#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১১
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে স্পষ্ট বুঝতে পারলেন নবনী আনজুম। সকলেই বুঝলো যে কাহিনি মোর নিচ্ছে অন্যদিকে। মায়মুনা মনে মনে হাসছেন। ভাবছেন যাক ভালোয় হলো। এই পরিস্থিতিতে আর ওই ব্যাপারটা আসবে না। কিন্তু নবনী আনজুম সহজে ছাড়ার পাত্রী নয়। কিন্তু গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠলেন,
“আবির!”
সবার দৃষ্টি অধরা থেকে সরে আনার নবনী আনজুমের উপর পড়লো। দাদুনির পাশে অধরাকে বসিয়েছে তানিশা। সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বসে আছে সে। দাদির গম্ভীর স্বরে আবির কিছুটা কেঁপে উঠলো। কিছুটা তোতলানো কন্ঠে উত্তর দিলো,
“জ..জ..জি দাদুনি।”
“এমন নিকৃষ্ট কাজটা কিভাবে করলে তুমি?”
নিজেকে বাঁচতে কে না চায়? লোকে কি আর সাধে বলে, ‘নিজরে ভালো পাগলও বোঝে।’ নিজেকে বাঁচতে আবির বলে উঠলো,
“আমি কিছু করিনি দাদুনি।”
ছেলের পক্ষে কথা বলতে মুখ খুললেন মায়মুনা,
“ওর ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছেন কেন আম্…..”
নবনী আনজুম হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,
“আমি কথা বলছি! কথার মাঝে কথা বলছো কেন?”
মায়মুনা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। স্বামীর দিকে তাকালো। ইশারায় বললো কিছু বলতে। ফারুক হাসান মুখ খোলার আগেই তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন নবনী আনজুম। কথা বলার সাহস পেলেন না তিনি। নবনী আনজুম দিরাজ কন্ঠে বলে উঠলেন,
“এমন জ*ঘন্য কিছু আমার বাড়িতে ঘটেছে বিশ্বাস করতে পারছি না আমি। ঘটনার কোন সাক্ষীও নেই, না দেখে একজনকে গণহারে দোষারোপ করছো তোমরা! তোমাদের বিবেক দেখে অবাক হয়েছি আমি। ঘটনার আসল রহস্য বের করার আগ অবধি কোন শাস্তি দিতে পারছি না আমি। তবে আবির, মনে রেখো সত্য কখনো চাপা থাকে না। সত্যটা একদিন না একদিন সামনে আসবেই আর সেদিনের জন্য অপেক্ষা করবো আমি। আসফিনের দিকে খবরদার আঙুল তুলবে না কেউ।”
এতটুকু বলে থামলেন নবনী আনজুম। এবার তাকালেন তুবার দিকে। দৃঢ় এবং স্পষ্ট কন্ঠে বললেন,
“যাকে দুনিয়া দেখানোর শখ ছিলো না কিন্তু ভুল বসতো জন্ম দিয়ে ফেলেছো তাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করার কোন দরকার তোমার নাই। জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না। ওর মা যখন হতেই পারোনি কখনো তখন ও কে শাসন করার অধিকারটাও তুমি রাখো না। পরবর্তী সময় ওর গায়ে হাত তোলার আগে দশবার ভাববে। তোমাকে কঠিন শাস্তি দিতে মন চাচ্ছে আমার, শুধু পারছি না অরুমিতার জন্য। একজন মা ছাড়া বড় হয়েছে চাচ্ছি না আর একজন হোক।”
উঠে দাঁড়ালেন তিনি। গম্ভীর স্বরে ফের বললেন,
“যা যা বলেছি মাথায় থাকে যেন সবার।”
থামলেন তিনি। তানিশার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আসফিন কে ঘরে নিয়ে যাও।”
তানিশা আর আঁখি অধরাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেলো। বিছানায় বসাতেই ধুপ করে শুয়ে পরলো অধরা। অসহিষ্ণু কন্ঠে বলল,
“তোমরা এখন যাও। আমি ঘুমাবো। ক্লান্ত লাগছে আমার।”
তানিশা আলতো স্বরে বলল,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দেই বাবুন।”
অধরা তীব্র গতিতে ডানে বায়ে মাথা নাড়লো। ভাঙা গলায় বলল,
“দোহাই লাগে আপা কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। যাও প্লিজ।”
তানিশা আর আঁখি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ঘরে থেকে বের হয়ে গেলো। ঘরে কেউ নেই বুঝতে পেরেই দুই হাতে মুখ ঢাকলো অধরা। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মুহুর্তের মাঝে। ক্ষণে ক্ষণে সে শব্দ বাড়লো। অরুমিতা ফুপির ঘর থেকে ছুটে এসে দাঁড়ালো বোনের ঘরের সামনে। তানিশার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে জানতে চাইলো,
“আপুইকে আবার মেরেছে?”
