এক ফালি প্রণয় পর্ব-২৬+২৭

0
68

#এক_ফালি_প্রণয়|২৬|
#শার্লিন_হাসান

সন্ধ্যায় চৌধুরী বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয় শিকদার পরিবারের গুটি কয়েক সদস্য। তার মধ্যে আছেন, শরীফ শিকদার, সিনথি,তূর্ণ, পূর্ণ এবং শূন্য। আর কেউই যায়নি। আদ্রিশ বলেছে রোদকে আসার জন্য। রোদ না করে দিয়েছে। আলতাফ পারভেজ চৌধুরীর সাথে শরীফ শিকদারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

কোল্ড ড্রিংয়ের গ্লাাটা হাতে নিয়ে দাঁড়ায় আদ্রিশ। কয়েক চুমুক দিয়ে সিনথির দিকে তাকায়। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, “শিকদার পরিবারে তোমার বিয়ে হয়েছে?”

“হ্যাঁ তোমায় কী বললাম? তুমি গ্রুপ পিকচার দেখোনি?”

“হ্যাঁ! পিকচার দেখেই তো দেশে আসলাম।”

“তা আংকেলের সাথে রাগ করে তো চলে গেলে জার্মান। এখন রাগ কমেছে?”

“না!”

গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয় আদ্রিশ। তখন সিনথি বলে, ” তা আমার কোন ননদকে পছন্দ হলো যে জার্মান থেকে চলে আসলে?”

“আছে সেরকম কিছু না।”

তখন পূর্ণ উপস্থিত হয় সেখানে। আদ্রিশের সাথে হ্যান্ডশেক করে। তারা মূলত বিজন্যাস পার্টনার সেই হিসাবে পরিচয়, বন্ধুত্ব। এছাড়া শিকদার পরিবারের কাউকেই তেমন চিনে না আদ্রিশ।

আলতাফ পারভেজ চৌধুরী শরীফ শিকদারের সাথে বসে নিরিবিলি কথা বলছেন। তখন শরীফ শিকদার বলেন, “আপনার ছেলে যদি কখনো আসল কাহিনী শোনে তাহলে কী হবে ভেবেছেন?”

কপালের ঘাম টিস্যু দিয়ে মুছেন আলতাফ পারভেজ চৌধুরী। মিহিত কন্ঠে শুধায়, “বন্ধু হয়ে বন্ধুর সাথে বেঈমানী করেছি সেটা আমি অস্বীকার করবো না। তবে আপনার তো রক্তের বোন ছিলো আপনি কেন এসব করলেন?”

“খানদের সাথে তেমন বনিবনা হয়না আমার। তীর্থ খানকে তেমন পছন্দ করতাম না। তারউপর আমার বোনকে নিয়ে বিয়ে করলো তো আমার দুই চোখের বিষ হলো। আমার বড় ভাই কীভাবে জেনো তাকে সহ্য করতো। মে’রে দিলাম সেটা কথা না কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি তো পেলাম না ওই তাহসিনার থেকে।”

“আমার ছেলে কীভাবে শুনেছে তাহসিনা বেঁচে আছে। দেশে চলে এসেছে! আমাকেও একবার জিজ্ঞেস করেনি।”

“পূর্ণ আমায় ওইদিন থ্রেট দিয়েছে। আমি পূর্ণকে ব্যবহার করেছি ঠিকই কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ওই তাহসিনাকে কোনভাবে সরাতে পারলাম না।”

“পাঁচ বছর আগে তো গোডাউনে রেখে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিলাম নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে নিলো আপনার ভাই।”

“ধুর! সেও তাহসিনার সাথে বেঁচে গিয়েছিলো। মেরেছি তো আমি!”

“হুয়াট!”

“শুট করেছিলাম।”

কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বলে শরীফ শিকদার। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী কোল্ড ড্রিং রেখে বলেন, ” আপনি!! ওনার দুই ছেলে জানলে!”

