#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
৯.
“তোমার বাবা মৃত্যুপথযাত্রী!যদি তাকে শেষবারের মতো দেখতে চাও তবে তোমাকে আমাকে বিয়ে করতে হবে।তাহলেই এখান থেকে তোমাকে যেতে দিব আমি।”
মৃত্তিকার কর্ণগোচর হয়নি দর্শনের বলা শেষের দুটো বাক্য।সে শুধু প্রথম বাক্যটিই শুনেছে।হাস্যজ্বল মুখশ্রী পরিনত হ’য়েছে অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়ে।চোখ টলমল করছে অশ্রুতে।মৃত্তিকা শুধু শুনেছিল দুঃসংবাদ শুনলে মানুষের পায়ের তলার মাটি নাকি সরে যায়।আজ প্রথমবারের মতো তার মনে হচ্ছে পায়ের তলার মাটি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে!মনে হচ্ছে মহাশূন্যে ভেসে যাচ্ছে সে!
ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে ধপ করে পরে যায় মৃত্তিকা।অক্ষিকোটরে থাকা অশ্রু কপোল বেয়ে মাটিতে পরে।মুহুর্তেই ডুকরে কেঁদে উঠে দর্শনের চোখে দেখা শক্তমনের মেয়েটা।নিস্তব্ধ রাত্রিরে রমনীর কান্না গুঞ্জন তুলে।বারবার প্রতিধ্বনিত হয় তার কান্নার সুর।দর্শনের নিবিড় চাহনি তাতেই নিবদ্ধ।
কান্না থামিয়ে দর্শনের দিকে তাকায় মৃত্তিকা।সরু নাক লাল হয়ে আছে কান্নার দরুন।গালে অশ্রুকণা লেপ্টে মুখশ্রীর শোভা বর্ধন করছে।মৃত্তিকা দর্শনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠে,
“এত পাষাণ তুমি?আমার বাবার এমন অবস্থা আর তুমি এই মুহুর্তে আমাকে বিয়ের কথা বলছো?এমনটা কিভাবে করতে পারো তুমি?”
শেষোক্ত কথা বলার পরপরই মৃত্তিকা জোরে ধাক্কা দেয় দর্শনের বুকে।বলিষ্ঠ পুরুষ তাতে পিছায় না একটুকুও!যেন পাথর বনে দাড়িয়ে আছে।মৃত্তিকার রাগ বাড়ে।ঘৃণ্য স্বরে সে বলে উঠে,
“তুমি আমাকে ব্যাকমেইল করে আমাকে বিয়ে করতে চাইছো?বিবেকে এতটুকুও বাঁধছে না তোমার?”
“তোমাকে মেহফুজ রাখতে চাইছি মৃত্তিকা।তোমার ভাবনাতেও নেই তোমার জন্য কি অপেক্ষা করছে!”
দুঃখের ভেতরেও হাসি ফুটে মৃত্তিকার ওষ্ঠে।তাচ্ছিল্যের হাসি।বিষাদময় কন্ঠে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে,
“আমাকে যেতে দাও দর্শন।”
“বলেছি তো দেবো।শুধু আমার কথাটা মেনে নাও।আমাকে কবুল করো!”
এবার মৃত্তিকা ফিরে তাকায় দর্শনের পানে।মিশ্র অনুভূতি মিশ্রিত সে চাহনি!রাগ,অসহায়ত্ব,ঘৃণা সব মিশে তাতে!সব!
নিচ দিক তাকায় মৃত্তিকা।মস্তিষ্ক জানান দেয় আর কোন উপায় নেই!নিজেকে এমন একজনের দারস্থ করা ছাড়া যে দুর্বলতার সুযোগে খুব সহজেই স্বার্থ হাসিল করতে জানে।
দর্শন মৃত্তিকার মৌনতা দেখে তার দিকে এগোয়।নিকটে এসে মৃত্তিকার হাত ধরে শক্ত করে।সদর দরজার দিকে একপা বাড়াতেই মৃত্তিকার কাঠকাঠ গলার আওয়াজ এসে বাড়ি খায় মস্তিষ্কে।
“আমি রাজি!”
দর্শনের ওষ্ঠকোণে বাঁকা হাসির রেশ ফুটে।মৃত্তিকাকে আবার আটকে রাখার এই পদক্ষেপ তো শুধু নাটক ছিলো!মেয়েটাকে যে তার চাই!তাই এতটা কঠোর কাজ করতেও যেন বিবেকে বাঁধছে না।
.
