দ্যুলোকে নব ঊষা পর্ব-১৪+১৫

0
2

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৪

সময়টা দুপুর। ঘরের মেঝেতে বসে আছে এক কিশোরী। পাশেয় এক রিম কাগজ। সে নিজের ইচ্ছে মতো কাগজ নিয়ে ভাজ করছে। তারপর নিপুণ হাতে সেলাই করে তৈরি করছে একের পর এক খাতা। আঁখি কলেজ থেকে ফিরে অধরার রুমে এসে সেই দৃশ্য দেখলো। সে এসে বসলো বিছানায়। মুচকি হেসে বলল,

“খাতা বানাচ্ছিস? কি করবি?”

অধরা চোখ তুলে একবার তাকালো আঁখির দিকে। কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। কোন জবাব না দিয়ে আবার মনোযোগ দিলো নিজের কাজে। আঁখিও আর বিরক্ত করলো না। কিছুক্ষণ পর চলে গেলো নিজের ঘরে।
খাতা গুলো বানিয়ে সব জিনিস উঠিয়ে রাখলো জায়গা মতো। তারপর টেবিলে সাজালো বই। গল্পের বই গুলোও একপাশে রাখলো। খাতা গুলো আপাতত রেখে গোসলে গেলো। আরো অনেক কাজ বাকি তার।

ফয়জাল হাসান তানিশা, আঁখির মুখে শুনলো মেয়ের পরিবর্তনের কথা। তিনি খুশি হলেন। মেয়েকে তার অনেক কিছু বলার আছে। আর একটু স্বাভাবিক হোক মেয়েটা। কয়েকটাদিন যাক। মেয়ের সাথে এমন দূরত্ব তার ভিতরটা পুড়িয়ে ফেলছে।

বিকেল বেলা। অধরা তার রঙিন কলম, রঙ, স্কেল আর বানানো খাতা নিয়ে বসেছে। খাতার উপরের পৃষ্ঠায় নিজের মন মতো করে আঁকতে লাগলো। কতদিন পর আঁকতে বসলো সে! অন্যরকম শান্তি অনুভব করলো। পরের দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে অধরা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে নিলো। নাস্তা করতে নিচে গেলো না। কাউকে কিছু জানালোও না। সবায় যখন নিজ নিজ কাজে চলে গেছে তখন সিঁড়ি বেয়ে নিজে নামলো অধরা। কোনদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো সামনের দিকে। নবনী আনজুম সোফায় বসে ছিলেন। তিনি ডেকে উঠলেন,

“আসফিন! নাস্তা করোনি তুমি। না খেয়ে স্কুলে যাচ্ছ?”

অধরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। কোন উত্তর দিলো না। নবনী আনজুম আর কথা বাড়ালেন না। তিনি মেয়েটার অবস্থা জানেন। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করলেও কারো সাথে কথা বলে না, কোন প্রশ্নের উত্তর দেয় না। তিনি সেঝ ছেলের বউ আয়েশাকে ডেকে অধরার জন্য টিফিন দিতে বললেন। আয়েশা দ্রুত টিফিন বক্সে নাস্তা সাজিয়ে আনলো। অধরার ব্যাগে ভরিয়ে দিলো। অধরা কোন প্রতিবাদ করলো না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।

স্কুলে অধরার খুব ভালো বন্ধু কেউ নেই। সবায় তাকে অহংকারী ভাবে ভালো শিক্ষার্থী বলে। অনেকেই মিশে না। যারা কথা বলে তারাও শুধুমাত্র স্বার্থের জন্য। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলতে গেলে আরাব। কিন্তু আরাব তো তার সাথে কথা বলে না। একা একাই কাটালো পুরো সময়। ভাগ্যিস মা বইটা সাথে নিয়ে এসেছিল। সময় তাই কেটে গেলো।
এভাবেই চলতে লাগলো অধরার দিন। একা একা! নিঃসঙ্গ ভাবে। সেদিন রাতে অধরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলো। তার নিঃসঙ্গ জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সাথে কথা বলছিলো। জানায় তার মন খারাপের কথা। তখন তার পাশে এসে দাঁড়ালো ফয়জাল হাসান। তার বাবা। অধরা বুঝলো কিন্তু ফিরে তাকালো না। ফয়জাল হাসান কিছুটা দ্বিধায় ভুগছেন। কিভাবে শুরু করবেন কথা। তিনি আলতো স্বরে ডাকলেন,

“আসিফন!”

