ফরগেট মি নট পর্ব-০৮

0
11

#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৮.
সফেদ লং জামা পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয় মৃত্তিকা।মাথায় ভেজা চুল!চুলের গোড়া থেকে কিছু সময় পরপর বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা পরছে ফ্লোরে।মৃত্তিকা হাতের ভেজা তোয়ালে নিয়ে জানালার পাশে দাড়ায়।তার দৃষ্টি ছুটে যাই ওই অসীম দুরত্বে থাকা আকাশে।হেমন্তের সকালে গোসল করার দরুন দেহে সুক্ষ্ম কাঁপন ধরেছে মৃত্তিকার।জানালার কাছে দাঁড়ালোর কারণে সকালে নরম রোদ এসে গায়ে লাগে।আরামে সেখানেই দাড়িয়ে রয় মৃত্তিকা।তার উদাস দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় মেঘহীন আকাশে।বাদামি চোখে সূর্যরশ্মি পরায় চোখের সৌন্দর্য বেড়েছে দ্বিগুণ।মৃত্তিকা গগন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশের পুষ্পে পরিপূর্ণ জায়গাটার দিকে তাকায়।মৃত্তিকা অনুধাবন করে বদ্ধ ঘরের সত্য যতটা তিক্ত ঠিক ততোটাই মনোরম এর বাইরের পরিবেশ।মৃত্তিকার ধ্যান ছুটে দরজায় নক করার শব্দে।মৃত্তিকা বাঁকা কথা ছুড়ে তার বিপরীতে,

“যাক!আমার কথা বৃথা যায়নি তবে!স্বয়ং দর্শন মির্জা রুমে প্রবেশের জন্য দরজায় নক করছে!”

সহসা দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দর্শন।পরনে শুভ্র শার্ট,হাতা কুনই পর্যন্ত গোটানো।মৃত্তিকা আড়চোখে একবার তার দিকে তাকায়।হঠাৎ কানে ভেসে আসে,

” তোমাকে শিশির ভেজা সদ্য পুষ্পিত পুষ্পের ন্যায় লাগছে মৃত্তিকা মেহেরজান!”

কথাটুকু কর্ণগোচর হতেই তাচ্ছিল্য হাসে মৃত্তিকা।তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলে উঠে,

“একজন খুনির মুখে প্রশংসা বেমানান মিস্টার দর্শন।”

দর্শন এসে জানালার একপাশে দাড়ায়।মৃত্তিকার কথা শুনে যেন চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার।আচমকা বলিষ্ঠ হাত মৃত্তিকার বাহু চেপে ধরে।চমকে নিজের বাহুর দিকে তাকায় মৃত্তিকা।কিছু বলার জন্য ওষ্ঠদ্বয় একে-অপরের থেকে আলগা করবে তখনই গাঢ় শান্ত স্বরে দর্শন বলে উঠে,

“আমাকে খুনি বলে বারবার কথার আঘাত করছো অথচ সকলের চোখে খুনির স্থানে তুমি অবস্থান করছো!টিভিতে নিউজ চলছে ইরফান চৌধুরীর কন্যাকে তার পিএ এর খুনি মনে করছে পুলিশ।আমি নাহয় একজনের চোখে খুনি কিন্তু তুমি?”

মৃত্তিকার দৃষ্টি আটকায় দর্শনের সুদর্শন মুখশ্রীতে।ওষ্ঠদ্বয় আপন শক্তিতে আলগা হয়ে আসে হঠাৎ।চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ পরে জানান দেয় দর্শনের মুখনিঃসৃত কথা তাকে কতটা অবাক করেছে।বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করে,

“কিহ!”

