#ফরগেট_মি_নট
#রক্তিমা(লেখনীতে)
২০.
“দানিশ মির্জা!দর্শনের বাবা!আমি সবসময় উনাকে সম্মান করে এসেছি।কিন্তু উনি আমার ব্যাপারে এমনটা ভাবতেন?মায়ের মৃত্যুর জন্য আমাকে দায়ী মনে করেন উনি!আমি তো এটাও জানতাম না উনার সাথে মার ফ্রেন্ডশিপ ছিল।”
কথাগুলো বলতে বলতে মৃত্তিকা বিছানায় নিথর হয়ে বসে পরে।তার চোখের পলক পরছে না।মৃত্তিকা হাতে থাকা ফোনটার দিকে তাকায়।হোয়াটস অ্যাপে আননোন নাম্বার থেকে আসা ভিডিওটা দেখে সে।ভিডিওটা পাঠানোর পর মেসেজে বলা হয়েছে,
“ইট’স মি জান,ইউর হাসবেন্ড।”
দর্শন ও তার সম্পর্কে দূরত্ব এতটাই বেশি যে এতদিনেও দর্শনের ফোন নাম্বার মৃত্তিকার ফোনে না সেভ করা ছিল আর না কোনদিন দর্শনের নাম্বার থেকে তার ফোনে কোন মেসেজ বা কল এসেছে!মৃত্তিকা কাঁপা কাঁপা হাতে তৃষার মার্ডারের দৃশ্যটা আরেকবার দেখে নেয়।
মৃত্তিকার আর বুঝতে বাকি নেই এটাই তার জন্মদিনের আনএক্সেপ্টিং বার্থডে গিফট।মৃত্তিকার ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে।মাঝরাত!
এই মুহুর্তে মৃত্তিকা দর্শনের সাথে কথা বলার খুব দরকার মনে করছে।কিন্তু দর্শন সেইদিন সত্যতা প্রমাণ করতে না চেয়ে কেন তাকে অজ্ঞান করে এই বাংলোয় এনে আটকে রেখেছিল?মৃত্তিকার এখনও কেমন সব ঝাপসা মনে হচ্ছে।হাতের ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে সে।
মৃত্তিকার শ্বাস-প্রশ্বাস বেশ দ্রুত চলছে।চোখের কোণে জমা অশ্রু গাল বেয়ে পরতেই দ্রুত তা মুছে নেয় মৃত্তিকা।তারপর অপেক্ষা করতে থাকে ভোরের আলো ফুটার।একবার যখন খুনির পরিচয় সামনে এসেছে তাকে বাইরে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ মৃত্তিকা মেহেরজান চৌধুরী দিবে না।আর এটা তার নিকট খুব সহজই হবে কেননা নিউজ চ্যালেন ও সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।
মৃত্তিকা অপেক্ষা করে সকাল হওয়ার।কিন্তু অপেক্ষার রাত বুঝি দীর্ঘ হয়।ছয় ঘন্টায় যেন তার কাছে একটা গোটা রাতের ন্যায় মনে হলো।সকাল হতেই মৃত্তিকা ফ্রেশ হয়ে নেয়।তারপর নিজের শখের বশে কিনা জলপাই রঙের একটা জর্জেটের শাড়ি পরে নেয়।রেডি হয়ে ঘড়িতে তাকাতেই দেখে আটটা বাজতে চললো।মৃত্তিকা ব্রেকফাস্ট না করেই ড্রাইভারকে নিয়ে মির্জা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়।
——-
বেডরুমে থমথমে মুখশ্রীতে বসে আছেন দানিশ মির্জা।কালকে থেকে দর্শনের মা কোনরুপ কথা বলছে না তার সাথে।মৃত্তিকার পিএ এর খুনের ভিডিও টিভিতে দেখার পরই স্বামীর সাথে অদৃশ্য এক দ্বন্দ্ব করে চলেছেন তিনি।এমনকি রাতে রুমেও আসেননি ঘুমানোর জন্য!মন-মেজাজ ভালো না থাকায় কিংবা স্ত্রীর সামনে মুখোশ উন্মোচনের হেতু দানিশ মির্জাও খোঁজ করেননি স্ত্রীর।একমাঝে একবারো রুম থেকে বের হয়নি দানিশ মির্জা।হঠাৎ রুমে অনুমতি নিয়ে একজন সার্ভেন্ট প্রবেশ করে।দানিশ মির্জার জন্য কফি নিয়ে এসেছে।দানিশ মির্জা কফির কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দেওয়ার পূর্বে সার্ভেন্টকে প্রশ্ন করে,
“তোমার ম্যাডাম কোথায়?”