অধরা চোখ তুলে তার দিকে তাকালো। তবে কোন উত্তর দিলো না। তাকিয়ে রইলো শান্ত চোখে। ফয়জাল হাসান ওই চোখে কোন অনুভূতির ছাপ খুঁজে পেলো না। তিনি কথা বলতে ভুলে গেলেন বোধহয়। তবে তাকে বলতেই হবে। তিনি অন্যদিকে তাকালেন। অধরার অনুভূতিহীন চোখের দিকে তাকিয়া থাকা দুষ্কর মনে হলো তার। অধরা মতো তিনিও তাকালে চাঁদের দিকে। বলতে শুরু করলেন,

“ভালোবেসে তোমার আম্মুকে বিয়ে করে ছিলাম। তার ইচ্ছে ছিলো নিজের পড়াশোনা ঠিক রাখবে, সুন্দর একটা ক্যারিয়ার হবে। আপত্তি ছিলো না আমার। সব কিছু ঠিকঠাক চলছিলো। এরমাঝে তুবা জানালে ওর গর্ভে আমার সন্তান। আমি কি যে খুশি হলাম। কিন্তু খুশি নষ্ট করে দিলো তোমার মা। সে রাখতে চায় না বাচ্চা। অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তার সিদ্ধান্তে সে অটল। তখনই ঝগড়ায় সম্পর্ক খারাপ হতে লাগলো আামাদের। কিন্তু আমি কখনোই একটা প্রাণ, আমার অংশকে হত্যা করতে দেয়নি। অবশেষে তুমি এলে। আমি ভেবেছিলাম নয় মাস তোমাকে যে গর্ভে রেখেছে সে নিশ্চয়ই তোমাকে ভালোবাসবে কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো। আম্মা জানালো তুমি ভালো নেই। আবার ঝগড়া হলো আমাদের। ডিভোর্সের কথাও আসলো। কিন্তু তুবা গলে গেলো। অনুরোধ করলো যেন ডিভোর্সের দিকে না যাই। সে তোমার খেয়াল রাখবে। এরপরের দিন গুলোতে আমি বাসায় এলে তোমাকে তুবার কোলেয় দেখতাম। ভাবতাম এই তো ভালো আছে আমার মেয়ে। কিন্তু আমার চোখে যে কালো পর্দা টাঙানো হয়েছে তা বুঝতে পারিনি। আমাকে বলার মতোও কেউ ছিলো না। বাবা অসুস্থ হয়ে পরে। আম্মা বেশিরভাগ সময় কাটান হসপিটালে। আর কেউ ছিলো না আমাকে সত্যিটা বলার।

