এক ফালি প্রণয় পর্ব-৩০+৩১

0
2

#এক_ফালি_প্রণয়|৩০|
#শার্লিন_হাসান

তূর্ণ হেঁসে সিনথির কোমড়ে হাত রেখে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ” তুমি সব ভুলে আমার হতে চাইলে আমিও আগলে নেবো। ভালোবাসারা ভালো থাকুক আমাদের কল্পনায় কিংবা আমাদের ছোঁয়ায়।”

সিনথি হাসে। তবে সে বাক্যটায় রোদকেও যে মিন করেছে বুঝেছে। ভালোবাসারা ভালো থাকুক কল্পনায়! হাহ্! সিনথি কিছু বলেনা। তবে বুঝেছে তূর্ণর ভালোবাসার গভীরতা। রোদের দিকে তাকিয়ে সিনথি শুধায়, “নিশ্চয়ই তুমি ভাগ্যবতী কন্যা! আমার ভালোবাসা একসময় তোমায় ভালোবেসেছিলো। পাগলের মতো ভালোবেসেছিলো। এক তরফা ভালোবাসা, প্রকাশিত ভালোবাসার তুলনায় ভীষণ ভয়ংকর হয়। প্রকাশ না করেও গভীরভাবে ভালোবাসা যায়।”

তখন তিশা সিনথির হাত ধরে রোদের কাছে নিয়ে যায়। সবাই মিলে সুন্দর একটা মূহুর্ত উপভোগ করে। বিকেলের দিকে তারা লিভিং রুমের একটা সাইড ডেকোরেশন করে। মেহেদী দেওয়ার জন্য। সিনথি কাজে ব্যস্ত তার শাশুড়ীদের সাথে। অরিন বিকেলে চলে গেছে। আগামী কালকে বিয়েতে আবার আসবে। সবার এতো সুন্দর কাটানো মূহুর্ত তবে শরীফ শিকদারের এসবে মন নেই। মন মরা হয়ে সোফায় বসে থাকেন তো কখনো রুমে গিয়ে শুয়ে থাকেন। পূর্ণ কে কিছুতেই ছাড়বেন না তিনি। এই পূর্ণর শেষ তিনি দেখে ছাড়বেন।

নিজের রুমের বেলকনিতে বসে গার্ডেনে চোখ ভোলাচ্ছেন শরীফ শিকদার। মাথা ভর্তি প্রতিশোধের নেশা! নতুন পরিকল্পনা করায় ব্যস্ত তিনি।

সন্ধ্যায় রোদ গোল্ডেন পাড়ের গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ী পড়েছে। তিশা,শিশা মিলে রোদকে মেহেদী পড়িয়ে দিচ্ছে। কিছু দূরে সোফায় তূর্ণ, শূন্য বসা। পূর্ণ এখানে আসেনি সে তার কাজে ব্যস্ত। সিনথি হাতের প্লেটে মিষ্টি নিয়ে তূর্ণদের কাছে আসে। শূন্য সিনথির থেকে কাঁটাচামচ দিয়ে একটা মিষ্টি নিতে,নিতে বলে,

“এটা তো বিয়ের মিষ্টি ভাবী। নতুন সদসস্যের আগমনের মিষ্টি খুব শীঘ্রই চাই আমরা।”

পেছন দিয়ে তিশা আসে। শূন্যর সাথে তাল মিলিয়ে বলে, ” আমায় ফুফি বানাও। আমাদের পরিবারে একটা ছোট বাচ্চা নেই।”

তূর্ণ উঠে দাঁড়ায়। ব্যস্ততা দেখিয়ে বলে, ” আমি গেলাম। আমার কাজ আছে।”

তখন শূন্য তার হাত ধরে টেনে বসিয়ে দেয় পাশে। তূর্ণর দিকে দৃষ্টি স্থির করে শূন্য। তূর্ণ সিনথিকে চোখের ইশারা করে চলে যেতে।
সিনথি ব্যস্ততা দেখিয়ে চলে যায় রোদদের কাছে। তূর্ণ শূন্যর দিকে তাকিয়ে বলে, “মুখে লাঘাম টানো শূন্য। আমি লজ্জা পাই তো।”

