#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৫
ফয়জাল হাসান তার মেয়েদের ভীষণ ভালোবাসেন। তবে যদি বলা হয় কাকে বেশি ভালোবাসে? এই প্রশ্ন সামনে এলে ফয়জাল হাসানের বুকটা কেঁপে উঠে। বড় মেয়ের মুখটা ভেসে উঠে চোখের সামনে। যে মেয়েটার বাবার চেয়ে মা সে বেশি। মেয়েটা গায়ের রঙ দুধে আলতা নয় ঠিক কিন্তু তার শ্যাম সুন্দর মায়াবী মুখশ্রী দেখলে যে কারো মায়া হবে। তার সেই আদুরে মেয়েটার গায়ে হাত তোলা হয়েছে ভাবতেই রাগে দপদপ করে ফুলে উঠলো তার কপালের নীল শিরা গুলো। তিনি পইপই করে বলে দিয়েছেন তার মেয়েদের গায়ে হাত না তুলতে, সেখানে তার মেয়েকে কিনা মেরে রক্ত বের করে দেওয়া হয়েছে! এত সাহস!
ছোট মেয়েটা বুকে চাপিয়ে তিনি এগুলেন বড় মেয়ের ঘরের দিকে। কোনরূপ শব্দ ছাড়ায় মেয়ের রুমে ঢুকলেন। ভুলে গেলোন নাস্তা করার কথা, একটু খানি বিশ্রাম নেওয়ার কথা!
—————
অধরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বারান্দার দরজার দিকে। বারান্দার গ্রীল ভেদ করে চাঁদের আলো আছরে পরছে বারান্দায়। চাঁদের আলোর অপরাজিতা গাছের ছোট ছোট পাতা গুলো চিকচিক করে উঠছে। অথচ চাঁদ প্রেমী মেয়েটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চন্দ্র বিলাশ করছে না। তার দৃষ্টিতে শূণ্যতা। যেন কিছুই দেখতে পারছে না সে।
র্নিবিকার অধরা বাবার উপস্থিতি টের পেলো না। রুমে আঁখি ছিলো। বোনকে একা ছেড়ে যেতে মন সায় দেয়নি তার। চাচাকে দেখে উঠে দাঁড়ালো সে। অরুমিতাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
ফয়জাল হাসান ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন মেয়ের কাছে। আলতো স্বরে ডাকলেন,
“আসফিন, মা!”
বাবার আদুরে স্বর শুনে চমকে সম্মুখে তাকালো অধরা। বাবাকে দেখে হু হু করে কেঁদে উঠলো। মেয়ের ঠোঁটের পাশে রক্ত হয়ে যাওয়া রক্ত, মেয়ের এহেন কান্নার সুর ফয়জাল হাসানকে এলোমেলো করে দিলো। অসহায় বোধ করতে লাগলেন তিনি। ফয়জাল হাসান মেয়ের কাছে এগিয়ে এলেন। অধরা ঝাপিয়ে পরলো বাবার বুকে। কান্নার গতি ক্রমেয় বাড়তে লাগলো। ফয়জাল হাসান বড় মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। আদুরে স্বরে বললেন,
“কি হয়েছে মা? বাবাকে বলো। মারলো কেন আমার মা কে?”
অধরা কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললো একের পর এক সব ঘটনা৷ কিছু বাদ দিলো না। ফয়জাল হাসান নীরবে শুনলেন সব। মুহুর্তেই মাথা গরম হয়ে গেলো তার। রাগে ফুসতে লাগলেন। অধরা বুঝলো বাবা রেগে গেছে। সে ভয় ভয় চোখে বাবার দিকে তাকালো। বুঝতে চেষ্টা করলো কার উপর রাগ করেছ বাবা। তার উপর? বাবাও কি এখন মায়ের মতো ভুল বুঝবে তাকে? অধরার ভয় বাড়তে লাগলো। সে ভীত স্বরে ডাকলো,
“বাবা!”
ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে তাকালেন। চোখে তার স্পষ্ট রাগ। অধরার ভয় বাড়তে লাগলো। তিনি কিছু বলার পূর্বেই ঘরে প্রবেশ করলো তুবা, অধরার মা। তিনি গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
“কাকে বাবা ডাকছো তুমি? আমাদের একটায় মেয়ে। কেও নও তুমি। যে মেয়ে বাব-মায়ের সম্মানের কথা ভাবে না তাকেও আমরা মেয়ে ভাবি না।”
মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অধরা ডুকরে উঠলো। তাকালো বাবার দিকে। বাবাও কি এখন মায়ের মতো ভুল বুঝবে? মা যদি বাবাকে উল্টো পাল্টা বলে বুঝায়, বাবা কি ওকে অবিশ্বাস করবে? অধরার চোখ দু’টো পুনরায় ছলছল করে উঠলো। কান্নারত স্বরে সে বলল,
“আমাকে তুমি একটু বিশ্বাস করো আম্মু, আমি কিছু করিনি। আমার কথাটা শুধু একবার শুনতে আম্মু!”