তোমার যখন পাঁচ বছর। নিজেই অনেক কিছু বোঝ তখন খেয়াল করলাম তুমি তানিশার কাছ থেকে আসতে চাও না। তুবা হাজার চেষ্টা করলেও তোমাকে নিতে পারতো না। আমি অবাক হয়ে গেলাম। তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম কেন মায়ের কাছে আসতে চাইছো না। তুমি কখনো অভিযোগ করোনি। কোন কারণ বলতে না। তাই একদিন তানিশাকে জিজ্ঞেস করলাম। ওর কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হলো। আমি আমার রাজকন্যাকে দেখে রাখতে পারিনি। এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম তাকে রাখবো না আর আমার জীবনে। কিন্তু নিয়তি অন্যরমক ছিলো জানতে পারলাম আমার দ্বিতীয় সন্তান আসছে। তার সাথে বোঝাপড়া হলো। তখন থেকেই মূলত তুবা তোমাকে যেমন স্নেহ করে না শাসনটাও কম করতো। আমি সাবধান হয়ে গিয়েছিলাম। দেখে দেখে রাখতাম তোমাকে। অরুমিতা হওয়ার পর দেখলাম তুবা তাকে মাতৃস্নেহ দিচ্ছে। তুমি মা ছাড়া বড় হয়েছো। মাঝরাতে মায়ের ভালেবাসার জন্য তোমাকে কাঁদতে দেখেছি। বাবার মৃত্যুর পর বুঝলাম একটা সন্তানের জন্য বাবা কি জিনিস! তোমাকে পূর্ণতা দিতে পারিনি তাই স্বার্থপর হয়ে অরুকে পূর্ণতা দিতে চাইলাম। ডিভোর্স দিলাম না তোমার মা’কে!

আমি সব সময় তোমার মা-বাবা দুটোই হতে চেষ্টা করেছি মা। হয়তে সফল হয়নি। মায়ের আদর সে তো অন্যরকম। দিতে পারিনি তোমাকে সেটা। কিন্তু তোমাকে খুশি রাখতে চেয়েছি। মায়েরা তো পাষাণ হয় না। আমিও ভাবতাম কখনো না কখনো তোমাকে তুবা ভালেবাসবে। কাছে ডেকে নিবে। তাই তোমাকে খুশি রাখতে বলতাম তোমার মা’ও তোমায় ভালোবাসবে। কিন্তু আমি বোধহয় ভুল। আমি সরি মা। বাবা তোমার খুশি দেখতে চেয়ে তোমার বিশ্বাস ভেঙে ফেলেছি। মিথ্যা বলেছি। বাবাকে পারলে ক্ষমা করে দিও।

ব্যর্থ বাবা আমি! মেয়েকে আগলে রাখতে পারিনি। সরি মা। বাবা সত্যি খুব সরি।”

ফয়জাল হাসানের কন্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে। অধরা নীরবে শুনলো সব। মেয়ের কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে ফয়জাল হাসান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বারান্দা থেকে চলে যাবেন মনস্থির করতেই শুনতে পেলেন মেয়ের ফোঁপানোর শব্দ। তিনি আলতো করে ডাকলেন,

“মা!”

অধরা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ঝাপিয়ে পরলো বাবার বুকে। কাঁদলো অনেকটা সময়। কাঁদতে কাঁদতে বলল,

“দুঃখিত বাবা। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য।”

একই কথা বারবার বললো। ফয়জাল হাসানের চোখ বেয়েও অশ্রু ঝরলো। গোপনে মুছে ফেললন সেই কান্না। অধরাকে সান্ত্বনা দিলেন। মৃদু স্বরে বললেন,

“বোকা মেয়ে। কাঁদে না। বাবা কষ্ট পাইনি। থামো। তুমি কাঁদলেই কষ্ট পাবো আমি।”

অধরা চোখ তুলে তাকালো বাবার দিকে। কান্নারত চোখে একটু হাসলো। মিষ্টি করে বলে উঠলো,

“আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি বাবা।”

ফয়জাল হাসান হাসলেন। প্রাপ্তির হাসি তার ঠোঁটে।

———————–
“এভাবেই ফিরে আসা। বাবা, বড় ভাইয়া, আপা, আঁখি আপা, সেঝ মা অনেক সাপোর্ট করে। আর একজন খুব গোপনে খেয়াল রাখে আমার। সে প্রকাশ করে না তাই আমিও বুঝতে দেই না।”

তাওসিফ হেসে বলল,

“কে সে?”