কথাটা জিজ্ঞেস করার পরপরই তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় দানিশ মির্জা।অন্যসময় হলে হয়ত সার্ভেন্ট লোকটার ভয় লাগতো না।কিন্তু স্যারের খুনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরপরই তাদের মনে অজানা ভয় ঢুকেছে।লোকটা কাঁপা গলায় জবাব দেয়,
“কিচেনে!”
উত্তর শুনে দানিশ মির্জা ইশারায় তাকে যেতে বলে।সার্ভেন্টটি প্রস্থান করলে দানিশ মির্জা দ্রুত কফি শেষ করে উঠে দাঁড়ায়।পঞ্চাশোর্ধ লোকটার চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ পরেনি।চেহারায় এখনো সুদর্শন একটা ভাব আছে।তবে লোকটার মুখ থমথমে থাকায় খানিক ফিকে লাগছে।মাথায় উঁকি দেওয়া সাদা সাদা চুলের জন্য বয়সটা বোঝাও যাচ্ছে একটু।কিন্তু দানিশ মির্জা যথেষ্ট ফিট।
সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নামতে থাকেন দানিশ মির্জা।উদ্দেশ্য প্রিয়তমা স্ত্রীর দর্শন লাভ।কিন্তু সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে সামনে তাকাতেই ভ্রুদ্বয় কুঁচকে আসে তার।দ্রুত হুংকার দিয়ে উঠেন তিনি।
“দাঁড়াও!”
তীব্র হুংকার শুনেও থামে না মৃত্তিকা।বরং সমস্ত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পা রাখে ড্রয়িংরুমে।ছোট ছোট পা ফেলে এগোতেই দানিশ মির্জা বলে উঠেন,
“তুমি এখানে কি করছো?বেরোও আমার বাড়ি থেকে!সর্বনাশী!”
সর্বনাশী শব্দটা মৃত্তিকার কানে ঝংকার তুলে।শুকনো একটা ঢোক গিলে দানিশ মির্জার দিকে তাকায় মৃত্তিকা।কালকে অবধি লোকটাকে ভালো মনে হয়েছিল মৃত্তিকা।অথচ আজ?মানুষের রুপ বদলে যাওয়ার জন্য বোধয় একদিনই যথেষ্ট!
মৃত্তিকাকে চুপ করে থাকতে দেখে দানিশ মির্জা ফের গর্জে উঠেন।আক্রোশ নিয়ে বলে উঠেন,
“আমার ছেলেকে রুপের জাদুতে বশ করে নিয়েছো তো!যে কারণে আমার বাধ্য ছেলে নিজের বাবার এতবড় ক্ষতি করতে দুবার ভাবলো না!সৌন্দর্য ব্যতিত কি আছে তোমার?”
