পিঞ্জিরা পর্ব-১৩

0
13

#পিঞ্জিরা
#পর্ব_১৩
#জান্নাত_সুলতানা

-“রিহান কল করেছে। একটু কথা বলবি?”

মিরা পড়তে বসে আছে।রোকেয়া তখন ফোন হাতে হন্তদন্ত হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। হাতের বাটন ফোন টা বেজে চলেছে অনবরত। মিরা ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফের বইয়ের দিকে তাকালো। বইয়ের পাতা উল্টায়। দৃষ্টি সেখানে নিবদ্ধ রেখেই নাকচ করে দেয়,

-“না আম্মা।”

কল বেজে কেটে গেলো। রোকেয়া মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।মেয়ে তার মন শক্ত করেছে। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে কিংবা কখনো কখনো সেই স্থান আরো শক্ত করতে আমাদের কিছু স্বভাব অভ্যাস বদলাতে হয়।কারোর কাছে নিজে কে মূলহীন প্রমাণ করার কোনো মানেই হয় না।আগে নিজে কে প্রায়োরিটি দিতে হবে। রোকেয়া মেয়ে কে বুঝিয়েছে।মিরা’র যেন এমন একটা মানুষ প্রয়োজন ছিলো।যে খুব কাছের তাকে বুঝবে, বোঝাবে।রোকেয়া বেগম বললো,

-“আচ্ছা পড়।”

অতঃপর তিনি চলে গেলো। মিরা’র চোখ গুলো লাল।ঠোঁট গুলো কাঁপছে কত কষ্ট এই “না” শব্দ টা সে মুখ দিয়ে বেড় করেছে একমাত্র মিরা’র মন জানে।কিন্তু এতে করে যদি নিজের একটু ভালো হয় তবে তাই করবে মিরা।কাল থেকে এক্সাম শুরু। রোকেয়া মেয়ের এক ক’দিনে এতো সেবাযত্ন করেছে মিরা খুব দ্রুত সুস্থ হয়েছে।
রাত সাড়ে এগারো টা বাজে রোকেয়া বেগম দুধের গ্লাস হাতে মিরা’র কক্ষে এলো।মেয়ে কে জোর করে খাইয়ে দিলো।ঘুমতে বলে তিনি নিজের রুমে গেলো।মিরা লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো। পরীক্ষার আগের রাতে বেশি রাত জাগতে নেই।নয়তো এক্সাম হলে শরীর খারাপ করবে।

—–

রোজকার ন্যায় রোকেয়া বেগম একদম সকালে রান্না শেষ করলো।আজ স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে। মেয়ের প্রথম পরীক্ষা আর তিনি যাবে না তা কি করে হয়!রান্না শেষ শাশুড়ী আর মেয়ে কে নিয়ে খাবার খেলো।মিরা সব গুছিয়ে রেখেছে। খাবার পর আস্তে ধীরে রেডি হয়ে নিলো।গোসল করেছে মিরা।লম্বা চুল গুলো ভেজা। রোকেয়া মেয়ের চুল মুছে দেয়।দশ টা থেকে পরীক্ষা শুরু।ন’টা বাজে মেয়ে কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।প্রথম দিন একটু আগে যাওয়া ভালো। তারউপর সীট পড়েছে অন্য একটা কলেজে।
দশ-টা বাজার ত্রিশ মিনিট আগেই মিরা কলেজের ভেতর ঢুকে গেলো।রোকেয়া বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। শাহনাজ এর একটা ক্লাস আছে ন’টা বাজে শেষ হবে। শাহনাজ ক্লাস শেষ হলেই চলে আসবে।রোকেয়া কলেজের পাশে থাকা বড় পুকুরের ঘাটলার দিকে গেলো।সেখানে অনেক গার্ডিয়ান বসে আছে। পাশে একটা মসজিদ ও আছে। রোকেয়া ফোন বেড় করে শাহনাজ কে কল করে ঠিকানা দিয়ে অন্য আরো অনেক মহিলা আছে তাদের সাথে আলাপপরিচয় হলেন।

পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টা অপেক্ষা করার পর মিরা বেরিয়ে এলো।মুখে তার গম্ভীর। দেখে বোঝার উপায় নেই পরীক্ষা কি ভালো হয়েছে না খারাপ। রোকেয়া চিন্তিত। শাহনাজ অধর কামড়ে ধরে ভাবুক হয়।ওর পরীক্ষা ভালো হলেও ওর মুখ এমন থাকে।কিন্তু মিরা’র মুখ এমন দেখাচ্ছে সেটার কারণ কি বুঝতে পারছে না। রোকেয়া শাহনাজ ভীড় ঠেলে মিরা’র কাছে গেলো।মিরা বহুনির্বাচনি প্রশ্নোপত্র শাহনাজ এর হাতে দিলো।শাহনাজ কয়েকটা দেখলো যেগুলো মিরা সঠিক দিয়েছে। আর যেগুলো পারে না সেগুলো নেটে দেখলো।তিন টা ভুল আর বাকি সব গুলো ঠিক দাগিয়েছে।
রোকেয়া বেগম মেয়ের জন্য আগে থেকে পানি আর একটা কেক এর প্যাকেট কিনে রেখেছে।মিরা কে একপাশে নিয়ে পানি দিলো।মিরা পানি খেয়ে একটা কেক এর পিস খেলো।শাহনাজ মিরা’র খাবার শেষ ফুচকা দোকানে গেলো।তিনজন মিলে ফুচকা খেলো।দুপুর দুইটার দিকে বাড়ি ফিরলো।

—-

সময় খুব দ্রুত চলে।দেখতে দেখতে কিভাবে যে মিরা’র পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। আজ শেষ পরীক্ষা। তবে প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা বাকি রয়েছে। রোকেয়া আজ আসে নি। স্কুলে পরীক্ষা চলে।সেইজন্য আসা সম্ভব নয়।শাহনাজ নিতে আসবে মিরা কে।মিরা পরীক্ষা শেষ বাহিরে এসে দাঁড়াল।হাতের ঘড়িতে সময় দেখলো সমান একটা বাজে। চক্ষুু ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই
সামনে পুকুর পাড়ে দৃষ্টি গেলো।মূহুর্তে চোখে মুখে অবিশ্বাস্য এক ছাপ ফুটে উঠলো। নিজের দেখার ভুল ভেবে অন্য পাশে তাকালো।তবে আঁড়চোখে সেদিকে ঠিক লক্ষ রাখলো।মিনিটখানেক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন পুকুর পাড়ে দাঁড়ানো জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। তখন অবাক হলো।সত্যি কি সে যা ভাবছে তাই হয়েছে? না-কি ভ্রম? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? একটা মানুষ সুইজারল্যান্ড থেকে কি করে এখানে আসবে?না-কি ইফাদ ভাই?মিরা’র ভাবনার মাঝেই মিরা কিছু বুঝে উঠার আগেই জিপগাড়ি টা খুব দ্রুত ওর সামনে চলে এলো।এতোটাই দ্রুত বেগে এসেছে যে মিরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
কিছু সময় ব্যবধানে যখন কোনো রকম আভাস অপরপ্রান্ত থেকে পেলো না তক্ষণি চোখ মেলে তাকালো। পিটপিট করে তাকিয়ে গাড়িতে বসা পুরুষ টাকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। গলা শুঁকিয়ে কাঠ হয়।মূহুর্তে মিরা খুব পানির তৃষ্ণা অনুভব করলো। চারমাস পর মানুষ টার সামনা-সামনি দেখা পেলো।মিরা’র বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম করছে।নিজের চোখ কে বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু সত্যি টা তো আর বদলে যাবে না। সত্যি এটাই রিহান শেখ বসে আছে জিপগাড়ি টায়।দৃষ্টি তার সামনের দিকে স্থির। মুখের আদল কঠোর। চোয়াল শক্ত করে সামনে তাকিয়ে আছে। মিরা আস্তে করে শুঁকনো ঢুক গিলে। এতোদিন সাহস করে মানুষ টাকে অবহেলা তো করেছে।কিন্তু এর পরিণয় কি হতে পারে মিরা’র কেনো একবার ও মাথায় এলো না? পরক্ষণেই মিরা’র মনে হলো সে কি সব ভাবছে?এমন টা তো কথা ছিলো না।সে নিজে কে শক্ত করেছে তবে এখন কেনো ভেঙ্গে যাচ্ছে আবার?নিজের ভয় কে আড়ালে রেখে মিরা হাসার চেষ্টা করে।অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

-“আপনার না দু’বছর পর আসার কথা রিহান ভাই?”