“পূর্ণ বিশ্বাস করে তাহসিনার জন্য ওর বাবা মা-রা গেছে।”

★★★

তূর্ণ আজকে মোটামুটি ভালো টাইম স্পেন্ড করছে। কিন্তু সিনথি তাকে ইগনোর করেছে পুরো সময়টা। একটা পিকচার ও তুলতে আসেনি। তূর্ণর সেসবে হেলদোল তেমন একটা নেই। বুকটা যে এখনো পুড়ছে! পূর্ণকে পুরো দমে ইগনোর করছে সে। কিন্তু লাভ কী ইগনোর করে? রোদকে তো আর সে পাবে না। ইশশ! চোখের সামনে একদিন রোদ অন্য কারোর হয়ে যাবে।

বুকের বা পাশটায় হাত রাখে তূর্ণ। চিনচিন ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার।
“আমার প্রণয় আমার চোখের সামনে অন্য কারোর সঙ্গে বাঁধবে ঘর! যেমন ভাবে আমি বাঁধলাম।”

“ভুল করেছিস তুই তূর্ণ! চুপ করে না থেকে ভালোবাসাটা প্রকাশ করতি। অন্তত রোদের থেকে তো জানতে পারতি পূর্ণ, রোদের মাঝে এমন কিছুই নেই।

ফারিহা চৌধুরী এবং আফিয়া ইসলাম দু’জন সিনথি এবং পূর্ণর সাথে কথা বলছেন। তূর্ণ এখানে নেই৷ পূর্ণ বুঝেছে তার ভাই সিনথির সাথেও দূরত্ব তৈরী করে নিয়েছে। কেনো জানি বেশ খারাপ লাগছে পূর্ণর। কী দরকার ছিলো এমন প্রতিশোধের নেশা মস্তিষ্কে ধারণ করার? শরীফ শিকদারের কথা শোনাটা কী খুব জরুরী ছিলো? কিন্তু সে তো বাবার সাধের,স্বপ্নের গড়ী ইন্ডাস্ট্রির রক্ষার জন্য এমনটা করেছে। নাহলে তো শরীফ শিকদার ইন্ডাস্ট্রি বন্ধের পাশাপাশি তার ক্যারিয়ার ও ধ্বংস করে দিতো। সব কেমন ঘোলাটে লাগছে। এলোমেলো মনে হচ্ছে পূর্ণর কাছে।

আলতাফ পারভেজ চৌধুরী এবং আদ্রিশ তাদের ক্লায়েন্ট এবং স্পেশাল গেস্টদের সাদরে গ্রহন করছেন। চারদিকে সুন্দর একটা অনুষ্ঠানমূখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর আদ্রিশ তূর্ণর কাছে যায়। তাকে দেখে বলে, ” ব্রো! আমার কাজিন সিনথিকে বিয়ে করে তুমি আমার বড় উপকার করেছো।”

তূর্ণ ভাবছে সিনথি হয়ত আদ্রিশ কে পছন্দ করতো বা জ্বালাতো। কিন্তু সিনথি তো বললো এমন কিছুই নেই। প্রশ্ন বোধক চাহনি দেয় তূর্ণ। তখন আদ্রিশ বলে, “তোমাদের বিয়ের পিকচার গুলোর কথা বলছি।”

“বিয়ের পিকচারে কী হয়েছে?”

“একজনকে ভালো লেগেছে।”

“এটা বলে দিলেই হতো। আমি কী না কী ভেবেছি।”

“ভাবতে যাও কেন?”

মাথা নাড়ায় তূর্ণ। আদ্রিশ হেঁসে দিয়ে বলে, “তা পূর্ণকে বিয়ে করাচ্ছো কবে?”

“সে যদিন বলে তার পরের দিন।”

“তাহলে খুব শীঘ্রই দাওয়াত পাচ্ছি আমরা।”

“হয়ত! তা তোমার বিয়ের খবর কী?”

“পনেরো দিন পর শুনবে আমার বিয়ে ঠিক।”

” এ তো বেশ ভালে খবর।”

আদ্রিশ হাসে। তূর্ণকে নিয়ে ভিতরের দিকটায় যায়। মাইক্রোফোন নিয়ে আদ্রিশ তার প্রজেক্ট কমপ্লিট হওয়ার ব্যপারে বলে।
” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ এভ্রিওয়ান টু কাম টু ডেইস পার্টি। উই অল গট এ বিউটিফুল মোমেন্টস। পাঁচটা বছর জার্মানি তে ছিলাম আমি। বিজন্যাস নিয়ে কোনপ্রকার ইন্টারেস্ট আসেনি। কাজ করার মনোবল পাইনি আমি! আমি ফাস্ট প্রজেক্ট এটা এবং এটা সুন্দর ভাবে কমপ্লিট হয়েছে। এর পেছনের ক্রেডিট অবশ্যই আমি শুধু একজনকেই দিবো।”

সবাই বেশ আগ্রহ নিয়ে বসে আছে কার নাম বলবে আদ্রিশ। সবার আগ্রহ দেখে আদ্রিশ বলে, ” সী’জ মাই পাওয়ার, মাই এভ্রিথিং! সী’জ মাই লাভ, মাই ফিউচার ওয়াইফি!”

