#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৭
নবকুঞ্জ বিশাল এক বাড়ি। বিশাল বাড়িটিতে লোক সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বাড়ির অন্দরমহল লোকসমাগমে ভরে থাকে সারাদিন। বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়, গৃহিণীদের সাংসারিক গল্প, কর্তাদের ব্যবসায়িক আলাপ কখনো বা বাড়ির সর্বোচ্চ কত্রী নবনী আনজুম গল্পের আসর জমান নাতি-নাতনিদের সাথে। নবকুঞ্জের আনন্দ, গল্প, হাসি যেন ফুরোয় না। তবে আজকের দিনটা ভিন্ন। বছরের প্রথমদিন। বাচ্চারা ব্যস্ত, স্কুলে যওয়ার তাড়া। একটু বড় যারা, তাদের কলেজ কিংবা ভার্সিটি আছে। তাও না থাকলে বছরের প্রথমদিন বন্ধুমহলের সাথে ঘুরতে যাওয়ার একটা পরিকল্পনা তো আছেয়। বাড়ির কর্তারা কাজে যাবে, গৃহিণীদের তাই ব্যস্ততার শেষ নেই। ব্যস্ততা শেষ হলো সকাল আটটা বাজতেই। যে যার কাজে চলে গেছে। এবার গৃহিণীরা নাস্তা করতে বসবে।
নাস্তার টেবিল সাজিয়ে একে একে বসলো সবাই। নীরব কাঁদছে। ফৌজিয়া অর্থাৎ অধরার ছোট ফুপি তাকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মাঝেই ঘুমিয়ে গেলো নীরব। তাকে শুইয়ে রেখে চেয়ার টেনে বসলো ফৌজিয়া। তখনই কথা বলে উঠলো তুবা,
“তোমার ভাই খেয়েছে ফৌজিয়া? নিচে নামতে দেখলাম না যে!”
ফৌজিয়া বিচক্ষণ মহিলা। সে খুব ভালো করেই বুঝেছে তার ভাইঝির কোন দোষ নেই। পুরোটায় পরিকল্পিত কাজ। কিন্তু কেন এই কাজ করা হলো তা তার ধারণাতে নেই। সে নিজে এই বাড়ির মেয়ে হলেও বিয়ের পর বাবার বাড়ি মেয়েদের আর নিজের বাড়ি থাকে না। স্বামীর অকাল মৃত্যুতে যখন তার দিশেহারা অবস্থা তখন ভাইরা আদরের ছোট বোনকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। নীরব তখন তার পেটে। ফৌজিয়া কারো সাথে ঝগড়া করতে চায় না। যদিও তুবাকে তার পছন্দ নয়, কেমন মা সে? নিজের মেয়ের অবস্থা বোঝে না। তবুও ঝগড়ার দিকে গেলো না সে। মৃদুস্বরে বলল,
“নিচে তো নামেনি ছোট ভাইয়া।”
তুবা ইতস্তত করে। কিছুটা নরম হয়ে বলে,
“একটু দেখে আসবে?”
ফৌজিয়াা কঠিন কিছু কথা বলতে মন চায়। কিন্তু নিজেকে এই বাড়ির বোঝা মনেহয় বলে কথা গুলো গিলে নেয়। তবে ভাইকে ডাকতে সে যায় না। মুখ নামিয়ে বলে,
“তুমি যাও ভাবি। আমি গেলে বুঝে যাবে তুমি পাঠিয়েছো, রেগে যাবে।”
তুবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফৌজিয়া অবাক হয়। এই মহিলা আদো আসফিনের মা? একটা বারও বললো না মেয়েটা খেয়েছে কিনা! মেয়েটা কেমন আছে। ফৌজিয়া মনে মনে কষ্ট পায়। শ্যাম বর্ণের স্নিগ্ধ মায়াবী মেয়েটার জন্য তার কষ্ট হয়।
——————–
সাতটার দিকে দ্বিতীয় বার ঘুম থেকে উঠলো অধরা। চোখ মেলতেই বাবাকে দেখলো সে। ফয়জাল হাসান মেয়ের পাশেই বসে ছিলেন। মেয়েকে চোখ মেলতে দেখে মুচকি হাসলেন,
“শুভ সকাল মা।”
অধরা উঠে বসলো। বাবার দিকে তাকিয়ে হাসলো। শুভ সকাল বললো না। তার জন্য সকালটা কি আদো শুভ? ফয়জাল হাসান মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। গাল দুটো কেমন কালচে হয়ে আছে। তিনি ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“স্কুলে যাবেন মা?”