তানিশা অরুমিতার দিকে ফিরলো। কিছু বললো না। তার চোখ দুটোও টলমল করছে। বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ভিতরের সত্তাটা চিৎকার করে বলছে,
“কাঁদিস না বাবুন। আমার কষ্ট হয়। সহ্য হয় না আদুরে পুতুলের এহেন কান্না।”
——————
আজ চাঁদের দেখা নেই। মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পরেছে। আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে। বৃষ্টি নামবে বোধহয়। অধরা দুঃখে প্রকৃতিও কাঁদবে আজ। অধরা নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে নির্বিকার ভাবে। ঘরের আলোও জ্বালয়নি আজ। যার মনে নেমেছে আঁধার রাত, কৃত্রিম আলো কি আর পারে সে আঁধার শুষে নিতে। পারে না তো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছমছম ছন্দ তুলে বৃষ্টি নামে ধরণীতে। গর্জে উঠে আকাশ। অধরা বজ্রপাতে ভয় পায় না। আপা, বাবা, দাদি বাসায় না থাকলে তাকে তো একা থাকতে হতো। কতদিন যে এমন বজ্রপাতে ভয়ে কাঠ হয়ে ঘরে বসে থেকেছে, সে খেয়াল কেউ রাখেনি। মানিয়ে নিতে নিতে ভয় দূরে পালিয়ে গেছে। অধরা এখন কঠিন বজ্রপাতের শব্দেও অনড় চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। অধরা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়। উন্মাদের মতো হাসে। চুপ হয়ে যায় পরক্ষণেই। হাতে বৃষ্টির কণা এলোপাতাড়ি ভাবে পরছে। সে আকাশের দিকে চায়। ফিসফিস করে শুধায়, ‘তুমি কেন কাঁদো? তোমার কি অনেক দুঃখ? তোমার কি মা আছে আকাশ? আগলে রাখার মতো মা? মা থাকলে তুমি কাঁদো কেন? দেখ আমার মা নেই, কেউ নেই, কিচ্ছু নেই, তবুও আমি কাঁদছি না।”
অধরা ফের হাসে। সশব্দে! তার হাসির ঝংকার দরজার বাইরে থেকে শুনতে পায় তানিশা, আঁখি। বুক কেঁপে উঠে তানিশার। হাসিও এতো বিষাদময় হয়! তানিশা ভেবে পায় না। অধরা ফিসফিস করে উঠে আবারও, ‘ধূর আমি কিসব বলছি, তোমারও তো মা নেই আকাশ। তবুও তুমি সুখী।’
অধরা থামে। নিজেই আবার বলতে লাগে, ‘তোমার তো মা ছিলো না কখনো। তুমি তো মিথ্যা আশায় দিন গুনোনি।”
চুপ হয়ে যায় অধরা। কথার তাল হারিয়ে ফেলে। এতক্ষণ পর আবার চোখ ভিজে উঠে ওর। ফুঁপিয়ে উঠে বলে, ‘আমাকে বাবাও ঠকালো আকাশ। বাবা আমাকে মিথ্যা আশা দেখিয়ে ভালোবাসার কাঙ্গাল বানালো।’
হু হু করে কেঁদে উঠলো অধরা। তানিশা এবার আর থাকতে পারলো না বাহিরে। বারান্দার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। অধরা ততক্ষণে নিচে বসে পেরেছে। কান্না আটকাতে নিজের চুল গুলো খামছে ধরে আছে। তবুপ কান্না থামলো না। অধরা কান্নারত স্বরে বলে উঠলো, ‘আমার আশা গুলো ধ্বং*স হয়ে গেলো আকাশ। মানুষ নাকি আশায় বাঁচে। যার আশা নেই সে কি করে বাঁচে?’