রাতের গভীরতা বেড়েছে।বাইরে প্রকৃতি নিস্তব্ধ!মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক শোনা যাচ্ছে।বাইরের থেকেও যেন ঘরের পরিবেশ আরো শব্দহীন।১টা নাগাদ দর্শন রাফিনকে কল করে বাংলোর ঠিকানায় আসতে বলেছে।বেচারা ঘুম বিসর্জন দিয়ে ছুটে এসেছে।সে তো গোলাম!যখন তলব করবে তখনই হাজির হওয়া চায়।সাথে কাজিকেও ধরে আনতে বলেছে দর্শন।বাংলোয় পৌঁছেই অসম্পূর্ণ ঘুম ঝেঁকে বসে চোখে।অথচ মস্তিষ্কে অন্যভাবনা!দর্শনের এভাবে মাঝরাতে কাজি ডেকে নিয়ে আসার আদেশ কি ইঙ্গিত দেয়?কার বিয়ে হতে যাচ্ছে?স্বয়ং দর্শনের নয়তো?
রাফিনের সমস্ত ঘুম নিমিষেই ঘায়েব হয়ে যায় যখন মৃত্তিকাকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে সে।শুভ্র রঙে মোড়ানো রমনী যে আসলেই মৃত্তিকা তা ভ্রম মনে করে বারকয়েক নিজের চোখ ঢলে রাফিন।অতঃপর যখন সত্যিই অনুধাবন করে যে সে ভুল দেখছে না চোখ বড় বড় করে দর্শনের দিকে তাকায় রাফিন।অস্ফুটস্বরে বলে উঠে,
“মিস মৃত্তিকা এখানে আছেন?”
দর্শন কান খাঁড়া করেই ছিল।তাই রাফিনের কথা শুনে সে।মৃত্তিকা এসে একটা বেতের সোভার উপর বসতেই কাজি সাহেব সংকোচ নিয়ে প্রশ্ন করে,
“মেয়ের ১৮ বছর হয়েছে তো?”
“১৮+।আপনি বিয়ে পড়ানো শুরু করুন!”
দর্শনের কথা শুনে চোখ কপালে উঠে রাফিনের।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি মিস মৃত্তিকাকে বিয়ে করছেন স্যার?পরিবারের অনুমতি ছাড়া এভাবে…”
“যেভাবেই হোক বিয়ে করছি।আর তুমি আমার বিয়ের প্রথম সাক্ষী হবে।
রাফিন আর কোন শব্দ উচ্চারণ করে না।শ্বাস আটকে বসে রয়।
দর্শন একবার এককোনায় দাড়িয়ে থাকা জামিলের দিকে চায়।তারপর কাজি সাহেবকে বিয়ে পড়ানো শুরু করতে বলে।যদিও এত রাত্রে ডেকে নিয়ে আসার জন্য কাজি বিরক্ত কিন্তু বুঝতে পারছে টাকার অংক মোটাই হবে।তাই মনে মনে প্রফুল্ল হয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন তিনি।
মৃত্তিকা বসার পর থেকেই নিম্নে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।একেবারে জন্যও চোখ তুলে তাকায়নি।জড় কোন বস্তুুর ন্যায় একইভাবেই বসে আছে সে।যখন সমস্ত কিছু শেষে মৃত্তিকাকে কবুল বলতে বলা হয় তখন চোখ তুলে তাকায় মৃত্তিকা।তাও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দর্শনের উপর পরে।দর্শন তাকায় ঘন পাপড়ি ঘেরা বাদামী চোখে।যেন মৃত্তিকা আঁখি চিৎকার করে বলছে সর্বোচ্চ ঘৃণা নিয়ে তোমাকে,
” কবুল,কবুল, কবুল!”
শব্দখানা একটানা তিনবার উচ্চারণ করে ফের দৃষ্টি নামায় মৃত্তিকা।মুখশ্রী থমথমে!যেন এক রত্তি অনুভূতি লেপ্টে নেই তাতে!