“তোমার আর ভাবীর মাঝে বেশী মান অভিমান চোখে পড়ে। আমার জানা নেই এর কারণ। তবে একটা কথা মনে রেখো জীবন কারোর জন্য থেমে থাকে না।”

“কিছু মানুষ হৃদয়ে থাকে তবে ভাগ্য না।”

“হ্যাঁ! সেইজন্য এসব ভাবনা দূর করে নিজের সুন্দর জীবন,সুন্দর ভবিষ্যতে ফোকাস করো।”

বিনিময়ে তূর্ণ হাসে। আদ্রিশের কাছে কল দেয় সে। কিছুক্ষণ কথা বলে শূন্যকে দিয়ে ফোন রোদদের কাছে পাঠায়। আ্দ্রিশ রোদকে দেখছে। মেয়েটা বড্ড পাষাণ! একটু কথা বলেনা তার সাথে। তবে আগামী কালকে সব হিসাব গুছিয়ে নেবে আদ্রিশ।

★★★

সকাল বেলা রোদের ঘুম ভাঙে আদ্রিশের কলে। বেশ বিরক্ত বোধ করে রোদ। ফোনের স্কিনে আদ্রিশের নাম্বার দেখে ব্রু জোড়া প্রসারিত করে তাকায়। আজকের কল স্কিপ করার জো খুঁজে পাচ্ছে না সে। রিসিভ করে কানে দিতে অপর পাশ থেকে আদ্রিশ শুধায়, “চৌধুরানীর অভিমান ভাঙানোর উপায় যদি বলতেন?”

“যদি বলে দিই তাহলে আপনি প্রেমিক হিসাবে একবারে শূন্য।”

“আমি প্রেমিক হতে চাইনা। আমি পারফেক্ট স্বামী হতে চাই।”

“তাহলে ঠিক আছে দেখ হবে বাসর ঘরে।”

“তাহসিনা!”

“বলুন?”

“মুখে লাঘাম টানো। তুমি দেখি নির্লজ্জ হয়ে গেছো।”

“এই শুনুন আমি খারাপ কিছু বলিনি। কেন বাসর না করলে বিয়ে করবো কেন?”

“ঠিক আছে তুমি ঘুমাও আমি রাখলাম।”

“পালাচ্ছেন কেন?”

“পালাবো কেন?”

“আচ্ছা ঠিক আছে আমার অভিমান ভাঙানোর জন্য বেশী কিছু করতে হবে না, অতীতের স্মৃতি মুছে দিলেই হবে।”

“না! আমি মূল্যায়ন না করলেও আমার অতীতের কিছু মূহুর্ত ভীষণ সুন্দর ছিলো। সেই অতীত মুছে দিলে মায়া,মোহ,ভালোবাসা মুছে যাবে।”

“তাহলে তাই হোক!”

“তাহসিনা আজকে আমাদের বিয়ে।”

“ওহ আচ্ছা।”

“তুমি এমন ভাবে কথা বলছ কেন?”

“এমনিতে!”

রোদ উঠে বেলকনিতে যায়। মুখ টিপে হাসছে সে। আদ্রিশকে সাত সকালে একটু রাগানোই যায়। এবার বুঝবে রোদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর শাস্তি। আদ্রিশ কিছুটা তেজী স্বরে বলে, “দেখ আমি আর একটাও উল্টাপাল্টা কথা শোনতে চাইনা। যদি বলো তাহলে এখনি বিয়ে করতে চলে আসবো।”

“আচ্ছা চলুন পালিয়ে বিয়েটা করে নেই।”

“তুমি কী রাতে কিছু খেয়েছ?”

“কেন,কেন?”

“আবোলতাবোল বলছো যে তাই।”

“ঠিক আছে আমার আবোলতাবোল কথা আপনার শুনতে হবে না। কল রাখলাম।”

“শোনো না?”

“বলুন?”

“আই লাভ ইউ।”

“থ্যাঙ্কিউ সো মাচ এ্যান্ড আই লাভ মি টু!”

“তোর বাপ তোরে জ্ন্মের পর মধু মুখে দিয়েছিলো তো?”

