিকঠাক করে তাড়াহুড়ো পায়ে উঠে গিয়ে অরুর হাত মুখ সব খুলে দিলো। এরপর অরুকে ছোট বাচ্চার মতো করে কোলের মধ্যে নিয়ে ঠান্ডা পানির ছাট দিতে লাগলো ওর চোখে মুখে।

খুব বেশিক্ষণ নয়, মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাবধানেই অরুর চেতনা ফিরে এলো, অরু চোখ খুলেছে দেখে ওকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে, চোখ দু’টো বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো ক্রীতিক। ওদিকে চেতনা ফিরতেই প্রচন্ড ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে ক্রীতিকের থেকে ছিটকে দূরে সরে যায় অরু। অরু এভাবে দূরে সরে গিয়েছে দেখে, ক্রীতিক অপ’রাধী গলায় বললো,
— বেইবি আস্তে, তুই উইক।

অরু নাক টেনে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো এবার, কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আপনি একটা জা’নোয়ার, আপনার জন্যই আমি উইক, এখন আবার দরদ দেখাচ্ছেন কোন মুখে?

অরুর আপসোসের কান্নায় হৃদয় ছিড়ে যাচ্ছে ক্রীতিকের, ও এগিয়ে গিয়ে অরুর মুখোমুখি হয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরে বললো,
—- আ’ম সরি হার্টবিট, আমি বুঝতে পারিনি তুই এভাবে হঠাৎ করেই জ্ঞান হারাবি, তোর শরীরটা দূর্বল জানলে আমি কখনোই এমনটা করতাম না, আর হুট করে ব্লেডিং….

ক্রীতিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো অরু, কাঁদতে কাঁদতে দু’হাতে ক্রীতিকের চুল খামচে ধরে বললো,
—- আমার বাচ্চার কিছু হয়ে গেলে, আমি তোকে ছাড়বো না জায়ান।

অরুর কথা শুনে ক্রীতিকের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পরলো, এসবের মাঝে বাচ্চা আবার কোথা থেকে এলো? অরুর পানে একটা আহত চাহনি নিক্ষেপ করে, ক্রীতিক বলে ওঠে,
— বাচ্চা মানে?

অরু কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— বেশ কয়েকবার টেস্ট করেও বারবার পজিটিভ রেজাল্ট আসছিল, তাই পুরোপুরি সিওর হতে ডক্টরের কাছে গিয়েছিলাম।

অরুর কথায় ক্রীতিকের চোখ কপালে উঠে গেলো, অরু প্রেগন্যান্ট তার মানে বাচ্চাটা ওর নিজের, এটা ভাবতেই, অরুর দু’বাহু ঝাঁকিয়ে ক্রীতিক দাঁত খিঁচিয়ে বলে ওঠে,
—- তো আমাকে বললি না কেন ইডিয়েট? সারাদিন তোকে পা’গলের মতো খুঁজেছি আমি, এই অচেনা শহরে এমন কোনো টুরিস্ট এরিয়া নেই যেখানে আমি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরাইনি। আর তুই কিনা ডক্টরের ক্লিনিকে ছিলি?

জবাবে কাঁদতে কাঁদতে অরু বলে,
—- আপনি বাচ্চা চাচ্ছিলেন না কিছুতেই , কিন্তু এটা এসে গিয়েছিল কোনোভাবে, ভয় করছিল যদি আপনি এ্যাবরশন করার জন্য জোর করেন, তাহলে আমার বাচ্চাটার কি হতো? তাই চুপি চুপি গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি চলেও আসবো কিন্তু, কি জানি কেন, আসার পথে একটাও গাড়ি পাচ্ছিলাম না।

অরুর এতোসব কথা শুনে নিজের চুল নিজেই টেনে ধরলো ক্রীতিক,অরুর উপর চরম বিরক্ত হয়ে ক্রীতিক রাশভারী গলায় বললো,
— তুই কি পা’গল অরু? নিজের অনাগত বাচ্চাকে কেন আমি নষ্ট করতে বলবো? হোয়াই? এটা তুই ভাবলি কি করে, সেটা আমায় বল? আচ্ছা সত্যি করে বলতো তোর ব্রেইন কোথায় থাকে?