মৃত্তিকার থেকে দৃষ্টি সরায় দর্শন।প্রস্থান করার উদ্দেশ্যে এক পা বাড়াতেই মৃত্তিকার শক্ত কন্ঠস্বর কানে আসে।

“আমার বোঝা উচিত ছিল যার ভাই একটা মেয়েকে জঘন্য প্রস্তাব দিতে পারে সে আসলে কতটা ভালো।শান্তি পেয়েছো তুমি?তোমার পরিবর্তে এখন আমাকে খুনির জায়গায় দেখা হচ্ছে!ফেঁসে যাওয়ার ভয় কেটেছে?এবার তো মুক্তি দাও আমায়।এখন তো আমি বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না তৃষার মার্ডার তুমি করেছো।”

হাত মুঠো করে নেয় দর্শন।বারবার খুনির ট্যাগ তার কাছে বিষাক্ত লাগছে।মৃত্তিকা ফের বলে,

“না আমি বাবার মন রক্ষার্থে তোমাদের সাথে ডিল করতে রাজি হতাম!আর না পার্টিতে যেতাম।তাহলে এসব কিচ্ছু হতো না।তৃষার মৃত্যুও হতো না।আর না আপনার মতো জঘন্য একটা মানুষের বন্দী অবস্থায় থাকতে হতো আমার।”

দর্শনের গম্ভীর কন্ঠ,

“আমাকে রাগিও না মৃত্তিকা।”

তাচ্ছিল্য হাসে মৃত্তিকা।জিজ্ঞাসু কন্ঠে সুধায়,

“গায়ে লাগলো কথাটা?আমার কথা তবে বৃথা গেল না।”

হঠাৎ মৃত্তিকার মাথায় অন্য চিন্তা ঢুকে।যেহেতু টিভিতে নিউজ দেখানো হয়েছে তার মানে তার বাবাও নিশ্চয়ই দেখেছে।তিনি ঠিক আছেন তো?হার্টের পেশেন্ট ইরফান চৌধুরী।এমন নিউজ দেখে আদো ঠিক আছেন তিনি?
মৃত্তিকার শুষ্ক আঁখিতে অশ্রুকণা জমতে শুরু করে।দর্শন তখন শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে।মৃত্তিকা ঘুরে তাকায় দর্শনের পানে।অশ্রুসিক্ত রাগি চাহনি দর্শনের নিকট হৃদপিণ্ড বরাবর ছোঁড়া তীক্ষ্ণ বর্শার ন্যায় মনে হয়।মৃত্তিকা দর্শনের নিকটে এসে আঙুল উচিয়ে বলে উঠে,

“যদি আমার বাবার কোন কিছু হয় তবে দর্শন মির্জা আমি আপনাকে ছাড়বো না!”

মৃত্তিকার আঙুল সন্তর্পণে নিজের হাতে মুঠোয় নেয় দর্শন।ক্ষিপ্ত হয়ে তা ছাড়ানোর চেষ্টা করে মৃত্তিকা।দর্শন গাঢ় চোখে তাকিয়ে অন্যরকম ভাবে বলে,

“মে দিস বি দ্যা হার্ডেস্ট ডিসিশন অফ ইউর লাইফ!মে বি!”

বলার পরপরই মৃত্তিকার হাত ছেড়ে দেয় দর্শন।তারপর নিঃশব্দে প্রস্থান করে সে।
মৃত্তিকা যান্ত্রিক মানবীর ন্যায় হেঁটে নরম তুলতুলে বিছানায় এসে বসে।শুভ্র মুখশ্রীতে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।

কিছুসময় বাদে দরজার ফের টোকা পরে।মৃত্তিকা চোখমুখ শক্ত করে চায়।কিন্তু দর্শনের পরিবর্তে আরেকটা লোক রুমে প্রবেশ করে।জামিল!লোকটা মৃত্তিকাকে তিনবেলা খাবার দিয়ে যায়।
জামিল ট্রি টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে মৃত্তিকার দিকে চায়।মেয়েটাকে সে প্রতিদিন খাবার দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলেও আজকে টিভিতেও দেখেছে সে।নিজের পিএকেই নাকি খুন করেছে!জামিল ভয়ে ভয়ে চায়।মৃত্তিকাকে রাগান্বিত দেখাচ্ছে।
প্রৌঢ় লোকটা কোনরকম বলে,