তখন পূর্ণ আদ্রিশের কাছে এসে বলে, ” সে একজনটা কে আদ্রিশ?”

“সারপ্রাইজ!”

সিনথির ব্যপারটা ভালোলাগে। কী সুন্দর ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে ভালোবাসা প্রকাশে দ্বিধাবোধ করেনি আর না কৃপণতা করেছে। শুধু নামটাই প্রকাশ করেনি। আসলেই মেয়েটা লাকী। কথাগুলো ভেবে তূর্ণর দিকে তাকায় সিনথি।

রাতের ডিনার শেষে শিকদার পরিবারের সবাই চলে আসে। তূর্ণ এবং সিনথি থেকে যায় শুধু।

পূর্ণর চোখে ঘুম নেই। ভাইয়ের চিন্তা তার মাথায় ঢুকে গেছে। তিশাকে বলেছে তাই কফির মগ রুমে দিয়ে গেছে।

রোদ ল্যাপটপের স্কিনে তাকিয়ে আছে। সে আদ্রিশের লাইভ দেখছিলো এতোক্ষণ। ব্যপারটা ভীষণ ভালো লেগেছে রোদের।

পূর্ণর কথা মাথায় আসতে হাসে রোদ।
“পূর্ণ ভাইয়া জানতাম তো ভালোবাসার খেলায় মেতে উঠবে তুমি। আমিও সায় দিয়েছিলাম একটু আধটু। বোঝাচ্ছিলাম তোমার প্রতি আমি উইক। এ্যান্ড তূর্ণ ভাইয়াও বিশ্বাস করেছে। নাহলে তূর্ণ ভাইয়া আমায় বিয়েটা করতো হয়ত বা। চাইলেও আমি কিছু আটকাতে পারতাম না। আলতাফ পারভেজ চৌধুরীর মুখোশ টেনে ছিঁড়ে ফেলা বাকী আছে তো। শরীফ শিকদার! আমার বাবার আপন রক্তের ভাই! আমার শক্তি চলে এসেছে। তাকে দেখলে আমি ভরসা পাই। আমার ভালোবাসা সে।”

★★★

পার্টির কাজ শেষ করে ফ্রেশ হয়ে রাত তিনটার দিকে বেলকনিতে দোলনায় বসে আদ্রিশ। আকাশে গুটি কয়েক তারা দেখা যাচ্ছে। আজকে চাঁদ উঠেনি। আদ্রিশ ❝এক ফালি প্রণয়❞ নামের ডায়েরিটায় হাত ভোলায়। ডায়েরিটা উল্টাতে চোখ পড়ে একটা পুরোনো লেখা। কালিটা কিছুটা লেপ্টে গেছে। ” নবিতা এ্যান্ড সিজুকা” “মিসেস চৌধুরানী তাহসিনা” “তাহসিনার খানসাহেব” আদ্রিশ পরের লেখাটা বুঝেনি। হয়ত তাহসিনাদের খান বংশ তাই আদ্রিশ কে এখানে খান সাহেব উপাধি দিয়েছে নিজে চৌধুরানী উপাধি নিয়েছে। সেই ছোট্ট রোদেলা এভাবে লিখতো?