রোদ আর হাসি আটকাতে পারছে না। কল মিউটে রেখে কিছুক্ষণ হাসে। আদ্রিশ রাগে চোয়াল শক্ত করে নেয়। রোদ হ্যালো বলতে আদ্রিশ খট করে কল কেটে দেয়। রোদকে কল দেওয়াটাই তার ভুল ছিলো। সাত সকালে মুডটাই নষ্ট তার। এমনিতে নারীর মন বোঝা,রাগ ভাঙানো এসবে বড্ড কাঁচা আদ্রিশ। গতকাল রাতে গুগল ঘেঁটে কিছু উপায় দেখেছে। আজকে ট্রাই করতে গেলো, সুন্দর ভাবে চৌধুরানী বলে রোমান্টিক মুডে কথা বলতে গিয়েছিল এখন মুড নষ্ট হয়ে গেছে।

ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে নিচে যায় আদ্রিশ। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী চায়ের কাপ হাতে নেয়। আদ্রিশকে দেখে বলেন, ” ওই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে না তোমার। বিয়েটা ভে’ঙে দাও।”

আদ্রিশ তার কথা আমলে নেয়নি। সার্ভেন্টের থেকে কফির মগ নিয়ে টিভিতে নিউজ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী পুনরায় বলেন, ” তাহসিনাকে বিয়ে করতে হবে না।”

আদ্রিশ ব্রু জোড়া প্রসারিত করে তাকায়।
“কিছু বলছ?”

“টিভি বন্ধ করো।”

আদ্রিশ টিভি অফ দেয়। তখন আলতাফ পারভেজ চৌধুরী বলেন, “তাহসিনাকে আমার বাড়ীর পূত্র বঁধু করতে চাই না আমি।”

“তাহলে তীর্থ খানকে কথা দিয়েছিলে কেন?”

“সেইসব অতীত!”

” তাহলে আমি অতীত টাকে টেনে বর্তমানে নিয়ে আসলাম। বিয়ে করবো আমি,বউ আমার তুমি বিয়ে ভাঙার কে?”

“আমি তোমার বাবা।”

“ঠিক আছে! তোমায় অভিনন্দন।”

“কেন?”

“আজকে আমার বউয়ের শ্বশুর হবা। বছর দুয়েক যেতে আমার বাচ্চাদের দাদা হবা। তোমার উচিত এসব বিয়ে ভাঙা,অতীত নিয়ে না ভেবে দাদা হওয়ার প্রিপারেশন নেওয়া।”

আলতাফ পারভেজ চৌধুরী চোয়াল শক্ত করে নেন। এই ছেলের সাথে কথা না বলাই বেটার।

★★★

শিকদার বাড়ীতে এসেছে চৌধুরী পরিবার। রোদকে লাল শাড়ীতে বউ সাজানো হয়। রোদ সেজেগুজে নিজেকে আয়নায় দেখে। কতগুলো বছরের প্রণয় এখন পরিনতিতে রুপ নিবে। কতগুলো, বছর,মাস,সপ্তাহ,দিন,মিনিট,সেকন্ড অপেক্ষা করেছিলো এই একটা দিনের জন্য। তখন তূর্ণ রুমে প্রবেশ করে হাতে একটা ফুকের তোড়া। তিশা,শিশা,রোদ ছিলো রুমে। তূর্ণকে দেখে রোদ একগাল হাসে। রোদকে হাসতে দেখে তূর্ণ নিজেও মলিন হাসে। রোদ বউ সেজেছে। তাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে বউ সাজে। তূর্ণ ফুলটা রোদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, “তোমার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা এবং দোয়া রইলো রোদ। নিজের ভালোবাসা নিয়ে ভালো থাকো আমৃত্যু পর্যন্ত।”

“ধন্যবাদ তূর্ণ ভাইয়া।”

তূর্ণ প্রস্থান করতে রোদ ফুলের তোড়ার দিকে তাকায়। নাড়াচাড়া দিয়ে দেখে। রঙিন কাগজ চোখে পড়ে রোদের। তিশা,শিশার আড়ালে কাগজটা খুলে দেখে রোদ। তাতে লেখা, “শুভকামনা রইলো।”