দানিশ মির্জার কথা শুনে মৃত্তিকার হাসি পেলো বোধয়।মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে হেসে উঠলো মৃত্তিকা।তারপরই শান্ত মুখশ্রীতে তাকালো দানিশ মির্জার দিকে।গম্ভীর স্বরে বললো,
“আপনার থেকে শুরু থেকেই অবাধ্য মিস্টার দানিশ মির্জা।ওনেস্টলি আমি কোন চেষ্টা করিনি তাকে বশ করার।এটা তো আমাকে বার্থডে গিফট দিয়েছিলো আপনার ছেলে।”
মৃত্তিকার শান্তস্বরে তাচ্ছিল্যময় বাক্য দানিশ মির্জা দাঁতে দাঁতে চেপে ধরেন।বা দিকে চোখ পরতেই দেখে উনার মিসেস কখন যেন এসে দাড়িয়েছেন সেখানে।শক্ত মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে স্বামীর দিকে।দানিশ মির্জা স্ত্রীর থেকে নজর সরায় মৃত্তিকার কথায়।
“আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন,আমি ডেইজি ইন্ডাস্ট্রির CEO। আমাকে হেও করার কিংবা আমার কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করলে বরং আপনারই লস।আর কিছু মুহুর্তই তো আসেন বাইরে।তারপরই আপনার হাতে হাতকড়া পরানো হবে।আর ভাববেন না টাকার জোরে বেঁচে যাবেন।আপনার ছেলে এমন কান্ড করেছে যাতে আপনাকে অন্তত কয়েকবছর জেলের…”
বাকি বাক্যটুকু আর সম্পূর্ণ করে না মৃত্তিকা।দৃষ্টি সরায় দানিশ মির্জার থেকে।দোতলায় দাড়িয়ে সবটাই পর্যবেক্ষণ করে দর্শন।মৃত্তিকার থেকে দৃষ্টি সরে এবার মদয়ের দিকে নজর যায় তার।একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে দর্শন।ভেবেছিলো এই খুনের সত্য উন্মোচন করলেই বোধহয় বুকে জমে থাকা দ্বন্দ্ব মিটে যাবে।কিন্তু না!তা হচ্ছে কই?
“আপনি আমার বায়োজেষ্ঠ্য তাই আপনার সাথে তর্কে জড়বার ইচ্ছে আমার নেই।”
মৃত্তিকা কথাখান বলে সিঁড়িতে পা রাখার আগেই রুমে ঢুকে পরে দর্শন।
পরিচিত কক্ষটাতে প্রবেশ করতেই শীতের তীব্রতা অনুভব করে মৃত্তিকা।দরজা লক করে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দর্শনের সন্ধান করে সে।ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে।মৃত্তিকা নিশ্চিত হয় দর্শন ওয়াশরুমে।রিমোট দিয়ে এসির তাপমাত্রা কমায় মৃত্তিকা।এইবার রুমটা থাকার যোগ্য হয়েছে।
মৃত্তিকা বিছানায় বসে হাঁটুতে মাথা ঠেকায়।পাঁচমিনিট পরে ওয়াশরুম থেকে বের হয় দর্শন।কোমড়ে একটা তোয়ালে পেছানো শুধু।মৃত্তিকা একবার তাকিয়ে দৃষ্টি সরায়।কিন্তু দর্শন তার দিকে তাকাইনি।দর্শন তার নিজ মনে কাবার্ড থেকে শার্ট-প্যান্ট বের করে পরে নেয়।সময়টাতে মৃত্তিকা অন্যপাশ ফিরে ছিল।দর্শন এসে দর্পনের সামনে দাঁড়াতেই মৃত্তিকা বলে উঠে,
“তুমি এই ভিডিওটা আমাকে আগে দেখাওনি কেন?আগেই কেন নিজেকে নির্দোষ প্রমান করো নি?
মৃত্তিকার কথায় দর্শনের কোন হেলদোল হয় না।সে নিজ মনে গম্ভীর হয়ে গায়ে পারফিউম মাখছে।মৃত্তিকা নামের কোন রমনীর অস্তিত্বই নেই যেন এখানে।
মৃত্তিকা ফের বলে,
” উত্তর দিচ্ছো না কেন?”
এবার মৃত্তিকার দিকে একঝলক ফিরে তাকায় দর্শন।ফের ড্রেসিং এ তাকিয়ে ঘড়ি পরায় ব্যস্ত হয়। মৃত্তিকার এবার রাগ লাগে।এগিয়ে এসে দর্শনকে নিজের দিকে ফেরায় সে।রাগি কন্ঠে বলে,
“চোখে দেখতে পাচ্ছো না নাকি কানে শুনতে পাচ্ছো না শুনি?প্রশ্নের জবাব দেওয়া তো দুর!এমন ভাব করছো যেন এই ঘরে শুধু তুমি একাই আছো।”
দর্শন এবার সরু চোখে তাকায় মৃত্তিকার দিকে।অসন্তুষ্ট স্বরে বলে,
“তোমার বর রাগ করেছে।সরি বলে মানাও আগে!”
চলবে…