অধরা আলতো হেসে বলল,

“অরুমিতা। আমার ছোট বোন।”

তাওসিফ চুপ। অধরাও মাথা নিচু করে বসে আছে। পুরো গল্পটা কাউকে বলে নিজের মধ্যে এক টুকরো শান্তি অনুভব করছে সে। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটা বিশাল পাথর নেমে গেছে। তাওসিফ হুট করে ডেকে উঠলো,

“অধরা।”

তাওসিফের মুখে প্রথমবার নিজের নাম শুনে কিছুটা চমকে উঠলো অধরা। তড়িৎ তাকালো তার দিকে। বুকটাও কেঁপে উঠলো একটু। তাওসিফ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অধরা আনমনে উত্তর দিলো,

“হু?”

তাওসিফ ঠোঁট দু’টো প্রসারিত করে হাসলো। পরক্ষণেই হাসি মিলিয়ে গেলো। কিছটা গম্ভীর হয়ে বলল,

“তুমি বলেছিলে তোমাকে জানাতে চাও। আমিও জানতে এসেছি। অতীত নয় অধরা, আমি তোমাকে জানতে চাইছি।”

অধরা দ্বিতীয় বারের মতে চমকে উঠলো। বিরবির করে বলল,

“আমাকে জানতে চাইছেন?”

তাওসিফ মৃদু হেসে বলল,

“হ্যাঁ, তোমাকে জানতে চাইছি। অতীত আর তুমি এক নও। অতীত নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই।”

“তবে এতো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন কেন?”

“তুমি চেয়েছো আমি শুনি, তাই শুনেছি।”

অধরার চোখে পানি আসতে চাইলো। সে চেয়েছে বলে মানুষটা এতো লম্বা গল্প শুনলো? তার অতীত নিয়ে কোন সমস্যা নেই তার? সত্যি? অধরার পুরোটা কল্পনা মনে হলো। লোকে তো অতীত-ই খোঁজে। তারপর কলঙ্ক লাগায় গায়। তবে এই লোকটা অন্যরকম কেন হবে? সত্যিই অন্যরকম? ভাবনায় পরে গেলো অধরা।

#চলবে…?

#দ্যুলোকে_নব_ঊষা
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৫

বাদাম, বাদাম বলে পাশ দিয়ে চলে গেলো একজন। চলে গেলো একদল দূরন্ত পাখি। হাসতে হাসতে একজন অন্য জনের উপর হেলে পড়তে লাগলো তারা। ওরা বোধহয় বন্ধু সবায়। বোধহয়? না না, বন্ধুই তো। অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ওদের দিকে চেয়ে। দৃষ্টি সরিয়ে নিলো অন্যত্র। অধরা ভাবনা গুলো আবার তাওসিফে সীমাবদ্ধ করলো। তাওসিফ আবরার, ছেলেটা তাকে জানতে চাইছে! অধরার অতীতকে এক চুটকি দিয়ে বহুদূর ফেলে দিলো লোকটি। কিন্তু কেন? যেই অতীতকে কেন্দ্র করে অধরাকে সবাই ঘৃণা করে সেই অতীত তাওসিফ নামের লোকটার কাছে কিছুই নয়? লোকটা কি সত্যিই অন্যরকম? অধরার ভাবনার মতো?

তাওসিফ অধরাকে দেখছে। সূক্ষ্ম ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। কিছু সময় আগে অধরা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে, সেটাও তার চোখ এড়ায়নি। অধরা ভাবনায় মশগুল। তাওসিফ জানতো এমন হবে। অধরা বরাবর দেখেছে তার অতীত নিয়ে সবার সমস্যা। এই অতীত তাকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করে রাখে। আর আজ সে সেই অতীত নিয়ে কোন সমস্যা নেই বলেছে। অধরা অবাক হয়েছে। মেনে নিতে পারছে না। তার কাছে বড়োই আশ্চর্যের ব্যাপার এটা। তাওসিফ স্মিত হাসলো। ঠোঁট দুটো প্রসারিত করেই বলে উঠলো,

“তোমাকে নিয়ে বলো অধরা। আমি তোমাকে জানতে চাইছি।”

অধরা চমকে নিজের ভাবনা থেকে বের হয়। তাওসিফেী চোখে চোখ রাখে। কিছুটা ফিসফিস করে বলে,

“আমাকে নিয়ে বলবো?”

