#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২.
“ইস ইট ইউর বেডরুম মৃত্তিকা?”
উচ্চস্বরে বলা কথাটা কর্ণগোচর হতেই ঘুম ছুটে যায় মৃত্তিকার।ধরফরিয়ে উঠে বসে সে।সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে তাই অফিসে এসে টেবিলে একটু মাথা এলিয়ে দিতেই ঘুম ঝেঁকে বসে ছিল চোখে।আচমকা পুরুষালী কন্ঠে সেই ঘুম পালিয়েছে।মৃত্তিকা স্পষ্ট চোখে তাকাতেই অচেনা এক যুবককে দেখে আরো ভড়কায়।এই মুহুর্তে সে ডেইজি ইন্ডাস্ট্রির উত্তরাধিকারী বেশে নেই বরং সে এখন হন্তভম্ব এক রমনী।
মৃত্তিকার এমন হন্তভম্ব মুখশ্রী দেখে মনে মনে হাসে দর্শন।তারপর ফের শক্ত কন্ঠে খানিক উচ্চস্বরেই বলে,
“তোমার কেবিনে কেউ আধঘন্টা যাবত বসে আছে আর তুমি ঘুমাচ্ছো?ডোন্ট ইউ হ্যাভ এনি সেন্স ওফ টাইম?”
মৃত্তিকা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।পাঁচ মিনিটে আসছি বলে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে সে।
ওয়াশরুমে ঢুকে চোখেমুখে পানি দেয় মৃত্তিকা।আরশিতে তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে দৃষ্টি দিয়ে নিজের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে সে।কি লজ্জাজনক ব্যাপার!লোকটা যেই হোক কিভাবে তার সময়জ্ঞান নিয়ে অপমান করলো তাকে!
তোয়ালে দিয়ে চোখে মুছে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসে মৃত্তিকা।প্রথমেই চোখ বুলায় তার মুখোমুখি চেয়ারে।ওমনি ভ্রু কুঁচকে আসে তার।কেউ নেই!তবে কি ঘুমের ঘোরে ভুলভাল দেখেছে সে?কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে কারো কাশির আওয়াজে ভেসে আসে।চটজলদি শব্দের উৎসের পানে তাকায় মৃত্তিকা।কৃষ্ণ বর্ণের শার্ট পরিহিত সুঠাম গড়নের একজন যুবক বিশাল কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।হাতদুটো পকেটে পুরে রাখা।মৃত্তিকা বলে উঠে,
“কে আপনি?আর আমার কেবিনেই বা এত সময় ধরে কি করছিলেন?”
সহসা মৃত্তিকার পানে ঘুরে তাকায় দর্শন।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভর্তি সুদর্শন মুখ ভেসে উঠে মৃত্তিকার অক্ষিকোটরে।মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মৃত্তিকাতে চোখ বুলায় দর্শন।সুডৌল গড়নের লতানো ফর্সা দেহে গাঢ় খয়েরী রঙ ফুটে উঠেছে প্রখর ভাবে।দর্শন মৃত্তিকার মুখোমুখি হয়েও তাকে পাশ কাটিয়ে এসে চোয়ারে বসে।তারপর বিস্ময় ও প্রশ্নাক্তোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মৃত্তিকা লর পানে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে উঠে,
“বসো!”
মৃত্তিকা দর্শনকে ভালো করে দেখে ধীরে সুষ্ঠে আসনে বসে।সে বসতেই দর্শন গম্ভীর স্বরে বলতে শুরু করে,
“আমি দর্শন মির্জা,দানিশ মির্জার ছোট ছেলে।”
কথাটুকু বলে দর্শন মৃত্তিকার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামে।তারপর বলে,
“তোমার কোম্পানির সাথে..”
“আপনার কোম্পানির সাথে কোন ডিল আমি করছি না”
সহসা দর্শনের দৃষ্টি সরু হয়ে আসে।তারপর কিছুটা এগিয়ে সে মৃদু আওয়াজে বলে উঠে,
“মিস মেহেরজান,তুমি অল্পবয়সী কাঁচা মস্তিষ্কের বিজনেস ওম্যান।”
এমন কথায় গোল গোল দৃষ্টিতে দর্শনের পানে তাকায় মৃত্তিকা।শুষ্ক একটা ঢোক গিলে সে।কিন্তু কেন তার জানা নেই।সামনে উপবিষ্ট দর্শন মির্জা যে তুখোড় বিজনেসম্যান তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে সে।
দর্শন আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসে।বলে,
“তোমার বাবার সাথে আমাদের বিজনেসের সম্পর্ক বহুদিনের।তুমি এই ডিলটা রিজেক্ট করেছো জানলে উনি বেশ অসন্তুষ্ট হবেন।আর আমি যতটুকু জানি ইউ নেভার হার্ট ইউর ফাদার।”
“উনার বহুদিনের বিজনেস পার্টনারের ছেলে ওনার মেয়েকে বাজে প্রস্তাব দিয়েছে এটা জানলে নিশ্চয়ই উনি খুশি হবেন না!মিস্টার দর্শন আপনার ধারণা অবশ্যই সঠিক নয়।আমি কাঁচা মস্তিষ্ক নিয়ে বিজনেস করতে মোটেও আসিনি”
আচমকা দর্শনের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি খেলে।সরু নাকের ডগায় স্পর্শ করে সন্দেহপূর্ণ স্বরে বলে উঠে,
“ওহ রিয়েলি জান?আই মিন মেহেরজান!”
