#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৬
নিশুতি রাত। চারদিকে সুনশান নীরবতা। খানিক আগে চাঁদের আলো থাকলেও এখন নেই। আকাশে মেঘ জমেছে। আলোকিত চাঁদটি হারিয়ে গেছে মেঘর আড়ালে। অন্ধকারে আচ্ছন্ন তাই এই নীরব শহর। নীরবতা অন্ধকারকে আরো গভীর করে তোলে। অধরার রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছেন ফয়জাল হাসান। মাথা ভর্তি চিন্তা। কিভাবে সামাল দিবেন এই অবস্থার! মা অর্থাৎ নবনী আনজুম বাড়িতে নেই। বোনের বাড়িতে ঘুরতে গেছে। মা বাড়িতে থাকলে এত কিছু হতো না, কেউ সাহস পেতো না। অধরাকে সে যেমন অতিরিক্ত বেশি ভালোবাসে তেমনি করে ভালোবাসে নবনী আনজুম। কিন্তু বাড়ির সবায় যেভাবে বেঁকে আছে তাতে মা’ও যদি তার পবিত্র মেয়েটাকে ভুল বোঝে? কি করবেন তখন তিনি? ফয়জাল হাসান আর ভাবতে পারেন না। চিন্তা গুলোকে দূরে ঠেলে দিতে অনবরত ফুঁকতে থাকেন সিগারেট।
হাতের সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলে দিলেন। বারান্দার দরজার কাছে এসে তাকালেন ঘুমন্ত মেয়ের দিকে। একটু ভাত খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিয়েছেন। ঘুমিয়েছে কেঁদে কেঁদে। চোখের পাশ দিয়ে পানি শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে। তিনি মেয়ের মাথার পাশে গিয়ে বসলেন। ধীর গতিতে বিলি কাটতে লাগলেন মেয়ের মাথায়। কিয়ৎকাল পর অধরা সোজা হয়ে শুলো। ওড়নাটা সরে গেলো গলার কাছ থেকে। ফয়জাল হাসান দেখলেন মেয়ের গলার কাছে ছোপ ছোপ লাল দাগ। নখের আঁচড়ো বিদ্যমান। ফয়জাল হাসানের চোখমুখ লাল বর্ণ ধারন করলো। অস্ফুটে স্বরে উচ্চারণ করলেন,
“জানো*য়ার!”
দ্রুত ব্যথা নাশক মলম এনে সর্দপনে লাগিয়ে দিলেন মেয়ের গলায়। আলতো করে চুমু খেলেন মেয়ের মাথায়। ফিসফিস করে বললেন,
“বাবা সরি মা। বাবা তার রাজকন্যাকে রক্ষা করতে পারেনি। বাবা অনেক গুলো সরি।”
অধরা শুনলো না সে কথা। জানলো না অনেক কিছু। সে আসলেও অনেক কিছু জানে না।
———-
ঘরের এমাথা থেকে ও মাথা পায়চারি করছে মায়মুনা। থামার নাম নেই। ফারুক হাসান বসে আছে বিছানায় তার চেহারায় কোন অনুভূতির ছোঁয়া নেই। ওদিকে মায়মুনা চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠছে৷ সে হুট করে থেমে গেলো। ফারুক হাসানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“তোমার ভাইয়ের এতো রাগ জানা ছিলো না। সব সময় শান্ত হয়ে থাকে আর আজ যেন পুরো জ্বলন্ত অগ্নিগিরি! কি চিৎকার বাপরে বাপ। এতো রাগ আসলো কোথা থেকে?”
ফারুক হাসান ভ্রূ কুঁচকিয়ে তাকালেন নিজের স্ত্রীর দিকে। এই মহিলাকে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমান মনে হয় তার। আবর পরক্ষণেই মনে হয় তার ধারণা ভুল। তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
“অহি, অণিতা আমাদের মেয়ে, ওদের জন্য আমাদের দরদ আছে। তুমি ওর মা, আমি বাবা। আর আসফিনের মা-বাবা দুটোই কিন্তু ফয়জাল। তুবা কখনো আসফিনের মা হতে পারেনি! মেয়ের জন্য ওর আদর থাকাটায় স্বাভাবিক।”
মায়মুনা চিন্তিত স্বরে বলে উঠলো,
“তাহলে তো ভালো ঝামেলা হবে গো।”
“তুমি কি ভেবেছিলে? তুবার মতো ফয়জালও আসফিনকে ছুঁড়ে ফেলবে?”
ফারুক হাসান হাসলেন। হাসি থামিয়ে বললেন,
“তুবাকে যত সহজে হাতে আনতে পেরেছো তার চেয়ে তিন চার গুঙ বেশি বুদ্ধি খরচ করেও ফয়জালকে হাতে আনতে পারবে না।”
“তাহলে? পরিকল্পনা কি ভেস্তে যাবে?”