অধরার এখনো বিশ্বাস হয় না বাবা, আপা আর গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া অন্য আরো একজন তাকে জানতে চাইছে, তার অতীতকে নয়। তাওসিফ অধরার চোখের দিকে তাকিয়ে তাকে ভরসা দেয়। হাসে ভরসা মাখা হাসি। অধরা সত্যি ভরসা পায়। আলতো স্বরে বলা শুরু করে,

“আমি ভীষণ একা। সারাদিন একা একাই থাকি। সবায় ভাবে আমি একায় থাকতে ভালোবাসি অথচ আমিও সঙ্গ চাই।
আমি কথা বলি খুব কম। কথা বলার মানুষ নেই যে! অথচ আমিও চাই আমার কথা কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনুক।
সবায় ভাবে আমি অহংকারী। তাই কারো সাথে মিশি না। অথচ আমিও বন্ধু চাই কিন্তু অতীত জানার পর সবায় দূরে সরে যাবে এই ভয়ে মিশতে পারি না।
আমি বদ্ধ ঘরে থাকি সব সময়। সবার ধারণা আমার সেই খাঁচায় পছন্দ। অথচ আমিও ভোরের পাখির মতো দল বেঁধে উড়ে চলার স্বপ্ন দেখি। ফের সন্ধ্যায় দল বেঁধে ঘরে ফেরার ইচ্ছে পোষণ করি।
সবশেষে আমি ভীষণ বই ভালোবাসি। আমার প্রিয় বন্ধু। বইয়ের সমুদ্রে ডুবে মরে গেলেও আফসোস নেই।
আর পছন্দ করি চাঁদ। আমার নিশি রাতের বন্ধু। যাকে আমি আমার মন খারাপের গল্প শোনায় রোজ।”

অধরা থামে। বড় করে শ্বাস নেয় একবার। তাওসিফ এতক্ষণ মস্তিষ্কে নোট করছিল অধরার পছন্দ গুলো। অধরাকে বড় করে শ্বাস নিতে দেখে তাওসিফ কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। তাকিয়ে দেখে মেয়েটাকে। চোখ দুটো পিটপিট করছে। অধরা ফের বলে উঠে,

“এই তো। এটুকুই আমি।”

তাওসিফের চোখে চোখ রেখে শেষ করে অধরা। তাওসিফ মুচকি হাসে। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলে উঠে,

“চলো হাঁটি।”

অধরা তাওসিফের দিকে তাকায়। কথাটা তার বোধগম্য হয়নি। হবে কি করে। বহুদিন হয়ে গেলো কেউ তাকে বলেনি, অধরা চলো হাঁটি একসাথে। অধরা তাকাতেই তাওসিফ ভ্রূ বাঁকিয়ে ইশারায় বলে,”কি?” অধরা ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে বোঝায় কিছু না। উঠে আসে বেঞ্চ থেকে। হাঁটতে শুরু করে তাওসিফের পাশাপাশি। কিছু সময়ে নীরবে কেটে যায়। তাওসিফ জিজ্ঞেস করে,

“কারো পাশাপাশি এভাবে হেঁটেছো আগে?”

অধরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠে,

“আগে স্কুলে যাওয়া-আসার সময় আরাবের পাশে হাঁটাতাম। কোথাও ঘুরতে গেলে কাজিনদের পাশে।”

এতটুকু বলে তাওসিফের দিকে তাকালে অধরা। ভবলো তাওসিফ বোধহয় প্রশ্ন করবে আরাব কে? কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে তাওসিফ শুধু মুচকি হাসলো। ততক্ষণে তারা বাতিঘরের সামনে পৌঁছে গেছে। তাওসিফ ফের বলল,

“বাতিঘরে আসা হয় মাঝে মাঝে তাই না?”