এই প্রশ্নো টা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতোই ছিলো।রিহান এতো সময় নিজে কে শান্ত করে রেখে ছিল। কিন্তু মিরা’র এমন হেয়ালি যেন তার একদম পছন্দ হলো না।মেয়ে টা তাকে অবহেলা করছে।রিহান শেখ ইগনোর করেছে।কত বড় স্পর্ধা এই মেয়ের রিহান অবাক না হয়ে পারে না। রিহান নিজে কে যথাযথ শান্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো।কিন্তু সে যেন আজ ব্যর্থ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে চিবিয়ে চিবিয়ে ধমক দিয়ে বললো,

-“চুপ।একদম চুপ।একটা কথা বলবি না। গাড়িতে বোস।”

মিরা মৃদু কেঁপে উঠলো।চোখ পিটপিট করে এদিক-ওদিক তাকালো।শাহনাজ আপা আসে নি।মিরা বিরক্ত হলো।কেনো যে এই মহিলা এখনো আসছে না।মিরা ভেবে পায় না। মিরা অস্থির হয় পুরুষ টার মুখের দিকে তাকিয়ে।বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা অনুভব করে।তবে উপরে উপরে সে নিজে কে ঠিক সামলে নিলো। রিহান এর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-“আমি গাড়ি নিয়ে যেতে পারব রিহান ভাই। আপনি বাড়ি যান।ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে।বিশ্রাম করুন।আমরা পরে দেখা করবো।”

রিহান ক্ষেপে উঠলো।রক্ত চক্ষুে মিরা’র দিকে তাকালো। মিরা’র অন্তর আত্মা সেই মুহূর্তে দেহো ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড় হয়।
রিহান রাগে হিসহিস করছে।তার মন দেহে সব এই মূহুর্তে আগুনে জ্বলছে। যা এই মূহুর্তে মিরাকে ও জ্বালাতে চাইছে।কিন্তু রিহান বরাবর এর মতো দাঁতে দাঁত চেপে রাগ হজম করে। এই মেয়ের সাথে সে কোনো রকম উলটো পাল্টা কিছু করতে চায় না।
মিরা রিহান কে এমন চুপচাপ বসে থাকতে দেখে একবার ভাবলো চলে যাবে এখান থেকে। কিন্তু রিহান এর কথায় সেটা আর হলো না।

-“আমি ভীষণ ক্লান্ত জান।একটু শান্তি দেয়।এরপর না-হয় তোর যা শাস্তি দেওয়ার দিবি।”

মিরা’র বুক ভারী হয়ে আসে।এভাবে বলছে কেনো পুরুষ টা?মিরা’র বুঝি কষ্ট হয় না?এতো মায়া, আদুরে কথা কেনো বলে?একটু কি জোর করতে পারে না? ভালোবাসার মানুষ অভিমান করলে যে তার অভিমান বুঝতে হবে। জোর করে অভিমান ভাঙ্গাতে হয় সেটা কি এই পুরুষ জানে না? এভাবে বললে তো মায়া লাগবেই।কিন্তু জোর করলেই না ভালোবাসার প্রখরতা বুঝতে সক্ষম হবে। মিরা উঠে বসে গাড়িতে। রিহান লাল টকটকে চোখ জোড়া দিয়ে একপলক দেখে নিলো মিরা কে। পরপরই জীপগাড়ি টা স্টার্ট করে।
গাড়ি চলে শাঁই শাঁই করে। মিরা চুপ করে বসে কোণ চোখে রিহান ভাইয়ের দিকে দেখে।অদ্ভুত সুন্দর পুরুষ টা।চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।মিরা’র সেই দিন এর কথা মনে পড়ে।রিহান ভাই আবার সেই বাগানবাড়ির দিকে যাচ্ছে। মিরা’র মন মূহুর্তে ভালো হয়।কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই নিজের বাহুতে প্রবল বেগে শক্ত হাতের ধাক্কা অনুভব করে। মনে হলো যেন তার ঠিক দশ সেকেন্ড পরই নিচে পড়লো মেয়ে টা।মস্তিষ্ক কিছুই বুঝতে পারে না।কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানে কানে ভেসে এলো বিকট এক শব্দ।

#চলবে…