কাজি সাহেব ভ্রু উচিয়ে চায়।আজ অবধি যত বিয়ে পড়িয়েছেন সেখানে এত তাড়াতাড়ি কবুল কেউ বলেনি।কমপক্ষে দুই মিনিট ব্যয় হয়েছে কন্যার মুখ থেকে এক একবার কবুল শব্দ উচ্চারণ করাতে!যাইহোক তিনি এবার দর্শনের দিকে তাকিয়ে কবুল বলতে বলেন।
মূর্তি বনে থাকা রমনীর দিকে তাকিয়ে দর্শন শুকনো একটা ঢোক গিলে।শুভ্র অপরূপা মুখশ্রী দৃষ্টি রেখেই পরপর তিনবার কবুল বলে সে।
বিয়ে সম্পন্ন হতেই বসা থেকে উঠে বসে মৃত্তিকা।দর্শন দ্রুত রাফিনকে বলে কাজিকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে।দর্শন মৃত্তিকার হাত ধরতে নিলেই হাত সরিয়ে নেয় মৃত্তিকা।শক্ত কন্ঠে বলে,
“যত দ্রুত পারেন আমাকে বাবার কাছে নিয়ে চলো।”
কথাটুকু শেষ করেই সদর দরজার দিকে এগোয় মৃত্তিকা।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড়বড় পায়ে তার পেছন পেছন আসে দর্শন।
..
ভোর রাত!আর কিছু মুহুর্তের অপেক্ষা আকাশে উদিত হওয়ার।এমন সময় হাসপাতালের সামনে পৌঁছায় মৃত্তিকা ও দর্শন।তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামে মৃত্তিকা।দৌড়ে ছুটে যায় সে।পেছন থেকে দর্শন চিৎকার করে বলে উঠে,
“চারতলা,আইসিউতে।”
ঘাড় ঘুড়িয়ে একবার তাকিয়ে দ্রুত হাঁটে মৃত্তিকা।পেছন পেছন দর্শন আসে।ভোর রাত হওয়ায় করিডোরে তেমন লোকজন নেই।মৃত্তিকা দ্রুত হেঁটে লিফটের কাছে আসে।লিফটে ঢুকে দরজা বন্ধ করবে তখনই ভেতরে ঢুকে পরে দর্শন।মৃত্তিকা আড়চোখে একবার দেখে বাটন চাপে।
মৃত্তিকার চোখেমুখের অশ্রু শুকিয়ে গেছে।অশ্রু লেপ্টে রয়েছে শুষ্ক কপোলে।চারতলায় পৌঁছে আইসিউর বাইরে থেকে ভেতরে চোখ রাখে মৃত্তিকা।মুখে অক্সিজেন মাক্স পরিহিত,সাদা চাদরে আচ্ছাদিত লোকটা তার বাবা,ইরফান চৌধুরী!
এতক্ষণ দূরে থেকে ঠিক যতটা দুশ্চিন্তায় ভুগছিলো মৃত্তিকা এখন তার মনের অবস্থা আরো করুন।মৃত্তিকা দরজায় হাত দিয়ে তাকিয়ে রয় বাবার পানে।নিরব অশ্রু তার কপোল বেয়ে বহমান।
একজন ডাক্তারকে আসতে দেখে তারদ দিকে এগিয়ে যায় মৃত্তিকা।গালে লেগে থাকা অশ্রু মুছবার কোন তাড়া নেই তার কাছে।ভেজা কন্ঠে সুধায়,
“ডক্টর উনি সুস্থ হয়ে যাবেন তো?
মাক্সের আড়ল থেকে ডাক্তারের কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
” দেখুন ম্যাম উনি হার্ট অ্যাটাকের বহু পরে উনাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়।যদি সাথে সাথে নিয়ে আসা হতো তবে অবস্থা এত ক্রিটিকাল হতো না।কিন্তু আমরা এখন কিছু করতে পারছি না।এখন সব উপরওয়ালার হাতে!”
মৃত্তিকা শূন্য দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়।তার সমগ্র পৃথিবী ঘুরছে।জীবনে একমাত্র আপন ছিল তার বাবা।এখন তিনিও ছেড়ে যেতে চাইছে তাকে।মৃত্তিকার ইচ্ছে হয় গগনবিদারী চিৎকার করতে!সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে।এত অভাগা কেন হলো সে?
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করে মৃত্তিকা।মৃত্তিকার চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠে হঠাৎ।শক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
“তুমি আমায় বলেছিলে না দর্শন?ফরগেট মি নট!ট্রাস্ট মি তোমাকে আমি একমুহূর্তের জন্যও ভুলবো না আমার বাবার এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী।একমাত্র তুমি দায়ি,দর্শন মির্জা!
চলবে…
ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।