“হ্যাঁ, আপনি কিভাবে জানলেন?

অধরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। তাওসিফ শব্দ করে হেসে ফেলে। অধরা বুঝতে পারেনা হাসির কি বলল সে। তাওসিফ হাসি থামিয়ে তাকায় অধরার দিকে। বলে,

” কিছুক্ষণ আগে বলেছো তোমার বই পছন্দ, সেই হিসেবে বলেছি বাতিঘরে আসো নিশ্চয়ই!”

অধরা কিছুটা বোকা বনে যায়। তাই তো! বইপ্রেমীরা তো বাতিঘরে আসেয়। হাঁটতে থাকে তারা নীরবে। তাওসিফ তাকিয়ে দেখে তার পাশের মেয়েটাকে। নিজেকে প্রশ্ন করে, এটা কি স্বপ্ন? পরক্ষণেই ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠে। স্বপ্ন হবে কেন? অধরা আড়চোখে তাকায় তাওসিফের দিকে। বুঝতে চায় লোকটাকে। কিন্তু পারে না। কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগে সব।

হাঁটতে হাঁটতে তারা চেরাগি মোরে পৌঁছে যায়। এতক্ষণে ধ্যান ভাঙে অধররা। চেরাগি মোর! চট্টগ্রামের শিল্প, সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এটি। এটি নগরীর জামালখান সড়ক ও মোমিন সড়কের মধ্যস্থলে অবস্থিত। চট্টগ্রামের কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, পাঠক-লেখক, সংগঠকদের মিলনস্থল হিসেবে চেরাগি পাহাড় পরিচিত। বর্তমানে এই স্থানে চেরাগী পাহাড় নামে কোন পাহাড়ের অস্তিত্ত্ব না থাকলেও এখানে তিন রাস্তার সংযোগ স্থলে রয়েছে চেরাগ আকৃতির স্থাপনা। এই স্থাপনাই বর্তমানে চেরাগি পাহাড় নামে পরিচিত। কথিত কাছে, ১৪ শতকে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুফি সাধক বদর আউলিয়া আরব থেকে সমুদ্রে ভাসমান একটি পাথরে আরোহন করে এগারোজন দরবেশ সহ চট্টগ্রাম এসেছিলেন। তিনি তার অলৌকিক চেরাগ হাতে জন-মানবহীন পাহাড় পর্বতে ঘেরা চটগ্রামের একটি পাহাড়ে উঠলে জ্বীন-পরীরা তাকে বাধা দেয়। পরে তিনি তার চেরাগ রাখার বিনিময়ে পাহাড় ত্যাগ করেন। অতঃপর তার অলৌকিক চেরাগের বিকিরণের তেজ সহ্য করতে না পেরে জ্বীন-পরীরা চট্টগ্রাম ছেড়ে প্রস্থান করে। এছাড়াও বলা হয় গভীর রাতে সেই চেরাগের আলো দেখা যেত বহুদূর থেকে। তাই এই স্থানের নাম চেরাগি পাহাড়।