“আমি রুপকথার কোন রাজকন্যা নই তবে আমার বাবার রাজকন্যা ছিলাম। আমি সবসময় চাইতাম একটা রাজপূত্র আসুক আমার রাজমহলে এবং বাবার রাজকন্যা এই আমির জীবনে। সত্যি,সত্যি একদিন আগমন হলো সেই রাজপূত্রর। কিন্তু সে আমাকে বেশী পাত্তা দিতো না। ভীষণ আবেগী ছিলাম আমি। কী জানি তখন ওই কঠোর মনের মানুষটাকে কোমল হৃদয়ে স্থান দিয়ে দিয়েছি। পরে ভেবেছি আমার মতো সফট হার্টের মিষ্টি মেয়ের সাথে এমন কাঠখোট্টা, কঠোর হৃদয়ের মানুষটা একদম যায় না। আমার জন্য চাই সফট হার্টের কেউ! কিন্তু সৃষ্টি নিয়মটা বোধহয় এমনি। মানুষ তার বিপরীত মানুষের প্রেমে পড়ে বা ভালোবাসে৷

#চলবে

#এক_ফালি_প্রণয়|২৭|
#শার্লিন_হাসান

“আমি রুপকথার কোন রাজকন্যা নই তবে আমার বাবার রাজকন্যা ছিলাম। আমি সবসময় চাইতাম একটা রাজপূত্র আসুক আমার রাজমহলে এবং বাবার রাজকন্যা এই আমির জীবনে। সত্যি,সত্যি একদিন আগমন হলো সেই রাজপূত্রর। কিন্তু সে আমাকে বেশী পাত্তা দিতো না। ভীষণ আবেগী ছিলাম আমি। কী জানি তখন ওই কঠোর মনের মানুষটাকে কোমল হৃদয়ে স্থান দিয়ে দিয়েছি। পরে ভেবেছি আমার মতো সফট হার্টের মিষ্টি মেয়ের সাথে এমন কাঠখোট্টা, কঠোর হৃদয়ের মানুষটা একদম যায় না। আমার জন্য চাই সফট হার্টের কেউ! কিন্তু সৃষ্টি নিয়মটা বোধহয় এমনি। মানুষ তার বিপরীত মানুষের প্রেমে পড়ে বা ভালোবাসে৷ আমিও আমার বিপরীত একজনের প্রেমে পড়লাম। তবে চিত্তে প্রেমটা বেশীক্ষণ স্থায়ী রাখলাম না। শুনেছি প্রেম ফুরিয়ে যায় এবং একটা সময় তা হারিয়ে যায়। কিন্তু; ভালোবাসা কখনো হারায় না আর না ফুরিয়ে যায়। হয়ত পরিস্থিতির কারণে, সময়ের সাথে কারণে মানুষগুলো বদলে যায়। আমি চিত্ত থেকে প্রেম নামক অনুভূতিকে নির্বসিত্তা করে চিত্তে ভালোবাসা নামক পবিত্র অনুভূতি বসান করলাম। জানতাম না এর পরবর্তীতে কী হবে। আদৌ আমি কী করলাম! আমার ভালোবাসাকে আমি কখনো পাবো তো? জানা ছিলো না! আদ্রিশ ভাইয়ার আশেপাশে থাকলেও সে আমায় তেমন পাত্তা দিতো না কথাও তেমন বলতো না। আমার এটা মোটেও সহ্য হতো না। একদিন মনে আছে তাঁদের বাড়ীতে গিয়েছিলাম। আলতাফ আংকেল আমায় হাত ধরে আদ্রিশ ভাইয়ার কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। ভাইয়ার হাতে একগুচ্ছ টাটকা লালগোলাপ ছিলো। সত্যি বলতে তার ফর্সা হাতে লাল গোলাপ এতো সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছিলো যে, মনে হয়েছিলো আমার মানুষটা গোলাপগুচ্ছ তার হাতে স্থান দিয়েছিলো বলে গোলাপগুচ্ছ এতো সুন্দর লেগেছিলো। গোলাপ আমার পছন্দ! চাইলে কিন্তু আমি গোলাপগুচ্ছকে সুন্দর বলতে পারতাম! একদম না! আমার সুশ্রী পুরুষের কাছে ওই একগুচ্ছ গোলাপ ও হার মানে। ভালোবাসি তাকে! চৌধুরী বাড়ীতে তখন আমার ঘনঘন যাওয়া হতো মূলত আদ্রিশ ভাইয়ার জন্য। এতো যেতাম তাও তার হেলদোল ছিলো না। ফারিহা মামনির থেকে তার জন্য কফি নিয়ে যেতাম আরো কত কী! হুট করে মনে হলো আমার সুশ্রী পুরুষ আমায় একটু কেয়ার করুক। তাই তো একদিন ভাইয়া রুমে বসে কাজ করছিলো। আমি কফি নিয়ে গিয়েছিলাম অন্যসব দিনের মতো। কফিটা ঠান্ডাই ছিলো। তার রুমে প্রবেশ করে ইচ্ছে করে মগটা পায়ের কাছে ফেলেছিলাম। তার রিয়েকশন দেখার জন্য। সে ব্যকুল হয়েছিলো। তার চোখেমুখে আমার জন্য চিন্তা প্রকাশ পেয়েছিলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ইশশ কী নির্লজ্জ প্রণয়ীনী আমি। আমার কাছে তেমন যোগ্যতা ছিলো না তখন তবে ছিলো ❝এক ফালি প্রণয়❞ ছিলো। বলে না, ‘ছোট,ছেট বালি কণা, বিন্দু, বিন্দ জল গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। তেমনি আমার বিশ্বাস ছিলো আমার ❝এক ফালি প্রণয়❞ একটা সময় তার হৃদয়ে গেঁথে সেই প্রণয় তার চিত্তের বিশালতায় থাকবে। ভাইয়াকে জ্বালাতাম আমি। কারণে-অকারণে! আমাদের একটা সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। ওই বড় ছেলেটা ছোট্ট একটা মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করেছে। সে পুনরায় যখন জার্মান গিয়েছিলো তিনমাসের জন্য সেদিন আমি কেঁদে দিলাম। ভীষণ কেঁদেছি। ভাইয়া আমায় ভুলে যাবে না তো? জার্মান যাওয়া পর তার সাথে কলে কথা হয়েছিলো। আমি ছিতকাদুনির মতো করে বলেছিলাম, “আমায় ভুলে যাবে না তো?”
ভাইয়া যখন বলেছিলো, ” তোমায় ভুলে যাওয়ার মতো সাধ্য কী আমার আছে? তাহসিনার আদ্রিশ তাহসিনারই থাকবে। যত আলোকবর্ষ দূরে থাকুক না কেন।”