“ম্যাডাম আপনার খাবার।”

তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় মৃত্তিকা।কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠে,

“যার আদেশে খাবার নিয়ে এসেছেন তার মুখে খাবার ঠুসে দিন।”

মৃত্তিকার কথা শুনে জামিল জ্বিভ কেটে গাল স্পর্শ করে তওবা করে।এমন করলে আদো সে জীবিত থাকবে?
জামিল ভয়ে ভয়ে মৃত্তিকার কাছে এগোয়।একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,

“ছোট স্যার এটা আপনারে দিতে বলছে।”

ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা লোকটার হাত থেকে কাগজটা নেয়।জামিল দ্রুত প্রস্থান করে।
মৃত্তিকা থমথমে মুখশ্রীতে কাগজটা খুলে।গুটি গুটি অক্ষরে কিছু শব্দ লেখা,

“যদি শেষপর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতো চাও তবে তোমাকে খেয়ে দেয়ে বাঘিনী হতে হবে।আর জঙ্গলে বেঁচে থাকতে হলে বাঘের মতো শক্তিশালী হওয়া আবশ্যক!
.
বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে।আশেপাশে এখন গরম একটা ভাব।মাথার উপর সূর্যের তেজ।চৌধুরী বাড়ির মেইড বীনা ও রাফিয়া ডাইনিং খাবার সাজাচ্ছে।ইরফান চৌধুরী সেই সকালে চা নাস্তা করে নিজের রুমে ঢুকেছেন।এরপর একবারও তাকে রুম থেকে বের হতে দেখেনি কেউ।ডাইনিং এ খাবার সাজানো শেষ হতেই বীনা রাফিয়া ইশারা করে ইরফান চৌধুরীকে খবর দিতে।রাফিয়া কাজ করার পর একটু বিশ্রাম করার ধান্দায় ছিল। কিন্তু আরো একটা কাজ কাঁধে পরায় বিরক্ত হতে দেখা যায় তাকে।বিরক্ত মুখে দোতলায় সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে সে।রাফিয়া মেয়েটা নতুন এসেছে কাজে।বয়স ১৩-১৪ মাত্র।গরিব বাবা তাই বড়োলোকের বাড়িতে কাজের জন্য পাঠিয়েছে।কিন্তু রাফিয়ার দুরন্ত মনে কাজের জন্য বিষাদ পূর্ণ।কোন কাজের তলব পরলে শ্যামলা মিষ্টি মুখখানায় বিরক্তি ছেঁয়ে বসে।আজকেও সে বিরক্ত মুখে মালিককে ডাকতে দোতলায় এসেছে।ইরফান চৌধুরীর রুমে এসে দরজা খোলা দেখে উঁকি দেয় রাফিয়া।নিচু স্বরে ডাকে,

“সাব।দুপুরের খাওন তৈরি।”

ইরফান চৌধুরী চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে আছেন।দরজা থেকে উনাকে পোছন থেকে দেখা যাচ্ছে শুধু।রাফিয়া ফের ডাকে,

“সাব!”

কোন সারাশব্দ না দেখে ঢোক গিলে রাফিয়া।পা টিপে টিপে এসে দাড়ায় চেয়ারের পেছনে।বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও কেন উত্তর না দেখে রাফিয়ার কোমল মনে ভয় ঝাঁকে।একছুটে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে নামে সে।

.
মাঝরাত।কালো আকাশে আলো ছড়াতে চাঁদ উঠেছে।বিছানার পাশে থাকা বন্ধ জানালায় হেলান দিয়ে অন্ধকারে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে মৃত্তিকা।মন দুশ্চিন্তায় ছেঁয়ে!অজানায় আশঙ্কায় ক্ষণে ক্ষণে হৃদয় কেঁপে  উঠছে তার।সকালের পরে আর দর্শনকে দেখা যায়নি।এতে খুশি হওয়ার বদলে মৃত্তিকা চিন্তিত হচ্ছে বেশি।ইরফান চৌধুরীর চিন্তা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে তাকে।মৃত্তিকা দূরাকাশে তাকিয়ে নিজের জীবনের স্মৃতিচারণ করে।