চেরাগি মোরের অন্যতম সৌন্দর্য রাস্তার দু’ধারে পাশাপাশি ফুলের দোকান গুলো৷ একসাথে এতো ফুলের দোকান চট্টগ্রামের অন্য কোথাও দেখা যায় না। হরেক রঙের, গন্ধের ফুল দেখা যায় এসব দোকানে। এতো ফুল একসাথে দেখে যে করো চোখ জুড়িয়ে যাবে। অধরাও অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। কতদিন পর এখানে এসেছে সে। কতদিন পর দেখলো সাজিয়ে রাখা ফুলের রাজ্য। ফুল ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো তার। অধরার চোখের ভাষা তাওসিফ বুঝলো বোধহয়। সে অধরাকে নিয়ে দাঁড়ালো একটি ফুলের দোকানের সামনে। রঙ বেরঙের ফুল রেখে সে দোকানী কে বলল তিনটি সাদা গোলাপ একসাথে বেঁধে দিতে। দোকানী ফুল থেকে কাঁটা সরিয়ে একত্রে জুড়ে দিয়ে তা তাওসিফের হাতে দিলো। তাওসিফ মূল্য পরিশোধ করে আবারো অধরাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। কিছুদূর হাঁটার পর তাওসিফ ফুল গুলো অধরার দিকে এগিয়ে দেয়। অধরা চোখ তুলে তাকায় তাওসিফের দিকে। তাওসিফ মুচকি হেসে বলে,

“যুদ্ধে কোন দল আত্মসমর্পণ করতে চাইলে সেই দল সাদা পতাকা উড়িয়ে দেয়। এর অর্থ তারা সন্ধি করতে চায়। তুমিও কিন্তু যুদ্ধে নেমেছো। বিয়ে ভাঙার যুদ্ধ। এবার সন্ধি করি আমরা কি বলো? সাদা পতাকার বদলে তাই তোমার জন্য সাদা গোলাপ।”

অধরা কিছুটা অবাক হয়ে বলে,

“আমি যুদ্ধ করতে চাইনি। শুধু আপনাকে সব সত্যিটা জানাতে চেয়েছি।”

তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,

“তাহলে বন্ধু হিসেবে দিচ্ছি। তুমি তো বন্ধু চাও। আমি হই তোমার বন্ধু? বাকি ইচ্ছে গুলো পূরণ করার প্রথম শর্ত কিন্তু বন্ধু হওয়া। আমি বন্ধু হলে তোমার অতীত ভেবে দূরে সরে যাব না, তোমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনবো, একসাথে ঘুরবো, বই পড়বো। উমম, চাঁদও দেখতে পারি।”

অধরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে তাওসিফের দিকে। তাওসিফ ফুল গুলো অধরার সামনে ধরে বলল,

“এবার বলো, আমার বন্ধু হবে? হতে চাইলে ফুল গুলো নাও।”

অধরা হেসে ফেললো। ফুল গুলো হাতে নিলো। তার ভীষণ ভালো লাগা কাজ করছে। ভালো লাগবার-ই কথা। কেউ একজন তার সকল ইচ্ছে পূরণ করতে চাইছে এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে? তাওসিফ মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকলো অধরার হাসি মুখের দিকে। অধরা তাওসিফের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,

“আপনাকে ধন্যবাদ।”

তাওসিফ আলতো হেসে বলল,

“স্বাগতম।”

হাঁটতে হাঁটতে আবারও জামালখান মোরে এসে পৌঁছাল তারা। তাওসিফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

“সন্ধ্যা হয়ে গেছে প্রায়। তোমার বাড়ি ফেরা উচিত।”

অধরা হাসলো কেবল। কোন কথা বলল না। তাওসিফ একটা রিকশা ডেকে অধরাকে উঠতে বলল। অধরা কোনরূপ প্রতিবাদ না করে উঠে বসলো। তাকালো তাওসিফের দিকে। তাওসিফ মুচকি হেসে বলল,

“পৌঁছে টেক্সট করবেন। সাবধানে যাবেন।”

তারপর রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল,

“সাবধানে যাইয়েন মামা।”

রিকশা চলতে শুরু করলো। অধরা বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে গেলো। তাওসিফে আপনি সম্বোধনে সে বড়ো অবাক হয়েছে। বিরবির করে বলে উঠলো সে,

“আপনি বড়ো অদ্ভুত তাওসিফ আবরার।”

#চলবে…?