মৃত্তিকা ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে উঠে,
“হোয়াট?কি বললেন আপনি?”
“তোমার নাম বেশ লম্বা। তাই আমি এর শর্টফর্ম করে নিয়েছি।জান!উফ সরি মেহেরজান।”
মৃত্তিকা কটমট করে তাকায় দর্শনের পানে। বেশ অসভ্য লোক তো!মৃত্তিকা শক্তস্বরে বলে,
“আমার কথা আমি বলে দিয়েছি।ইউ ক্যান গো নাও!”
দর্শন হাই তোলার মতো ভঙ্গি করে উঠে দাঁড়ায়।পকেটে হাত পুরে দাঁড়ায় সে।একমুহূর্তেই চোখমুখ গম্ভীর হয়ে আসে তার।শান্ত গম্ভীর স্বরে বলে উঠে,
“থিংক সো কেয়ারফুলি মৃত্তিকা।এমন না হয় তোমার দৃঢ় কথা নেওয়া সিদ্ধান্ত তোমাকে বদলাতে হয় বিষন্ন মনে!”
মৃত্তিকা গাঢ় দৃষ্টিতে দর্শনের পানে তাকায়।লোকটার কথার ধরন,চাহনি মুহুর্তেই কেমন পাল্টে যায়!এই মনে হয় ভীষণ বেপরোয়া!আবার এই মনে হয় তার দেখা সবচেয়ে গম্ভীর স্বভাবের মানুষ সে!
দর্শন মৃত্তিকার টেবিলে দুহাত রেখে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়ায়।ওষ্ঠকোণে দুষ্ট হাসি জ্বলজ্বল করে উঠে তার।মৃদুকণ্ঠে বলে উঠে,
“গুড বাই মেহের..জান! এন্ড ফরগেট মি নট।
মৃত্তিকা কোন শব্দ উচ্চারণ না করে হুট করে আসা মানুষটার হুট করে চলে যাওয়া দেখে।দর্শন দরজার ওপারে চলে যেতেই দৃষ্টি সরায় সে।মাথা এলিয়ে আরামে বসার চেষ্টা করে।এক গাঢ় শ্বাস নির্গত হয় শ্বাসনালী থেকে।
.
বাসার ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই ঘরের মেইড বীনা খবর দেয় মৃত্তিকাকে তার বাবা রুমে দেখা করতে বলেছে।অফিস থেকে সবে ফিরেছে মৃত্তিকা।বাবার জরুরি তলব পেয়ে প্রথমেই বাবার দরজায় কড়া নাড়ে।মৃত্তিকার বাবা ইরফান চৌধুরী চেয়ারে বসে কিছু পড়েছিলেন।মৃত্তিকা মৃদু হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উনাকে।মৃদুস্বরে বলে,
” আমায় ডেকেছো বাবা?কোন জরুরি কিছু?”
কথা বলার পাশাপাশি মৃত্তিকার ওষ্ঠকোণে মিষ্টি হাসির ছড়াছড়ি। ইরফান চৌধুরী চোখ তুলে তাকায় মেয়ের দিকে।ইশারায় বসতে বলে তাকে।মৃত্তিকা নাকোচ করে বলে,
“বসবো না।ফিরলাম মাত্র!তোমার কথা শুনেই ফ্রেশ হতে যাবো।তারপর লম্বা একটা ঘুম দিবো।”
বলতে বলতে মৃত্তিকা কল্পনায় তার নরম তুলতুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।তার মিষ্টি কল্পনায় ব্যাঘাত ঘটে ইরফান চৌধুরীর গম্ভীর স্বরে,
” তুমি নাকি দানিশ ইন্ডাস্ট্রির সাথে ডিল ক্যানসেল করেছো?”