অধরা মাথা নিচু করে ফেললো। দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে না বললো। ফয়জাল হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পনেরো বছরের মেয়েটা এই প্রথম স্কুলে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখান করলো। ফয়জাল হাসান মৃদুস্বরে বলল,
“ফ্রেস হয়ে আসো। বাবা পরোটা আর ভাজি এনেছি। খাবে না?”
অধরা জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিলো। আস্তে করে বলল,
“তুমি এখনো খাও নি বাবা?
ফয়জাল হাসান হাসলেন। মেয়ের মাথার উপরা হাত দিয়ে বললেন,
” ফ্রেস হয়ে আসোতো মা। আমার খিদে পেয়েছে।”
অধরা বিছানা ছেড়ে নামলো। খাওয়ার ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু বাবার জন্য খেতে হবে। বাবা ভীষণ চালাক। তাইতো না খেয়ে বসে আছে।
প্লেটের এক কোণে ভাজি। ফয়জাল হাসান পরোটা ছিড়ে রাখছেন আর এক পাশে। অধরা একটা টুকরো নিয়ে তাতে কিছুটা ভাজি যোগ করে মুখে পুরছে। সকালের নাস্তাটা এভাবেই খাওয়া হয় অধরার। দুপুরে বাবা অফিসে থাকে। তখন নিজে নিজে সব করতে হয়, আঁখি আপা থাকলে অবশ্য খাইয়েও দেয়। রাতের খাবার আবার বাবার হাতে খায় অধরা। এটা নিত্য দিনের রুটিন। অধরা এক টুকরো পরোটা মুখে নিয়ে ধীর স্বরে বলল,
“আমার জন্য তোমাকে সবার সাথে ঝগড়া করতে হলো বাবা। আ’ম সরি।”
ফয়জাল হাসান মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
“আমার রাজকন্যার গায়ে মানুষ দাগ লাগিয়ে দেবে আর আমি বসে বসে দেখবো? কখনো না। আমায় যদি পুরো পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয় তবে তাই সই। রাজকন্যাকে রক্ষা করতে বাবা তাতেয় রাজি।”
অধরা মুচকি হাসলো। এমন আবেগি কথায় আজ তার কান্না এলো না। গতদিন থেকে বহু কেঁদেছে৷ আর কথা বাড়ালো না সে। চুপচাপ খেয়ে নিলো। বুঝলো বাবা তার পাশে ঢাল হয়ে থাকবে সর্বক্ষণ!
—————-
সকাল দশটা। দুপুরের খাবারের আয়োজন করতে ব্যস্ত গৃহিণীরা। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে হাঁড়ি-পাতিল নড়াচড়া করার শব্দ সেই সাথে খাবারের সুঘ্রাণ। খুন্তি দিয়ে ঢেঁড়স নাড়ছিলো ফৌজিয়া। তখন চিৎকার করে কেঁদে উঠলো নীরব। আয়েশা ওর হাত থেকে খুন্তি নিয়ে বলল,
“তুমি যাও। বাবু কাঁদছে। আমি দেখছি এটা। জলদি যাও তো দেখি।”
আয়েশা তার মেঝ ভাইয়ের বউ। ফৌজিয়ার সবচেয়ে পছন্দের মানুষ। আয়েশা শান্ত, প্রয়োজোন ছাড়া কথা বলে না। ঝগড়া-ঝামেলা করা তার ধাতে নেই।
প্রতিদিন রান্নার সময় চার বউয়ের আলাপ হয় অনেক। কিন্তু আজ রসুইঘরে রান্নার শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। তুবা চুপ, স্বামী গতকাল চর মারার পর থেকে আর একটা কথাও বলেনি। রাতে ঘরেও আসেনি। সে চিন্তিত খুব। চিন্তার মাঝেও বিরক্ত হয় সে। ওই মেয়েটার উপর। জন্মের আগে থেকে জ্বালাচ্ছে ওকে। অসহ্য! মায়মুনাও কথা বলছে না। সে চিন্তিত তার পরিকল্পনা নিয়ে। সে যেভাবে ছক কষেছিলো সেভাবে আগায়নি সব। সব ভেস্তে দিয়েছে ফয়জাল। মেয়ের উপর কি বিশ্বাস! নতুনভাবে কি করা যায় তাই ভাবছে সে। আশেয়া বারাবরই চুপচাপ। বেশি কথা বলে না। তহুরা প্রথমে কথা বলতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কেউ পাত্তা দিচ্ছে না বলে থেমে গেছে।
——————–