ফারুক হাসান বিরক্ত হলেন। বিরক্তি নিয়েই বললেন,
“অতিরিক্ত ভাবতে বলেনি কেউ তোমাকে। এখন ঘুমাও। সকালে কাজে যেতে হবে আমার!”
——————–
অধরার যখন ঘুম ভাঙলো তখনও সকাল হয়নি। চারদিকে অন্ধকার। অধরা উঠে বসলো। বালিশের নিচ থেকে নিজের ট্যাবটি বের করে সময় দেখলো। তিনটা বিশ বাজে। বিছানা ছেড়ে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অন্ধকার তার খুব প্রিয়। কেন যেন ভালো লাগে। অধরা লম্বা শ্বাস টানলো। যেন কতদিন নিশ্বাস নেয় না সে। বারান্দার চেয়ারটায় বসে ভাবতে লাগলো এক দিনের ব্যবধানে কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেলো নিজের জীবনটা। অধরা হাসলো। দুঃখে মানুষ হাসে বুঝি? হু, হাসে। কষ্ট লুকিয়ে রাখতে হাসে!
উত্তরের হাওয়া এসে গ্রীলের ফাঁক দিয়ে ঢুকছে। অধরার শীত লাগছে। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না তাই। ঘরে এসে দেখলো দরজাটা হালকা করে চাপিয়ে রাখা। সে দরজা বন্ধ করে দিলো, তারপর লাইট জ্বালালো। বারান্দার দরজাটা বন্ধ করতে ইচ্ছে করলো না, শীত কমাতে তাই হুডি গায়ে জড়ালো। চেয়ার টেনে বসলো পড়ার টেবিলের সামনে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে বের করলো আকাশি-সাদা মিশেলে স্নিগ্ধ একটা ডায়েরি। পাতা উল্টিয়ে চলে গেলো মাঝের দিকের একটা পৃষ্ঠায়। গুটিগুটি অক্ষরে লিখতে লাগলো মনে কথা।
“আবির ভাইয়া, আমার চাচাতো ভাই। একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে এ বছর ভর্তি হয়েছে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকে নিজের ঘরে থাকে। তার ঘরে সে কাউকে খুব একটা ঢুকতে দেয় না। নিজেও কারো ঘরে আসে না। আমরা কাজিনরা মিলে অনেক মজা করি, কিন্তু সে আমাদের সাথে আসে না।
আমাদের বাড়িতে মোট বাচ্চার সংখ্যা বারো (আমি সহ)। এর মাঝে ছেলে মাত্র চার জন। আরহাম ভাইয়া, আবির ভাইয়া, আরাব আর নীরব। নীরব ছোট, সবে দু’মাস। বাকি তিনজনই আমার বড়। আমি আমার ভাইদের ভীষণ সম্মান করতাম!
আবির ভাইয়া, আমার মেঝ চাচার ছেলে আজ সে সম্মান যেন ধুলোয় মিশিয়ে দিলো। আমার আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে দিলো। অথচ আমি কি গর্বের সাথে বলতাম, আমার ভাইয়েরা বেস্ট!
কিশোরী একটা মেয়েকে ওলোট পালোট করে দিতে এইটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু আমার জীবনের গল্পটা অতটুকুতে থামতে চাইলো না, তাইতো পুরো বাড়ির মানুষ আমার দিলে আঙ্গুল তুললো, লাগিয়ে দিলো কলঙ্কের দাগ। চাঁদের গায়েও নাকি দাগ আছে? আশ্চর্য, চাঁদ আমার ভীষণ প্রিয়!
চেনা মানুষ গুলো হঠাৎ অচেনা হয়ে যায় কেন? যদের আমি ভীষণ ভালোবাসতাম আজ তাদের কাউকে চিনতেই পারছি না আমি। অথচ তারা বলতো তারাও আমাকে ভালোবাসে! ভালোবাসা এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়?
মায়েরা নাকি সন্তানের ভালো চায়। তাদের আগলে রাখে। মায়েদের সংজ্ঞা-ই হয় সন্তানকে সব বিপদ থেকে আড়াল করে রাখা। আশ্চর্যের বিষয় হলো সংজ্ঞা অনুযায়ী আমার আলাদা করে কোন মা নেই। মা এবং বাবা দু’টোয় ওই এক বিন্দুতে গিয়ে যোগ হয়। বাবা! তিনি শুধু আমার বাবা নন, মা’ও বটে। বাবা, আমি তোমাকে ভয়ংকর রকম ভালোবাসি!”