তুবা ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো তেজী স্বরে বলে উঠলো,
“কি শুনবো তোমার কথা হ্যাঁ? কি শুনবো? বে*শ্যামি করেও শান্তি হয়নি তোমার? মুখ দেখাতে পারছি না লজ্জায়। ছিহ! আবার নিজের অপরাধ ঢাকতে মিথ্যা বলছো? অস*ভ্য মেয়ে। আজ তোমায় দেখাচ্ছি মজা।”
এ কথা বলেই তিনি অধরাকে থাপ্প*ড় দেওয়ার জন্য হাত তুললেন। অধরা ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করলো। অনেকক্ষণ পর যাখন তার গায়ে কোন আঁচড় লাগলো না সে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। দেখলো তার বাবা মায়ের হাত ধরে রেখেছে। মানে বাবা মারতে দেয়নি।
ফয়জাল সাহেব এতক্ষণ চুপ করে স্ত্রীর বলা প্রতিটি কথা শুনেছেন আর রাগে ফুসলেছেন। তার ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটাকে এভাবে বলছে? তাও কিনা মেয়েটার জন্মদাত্রী মা! তুবা যখন অধরাকে মারার জন্য হাত তুললো তখনই ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো ফয়জাল হাসানের। ক্ষিপ্ত হয়ে হাত ধরে ফেললেন তিনি। এরপর ছুঁড়ে ফেললেন সেই হাত। কোন সময় ব্যয় না করে থাপ্প*ড় বসিয়ে দিলেন স্ত্রীর গালে। তুবা গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে যেন বুঝতে পারছে না। যখন বুঝলো তখন হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“তুমি আমায় মারলে!”
—————-
অধরার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির মানুষজন। ফয়জাল হাসান মেয়েকে আগলে নিয়ে বসে আছেন বিছানায়। তুবা দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখে আর তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ফয়জাল হাসানের বড় তিন ভাই এবং তাদের সহধর্মিণীগণ এবং তার ছোট বোন। কিছুক্ষণ আগে,
ফয়জাল হাসান তুবাকে থাপ্প*ড় মারতেই তুবা অবাকে শীর্ষে পৌঁছে যায়। বিস্মিত হয়ে বলে উঠে,
“তুমি আমাকে মারলে!”
ফয়জাল হাসান তখন ভয়ংকর রেগে ছিলেন। তিনি হিসহিসিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, মারলাম!”
তুবা এবার তড়া স্বরে কেঁদে উঠে। তার কান্নার শব্দ বাইরে যেতেই ছুটে আসে বাড়ির অন্যরা। আঁখি ছোটদের আটকে দেয়। ঘরে ঢোকে শুধু বড়রা। সে নিজেও ছোটদের সাথে বাইরে থাকে। তুবা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। অধরা সিটিয়ে আছে বাবার পিছনে। ফয়জাল হাসান খাটে বসে আছেন নিঃশব্দে। ফয়জাল হাসানের বড় ভাই ফখরুল হাসান গম্ভীর স্বর শোনা গেলো,
“বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত দিয়েছো কোন সাহসে তুমি? আম্মা এই শিক্ষা দিয়েছে তোমাকে?”
ফয়জাল হাসান কথা বললো না। বলার প্রয়োজোন বোধটুকুও করলো না। আর না অনুতপ্ত হলো স্ত্রীকে মারার জন্য। ফখরুল হাসান এবার ধমকে উঠলেন,
“কথা বলছো না কেন?”
ফয়জাল হাসান চুপ। ফখরুল হাসানের স্ত্রী তহুরা আগুলে ঘি ঢালতে প্রাস্তুত থাকে সব সময়। আজও ব্যতিক্রম হলো না। তিনি বলে উঠলেন,
“মেয়ে অপরাধ করছে, তাকে একটু শাসন করেছে বলে বউয়ের গায়ে হাত তুললে ছোট ভাই? বলি কাজটা কি ঠিক হলো? মা হয়ে মেয়েকে শাসন করতে পারবে না?”