রোদ স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। ভেবেছিলো কী না কী দেয়। কিছুক্ষণ পর পূর্ণ আসে রুমে। রোদ পূর্ণকে দেখে হাসে। আর কিছ মূহুর্ত তারপর চলে যাবে সে। পূর্ণ! পূর্ণর করা কাজগুলো মস্তিষ্ক হানা দেয়। তবে শুভ মূহুর্ত, বিশেষ দিনে অতীত মনে করতে চায় না রোদ। কিছুটা ঘৃ’ণা জন্মেছে। পূর্ণ রোদকে বলে, “তাহসিনা খানম রোদেলার জীবনের নতুন অধ্যায়ের জন্য শুভকামনা রইলো।”

রোদ কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে জবাব দেয়, “ধন্যবাদ আপনায়।”

পূর্ণ কিছু বলেনা। রোদ সব জানে! সব জানে রোদ! পূর্ণ র মনে পড়ে রোদকে সে মা-রতে চেয়েছে কয়েকবার।

পূর্ণ বাইরে আসতে চোখ যায় তূর্ণর দিকে। সে সোফায় বসে আছে। তূর্ণ একবার পূর্ণ আরেকবার সিনথির দিকে তাকায়। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনে,মনে আওড়ায়,
“গল্পের মোড় কোথায়,কীভাবে বদলে যায় বলা যায়না। সব হারিয়ে যায়,সবাই হয়ত হারিয়ে যায়। আসলেই হারিয়ে যায়? এই ভালোবাসার অপূর্ণ গল্পটার সমাপ্তি আর কয়েক মূহুর্ত পরেই! এরপর! এরপর সব কেবল অতীত। তবে চিত্তের একটা কোণে অতীত বিষাদ কিংবা সুন্দর অনুভূতি হয়ে থাকবে! আচ্ছা অপূর্ণ গল্পের অতীত সুন্দর অনুভূতি হয়ে চিত্তে থেকে যায়? থাকে না! অপূর্ণ গল্পের অতীতকে আমরা বিষাদ বলেই আখ্যায়িত করি তবে এই না পাওয়ার গল্পটা ভীষণ স্নিগ্ধ ছিলো। এই গল্পটা আমি বিষাদ ভাবতে চাইনা। সুন্দর অনুভূতি বলে চিত্তে স্থান দিতে চাই।

#চলবে

#এক_ফালি_প্রণয়|৩১|
#শার্লিন_হাসান

পূর্ণ বাইরে আসতে চোখ যায় তূর্ণর দিকে। সে সোফায় বসে আছে। তূর্ণ, একবার পূর্ণ আরেকবার সিনথির দিকে তাকায়। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মনে,মনে আওড়ায়,
“গল্পের মোড় কোথায়,কীভাবে বদলে যায় বলা যায়না। সব হারিয়ে যায়,সবাই হয়ত হারিয়ে যায়। আসলেই হারিয়ে যায়? এই ভালোবাসার অপূর্ণ গল্পটার সমাপ্তি আর কয়েক মূহুর্ত পরেই! এরপর! এরপর সব কেবল অতীত। তবে চিত্তের একটা কোণে অতীত বিষাদ কিংবা সুন্দর অনুভূতি হয়ে থাকবে! আচ্ছা অপূর্ণ গল্পের অতীত সুন্দর অনুভূতি হয়ে চিত্তে থেকে যায়? থাকে না! অপূর্ণ গল্পের অতীতকে আমরা বিষাদ বলেই আখ্যায়িত করি তবে এই না পাওয়ার গল্পটা ভীষণ স্নিগ্ধ ছিলো। এই গল্পটা আমি বিষাদ ভাবতে চাইনা। সুন্দর অনুভূতি বলে চিত্তে স্থান দিতে চাই।

কয়েক মূহুর্তের মধ্যে রোদের সাথে আদ্রিশের বিয়ের কাজ সম্পূর্ণ হয়। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে যাচ্ছেন। রোদকে তার এই মূহুর্তে অসহ্য লাগছে। অন্য দিকে শরীফ শিকদার বিরক্তি নিয়ে সব দেখছে। তার আজকের দৃষ্টি পূর্ণর দিকে। পূর্ণ কিছুই করলো না ভাবতে গা জেনো পুড়ে যায় শরীফ শিকদারের।
ফারিহা চৌধুরী রোদকে দেখে জড়িয়ে ধরেন। কপালে চুমু খেয়ে বলেন, ” কতগুলো বছর পর দেখা পেলাম তোমার।”

বিনিময়ে রোদ হাসে। জবাব দেয়না! কিছুটা খোঁচা মে’রে বলে, “আংকেল ভালো আছে তো? আমার কথা শোনে হার্টে কোন রকম প্রব্লেম দেখা দেয়নি তো?”