— তাহলে কেন করলেন এটা বলুন?

অরুর প্রশ্নের জবাবে ক্রীতিক রেগেমেগে বলে,
—- আমি কি জানতাম ইডিয়েট?

ক্রীতিকের কথায় ঝাঁজিয়ে ওঠে অরু, কাঁদতে কাঁদতে আহত সুরে বললো,
—- বাচ্চাটা মনে হয়না আর টিকবে।

— টিকবে না মানে? এক্ষুনি ডক্টরের কাছে যাবো আমরা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি, জাস্ট ফাইব মিনিটস বেইবি।

অরু হকচকিয়ে উঠে বললো,
— কিন্তু এখনো তো সকাল হয়নি, এই সময় ডক্টর কোথায়?

অরুর বাক্যটুকু শেষ হওয়ার আগেই ক্রীতিক ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে গম্ভীর গলায় জবাব দিলো,
—- সেটা তোর না ভাবলেও চলবে।

*************************************************

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আজ সবার প্রথমে ডাইনিং এ হাজির হয় সায়র আর নীলিমা। সায়র আগে আগে ছিল আর নীলিমা পেছনে। ও যখন হাই তুলতে তুলতে ডাইনিং এর দিকে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই নজরে পরে ক্রীতিক আর অরুকে। সাধারণত ভ্যাকেশনে আসার পর থেকে ক্রীতিক আর অরুই একমাত্র জুটি যারা সবার শেষে ডাইনিং এ হাজির হতো। ক্রীতিক নিজে বেলা করে ঘুমাতো দেখে, অরুকেও জোরজবরদস্তি করে নিজের কাছে আটকে রাখতো। অথচ আজ সূর্য একেবারে পশ্চিম আকাশে উদয় হওয়ার মতোই অরু ক্রীতিক সবার আগে ডাইনিং এ। শুধু ডাইনিং এ বললে ভুল হবে, অরুকে পাশে বসিয়ে রেখে ক্রীতিক নিজ হাতে ফ্রুটস খাওয়াচ্ছে ওকে, ব্যাপারটা পুরোপুরি সন্দেহজনক। তাই ডাইনিং এ এসে বসতে বসতে সায়র শুধালো ,
—- সূর্য আজ কোন আকাশে উদয় হলো জেকে? কাল রাতেই দেখলাম বউ কে ধমকাচ্ছিস, আর এখন পাশে বসিয়ে ফ্রুটস খাওয়াচ্ছিস? বাহ বাহ।

সায়রের কথার বিপরীতে ওর দিকে গরম চাহনি নিক্ষেপ করে, ক্রীতিক ক্ষুব্ধ গলায় বলে,
— শাট আপ, শী ইজ প্রেগন্যান্ট উইথ মাই বেইবি, ইডিয়েট।

ক্রীতিকের কথায় শুনশান নীরবতায় ছেয়ে গেলো পুরো লিভিং রুম, কারও মুখে কোনো রা নেই, কেবলই চামচ নাড়ার টুংটাং আওয়াজ। এমতাবস্থায় ফট করেই অরুর নিকট এগিয়ে গিয়ে নীলিমা বেকুবের মতো বলে ওঠে ,
—- কিরে অরু, তুই না বলেছিলি ক্রীতিক ভাইয়া বাচ্চা নিতে মোটেই ইচ্ছুক নয় তাহলে হলো টা কি করে?

অরু গাল ভর্তি ফ্রুটস চিবুতে চিবুতে জবাব দিলো,
— ভুল করে।

অরু কথাটা বলতেই ঠোঁট টিপে কৌতুক মিশ্রিত হাসি হাসলো সায়র, হাসতে হাসতে ক্রীতিককে উদ্দেশ্য করে সায়র বললো,
— তুই আজকাল এসবেও ভুল করিস ভাই?