সেদিন আমার মন খারাপ, কান্না নিমিষেই দূর হয়ে যায়। কী সুন্দর কেটেছে দিনগুলো। হুট করে বাবার পেছনে কারা জেনো লেগেছিলো। আমাদের সুন্দর পরিবারটা শেষ করার পেছনেও বলা যায়৷ বিজন্যাস নিয়ে জামেলা চলছিলো। তখন আবার আদ্রিশ ভাইয়া দেশে এসেছিলো। এতো সমস্যার মাঝে আমার আনন্দ জেনো দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছিলো। আমাদের পেছনের শত্রু নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা ছিলো না। বলা যায় মাথা থেকে বিষয়টা উড়ে গিয়েছিলো। একদিন সন্ধ্যায় বাবা বাসায় এসেছিলো অনেকটা ক্লান্ত হয়ে। জানতে পেরেছি এক্সিডেন হতে গিয়েও হয়নি। বাবা অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। ”

আদ্রিশ আর লেখা পায়নি। হয়ত এরপরের দিনগুলোতে ডায়েরি লিখেনি। লিখবে কীভাবে? রোদের বাবা মা মা-রা গিয়েছিলো রোড এক্সিডেন্টে। রোদ ভীষণ ভে’ঙে পড়েছিলো। আদ্রিশের মনে আছে। সে কী কান্না করেছিলো মেয়েটা। ফারিহা চৌধুরী রোদকে চৌধুরী বাড়ীতে নিয়ে যান। পূর্ণর বাবা ও তখন রোদের খেয়াল রাখতো। খোঁজ খবর নিতো। কখনো শিকদার বাড়ীতে যেতো তো চৌধুরী বাড়ীতে। কী জানি হুট করে একদিন রোদ গুম হয়ে যায়। প্রায় তিনদিন নিখোঁজ ছিলো। আদ্রিশ পা’গলের মতো তাকে খুঁজে ছিলো পায়নি। কিছু,কিছু কারণে আলতাফ পারভেজ চৌধুরীর উপর সন্দেহ আসে তার। রাফির বাবা,শরীফ শিকদার এদের উপর ও সন্দেহের উৎপত্তি হয়। কিন্তু যখন খবর পেয়েছে রোদকে কোন গোডাউনে আটকে রাখা হয়েছে। সে পা’গলের মতো ছুটে গিয়েছিলো। তখন শুধু জ্বলন্ত গোডাউন দেখেছিলো আর কিছুই না। আদ্রিশের মনে পড়ে সেদিনের কথা। বুকের বা পাশটায় হাত রাখে সে! চোখের সামনে তাহসিনা নামক তার চিত্তের একমাত্র প্রণয়ীনীকে পুড়তে দেখেছিলো। কিছুই করতে পারেনি! তারপর থেকে আলতাফ পারভেজ চৌধুরীর সাথে তার সম্পর্ক না-ই য়ের মতো। টিকেট কেটে জার্মানিতে পাড়ি জমায় আদ্রিশ। তবে তার বাবা,রোদের মামু,রোদের চাচ্চু সবাইকে বেশ ভালো ভানে শাসিয়ে গিয়েছিলো আদ্রিশ।