ফারিহা কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে জবাব দেয়, “সে ভালোই আছে।”

রোদকে নিয়ে যাওয়া হয় আদ্রিশের কাছে।
সিনথি,তিশা,শিশা, অরিন তারা সবাই রোদ,আদ্রিশের কাছে আসে। আদ্রিশ রোদের দোপাট্টা সরিয়ে একনজর দেখে রোদকে। রোদ নিজেও আদ্রিশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। পরক্ষণে আশে পাশে তার শ্বশুরকে খুঁজতে থাকে। দু’জনকে একসাথে বসিয়ে আয়না দেওয়া হয়। তিশা আদ্রিশকে জিজ্ঞেস করে, ” আয়নায় কী দেখো জিজু?”

“হারিয়ে পাওয়া আমার সেই ভালোবাসা! আমার বউকে!”

আদ্রিশের কথায় রোদ মুচকি হাসে। তখন অরিন রোদকে বলে, ” আপু তুমি কী দেখো আয়নায়?”
রোদ শুধায়, “আমার ভালোবাসা, আমার বাবুর পাপাকে।”

রোদের কথায় সবাই হাসে। আদ্রিশ নিজেও হাসে! তূর্ণ শুনেছে রোদের বলা বাক্য। “আমার ভালোবাসা” রোদের বলা এই বাক্যটা জেনো তার চিত্তে তীরের আঘাতের মতো বসলো। সেসবে পাত্তা দেয়না তূর্ণ। রোদ এখন আর কেউ না! ইশশ! কয়েকমাস আগের দিনগুলো ও তো ভীষণ সুন্দর ছিলো। সব হারিয়ে গেছে।

বিয়ের কাজ সেরে খাওয়া দাওয়া, টুকটাক কথাবার্তা শেষ হতে চৌধুরী পরিবার বিদায় নেয় রোদকে নিয়ে।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রোদের যাওয়া দেখছে তূর্ণ। নিজের অজান্তে হাত বাড়িয়ে দিয়ে শুধায়, “আমি তৃষ্ণা দগ্ধ হয়ে হাত বাড়াই, কল্পনায় তোমার আমার গল্পের পূর্ণতা আবছায়ায় দেখতে পাই। আমার চিত্ত কোঠার প্রণয়িনী তুমি ভালো থাকো অন্য কারোর প্রণয়ে।”

আদ্রিশের হাতে হাত রেখে চৌধুরী বাড়ীতে পা রাখে রোদ। ফারিহা চৌধুরী তাকে বরণ করে নেয়। একমাত্র ছেলের একমাত্র বউ বলে কথা। আলতাফ পারভেজ চৌধুরী এসে রুমে ঢুকেছেন আজকের মতো আর বাইরে আসবেন না।

সন্ধ্যায় সবাই ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে নেয়। চৌধুরী বাড়ীতে সিনথি,শিশা,তিশা,শূন্য এসেছে। রাতে তারা চলে যাবে আবার। রোদের তাদের সাথে কথা বলে। তবে ফারিহা চৌধুরী তাকে সঙ্গ দেয়। দূর থেকে শাশুড়ী, বউমার খুনসুটি দেখে আদ্রিশ।

কিছুক্ষণ কথা বলে তারা চারজন আদ্রিশের রুম সাজানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
সিনথি সোফায় বসে ফোন স্ক্রোল করছে বাকীরা সাজাচ্ছে। আজকে সে বেশ আনমনা। ব্যপারটা শূন্যর দৃষ্টি এড়ায়নি। তূর্ণ, সিনথির জন্য তার বেশ খারাপ লাগে। কবে তাদের দূরত্ব শেষ হবে? পূর্ণর কথা ভাবলে জেনো আরো দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে আসে। শূন্য মনে,মনে আওড়ায়,