ফয়জাল হাসান ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে সিগারেট। তিনি চেইন স্মোকার নন। মাঝেসাঝে একটা আধটা ধরান। কিন্তু গতরাত থেকে টেনশনে আটটা সিগারেট শেস করেছেন। এখন নয় নাম্বার চলছে। মেয়কে নিয়ে ভয় পাচ্ছেন তিনি। তার মেয়ে আবেগি, কেঁদে গা ভাসাবে ঠিক আছে কিন্তু মেয়ে কেন চুপ হয়ে যাবে? কান্নার বদলে ঠোঁট বাকিয়ে হাসবে কেন? আহ্লাদী মেয়েটা শূণ্য চোখে কেন তাকিয়ে থাকবে? মেয়কে এক মুহুর্ত একা ছাড়তে তিনি ভয় পাচ্ছেন। এই বয়সী মেয়েরা সমস্যায় পরলে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোন যুতসই সমাধান না পেয়ে তা আত্মহ*ত্যায় গিয়ে ঠেকে। অধরার এখন দরকার একটা উষ্ণ কোল, যেখানে ও শান্তি পাবে। তিনি মেয়ের বাবা-মা হয়ে উঠলেও কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। তিনি কল করলেন বড় ভাইঝিকে।
তানিশা, ফখরুল হাসানের বড় মেয়ে, নবকুঞ্জের প্রথম সন্তান। বিয়ে হয়েছে তার দেড় বছর হলো, প্রেমের বিয়ে নাহয় এত তাড়াতাড়ি তাকে কখনো বিয়ে দিত না। তার একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে, বয়স সবে পাঁচ মাস। মেয়েকে কোলে নিয়ে ছিলো সে, তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। মেয়েকে শাশুড়ির কোলে দিয়ে সে ঘরে গেলো। ছোট চাচার কল দেখে যতখানি না অবাক হলো তার চেয়ে বেশি খুশি হলো। বাড়ির বড় মেয়ে হওয়ায় বাবা-চাচাদের কাছে সে ভীষণ আহ্লাদী। আহ্লাদ নিয়েই বলে উঠলো তানিশা,
“ছোট চাচা! কেমন আছো?”
“ভালো। কেমন আছিস মা?”
“আমিও ভালো আছি।”
ফয়জাল হাসান দ্বিধায় ভুগলেন। কি বলবে মেয়েটাকে? তবুও মেয়ের কথা ভেবে সব দ্বিধা সরিয়ে বললেন,
“তুই একটু এ বাড়িতে আসতে পারবি মা?”
তানিশার সব উচ্ছ্বাস ভয়ে পরিণত হলো। ফ্যাকাসে মুখে বলল,
“কিছু হয়েছে চাচা।”
ফয়জাল হাসান রুদ্ধশ্বাসে বললেন,
“আসফিন ভালো নেই। ওর তোকে দরকার।”
তানিশা আঁতকে উঠলো। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে আসফিনের?”
কিন্তু তানিশা সে প্রশ্নের উত্তর পেলো না। কলটা কেটে দিয়েছে ছোট চাচা। তানিশা ফের ডায়াল করলো কিন্তু রিসিভ হলো না। তানিশা হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে থাকা একটা শ্যাম মুখশ্রী। সে বড় মায়া নিয়ে ডেকে উঠে, “আপা!”
তানিশা খেয়াল করলো সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। হাত-পা কেঁপে কেঁপে উঠছে। অবচেতন মন কঠিন কঠিন সব বিপদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তানিশা বিছানায় বসে নিজেকে ধাতস্থ করলো৷ তারপর ছুটে বের হলো ঘর থেকে। শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলল,
“আমি ও বাড়িতে যাব আম্মা।”
তানিশার শাশুড়ি শর্মিলা আক্তার কিছুটা অবাক হলেন তবে নিষেধ করলেন না। একমাত্র পুত্রবধূকে তিনি যথেষ্ট স্নেহ করেন। তিনি হেসে বললেন,
“তুমি ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে মারুফ কে কল করে বলে দাও তুমি যাচ্ছ। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলছি। কিন্তু এমন তাড়াহুড়ো করছো কেন তানিশা? কিছু হয়েছে?”
তানিশা এবার অপ্রস্তুত হলো। কি বলবে সে? তবুও মাথা নিচু করে বলল,
“আসফিন অসুস্থ।”
শর্মিলা আর মানা করলেন না, তিনি জানেন আসফিন নামের মেয়েটাকে তার পুত্রবধু মারাত্মক ভালোবাসে। তিনি নাতনিকে তৈরি করে দিতে নিয়ে গেলেন। যাক ঘুরে আসুক। অনেকদিন যায়নি ও বাড়িতে। তিনি মুচকি হেসে নাতনিকে জামা পড়িয়ে বললেন,
“নানুবাসায় গিয়ে আমাকে ভুলে যেও না যেন দাদু।”
ছোট্ট মাসফিয়া দন্তহীন মাড়ি বের করে হাসতে লাগলো।
#চলবে…?