ফয়জাল হাসান এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন তার বড় ভাবির দিকে। হুংকার দিয়ে উঠলেন,
“খবরদার আমার মেয়েকে নিয়ে একটাও বাজে কথা মুখে আনবেন না। ফুলের চেয়েও পবিত্র আমার মেয়ে।”
তহুরা ছোট দেবরের এমন অগ্নি রূপ দেখে ভয় পেলেন। আর কিছু বলার সাহস পেলেন না। কিন্তু ক্ষেপে গেলেন মায়মুনা, ফয়জাল হাসানের মেঝ ভাই ফারুক হাসানের বউ। তিনি তিক্ত স্বরে বললেন,
“তুমি কি বলতে চাইছো ছোট ভাই? আমার ছেলে তোমার ওই ন*ষ্টা মেয়ের সাথে জোর করে এসব করেছে?”
ফয়জাল হাসান র্নিলিপ্ত গলায় সহজ স্বীকারোক্তি দিলেন,
“হ্যাঁ ভাবি, সেটায় বলতে চেয়েছি। এবং সেটায় সত্য!”
মায়মুনা ফুঁসে উঠে স্বামীর দিকে চাইলেন। বললেন,
“এখনো চুপ থাকবে তুমি? দেখেছো তোমার ছোট ভাই কি বলছে! আমার ছেলে নাকি খারাপ।”
ফারুক হাসান এবার হুংকার দিলেন,
“ফয়জাল! মুখ সামলে কথা বলো।”
ফয়জাল হাসান তার চেয়েও তেজী স্বরে বলে উঠলেন,
“গেইট আউট!”
ফয়জাল হাসানের এহেন স্বরে ভয় পেলো সবায়। ফখরুল হাসান গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন,
“কি বলছো তুমি!”
“আই সেইড গেইট আউট! বের হন ঘর থেকে, সবায়।”
“মুখ সামলে কথা বলো ফয়জাল, বড় ভাই আমরা তেমার।”
ফয়জাল হাসান বড় ভাইয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,
“মুখ সামলে রাখতে চাইছি বলেই বের হতে বলেছি। আপনারা এখানে থাকলে মুখ সামলানো কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।”
ফখরুল হাসান আরো কিছু বলতে চেয়েও বললেন না। ফারুক হাসান ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,
“তোমাকে আমি দেখে নিব।”
ফয়জাল হাসান সেসবে পাত্তা দিলেন না৷ মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। একে একে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো সবাই। তুবা দাঁড়িয়ে রইলো। ফয়জাল হাসান তার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো,
“তোমাকে কি আলাদা করে বের হতে বলতে হবে?”
তুবা বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
সবায় বের হয়ে যেতেই আঁখি ঘরে ঢুকলো। তার এখন ভীষণ মজা লাগছে। ঠিক করেছে ছোট চাচা। পেয়েছে কি এরা। পনেরো বছরের মেয়েটার গায়ে কলঙ্ক লাগায়! ফয়জাল হাসান ফাস্ট এইডস্ বক্সটা আনতে আনতে আঁখিকে বলে,
“এক প্লেট ভাত নিয়ে আয় তো মা।”
আঁখি তখনি ছুটে নিচে যায় ভাত আনতে আর ফয়জাল হাসান বসে মেয়ের ঠোঁটের পাশে কাটা জায়গাটা পরিষ্কার করে দিতে।
আঁখি বের হয়ে যেতেই অধরা মৃদুস্বরে ডাকলো,
“বাবা!”
“জ্বি মা।”
“তুমি আমাকে অবিশ্বাস করলে না কেন?”
“আমার রাজকন্যাকে আমি চিনি যে।”
ফয়জাল হাসান মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অধরার চোখ বেয়ে জল গড়ালো। ফয়জাল হাসান যত্ন করে মুছে দিলেন সেই পানি। অধরা কান্নারত স্বরে বলল,
“মা কেন অবিশ্বাস করলো বাবা?”
ফয়জাল হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ উত্তর দিলেন না। দিবে কি করে? তুবা কেন অধরার মা হতে পারলো না নিজেই জানেন না ফয়জাল হাসান। মায়েরা কি এমন হয়? ফয়জাল হাসান উত্তর পায় না। মায়াবী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এই ময়েটাকে সব দিয়েছে শুধু একটা সত্যিকারের মা বোধহয় দিতে পারেনি। ফয়জাল হাসানের নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে, আর ভাবতে পারেন না তিনি!
#চলবে…?