এই একতরফা ভালোবাসার অপূর্ণতা এবং মান-অভিমানের দূরত্বের জন্য পূর্ণ দায়ী। তবে তার সাথে খারাপ কিছু না হোক! আদৌ এটা হবে তো? প্রকৃতি যে দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেয় সব।”

রাতের ডিনার শেষ করে রোদকে আদ্রিশের রুমে নিয়ে আসে সিনথি। সাড়ে এগারোটায় রুমের দরজার সামনে আসে আদ্রিশ। শূন্যর দাবি করা টাকা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আদ্রিশের তাড়াহুড়ো দেখে শূন্য বলে, “বউ টা তোমারই! এতো তাড়াহুড়োর কী আছে?”

“এই রাতটা স্পেশাল। আর কখনো ফিরে আসবে না। সো সময় নষ্ট করা বোকামির কাজ।”

আদ্রিশের কথায় বাকীরা হাসে। চৌধুরী পরিবারের থেকে বিদায় নিয়ে তারা শিকদার বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়।

রুমে এসে দরজা লক করে দেয় আদ্রিশ। রোদ খাটের মাঝখানে বসা। আদ্রিশ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে রোদের পাশে গিয়ে বসে। রোদের গোমটা সরিয়ে আদ্রিশ শুধায়, “আমার বউ।”

রোদ মুচকি হাসে। আদ্রিশ পকেট থেকে একটা গিফ্টের বক্স বের করে৷ একটা গোল্ডের লকেট আর একজোড়া বালা রোদকে পড়িয়ে দেয়। আদ্রিশ তখন বলে, “পরে তোমার পছন্দ মতো কিনে দেব। সময় পাইনি তেমন করে।”

“ইট’স ওকে! ওতো গিফ্টের প্রয়োজন নেই মিস্টার চৌধুরী আপনি তো আমার জীবনে পাওয়া সেরা গিফ্ট।”

আদ্রিশ হেঁসে রোদের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। রোদের চোখে চোখ রেখে বলে, “বলো আমায় কখনো ছেড়ে যাবে না। এই হাত দু’টি আলাদা করে দেবে না।”

“এই যে সৃষ্টিকর্তা না চাওয়া অব্দি এবং আমার মৃত্যুর আগ অব্দও এই হাত দু’টি ধরে রাখবো। বলুন তো ভালোবাসি? শোনা হয়নি কখনো এই শব্দটা।”

আদ্রিশ তখন কপাট অভিমান নিয়ে বলে, “তুমি আমার কল ধরোনি তাহসিনা। তুমি আমায় এই কয়দিন তীব্র শাস্তি দিয়েছ।”

“ঠিক আছে না বললে নাই।”

“তাহসিনা….

নরম স্বরে ডাক দেয় আদ্রিশ। রোদ জেনো তাতে গলে যায়। নিজে থেকে বলে, ” পাঁচ বছরের শাস্তি ওটা। এখন তো আমি আপনারই।”

“পাঁচ বছরের একটা দিনও আমি ভালো থাকতে পারিনি। তুমি জানো আমার দিনগুলো কত খারাপ কেটেছে। আমি তাহসিনাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার জন্য করা তার পাগলামি গুলো আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। মনে হতো, ” ইশশ! তখন একবার ভালোবাসি বলে দিলেও ওতো আফসোস থাকতো না। আমি মানুষটাকে আর ফিরে পাবো না। ভালোবাসি বলা হবে না। সে আকাশের তারা হয়ে গেছে। আমি সিনথির বিয়ের গ্রুপ পিকচার থেকে তোমায় দেখেছি। পরে শিওর হয়েছি তুমি এখনো বেঁচে আছো। তোমার মামুর পরিবার আমি তেমন করে চিনতাম না। জানো তো তাহসিনা! আমি তোমার খবর পাওয়ার পর আর দেরী করিনি। জার্মানি থেকে চলে এসেছি। চিন্তা করোনা। সব ঠিক করে দেবো আমি। রাত্রি,রাফি তাহাফ খান ওনাদের থেকে তোমার বাবার বাড়ী আমি তোমায় নিয়ে দেবো। তোমার ইন্ডাস্ট্রির দায়িত্ব তুমি নিবে। আমি সবসময় তোমার সাথে থাকবো। আমার তাহসিনা সব অপূর্ণতা আমি পূর্ণ করে দেবো।”

রোদ জবাব দেয়না। আদ্রিশ রোদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে, ” বলো তো ভালোবাসি?”