মৃত্তিকা মা ডেইজি একজন বিদেশিনী।বিজনেসের জন্য দেশের বাইরে গিয়ে তার সাথে পরিচয় ইরফান চৌধুরীর।তারপর প্রেমবিনিময় থেকে শুরু করে বিবাহ করেন তারা।বিয়ের পরপরই সহধর্মিনীর নামে কোম্পানির নামকরণ করেন ইরফান চৌধুরী।

বিয়ের দু বছরের মাথায় জন্ম নেয় মৃত্তিকা।মায়ের মতো গায়ের রং পেলেও মৃত্তিকার মুখের গড়ন বাবার মতো।বিদেশি ও দেশি সংমিশ্রণে জন্ম নেওয়া মেয়েটার আর মায়ের আদর পাওয়া হয়নি।তাকে জন্ম দিতে গিয়েই মারা যায় ডেইজি।মায়ের আদর কি মৃত্তিকার জানা নেই।বাবার হাতেই মানুষ।বাবার প্রতিটি কথার পালন করে আসছে মৃত্তিকা।সেই বাবার যদি কিছু হয়!

আর ভাবতে পারে না মৃত্তিকা।ডুকরে কেঁদে উঠে সে।গায়ে ওড়না জড়িয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজার নিকট এসে দাড়ায়।সর্বশক্তি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করতেই মৃত্তিকা অনুভব করে দরজা খোলাই ছিল!অবিশ্বাসে ও আনন্দে মৃত্তিকা তড়িঘড়ি করে অশ্রু মুছে পা টিপে টিপে রুম থেকে বেরোয়।দর্শনের দ্বারা এতবড় ভুল হয়েছে ভাবতেই পারছে না সে।মাঝ রাত্রি হওয়ার পরও বাংলোটা আলোয় ভরা ছিল।তাই সদর দরজা অবধি পৌঁছাতে বেগ ওেতে হয় না মৃত্তিকার।কিছু নিয়তির লিখন বোধ হয় ভিন্ন ছিল!

দরজার চাবি ঘুড়িয়ে বাইরে বেরোতেই তীব্র আলোয় চোখ বন্ধ হয়ে আসে মৃত্তিকার।মুহুর্তেই আলো নিভে আসে।বদ্ধ আঁখি খুলে তাকায় মৃত্তিকা।দৃশ্যমান হয় সাদা শার্টে মোড়ানো সেই বলিষ্ঠ সুদর্শন যুবক।মৃত্তিকাকে এভাবে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া দেয় না দর্শন।কিন্তু নিরব অশ্রু গড়ায় মৃত্তিকার নেত্র বেয়ে।তার এই দুঃসাহসের চরম মূল্য বুঝি দিতে হয়।কিন্তু না!বড্ড শান্ত ভঙ্গিতে তার দিকে এগোয় দর্শন।ফুল হাতা ও পা পর্যন্ত লং জামার এক সাইডে গোল্ডেন রঙের ওড়না নেওয়া রমনীর নেত্র অশ্রুতে পূর্ণ।মৃত্তিকা দর্শনের তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে মৃত্তিকা ভীত মনে পিছাতে থাকে।কন্ঠে আকুল নিবেদন নিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে উঠে,

“আমাকে যেতে দাও দর্শন।”

“তোমাকে যেতে দিব মৃত্তিকা। আজ তোমার বন্দীদশা সমাপ্ত হবে।”

মৃত্তিকার ওষ্ঠ হাসিতে পূর্ণ হয়।অশ্রুসিক্ত হাস্যজ্বল রমনীর দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে দর্শন বলে উঠে,

“বাট ইউ হ্যাভ টু ম্যারি মি”

চলবে..