ঠিক পাঁচটা বছর পর সিনথির বিয়ের গ্রুপ ফটো দেখে রোদকে চিনতে পারে আদ্রিশ। শিকদার পরিবারে বিয়ে হয়েছে এটা জানা ছিলো। তবে পিকচার থেকে রোদের ব্যপারে সিনথিট থেকে জেনে শিওর হয় আদ্রিশ। দেশেও খোঁজখবর নিয়েছে সে। তার একসপ্তাহ ও লেইট করেনি সে। দেশে এসেছে। রোদের মুভমেন্ট ফলো করতো আগে থেকেই। সেদিন খান বাড়ীতে রোদের যাওয়ার খবর আসে তার কাছে। রোদ যখন রাস্তায় হাঁটে তখন আদ্রিশ দৃষ্টি রাখে তার উপর। এতো তাড়াতাড়ি রোদের সামনে ধরা দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না তার। তবে সেদিন পেছন দিয়ে যে কেউ তাকে মার-তে চেয়েছে সেটা বুঝেছে আদ্রিশ। গাড়ীর নাম্বারটা ভালো করেই চিনে রাখে।

আদ্রিশ ডায়েরিটা নিয়ে রুমে আসে।

★★★

পরের দিন সকালে তূর্ণ, সিনথির সাথে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার সময় আদ্রিশের দেখা হয়। দু’জনে কেমন চুপচাপ! আদ্রিশের দৃষ্টিতে আসে বিষয়টা। হয়ত ঝগড়া হয়েছে তূর্ণ বেচারা রাগ ভাঙাতে পারেনি সিনথির। ভাবতে আদ্রিশ তূর্ণর পাণে তাকিয়ে হাসে।

পার্টি অফিসে বসে আছে পূর্ণ। আজকাল তার মনটা একদম ভালো যাচ্ছে না। সিনথি তূর্ণর বিষয়টা না চাইতেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে পূর্ণর। বাবার পর তো বড় ভাইয়ের ছায়া। তূর্ণ যতটুকু পেরেছে দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করেছে। পূর্ণ ভাবছে তূর্ণর কাছে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সে মুখ কী আর তার আছে?

শরীফ শিকদারের ব্যপারটা পূর্ণ আমলে নেয়নি। সে আর চাইলেও কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তার বাবার মৃ’তুর জন্য আসলে কে দায়ী? অনেক কিছুই তো আড়ালে ঢেকে গেছে। এতোদিন পূর্ণ ভাবতো এটা রোদের জন্য হয়েছে। রোদকে বাঁচাতে গিয়েই তো গোডাউনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে তার বাবা।
আসলেই কী সত্যি তাই? পাঁচ বছর আগের সব অতীত জেনো মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ করছে। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।

কেটে যায় একসপ্তাহ। রবিবার বিকেলে অফিস শেষ করে আলতাফ পারভেজ চৌধুরী এবং শরীফ শিকদার একটা ক্যাফেতে বসে কথা বলছেন। শরীফ শিকদারের মন মানসীকতা তেমন ভালো যাচ্ছে না। তূর্ণকে নিয়ে সে চিন্তা করেনা। ছেলেটা কুল! কিন্তু পূর্ণ! যদি কখনো জানে তার বাবার খু’নি আসলে তার বাবার রক্তের ভাই ছিলো। তাহলে সে রক্তের সম্পর্কের কথা ভুলে যাবে। শরীফ শিকদার কিছুতেই নিজের খোলস ছেড়ে বের হতে চায় না।