অধরা থামে। লেখা আর এগোয় না। কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। যতদূর মনে পরে সে ভাবতে থাকে। মা’কে সে কখন মা হিসেবে পেয়েছে? ঝিমঝিম করে অধরার মাথা। শুনতে পায় দূর থেকে ভেসে আসছে একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ!
ছয় বছর বয়সের মেয়েটা ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁদছে। পরনে তার লাল ফ্রক। সিল্কি চুল গুলো সুন্দর করে ঝুঁটে করা। ঝুঁটির দুই পাশে দু’টো লাল ক্লিপ। হাতে তার চিপসের প্যাকেট। ডাইনিং রুমের একপাশে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে সে কাঁদছে। কান্নার শব্দে বিরক্ত হয়ে তুবা এলো সেখানে। ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“কি সমস্যা? কাঁদছিস কেন? কাজ নেই কোন? দিনরাত প্যা প্যা করা!”
ছোট্ট অধরা মায়ের দিকে তাকিয়ে কান্না থামাতে চাইলো কিন্তু থামলো না। সে ফোঁপাতে লাগলো। তুবা আরো একবার ধমক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখনই আরাব বলে উঠলো,
“ও আমার চিপস নিয়ে নিয়েছে চাচি! আবার কাঁদছেও।”
তুবা রেগে গেলো। এই মেয়েটাকে তার সহ্য হয় না। আবার তার জন্য নালিশ শুনতে হবে? ধমক ধমকের জায়গার রেখে তিনও টেনে উঠে বসালো অধরাকে। ছোট ঝুঁটিটা টেনে ধরে হিসহিসিয়ে উঠলো,
“কেন নিয়েছিস ওর চিপস? কেন? কম খাস তুই? এনে দেয় না তোর বাপ? তাও কেন নিবি অন্যেরটা? দিয়ে দে। এক্ষুনি দে।”
অধরার কান্নার গতি বাড়ে। বলতে চায় আমি নেয়নি মা, আরাব ই তো নিলো। আমারটা থেকে। কিন্তু ব্যথায় বলতে পারে না। দিয়ে দেয় আরাব কে। আরাব হাসতে হাসতে চলে যায়। আর অধরা! কান্না থামানোর চেষ্টা করে। ছয় বছরের সেও বুঝে গেছে তার মা তার কান্না দেখতে পারে না। শুধু এটুকু বুঝতে পারেনি, কেন সে কাঁদলে মা রেগে যায়? মায়ের কষ্ট হয় বলে নাকি বিরক্ত লাগে বলে?
পনেরো বছরের অধরা হাসে। বুঝে যায় অনেক কিছু। এতদিন যা সে উপেক্ষা করে এসেছে আজ তা মস্তিষ্কে হানা দেয়। প্রশ্ন করে, উত্তর জানতে চায়। কিন্তু হায়! অধরার যে উত্তর জানা নেই।
—————
ধরণীতে পর্দাপন করেছে নতুন ভোর। ফয়জাল হাসান ফজরের নামাজ শেষ করে মেয়ের ঘরে উঁকি দিয়ে গেছেন। মেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। মেয়েকে ঠিকঠাক দেখে তিনি গেস্ট রুমে চলে গেলেন আবার। গতকাল রাতে সেখানেই ঘুমিয়েছিলেন।
সাকল সাতটা। নবকুঞ্জে ডাইনিং রুমে ব্যস্ত ভঙ্গিতে নাস্তা করছে বাড়ির কর্তা এবং ছেলেমেয়েরা। নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার তাড়া। তবে টেবিলে নেই বাড়ির ছোট৷ কর্তা এবং তার বড় কন্যা। ফজলুল হাসান, বাড়ির সেজ কর্তা গলা উঁচিয়ে ডাকলেন,
“ফয়জাল, ফয়জাল! খেতে আয়।”
ফয়জাল হাসানের কোন সাড়া নেই। ফজলুল দ্রুত খেয়ে নিয়ে ছোট ভাইয়ের খোঁজে গেলেন। দেখলেন মেয়ের রুমে চুপচাপ বসে আছেন তিনি। ফজলুল হাসান ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ছোট ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলেন। মৃদুস্বরে ডাকলেন,
“ফয়জাল।”
ফয়জাল হাসান ভাইয়ের দিকে তাকালেন। কিছু বললেন না। ফজলুল হাসান মৃদুস্বরে বললেন,
“আজ যাবি না?
” নাহ!”
কথা বাড়ালেন না ফজলুল। ভাইয়ের কাঁধে স্বান্তনার হাত বুলিয়ে দিয়ে বের হলেন ঘর থেকে। মনে মনে দোয়া করলেন, সব যেন দ্রুত ঠিক হয়ে যায়। পারিবারিক এমন অশান্তি কার ভালো লাগে?
#চলবে…?