কান্নার তোপে আটকে যায় কথা। তবুও বিরবির করে বলে, ‘আমি তবে বাঁচবো কি করে। আমার কোন আশা নেই। বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। শুনেছি মানুষ নাকি নশ্বর এই পৃথিবীতে অবিনশ্বর হতে চায়? কেন চায়? দুঃখ পেতে? দুঃখ পেয়ে ওরা কিভাবে বাঁচতে চায় আকাশ? তুমি জানো? আমায় বলবে? শিখিয়ে দিবে একটু?’
আঁখির সয় না ছোট বোনটার এমন আহাজারি। সে মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে। তানিশা তাকিয়ে থাকে। তার বুকটা পুরে যাচ্ছে। কি করবে সে। একসাথে এতো গুলো চাপ কে সহ্য করতে পারে। পনেরো বছরের মেয়েটা, মাত্র দুই দিনে কতকিছু সহ্য করলো। তানিশা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।
আর কথা বের হয় না অধরার মুখ থেকে। ছোট শরীরটা শটান হয়ে পরে যায় বারান্দার ফ্লোরে। তানিশা এসে আগলে নেয়। অতিরিক্ত মানসিক চাপে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।
চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফিরানো হলো অধরার। জ্ঞান ফেরার পর কিছু সময় চুপ করে বসে রইলো সে। বুঝতে চেষ্টা করলো কি হয়েছে তার। একে একে মনে পড়ে গেলো সব। চোখ তুলে তাকালো সামনে। আপা, বাবা, দাদি, আঁখি আপা, সেঝ চাচি, তোষা আপা দাঁড়িয়ে আছে। অধরার অধর প্রসারিত হলো। ঠোঁট বাকিয়ে হাসলে সে। বাবার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তুমি ভীষণ অপরাধী বাবা।”
ফয়জাল হাসান অসহায় চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। অধরা হেসে বললো,
“এমন একটা জীবন পাওয়ার থেকে পৃথিবীতে না আসা ভালো ছিলো না বাবা? তুমি বাবা হয়েও আমার ভালো বুঝলে না। আমায় এতো কষ্ট দিলে বাবা।”
ফয়জাল হাসান অস্ফুটে স্বরে ডাকে,
“মা!”
অধরা হাসে, শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতেই তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে। বাবার দিকে না তাকিয়ে সিলিং এর দিকে তাকায়। অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে,
“তুমি আমায় মিথ্যে আশা দিলে বাবা। সব মিথ্যে। একটা শব্দও সত্যি নয়। তুমি আমায় এভাবে ভেঙে না দিলেও পারতে বাবা। আমায় সত্যি বলে দিলেই পারতে যে আমায় কখনো আম্মু ভালোবাসেনি আর না কখনো বাসবে।”
ফয়জাল হাসান কথা বলতে পারেন না৷ এমন শক্ত সামর্থ মানুষ হয়েও তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়ায়। অধরা আর কিছু বলে না। ঘরজুড়ে নীরবতা। দৈবাৎ অধরা বলে উঠে,
“আমি তোমায় বিশ্বাস করতাম বাবা। তুমিও আমার বিশ্বাস ভেঙে দিলে?”
আবার নিশ্চুপ,
“আশ্চর্য, তোমরা সবায় আমার বিশ্বাস ভাঙার খেলার মেতে উঠলে কেন? বিজয়ী হয়েছে সবায়? অনুভূতি কেমন? ভালো লাগছে?”
ফয়জাল হাসান কিছু বলতে চাইলেন। অধরা সুযোগ দিলো না। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। বলল,
“আমি ঘুমাবো। যাও এখান থেকে সবায়। তোমাদের কাউকে আমার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। যাও এখান থেকে।”
কেউ কথা বাড়ালো না। বাড়ানোর সাহস পেলো না। এলোমেলো হয়ে যাওয়া অধরার কথায় কিছু মনেও করলো না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তবুও মেয়েটা শান্ত হোক।
#চলবে…?