ক্রীতিক জবাব দিলো না, উল্টো নিজের মাথামোটা বউটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরু পাপ্পি আইস করে তাকিয়ে আছে ক্রীতিকের পানে, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা সে। সায়র ক্রীতিককে খোঁচা মে’রে আরও দু’একটা কথা শোনাবে, তার আগেই ওদের মাঝে আগমন ঘটে অর্ণব আর এলিসার।

এলিসার কাঁধে ভর করে মুমূর্ষু রোগীর মতো হাটছে অর্ণব, ওকে এভাবে হাটতে দেখে সায়র উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে ওঠে,
—- কি হয়েছে তোর অর্ণব?

অর্ণব কিছু বললো না, এলিসা জবাব দিলো,
— কি জানি কি স্ট্রিট ফুড খেয়ে, ডিসিন্ট্রি বাঁধিয়েছে, কাল থেকে কতবার গিয়েছে তার হিসেব নেই, তাই রাতেই হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলাম।

পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে সায়র বলে,
— কি বলিস , আমাদের কেন জানালি না? রাস্তা ঘাটে কোথাও কাজ সারেনি তো আবার?

অর্ণব দাঁত কটমটিয়ে সায়রের পানে অগ্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
—- শালা বেশি কথা বলিস তুই।

অর্ণবের ঝাড়ি খেয়ে থামলো সায়র, এবার অর্ণবের চোখ গেলো ক্রীতিক আর অরুর দিকে, ওদের পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা মাত্রই এলিসার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো অর্ণব, ওকে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে এলিসা ঠোঁট উল্টে শুধালো,
— কি ব্যাপার এতোক্ষণ তো হাঁটতেই পারছিলি না, এখন ওমন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলি যে, ক্লান্ত লাগছে না?

কাঁধ ঝেড়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে অর্ণব বললো,
— নাহ এখন ঠিক আছি, আয় জান তুই ও আমার পাশে এসে বস, কাল থেকে বড্ড খাটুনি গিয়েছে তোর।

সায়র খেতে খেতে অবাক দৃষ্টিতে অর্ণবকে পরখ করে বললো,
—- কি অদ্ভুত ডিসিন্ট্রি রে বাবা, এইটুকুর মধ্যে সেরে গেলো?

সায়রের কথার জবাবে অর্ণব কথা ছুড়বে, তার আগেই অরুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পরলো ক্রীতিক।
সায়র ঘাড় ঘুরিয়ে ক্রীতিকের পানে চেয়ে শুধালো,
— তুই আবার বউ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?

সায়রের কথার জবাব না দিয়ে, ক্রীতিক ওদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— আমরা আগামী কাল তোদের সাথে ইউ এস এ ফিরছি না, ডক্টর অরুকে সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে বলেছে, এই মূহুর্তে জার্নি করা পসিবল নয়। তাই আমরা আর কিছুদিন পরে ফিরবো।

কথা শেষ করে অরু সমেত রুমের দিকে পা বাড়ায় ক্রীতিক।

এদিকে সায়রের সব খটকা থেকেই যায়, ও খাবার চিবুতে চিবুতে একা একাই বিড়বিড়ায়,
— অদ্ভুত তো, আমার বউকে তো ডক্টর বেড রেস্টে থাকতে বললো না,অথচ ওর বউকে বললো। কালকেই গিয়ে ডক্টর ব্যাটাকে ধরতে হবে।
*******************************

বিগত দিন গুলোর কথা ভেবে আরও একবার প্রানোচ্ছ্বল হাসি হাসলো অরু। ঠিক সেসময় দরজার পাসওয়ার্ড খোলার পিক পিক আওয়াজ হলো নিচ তলা থেকে, বোধ হয় ক্রীতিক এসেছে,সেই ভেবে তাড়াহুড়ো করে আবারও কম্ফোর্টারের নিচে গিয়ে ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো অরু।

উদ্দেশ্য একটাই, তার শক্ত চওড়া উষ্ণ বুকে মুখ লুকিয়ে একটু খানি আবেশিত ওম গ্রহন করা। তার মাতাল মাতাল স্যান্ডাল উড পারফিউমের গন্ধটা নিজের সর্বাঙ্গে ধারণ করা। এই ছোট্ট জীবনে প্রাপ্তির ঝুড়ি পরিপূর্ণ, আর কিইবা চাই?
” সমাপ্ত”