মৃত্তিকার দৃষ্টি ছিল বাইরে।গোধুলির আকাশ হলদে রঙে ছেয়েছে।সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বাবার দিকে তাকায় সে।মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে থাকা চোখদ্বয় হাতে থাকা মোটা বইয়ে নিবদ্ধ।সেখানেই দৃষ্টি রেখে আবার বলে উঠেন,
“উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
“হ্যা ক্যানসেল করেছি আর তার যথাযথ কারণও আছে।”
বই বন্ধ করে এবার মেয়ের দিকে তাকান ইরফান চৌধুরী।পুরু আওয়াজে বলেন,
“দানিশ মির্জার সাথে আমার ব্যবসায়িক সম্পর্ক বহুদিনের।আমি চাই না সেটা নষ্ট হোক।ভেবে চিন্তে কাজ করো মেহের।মনে রেখ তোমাকে ছাড়া আমার কোন অপশন নেই।এবার যেতে পারো তুমি।”
বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সালাম দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে মৃত্তিকা।থমথমে মুখশ্রীতে প্রবেশ করে নিজের রুমে।মৃত্তিকার রুমে তার বেডের পিছনে ওয়াল জুড়ে তার পনেরো বছরে হাস্যোজ্জ্বল একটা চিত্র লাগানো।সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয় মৃত্তিকা।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে অর্থাৎ মৃত্তিকার যখন পনেরো বছর তখন ইরফান চৌধুরীর হার্টের সমস্যা ধরা পরে।ডাক্তার সরাসরি মানা করে দেয় কোন প্রকার চাপ না নিতে।তখন থেকে একটু একটু করে বিজনেসে ইলভলব হতে শুরু করে মৃত্তিকা।তারপর ধীরে ধীরে আজকে এই জায়গায়।শ্রেষ্ঠ হয়ে না উঠলেও বিজনেস আয়ত্ত করেছে ভালোভাবে।একটু আধটু সুনামও হয়েছে।কলেজের গন্ডি পেরিয়েছে ভার্সিটিতে উঠেছে একবছর আগেই।
সবকিছু ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয় মৃত্তিকার শ্বাসনালী থেকে।কিছু একটা ভেবে ফোন করে পিএ কে।
একটা লং ড্রাইভ দিয়ে এসে হেলতে দুলতে বাড়িতে ঢুকে দীপন।বাইরে সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে।ধরিত্রী থেকে সকল সূর্যরশ্মি মুছে গিয়ে জ্বলে উঠছে মানব সৃষ্ট আলো।
ড্রয়িংরুমে আসতেই সোভায় লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা দর্শনকে নজরে আসে তার।হাতে রুবিক্স কিউব নিয়ে নিজের সম্পূর্ণ ধ্যান তাতে দিয়ে রেখেছে সে।দীপন তার দিকে এগোতে এগোতে জিজ্ঞেস করে,
” ড্যাড কই রে?”
“আমার কোলে!”
দীপনের দিকে না তাকিয়েই দর্শন উত্তর দেয় খুব ধীরে সুষ্ঠে।ভালোভাবে খেয়াল না করেই দীপন সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে ওহ বলে।কিন্তু হঠাৎ ই অনুধাবন করে দর্শন আসলে কি বলেছে।দর্শনের দিকে ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে দীপন বলে,
-ফাজলামো করিস আমার সাথে?
দর্শন এবার সোজা হয়ে বসে।রুকিক্স কিউবটা সলভ করা হয়ে গেছে।সামনের টি টেবিলে সেটা রেখে সে বলে,
“হ্যা করলাম।কেননা তুই সবকিছুকে এই ফাজলামো করার মতোই নিস।”
দর্শনের শক্ত চোখ মুখ দেখে দীপন কিছু একটা গেস করে।তারপর তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
“ডিল করতে রাজি হয়নি বুঝি?”
দর্শনের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে এবার।দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে উঠে,
“রাজি হয়ে যাবে এতটুকু বিশ্বাস আসে আমার নিজের উপর কিন্তু তুই যা করেছিস তা বাবার কাছে তুললে কি হবে তুই জানিস?”
মুহুর্তেই দীপনের চোখমুখ চুপছে আসে।তখনই রাফিন উপস্থিত হয় সেখানে। কি বলবে তার আগেই তাকে চুপ করিয়ে দেয় দর্শন।তারপর বলে,
“আর তোর হবু বউ শুনলে কি রিয়েকশন দিবে সেটা অভিনয় করে দেখাও তো রাফিন।”
আচনকা এমন কথায় আটকে উঠে রাফিন।দর্শন তখন আয়েশ করে গা এলিয়ে বসেছে।রাফিন সংকোচ নিয়ে বলে,
“স্যার আমি”
“হ্যা তুমি।কুইক!”
কথা শেষ করে কড়া চোখে তাকায় দর্শন।বেচারা রাফিন।গলার স্বর চিকন করে দীপনের উদ্দেশ্যে তাকিয়ে বলে উঠে,
“দীপন!তুমি একটা মেয়েকে এমন বাজে প্রস্তাব কি করে দিতে পারলে?এটা শোনার আগে আমি ডেড হয়ে গেলাম না কেন?”
রাফিনের মেয়েলী অভিনয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পরে দর্শন।সাথে সাথে লজ্জায় চুপছে যায় ছেলেটা।দীপন ক্ষোভ নিয়ে দর্শনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আ’ম সিউর তোকে ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে মা!”
“আর তোকে বাজে কোন জায়গা থেকে।এইজন্য তোর স্বভাব এত জঘন্য!”
চলবে..
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।