“পারবো না।”

“শিওর?”

“আপনি বললে বিনিময়ে আমিও বলবো।”

“ভালোবাসি।”
আদ্রিশের কথায় রোদ শুধায়,

“বলাটা খুবই সহজ! শেষ অব্দি থেকে যাওয়াটা ভীষণরকম কঠিন।”

“কঠিনকে সহজ করে নেবো।”

“ভালো।”

রোদ উঠে মেঝেতে দাঁড়ায়। আদ্রিশের হাত ধরে বেলকনিতে যায় সে। নিচের দিকে তাকিয়ে রোদ শুধায়, “জানেন তো আদ্রিশ চৌধুরী আমার বাবার কাছের লোকগুলোই তার সাথে বেঈমানী করেছে।”

“আচ্ছা তুমি তাঁদের চেনো?”

“চিনি! ভীষণ ভালো করে চিনি। ওরা আমায় মারতে চেয়েছে।”

মূহুর্তে চোয়াল শক্ত করে নেয় আদ্রিশ। কঠোর গলায় শুধায়, ” তাঁদের সম্পর্কে আমি জানতে চাই।”

“নিতে পারবেন না তিক্ত সত্য।”

“তুমি আমাকে কী মনে করো বলোতো রোদ? সে যেই হোক না কেনো শাস্তি তাকে পেতে হবে।”

রোদ প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “আচ্ছা চলুন ঘুমাবো।”

কথাটা বলে আদ্রিশের বাহুতে হাত রাখে রোদ। আদ্রিশ তার জবাব পায়নি। রোদের টানাটানিতে সে বাধ্য হয়ে রুমে চলে আসে। মাথায় শুধু একটাি চিন্তা সেটা হলো রোদের বাবা-মা ‘র খু-নি দের চিনতে পারা। কারা তারা?

“আচ্ছা আদ্রিশ চৌধুরী আজকে থেকে আমার উপর আপনার পুরো অধিকার আছে।”

আদ্রিশ জবাব দেয়না। রোদ ক্লান্তি নিয়ে নিজের বালিশে মাথা রাখে। আদ্রিশ লাইট অফ করে রোদের পাশে গা এলিয়ে দেয়। রোদকে নিজের বুকে টেনে নেয় আদ্রিশ। কপালে চুমু খেয়ে বলে, “শেষটা সুন্দর হোক!”

রোদ জবাব দেয়না। আজকের দিনটা স্পেশাল কিন্তু অতীত জেনো পিছু ছাড়ছে না। মন খারাপদের জেনো ডেকে আনছে। রোদের খারাপ লাগছে। আদ্রিশ পাশে থাকা সত্ত্বেও তার খারাপ লাগছে। আদ্রিশের বুকে মাথা রেখে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে রোদ।

“আমি মনে হয় বেশীদিন বাঁচবো না।”

রোদের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় আদ্রিশ। উঠে ফোনের ফ্লাশ অন করে আদ্রিশ। রোদের চোখে পানি। আদ্রিশ বুঝতে পারছে না কী হয়েছে হঠাৎ। রোদের দু’গালে হাত রেখে আদ্রিশ প্রশ্ন করে, “তোমার কী হয়েছে রোদ?”

“আমি অতীত ভুলতে চাই আদ্রিশ। ওদের ক্ষমা করে দিতে চাই। অতীত আমার মস্তিষ্কে বা’জে ভাবে প্রভাব ফেলছে। আমি কাউকে কখনো কিছু বলতে পারিনি। অভিযোগ করতে পারিনি! আজ অভিযোগ করলাম। সব জেনো কেমন লাগছে। আমি আপনার হাত ধরে বাকী জীবন কাটাতে চাই কিন্তু জানি না এর পর কী হবে, কী আছে কপালে।”

“তুমি আসলেই একটা পা-গল রোদ। আমি আছি তো! আমি থাকতে এতো চিন্তা কিসের?”

“ভালোবাসি আপনায়।”

“আমিও ভালোবাসি রোদ।”

#চলবে