অন্যদিকে আলতাফ পারভেজ চৌধুরী রোদকে নিয়ে চিন্তিত। মেয়েটা তো সব জানে! তার মামুর খু’নিদের কেও বেশ ভালো করে চিনে। আপাতত দু’জনের চিন্তার বিষয় রোদ। সে মুখ খুলে একবার আদ্রিশ বা পূর্ণর কাছে কিছু বললে সব শেষ। কেউই ছেড়ে দিবে না। বাবা,চাচা কিছুই পরোয়া করবে না।

“বুঝলেন চৌধুরী সাহেব! এই তাহসিনা ছোট থেকেই পথের কাটা। ওটার কী দম ভাবা যায়? এমন কত বার যে চেষ্টা করলাম নিজে মারতে,অন্যকে দিয়ে মারতে বারবার বেঁচে যায়।”

“এই মেয়ে আমার ছেলেকে কিছু বললে তো হলোই! সোজা কপাল বরাবর শুট করবে আমার ছেলে আমাকে। তার কাছে ন্যায় বিচার আগে। ছেলেটা জানি কার মতো হয়েছে। বাপের শরীরে বেইমানির রক্ত বইছে আর ছেলেটা!!”

“সেসব ছাড়ুন চৌধুরী সাহেব পূর্ণকে আমি ব্লাকমেইল করে ইউজ করলাম। লাভটা হলো কী? না রোদ মরলো না ইন্ডাস্ট্রি পেলাম। উল্টো নিজে ফেঁসে গেলাম। ওই ছেলের প্রেমিকা আছে কিন্তু আমার জন্য তাকে রোদের সাথে ভালোবাসার অভিনয় করতে রাজী করিয়েছিলাম। শেষমেশ কিছুই হলো না! দু’জন দুই পথে হাটা ধরলো।”

“আপনি আসলে বোকা শিকদার সাহেব।”

“কী?”

” তাহসিনা খানম রোদেলাকে আমার ছেলে আদ্রিশ পা’গলের মতো ভালেবাসতো। মেয়েটাও ভালোবাসে তাকে। তার বাবা থাকতে তো এমনিতে কথার ছলে বিয়ের প্রসঙ্গ ও তুলেছিলো।”

“আপনি আমায় আগে জানাবেন না?”

“এতো কিছু মাথায় থাকে নাকী। আপনি কী আমায় আপনায় পরিকল্পনা নিয়ে বলেছেন নাকী?”

“আমার ও এতো কিছু মাথায় থাকে না।”

“মাথাটা দেওয়ালে বা’রি মারুন।”

কন্ঠে গম্ভীর টেনে কথাটা বলে আলতাফ পারভেজ চৌধুরী। শরীফ শিকদার ও কপাট রাগ দেখিয়ে বলেন,
“আপনার কথায় শয়তান ভর করেছিলো মস্তিষ্কে। এখন আমি হারে,হারে বুঝছি।”

“বুঝতেই থাকুন। আপনি আসলে কোন কাজের না শিকদার সাহেব।”
কথাটা শেষ করে আলতাফ পারভেজ চৌধুরী বিদায় নিয়ে বাড়ী আসেন। বাড়ীতে আসতেই দেখেন ফারিহা এবং আদ্রিশ কিসের জেনো লিস্ট বানাচ্ছে। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী সেসবে কান দেয়নি। এমনিতে তার জীবন মরনের প্রশ্ন আছে।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যাবে তখন ফারিহা চিৎকার করে বলে, “শুনেছো? আদ্রিশের বিয়ে এই সপ্তাহে।”

“আলহামদুলিল্লাহ! পাত্রীটা কে?”

“আগে যাকে ফিক্সড করা ছিলো সেই।”

“তাহসিনা?”

“হ্যাঁ! তুমি বলো বিয়েটা হলে ভালো হয়না?”

“হলে ভালো হয় তবে না হলে আরো বেশী ভালো হয়।”

দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে আলতাফ পারভেজ চৌধুরী। আদ্রিশ সেসব আমলে নেয়নি। আগামী কালকে শিকদার বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব যাবে।

#চলবে